লস অ্যাঞ্জেলিসে বাংলাদেশিদের বইমেলা ও বড় আকারের সাংস্কৃতিক উৎসব এই প্রথম, তাই অভিজ্ঞতার অভাবে সময়-রক্ষা ও অনুষ্ঠানসূচিতে এলোমেলো ভাব রয়ে গেছে কিছুটা। অবশ্য উদ্যোক্তাদের আন্তরিকত ও নিষ্ঠার অভাব নেই। এখানে পেশা বা ব্যাবসায় যাই হোক, সবসময়। ব্যস্ত থাকতে হয়, তবু এইসব অনুষ্ঠানের জন্য যাঁরা স্বেচ্ছায় সময় দান ও খাটাখাটনি করতে আসেন, তাঁরা আসলে জন্মভূমির টান ভুলতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গীয়দের তুলনায় বাংলাদেশিরা অনেক ঘন ঘন স্বদেশে যায়।
একটা জিনিস লক্ষ করলাম, এখানকার বাংলাদেশি মানুষগুলি সবাই ভালো ছেলে, কেউ সিগারেট খায় না, সন্ধে আটটার পরেও কেউ গেলাস ধরার জন্য উসখুস করে না। ঢাকা শহরের মানুষদের মধ্যে অনেক বেশি উদ্দামতা দেখেছি।
আমেরিকায় এখন সিগারেট বিরোধী আন্দোলন একেবারে তুঙ্গে। বিধিনিষেধ আরোপ হতে হতে এখন শুধু খোলা মাঠ ও রাস্তাগুলি বাকি আছে। খুব শিগগিরি সম্ভবত সিঙ্গাপুরের মতন আমেরিকাতেও রাস্তায় ধূমপান নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। আমেরিকান পুরুষরা সবাই প্রায় ধূমপান ছেড়েছে, শুধু এখনও স্বাস্থ্য-সতর্কতা উপেক্ষা করে যাচ্ছে মেয়েরা, অনেক শহরে দেখেছি, দোকানের কাউন্টার সামলানো রমণীরা মাঝে-মাঝে দোকান ছেড়ে রাস্তায় গিয়ে, তুষারপাত কিংবা বৃষ্টির মধ্যেও দাঁড়িয়ে ফুক ফুক করে একটা সিগারেট টেনে আসছে।
বাঙালি নারী-পুরুষদের মধ্যে ধূমপায়ী আর দেখাই যায় না। আমার লজ্জা করে। অনেক সময়েই দেখি চতুর্দিকে ধূমপান বিরোধী হংসদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে বসে আছি আমি এক বেয়াদপ বক! আমার মস্তিষ্ক থেকে তাম্রকূটের টানটা কিছুতে যাচ্ছে না। সন্ধের পর একটু-আধটু সুরা পানেও এরা অনাগ্রহী! আমি আর নিজেকে শোধরাতে পারলাম না।
সন্ধের পরেও বইমেলার একটা দোকানে বসে থাকতে থাকতে মনে হয়, আমি এখানে কেন এসেছি? কেন একাকিত্ব বোধটা কাটছে না? এখানকার সব কিছুর মধ্যেই যেন আমি বেমানান।
কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা, কিন্তু আমার গন্তব্য সেখানেও নয়। এই আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব হচ্ছে অন্য একটি শহরে, তার নাম Madellin, উচ্চারণ অবশ্য ম্যাডেলিন নয়, ফরাসি ভাষার মতন স্প্যানিশেও পাশাপাশি দুটো এল থাকলে উহ্য হয়ে যায়, কিংবা বদলে যায়। আমি সে চেষ্টা করব না, ইংরিজি মতে ম্যাডেলিনই বলব।
এখান থেকে আমাকে যেতে হবে মায়ামি, সেখান থেকে বিমান বদল করে বোগোটা, আবার ছোট বিমানে ম্যাডেলিনে পৌঁছে একটানা যাত্রার সমাপ্তি।
মায়ামির ফ্লাইট ধরতে হল অতি ভোরে উঠে, কষ্ট করে শাহিন আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেল। বৃষ্টিহীন রোদ-ঝলমলে দিন, তবু এবারেও জানলা পাওয়া আমার ভাগ্যে নেই।
ফ্লোরিডার মায়ামি একটি জগৎবিখ্যাত প্রমোদ-নগরী, প্রকৃতিও এখানে বড়ই রূপসী। আমার হাতে পরবর্তী উড়ানের আগে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময়। ছোট হোক বা বড় হোক, পৃথিবীর সমস্ত বিমানবন্দরই প্রায় একই রকম বৈচিত্র্যহীন, সুতরাং বিমানবন্দরে অযথা বসে না থেকে শহরটা ঘুরে দেখা যেত অনায়াসে, তা আর হয়ে উঠল না। মায়ামি বিমানবন্দর আমেরিকা যাওয়া-আসার একটি প্রধান দ্বার বলে এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থার খুবই কড়াকড়ি। তা ছাড়া নিকটবর্তী কিউবা সম্পর্কেও আমেরিকার সরকারের শুচিবাই আছে। নানাবিধ অস্ত্রধারী শান্ত্রীরা মাঝে মাঝেই এক একটা হিংস্র কুকুর নিয়ে এসে সবকিছু শোঁকাচ্ছে।
বিমানে ওঠার আগে আবার একটি ঝঞ্ঝাট হল। যাত্রা বাতিল হওয়ার উপক্রম। পাসপোর্ট ভিসা পরীক্ষা করা হচ্ছে বারবার। একেবারে শেষ মুহূর্তে আমাকে আটকে দিয়ে বলা হল, আমার নাকি ভিসায় গণ্ডগোল আছে।
আমি দিল্লি থেকে কলম্বিয়ার ভিসা করিয়ে এনেছি, তার জন্য দণ্ড দিতে হয়েছে অনেক। আমি এ পর্যন্ত যত দেশে গেছি, তার মধ্যে কলম্বিয়ার মতন একটি ছোট, অকিঞ্চিৎকর দেশের ভিসা খরচ সবচেয়ে বেশি। তার আবার কীসের গণ্ডগোল?
