[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

৪৯. আবার সূর্যর অ্যাপার্টমেন্টে

কদিন বাদে আবার ফিরে এলুম সূর্যর অ্যাপার্টমেন্টে। মুখার্জিদা ক্রিসমাসের আগের রাতে তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন করে রেখেছিলেন আগে থেকেই। এবং বলে রেখেছিলেন, আয়ওয়া থেকে আমি যেদিন ফিরব, সেদিন ওঁকে খবর দিলেই উনি আমাকে গাড়ি করে নিয়ে আসবেন।

কিন্তু মুখার্জিদাকে আর জ্বালাতন করিনি, বাসেই চলে এলাম। বাস স্টেশন থেকে সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়ে হেঁটেই চলে এলুম বাড়িতে। এর মধ্যে শীত অনেকটা সহ্য হয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে মাথায় টুপি পরতে ভুলে যাই। তবে গ্লাভস না পরলে চলে না, আঙুলগুলো কয়েক মিনিটে অবশ হয়ে যায়।

অ্যাপার্টমেন্টের দরজার চাবি খুলতে গিয়ে মনে হল, কী যেন নেই। কী নেই?

সঙ্গে-সঙ্গে দুম করে কেউ যেন একটা ঘুসি মারল আমার বুকে। মাথার মধ্যে বজ্রপাত হল। আমার কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা?

বাস থেকে নামার সময় সুটকেসটা ঠিকই নিয়েছি পেছন থেকে, কিন্তু ঝোলা ব্যাগটা রেখেছিলুম মাথার ওপর র‍্যাকে, সেটার কথা একদম মনে পড়েনি।

ইচ্ছে হল, তক্ষুনি দৌড়ে চলে যাই। কিন্তু দৌড়ে কোনও লাভ নেই, গ্রে হাউন্ড বাস এই দশ মিনিটে অন্তত দশ মাইল দূরে চলে গেছে।

দৌড়ে টেলিফোনের কাছে যেতে গিয়ে আমি ডাইনিং টেবিলে খুব জোর একটা ধাক্কা খেলুম। কিন্তু তখন ব্যথা বোধ করারও সময় নেই। টেলিফোনের পাশেই দেওয়ালে-সাঁটা একটা কাগজে সূর্য কতকগুলো জরুরি টেলিফোন নাম্বার লিখে রেখেছে। তার মধ্যে গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশনের নম্বর নেই। সূর্য ভালো চাকরি করে, সে সব সময় প্লেনেই যাতায়াত করে নিশ্চয়ই। সুতরাং টেলিফোন গাইড ঘাঁটতে হল।

তারপর টেলিফোনের বোতাম টিপেই আমি ব্যস্তভাবে জিগ্যেস করলুম, আয়ওয়া থেকে যে বাসটি একটু আগে এসেছিল, সেটা কি ছেড়ে গেছে?

ওপাশ থেকে একটি মেয়ের ঠান্ডা গলা ভেসে এল, আয়ওয়া থেকে কোন বাস? কত নম্বর? কুড়ি মিনিটের মধ্যে দুটি বাস এসেছে।

নম্বর? এই রে, বাসের নম্বরটা তো খেয়াল করিনি। টিকিটে নম্বর লেখা থাকে না, এক টিকিটে যেকোনও বাসে চড়া যায়। দূরপাল্লার বাসে উঠলে বাসের নম্বর মনে রাখা খুবই দরকার কারণ মাঝে-মাঝে নামতে হয়, তখন অনেক বাসের মধ্যে নিজের বাসটি খুঁজে নিতে হয়। কিন্তু এসেছি মাত্র এক স্টেশন, সেইজন্য মাথা ঘামাইনি।

আমি ব্যাকুলভাবে বললুম, দেখুন, আমি একটা হ্যান্ডব্যাগ ফেলে এসেছি, খুবই দরকারি সব জিনিস আছে, সেটা না পেলে আমি খুবই বিপদে পড়ে যাব–।

ওপার থেকে মহিলাটি বলল, আয়ওয়া থেকে আসা একটি বাস এখনও দাঁড়িয়ে আছে, আপনি একটু ধরুন, আমি দেখে আসছি। কী রঙের ব্যাগ ছিল?

