পরিব্রাজক, তুমি কোথায়?
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসে একজন বুড়ো মানুষের চরিত্র ছিল, যে-লোকটি নদিয়া আর যশোহর জেলার সীমান্তে একটি গাছের নীচে এসে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। দুটো আলাদা জেলা ওখানে মিশেছে, সেই বিশেষ রেখার ওপর দাঁড়াবার উপলব্ধি ওই বৃদ্ধকে আত্মহারা করে। বৃদ্ধ জীবনে অমন আনন্দ খুব কম পেয়েছেন।
অথচ কিছুই তো না, দুটো জেলার আলাদা সীমারেখা তো নেহাত খাতাপত্রে অথবা চালের কর্ডনিং-এর সময় পুলিশের পাহারায়, এ ছাড়া আর কী এমন আলাদা? তবু ওই বৃদ্ধ, প্রগাঢ় প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে, সংসারের সব দায়িত্ব ঠিক ঠিক ভাবে মিটিয়ে পদব্রজে ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। এ গ্রাম ও গ্রাম, এক জেলা থেকে আরেক জেলা–এতেই তিনি পেয়েছিলেন অপরিসীম আনন্দ, বৈচিত্র্যের পরমাকাঙ্ক্ষিত সুস্বাদ। বিভূতিভূষণের সেই বৃদ্ধটিকে আমি ছেলেবেলা থেকে ভালোবাসি।
নাম মনে নেই, একটি মার্কিন উপন্যাসে পড়েছিলুম, ট্রিলিং নামের একজন বিপত্নীক চাষির সংসারে সবচেয়ে প্রিয় ছিল তার কালো-ধূসর ঘোড়াটি। বিয়ের পর তার বউয়ের বাবা ওই ঘোড়াটি তাকে দিয়েছিল। বিয়ের ছ’মাস বাদেই ট্রিলিংয়ের বউ মরে যায়, তখন থেকে ওই ঘোড়াটিই ছিল তার একমাত্র সচিবসখা। সকালবেলা ঘোড়াটা এসে ট্রিলিংয়ের মুখের ওপর গরম নিশ্বাস ফেলে তার ঘুম ভাঙাত। বিকেলবেলা সেই ঘোড়ার পিঠে চেপে সূর্যাস্তের শোভা দেখত ট্রিলিং। রাত্রিবেলা চাঁদের আলোয় হেলান দিয়ে স্যাক্সোফোন বাজিয়ে যখন গান করত সে, তখনও একমাত্র শ্রোতা সেই ঘোড়া। এইরকমভাবে আট বছর কাটার পর একদিন ট্রিলিং-এর খুব জ্বর হয়েছে, ঘোড়াটা বিশ্বস্ত নার্সের মতন মাথার কাছে বসে থেকে বড়-বড় নিশ্বাস ফেলে ট্রিলিংকে বাতাস দিয়েছে, তারপর বিকেলের দিকে একটু বেরিয়েছে নিজের ক্ষুধার অন্ন জোগাড় করতে। একটু পরেই একটা বন্দুকের শব্দ, আশঙ্কায় টলতে টলতে বেরিয়ে এসে ট্রিলিং দেখল–তার বাড়ি থেকে অদূরেই মাঠের মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে ঘোড়াটা। ট্রিলিং যখন তার কাছে পৌঁছল তখনও সে মরেনি, বিশাল দুটি চোখ মেলে ট্রিলিং-এর দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে সে মরে গেল।
ট্রিলিং কখনও জানতে পারেনি কে বা কেন তার ঘোড়াটাকে মারল। হয়তো কোনও প্রতিবেশী র্যা ঞ্চার কিংবা কোনও আইটল, নেহাত কৌতুকের বশেই তাক পরীক্ষার জন্য গুলি ছুঁড়েছে। কিংবা অন্য কিছু, ট্রিলিং ভাবতেও পারে না। ট্রিলিং লোকটা ছিল নিরীহ ধরনের, প্রতিশোধ বা আততায়ীকে খোঁজার চেষ্টা ছেড়ে পরদিন সে তার বাড়ি জমি বিক্রি করে দিয়ে ক্যানসাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। এই প্রথম সে তার জন্মস্থান ছেড়ে বাইরে যায়। ট্রিলিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল, যে-দিকে দু-চোখ যায়, সেদিকেই হাঁটতে থাকবে, কোথাও থামবে না, যতদিন না সে লিটল রকির মতন ঠিক ওই রকম আর একটি কালো ধূসর ঘোড়া খুঁজে পায়।
