[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১০. দরজায় দুম দুম ধাক্কা

সেই দ্বিতীয় রাত্রে যে দরজায় দুম দুম ধাক্কা ও নারীকণ্ঠের আবেদন শোনা গিয়েছিল, সে রকম কিছু আর ঘটেনি। তার পরের কয়েকটি দিনে, যেসব মেয়েদের দেখলেই তাদের পেশা বোঝা যায়, তাদের দেখিনি হোটেলের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে।

এ হোটেলের পেছনের রাস্তাতেই লালবাতি এলাকা, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে ফুলো ফুলো বুকের রমণীরা, সিগারেট ফুঁকতে-ফুঁকতে তারা আড়ে-আড়ে পথিকদের দিকে চায়, আর কোনও প্রকাশ্য ইঙ্গিত করে না। তারা হোটেলের মধ্যেও ঢোকে না, সেদিক দিয়ে হোটেলটি পরিচ্ছন্ন।

তা হলে সেই দ্বিতীয় রাতের রমণীর ব্যাপারটা কী? অত জোরে-জোরে দরজায় ধাক্কা দেওয়া স্বাভাবিক নয়। হয়তো সে কোনও চেনা লোককেই খুঁজতে এসেছিল, ঘরের নম্বরটা ভুল করেছে। আমার কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারেনি? হয়তো ততটা ইংরিজি জানে না কিংবা ছিল নেশাগ্রস্ত।

যাই হোক, বেনিফিট অফ ডাউট দেওয়া গেল।

টেলিফোনটা প্রায় নিস্তব্ধই থাকে, বেজে ওঠে কদাচিৎ।

পৌঁছবার পরদিনই কানাডা থেকে ফোন করেছিলেন কান্তি হোর। আমি তাঁকে হোটেলের নাম জানিয়ে আসতে পারিনি। তিনি ওয়েবসাইটে কবিতা উৎসবের সংবাদ থেকে উদ্যোক্তাদের ফোন নাম্বার খুঁজে বার করেছেন।

এত দূর দেশে এসে এরকম একটি সহৃদয় বাংলা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলে ভারী ভালো লাগে। ওঁর সঙ্গে ঠিক হয়ে রইল, উনি কয়েকদিন পরে চলে আসবেন বোগোটায়, পৌঁছেই ফোনে জানাবেন কোথায় উঠেছেন। আমিও সেখানে গিয়ে উপস্থিত হব, এক রাত অন্তত আড্ডা হবে।

আমি নিজে থেকে স্বা তাঁকে ফোন করেছি একবারই, ঠিকঠাক এক খণ্ড অবস্থায় যে পোঁছেছি, সে খবর জানাবার জন্য। হোটেলের ঘর থেকে টেলিফোন করার খরচ খুব বেশি, তা ছাড়া অপারেটরকে সংখ্যা বোঝাতে গলদঘর্ম হতে হয়। শেষ পর্যন্তও বুঝতে না পেরে অপারেটর আমার ঘরে এসে কাগজ-পেনসিল দেখিয়ে ইঙ্গিতে বলেছিল সংখ্যাটা লিখে দিতে। এটাও খুব সৌজন্যের ব্যাপার, টেলিফোন অপারেটর নিজের কাজ ছেড়ে, খুপরি ছেড়ে আটতলায় উঠে আসবে, এরকম আশাই করা যায় না। কিন্তু বারবার কি তাকে আমার ঘরে টেনে আনা উচিত? অপারেটরের সাহায্য ছাড়াই হোটেলের ঘর থেকে সারাবিশ্বে সরাসরি ফোন করার ব্যবস্থা এমনকী আমাদের দেশেও চালু হয়ে গেছে, এখানে নেই।

আমি স্প্যানিশ এক থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যা কার্লোসকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে মুখস্থ করে ফেলেছি। কিন্তু উচ্চারণ আয়ত্ত করা তো সহজ নয়, তাই বললেও কেউ বুঝতে পারে না। শুধু হোটেলের লিফটে উঠে যখন বলি, ওচো, চালিকা মহিলাটি আমায় ঠিক নিয়ে যান আট তলায়। ওচো মানে আট। এরপর ধন্যবাদের বদলে গ্লাসিয়াস।