–খয়েরি রঙের, ভেতরে একটা ক্যামেরা, আর আমার প্লেনের টিকিট, তিন প্যাকেট ক্যামেল সিগারেট আর…

মহিলাটি একটুবাদে লাইনে ফিরে এসে বললেন, না। ও-বাসে ওরকম কোনও ব্যাগ নেই। আগের বাসটি ছেড়ে গেছে।

–তা হলে কী হবে?

মহিলাটি নির্লিপ্ত গলায় বললেন, আপনার ঠিকানাটা বলুন, সন্ধান পেলে আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দেব।

–বাসটা ছেড়ে চলে গেছে, আর কী করে সন্ধান পাবেন?

–বাসটা কোথাকার ছিল?

–নিউ ইয়র্কের।

–তা হলে এরপর শিকাগোয় থামবে। সেখানে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।

–দয়া করে যদি একটু বিশেষ চেষ্টা করেন। ওই ব্যাগটির মধ্যে আমার প্লেনের টিকিট আছে, ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের–

–নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।

টেলিফোন রেখে আমি নিঝুম হয়ে বসে রইলুম। যেন আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। ব্যাগটা যদি পাওয়া যায়, তা হলে আমি ফিরব কী করে? আমার টিকিট…।

তাড়াতাড়ি সুটকেসটা খুললুম। উলটে ফেলে দিলুম সব জিনিসপত্র। যাক, পাসপোর্টটা আছে। অনেকদিন পাসপোর্ট দরকার হয়নি। তাই বার করিনি। প্লেনের টিকিটটা কেন সুটকেসে রাখিনি?হ্যান্ডব্যাগটা যে হারাবে তা কি জানতুম? আমার শেষ সম্বল আর ছাপ্পান্নটি ডলার, তাও ওই ঝোলার মধ্যে, আমার মানিব্যাগ বা পার্স ব্যবহার করার অভ্যেস নেই, টাকা রাখি বইয়ের মধ্যে। আজ যদি ওভারকোটের পকেটেও রাখতুম।

ক্যামেরা ট্যামেরা গেছে তার দুঃখ নেই, কিন্তু প্লেনের টিকিটটা গেছে বলেই খুব অসহায়বোধ করতে লাগলুম। ওটার জন্য সবসময় মনে একটা জোর ছিল, যখন খুশি ফিরে যাওয়ার স্বাধীনতা ছিল।

বাসটা শিকাগো পৌঁছতে চার-পাঁচ ঘন্টা লাগবে, তার আগে কিছুই জানা যাবে না। এই সময়টা কীভাবে কাটাব? অনর্থক বসে-বসে চিন্তা করে তো লাভ নেই, তাই আমি শুয়ে পড়লুম। ওভারকোট কিংবা জুতো মোজাও খুলতে ইচ্ছে করল না। মনের যদি একটা সুইচ থাকত, তা হলে এখন সেটা অফ করে দিতুম। কিংবা সেরকম কোনও ঘুমের ওষুধ, যা খেলে এক নিমেষে ঘুমিয়ে পড়া যায়। ভীষণ রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। এরকম ভুল যে করে তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ব্যাগটা যদি ফেরত না পাই, তা হলে কত রকম যে ঝামেলায় পড়ব, তা ভাবতেই পারছি না।

ফেরত পাব কী? আগে জানতুম, এদেশে কোনও কিছুই হারায় না। এটা ডাকাতদের দেশ, এখানে কেউ ছিচকে চুরি করে না। কিন্তু সেই সুদিন আর নেই। নিউ ইয়র্কে একটি মেয়ের হাত থেকে ব্যাগ ছিনতাই-এর ঘটনা তো আমি নিজের চোখেই দেখেছি।

মুখার্জিদাকে ফোন করা উচিত। উনি এদেশে এতদিন আছেন, উনি নিশ্চয়ই জানবেন কীভাবে খোঁজখবর করতে হয়। কিন্তু নিজের দীনতার কথা বা নির্বুদ্ধিতার কথা কি সাধ করে অন্য কারুকে জানাতে ইচ্ছে করে?

