কয়েকদিন বেশ এক টানা আড্ডা হল। এলেন আরও বাঙালিরা। সন্ধের পর জমল গান ও কাব্য টাব্য পাঠ। তারপর একদিন সকালবেলা রমেনদা গা ঝাড়া দিয়ে বললেন, চলো, নীললোহিত, তোমায় একটা মনে রাখবার মতন জায়গা দেখিয়ে আনি।
ওঁদের দুই মেয়ে মুনু আর মোম ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারবে না। কারণ ওদের ক্লাস আছে। বেলাবেলি বেশ মিষ্টি রোদে আমরা বেরিয়ে পড়লুম, সঙ্গে কফির ফ্লাস্ক আর ফলটল। রাস্তার দু পাশে ঝুরো-ঝুরো বরফ পড়ে আছে, মাঝে-মাঝে দু’এক পশলা তুষারপাত হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি চলেছে নির্জন প্রকৃতির মধ্য দিয়ে। মাঝে-মাঝে দু-একটা ছোট গ্রাম, যা শহরও বলা যায়। এই ছোট্ট গ্রাম-শহরগুলোই যেন এক-একটা স্বাস্থ্যকর বেড়াবার জায়গা, এখানে রয়েছে বড়-বড় কয়েকটা হোটেল আর পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য লোভনীয় বিজ্ঞাপন। বড় শহরের টানটান করা জীবন থেকে বেরিয়ে এসে দু-চার দিনের জন্য এই পাহাড়ের কোলে আর জঙ্গলের পাশে কয়েকদিন কাটিয়ে যাওয়া বেশ চমৎকার ব্যাপার। কয়েক ঘন্টা মাত্র গাড়ির যাত্রা।
যেতে-যেতে রমেনদা এক সময় বললেন, এদেশে আমি কোনও জিনিসটা খুব মিস করি জানো? মনে করো খুব একটা বৃষ্টির দিন, তার মধ্যে বেরিয়ে পড়লুম, সুবর্ণরেখা কিংবা রূপনারায়ণ নদীর ধারে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান, সেখানে বসে বসে মুড়ি, তেলেভাজা আর কাঁচা লঙ্কা খেতে-খেতে বৃষ্টি দেখা। সে আনন্দ এ দেশে পাওয়ার উপায় নেই!
বুঝলুম, রমেনদার মধ্যে এখনও একটা বেশ রোমান্টিক মন রয়ে গেছে। এই ধরনের লোকরা প্রায়ই দুঃখ পায়।
নদীর ধারে ছোট্ট চায়ের দোকান নয় অবশ্য, আমরা মধ্যাহ্নভোজ সারতে ঢুকলুম বার্গার কিং-এ। ম্যাকডোনালডস এ যেমন কফি ও আলুভাজা বিখ্যাত, বার্গার কিং-এর হ্যাম বার্গারের স্বাদে ও চেহারায় বেশ বিশেষত্ব আছে। এক-একটি দোতলা হ্যামবার্গার একা খেয়ে প্রায় শেষ করা যায় না।
এই দোকানে একটা বিজ্ঞপ্তিতে দেখলুম যে কোনও কোকাকোলার ছিপিতে বিশেষ একটা চিহ্ন থাকলে আর একটি কোকাকোলা বিনামূল্যে পাওয়া যাবে। আমরা তিনটি কোকাকোলা নিয়েছিলুম, তিনটিতেই সেই চিহ্ন। নিয়ে এলুম বিনে পয়সায় তিনটে। সেগুলোর ছিপিতেও আবার সেই চিহ্ন। এ তো মহা মুশকিল। এত কোকাকোলা নিয়ে আমরা কী করব? এক সঙ্গে এত তো খাওয়া যায় না। শেষের তিনটি কোকাকোলার বোতলের ছিপি আর আমরা ভয়ে খুললুম না, সঙ্গে নিয়ে চললুম গাড়িতে।