মিলিটারির মতন পোশাক ও চেহারার সেই লোকটি বলল, এ ভিসা তুমি কোথা থেকে পেয়েছ?
বললাম, কলম্বিয়ার দিল্লি দূতাবাসের ছাপই তো রয়েছে, তা দেখেই বোঝা যাবে। লোকটি পাসপোর্টের সেই পাতাটি আমার চোখের সামনে ধরে বলল, এতে কোনও তারিখ নেই।
সত্যিই তো তাই। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আমাকে এক মাসের জন্য ভিসা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোন তারিখ থেকে কত তারিখ পর্যন্ত তার উল্লেখ নেই, সইয়ের তলাতেও কোনও তারিখ নেই। এরকম ভুল কোনও দূতাবাস করতে পারে? তারিখবিহীন যে কোনও দলিলই তো মূল্যহীন!
লোকটি আমাকে একপাশে সরে আসতে বলে কমপিউটার নিয়ে বসল।
কম্পিউটার যে কত অসাধ্য সাধন করতে পারে, সে বিষয়ে আমার সম্যক জ্ঞান নেই। মায়ামিতে বসে কম্পিউটার মারফত দিল্লির দূতাবাস থেকে দেওয়া ভিসার তারিখ কী করে বার করা হবে, তা আমার বুদ্ধির অগম্য।
ভিসা শব্দটি লিখছি বটে, কিন্তু এর উচ্চারণ ভিজা ও ভিঝার মাঝামাঝি। সে উচ্চারণ বাংলায় বানান করা যায় না।
অন্য সব যাত্রী-যাত্রিণীরা চলে যাচ্ছে ভেতরে, আমি দাঁড়িয়ে আছি একপাশে, সেই মিলিটারি প্রতিম লোকটি কম্পিউটার খটখটিয়েই চলেছে।
যেন আমি কোনও অপরাধ করে ধরা পড়েছি। কিংবা কৃপাপ্রার্থী। মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা নামে অধিকারটা আজকাল সব বিমানবন্দরে এসে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কোনও প্রশ্ন করার উপায় নেই। নিরাপত্তার নামে যখন তখন সারাগায়ে চাপড় মারবে, একই জায়গায় দু-তিনবার বাক্স-প্যাঁটরা খুলতে বলবে, ঘাঁটাঘাঁটি করবে, দাড়ি কামাবার পাউচটা তুলে জিগ্যেস করবে, এটা কী? পাসপোর্টটা এ হাত থেকে ও হাত ঘুরবে, তা নিয়ে চলবে গু জ্বর গু জ্বর ফুসুর-ফুসুর। প্রশ্ন করলেই যাত্রা বাতিল করে দেওয়ার ক্ষমতা আছে বিমানকর্মীদের। যদিও হাইজ্যাকাররা বোমাপিস্তল নিয়ে ঠিকই উঠে পড়ে।
আমার এ যাত্রার ঠিক সাড়ে তিন মাস পরেই আমেরিকায় একসঙ্গে চারখানি বিমান হাইজ্যাকিং হয় একই দিনে, প্রায় একসঙ্গে। দুটি বিমানের ধাক্কায় ধ্বংস হয়ে যায় জগৎবিখ্যাত দুটি বিশালাকায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, একটি আঘাত হানে পেন্টাগনে।
প্রায় মিনি পনেরো দাঁড়িয়ে থাকার পর আর ধৈর্য রাখা গেল না। জিগ্যেস করলাম, কত দেরি হবে?
লোকটি কঠোর কণ্ঠস্বরে বললেন, দেরি হবে, হ্যাঁ, কত দেরি হবে তা কী করে বলব!