খবরের কাগজ খুললুম। কিছুতেই মন বসে না। টিভি খুললুম, সব কিছুই উৎকট বাঁদরামো মনে হচ্ছে। মনের মধ্যে ঢংঢং করে অবিরাম বাজছে একটিই প্রশ্ন, যদি ফেরত না পাই? যদি ফেরত না পাই?

ওভারকোটের সব ক’টা পকেট উলটে দিলুম। অনেক খুচরো পয়সা জমে আছে। ডাইম আর কোয়ার্টারগুলো আলাদা করে সাজিয়ে নিলুম। সব মিলিয়ে আট ডলার পঁচাত্তর সেন্ট, আরও খুচরো এক সেন্ট আছে কুড়ি-পঁচিশটা। এই এখন আমার যথা সর্ব! কথাটা উপলব্ধি করামাত্র খিদে পেয়ে গেল।

ঠিক পাঁচ ঘণ্টা পরে ফোন করলুম স্থানীয় বাস স্টেশনে। এবারে ফোন ধরেছে একজন পুরুষ।

–আমার হ্যান্ডব্যাগটার কোনও খবর পেয়েছেন?

–কীসের হ্যান্ডব্যাগ?

–দেখুন, আমি আয়ওয়া থেকে…

–আয়ওয়ার বাস এখনও আসেনি, আধঘন্টা পরে আসবে।

–না, শুনুন, অনুগ্রহ করে আমার ব্যাপারটা শুনুন–।

ডিউটি বদলে গেছে, আগের মহিলাটি নেই, এই পুরুষটি আমার ঘটনা কিছুই জানেন না। সব কিছু শোনার পর বললেন, না, শিকাগো থেকে কোনও খবর তো আসেনি, একটু আগেই একটা ফোন এসেছিল, কোনও হ্যান্ডব্যাগের কথা বলেনি–।

দয়া করে ওদের যদি আর একবার জানান। হ্যান্ডব্যাগটাতে আমার খুবই দরকারি জিনিসপত্র আছে।

–আপনি নিজেই শিকাগো বাস স্টেশনে ফোন করতে পারেন।

–দেখুন, আমি বিদেশি, ভারতবর্ষীয়, যদি একটু সাহায্য করেন, আমি বাসের নম্বরও জানি, আমি অতি নির্বোধের মতন কাজটি করেছি বটে, কিন্তু ব্যাগটা খুঁজে পাওয়া আমার খুবই দরকার।

আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, লোকটি অন্য একটা টেলিফোন তুলে আর কারুর সঙ্গে কথা বলছে, আমার কথা শুনছেই না।

আমি তবু নাছোড়বান্দার মতন বকবক করে যেতে লাগলুম। লোকটি এক সময় বলল, আপনার নাম ঠিকানা বলুন, খোঁজ পেলে জানাব।

–আপনার আগে যিনি ডিউটিতে ছিলেন, তিনি সব জানেন। আমার নাম এই…

–ও, হ্যাঁ, একটা শ্লিপ লেখা আছে দেখছি। আপনার ব্যাগটার বর্ণনা দিন, আপনার ফোন নম্বর দিন, কোনও খবর পেলে নিজেরাই জানাব। হ্যাঁ, শিকাগো আর নিউ ইয়র্কে খবর দিচ্ছি।

একটি বিনিদ্র রাত্রি কাটাবার পর পরদিন সকালে মুখার্জিদাকে সব ব্যাপারটা খুলে বলতেই হল।

মুখার্জিদা তাঁর বাড়ি থেকে সব মিলিয়ে প্রায় গোটা পনেরো ফোন করলেন। তাতেও বিশেষ কিছু সুরাহা হল না। আমার বিমান কোম্পানির কাছ থেকে জানা গেল যে আমার জন্য একটা ডুপ্লিকেট টিকিট ইস্যু করানো যেতে পারে কিন্তু তার আগে, যেখান থেকে আমার টিকিট ইস্যু করা হয়েছে, অর্থাৎ কলকাতা অফিস থেকে আগে খবরাখবর আনতে হবে। তার জন্য সময় লাগবে।

মুখার্জিদা আমায় উপদেশ দিলেন যে, হয় আমার কোনও ট্রাভেল এজেন্টের শরনাপন্ন হওয়া উচিত কিংবা নিজেই শিকাগো গিয়ে যেন তদবির শুরু করি। আজকাল কোনও কাজই তাড়াতাড়ি হয় না।

