নিউ ইয়র্কের কুইনস পাড়ায় বাঙালিদের একটা উৎসব হচ্ছে শুনতে পেয়ে গেলুম এক সকালবেলা। গিয়ে চমৎকৃত হলুম একেবারে। এ তো শুধু উৎসব নয়, এ যে পুরোপুরি ফাংশান। একটা ইস্কুল বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে, সেখানে গিসগিস করছে শুধু বাঙালি, এটা যে। সাহেবদের দেশ তা বুঝবার কোনও উপায়ই নেই।
মনে হল যেন কানপুর বা জব্বলপুরের কোনও বাঙালি ফাংশানে হাজির হয়েছি। মঞ্চের ওপর গান বাজনা হয়েই চলেছে, একাধিক ঘোষক এক-একরকম ঘোষণা করছেন মাঝে-মাঝে, হঠাৎ হঠাৎ ড্রপ সিন পড়ে যাচ্ছে ভুল করে, মাইক্রোফোনে মাঝে মাঝে চো-ও-ও-ও করে অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে, কয়েকজন কর্মকর্তা অহেতুক ব্যস্ততায় দৌড়াদৌড়ি করছেন এদিক-ওদিক। এদিকে অডিটোরিয়ামে যুবক-যুবতীরা তো রয়েছেই, তা ছাড়াও আছে মাসি-পিসি, ঠাকুরদা ঠাকুমারাও, অনেকে বেশ জোরে জোরেই গল্প করছেন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের খবর নিচ্ছেন, কাচ্চা-বাচ্চারা ছুটোছুটি করছেন আপন মনে। বেশ কয়েকজন পুরুষ সিগারেট টানতে-টানতে আড্ডা দিচ্ছেন বাইরে দাঁড়িয়ে, মাঝে-মাঝে কে যেন চেঁচিয়ে বলে উঠছে, বড্ড গোলমাল হচ্ছে, আস্তে! আস্তে!
একেবারে পুরোপুরি মফসসলিয় বাঙালিদের ছবি।
গোড়ার দিকে লোকাল আর্টিস্টদের গান ও নাচ টাচ হচ্ছিল, শুনলুম কলকাতা থেকে কয়েকজন ভালো ভালো আসল রেডিয়ো আর্টিস্টও এসেছেন। কারুর-কারুর কথা থেকে জানতে পারলুম। ভূপেন হাজারিকা নাকি এসে ঘুরে গেছেন। তা ছাড়া রয়েছেন সলিল চৌধুরী, পূর্ণদাস বাউল ও তাঁর স্ত্রী, লক্ষ্মীশঙ্কর ও তাঁর সম্প্রদায়, আরও যেন কে কে। একজন সাহিত্যিকও নাকি রয়েছেন। তারপরই মঞ্চে ঘোষণা করা হল, এবারে ভাষণ দেবেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
শুনেই আমার বুকটা ধক করে উঠল। সুনীলদা! সলিল চৌধুরী কিংবা পূর্ণদাস বাউলদের সঙ্গে আমার আলাপই নেই, সুতরাং তাঁরা আমাকে পাত্তা দেবেন কেন? কিন্তু সুনীলদার সঙ্গে আমার অনেক দিনের পরিচয়।
বক্তৃতার ব্যাপারে সুনীলদা চিরদিনের ফাঁকিবাজ। স্টেজে দাঁড়িয়ে তিন-চার মিনিট কী সব এলেবেলে কথা বলেই নেমে এলেন। বসলেন সামনের দিকের একটা চেয়ারে। আমি দৌড়ে গেলুম সেখানে। আরও সহর্ষ বিস্ময়ে দেখলুম, সুনীলদার সঙ্গে স্বাতীদিও রয়েছেন।
সুনীলদাকে চমকে দেওয়ার জন্য একেবারে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললুম, ভালো আছেন, সুনীলদা? আমায় চিনতে পারছেন?
সুনীলদা চমকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। ভুরু কুঁচকে একটু দেখে নিয়ে বললেন, খানিকটা চেনা চেনা লাগছে। তুমি কে বলো তো?