স্বা তাঁকে বলেছিলাম, পুপলু-চান্দ্রেয়ীকে আমার হোটেলের টেলিফোন নাম্বার জানিয়ে দিতে, তাই ওরা নিজেরাই ফোন করেছিল পরের দিন। পুপলু কিছুটা স্প্যানিশ শিখেছিল, তাই অপারেটরকে আমার নামধাম বোঝাতে অসুবিধে হয়নি। পুপলুর কাছ থেকে জেনে গিয়েছিল গৌতম দত্ত, সেও আমার খোঁজখবর নিয়েছে। টরেন্টোর দীপ্তেন্দু চক্রবর্তীকে জানানো হয়ে ওঠেনি, ভুল হয়ে গেছে। দীপ্তেন্দু কানাডা থেকে কলকাতায় আমাকে প্রায়ই ফোন করে শুধু এইটুকু জানবার জন্য, আমি রোজ একটা করে অ্যাসপিরিন খেতে ভুলে যাচ্ছি কি না। ওর মতে অ্যাসপিরিনই এখন সর্ব রোগের বিশল্যকরণী।

এক একজন মানুষের টেলিফোনের নেশা থাকে। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আমার চেনা-জানা মানুষদের মধ্যে এই নেশায় এক নম্বর চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে কামাল। সে বিড়ি-সিগারেট, মদ, পান জর্দা কিছুই খায় না, জামা-প্যান্টের শখ নেই, অন্য কোনও নেশা নেই, সব নেশা পুঞ্জীভূত হয়েছে টেলিফোনে। টেলিফোন দেখলেই তার হাত নিশপিশ করে। পৃথিবীর বহু দেশে আমি আচম্বিতে তার টেলিফোনের ডাক পেয়েছি। কামালকে নম্বর জানাবার দরকার হয় না। একবার সানফ্রান্সিসকোতে এক বন্ধুর সঙ্গে রাস্তায় হঠাৎ দেখা, সে খুব খুশি হয়ে বলল, চলো, আমার বাড়ি চলো। বন্ধুটির বাড়ি বার্কলেতে, সেখানে অনেকক্ষণ ধরে আজ্ঞা ও পানাহার চলছে, এক সময় টেলিফোন বাজল, বন্ধুটি সেটা তুলে বলল, সুনীল, তোমাকে ডাকছে!

এটা ভৌতিক ব্যাপার মনে হয় না? আমি যে সন্ধেবেলা এ বাড়িতে থাকব, তা দুপুরেও ঠিক ছিল না, অন্য কারুর জানবার কথাও নয়। টেলিফোনটা তোলবার আগেই বুঝে যাই, কামাল ছাড়া আর কেউ নয়।

প্রথমেই তাকে জিগ্যেস করি, কামাল, তুমি কোথায়? সানফ্রান্সিসকোতে এসেছ নাকি?

না, আমি এখন মালয়েশিয়ায়।

আমার এখানকার নম্বর তুমি কী করে পেলে?কী করে জানলে—

কামাল এমনভাবে উত্তর দিল, যেন পদ্ধতিটা খুবই সহজ। প্রথমে সে ফোন করেছে কলকাতায়, তারপর আমেরিকার অমুক, অমুক আর অমুকের কাছে। অর্থাৎ সাত জায়গায় ফোন করে সে তারপরেও আন্দাজে এখানে চেষ্টা করেছে।

এতগুলি আন্তর্জাতিক ফোনের টাকা খরচ করে সে আমাকে খুঁজে বার করল কেন? বিশেষ জরুরি কোনও কারণ আছে? কিছু না, এমনই, অনেকদিন কথা হয়নি। এরকমই তার ভালোবাসা।

এবারে কামাল এখনও পর্যন্ত ফোন করেনি। সে অসুস্থতায় খানিকটা কাবু হয়ে আছে। তবু, ফোন বাজলে প্রথমেই মনে পড়ে কামালের কথা।

টেলিভিশনে কয়েকটি চ্যানেলের মধ্যে দুটি ইংরিজি, সি এন এন আছে, তাতে মাঝে-মাঝে খবর দেখে নিই, বহির্বিশ্বের সঙ্গে এইটুকুই সংযোগ, খবরের কাগজ তো পড়বার উপায় নেই। কলম্বিয়ার খবরও থাকে, একটি জঙ্গি দলের সঙ্গে বন্দি-বিনিময় নিয়ে আলোচনা চলছে সরকারের, আর একটি জঙ্গি দল আবার গোলাগুলি চালিয়েছে। কলম্বিয়ায় গৃহযুদ্ধের মতন অবস্থা চলছে দীর্ঘদিন ধরে।