মনে মনে বললাম, ধুত্তোরি ছাই! কলম্বিয়ায় যেতেই হবে, এমন মাথায় দিব্যি কে দিয়েছে? এত বিঘ্নের মধ্য দিয়ে কবিতা পড়ার শখ আমার নেই।
নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলিসে পরিচিতরা সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করেছে, কেন আমি যাচ্ছি ওদেশে? বিশেষত এই সময়ে? সেখানে সন্ত্রাস ও খুনোখুনি লেগেই আছে।
একটা প্যারামিলিটারি বাহিনী, একটা চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী দল ও একটি মার্কসবাদী বিপ্লবী সংগঠন, এই তিন রকম দল অরাজকতা চালিয়ে যাচ্ছে সে দেশে। অতি শক্তিশালী মাদক চোরাচালান চক্র তো আছেই।
এখানে থাকতে থাকতেই কাগজে পড়লাম বোগোটা শহরে দিনদুপুরে বোমা বিস্ফোরণে অনেক লোক হাতাহত হল একদিন। প্রথমে একটি গাড়ি-বোমা বিস্ফোরণে কয়েকজন মরল, তারপর পুলিশ ও উদ্ধারকারীরা যখন সেখানে পৌঁছেছে, তখন ফাটল কাছাকাছি আর একটি গাড়ি-বোমা, তাতে কয়েকজন পুলিশসমেত ঘায়েল হল কিছু সাংবাদিক ও টিভির লোকজন।
এখানকার উগ্রপন্থীদের বিশেষ শখ পুলিশ খুন করা। তিনশোর বেশি পুলিশ ওদের হাতে বন্দি আছে। চোরাচালানকারীদের অস্ত্রে পর পর কয়েকজন বিচারক হত্যার কাহিনিও সবাই জানে। নিজের দেশের একজন ফুটবল খেলোয়াড় হঠাৎ একটা সেমসাইড গোল করে ফেলেছিল, সেই ভুলের জন্যও বেচারিকে গুলি খেয়ে মরতে হয়েছে।
ম্যাডেলিনও খুব সশস্ত্র হিংসার শহর। এক সপ্তাহ আগেই সেখানে চলন্ত বাসে গুলি চালিয়ে খতম করে দেওয়া হয়েছে বারোজন নিরীহ, সাধারণ যাত্রীকে। সেখানে অপহরণও নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।
এরকম জায়গায় কেউ সাধ করে যায়?
শুধু দুজন, ফ্রান্সের প্রতি সান্যাল ও কানাডার কান্তি হোর আমাকে বিশেষ উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, কলম্বিয়া অবশ্যই দেখার মতন জায়গা, মানুষজন যেমন সুন্দর, তেমনই সুদৃশ্য প্রকৃতি।
প্রতি সান্যাল নিজে গিয়েছেন কলম্বিয়ায়, তাঁর স্বামী বিকাশ সান্যালের ইউনেস্কোর কাজের সূত্রে। ওঁদেরও বিপদের ভয় সম্পর্কে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু ওখানকার মানুষদের কাব্য ও গানবাজনার প্রতি ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।
আর কান্তি হোরকে কাজের সূত্রে কলম্বিয়া তথা দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশে প্রায়ই যেতে হয়। তাঁর একটা সুবিধে, তিনি স্প্যানিশ ভাষা মাতৃভাষার মতন ভালো জানেন। না, একটু ভুল হল, অনেকেই নিজের মাতৃভাষাটা ভালো জানে না। কান্তি হোর এক আশ্চর্য, বিরল ব্যতিক্রম। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশ ছাড়া, কিন্তু বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রতি রয়ে গেছে প্রগাঢ় ভালোবাসা। তিনি যখন মুক্তোর মতন অক্ষরে বাংলার চিঠি লেখেন নিজের হাতে, তাতে একটাও ইংরিজি শব্দ থাকে না, থাকে না কোনও বানান ভুল।
কান্তিবাবু কলম্বিয়ার ভায়োলেন্সের ব্যাপারটা পাত্তাই দিতে চান না। তাঁর মতে, সেখানকার মানুষদের আন্তরিক ও শিষ্ট ব্যবহার অতুলনীয়। আমি যতদিন থাকব, তার মধ্যেও তিনিও একটা কাজের ছুতো নিয়ে চলে আসবেন, খুব আড্ডা হবে।
হিংস্রতা ও খুনোখুনি কোন দেশে নেই? বোমা, বাসযাত্রীদের গুলি করে মারা, অপহরণ কি আমাদের দেশে নেই? নকশাল আমলের কলকাতা, এখনকার ত্রিপুরা, অসম, মেঘালয়, মণিপুরে এসব অহরহ ঘটছে, তবু কি সাধারণ জীবনযাত্রার স্রোত থেমে থাকে? কাশ্মীরের কথা বাদই দিলাম।
শুধু কবিতা পাঠের বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহে আমি অত দূরের দেশে যাচ্ছি না। অত কবিতা পড়ার নেশা আমার নেই, প্রকাশ্য জনসভায় কবিতা পাঠের চেয়ে ঘরোয়া অন্তরঙ্গ পরিবেশে কবিতা পড়া ও শোনাই আমার কাছে বেশি উপভোগ্য। তবু অনেক জায়গায় যেতেই হয়। ওখানে যাচ্ছি, দেশভ্রমণের নেশায়। আর ওই যে আগেই বলেছি, আর একটা মহাদেশ ছুঁয়ে আসার ছেলেমানুষি!
কিন্তু এ যাত্রায় গোড়া থেকেই এমন বিড়ম্বনা শুরু হয়েছে বলে সব উৎসাহে ছাই চাপা পড়ে যাচ্ছে।
এবারে আমিও খানিকটা কড়া গলায় বললাম, আমার আমেরিকান ভিসা তো ঠিক আছে? পাসপোর্টটা ফেরত দিন, আমি আর যাব না। এখান থেকেই ফিরব।
এতে ম্যাজিকের মতন কাজ হল।
লোকটি সঙ্গে-সঙ্গে কম্পিউটার থেকে হাত তুলে, আমার পাসপোর্টটা বন্ধ করে এগিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, আপনি প্লেনে উঠে পড়ুন!
