[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

৫০. ডেনভার এয়ারপোর্ট থেকে প্লেন বদল

ডেনভার এয়ারপোর্ট থেকে প্লেন বদল করে যেতে হবে এডমন্টনে। মাঝখানে হাতে রয়েছে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা সময়।

এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে যে শহরটা ঘুরে দেখে আসব তার উপায় নেই। পকেট ঢনঢ়ন। কলোরাডো রাজ্যটিই অতি মনোরম। ছোট-ছোট পাহাড়, নিবিড় জঙ্গল আর নদীমাতৃক এই রাজ্যটির সৌন্দর্যের খ্যাতি আছে সারা পৃথিবীতে। আমার কলোরাডো ঘুরে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, হল না।

আর কয়েক ঘণ্টা বাদে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে যাব, আর কোনওদিন এখানে আবার আসব কি না কে জানে! হাতে সময় আছে, তাই হিসেব করতে বসলুম, কী-কী দেখা বাকি থেকে গেল এ যাত্রায়।

কাছেই গ্র্যান্ড কেনিয়ান। এই বিশ্ববিখ্যাত উপত্যকাটি সত্যিই প্রকৃতির এক মহান বিস্ময়। যারা এ দেশ ভ্রমণ করতে আসে, তাদের দ্রষ্টব্য তালিকায় প্রথমেই গ্র্যান্ড কেনিয়ানের নাম থাকে। আমি ছবিতে, চলচ্চিত্রে অনেকবার গ্র্যান্ড কেনিয়ান দেখেছি, কিন্তু দু-দুবার এসেও চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হল না। প্রথমবার ভেবেছিলুম, অনেকদিন তো থাকব, কোন এক সময় দেখে নিলেই হবে। তারপর হঠাৎ ফিরে গেছি। এবারে পাঁচটা মাস কেটে গেল ঝড়ের বেগে, এখন আমি সর্বস্বান্ত। অবশ্য পয়সা থাকলেও এই শীতের মধ্যে গ্র্যান্ড কেনিয়ান দেখা সম্ভব হত না।

অ্যারিজোনার মরুভূমি দেখে গতবার খুব ভালো লেগেছিল। এ এক অন্যরকম মরুভূমি। আগাগোড়া রুক্ষ নয়, মধ্যে মধ্যে রয়েছে অসংখ্য বিরাট ক্যাকটাস। এই সাউয়ারা ক্যাকটাসগুলো এক-একটা দোতলা-তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু। অপূর্ব সেই দৃশ্য। ইচ্ছে ছিল সেখানে একবার যাব।

টেক্সাসের দিকে তো যাওয়াই হল না। ওয়েস্টার্ন ছবিতে কতবার যে টেক্সাস দেখেছি, সেখানে আমার পায়ের চিহ্ন পড়ল না। যদিও জিনস আর গেঞ্জি কিনে রেখেছিলুম। রেড ইন্ডিয়ানদের একটা এনক্লেভ-ও আমার দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল।

আমেরিকার যে চারটি রাজ্যকে সাদার্ন স্টেটস বলে, সেখানে কখনও যাইনি। এরা এখনও নাকি কালো লোকদের ওপর খড়গহস্ত, কত নৃশংসভাবে যে এখানে নিগ্রোদের খুন করা হয়েছে তার ঠিক নেই। অথচ, এই দক্ষিণ রাজ্যের নাগরিকরাই তাদের ভদ্রতার জন্য বিখ্যাত!

যাওয়া হল না পাশের রাজ্য মেক্সিকো-তে। যদিও সেখানকার দু-একজন বন্ধু নেমন্তন্ন করে রেখেছিল। কিউবা দেখারও একটা অদম্য শখ রয়ে গেছে আমার মনে। এক সময় ফিদেল কাস্ত্রো ছিল আমার হিরো। হেমিংওয়ের লেখা কিউবার অনেক বর্ণনা পড়েও মন টেনেছে। এই ডেনভার এয়ারপোর্ট থেকেই কিউবাগামী বিমানের জন্য ঘোষণা শুনতে পেলুম কয়েকবার। কিন্তু আমার যাওয়ার উপায় নেই।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে যাওয়া খুবই শক্ত আমি জানি। আমাদের দেশ থেকে কেউ, বিনা কাজে, শুধু ভ্রমণের জন্য ওখানে গেছে, এমন শুনিনি। তবু ব্রাজিল, উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা, পেরু এইসব রোমাঞ্চকর নামগুলি আমায় হাতছানি দেয়।