অন্য ইংরিজি চ্যানেলটিতে একটু রাত হলেই খোলাখুলি পর্নোগ্রাফি দেখাতে শুরু করে। এমন বুদ্ধিভাষ্যহীন নগ্ন চিত্র কোনও ভদ্দরলোকের পক্ষে পাঁচ মিনিটের বেশি সহ্য করা সম্ভব নয়। সুতরাং টিভিটা বন্ধই রাখি।

ঘরে একটা খালি ফ্রিজ আছে। আমার বরফ লাগে না, তাই এটাও অকেজো। কিন্তু কাজে লাগাবার একটা বুদ্ধি বেরিয়ে গেল। প্রয়োজনই তো উদ্ভাবনার জননী।

আজকাল পানীয় জল সম্পর্কে সকলেরই শুচিবাই হয়ে গেছে। অল্প বয়েসে গ্রামগঞ্জে, অচেনা দেশে যখন যে রকম জল পেয়েছি, তাতেই চুমুক দিয়েছি, কিছু হয়নি তো! এর মধ্যে কি সারা পৃথিবীর জল দূষিত হয়ে গেল? অনেকেরই হাতে-হাতে পয়সা দিয়ে কেনা বোতলের জল। কলকাতাতেও বোতলের জল এখন দ্রুত প্রসারমান ব্যাবসা। সব বোতলের জল কতটা জীবাণুমুক্ত আর নির্ভরযোগ্য তার ঠিক নেই, তবু বাড়ির জলের ওপর আর ভরসা নেই। নেমন্তন্ন বাড়িতেও এখন দেওয়া হয় বোতলের জল।

ফ্রান্সে কিংবা উত্তর আমেরিকায় কলের জল সম্পূর্ণ নির্ভয়ে পানের উপযুক্ত বলে ঘোষণা করা হলেও সেখানেও দেখি অনেকে বোতলের জল কেনে। কলম্বিয়ায় কলের জল সম্পর্কে সেরকম কোনও ঘোষণা নেই। সুতরাং বিশ্বাস করা যায় না।

প্রথম রাতে এসেই দু-বোতল জল কিনেছিলাম হোটেল থেকে। বেশ চড়া দাম। এগারো বারো দিন থাকতে হবে, প্রতিদিন দু-বোতল জল অন্তত লাগবেই, অনেক টাকা বেরিয়ে যাবে। আমাকে হাতখরচও দেয়নি।

বাথরুমের কলে গরম জল-ঠান্ডা জল পাওয়া যায়। গরম জলটা সকালের দিকে খুবই গরম থাকে, বেলা হলে তার তেজ কমে যায়। সকালবেলা গরম জলের কলটা খুলে রাখলে একটু পরে ধোঁয়া বেরুতে শুরু করে। এত গরম জলে কোনও বীজাণু থাকতে পারে না। একটা কাঁচের বোতলে সেই জল ভরে নিলাম। ফুটন্ত জলে কাঁচের বোতল ফেটে যেতে পারে, তাই কায়দা করতে হল, ঠান্ডা জলের কলটাও খুলে রেখে তার তলায় রইল আমার বোতলের পেছন দিকটা।

গরম জলে বোতলটা ভরে গেলে সেটা এমনই গরম হয়ে যায়, যে সেটা হাতে ধরা রাখা যায় না। তা হলে বোতলটা আগে থেকেই তোয়ালে দিয়ে মুড়ে নিতে হবে। সেই অবস্থায় বাথরুম থেকে বেরিয়ে বোতলটা ভরে দিতে হবে ডিপ ফ্রিজে। সেখানেও কাঁচের বোতল বেশিক্ষণ থাকলে ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা, তাই আধঘণ্টা পরে বার করে রাখতে হয় অন্য তাকে।

এইভাবে দু-তিন বোতল পানীয় জল তৈরি করা আমার প্রতিদিন সকালের প্রথম কাজ।

এ যেন গ্রামের মেয়েদের পুকুরঘাটে জল আনতে যাওয়ার মতন। আমিও বোতল ভরতে ভরতে গান ধরি : তরী আমার হঠাৎ ভেসে যায়…। কিংবা, ঘাটে বসে আছি আনমনা, যেতেছে বহিয়া সুসময়…কিংবা, ক্ষণে ক্ষণে, মোর মনে-মনে, শুনি অতলজলের আহ্বান। মন রয়না, রয়না ঘরে, মন রয়না–

সন্ধের পর একটা গেলাসে হুইস্কি ঢেলে তার সঙ্গে ঠান্ডা জল মিশিয়ে, গেলাসটা হাতে নিয়ে দাঁড়ালাম জানলার ধারে। সামনেই আলোয় সাজানো পাহাড়। ঠান্ডা করা ঘরে সব দরজা-জানলা বন্ধ, তাই বাইরের কোনও আওয়াজ শোনা যায় না। শব্দহীন নৈশদৃশ্য।