তারিখবিহীন ভিসাতেই যদি কাজ চলে, তাহলে লোকটি এতক্ষণ দেরি করল কেন? অদ্ভুত সব ব্যাপার। ও কি আশা করেছিল, আমি ওর কাছে কাকুতি মিনতি করব? অন্যের আত্মসম্মান নষ্ট করিয়ে অনেকে আনন্দ পায়।
বিমানে উঠে উচ্চশ্রেণির অংশটা পেরিয়ে সাধারণ শ্রেণিতে ঢোকার পরই দেখলাম, একেবারে সামনের সারিতে বসে আছেন সেই মহিলা। যাঁকে লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্ক আসার বিমানে দেখেছি, যিনি আমার মানিব্যাগটা উদ্ধার করে দিয়েছিলেন।
কাকতালীয়? তা ছাড়া আর কী!
আমার সিটটা বেশ খানিকটা দূরে। যেতে যেতে মনে হল, মানিব্যাগটার জন্য ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত ছিল। এই তো সুযোগ।
কিন্তু মহিলার সঙ্গে এবারে একটি বেশ বড় দল আছে, তিনি তাদের সঙ্গে কথাবার্তায় মগ্ন। থাক পরে দেখা যাবে।
বিমানটি কিন্তু ঠিক সময়ে ছাড়ল না।
প্রথমে ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলেন যে সামান্য কোনও কারণে মিনিট পনেরো দেরি হবে, সে জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থী।
পরবর্তী ঘোষণায় সেই সময়সীমা বেড়ে গেল।
তৃতীয়বার জানা গেল, রানওয়ে খালি নেই বলে বিমানটি উড়তে পারছে না।
এই কালহরণ অত্যন্ত বিরক্তিকর।
উড়ন্ত বিমানেই সময় যেন কাটতেই চায় না, মাটিতে থেমে থাকা বিমান একেবারেই চরিত্রহীন। টিভি-র নীরেস ছবি দেখার চেয়ে বইয়ের পাতায় চোখ ডুবিয়ে অন্যমনস্ক হওয়া বরং ভালো।
নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘সোল মাউন্টেন’ নামে যে উপন্যাসটি আমি পড়ছি, সেটাও অনেকটা ভ্রমণকাহিনির মতন। একটি উপকথার পাহাড় খুঁজতে-খুঁজতে চিনের দুর্গম অঞ্চলে ঘুরছেন লেখক। তাঁর আঙ্গিকটি অনেকটা সতীনাথ ভাদুড়ির ‘সত্যি ভ্রমণকাহিনি’র মতন। এক পরিচ্ছেদের বর্ণনা প্রত্যক্ষভাবে লেখকের উত্তম পুরুষে, পরবর্তী পরিচ্ছেদ তৃতীয় পুরুষে।
এই ভ্রমণকাহিনি যাতে একঘেয়ে না লাগে, তাই মাঝে-মাঝে লেখক মশাই বেশ রসালো মালমশলা মিশিয়ে দিয়েছেন। এর সময়কাল লেখকের তরুণ বয়েসের, ঘুরতে-ঘুরতে লেখকের সঙ্গে প্রায়ই একটি সুন্দরী যুবতীর সঙ্গে দেখা ও আলাপ হয়ে যাচ্ছে, তারপর দুজনেই কিছুক্ষণ পর এক শয্যায়। একই নায়িকা নয়, বিভিন্ন পরিচ্ছেদে অন্য অন্য যুবতী, কোথাও-কোথাও আদিরসেরও অভাব নেই। সাম্যবাদী চিনের প্রত্যন্ত মফসসলে যে এরকম বিছানা-উদার স্বাধীন রমণীদের দেখা পাওয়া যায়, তা আমার জানা ছিল না।
অবশ্য এই লেখক সাম্যবাদ-বিরোধী। হয়তো তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সেটাই প্রধান কারণ।
সে যাই হোক, আমার এই রচনাটির সঙ্গে ওই উপন্যাসটির প্রধান অমিল এই যে, আমারটির মধ্যে কোনও প্রেম কাহিনি নেই। কাহিনিই প্রায় নেই বলতে গেলে, প্রেম থাকবে কী করে?