বসে-বসে এইসব ভাবতে-ভাবতে আমি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি পদ্যে নিজস্ব সুর দিয়ে গুনগুন করে গাইতে লাগলুম:

ইচ্ছা সম্যক জগদর্শনে
কিন্তু পাথেয় নাস্তি
দু-পায়ে শিক্লি, মন উড়ু উড়ু
এ কী দৈবের শাস্তি!

বেশিক্ষণ এ গানটা গাওয়া গেল না, কারণ সুরটা তেমন জুতসই রকমের করুণ হয়নি। তাই এরপর আমি গাইতে শুরু করলুম দ্বিজেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভাইয়ের লেখা:

কী পাইনি
তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি…

কিন্তু একলা বসে-বসে গান গেয়ে তো বেশি সময় কাটানো যায় না। তাই উঠে পায়চারি করতে লাগলুম খানিকটা। ডেনভার এয়ারপোর্টটি বিরাট, এখানে রয়েছে অজস্র দোকানপাট, ওপর তলায় একটা ছোটখাটো মিউজিয়াম পর্যন্ত রয়েছে। অনেক খাবার দোকান, কিন্তু আমি বাইরে থেকে দেখেই চক্ষু সার্থক করছি।

সিডার র‍্যাপিডস ছেড়ে আসতে হয়েছে খুবই তাড়াহুড়োর মধ্যে। মুখার্জিদা এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়েছে এবং বারবার জিগ্যেস করেছেন, তোর ব্যাগ হারাইছে, পয়সাকড়ি ঠিক আছে তো? অসুবিধা থাকলে লুকাইস না, খুইল্যা ক! লজ্জার কিছু নাই, আমি তোরে বেনিফিট অব ডাউটে দুই-তিনশো ডলার ধার দিতে পারি।

আমি জোর দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলুম, না, না, আমার কোনও অসুবিধে নেই।

মুখার্জিদার পরামর্শে স্থানীয় পুলিশস্টেশনে একটা ডায়েরি করিয়ে এসেছি আমার ব্যাগ হারাবার বিষয়ে। প্লেনের টিকিট পুনরুদ্ধার করতে হলে এটা নাকি দরকার। সূর্যকে সব খবর জানিয়ে একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছি। জয়তীদি হঠাৎ কেন টিকিট পাঠিয়ে দিলেন তা জানবার জন্য দু-বার ওঁকে টেলিফোন করেছিলুম। বাড়িতে পাইনি। ওঁর ছোট মেয়ে ছুটকি কিছুই বলতে পারেনি। যাই হোক, টিকিট নষ্ট করার কোনও মানে হয় না বলে আবার যাত্রা শুরু করে। দিয়েছি।

অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ করছিলুম, দুটি শাড়ি পরা মেয়ে ও একটি ধুতি পরা ছেলে হাতে কয়েকটি বই নিয়ে ব্যস্ত যাত্রীদের পাশ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে কী সব বোঝাচ্ছে। ছেলেমেয়ে তিনজনেরই পায়ে চটি। এটা অবিশ্বাস্য লাগে। বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা হলেও বিমানবন্দরের মধ্যে স্বাভাবিক উত্তাপ। কিন্তু ওরা তো কখনও বিমানবন্দরের বাইরেও যাবে, তখন কি চটি পড়ে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটবে?