আমার বুকটা দমে গেল, সঙ্গে-সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। হায়, সময় কী নিষ্ঠুর! সুনীলদা আমায় চিনতে পারলেন না? অথচ এক সময় সুনীলদা আর আমি কত কাছাকাছি ছিলুম, প্রায় হরিহর আত্মা বলতে গেলে। সেই সুনীলদা এখন অনেক দূরে সরে আছেন। পুরোপুরি এস্টাবলিশমেন্টের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন, চেহারাও অনেকটা ভারিক্কি হয়ে গেছে। মুখে খানিকটা উদাসীন ভাব, আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কিন্তু যেন আমায় দেখছেন না। যেন আমার মতন ছোটখাটো মানুষদের দিকে তেমন মনোযোগ না দিলেও চলে।
স্বাতীদি কিন্তু ঠিক আগের মতনই আছেন। আন্তরিক উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ওমা, নীলু! তুমি কবে এলে? দারুণ ভালো লাগছে তোমায় দেখে। এত সব অচেনা মানুষের মধ্যে হঠাৎ একজন চেনা লোক দেখলে এত ভালো লাগে।
পাশে একটা চেয়ার দেখিয়ে স্বাতীদি বললেন, বসো। তোমার মুখটা শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে কেন? সকালে কিছু খাওনি তুমি?
আমি মুখটা নীচু করলুম। প্রবাসে একাকী ভ্রাম্যমাণ জীবনে হঠাৎ কারুর কাছ থেকে একটা স্নেহের কথা শুনলে চোখে জল এসে যায়। যামিনীদার বাড়িতে ক’দিন একা-একা নিজে রান্না করে খাচ্ছি। কিন্তু রোজ-রোজ কি আর শুধু নিজের জন্য রান্না করতে কারুর ইচ্ছে করে?
এই সময় ঘোষক পরবর্তী নাচের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির জন্য দশ মিনিটের বিরতি চাইলেন। সুনীলদা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, বাইরে চা খেয়ে আসি।
তিনজনে চলে এলুম বাইরে। এদেশে মাটির ভাঁড় পাওয়া যায় না, তার বদলে পেপার কাপ। সেই কাগজের ভাঁড়ে তিনটে চা জোগাড় করে আনলুম উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে। চা শেষ হওয়ার পর চারমিনারের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে সুনীলদাকে জিগ্যেস করলুম, নেবেন?
সুনীলদা এবারে আমার প্রতি একটু উৎসাহ দেখিয়ে বললেন, কোথায় পেলে? আমার তো স্টক শেষ, তাই এখন আমি ক্যামেল খাচ্ছি, অনেকটা এই রকমই।
আমি বললুম, আমার কাছে কয়েক প্যাকেট মাত্র আছে, সাবধানে জমিয়ে রেখেছি, খুব স্পেশাল কারুর সঙ্গে দেখা হলে একটা করে দিই। আপনারা কতদিন হল এসেছেন, সুনীলদা?
–মাসতিনেক হয়ে গেল বোধহয়? এবারে ফিরে গেলেই হয়।
–আপনি এখানে লেকচার টেকচার দিতে এসেছেন বুঝি?
–ধ্যাৎ, লেকচার কে দেয়। এক জায়গায় সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’ আর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দেখানো হল, সেইসঙ্গে আমি বই দুটো বিষয়ে সামান্য দু-চার কথা বলেছি মাত্র, ব্যাস, তাতেই আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে। এখন স্রেফ বেড়ানো।
–দেশে থাকতে শুনেছিলুম আপনার কী একটা অপারেশান হয়েছিল?
খুব একটা অগ্রাহ্যের ভাব দেখিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সুনীলদা বললেন, সে কিছু নয়। তারপর বললেন, কবিতা সিংহও এসেছেন জানো তো?
–কোথায়? এখানে আছেন?
–না, এখন নিউ ইয়র্কে নেই। কবিতা সিংহ এসেছেন আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামের নেমন্তন্ন নিয়ে…আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
আরও দু-একটা টুকিটাকি কথার পর জিগ্যেস করলুম আপনার কেমন লাগছে সুনীলদা?