ট্রাভেল এজেন্টের কাছে গেলে তাকে পয়সা দিতে হবে, আর শিকাগো যাওয়ার ভাড়াও আমার কাছে নেই। মুখার্জিদা এতটা জানেন না। সে কথা আমি মুখ ফুটে বলতেও পারলুম না।

বাস স্টেশন থেকে আমার হ্যান্ডব্যাগ সম্পর্কে কোনও নতুন খবর পাওয়া গেল না। নিউ ইয়র্ক বা শিকাগোতেও সেরকম কোনও ব্যাগ জমা পড়েনি।

দ্বিতীয় দিন কেটে যাওয়ার পর আমি নিশ্চিন্ত হলুম যে আমার ঝোলা ব্যাগ অন্য কারুর ঘাড়কে পছন্দ করে ফেলেছে। এদেশের ছেলেমেয়েরা ঘনঘন বিয়ে বদলায়, আমার ব্যাগেরও সেরকম শখ জেগেছে নিশ্চয়ই। নইলে, ওর গায়ে আমার ঠিকানা লেখা ছিল, অনায়াসেই ফিরে আসতে পারত।

মুখার্জিদা অতিশয় সহৃদয় মানুষ, কিন্তু মরে গেলেও আমি তাঁর কাছ থেকে টাকা ধার চাইতে পারব না। এর আগেই কয়েক জায়গায় গল্প শুনেছি, আমাদের দেশ থেকে কেউ-কেউ এদেশে বেড়াতে এসে জিনিসপত্র কেনাকাটির লোভে এখানকার কারুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়, দেশে ফিরে তার মা-বাবা বা বাড়ির লোককে ভারতীয় মুদ্রায় ধার শোধ করে দেবে। তারপর দেশে ফিরে অনেকেই সে কথা বেমালুম ভুলে যায়। আমাকেও যদি এরা সেরকম ভাবেন?

তা ছাড়া দেশে ফিরে সঙ্গে-সঙ্গে শোধ দেওয়ার সামর্থ্যও আমার নেই। এদিকে ডুপ্লিকেট টিকিটের ব্যাপারেও কোনও ভরসা পাচ্ছি না।

কিন্তু খুচরো ন’ডলারে আমার আর কতদিন চলবে? সূর্যর ভাঁড়ারের চাল-ডাল ধ্বংস করতে করতে প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। চিনি ছিল না। চা খাওয়ার জন্য একদিন চিনি কিনতেই হল। এদেশের দোকানে কম-ওজনের কিছু পাওয়া যায় না। চিনির প্যাকেট দু-পাউন্ডের। অগত্যা কিনতেই হল। তারপরেই অবশ্য মনে হল, ম্যাকডোনাল্ডের দোকানে কফি খেতে গেলে টেবিলের ওপর অজস্র ছোট-ছোট চিনির প্যাকেট পড়ে থাকে। তার যত খুশি নেওয়া যায়। ষাট সেন্ট দিয়ে এক কাপ কফি খেতে গিয়ে ওভারকোটের পকেট ভরতি বিনে পয়সার চিনি নিয়ে আসলেই হত। এই সব ভালো-ভালো বুদ্ধি পরে মাথায় আসে।

রাত্তিরবেলা খুব মন খারাপ লাগছিল। অনেকক্ষণ দোনামনা করার পর কানাডার দীপকদাকে একটা ফোন করলুম।

ফোন ধরলেন জয়তীদি। খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার, এত রাত্তিরে টেলিফোন? অনেকদিন তোমার পাত্তাই নেই। আমরা ভাবছিলুম, তুমি হারিয়ে গেলে কি না। সেই যে তোমার বাস অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, তারপর থেকে তো তোমার আর কোনও খবরই পাইনি!

আমি কাঁচুমাচুভাবে বললুম, জয়তীদি, দীপকদা আছেন? ওঁর সঙ্গে আমার একটা দরকার আছে।

–তোমার দীপকদা তো নেই। একটা কনফারেন্সে গেছেন, ভ্যাঙ্কুবারে। তিন দিন পরে ফিরবেন!