ক্রমশ রাস্তা জনবিরল হয়ে আসছে। পাশে কোথাও ফসলের খেত, কোথাও বা জঙ্গল। এখানে জঙ্গলের মধ্যেও কিন্তু মানুষ থাকে, অবশ্য তারা জংলি নয়। এক এক সময় দেখতে পাই এই জঙ্গলের রাস্তা দিয়েই চলেছে স্কুলের বাস, মাঝে-মাঝে দাঁড়িয়ে আছে মায়েরা, তাদের বাচ্চারা বাস থেকে নেমেই ছুটে যাচ্ছে মায়ের কাছে। এক কালে এই অঞ্চলে রেড ইন্ডিয়ানদের ঘন বসতি ছিল, এখন আর একজনও চোখে পড়ে না।
আরও একটু দূর যাওয়ার পর চোখে পড়ল বু রিজ পর্বতমালা। দূর থেকে সব পাহাড়কেই দেখতে এক রকম। কিন্তু এই ব্লরিজ পর্বতমালা পৃথিবীর প্রাচীনতমদের মধ্যে একটি। এর বয়েস প্রায় একশো কোটি বছর। আমাদের হিমালয় এর তুলনায় ছেলে মানুষ। আল্পস বা অ্যান্ডিজও এর চেয়ে বয়েসে ছোট। এই পৃথিবীতে যখন কোনও জন্তুজানোয়ার ছিল না, ঝোঁপঝাড় বা বৃক্ষও জন্মায়নি, সেই আদিম যুগে এই প্রস্তুরস্তূপ দানা বেঁধেছে।
এই ব্লু রিজ পর্বতমালার গায়েই আছে বিখ্যাত শেনানডোয়াহ উপত্যকা এবং শেনানডোয়াহ ন্যাশনাল পার্ক। কিন্তু আমাদের গন্তব্য সেদিকে নয়। আমরা যাচ্ছি একটা গুহা দেখতে। গুহা বললে অবশ্য কিছুই বোঝা যায় না। লুরে ক্যাভার্ন সারা পৃথিবীর বিখ্যাত দ্রষ্টব্য স্থানগুলির অন্যতম।
বিকেল-বিকেল আমরা পৌঁছোলুম সেখানে। ওপরটা দেখলে কিছুই বোঝবার উপায় নেই। গোটাকয়েক দোকান, জিনিসপত্রের ও খাবারদাবারের। টিকিট কেটে লিফটে নামতে হয় নীচে।
রমেনদারা অনেকবার দেখেছেন বলে নীচে নামবেন না, তাঁরা ওপরেই রয়ে গেলেন। আটজনের একটা দলে আমি জায়গা পেলুম, সেই দলে রয়েছেন আর একজন বাঙালি মহিলা। আমাদের সঙ্গে রয়েছেন একজন গাইড, আমি আবার ওই বাঙালি মহিলার গাইড।
মাটির অনেক নীচের গুহায় ঘুটঘুঁটে অন্ধকার থাকবার কথা। কিন্তু কোথাও-কোথাও সেই অন্ধকার অবিকৃত রাখা রয়েছে, আবার কোথাও-কোথাও ব্যবস্থা করা হয়েছে লুকোনো আলোর। এমনই চমৎকার ব্যবস্থা যে কোথাও আলোর নগ্ন বালব বা টিউব দেখতে পাওয়া যায় না, যেন অনৈসর্গিক এক দীপ্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
প্রকৃতি দেবী চল্লিশ কোটি বছর ধরে শিল্পীর মতন খোদাই করে নির্মাণ করেছেন এই লুরে ক্যাভার্ন। মাটির অনেক নীচে যেন এক অমরাবতী। দেখতে-দেখতে বিস্ময়ে চোখ জুড়িয়ে আসে।
বারবার বাঙালি মেয়েটি আমাকে জিগ্যেস করতে লাগলেন, সত্যিই। এসব মানুষে তৈরি করেনি? এমনি-এমনি হয়েছে?