সতীনাথ ভাদুড়ির ‘সত্যি ভ্রমণকাহিনি’তে তবু একটা প্রেম না হলেও মধুর সম্পর্কের কথা আছে, আমার এ যাত্রায় সব মাধুর্য নিরুদ্দেশ।
তবে, আমার ব্যাগ উদ্ধারকারিণী, দ্বিতীয়বার দেখা এই কলম্বিয়া যাত্রিণী মহিলাটিকে নায়িকা বলা যেতে পারে, নায়িকা হওয়ার মতন সবরকম গুণই তাঁর আছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আর একটিও বাক্য বিনিময় হয়নি আমার। আগবাড়িয়ে অচেনা মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করার যোগ্যতাই আমার নেই। মেয়েরা যদি দয়া করে, সে আলাদা কথা।
টয়লেটে যাওয়ার ছুতোয় আমি সেই মহিলার পাশ দিয়ে ঘুরে এলাম একবার। আমাকে তাঁর চেনার কোনও প্রশ্নই নেই, দেখেও দেখলেন না। তিনি তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে গল্পে মগ্ন হয়ে আছেন, এখন আমি ধন্যবাদ জানাতে গেলে যদি আলাপের ছুতো ভেবে বিরক্ত হন? তাই কিছুই বলা হল না।
তবে, মহিলাটির নাম জানা গেল, ইলিয়ানা। অন্যরা এই নামে ডাকছে। কথা না বললেও ওঁর মুখের দিকে তাকালে দৃষ্টি ধন্য হয়।
নিউ ইয়র্ক যাওয়ার সময় ইলিয়ানা এক সহযাত্রীর ওপর বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়েছিলেন, এখানে তিনি মনের মতন সঙ্গীদের পেয়েছেন, বেশ খুশিতে আছেন।
বিমানটি শেষ পর্যন্ত উড়ল দেড় ঘণ্টা বাদে।
এবারে জানলা পাওয়া গেছে, অনেক সিটই খালি, সুতরাং এটা কোনও সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়। যদিও একটুপরেই সন্ধে হয়ে যাবে, তবু এখনও নীচের দিকে অনেক কিছুই চোখে পড়ে।
ম্যাপে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সংযোগ-জায়গায় অনেক বিন্দু বিন্দু দ্বীপ দেখেছি। মায়ামি থেকে কিউবা ডিঙিয়ে যেতেই হবে, তারপর ক্যারিবিয়ান সাগর, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ, জামাইকা, কোস্টারিকা, পানামা, কোনটা যে কী তা বোঝার উপায় নেই। সমুদ্রের বুকে যে একটা গম্ভীর পাহাড় চোখে পড়ল, সেটাই কি সান অ্যান্ড্রস?
এক সময় একজন পারসার আমার কাঁধে টোকা দিয়ে জিগ্যেস করল, তোমার কি পাসপোর্টটা হারিয়েছে?
আমি আঁতকে উঠলাম। মানিব্যাগ হারিয়েছি। চশমা ভেঙেছি, এরপর পাসপোর্ট? সেই কম্পিউটার খটখটানো মিলিটারি মেজাজের লোকটি কি শেষ পর্যন্ত আমার পাসপোর্ট ফেরত দেয়নি?
পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম। না তো, পাসপোর্ট ঠিকই আছে। বার করে মিলিয়েও নিলাম। লোকটি বলল, টয়লেটের কাছে একটা পাসপোর্ট পাওয়া গেছে, ছবিটা অনেকটা তোমারই মতন—
পৃথিবীতে আমার মতন চেহারার অনেক মানুষ আছে, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ, তবে আমার পাসপোর্ট আমার কাছেই অটুট আছে। এ ব্যাপারে তাকে নিশ্চিন্ত হতে বললাম।
এতবার এরকম ঘোরাঘুরিতেও আমি কখনও পাসপোর্ট হারাইনি। এ ব্যাপারে ভাস্কর ছিল আমার ঠিক বিপরীত, যেখানে সেখানে পাসপোর্ট ফেলে যেত। ওর ব্রিটিশ পাসপোর্ট, খুবই মূল্যবান, একটু সুযোগ পেলেই চোরেরা লুফে নেবে, তাতেও হৃক্ষেপ ছিল না ওর। নিজের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ইনসুলিনের বাক্সটাও যে হারিয়েছে কতবার!
একেবারে শেষ যাত্রার সকালবেলা ভাস্কর জামা-প্যান্ট পরে হোটেল থেকে বেরুবার জন্য তৈরি হয়েছে, ঘরে কিছু ফেলে যাচ্ছে কি না আমি আর অসীম খুঁজে দেখে একটা রুমাল ও একজোড়া মোজা পেয়েছিলাম, ভাস্কর পকেট থাবড়ে বলে দিল সব ঠিক আছে। তখন তো আমরা বুঝিনি যে এটাই ওর শেষ যাত্রা, মৃত্যু এর মধ্যেই এসে ওর বুকের মধ্যে থাবা গেড়েছে। ভাস্কর কথা বলছে বটে, আসলে ওর বাহ্যজ্ঞান নেই।
কয়েক মিনিট পরেই খুব কাছের হাসপাতালে ডাক্তাররা যখন ওর বুকে চাপ দিয়ে দিয়েও আর নিশ্বাস ফেরাতে পারলেন না, তখন সেখানে একটা ভিড় জমে গিয়েছিল। ভাস্কর যেখানেই একদিন-দুদিন থাকে, সেখানেই ও সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে যায়। হোটেলের ম্যানেজারদের সঙ্গে সে অনেকবার দরাদরি করেছে। কিন্তু বেয়ারা-খানসামাদের অবিশ্বাস্য রকমের বেশি বকশিশ দিয়ে হতভম্ব করে দিত।