আমি নিরাশভাবে বললুম, নেই?

–কেন, কী দরকার? আমাকে বলা যায় না?

–না, মানে, আমার প্লেনের টিকিটটা হারিয়ে ফেলেছি। দীপকদার তো এক বন্ধুর ট্রাভেল এজেন্সি আছে শুনেছিলুম। উনি যদি সেই বন্ধুকে বলে আমার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন।

জয়তীদি উদ্দাম ঝর্নার মতন হাসতে-হাসতে বললেন, টিকিট হারিয়ে ফেলেছ? অ্যাঁ? বেশ হয়েছে! টিকিট হারালে কি আবার বিনা পয়সায় টিকিট পাওয়া যায় নাকি? তুমি পাগল! সে কেউ দেবে না! এখন কী হবে? থাকো, ওই মিড ওয়েস্টে বন্দি হয়ে? ওখানে চাষ বাস শুরু করো। তোমার আর দেশে ফেরা হবে না!

এদিকে আমার এই করুণ অবস্থা আর জয়তীদি মোটেই সেটাকে কোনও গুরুত্বই দিচ্ছেন। খালি ঠাট্টাইয়ার্কি করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত আমি বললুম, ঠিক আছে, জয়তীদি তিনদিন পর দীপকদা ফিরলে আমি আবার ফোন করব।

রিসিভার রেখে দিয়ে আরও দমে গেলুম। এই হৃদয়হীনা রমণীর সঙ্গে আর কোনওদিন কথা বলব না! এই বিশাল দেশে যে আমি কপর্দক শূন্য, তা উনি বুঝলেন না! পুরুষ মানুষরা হঠাৎ অসহায় অবস্থায় পড়লে মেয়েরা সেই ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করে। দীপকদা আবার এখন বাড়ি নেই। উনি থাকলে একটা কিছু ব্যবস্থা করতেনই। এই তিনদিন আমি কী করে কাটাব?

রাত মাত্র ন’টা। কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। খিদে পেয়েছে, কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠে দুটি চাল-ডাল ফুটিয়ে নেওয়ারও উৎসাহ নেই। খালি মনে হচ্ছে, আমার মুক্তি নেই, আমার মুক্তি নেই!

এই কটা মাসে কত রকম মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। অনেকের কাছ থেকেই আশাতীত সহৃদয়তা পেয়েছি। এদেশের বাঙালিরা অনেকেই বেশ সচ্ছল। হাজার খানেক ডলার দিয়ে কয়েকজন অবশ্যই আমাকে সাহায্য করতে পারেন। সূর্যর টেলিফোন যত খুশি ব্যবহার করতে পারি, যদি টেলিফোন তুলে কারুর কাছে চাই…। কিন্তু টেলিফোন করতে হাত ওঠে না। কারুর কাছে টাকা চাওয়া, ওঃ, সে যে এক অসম্ভব শক্ত কাজ। বারবার মনে পড়ছে মাইকেলের একটা লাইন, ‘প্রবাসে দৈবের বশে জীবতারা যদি খসে…’।

পরদিন বেলা এগারোটায় একটা ফোন এল। সাহেবের গলা শুনে ধক করে উঠল আমার বুক। তবে কি ফিরে এল আমার ব্যাগ?

সাহেবটি জিগ্যেস করল, তোমার নাম নীললোহিত?

আমি সোৎসাহে বললুম, হ্যাঁ। আপনি বাস স্টেশন থেকে বলছেন?

লোকটি বলল, না, আমি বলছি এয়ারপোর্ট থেকে। তোমার নামে একজন…লেটস সী, খুব শক্ত নাম, মিসেস জয়া-টি স-রো-সোয়া-টি একটি প্লেনের টিকিট পাঠিয়েছেন। কানাডার এডমন্টনের। তোমার ফ্লাইট বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। তুমি এখানকার কাউন্টারে এলেই টিকিট পেয়ে যাবে।

আমি তখনও বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা। টিকিট পাঠিয়েছে? আমার জন্য? কানাডা থেকে? জয়াটি কে? ওঃ হে, জয়তী সরস্বতী! জয়তীদি, জয়তীদি!