আমার তখন মনে হয়, মানুষ এখনও এত সুন্দর স্থাপত্য নির্মাণ করতে শেখেনি। যেমন আকাশের অনেক রকম রং দেখি, কোনও শিল্পীর তুলিতে আজও তো যথাযথ সেইরকম রং দেখলুম না।
পৃথিবীতে যখন বিপুল উত্থানপতন চলছিল, সেই সময় সৃষ্টি হয় এই বিশাল গুহাটি। প্রায় এক বর্গ মাইল। এর মধ্যে চাপা পড়ে গিয়েছিল কিছু জল ও বাতাস। সেই জল ও বাতাসের তুলি ও বাটালিতে তৈরি হয়েছে নানা রকম রঙের ডিজাইন এবং অনেকরকম আকার। কোথাও মনে হয় পাতা আছে একটা সিংহাসন, কোথাও উঠে গেছে বিরাট মন্দিরের মহান কারুকার্য করা থাম। নিউ ইয়র্ক শহরটিকে দূর থেকে যেরকম দেখায়, এক জায়গায় দেওয়ালে ফুটে উঠেছে অবিকল সেই রকম একটি মডেল। এক জায়গায় রয়েছে যেন সদ্য ভাজা একটা ডিমের পোচ, অবশ্য সেটা রক পাখির ডিম হতে হবে। এক জায়গা পুরোপুরি একটা গির্জার অভ্যন্তরের মতন, সেই জায়গাটির নামও দেওয়া হয়েছে ‘ক্যাথিড্রাল’। সেখানে রাখা আছে একটি অর্গান, তাতে একটু ঝংকার তুললেই গমগম করে এক অপূর্ব রাগিণীর সৃষ্টি হয়।
খানিকটা ঘুরতে-ঘুরতে শরীরে রোমাঞ্চ লাগে। মনে হয়, আমরা যেন দেবতাদের গোপন আস্তানায় হঠাৎ এসে হাজির হয়েছি। এখানে জোরে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, মনে হয়, তা হলে এর পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাবে।
মাঝে-মাঝে কাকচক্ষু জল জমে আছে। তার মধ্যে পড়ে আছে প্রচুর পয়সা। এদেশের লোকরা পবিত্র জল দেখলে মানত করে পয়সা দেয়, আমাদের দেশে যেরকম লোকে গঙ্গায় পয়সা ছুঁড়ে দেয়। এক-এক জায়গায় দেখলুম, খুচরো পয়সায় প্রায় দশ বারো-হাজার টাকা হবে। নীচু হয়ে হাত বাড়ালেই সে পয়সা তুলে আনা যায়। কিন্তু কেউ নেয় না। আমাদের মহিলা গাইডটি বললেন, বছরের শেষে এরকম প্রায় সত্তর-আশি হাজার ডলার পাওয়া যায়, সে টাকা দিয়ে দেওয়া হয় কোনও অনাথ আশ্রমকে।
যদিও একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান প্রথমে এই গুহাটি ‘আবিষ্কার’ করে এবং এখন তারাই এটা পরিচালনা করছে, তবু এই বিস্ময়কর গুহাটির অস্তিত্ব জানা ছিল রেড ইন্ডিয়ানদের। এর মধ্যে একটি রেড ইন্ডিয়ান কিশোরের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। দূর অতীতে কোনও একদিন সে এই গুহায় ঢুকে পথ হারিয়ে ফেলেছিল।
আর একটি জায়গায় পাওয়া গেছে কিছু পোড়া কাঠকয়লা ও জন্তুর হাড়। সম্ভবত রেড ইন্ডিয়ানদের একটি ছোট দল এখানে লুকিয়ে ছিল এক সময়, তারা রান্নাবান্না করে খেয়েছে।
এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের লোকেরা দৈবাৎ দেখতে পায় যে এক জায়গায় মাটি খুঁড়ে ঠান্ডা হাওয়া বেরুচ্ছে। তখন জায়গাটি অনেকখানি খুঁড়ে ফেলে তারা দেখতে পায় তাদের স্বপ্নের অতীত এক বিশাল প্রাকৃতিক রাজপ্রাসাদ। এখানকার বাতাস এতই ঠান্ডা যে সেই বাতাস নিয়ে সে যুগে প্রথম এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা চালাবার চেষ্টা হয়েছিল।