দশ মিনিট আগেও ভাস্কর কথা বলেছে। এখন থেকে আর কখনও তার কণ্ঠস্বর শোনা যাবে, এই উপলব্ধিটা তখনও আমরা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য করতে পারছি না, থুম মেরে বসে আছি হাসপাতাল-প্রাঙ্গণে একটা গাছের নীচে, ভিড় ঠেলে একটি অল্পবয়েসি ছেলে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। এই ছেলেটি হোটেলে ভাস্করের ঘরে ফাই ফরমাস খাটত। ওর হাতে ভাস্করের মানিব্যাগ আর পাসপোর্ট, ও দুটো ছিল মাথার বালিশের নীচে। আমরা সারাঘর খুঁজেছি, বালিশের তলাটা দেখার কথা মনে পড়েনি। ভাস্করের আর কখনও পাসপোর্টের প্রয়োজন হবে, মানিব্যাগটাও কাজে লাগবে না, তাই বোধহয় ওগুলো নিয়ে ভার বাড়াতে চায়নি। ব্যাগটায় একগাদা টাকা।
ছেলেটি এসেছিল ছুটতে ছুটতে, সে এসেছিল জীবন্ত ভাস্করের ওগুলো ফেরত দিতে। যে হাসিখুশি, মজাদার বাবুটিকে সে কতবার চা, ওমলেট, সোডা এনে দিয়েছে, সেই বাবুর অসুখ করেছে, আবার নিশ্চয়ই সেরে উঠবেন, ধরে নিয়েছিল। সে ওগুলো পেয়ে লুকিয়ে রাখলে আমরা টেরও পেতাম না। আর একটু পরেই মানালি থেকে আমাদের পাহাড়ের নীচে নেমে যাওয়ার কথা। হোটেলের ওই বাচ্চা চাকরটার অতগুলো টাকা অনেক কাজে লাগত, তবু যে সে ফেরত দেওয়ার জন্য ছুটে এসেছে, তাতেই সে একা বিশ্বের সব চোর ডাকাতদের বিবেকহীনতার প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে রইল।
আমার কখনও পাসপোর্ট না হারালেও পাসপোর্টের জন্য একবার আমাকে এক দারুণ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল।
এটা সেই ইস্তানবুলে যাওয়ার ঠিক আগেকার ঘটনা।
ভারতীয় লেখক-প্রতিনিধি দলটির বাকি সবাই ফিরে যাবে ভারতে, আমি একাকী যাব তুরস্কে। ভারতের বিমান দুপুরবেলা, আমার বিমান খুব ভোরে, তাই অন্যদের না জাগিয়ে আমি তৈরি-টেরি হয়ে নেমে এসেছিলাম হোটেলের কাউন্টারে।
এটা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঠিক বছর খানেক আগের কথা। সে সময় চেকোশ্লোভাকিয়া অধিকাংশ মানুষকেই বিরক্ত আর ক্ষুব্ধ মনে হয়েছিল, আমাদের এই সরকারি কর্মচারীদের আতিথ্য ছিল নিতান্তই দায়সারা, আসলে তারা সকলেই তখন সরকারের প্রতি ক্রোধে ফুঁসছে। হোটেলগুলিও সব সরকারি, সেখানকার কর্মীদের ব্যবহারও খুবই শুষ্ক।
সব সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতেই ভিসা ব্যবস্থা ছিল অন্যরকম। গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে পাসপোর্টের মধ্যে একটা পাতায় ভিসার ছাপ দেওয়া থাকে, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে আলাদা একটি কাগজে দেওয়া হত ভিসা। সে কাগজটায় ছবিও থাকত। সেসব দেশ ছেড়ে আসবার সময় ভিসার কাগজটা এয়ারপোর্টে রেখে দিত। অর্থাৎ, ধরা যাক মস্কো, সেখান থেকে বিমানে ওঠার পর আর কোনও প্রমাণই থাকত না যে আমি মস্কো গিয়েছিলাম।
তা ছাড়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিতে যেমন একবার বিমানবন্দর থেকে দেশটার মধ্যে ঢুকে পড়লে তারপর আমি কোথায় যাব কিংবা কোথায় থাকব, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, কিন্তু রাশিয়া, পোলান্ড, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া কয়েকটি মাত্র শহরের নাম নির্দিষ্ট থাকত, তার বাইরে কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। শুধু তাই নয়, যে-কোনও শহরের হোটেলে পৌঁছলেই পাসপোর্টটি জমা নিয়ে নিত, সেটি সঙ্গে রাখতে দিত না।
আমার পাসপোর্টও এখানে জমা করা আছে, সেটা ফেরত চাইতেই ঘুম-ঘুম চোখে হোটেল কর্মীটি একগাদা পাসপোর্টের ভেতর থেকে আমারটা বার করে দিল। সে পাসপোর্টের ভেতর থেকে আমার ছবি-সাঁটা ভিসার কাগজটা বেরিয়ে আছে।
একটা ট্যাক্সি নিয়ে একা চলে গেলাম এয়ারপোর্ট। সফরের চোদ্দোদিন সবসময় একজন না একজন ইন্টারপ্রেটার সঙ্গে থাকত। প্রাহা শহরের এয়ারপোর্টটি তখন বেশ ছোটই ছিল, কর্মীদেরও ঢিলেঢালা ভাব। সুটকেস বইবার ট্রলি পাওয়া যায় না। নির্দিষ্ট কাউন্টারে গিয়ে মালপত্র জমা দিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নিলাম। সুভেনির হিসেবে এক জোড়া কাঁচের পুতুলও কিনে ফেললাম দোকান থেকে।
তারপর ইমিগ্রেশানে এসে এক মহিলা অফিসারকে পাসপোর্ট দিতেই শুরু হল নাটক।
তিনি পাসপোর্টটা দেখছেন আর আমার মুখটা দেখছেন পর্যায়ক্রমে বারবার। তারপর ছবির পাতাটা আমার চোখের সামনে এনে জিগ্যেস করলেন, ইজ দিস ইয়োর পাসপোর্ট?