মুখখানা আগের মতন উদাসীন করে উনি বললেন, আমার এবার খুব যে ভালো লাগছে তা বলতে পারি না। তবে স্বাতীর খুব ভালো লাগছে।
সুনীলদা ধুতি-পাঞ্জাবিও পরেননি, আবার সুট-টাই-ও পরেননি। সাধারণ প্যান্ট-শার্ট, সামান্য শীত পড়েছে বলে তার ওপরে একটা পাতলা কোট। স্বাতীদি একটা চওড়া নীল পাড়ের শাড়ি পরেছেন, তার ওপরে রোঁয়া-রোঁয়া তুলোর মতন একটা বেশ জমকালো সোয়েটার। একটু স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে স্বাতীদির, মুখখানা উৎফুল্ল।
–আপনার খুব ভালো লাগছে বুঝি স্বাতীদি।
স্বাতীদি হেসে বললেন, হ্যাঁ। খুব ভালো লাগছে। তাতে আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছি। জানো, নীলু, আগে আমেরিকা বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহই ছিল না। আমেরিকায় বেড়াতে আসার শখও ছিল না। আমার স্বপ্ন ছিল ফ্রান্স। ছেলেবেলা থেকেই ভেবে রেখেছিলুম, একদিন না একদিন ফ্রান্সে যাবই। আর্ট গ্যালারিগুলো দেখব। এবারে সত্যি-সত্যি ফ্রান্সে এসে আমার চোখ জুড়িয়ে গেছে, প্রাণ ভরে গেছে। খুব ভালো ছিলুম প্যারিসে। তারপর প্যারিস থেকে দেশে ফিরে গেলে আমার খুব একটা আপত্তি ছিল না। তারপর ও এখানে একটা নেমন্তন্ন পেল, তখন ভাবলুম একবার ঘুরে আসাই যাক। এখানে এসে কিন্তু অবাক হয়ে গেছি। যত মানুষ জনের সঙ্গে মিশছি, ততই ভালো লাগছে।
–দেখবারও অনেক কিছু আছে।
–দেখবার জিনিস তো আছেই। কিন্তু আমেরিকানদের সম্পর্কে আমার আগে অন্যরকম ধারণা ছিল, একটু অহংকারী আর মাথা মোটা ধরনের। কিন্তু আমি এখানে এখানে এসে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশে দেখছি, বেশিরভাগই কী সরল আর সুন্দর, কত রকম বিষয়ে আগ্রহী। এক একজনের হাসি দেখলেই বোঝা যায়, তাদের মনটা কত পরিষ্কার। আমরা বেশ কিছুদিন একটা খুব ছোট জায়গায় থেকেছি। সেটা একটা ইউনিভার্সিটি-টাউন, প্রায় সবাই ছাত্রছাত্রী বা পড়ান। তাদের সঙ্গে মিশে দেখলুম, এমন আন্তরিক ব্যবহার…আমার অনেক বন্ধু হয়ে গেছে…ও কিন্তু বিশেষ কারুর সঙ্গে মেশে না, বেশিরভাগ সময়ই বই মুখে নিয়ে শুয়ে থাকে কিংবা টিভি দেখে।
সুনীলদা বললেন, একটা নতুন দেশে এসে সে দেশের টিভি পরদায় ক’দিন মন দিয়ে দেখলে সেখানকার সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।
আমি জিগ্যেস করলুম, আপনার কেন ভালো লাগছে না সুনীলদা?
আর একটা সিগারেট ধরিয়ে সুনীলদা বললেন, স্বাতী অনেকটা ঠিকই বলেছে, এদেশের মানুষ জনের সঙ্গে মিশলে ভালোই লাগে। অনেকেই সরল ও আন্তরিক, বেশ একটা পরোপকারের ঝোঁক আছে। কিন্তু টিভি, রেডিয়ো বা খবরের কাগজে এদেশের সরকারি নীতিগুলো যখন দেখি বা শুনি, তখন রাগে গা জ্বলে যায়। মানুষ হিসেবে আজও আমেরিকানদের বেশ পছন্দ হয়, কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকাকে আমি ঠিক পছন্দ করতে পারি না।
–একটা দেশের অধিকাংশ লোকই যদি ভালো হয় তবে সে দেশের সরকার খারাপ হয় কী করে?