কল্পনায় যেন দেখা যায়, সাড়ে চারশো বছর আগে একদিন ওই পাহাড়ের ওপর এসে দাঁড়িয়েছিল দুই অশ্বারোহী। স্পেন থেকে অভিযানে বেরিয়ে বিভিন্ন অঞ্চল তছনছ করতে-করতে তারা এসে পৌঁছেছিল এখানে। একটা ছবির মতো উপত্যকা, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একটা স্ফটিকস্বচ্ছ জল প্রবাহিত নদী, চারদিকের পাহাড়ে নিবিড় অরণ্য, উপত্যকায় স্থানীয় হলুদ ফসলের খেত, তাদের শান্তিপূর্ণ, নির্বিরোধী জীবন। সভ্যতায় তারা উন্নত, অস্ত্র ধরতেও জানে। কিন্তু তারা ঘোড়সওয়ার দেখেনি, জানে না আগ্নেয়াস্ত্রের কথা। সেই দুই অশ্বারোহী ফিরে গিয়ে ডেকে এনেছিল তাদের সৈন্যবাহিনী, এই মনোরম উপত্যকাটি জয় করার জন্য তারা দ্রুতগতির বাহন আর বারুদভরা অস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে আদিবাসীদের শান্ত সভ্যতা।

আমাদের দেশে যখন মোগল শাসন চলছে, তখন ইওরোপের স্পেন, পোর্তুগাল, ব্রিটেনের মতো ছোট-ছোট দেশের দুঃসাহসী মানুষেরা সমুদ্র পেরিয়ে এদিকে এসে অস্ত্রের জোরে দখল করছে বিশাল বিশাল ভূমি, চালিয়ে যাচ্ছে হত্যালীলা, সেসব আমরা খবরও রাখিনি।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে হল, ঘরটা দুলছে।

মেঝেটাও দুলছে, ছাদও দুলছে। ভূমিকম্প শুরু হল নাকি?

দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। তা হলে তো ছোটাছুটি শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু অন্য কোনও ঘরের তো দরজা খুলল না। আমি একলা দৌড়ব নাকি? আমি ছাড়া আর কেউ টের পায়নি, তা কি হয়?

একটু যেন কমেছে মনে হল, ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।

সঙ্গে সঙ্গে খাটসুদু আমি যেন বোঁ করে ঘুরে গেলাম, ঘরের ছাদটাও একবার নীচে নেমে আবার উঠে গেল ওপরে।

এখনও বাইরে কোনও গোলমাল নেই। আবার উঠে এসে দরজাটা খুললাম, লম্বা টানা প্যাসেজটা একেবারে শুনশান।

তা হলে ভূমিকম্প নয়, আমারই মাথা ঘুরছে।

এর আগে দু-একদিন স্নানের সময়ও মনে হয়েছিল একটু একটু দুলছে বাথরুমটা, জাহাজের মতন। তখন ভেবেছি, মনের ভুল।

এখন আর মনের ভুল নয়, সত্যিই খাট-বিছানা, দেওয়াল, আয়না, ছাদ সবই দুলে উঠছে মাঝে-মাঝে।

শুয়ে পড়ে ভাবলাম, এটা কি কোনও অসুখ? তা হলে তো অসুখটা বেশ ভালো। ঘরের সবকিছু যদি দোলে, তা হলে একঘেয়েমি কেটে যায়। সবকিছু কেন স্থায়ীভাবে এক জায়গায় থাকবে?

এরকম দুলুনি বেশ উপভোগ্য। চলুক না আরও অনেকক্ষণ।

এই কৌতুক অবশ্য বেশি চালানো যায় না। এটা গুরুতর অসুখ হয় যদি। ব্লাড প্রেশার খুব বেড়ে গেছে? হার্ট অ্যাটাকের আগে এরকম হয়?

এত দূর দেখে এসে একলা একলা মরে-ফরে যাব নাকি?

মৃত্যুচিন্তাটা মোটেই সুখকর লাগল না।

ডাক্তার ডাকব? আমার মেডিকাল ইনসিওরেন্স আছে। এত রাতে কি ডাক্তার পাওয়া যাবে?

