[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

৪৩. ভগবানের বেশ জনপ্রিয়তা

এদেশে এখনও ভগবানের বেশ জনপ্রিয়তা আছে। ভগবানের তল্পিবাহকরাও বেশ জোরদার। টিভি-তে প্রত্যেক রবিবার সকালে যে-কোনও চ্যানেল খুললেই শোনা যায় পাদরিদের বক্তৃতা। আজকাল আর অনেকেই কষ্ট করে রবিবার সকালে গিরজায় যেতে চায় না, তাই টিভি-তেই শোনানো হয় পাদরিদের সারমন।

সকাল মানে অবশ্য সাড়ে ন’টা-দশটা। শনিবার রাত্তিরে পার্টি সেরে রবিবার এর চেয়ে আগে কেউ ঘুম থেকে উঠবে না। ভোরে ওঠে বাচ্চারা। তাই ভোর থেকে শুরু হয় ছোটদের জন্য চমক্কার সব মনোহারী অনুষ্ঠান। তারপর একটু বেলা হলে বাচ্চারা টিভি ছেড়ে যখন খেলতে যাবে, বাবা-মায়েরা বিছানায় শুয়ে দিনের প্রথম কাপ চা বা কফিতে চুমুক দিয়ে সবে মাত্র টিভি-র দিকে তাকাবে, অমনি চোখের সামনে ভেসে উঠবে পাদরিদের মুখ।

পাদরিদের বক্তৃতা সাধারণত অন্তহীন হয়। গল্পে আছে, এক পাদরি তার সুদীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করার পর বলেছিলেন, দুঃখিত, আমার হাতে ঘড়ি নেই, তাই বুঝতে পারিনি এতটা সময় কেটে গেছে। তখন শ্রোতাদের একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, দেওয়ালে তো ক্যালেন্ডার রয়েছে, সেটাও দেখেননি?

টিভি-র মতন চাক্ষুষ-মাধ্যমে লম্বা বক্তৃতা সাধারণত দেখানো হয় না। কিন্তু পাদরিদের বক্তৃতা চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিটের কম হবে, এ তো ভাবাই যায় না। সেই জন্য টিভি-র পাদরিরা সকলেই অত্যন্ত জবরদস্ত বক্তা, কথার মায়াজাল বোনায় দক্ষতা অসাধারণ এবং উচ্চাঙ্গের অভিনেতাদের মতন তাঁদের কণ্ঠস্বরও নাটকীয়ভাবে ওঠে-নামে।

আমি নিজেই টিভি-তে এরকম দু-একজন পাদরির বক্তৃতা একটুখানি শোনবার পরই মন্ত্রমুগ্ধের মতন আটকে গেছি। চোখ সরাতে পারিনি। বক্তৃতার মধ্যে ধর্মের নাম গন্ধও নেই, বিষয়বস্তু হচ্ছে বিশ্বশান্তি। ইতিহাস ও সাহিত্য থেকে অজস্র উদাহরণ টেনে আনছেন তিনি, পৃথিবী যে এক অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে তাও মর্মন্তুদভাবে বুঝিয়ে দিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁর সার কথা, ভগবান যিশুর শরণ নিলে এইসব সমস্যাই মিটে যাবে, এমনকী অ্যাটম বোমাও ব্যর্থ হতে বাধ্য। এ যেন নদীর ঢেউ দেখাতে-দেখাতে সটকে শেখানো।

ভগবানের সঙ্গে ডারউইন সাহেবেরও নতুন করে ঝগড়া লেগেছে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ ধর্মীয় সৃষ্টিতত্বের একেবারে গোড়ায় কোপ বসিয়ে দিয়েছে গত শতাব্দীতে। ডারউইনের মৃত্যু শতবার্ষিকীর বছরে বাইবেলপন্থীরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছেন। তাঁদের দাবি, যেসব স্কুল কলেজে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ানো হয়, সেখানে বাইবেলের সৃষ্টিতত্বও পড়াতে হবে। যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা দুটো দিকই যাচাই করতে পারে। অনেক স্টেটে এই নিয়ে মামলা হয়েছে, টিভি-তেও এর প্রচার খুব জোরদার। আশ্চর্যের ব্যাপার এই, এই প্রচারে কয়েকজন বৈজ্ঞানিককেও দেখা যায়। তাঁদের বক্তব্য, ডারউইনের মতবাদ অকাট্য নয়, সুতরাং ধর্মীয় তত্বই বা অগ্রাহ্য করা হবে কেন?