জীবনে এত অবাক কখনও হইনি। বিস্ময়ের সঙ্গে ভয়, কেউ যদি পাহাড়ের একটা খাদে ঠেলে ফেলে দেওয়ার মতো পিঠে হাত রাখে, সেইরকম অবস্থার মতন।
বোমা ফাটানোর মতন চিৎকার করে বললাম, ‘নো!’
পাসপোর্টের ছবিটা আমার নয়, ভিসার কাগজটা আমার। অর্থাৎ অলস, ফাঁকিবাজ হোটেল কর্মী অন্য একজনের পাসপোর্টের মধ্যে আমার ছবিটা ঢুকিয়ে রেখেছে।
মহিলাটি চেয়ারে হেলান দিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, অন্যের পাসপোর্ট নিয়ে ঘোরা কতখানি বে-আইনি, তুমি জানো নিশ্চয়ই? সিকিউরিটির লোককে ডেকে এখুনি তোমাকে জেলে দেওয়া উচিত। আর আমি যদি নিয়ম ভেঙে তোমাকে ছেড়েও দিই, তাতেও তোমার কোনও লাভ হবে না। নকল পাসপোর্ট নিয়ে তুমি অন্য যে-দেশে যাবে, সেখানেই বাধা পাবে, এমনকী নিজের দেশেও ঢুকতে পারবে না।
ভদ্রমহিলা যা বললেন, তার প্রতিটি বর্ণ মর্মে-মর্মে সত্যি।
আমি দ্রুততম চলচ্চিত্রের বেগে ভেবে যেতে লাগলাম ঘটনা পরম্পরা।
ইস্তানবুলের এই ফ্লাইট ধরতে না পারলে আবার কবে রিজার্ভেশন পাব তার ঠিক নেই। এখান থেকে ভারতের রিজার্ভেশান পাওয়া খুবই দুষ্কর, আগেই শুনেছি। মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। এখানেই বা থাকব কী করে, আমার কাছে খুব বেশি টাকা নেই। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই সব দেশে সরকারি আতিথ্যের নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে গেলে তারপর আর কেউ ফিরেও তাকায় না। আমার ভিসাও আর একদিন আছে মাত্র।
তবে কি বিদেশ-বিভুঁইয়ে জেল খাটাই আমার নিয়তি?
মরিয়া হয়ে বললাম, মালপত্র চেক-ইন করার সময় কেন আমাকে কিছু বলা হয়নি?কাউন্টারে পাসপোর্টটা রেখেছিলাম, ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি সেটা উলটেও দেখেনি। তখন জানালে তবু একটা ব্যবস্থা করা যেত।
মহিলাটি বললেন, হ্যাঁ, উচিত ছিল, এটা ওই ব্যক্তিটির গাফিলতি। কিন্তু তাতেও তোমার কাছে অন্যের পাসপোর্ট রাখার অপরাধ খণ্ডন হয় না। তোমার ভিসার কাগজ দেখে বুঝতে পারছি, তুমি ইচ্ছে করে এটা করোনি। তোমাকে আমি এইটুকু মাত্র সুযোগ দিতে পারি, তোমার বিমান ছাড়ার পঞ্চাশ মিনিট দেরি আছে, তোমাকে চল্লিশ মিনিট সময় দিচ্ছি, এর মধ্যে যদি এটা বদল করে নিজের পাসপোর্ট নিয়ে আসতে পারো, তা হলে তোমার কোনও শাস্তি হবে না।
তাতেও কোনও সুরাহা হল না।
ভোরবেলা হোটেল থেকে ট্যাক্সিতে এয়ারপোর্টে আসতে পাক্কা পঁচিশ মিনিট সময় লেগেছিল। এখন যানবাহন বেড়েছে, আর একটু বেশি সময় লাগতে পারে। সুতরাং হোটেলে যাওয়া-আসার সময় হবে না।
আমাদের দলের অন্য কোনও লেখককে যে অনুরোধ জানাব, তাতেও বিশেষ সুবিধে হবে না। তারা সবাই ঘুমোচ্ছে দেখে এসেছি। ডেকে তুলতে হবে। তৈরি হতে কিছুটা অন্তত সময় তো লাগবেই। তা ছাড়া, অন্যের হাতে আমার পাসপোর্ট কি দেবে হোটেল কর্তৃপক্ষ?
তবু হোটেলে একটা ফোন করলাম।
এর মধ্যে হোটেল কাউন্টারের আগের কর্মীটি বদলে গেছে, অন্য যে এসেছে, সে এতই কম ইংরিজি জানে যে ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পারে না। ভিসার কাগজ আমার, পাসপোর্টটা অন্যের, এটা শুনে সে বারবার বলতে লাগল, হোয়াট! হোয়াট! দ্যাট ক্যানট বি! তারপর লাইন কেটে দিল।
বুকের মধ্যে দুমদুম শব্দ হচ্ছে, ডুবন্ত মানুষের মতন আঁকুপাঁকু করতে-করতে হঠাৎ দেখতে পেলাম এক মহিলাকে। ইনি প্রথম কয়েকটি দিন আমাদের দলটির ইন্টারপ্রেটার ছিলেন। ভদ্রমহিলার চেহারা এতই রোগা, এতই শুকনো যেন শরীরের সব রসকষ শুষে নেওয়া হয়েছে, মুখে কখনও হাসি নেই, বরং সবসময় বিরক্তি ও রাগ-রাগ ভাব। আমাদের দলের পুরুষরা আড়ালে তাঁকে বলত পেতনি। একজন হিন্দি লেখক বলেছিল, সব ভ্রমণ কাহিনিতে কত সুন্দরী, রসিক ইন্টারপ্রেটার বা গাইড থাকে, আর আমাদের ভাগ্যে এই!