হোটেলের লোকদের উত্যক্ত করে একজন ডাক্তার সংগ্রহ করা যেতে পারে। কিন্তু অত ঝামেলার পর ডাক্তার এসে যদি বলেন, আপনার কিছুই হয়নি? হার্ট ঠিক আছে, ব্লাড প্রেশার ঠিক আছে, ওরকম একটু-আধটু মাথা ঘোরা সকলেরই হতে পারে! আপনি শুধু-শুধু ভয় পেয়েছেন।

সেটা একটা লজ্জায় ব্যাপার হবে। আমি কি কখনও অকারণে মৃত্যুভয় পেয়েছি? বরং মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কি অনেক খেলা খেলিনি? এখন আমার মনের জোর কমে যাচ্ছে?

দরজাটা বন্ধ রাখা কি ঠিক হল?

এরপর যদি উঠতেই না পারি? ডাক্তার ঢুকবে কী করে? দরজা ভেঙে! ও না, হোটেলের লোকদের কাছে আর একটা চাবি থাকে।

একটু-একটু বাথরুম পাচ্ছে। যাওয়া উচিত নয়। সত্যিকারের হার্ট অ্যাটাক হলে, এক পাও হাঁটা উচিত নয়। বুদ্ধদেব বসু বাথরুমের মধ্যে শেষ নিশ্বাস ফেলেছিলেন। অনেকেই তখন বলেছিল, উনি যদি ওখানে না গিয়ে তখুনি চিত হয়ে শুয়ে পড়তেন, তা হলে হয়ত বেঁচে যেতে পারতেন তখনকার মতন, চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া যেত।

সত্যিকারের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না তা বুঝব কী করে? আগে তো হয়নি, তাই জানি না কী তার উপসর্গ।

কোনও মানুষই দুবার মরে না, তাই কারুকেই জানিয়ে যেতে পারে না তার চরম মুহূর্তটির অনুভূতি। ভাস্কর বলেছিল, এটা কী হচ্ছে, এটা কী হচ্ছে।

ভাস্করের পাশে ছিল তার দুই বন্ধু, এখানে আমার পাশে কেউ নেই।

এখনও বেশ মাথা ঘুরছে। কোনওরকমে উঠে সর্বরোগহর দুটি অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট খেলাম, তাতেও বিশেষ সুবিধে হল না।

যদি কালকেও এটা চলতে থাকে, আমি চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলি, তাহলে পুপলু চান্দ্রেয়ীকে খবর দিতে হবে। কাজ ফেলে ছুটে আসতে হবে ওদের। গৌতম বা আরও দু-একজন বন্ধুও আসতে পারে, ওদের কত ঝঞ্ঝাটে পড়তে হবে, সেটাও খুবই লজ্জার ব্যাপার।

তার চেয়ে একেবারে টেঁসে যাওয়াই ভালো।

তাতেও আমার ডেডবডি নিয়ে ওদের বিড়ম্বনা হবে খুবই, কিন্তু তখন আর আমার লজ্জা পাওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই।

ডেডবডি! এখন এই যে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত যে শরীর, তার নাম সুনীল। যে মুহূর্তে আমার শেষ নিশ্বাস পড়বে, তখন থেকেই এ নামের অবসান। তখন তার এই শরীরটাকে কেউ সুনীল বলবে না তখন এটা সুনীলের ডেডবডি। রবীন্দ্রনাথকে নিমতলা শ্মশাটঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়নি, নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁর প্রাণহীন দেহ।

তা হলে প্রাণটাই মানুষের অস্তিত্ব, শরীর নয়।

কেউ কেউ প্রাণের বদলে বলে আত্মা। যা নাকি অজয়, অক্ষয়। আত্মার বিনাশ হয় না, সে এক শরীর ছেড়ে গিয়ে আবার নতুন দেহ ধারণ করে। শুধু যারা মহাযোগী ও মহাপুণ্যবান, তাঁদের আর পুনর্জন্ম হয় না, তাঁদের আত্মা মিশে যায় পরমাত্মায়।

এই চমৎকার রূপকথাটি বহু যুগ ধরে চলে আসছে বটে কিন্তু কিছু মানুষ এখনও তা সত্যি বলে বিশ্বাস করে কী করে?