বিজ্ঞানের ডিগ্রি থাকলেই বৈজ্ঞানিক হওয়া যায় না। বাইবেলের সৃষ্টিতত্ব যদি কারুর ঠিক খেয়াল না থাকে, তবে আমি একটু মনে করিয়ে দিচ্ছি। পশু-পাখি, তরু-লতাসমেত সব কিছু এবং মানুষকে ভগবান আস্ত-আস্ত ভাবে সৃষ্টি করেছেন মাত্র ছ’দিনে। সপ্তম শতাব্দীর এক আর্চ বিশপ বাইবেল থেকে হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে, ভগবানের এই সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন হয়েছিল ঠিক খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার চার সালে। সপ্তদশ শতাব্দীতে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ জন লাইটফুট এই হিসেবটি আরও নিখুঁত করেছিলেন। তাঁর মতে প্রথম মানুষের জন্ম হয়েছিল ঠিক খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার চার বছরের তেইশে অক্টোবর সকাল নটার সময়। অর্থাৎ মানুষের ইতিহাস মাত্র ছ-হাজার বছরের। সুসভ্য, সুশিক্ষিত, ইংরেজি-জানা ভদ্রলোকেরা এখনও যে এই মতের সমর্থনে বক্তৃতা করতে পারে, তা নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাসই করতুম না আমি। ঈশ্বর বিশ্বাস যে মূককেও বাচাল করে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

প্রায় চব্বিশ ঘন্টা ধরেই টিভি চলে, তার মধ্যে অন্তত এই ধরনের ধর্মীয় প্রচার খুব সামান্য সময় জুড়ে থাকে। তবে যেটুকু সময় নেয়, তা খুব দামি সময়, অর্থাৎ যে-সময় সকলেই টিভি খোলে। এখানকার টিভি-র সিংহভাগ জুড়ে থাকে খেলা। তাও বিশেষ একটি খেলায় যে-খেলার নাম ফুটবল বটে, কিন্তু আমরা যাকে ফুটবল বলে জানি, তা নয়। এই ফুটবল খেলায় পায়ের থেকে হাতের ব্যবহার বেশি, খেলোয়াড়দের শরীরে থাকে বর্ম, মুখে লোহার মুখোশ। বিদেশিদের পক্ষে এ খেলার রস পাওয়া শক্ত। আমি কয়েকবার স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে গেছি, কিন্তু নিয়মকানুন ঠিক মাথায় ঢোকেনি। সারা মাঠে যখন দারুণ উত্তেজনা, দর্শকরা উত্তাল, আমি তখন বরফের মতন শীতল ও স্থির।

আমেরিকান টিভি’র সঙ্গে সরকারের কোনও সংস্রব নেই। প্রধান তিনটি জাতীয় নেটওয়ার্ক হল আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, সেন্ট্রাল ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন আর ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন-এরা নানা রকম অনুষ্ঠান বানায়। আর আছে অসংখ্য স্থানীয় অনুষ্ঠান। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি বালুরঘাট কিংবা ঘাটাল কিংবা চুঁচুড়োয় থাকেন। এরকম প্রত্যেক জায়গাতেই আছে নিজস্ব টিভি কেন্দ্র। অর্থাৎ চুঁচুড়োয় বসে আপনার টিভি-তে আপনি উঁচুড়োর আশে পাশের ঘটনা অনর্গল দেখতে পাবেন। সেই সঙ্গে জাতীয় অনুষ্ঠানও দেখবেন। বালুরঘাটের বাসিন্দা টিভি-তে দেখবেন বালুরঘাটের নানা অনুষ্ঠান, সেই সঙ্গে জাতীয় অনুষ্ঠান। ছোটখাটো জায়গায় স্থানীয় অনুষ্ঠানেরই প্রাধান্য। আমেরিকানরা বিশ্বপ্রেমিক যত না, তার চেয়ে বেশি অঞ্চল-প্রেমিক। ওখানকার স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ভূগোল ক্লাসে পৃথিবীর মানচিত্রের আগে পাড়ার মানচিত্র আঁকতে শেখে।

