[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

৪৬. কয়েকদিন পরেই ক্রিসমাস

আর কয়েকদিন পরেই ক্রিসমাস। চতুর্দিকে সাজো-সাজো রব। প্রত্যেক পরিবারে পুজোর বাজার চলছে পুরোদমে। কয়েকদিন তুষারপাত বন্ধ আছে, বরফ-ঠিকরানো রোদ্দুরে অতিরিক্ত ঝলমল করছে প্রকৃতি। এই যে বরফ জমে আছে এখন, এই বরফ গলতে শুরু করবে সেই মার্চ-এপ্রিলে। কিন্তু ততদিন আমি থাকব না। আমার মনের মধ্যে যাই-যাই রব উঠে গেছে। ঠিক করে ফেলেছি, ক্রিসমাস আর থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বরের উৎসব দেখেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাব।

বাইরে অত ঠান্ডা, কিন্তু কাল রাতে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল দারুণ গরমে। ঘামে ভিজে গিয়েছিল সারা শরীর। বিছানা ছেড়ে ওঠে সেন্ট্রাল হিটিং ব্যবস্থা একেবারে বন্ধ করে রেখেছিলুম কিছুক্ষণের জন্য। সারাক্ষণ কৃত্রিম গরম বাতাস ঢোকানো হচ্ছে ঘরে, এক-এক সময় শরীরে খুব অস্বস্তি হয়, তখন মনে হয়, এর চেয়ে ঠান্ডায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আসাও ভালো। কাল রাত দুটোর সময় আমি ঠান্ডা জলে স্নান করেছিলুম।

সকালে ভাবছিলুম, আজ একটু পায়ে হেঁটে ঘুরে আসব। এমন সময় মুখার্জিদার ফোন এল।

–ওহে নীলুচন্দর, ঘুম ভাঙছে? চা খাওয়া হইছে?

–গুড মর্নিং মুখার্জিদা। অ্যাম অ্যাট ইওর সার্ভিস।

–বইস্যাবইস্যা কী করতাছো?

–সিমপলি ডে ড্রিমিং!

–আমি ডে ময়েন যাইতাছি, একখান লেকচার আছে। যাবা নাকি আমার লগে?

–ডে ময়েন?

–হ, ভালো জায়গা। বি রেডি উইদিন হ্যাফ অ্যাওয়ার। আইল পিক ইউ আপ!

ফোন ছেড়ে আমি ঝিম মেরে বসে রইলুম কিছুক্ষণ। আমার নিয়তি!

ভেবেছিলুম আমেরিকার আর যেখানেই যাই, আয়ওয়া শহরে যাব না। ও জায়গাটা আমার নিষিদ্ধ এলাকা। কিন্তু ডে ময়েন যেতে হলে আয়ওয়া শহরের পাশ দিয়েই যেতে হবে। আমার নিয়তিই আমাকে টেনে এনেছে এই পর্যন্ত। মুখার্জিদার প্রস্তাবটি যে প্রত্যাখ্যান করব, সেরকম মনের জোরও নেই।

মুখার্জিদার দুটি গাড়ির মধ্যে আজ এনেছেন মার্সিডিজ বেঞ্জখানা। ঝকঝকে নতুন। মুখার্জিদার চেহারাটিও পাক্কা সাহেবের মতন, ইংরেজিও বলেন দারুণ চোস্ত। এই লোকটির মুখে একেবারে নিপাট বাঙাল ভাষা শুনলে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। মুখার্জিদা মদটদ খান না এবং গাড়ি চালাবার সবরকম নিয়মকানুন মেনে চলেন। মুখার্জিদার পাশে বসলেই সিট বেল্ট বাঁধতে হয়।

হাইওয়েতে পড়বার পর মুখার্জিদা জিগ্যেস করলেন, কী বেরাদর, আইজ মুখখান বাঙলার পাঁচের মতন গম্ভীর কইর‍্যা আছে ক্যান?

আমি একটু চমকে উঠে বললুম, কই না তো?

–দ্যাশের জন্য মন কান্দে?

–আপনার কাঁদে না?

–না রে ভাইডি। আমার কোনও দ্যাশনাই। সে দুঃখের কথা আর কী কমু।

এরপর কিছুক্ষণ আমি মুখার্জিদাকে একলাই কথা বলতে দিলুম। আমার আজ সত্যিই আড্ডার মুড নেই। রোড সাইন দেখে বুঝতে পারছি, আয়ওয়া সিটি আর বেশি দূরে নেই। সব হাইওয়ের চেহারাই এক, সুতরাং চেনা কিছুই চোখে পড়ছে না।

হঠাৎ মন ঠিক করে ফেললুম। মুখার্জিদাকে বললুম, দাদা, একটা কথা বলব? আপনি ডে ময়েন থেকে কখন ফিরবেন?