মেয়ে দুটি পরে আছে সাধারণ ছাপা শাড়ি, ছেলেটির গায়ে গেরুয়া রঙের চাদর। তার মস্তক মুণ্ডিত, মাঝখানে একটি টিকি। ওদের চিনতে ভুল হয় না। ওরা কৃষ্ণ কনসাসনেস-এর স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবিকা। ওরা চাঁদা তোলে না, যতদূর জানি, এ দেশে রাস্তায় ঘাটে চাঁদা তোলা নিষিদ্ধ, ওরা নিজস্ব প্রকাশনীর বই বিক্রি করতে চাইছে। উদ্দেশ্য শুধু বই বিক্রি নয়, বৈষ্ণব দর্শনের সম্প্রচার।

ভগবৎ দর্শন বা ধর্মের ব্যাপারটা আমি কিছু বুঝি না, কোনও আগ্রহ নেই। বিরাগও নেই, ও ব্যাপারে আমি উদাসীন। কিন্তু দূর থেকে ওদের দেখতে-দেখতে আমি ভাবছিলুম, কোন টানে ওরা ধর্মের কাছে এতখানি নিবেদন করতে পেরেছে নিজেদের। তিনটি আমেরিকান ছেলেমেয়ে। বয়েস তিরিশের বেশি নয়, এই ডিসেম্বরের সন্ধেবেলা কতরকম আমোদ প্রমোদেই তো সময় কাটাতে পারত। তার বদলে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে নিরলসভাবে এয়ারপোর্টের এ মাথা থেকে ও মাথা হেঁটে চলেছে, জাঁদরেল চেহারার অতিশয় ব্যস্ত মানুষদের বোঝাতে চাইছে শ্রীকৃষ্ণের মহিমা। এ পর্যন্ত একটা বইও বিক্রি হতে দেখিনি। কেউ ওদের কথা মন দিয়ে শুনছেও না। তবু ওদের ধৈর্য নষ্ট হচ্ছে না। যে-কোনও কাজেই এমন নিঃস্বার্থ নিষ্ঠা দেখলে শ্রদ্ধা জাগেই।

আমি যদিও ধুতি পরে নেই, তবু আমার মুখে একটা দুর্মর বাঙালি ছাপ আছে নিশ্চয়ই। ওদের মধ্যে দুটি ছেলেমেয়ে ঘুরতে-ঘুরতে এক সময় আমাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়াল। মুখে ফুটে উঠল আগ্রহের হাসি। কাছে এগিয়ে এসে ছেলেটি পরিষ্কার বাংলায় আমায় জিগ্যেস করল, আপনি কি কলকাতা থেকে আসছেন?

আমি মাথা নেড়ে হাঁ বলতেই ছেলেটি আমার হাতে দুখানি বই দিয়ে বলল, আপনি এই বই দুটি দেখেছেন? অবশ্য এসব আপনার পড়া আছে নিশ্চয়ই!

একটি বেদের সংকলন আর একটি গীতার অনুবাদ। ছাপা ও কাগজ অতি চমৎকার, মলাট বেশি রংচঙে, অনেকটা আমাদের ক্যালেন্ডারের ছবির মতন।

বই দুটি নাড়তে-চড়তে আমার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। এরা কি ভাবে বাঙালি মাত্রেই বেদ উপনিষদ-গীতা পড়েছে? আমি রাজশেখর বসুর অনুবাদে গীতা পড়েও কিছুই বুঝতে পারিনি, বড্ড খটখটে লেগেছে। আর বেদ? আমার মতন স্নেচ্ছের কি বেদ পড়ার অধিকার আছে?

আমি বললুম, বাঙালি হলেও আমি এসব পড়িনি, অনেক বাঙালিই পড়েনি। ছেলেটি বলল, তা আমরা জানি। সকলে পড়ে না। কিন্তু বিশ্বে শান্তি আনতে হলে এইসব পবিত্র পুস্তক কি আবার নতুন করে পড়া উচিত নয়?

আমি বললুম, বাঃ, আপনার বাংলা অ্যাকসেন্ট তো চমৎকার!