পুনর্জন্মে বিশ্বাসও এক ধরনের মায়া, কিছুতেই ছেড়ে যেতে হচ্ছে করে না এ পৃথিবী। জরা ও মৃত্যু এসে একদিন শরীরটা ধ্বংস করে দেবেই, তখনও মনে হয় বিশ্বাস থাকে, আবার নতুন শরীর নিয়ে জন্ম হবে। বিপ্লবী এই বিশ্বাস নিয়ে ফাঁসির মঞ্চে উঠেছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা যুগ্মভাবে আত্মহত্যা করায় সময় ভাবে, পরজন্মে আবার দেখা হবে।

আমি জানি, আমার মৃত্যুতেই সবকিছু শেষ। শরীর বাদ দিয়ে প্রাণ বা আত্মা বলে কিছু থাকে। শেষ নিশ্বাসটা নিছকই শেষ নিশ্বাস, তার সঙ্গে ফুরুৎ করে অন্যকিছু বেরিয়ে যায় না।

কী করলাম এতদিন এই জীবনটা নিয়ে?

শুধু খেলাই তো খেলে গেলাম। এই লেখা-লেখা, সবই তো খেলা। প্রেম-ভালোবাসাও খেলা। এই খেলায় জয়ী হতে চাইনি তো সবসময়। কখনও-কখনও হেরে গিয়েও মজা লেগেছে। কিছু কিছু পরাজয় মনের তেজ বাড়িয়ে দেয়।

কাকে বলে জীবনের সার্থকতা?

অকালে ঝরে না যাওয়াই তো ফুল ও ফলের সার্থকতা। অসময়ে শুকিয়ে না যাওয়া নদীর সার্থকতা।

মাঝপথে থেমে না যাওয়াই যেমন একটা গানের সার্থকতা, সব খেলারও তো তাই-ই। তবু তো যখন-তখন খেলা ভেঙে যায়। আজ রাত্রির নির্জনতার সঙ্গে খেলাটা যদি হঠাৎ এখুনি শেষ হয় তো হোক, মন্দ কাটল না তো এই পৃথিবীতে।

হঠাৎ একটা গান মনে পড়ে গেল! কে বলে যাও, যাও তোমার যাওয়া তো নয় যাওয়া…কী তাল এটা, দাদরা নাকি?

দাদরা ছমাত্রা, কাহারবা আটমাত্রা।

পাশ ফিরে ছোট টেবিলটায় তাল দিতে লাগলাম, ধাধিন না, তা ধিন না।

গানটার পরের কথাগুলো কী?মনে পড়ছে না।

কিন্তু ভুলে যাওয়া সব গানই, এক সময় ফিরে আসে। পথিক আমি পথেই বাসা, আমার যেমন যাওয়া তেমনি আসা–

হে ক্ষণিকের অতিথি, এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া এটাও দাদরা না! এক সময় তবলা শিখেছিলাম। কতকাল টেবিলের ওপর তাল দিইনি।

মাথাটা একটু এপাশ থেকে ওপাশে নাড়াতেই আবার সবকিছু ঘুরতে থাকে। ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া। এই গানটা ভালো, কিন্তু কোন অমরার বিরহিনীরে..এ জায়গাটা দুর্বল, একটু ন্যাকা-ন্যাকা।

ধা ধিন না, তা ধিন না।

বুকেও একটু-একটু ব্যথা করছে নাকি? কিংবা মনের ভুল? ভুল হোক ঠিক হোক আর কিছু করার নেই। এখন কারুকে ডাকা সম্ভব নয়। ধা ধিন না, তা ধিন না, হে ক্ষণিকের অতিথি

এ কী, হয়তো আমি একটু পরেই মরে যাব। এখন টেবিলে তবলার তাল ঠুকছি? অন্য কেউ দেখলে হাসবে না?

অন্য কেউ দেখার নেই। তা ছাড়া হাসির কী আছে? শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাল ঠিক রাখতে হবে। সুর ঠিক রাখতে হবে।

পাছে সুর ভুলি, সে-ই ভয় হয়, পাছে শূন্যতারই জয় হয়…

এ গানটায় সুর ঠিক আছে? ‘ভয়’ এই জায়গাটায় হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠতে হবে।

কে?

দরজায় কি কোনও শব্দ হচ্ছে? না-তো।

জানলায় কেউ টক টক করল?

আটতলার ওপর বাইরের দিকে জানলায় কে টক টক আওয়াজ করবে? তবে, হাওয়ার শব্দ? ওখানে কে? কেউ না। হাওয়া। হাওয়া কি কেউ না?