হাঁটতে-হাঁটতে বহু মাস বছর কেটে যায়, ট্রিলিংয়ের টাকা পয়সা ফুরিয়েছে ইতিমধ্যে, এখন সে স্যাক্সোফোন বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রাসাচ্ছাদন জোগাড় করে, ঘোড়া খোঁজার কথা আর ট্রিলিংয়ের মনে নেই, এক একটা প্রদেশ সে পায়ে হেঁটে পেরুচ্ছে, দেখছে প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সমারোহ, নানা ধরনের মানুষ, নানা ধরনের সুখ-দুঃখ। সে নিজে ছিল চাষা, সল্ট লেকে এসে দেখল সেখানে নুনের মরুভূমি। নেভাডা যাওয়ার পথে, যতদূরে চোখ যায় ধূ-ধূ করছে জমি, কিন্তু সেখানে মাটিও নয়, বালিও নয়, গুঁড়ো-গুঁড়ো নুন। ট্রিলিং অভিভূত হয়ে ভাবল, পৃথিবীতে এমনও আছে বাড়ি থেকে না বেরুলে তো জানতে পারতুম না! গ্র্যান্ড কেনিয়নের প্রপাতের সামনে সে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বহুক্ষণ, তারপর টুপি খুলে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলেছিল, ঈশ্বর, তুমি আমায় মনুষ্যজন্ম দিয়ে ধন্য করেছ। এইভাবে ঘুরতে-ঘুরতে ট্রিলিং একদিন এসে পৌঁছল টেকসাসে, সেটা তো ঘোড়ারই রাজ্য। দেখল, সেখানে তার লিটল রকির মতন হুবহু কালো-ধূসর রঙের ঘোড়া অনেকগুলো। লিটল রকির জন্য তার বুক মুচড়ে উঠল পুরোনো কালের মতন। ট্রিলিং-এর টাকাপয়সা সব ফুরিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার বুকের ক্রুশ চিহ্নটা ছিল সোনার, সেটাকে বিক্রি করে দিয়ে সে কালো-ধূসর একটা ঘোড়া কিনল। সেই ঘোড়াটার আকৃতি, হাব-ভাব সবই লিটল রকির মতন, অল্পক্ষণেই ট্রিলিং-এর সঙ্গে তার বেশ ভাব হয়ে গেল, কিন্তু ট্রিলিং দেখল, ঘোড়ার পিঠে চড়ে তার আর ভালো লাগছে না, হেঁটে হেঁটে ভ্রমণ করাই তার অভ্যেস হয়ে গেছে। ঘোড়া বড় তাড়াতাড়িই যায়। তখন ট্রিলিং ঘোড়াটাকে পাশে নিয়ে হেঁটে হেঁটেই ভ্রমণ শুরু করল, ঘোড়াটা যেন তার বাহন নয়, বন্ধু। ঘুরতে-ঘুরতে ট্রিলিং এসে পৌঁছল প্রশান্ত মহাসাগরের পারে। এর আগে সে সমুদ্র দেখেনি। বন্দরের একদল মানুষের মুখে শুনল, তারা ব্রাজিল যাচ্ছে, ব্রাজিল এক অদ্ভুত, অন্যরকম দেশ। শুনেই, ব্রাজিলে ভ্রমণ করার ইচ্ছে তীব্র হয়ে উঠল ট্রিলিং-এর মধ্যে। কিন্তু কী করে যাবে? ঘোড়াটা তার আগের লিটল রকির মতই এখন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু ঘোড়াটা আগের মতন, ট্রিলিং যে এখন অন্যরকম। শেষ পর্যন্ত অত আদরের ঘোড়াটিকেও ট্রিলিং বিক্রি করে দিল, ব্রাজিলে যাওয়ার টিকিট কাটার জন্য।
বইটির লেখকের কথা আমার মনে নেই, কিন্তু ট্রিলিং-এর চরিত্র আমার দীর্ঘকাল ধরে মনে আছে।