এখন সেই মহিলাকেই আমার মনে হল দেবদূতী।
এয়ারপোর্টের জনারণ্যে তিনিই একমাত্র, যিনি আমাকে চিনবেন এবং ইংরিজিতে আমার সমস্যা বুঝতে পারবেন।
আমি ভদ্রতা-সভ্যতা ভুলে গিয়ে ওঁর হাত চেপে ধরে বললাম, মিস, আমাকে বাঁচান!
তিনি সব শুনে বললেন, আমি একটি চিনা প্রতিনিধি দলকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছি, আর দশ মিনিটের মধ্যে তাদের বিমান নামবে। আমি তোমাকে বেশি সময় দিতে পারব না। তবে শেষ চেষ্টা করছি। তোমারও দোষ আছে, পাসপোর্ট সবসময় ভালো করে দেখে নেওয়া উচিত, শুধু ভিসার কাগজ দেখে তোমার নিশ্চিত হওয়া উচিত হয়নি। আর হোটেলেরও দোষ আছে, অন্যের পার্সপোর্টে তোমার ভিসার কাগজ ছাপা মারাত্মক অপরাধ। এই পাসপোর্টটা যার, সেও তো বিপদে পড়বে! যাই হোক, আমি হোটেলের ঘাড়েই সব দোষ চাপাচ্ছি।
একটা টেলিফোন বুথে ঢুকে তিনি কয়েক মিনিট কথা বললেন, মনে হল যেন কারুকে খুব ধমকাচ্ছেন। ভয় দেখাচ্ছেন!
বেরিয়ে এসে বললেন, ওদের কোনও লোক এখন আসতে পারবে না, তবে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের হাতে দিয়ে এক্ষুনি তোমার পাসপোর্টটা পাঠাচ্ছে, তার হাতেই অন্য পাসপোর্টটা দিয়ে দিও। বাইরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করো।
তিনি আর দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন অ্যারাইভালো গেটের দিকে। আমি কৃতজ্ঞতায় তাঁর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলাম, তাঁর পদচুম্বনেও রাজি ছিলাম। আর দু-চার মিনিট এদিক-ওদিক হলে ওঁর সঙ্গে আমার দেখাই হত না।
প্রতিটি মিনিট এখন মূল্যবান। হোটেল থেকে ট্যাক্সিটি আসতে অন্তত আরও আধঘণ্টা তো লাগবেই। এই আধঘণ্টা মানে আসলে কত ঘণ্টা?
থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি খুব সহজ করে বোঝাবার জন্য আইনস্টাইন নাকি কারুকে বলেছিলেন, মনে করো, কোনও লোকের একটা পা ফায়ার প্লেসের আগুনে ঠুসে ধরা হয়েছে, তা হলে সেই লোকটির কাছে পাঁচ মিনিটই মনে হবে এক ঘণ্টা। আর কেউ যদি তার প্রেমিকার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকে, তা হলে তার এক ঘণ্টাকেই মনে হবে পাঁচ মিনিট।
আমার পা নয়, যেন মাথাটাই ঠুসে ধরা হয়েছে ফায়ার প্লেসে। এই আধঘণ্টার মধ্যেই নির্ভর করছে আমার জীবন-মরণ না হলেও তুরস্ক ভ্রমণ কিংবা কারাদণ্ড।
অনবরত ঘড়ি দেখতে-দেখতে আর ঘন-ঘন সিগারেট টানতে টানতে এ কথাও মনে হচ্ছে যে, সেই ট্যাক্সিওয়ালা আমায় চিনবে কী করে? এখানে এসে ট্যাক্সি পার্ক করে নেমে এসে আমার নাম ঘোষণার ব্যবস্থা করবে?
পার্কিং করতেই তো অনেক সময় লেগে যায়। আমি তো আর একটা মিনিটও অতিরিক্ত ব্যয় করতে পারব না। পরপর ট্যাক্সি আসছে। নির্দিষ্ট লেন দিয়ে ঢুকছে ট্যাক্সিগুলো, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে আমার চোখে ব্যথা হয়ে গেল। হঠাৎ দেখি, এক ট্যাক্সিচালক জানলা দিয়ে একটা হাত বাইরে তুলে আছে, সেই হাতে ধরা একটা পাসপোর্ট!
কত ভাড়া হবে সেটা জানাই আছে। তার সঙ্গে কিছু বকশিশ জুড়ে সেই টাকা নিয়ে ছুটে গেলাম। পাসপোর্ট বদলাবদলি করেই আবার দৌড় দিলাম প্রস্থানদ্বারের দিকে।
তখন আমার নামে শেষ ডাক ঘোষিত হচ্ছে।