সব আলো নিভে গেল হঠাৎ? লোডশেডিং? এ দেশেও হয়? লোডশেডিং নয়, পাওয়ার কাট। ধ্যাৎ কী হচ্ছে আমার। আলো তো ঠিকই আছে। মানুষ বেশিক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে পারে না। মাঝে-মাঝে চোখের পাতা তো পড়েই। সেই মুহূর্তের ভগ্নাংশেও তো সব অন্ধকার, কিন্তু অন্য সময় সেটা আমরা খেয়ালই করি না।

ঘুমও তো অন্ধকার।

কিন্তু আমার ঘুমও আসছে না।

চুপ করে চেয়ে আছে আলো। এ কথাটার কোনও মানে হয়? আলো কি চেয়ে থাকে, না আমরা তাকাই আলোর দিকে।

তবু, এখন যেন মনে হচ্ছে, টেবিল ল্যাম্পটা ঠিক যেন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিছু একটা বলতে চায়।

চওড়া রাইটিং টেবিলটার ওপর দু-তিনখানা বই, আমার কবিতা লেখার খাতা, এক গেলাস জল–এই জলের গেলাসটাও চেয়ে আছে, দেওয়ালে একটি মাত্র ছবি, সমুদ্রের দৃশ্য, সমুদ্র চেয়ে আছে, ফ্রিজটাও কিছু বলতে চায়, ওয়ার্ডরোবের দরজাটার একটা পাল্লা খোলা, তার ভেতরে কেউ না কেউ না, খোলা পাল্লাটাই যেন তাকিয়ে থাকার মতন–

এ কী হচ্ছে আমার? এই কদিনে হোটেল ঘরটা চেনা হয়ে গেছে, কোন জিনিসটা কোথায় একেবারে মুখস্থ, এখন আমার মাথা ঘুরলেও, কোনও জিনিসই জায়গা বদলায়নি, এদিকে ছবিওয়ালা দেওয়ালের ঠিক উলটো দিকে ফ্রিজ, তবু, এরা সবাই যেন আজ জীবন্ত, টেবিল বাতির বালবটা, জলের গেলাস, ছবি, ফ্রিজ, এরা যেন উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে, কিছু একটা বলতে চায়।

কিছু একটা বলতে চায়।

কিছু একটা বলতে।

কিছু একটা।

তারপরেই কীসের একটা শব্দে আমি কেঁপে উঠলাম। খুব জোর শব্দ। সেই শব্দটাও কাঁপছে কিংবা দুলছে।

প্রথমে চিনতেই পারলাম না শব্দটা।

তারপর বুঝতে পারলাম। টেলিফোন।

আমার ঘোর কেটে গেল। মনে হল, সবকিছুই তো স্বাভাবিক, ঠিকঠাক আছে।

টেলিফোনটা হঠাৎ যেন বেশি জোর ঝনঝন শব্দ করে বেজে উঠল।

মাথার বালিশ থেকে সেটা খুব দূরে নয়, হাত বাড়িয়ে ধরা যায়। রিসিভারটা তোলার আগে মনে হল, এবার নিশ্চয়ই কামাল। নইলে, এত রাত্রে কে আর আমাকে মনে করবে?

কামাল নয়, অন্য একটা অচেনা কণ্ঠস্বর জিগ্যেস করল, আর ইউ সুনীল?

হ্যাঁ।

তোমার ঘরে কি ইলিয়ানা আছে?

মাথার মধ্যে যেন চড়াৎ করে একটা শব্দ হল। ইলিয়ানা? আমার ঘরে? সেই গাম্ভীর্য মাখা মধ্যবয়েসিনী সৌন্দর্য প্রতিমাকে আমি দেখেছি মাত্র কয়েকবার, প্রায় কোনও কথাই হয়নি, তিনি আসবেন আমার ঘরে? এত রাতে? ম্যাডেলিন শহরে তিনি এসেছেন কি না তাও তো জানি না। তাঁর নামটা ছাড়া কিছুই জানি না তাঁর সম্পর্কে।

কে জিগ্যেস করছে এরকম উদ্ভট প্রশ্ন?

ইলিয়ানা আমার ঘরে থাকবেন কেন?

সেই লোকটি আবার জিগ্যেস করল, তোমার সঙ্গে ইলিয়ানার আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল না?

মোটেই না। সে প্রশ্নই ওঠে না।

তুমি ইলিয়ানাকে চেনোনা? একটি কলেজের ছাত্রী, কবিতা লেখে?

আবার মাথাটা ঘুরে গেল। এ অন্য মেয়ের কথা বলছে। কলেজের ছাত্রী, তার মানে অনেক কম বয়েস।

এবার, দৃঢ় স্বরে বললাম, না, আমার সঙ্গে কোনও মেয়ের আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল না।

তুমি শিওর। ইলিয়ানা তোমার ঘরে যায়নি?