–তাই তো হয় দেখছি। এদেশের লোক কী করে তা মেনে নেয়, তাও বুঝি না। এদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাটা আমাদের বোধগম্য হয় না। রীতিমতো বড়লোক না হলে কারুর পক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোই অসম্ভব। রুজভেল্ট-এর পর সত্যিকারের কোনও ভদ্দরলোক এদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছে? কেনেডি ছাড়া? তাও কেনেডির চেহারা ও কথাবার্তায় খানিকটা চাকচিক্য থাকলেও মানুষ হিসেবে তিনি যে খুব সুস্থ ছিলেন না, সেটা তাঁর জীবনীকাররা ফাঁস করে দিয়েছেন জানো তো? এদেশে কত নোবেল লরিয়েট, কত জ্ঞানী-গুণী, কত উদার মানুষ রয়েছে, তবু এদের প্রেসিডেন্ট হয় নিক্সনের মতন খিস্তিবাজ কিংবা রেগনের মতন দ্বিতীয় শ্রেণির এক সিনেমার ভিলেন? এটা একটা ট্রাজিডি নয়! আসলে এদের সরকার চালায় কয়েকটা বড়-বড় ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, এদেশে যাদের বলে কর্পোরেশন, আমরা যাদের বলি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি। লাভের জন্য এরা মানুষের রক্ত শুষে নিতেও দ্বিধা করে না। এরাই নিজেদের স্বার্থে পৃথিবীর এক-এক জায়গায় যুদ্ধ লাগায়।
–আপনি বেশ রেগে আছেন দেখছি, সুনীলদা।
–ভারতীয় হিসেবে এই সরকারের অনেক আচার আচরণ দেখলে তোমার, রাগ হতে বাধ্য। রাষ্ট্র হিসেবে ভারতবর্ষকে এরা পাত্তাই দেয় না, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। আমি টানা তিন মাস এদের টিভি দেখেছি, তুমি বিশ্বাস করবে কি, মাত্র একদিন একটা ভারতীয় বিমানের হাইজ্যাকিং ছাড়া আর কোনও দিন একবারও ভারতবর্ষ সম্পর্কে একটাও খবর দেয়নি। এদের খবর শুনলে মনে হয়, পৃথিবীতে এখন পোল্যান্ড ছাড়া আর কোনও দেশ নেই। সবসময় রুশ বিরোধী প্রচার একেবারে বিরক্তিকর পর্যায়ে চলে গেছে। এমন অবস্থা, এদেশে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মনেও রুশ জু জ্বর ভয় দানা বেঁধে যাচ্ছে। এটা কী সুস্থ ব্যাপার? রাশিয়াতেও এরকম প্রচার হয় কি না আমি জানি না। আমি কিন্তু এদেশে বসেই অনুভব করছি, রুশ-মার্কিন যে আণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে রাশিয়ার চেয়ে মার্কিন দেশের দায়িত্বই যেন বেশি। এক একটা আণবিক মিসাইলের জন্য যা খরচ, সেই খরচে তেরো লক্ষ শিশুকে এক বছর খাদ্য দেওয়া যায়। শুধু আমাদের দেশে কেন, এদেশেও অপুষ্টিতে ভোগা শিশু আছে। এদিকে এখন চিনের সঙ্গে এদের খুব ভাব, কারণ চিনের সঙ্গে চুটিয়ে ব্যাবসা চলছে কিনা।
–কিন্তু সুনীলদা, আমি যতদূর জানি, আণবিক অস্ত্রের স্টক পাইল আমেরিকানদের চেয়ে রাশিয়ারই বেশি।
–রাশিয়ার বেশি হলে এরা আরও বেশি রাখতে চায়। আবার এদের যদি একটা দুটো বেশি হয়ে যায়, তখন রাশিয়া আবার বেশি বানাবে। এই রকম করতে করতে পৃথিবীটা এক দিন হঠাৎ দুম ফটাস হয়ে যাবে।
স্বাতীদি বললেন, আমরা সেই যে একটা কোম্পানি অফিসে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলুম–স্বাতীদিকে থামিয়ে দিয়ে সুনীলদা বললেন, একটা ওইরকম মালটি ন্যাশনাল কোম্পানি আমাদের অনেককে খেতে নেমন্তন্ন করেছিল, আমাদের দলে কয়েকজন চিনে লেখক লেখিকাও ছিলেন। সে এক এলাহি ব্যাপার। কোম্পানিটির নাম জন ডিয়ার কোম্পানি, আমাদের দেশে অনেকে নাম শোনেনি, কারণ আমাদের দেশে এদের ঠাঁই গাড়তে দেওয়া হয়নি। এরা পৃথিবীতে কৃষির যন্ত্রপাতি বানাবার বৃহত্তম কোম্পানি। ট্রাকটর ফ্রাকটর বানায়। এদের অফিস বাড়িটি দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, বিশ্ববিখ্যাত সব শিল্পীদের আসল ছবি দিয়ে সাজানো, স্বয়ং হেনরি মুরকে ডেকে এনে ভাস্কর্য গড়িয়ে রাখা আছে বাগানে। খাওয়াদাওয়াও হল দারুণ। কথায়-কথায় এই কোম্পানির একজন ডিরেকটর খুব আহাদ করে আমাদের জানালেন যে ইদানীং চিনে এরা কত হাজার কোটি ডলারের যেন কয়েকটা কারখানা বসিয়েছে। তখন আমার মনে হল, এই যে আড়ম্বর ও বিলাসিতা, তার অনেকটাই নিশ্চয়ই সাম্যবাদী চিনকে শোষণ করা টাকায়। সাম্যবাদী চিনও হঠাৎ কেনই বা নিজেদের এখন মার্কিনিদের দিয়ে শোষিত হতে দিচ্ছে, তাই বা কে জানে!