কথাটা বলে আমি বেশ শ্লাঘা বোধ করলুম। সাহেবদের কাছ থেকে আমাদের ইংরিজি উচ্চারণ সম্পর্কে নানারকম মন্তব্য শুনতে হয়, কোনও সাহেবের বাংলা উচ্চারণ সম্পর্কে মতামত দেওয়ার সুযোগ তো সহজে পাওয়া যায় না।

ছেলেটি লজ্জা পেয়ে বলল, না, না, আমি বাংলা তত ভালো জানি না। বাংলা খুব সুন্দর ভাষা।

আমি কলকাতায় ইসকনের সাহেব বোষ্টম-বোষ্টমি অনেক দেখেছি, ওঁদের প্রধান কেন্দ্র মায়াপুরেও গেছি বেড়াতে, কিন্তু কখনও ওঁদের কারুর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়নি। এই প্রথম সেই সম্প্রদায়ের দুজনের সঙ্গে আলাপ হল ডেনভার বিমানবন্দরে।

ছেলেটি বলল তার নাম মাধব দাস। আর মেয়েটির নাম বিনোদিনী। পূর্বাশ্রমে নিশ্চয়ই ওদের অন্য নাম ছিল। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ওরা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই গল্প করতে লাগল আমার পাশে বসে। মেয়েটির মতন এমন লাজুক আমেরিকান মেয়ে আমি আগে আর কখনও একজনও দেখিনি। সে কোনও কথা বলে না, শুধু হাসি-হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকে।

ছেলেটি অনেক কিছু জানে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকৃষ্ণ, কেশব সেন এই সব নাম বলে যেতে লাগল টপাটপ। এক সময় সে আমাকে জিগ্যেস করল, তুমি বলতে পারো, ব্রহ্মধর্মে এক সময় বৈষ্ণবদের প্রভাব বাড়ল কী করে?

আমি আবার ইতিহাসে খুব কাঁচা। আমাদের দেশের নাইনটিনথ সেঞ্চুরির ইতিহাস প্রায় কিছুই জানি না। দেবেন ঠাকুর আর বিদ্যাসাগরের মধ্যে কে বয়েসে বড়, তা আমার গুলিয়ে যায়। কেশব সেন খ্রিস্টান ছিলেন না ব্রাহ্ম ছিলেন, সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। সুনীলদা এই সব বিষয় নিয়ে একটা ঢাউস বই লিখেছেন, তিনি থাকলে এই সাবজেক্টে একটা লম্বা লেকচার দিতেন নিশ্চয়ই।

আমি আমতা-আমতা করে বললুম, ভাই, আমি ঠিক বলতে পারছি না। আপনি কলকাতায় গিয়ে যেকোনও বাংলার এম-একে জিগ্যেস করলেই উত্তর পেয়ে যাবেন।

ছেলেটি নিজেই আমাকে অনেক কিছু বোঝাল। তার মতে ভক্তিই হচ্ছে মুক্তির উপায়। শুদ্ধ ভক্তি মানুষের মনকে একেবারে পরিচ্ছন্ন করে দেয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি… আমি খুব মন দিয়ে

শুনছি না বুঝতে পেরেই এক সময় উঠে পড়ল সে। যাওয়ার সময় আমি তাকে বই দুটো ফেরত দিতে যেতেই সে বলল, না, না, ও বই আপনার জন্য। আপনি রাখুন।

আমি যতই বলি যে এই বই দিয়ে আমি কী করব, সে কিছুতেই শুনতে চায় না।

আমি তখন বললুম, দেখুন, কিছু মনে করবেন না, আপনারা তো এই বই বিক্রি করছেন–

আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে বলল, না, আমরা বিক্রি করছি না। তবে কেউ যদি আমাদের সাহায্যের জন্য কিছু দেয়, তবে আমরা খুশি হয়েই নেব।

আমি বললুম, আমাদের তো গোনা গাঁথা ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ে এদেশে আসতে হয়, সুতরাং আমার পক্ষে এখন কিছুই দেওয়া সম্ভব নয়। কলকাতায় দেখা হলে কিছু দিতে পারি নিশ্চয়ই

ছেলেটি বলল, আপনাকে কিছুই দিতে হবে না। আপনি রাখুন বই দুটি, অবসর সময়ে পড়বেন। কিংবা অন্য কোনও উৎসাহী ব্যক্তিকে দিয়ে দেবেন।