তিনটি জাতীয় নেটওয়ার্কের মধ্যে প্রতিযোগিতা আসে কে কত চিত্তাকর্ষক অনুষ্ঠান করতে পারে। সরকারি ব্যাপার তো নয়। সব কিছুই ব্যাবসায়-ভিত্তিক। স্থানীয় কেন্দ্রগুলো কার কাছ থেকে কোন অনুষ্ঠান কিনবে তার ওপর নির্ভর করে ওদের ক্ষতি বৃদ্ধি। এই রকম প্রতিযোগিতা আছে বলেই অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্যের শেষ নেই।

এই সব অনুষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা সোপ অপেরার। সংক্ষেপে সোপ। অভিধানে এখনো সোপ-এর অর্থ সাবান হলেও এখানকার খবরের কাগজে ‘সোপ’ শব্দে একরকম টিভি’র নাটক বোঝায়, যার সঙ্গে অপেরার কোনও সম্পর্ক নেই। সাবানেরও কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এগুলো হচ্ছে টিভি-র ধারাবাহিক নাটক, এর কোনও শেষ নেই। এর কাহিনির কোনও মাথামুণ্ডু নেই, নতুন-নতুন চরিত্র আর ঘটনা এনে বছরের পর বছর ধরে চলে। এই সব নাটক কিন্তু সপ্তাহে একদিন নয়, প্রত্যেকদিন। রবিবার বা বিশেষ ছুটির দিন বাদে। এবং প্রত্যেকদিন এরকম ধারাবাহিক নাটক মাত্র একখানা নয়, অন্তত পাঁচ খানা। তাহলে কী বিপুল লোকলশকর আর উদ্যম লাগে এগুলো তৈরি করতে, ভাবতে গেলে থ হয়ে যেতে হয়। খোদ আমেরিকায় এই সব সোপ অপেরা সিনেমার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়। এক সময় সাবান কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করে এই সব নাটক শুরু হয়েছিল বলেই সোপ নামটি চালু হয়ে গেছে। এখন অবশ্য অন্য সব বিজ্ঞাপনদাতাই এরকম ধারাবাহিক, প্যাঁচপেচে সেন্টিমেন্টাল, কিছুটা রহস্য মেশানো নাটক বানায়। ইদানীং এইসব নাটকের মধ্যে ‘ডালাস’ জনপ্রিয়তার শীর্ষে।

এখানকার ঘরে বসে বসে টিভি দেখাই আমার একমাত্র কাজ। এ শহরে আমার চেনা কেউ নেই, সুতরাং কোথাও ঘুরে বেড়াবার প্রশ্ন নেই। গাড়ি না থাকলে এই শীতে পথে ঘোরাঘুরির প্রশ্ন ওঠে না। সুতরাং টিভি-তেই আমি বিশ্বদর্শন করতে চাইলাম। অবশ্য আমেরিকান টিভি-তে বিশ্বদর্শন খুব সহজসাধ্য নয়। এরা নিজেদের নিয়ে বড় বেশি মগ্ন। এমনকী যাকে এরা বলে ‘বিশ্ব সংবাদ’ তাতেও পৃথিবীর যে-সব দেশ বা ঘটনায় আমেরিকান স্বার্থ জড়িত, শুধু সে সবই দেখাবে। এদের বিশ্ব সংবাদ দেখলে মনে হয় পৃথিবীতে ভারতবর্ষ নামে কোনও দেশ নেই। আর চিন নামে হঠাৎ একটা নতুন দেশ গজিয়ে উঠেছে। খবরেরও মাঝে-মাঝে থাকে বিজ্ঞাপন। আরব দেশে প্রচণ্ড একটি বোমার বিস্ফোরণের পরই কাট। তিন চারটি ছেলে-মেয়ে নাচতে নাচতে একরকম মাখনের জয়গান গেয়ে গেল। তারপরই আবার যুদ্ধের দৃশ্য।