অফ কোর্স আই অ্যাম শিওর!

লোকটি ফোন রেখে দিল।

কয়েকটা মুহূর্ত আমার বিমূঢ় অবস্থায় কাটল। একজন অচেনা লোক কেন জানতে চাইল এসব কথা?

আজ কেন, এর মধ্যে কোনওদিন, কোনও মেয়ের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়নি। কোনও পুরুষেরও না। এ যাত্রায় এমনই এক ধরনের নিস্পৃহতা আমাকে পেয়ে বসেছিল যে কোনও পুরুষ বা নারীর সঙ্গেই হৃদ্যতা হল না।

আমার ঘরে একবারই শুধু একজোড়া তরুণ-তরুণী এসেছিল, তারা একটা লিটল ম্যাগাজিন চালায়, তারা আমার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিল। তারা দুজনেই পড়তে গিয়েছিল টেক্সাসে, ভালো ইংরিজি জানে, ঘোর আমেরিকা-বিদ্বেষী হয়ে ফিরে এসেছে। তাদের মতে, কলম্বিয়ার সব অশান্তির মূলে আমেরিকার সরকার।

আর তো কেউ আসেনি।

এই লোকটার টেলিফোনের মর্ম কী? সে ভুল নাম্বারে ফোন করেনি, আমার নাম ধরে ডেকেছে, ইংরিজিও বলতে পারে।

এটা মেয়ের দালালি হতে পারে কি? ভাষাটা তো সেরকম নয়, কথা বলছিল খানিকটা ধমকের সুরে। ইলিয়ানা নামটা বলে প্রথমে আমাকে খুব ঘাবড়ে দিয়েছিল।

কিংবা, এমন হতে পারে, এই লোকটি ইলিয়ানা নামের এক যুবতীর প্রেমিক। সেই ইলিয়ানা ওকে ফাঁকি দিয়ে সময় কাটাচ্ছে কোনও বিদেশি কবির সঙ্গে। তাই ও খোঁজ করছে প্রত্যেক ঘরে-ঘরে।

কিন্তু কারুর ঘরে যদি ইলিয়ানা গোপনে এসে থাকে, তা হলে সে কী তা স্বীকার করবে।

এই লোকটিও টেলিফোনে আমার অস্বীকার শুনে বিশ্বাস করবে কি? না দেখতে আসবে।

এক্ষুনি সে যদি এসে বলে, দরজা খোলো, ইলিয়ানা তোমার ঘরের ভেতরে আছে কিনা দেখব!

কল্পনায় দেখতে পেলাম সেই ল্যাটিন প্রেমিককে। এরা এমনিতে বেশ মজাখোর গান-বাজনা নিয়ে মেতে থাকে, কিন্তু প্রেমে ধাক্কা খেলে হিংস্র হয়ে ওঠে। হয়তো তার সঙ্গে আছে রিভলভার কিংবা লম্বা ছুরি।

সে যদি উত্তেজিত হয়ে ছুটে আসে তাহলে কি আমার দরজা খোলা উচিত?

এই আকস্মিক টুকরো ব্যাপারটার জন্য আমার অসুখটার কথা ভুলেই গেলাম। উঠে গিয়ে বসলাম চেয়ারে।

আসুক সে, আমি খুলে দেব দরজা।

একটু আগে মৃত্যুর জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। এটাও যদি একটা খেলা হয়, এ খেলায় দরজা বন্ধ রাখতে নেই।

প্রতি মুহূর্তে ভাবছি, একটি উগ্রমূর্তি এসে দরজায় আঘাত করবে। তার জন্য অপেক্ষা।

কিছু কি বাকি রয়ে গেল? মনে পড়ে গেল, তারাশঙ্করের কবি উপন্যাসের একটা গান : জীবন এত ছোট কেনে, ভালোবেসে মিটিল না সাধ…।

এবং আশ্চর্য! কত প্রতিশ্রুতিই তো রক্ষা করতে পারিনি, তবু মনে পড়ল একটি যুবকের কথা, তাকে চিঠি লিখব কথা দিয়েছিলাম, বোধহয় সে চিঠি আর লেখা হবে না। লস অ্যাঞ্জেলিসে দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে। তার নাম বাবুল, ভালো নাম রেহুল আহমেদ, সে পাগলের মতন ভালোবাসে আমাকে, সে-ই সর্বশেষ, তাই তার কথাই বেশি করে মনে পড়ছে।

কখন এসে দরজায় ধাক্কা দেবে এক ব্যর্থ প্রেমিক, কিংবা মৃত্যু?