আমি বললুম, যাক গে, ওসব বড়-বড় রাজনীতির ব্যাপার। সুনীলদা আপনার সঙ্গে এখানকার অনেক লেখকদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে নিশ্চয়ই?
স্বাতীদি অনুযযাগের সুরে বললেন, দ্যাখো না, ও কারুর সঙ্গে আলাপই করতে চায় না। আজকাল ভীষণ অমিশুকে হয়ে গেছে।
সুনীলদা বললেন, যখন বয়েস কম ছিল, তখন ঝোঁক ছিল বিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে আলাপ করব। তাঁদের কথা শুনব। এখানে অনেক ভালো লেখক আছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু আজকাল তাঁদের সঙ্গে কথা বলার উৎসাহ পাই না। ওদের সামনে গেলে একটা হীনমন্যতা জাগে। কারণ কী জানো, ওরা আমাদের বিষয়ে কিছুই জানে না, আমাদের কারুর লেখা পড়েনি। অথচ আমরা এদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানি, অনেক লেখা পড়েছি। এখানে সব আলোচনাই একতরফা হতে বাধ্য। তাতে আমার রুচি নেই। আমি মনে করি, আমাদের বাংলা সাহিত্যের মান এখানকার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়, এদের কিছু লেখা খুব ভালো হলেও অধিকাংশ লেখাই তো রাবিশ। এরা যদি বাংলা সাহিত্য পড়তে না চায় তা হলে নিজে গিয়ে সেধে-সেধে কিছু জানবার আগ্রহ আমার একটুও নেই। তার চেয়ে এদেশটা বেড়াবার পক্ষে ভালো, টাকাপয়সা জুটলে কিছুদিনের জন্য বেড়িয়ে যেতে বেশ ভালোই লাগে।
–আপনাকে যদি অনেক টাকা দেওয়া হয়, তাহলে আপনি এদেশে থেকে যাবেন?
–যদি আমায় মাসে এক লাখ ডলারও দেয়, তা হলেও আমি এদেশে থাকব না। যদি আমায় জেলে বন্দি করে রাখে পরের দিনই আমি আত্মহত্যা করব।
সুনীলদার এমন তীব্র মন্তব্য শুনে আমি আর স্বাতীদি দুজনেই হাসতে লাগলুম। তাতে সুনীলদা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। বেশি বড়-বড় কথা বলা হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে নিজেকে একটু সামলে নিলেন। তারপর নিজেও হাসতে-হাসতে বললেন, আরে বাবা, বাংলায় কিছু লিখতে গেলে আমাকে তো নিজের দেশের মানুষের মধ্যেই থাকতে হবে। নিজের দেশের মানুষকে না জানলে তো কিছু লেখা যায় না।
স্বাতীদি বললেন, আমারও খুব বেশিদিন এসব দেশে থাকবার খুব একটা ইচ্ছে নেই। জানো তো, ও ক্যালঘেরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও চার মাস থেকে যাওয়ার একটা প্রস্তাব পেয়েছিল, কিন্তু ও নিতে রাজি হয়নি। ভালোই করেছে। বেড়াতে এসেছি, বেড়িয়ে ফিরে যাব।
সুনীলদা আবার হঠাৎ মেজাজ বদলে কড়া গলায় আমায় জিগ্যেস করলেন, তুমি আমায় এত কথা জিগ্যেস করছ কেন? তুমি কি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছ নাকি?
–না, না, এমনি। এসব কথা আর কাকে জিগ্যেস করব, বলুন?
–এসব আবার কোথাও ছাপিয়ে টাপিয়ে দিও না।
–এখন আবার ফাংশান শুনবেন না একটু রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াবেন? আজ কিন্তু চমৎকার রোদ উঠেছে।
স্বাতীদি খুব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, চলো-চলো, সেই ভালো। এইসব গান-বাজনা তো আমরা কলকাতায় রোজই শুনি–।
আমরা তিনজনে বেরিয়ে পড়লুম পথে।