বিজ্ঞাপনের দৃশ্য থেকেও অবশ্য একটা দেশের রুচির অনেকটা পরিচয় পাওয়া যায়। আমেরিকানদের আমরা গরু ও শুয়োরখোর জাতি বলে জানি। কিন্তু ইদানীং নানা বিজ্ঞাপনে গোমাংস ও শূকর মাংসের বিরুদ্ধে প্রচার চলছে। তার মানে এরা ভারতীয় জীবনযাত্রার মান আদর্শ মনে করছে তা নয়। শারীরিক পরিশ্রম নেই বলে ব্লাডপ্রেসার ও কোলস্টোরল ভীতি এদের সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। এতকাল এদেশে মুরগি ছিল গরিবের খাদ্য ও অবজ্ঞার বস্তু, এখন রব উঠেছে মুরগি খাও, মাছ খাও, সবুজ শাকসবজি খাও! হেলথ ফুড নামে নিছক নিরামিষ খাদ্যের দোকানও চলছে খুব। আর এসেছে বিকল্পের যুগ। বেশি কফি খেলে নাকি ক্ষতি হয়, তাই কফির বদলে ডি-ক্যাফিনেটেড কফি। সে বস্তু আমি দু-একবার খেয়ে দেখেছি, অতি অখাদ্য। ভাগ্যিস চায়ের বিকল্প ওরা এখনও তৈরি করেনি। সেই রকম, মাখনের বদলে মার্জারিন, সিগারেটের বদলে তামাকহীন সিগারেট। অ্যালকোহল বর্জিত বিয়ার। মদের বিজ্ঞাপন তো চোখেই পড়ে না, তার বদলে দেখা যায় দুধের বিজ্ঞাপন। একটা ছবি প্রায়ই দেখায়, ধপধপে সাদা একটা দুধের নদী বয়ে চলেছে। সে দৃশ্য দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মজা লেগেছিল একটা কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেখে। মার্কিনদেশে এখন ছাত্রছাত্রীদের বাধ্যতামূলক সমর শিক্ষা নেই, অনেক ছেলেমেয়েই আজকাল আর সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহী নয়। সেইজন্য সরকার থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় লোভনীয় শর্তে ছেলেমেয়েদের সৈন্যবাহিনীতে আকৃষ্ট করবার জন্য। গান গেয়ে গেয়ে বলা হয়, এসো, এসো যোগ দাও, কত ভালো মাইনে, কত ভালো খাবার, কত সুন্দর পরিবেশ ইত্যাদি। ইত্যাদি। দুর্ধর্ষ আমেরিকান টমির যে চিত্র অনেকের মনে আঁকা আছে, তার সঙ্গে কি এই। বিজ্ঞাপন একটুও মেলে?

টিভি বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে অশ্লীল দিক হল টাকার ঝনঝনানি। সারাদিন ধরে যে কতবার টাকা কথাটা উচ্চারিত হয় তার ঠিক নেই, টাকা পাইয়ে দেওয়ার কতরকম প্রলোভন, এমনকী সত্যি-সত্যি টাকা হাতে গুঁজে দেওয়ার দৃশ্যও দেখা যাবে দিনের মধ্যে পাঁচ সাতবার। কত সামান্য কারণে লোকে হাজার-হাজার টাকা পেয়ে যায়। বড়-বড় কোম্পানিগুলো নির্বাচিত দর্শকদের সামনে ধাঁধা প্রতিযোগিতা চালায়।

আমেরিকান টিভি কিন্তু সব মিলিয়ে বেশ নীতিবাগিশ। মরাল মেজরিটির চাপেই হোক বা যে কারণেই হোক, যৌন দৃশ্য টিভি-তে একেবারে নিষিদ্ধ। সাধারণ অনুষ্ঠানে তো বটেই এমনকী কোনও বিজ্ঞাপনচিত্রেও নগ্নতা কিংবা নারীর উন্মুক্ত বক্ষদেশ দেখানো হয় না। তবে চুম্বন যেহেতু চা-জলখাবারের মতন, তাই সেই দৃশ্য দেখা যায় মুহুর্মুহু। সোপ অপেরায় প্রতি পাঁচ মিনিটে একটি করে দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন দৃশ্য থাকবেই। আর নগ্নতার পরিবর্তে যা দেখানো হয়, তাও বেশ বিরক্তিকর। একই রকম স্বল্পবাস ঝাঁক-ঝাঁক মেয়ে, যাদের ঠিক মানুষ মনে হয় না। মনে হয় পুতুল। টিভি-তে যেসব সিনেমা দেখানো হয় তাও নিরামিষ ধরনের। অবশ্য কেবল কানেকশন নামে আর একটি ব্যাপার আছে। যাতে একটি চ্যানেলে চব্বিশ ঘণ্টাই একটার পর একটা সিনেমা দেখা যায়, তাতে সব রকম ফিলমই থাকে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী ফিলম দেখানো হয় বেশি রাত্রে। কানাডার টিভি-তে এই ব্যাপারটি আরও মজার। সেখানকার অনুষ্ঠান ইংরেজি এবং ফরাসি এই দুই ভাষায় হয়, এর মধ্যে ইংরেজি অনুষ্ঠান যৌন দৃশ্য বিরহিত, কিন্তু ফরাসি অনুষ্ঠানে সবই চলে।