ওরা চলে যাওয়ার পর আমি একখানা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছি, একটু পরে ফিরে এল সেই মেয়েটি। হাতে একটি ছোট কাগজের বাক্স।

নম্র হেসে মেয়েটি বলল, প্রসাদ। আপনার জন্য।

আমি হাত পেতে নিলুম। সেই বাক্সের মধ্যে কয়েকখানা পুরি আর আলু ভাজা আর খানিকটা মিষ্টি। আমি বহুদিন কোনও পূজা-আচ্চার জায়গায় যাইনি, তাই প্রসাদও খাইনি। কিন্তু পয়সার অভাবে আমি অনেকক্ষণ খিদে চেপে বসেছিলুম। সেই ঠান্ডা পুরি আর আলু ভাজাই অমৃত মনে হল আমার কাছে। চোখের নিমেষে শেষ করে ফেললুম। ওরা কী করে বুঝল যে আমার এমন খিদে পেয়েছে?

খানিক বাদে ফিরে এল আবার মাধব দাস। আমাকে একটা কাগজ দিয়ে বলল, এতে আমাদের মন্দিরগুলির একটা তালিকা আছে। এইসব জায়গায় গেলে আপনি আমাদের মন্দিরে থাকতে পারবেন আর প্রসাদ পাবেন।

ডেনভারে ইসকনের মস্ত বড় মন্দির আছে। তা ছাড়া সারা আমেরিকা-কানাডা জুড়ে যে এদের এতগুলো আশ্রম, এ সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। অন্তত আশি-পঁচাশিটা! গোটা আমেরিকাটাকেই ওরা হিন্দু করে ফেলবে নাকি?

কিন্তু সেই মুহূর্তে ওদের সম্পর্কে আমার কোনও ঠাট্টাইয়ার্কি করতে ইচ্ছে হল না। ওরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বারবার আমায় সাহায্য করতে আসছে। ওদের তো বিন্দুমাত্র স্বার্থ নেই! আমি বরং কৃতজ্ঞতাই অনুভব করলুম।

আমার চোখ অনেকক্ষণ ওদেরই অনুসরণ করতে লাগল। গ্রে ফ্লানেল সুট পরা অতিশয় কেজো, গম্ভীর চেহারার, বিশালকায় আমেরিকান পুরুষদের কাছে ওরা হিন্দু ধর্মের বই বিক্রি করার অনলস চেষ্টা করে যাচ্ছে। শাড়ি পরা শ্বেতাঙ্গিনী যুবতি ও গেরুয়া চাদর পরা মার্কিন যুবককে দেখে অন্যরা যেন শিউরে উঠছে, কারুর কারুর মুখে ফুটে উঠছে গভীর অবজ্ঞার ভাব। ওই ছেলে-মেয়েরা কিন্তু বিরক্ত হচ্ছে না, রেগেও যাচ্ছে না। এত কম বয়েসে এতখানি ধৈর্য ওরা আয়ত্ত করল কী করে?

তারপর এক সময় আমার প্লেনের ডাক পড়ল। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি এগিয়ে গেলুম সিকিউরিটি কাউন্টারের দিকে। ডেনভারের মতন সিকিউরিটির কড়াকড়ি আমি পৃথিবীর আর কোনও বিমানবন্দরে দেখিনি। পকেটের সব খুচরো পয়সা, হাতের ঘড়ি, চাবি, কোমরের বেল্ট পর্যন্ত জমা দিতে হয়। এক আধ টুকরো ধাতু সঙ্গে নিয়ে সিকিউরিটি বেরিয়ার পার পাওয়া যায় না কিছুতে। কিউবার পলাতকদের জন্যই নাকি এত সতর্কতা।

বিমানটা রানওয়ে দিয়ে ছুটতে শুরু করতেই মনে পড়ল, এবারের মতন আমায় এদেশ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে এখানেই। আর হাজার চেষ্টা করলেও ফিরে আসা যাবে না। ভিসায় ছাপ পড়ে গেছে। সেজন্য কোনও দুঃখ হচ্ছে না, চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি ভবিতব্যের উন্মুক্ত দ্বার।