সুদূর আফ্রিকা থেকে ইবন বতুতা এসেছিলেন বাংলা দেশে। সাতগাঁয়ের পথ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে তিনি অবাক। এ কোন দেশ, এর যেখানে সেখানে নদী, নদী ভরা নৌকো, নৌকোগুলি পরস্পরকে অতিক্রম করার সময় ডংকা বাজায়, গানের মতন সুরেলা ভাষায় কথা বলে এর জনপদের মানুষ। কী গাঢ় সবুজ এখানকার গাছপালা, লেবুর গন্ধ ভরা এখানকার বাতাস। এরকম দেশও পৃথিবীতে আছে, যেখানে জীবন যাপনের জন্য প্রায় পয়সা খরচ করতে হয় না বললেই চলে? ইবন বতুতা লিখেছেন–তখন মোট তিনজনের পুরো এক বছরের খাবার খরচ লাগত সর্বসমেত সাত টাকা। এখানে এক মণ ঘিয়ের দাম এক টাকা সাত আনা, এক মণ চালের দাম সাত পয়সা। একটি দুগ্ধবতী গরুর দাম তিন টাকা, একটি নারীর দাম দশ টাকা। ইবন বতুতা নিজের জন্য দশ টাকা দিয়ে আসুরা নামের একটি পরমা রূপসি মেয়েকে কিনলেন, ওঁর সঙ্গী কিনলেন লুলু নামের একটি ক্রীতদাস, কুড়ি টাকায়। এত দেশ ঘুরে ইবন বতুতার ভ্রমণ সার্থক। সময়, চতুর্দশ শতাব্দী, তখনকার সস্তা বাজারের জন্য আমার কৌতূহল নয়, ভাবতে অবাক লেগেছিল সেই আফ্রিকা থেকে একজন পর্যটক এসেছিলেন এতদূরের বাংলা দেশে। অধিকাংশ পথ পায়ে হেঁটে।
শ্রীহট্টের একজন ফকিরকে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল ইবন বতুতার। ফকিরের নাম শেখ জালালুদ্দিন, শ্রীহট্টের কাছে এক পাহাড়ে তার বাস। ফকিরের দীর্ঘ শীর্ণ দেহ, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে থেকে তপস্যা, করেন, কিছু না খেয়ে, এই রকম দশ দিন, তারপর একাদশ দিনের দিন সামান্য দুধ খেয়ে উপবাস ভঙ্গ। ফকির অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন, তিনি হাওয়ায় উড়তে পারেন, তিনি প্রত্যেকদিন ভোরবেলা অদৃশ্য হয়ে হাওয়ায় উড়ে গিয়ে শ্রীহট্ট থেকে চলে যেতেন মক্কায়, সেখানে নমাজ সেরে আবার সূর্যোদয়ের সময় ফিরে আসতেন। ইবন বতুতা নিজে শ্রীহট্টে পৌঁছে ফকিরের গুহায় আশ্রয় নিলেন এবং ওই অলৌকিক ব্যাপার প্রত্যক্ষ করলেন।
‘অনেকক্ষণ অনাবৃত পদে পাষাণময় বন্ধুর পথে বিচরণ করিতে করিতে পা ক্ষতবিক্ষত হইয়াছিল। এখন শুষ্কপ্রায় কর্দমের উপর দিয়া চলিতে বেশ আরাম বোধ হইতে লাগিল।’ পথ কোথাও রুক্ষ কঠিন, কোথাও নরম মসৃণ, তাতেই যা কখনও কষ্ট, কখনও আরাম। নিজে আরামের ব্যবস্থা করার কোনও চেষ্টাই নেই, কেন না, বিশেষ লক্ষণীয়, লেখকের খালি পা। শরৎচন্দ্র শাস্ত্রীর ‘দক্ষিণাপথ ভ্রমণ’ পড়েছিলাম। কাশীর টোল ছেড়ে শাস্ত্রী মশাই পরিভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, শুধু খালি পা নয়, মস্তকে ক্ষুদ্র টিকি আর অঙ্গে উত্তরীয়। কিন্তু বাঙালি তো, একটি মাত্র আরামের ব্যাপারে খুব সজাগ, উজ্জয়িনীতে শেঠের বাড়িতে হাজির হয়েই বলেছিলেন, ‘আমরা রুটি খাই না, অন্ন আহার করিয়া থাকি।’ কিন্তু রান্না তো নিজেকেই করতে হবে, উনুনটা সদ্য তৈরি করা, তাই ভিজে, কিছুতেই ধরতে চায় না। ভলকে-ভলকে শুধু ধোঁয়া বেরুচ্ছে, চোখের জলে নাকের জলে এক তবু শাস্ত্রীমশাই অসীম অধ্যবসায়ে উনুনে হাওয়া করতে লাগলেন, তাতে আরও বেশি ধোঁয়া, এসব উনুন ধরানো মেয়েদের কাজ কিন্তু শেঠ গিন্নিকে কিছু বলতে সাহস হয় না। কারণ শেঠের বয়েস পঞ্চাশের বেশি কিন্তু তার গৃহিণীর বয়েস পঁচিশ ছাব্বিশ। শেঠের পরনে ময়লা কাপড়, সে নিজেই সব কাজকর্ম করে, আর শেঠ গৃহিণী ‘কেবল সর্বদা দুই চারিখানি স্বর্ণালঙ্কার ও রঙিন সূক্ষ্ম বসন ও আঙরাখার দেহ আবৃত করিয়া বারান্দায় বেড়াইয়া বেড়ায়।’ একে উনুন ধরাতে বলা যায় না, তা ছাড়া শেঠ গৃহিণী একটি হাসির ফোয়ারা, উনুনের ধোঁয়ার মতোই তার মুখে সবসময় গলগল করে হাসি বেরুচ্ছে। তারপর কী হল, শেঠ গৃহিণীর হঠাৎ উনুন ধরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে হল, তিনি গজেন্দ্রগমনে উনুন পর্যন্ত এসে পৌঁছবার আগেই দপ করে উনুনের আগুন জ্বলে উঠল। তখন হাসিতে সারা শরীর দুলিয়ে শেঠ গৃহিণী বলল, দেখলে তো মহারাজ, তোমার এক ডাকাডাকিতেও আগুন এল না, শুধু ধোঁয়া পাঠাচ্ছিল। আর আমাকে দেখা মাত্রই আগুন জ্বলে উঠল। এর উত্তরে আর শাস্ত্রীমশাই কী বলবেন? তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘চতুষ্পাঠীর ছাত্রদের মধ্যেও অনেক রসিক আছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে আমি ওই বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ।’ সুতরাং শেঠনীর হাসি অগ্রাহ্য করে শাস্ত্রীমশাই ‘আলু, মুগের ডাল সিদ্ধ, আতপান্ন পাক করিয়া গব্যঘৃত, লেবুর চাটনি ও দুগ্ধের দ্বারা ভোজন শেষে করিলেন।’ উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরের সামনে প্রণত সেই পর্যটক ব্রাহ্মণের মূর্তি আমি আজও স্পষ্ট দেখতে পাই।
অনেক কাজ আমরা নিজেরা করি না, করতে পারি না, কিন্তু অন্য কেউ করছে জানলে বড় ভালো লাগে। ছেলেবেলা থেকে কত ভ্রমণকাহিনি পড়েছি, সবচেয়ে ভালো লাগে আমার পায়ে হেঁটে উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণ। ছেলেবেলায় বোধ হয় সবাই মনে-মনে একবার অন্তত ভাবে, কোনওদিন সে তেপান্তরে মাঠ পাড়ি দেবে। পথিক শুনলেই মনে হয় একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, কোথায় কোনও অজানা রাস্তায় আসন্ন গোধূলিতে অন্যমনে হেঁটে চলেছে। পরিব্রাজক কথাটা শুনলেই মনে হয়, তার কোনও গন্তব্য নেই, যে-কোনও জায়গায় সে যেতে পারে। একসময় কি যে-কোনও বালকই ভাবেনি, সেও একদিন নিরুদ্দেশের রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে! বাল্য বয়সে সে রামমোহন রায়ের জীবনী পড়েছে, পায়ে হেঁটে রামমোহন রায় তিব্বতে চলে গিয়েছিলেন–সেও কি রামমোহন রায়ের সঙ্গে-সঙ্গে তিব্বত যায়নি? তারপর সেইসব বালকেরা ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে, শিক্ষা সমাপ্ত করে ক্রমশ ভদ্র, সভ্য ও যুক্তিবাদী হয়ে উঠেছে, পোশাক পরিচ্ছদ নিখুঁত না হলে চলে না, কথাবার্তা যথোপযুক্ত, বিনা উদ্দেশ্যে কোনও কাজ করার আর তখন প্রশ্নই ওঠে না, সুতরাং তখন উদ্দেশ্যহীন পথে পরিব্রাজক হয়ে কে আর বেরুতে পারে? তখন সেলসম্যান হয়ে বা অফিসের কাজে যেত হয় নাগপুর বা কানপুর, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে শিলং পাহাড়, কিম্বা বয়স্ক হয়ে ওঠার প্রধান লক্ষণই হল জমি কেনা কিংবা বাড়ি কেনার চেষ্টা, অর্থাৎ স্থায়ী হওয়া, স্থাবরের অধীশ্বর হওয়া। শুধুই পথকে ভালোবেসে কে আর পথে বেরিয়ে পড়তে পারে?