এখনও লুরে ক্যাভার্নের পরিচালনা সেই ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের হাতেই এবং তারা লাভও করে নিশ্চয়ই। কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তারা এই অতল গুহায় কোনও রেস্তোরাঁ বসায়নি। বিরাট চিকারের গানবাজনার ব্যবস্থা করেনি এবং প্রকৃতির ওপর খোদকারি করে আরও সুন্দর করবার চেষ্টা করেনি। তারা পুরো জায়গাটিকে নিখুঁত অবিকল রাখার ব্যবস্থা করেছে।
আমাদের দেশে এরকম সুবৃহৎ কিংবা অপূর্ব সৌন্দর্যময় গুহা কোথাও আছে কি না আমি জানি না। হয়তো এখনও সেরকম আবিষ্কৃত হয়নি। তবে ছোট আকারের যেগুলি আছে, সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থার কথা ভাবলেই হৃৎকম্প হয়। মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারিতে আমি এর থেকে অনেক ছোট হলেও একটা চমৎকার গুহা দেখেছিলুম। আমাদের দেশের যে-কোনও প্রাকৃতিক বিস্ময়কর জায়গাতেই তো একটা মন্দির বানিয়ে তোলা হবেই। আর মন্দির মানেই নোংরা আবর্জনা, দুর্গন্ধ। ওই পাঁচমারিতেই এক জায়গায় পাথরের বুকে রোদবৃষ্টি বাতাসের ভাস্কর্যে একটি মহাদেবের ছবির আদল ফুটে উঠেছিল। এরকম একটা জিনিসকে যেমন আছে ঠিক তেমনটি রাখলেই যে সৌন্দর্য খোলে, সেটা অনেকেই বোঝে না। সেই মহাদেব মূর্তিটির গায়ে বিকট হলুদ আর নীল রং বুলিয়ে দিয়েছে কেউ, মাথায় আবার একটা সাপ এঁকে দিয়েছে। ফলে, সেটার দিকে আর তাকানোই যায় না।
লুরে ক্যাভার্নের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরলেও ক্লান্তি লাগে না। গাইডের কাছ ছাড়া হয়ে পথ হারিয়ে ফেললে খুবই বিপদের সম্ভাবনা। এক-একবার আমার লোভ হচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যাই। তারপর বহুঁকাল পরে সেই রেড ইন্ডিয়ান কিশোরটির মতন এই ভারতীয়টিরও হাড়গোড় অন্যরা খুঁজে পাবে।
তা অবশ্য হল না, ওপরে উঠে এলুম যথা সময়ে।
বাড়ি ফিরলুম ঘোর সন্ধের পর। একটু পরেই টেলিফোন বেজে উঠল। রমেনদা ধরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমায় ডাকছে।
আবার বিস্ময়। টেলিফোন করছে কামাল। নিউ ইয়র্কের কাছে স্কারসডেলে ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল একদিন। কামালের জানার কথা নয় যে আমি এখানে এসেছি। এসে কার বাড়িতে উঠেছি তা তো কেউ জানে না। তবু কোন মন্ত্রবলে কামাল ঠিক এখানে টেলিফোন করেছে।
কামাল বলল, একি, তুমি নিউ ইয়র্ক থেকে বস্টনে না এসেই ওয়াশিংটন ডি সি-তে চলে গেলে যে? ওটা তো উলটো দিকে? না, না, ওসব চলবে না। শিগগির বস্টনে চলে এসো। কালই–