সিরিয়াস ধরনের অনুষ্ঠানও কিছু কিছু থাকে এবং সেগুলি খুবই সুচিন্তিত। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ডেকে এনে নানান বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা। শুধু বক্তৃতা নয়, অজস্র উদাহরণ ছবি সমেত। এ দেশটার একটা গুণ স্বীকার করতেই হবে। আমেরিকায় বসে আমেরিকাকে যত খুশি গালাগালি দেওয়া যায়। এদেশের প্রেসিডেন্ট কিংবা শাসক দল সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা টিভি-তে শোনা যায় অহরহ। সাধারণ মানুষকে ইন্টারভিউ করেও এক-একজন খুব নাম করে ফেলে। যেমন ডনেহু-র টকশো খুব জনপ্রিয়। তবে এইসব গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাঝখানেও এমনই ঘনঘন বিজ্ঞাপনের বাহুল্য থাকে যে সুর কেটে যায়। আসলে, বিজ্ঞাপনের মাঝখানের জায়গাগুলো ভরাট করার জন্যই যেন অন্য অনুষ্ঠান।

তবে এইসব বিজ্ঞাপনদাতাদের একটা গুণ আছে। ছোটদের অনুষ্ঠানের মাঝখানে শুধু ছোটদের ব্যবহার্য জিনিসের বিজ্ঞাপন এবং সেগুলো এমনই সুন্দর ও মজাদার, যে সেগুলোও আলাদাভাবে দর্শনীয়। এখানকার টিভি-তে ছোটদের অনুষ্ঠানগুলির কোনও তুলনা নেই। এর মধ্যে মাপেট শো তো জগৎবিখ্যাত এবং ছোটবড় সকলের প্রিয়।

ব্যাবসায়িক টিভি-র পাশাপাশি একটি চ্যানেলে সম্পূর্ণ অব্যাবসায়িক অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। এর নাম পাবলিক ব্রডকাস্টিং সিস্টেম। এতে একটাও বিজ্ঞাপন নেই এবং নিছক স্কুল রুচি বা ভাঁড়ামোর কোনও অনুষ্ঠানও এতে থাকে না, জাঙিয়া পরা পুতুল মেয়েদের নাচও নেই। এই অনুষ্ঠানগুলি চলে বিভিন্ন কোম্পানির চাঁদায়, তাদের নাম উল্লেখ থাকে শুধু। অনেক বিদেশি অনুষ্ঠানও এরা ধার করে কিংবা কিনে আনে। এই চ্যানেলেই মাঝে-মাঝে দেখা যায় ভারতীয় চলচ্চিত্র। মহাকাশ বিষয়ে কার্ল সেগানের ‘কসমস’ নামে বিখ্যাত অনুষ্ঠানটিও দেখা যায় এই চ্যানেলেই। ক্লাসিক সাহিত্যের চিত্ররূপও প্রায়ই দেখানো হয়। তবু পাবলিকব্রডকাস্টিং সিস্টেম এর অনেক অনুষ্ঠান দেখাবার পর একঘেয়ে লাগতে শুরু করে। মনে হয় যেন বড্ড বেশি জ্ঞানের কথা বলছে।

এবং এতগুলো চ্যানেল, এত অনুষ্ঠান বৈচিত্র্য, এত সিনেমা সত্বেও কোনও এক সময় টিভি-র নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়েও কোনও একটা অনুষ্ঠানও মনঃপূত হয় না। তখন ইচ্ছে করে টিভি বাক্সটাকে জোরে একটা লাথি কষাই। এই জন্যই একটি টিভি প্রস্তুতকারক কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, উই অফার কিক-প্রফ সেটস।