–সাতটা আটটা হবে। ক্যান, তোমার তাড়া আছে নাকি?

–না। সেজন্য নয়। আপনি বরং এক কাজ করুন। আমাকে আয়ওয়া সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যান। ফেরার সময় আবার আমায় তুলে নিয়ে যাবেন। ডে ময়েন শহরে আমার চেনাশুনো কেউ নেই, আপনার বক্তৃতা শুনেও আমি কিছুই বুঝতে পারব না। সেরকম বিদ্যাবুদ্ধি আমার নেই। বরং আয়ওয়া শহরটা ঘুরে দেখি।

মুখার্জিদা দারুণ অবাক হয়ে বললেন, আয়ওয়া সিটি? সেখানে দেখার আছেটা কী? পুঁইচকা একখান শহর, ল্যাজা নেই মুড়া নাই। ডে ময়েন অনেক বড়, ভালো ভালো দোকানপাট আছে…

–না দাদা, আমি এখানেই নামব।

–আয়ওয়া সিটিতে চেনা কেউ আছে?

–হয়তো চেনা কারুকে পাব না। কিন্তু জায়গাটা আমার খুব চেনা। গাছ-পালা, বাড়ি ঘরগুলোকেও চিনি।

মুখার্জিদা নিরাশ হয়ে বললেন, যাবা না আমার লগে? আমি একলা একলা যামু? চলো না ভাইডি, অনেক কিছু খাওয়ামু। ওয়াইলড রাইস খাইছ কখনও?

তবু আমি নেমে পড়লুম প্রায় জোর করে। ওয়াইলড রাইসের লোভ দেখিয়ে কোনও কাজ হল, ওই চালের ভাত আমি অনেকবার খেয়েছি। এ একরকম বুনো ধান, কেউ চাষ করে না, জলা জায়গায় জন্মায়, লাল ইন্ডিয়ানরা খুঁজে আনে। লম্বা লম্বা চাল হয়, একটু হলদে ধরনের। তাতে অপূর্ব সুন্দর একটা গন্ধ। আশ্চর্য ব্যাপার, এই আয়ওয়া শহরেই প্রথম একজন ওয়াইলড রাইস বেঁধে খাইয়েছিল আমায়।

ঠিক হল, ইউনিভার্সিটির ইউনিয়নের রেস্তোরাঁ থেকে ঠিক রাত আটটার সময় মুখার্জিদা আমায় তুলে নিয়ে যাবেন ফেরার সময়।

অনেক দিন আগে এই ছোট্ট শহরে আমি এক বছর থেকেছি। এখানকার রাস্তার প্রতিটি ধুলোও আমার চেনা, যদিও এদেশের রাস্তায় ধুলো থাকে না। তা ছাড়া আমার ধারণা ঠিক নয়, যে শহরটাকে আমি চিনতুম, সেটা আর নেই। এদেশে সব কিছুই বড় দ্রুত বদলায়। তখন আয়ওয়া সিটি ছিল একটা ছোট্ট, ছিমছাম নিরিবিলি শহর, অধিকাংশ বাড়িই কাঠের দোতলা। এখন সেসব বাড়ি আর প্রায় চোখেই পড়ে না, এদিকে সেদিকে বড় বড় বাড়ি। চারদিকে ছিল ছোট ছোট পাহাড় আর নিবিড় জঙ্গল, এখন পাহাড়ের গায়ে গায়েও বাড়ি উঠেছে, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বড় বড় রাস্তা। দোকান ছিল মাত্র দু-তিনটে, এখন রীতিমতন একখানা ডাউন টাউন, সেখানে সার সার দোকান ও ট্যাভার্ন। যেখানে ছিল বাস স্টেশন, সেটা ভেঙে সেখানে গড়ে উঠেছে সুদৃশ্য শপিং মল। সেখানে, এমনকী একটা ভারতীয় জিনিসপত্রের দোকান রয়েছে দেখছি।

রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালুম অনেকক্ষণ। একটা লোকও আমায় চেনে না। আগে রাস্তায় বেরুলেই দু-তিনজন অন্তর একজন মুখ-চেনা চোখে পড়ত, মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে জিগ্যেস করত, হাই!

শুধু আয়ওয়া নদীটি একই রকম আছে। রোগা, কালো জল। নদীর দুপাশের দৃশ্য বদলে গেছে, সেই নির্জনতা আর নেই, নতুন ব্রিজও তৈরি হয়েছে গোটাতিনেক, তবু নদীটিকে চেনা লাগল। তার কিনারে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলুম, নদী, তুমি কেমন আছো? আমায় চিনতে পারো?