অনেকেই পারে না, যেমন আমি পারি না, তবু কি মনে-মনে কল্পনা করতে ইচ্ছে হয় না, পৃথিবীর পথে-পথে এখনও পরিব্রাজকরা ঘুরছে? না কি, সবাই ভদ্র, সভ্য এবং যুক্তিবাদী হয়ে গেল, আর কেউ অনাসক্ত পরিব্রাজক নেই? ভাবতে আমার ভয় হয়। কালচারাল ডেলিগেশন, বাণিজ্যিক মিশন, ছুটি কাটানো বা স্বাস্থ্যোদ্বারে ভ্রমণ, ভ্রমণকাহিনি লেখা বা উপন্যাসের উপকরণ
খোঁজার জন্য ঘুরে বেড়ানো–এগুলি অবশ্যই বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু শুধু পথের প্রেমিক কোনও পরিব্রাজককে যেন চোখ বুঝলে আর দেখতে পাই না। মনে পড়ে পৃথিবী যত বেশি স্বাধীন হচ্ছে ততই ছোট হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী, এখন পথের বাঁকে বাঁকে ভিসা, পাসপোর্ট আর রিজার্ভ ব্যাংক ডিক্লারেশন, দুই সহোদরা দেশেরও একদিক থেকে অন্যদিকে যাওয়া যাবে না। ভাবতে ভয় হয় যে, পরিব্রাজক হয়তো এসে দাঁড়িয়েছেন কোনও এক অজানা দেশের সীমান্তে। অমনি সীমান্ত প্রহরীবৃন্দ এসে বলবেন, কী চাই হে তোমার? পরিব্রাজক উদাসভাবে উত্তর দিলেন, আমি কিছুই চাই না, শুধু পথ অতিক্রম করে যেতে চাই!
কিছুই চাই না? এই কথাটাই যে এই বস্তুবাদী পৃথিবীতে সন্দেহজনক। এক প্রহরী তখন নিশ্চিত চোখ মটকে অপর প্রহরীকে বলবে, এ ব্যাটা তাহলে নিশ্চয়ই স্পাই! কী রকম নিখুঁত ছদ্মবেশ!–তখন পরিব্রাজকের কাঁধে এসে পড়বে–তাদের নোংরা হাত, ভাবতে আমি শিউরে উঠি।
না, একজন না একজন পরিব্রাজক আমাদের সব সময় চাই। আমরা যারা ধরাবাঁধা জীবনে আছি, প্রতিদিন প্রায় একই পথ হেঁটে বেঁচে আছি, বাসস্থান, কর্মস্থান আর বান্ধবগৃহ একই ছক বাঁধা পথে, আমরা মাঝে-মাঝে স্বপ্নে অন্তত দেখতে চাই কোথাও কোনও অজ্ঞাত জনপদে, রুক্ষ পাহাড়ি পথে, রহস্যময় অরণ্যের মধ্য দিয়ে একজন ছন্নছাড়া পরিব্রাজক আমন মনে হেঁটে চলেছে।