এই নদীর ধার দিয়ে বিকেলবেলা আমি আর মার্গারিট হাঁটতুম। এই রকম শীতের বেলায়। এখনও যেমন, তখনও তেমন নদীর জলে ভাসত চাঁইচাঁই বরফ, কোথাও কোথাও একেবারে শক্ত হয়ে জমে যাওয়া। দুধারে পপলার গাছের সারি। হাঁটতে-হাঁটতে মার্গারিট আমায় শোনাতো ফরাসি ভাষা, আমি ওকে শেখাতুম বাংলা। আমি জানি না, এর ফরাসি কী? জ্য ন সে পা। তাড়াতাড়িতে বলতে হয়, জ্যন্সেপা! এবার বলল, জ্য পাঁঝ দক, জ্য সুই! আমি চিন্তা করি, তাই আমি বেঁচে আছি।

মার্গারিটের ফরাসি ঠোঁটে বাংলা শোনাতো বড় মধুর। আমি সসেজ কাবো! আমি জল কাবো! আমি চুমু কাবো! স-ব কাবো? হাউ অ্যাবসার্ড! হাউ সুইট!

একেবারে পাগলি ছিল মেয়েটা। কবিতা পাগল। দিনরাত কবিতা-তন্ময়। যে কোনও দৃশ্য, যে কোনও ঘটনা দেখলেই জিগ্যেস করত, বলো তো, কার কবিতায় ঠিক এরকম আছে?

আমি কি অত পারি? আমার তো অত কবিতা জ্ঞান নেই। সুতরাং ও-ই শোনাত আমাকে। আমার ঘরে পাশাপাশি বসে ও আমাকে গিয়ম অ্যাপোলোনিয়েরের কবিতা পড়ে শোনাতো ঘন্টার পর ঘন্টা। অ্যাপোলিনিয়েরের একটি কবিতায় দুষ্মন্ত শকুন্তলার প্রণয় কাহিনির উল্লেখ থাকায় ও বলেছিল, তুমি আমায় কালিদাসের শকুন্তলা শোনাও! শুধু কাহিনিটা বললে হবে না, কালিদাসের রচনা ওকে পড়ে শোনাতে হবে। দেশ থেকে বাংলা কালিদাস গ্রন্থাবলী আনিয়ে দিনের পর দিন আমার অক্ষম ইংরেজিতে ওকে অনুবাদ করে শুনিয়েছি।

যে বাড়িটায় আমি থাকতুম, খুব ইচ্ছে হল সেই বাড়িটা দেখবার। ঠিকানা এখনও মুখস্ত আছে। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বাড়িটার নাম ক্যাপিটল। তার চারদিকে চারটে রাস্তা। আমার বাড়ি ছিল তিন শো তিন নম্বর সাউথ ক্যাপিটলে। এক বছর যেখানে থেকেছি, সেই রাস্তা ভুলে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবু আমি পথ চিনতে পারছি না। সাউথ ক্যাপিটল রাস্তাটা ধরে হাঁটতে হাঁটতেও দিশেহারা হয়ে যাই। এ যে সব কিছুই অন্যরকম। আমার বাড়িটা গেল কোথায়? আমার বাড়িটা ছিল রেল স্টেশনের দিকে। পথ চলতি দু-একজন ছাত্রকে রেল স্টেশনের কথা জিগ্যেস করলে তারা চিন্তিত মুখে থমকে থাকে। রেলস্টেশন? কখনো এর কথা শুনিনি তো? ছাত্র মানেই নতুন আবাসিক, তাই চেনে না। এবার জিগ্যেস করলুম একজন বয়স্ক লোককে। তিনি বললেন, রেলস্টেশন? হ্যাঁ ছিল বটে এককালে। এখন তো সেটাতে আর কিছু হয় না। এখান থেকে রেল উঠে গেছে!

কোনও শহর থেকে রেলস্টেশন উঠে যাওয়ার কথা কেউ আগে শুনেছে? আমরা তো জানি নতুন নতুন রেলস্টেশন হয়, পুরোনোরা উঠে যায় না। আমেরিকাতে ট্রেন ব্যাপারটাই এখন মুমূর্ষ।

অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর বুঝতে পারলুম, সাউথ ক্যাপিটলের অর্ধেকটা আছে, আর বাকি অর্ধেকটা উধাও হয়ে গেছে। সেই রাস্তা ও সেখানকার সব বাড়ি ঘর ভেঙে-গুঁড়িয়ে সেখানে উঠেছে অনেকগুলো মাল্টিস্টোরিড অ্যাপার্টমেন্ট হাউস। সেই বাড়িটিতে আমার প্রথম যৌবনের অনেক স্মৃতি ছিল। বাড়িটি আর ইহলোকে নেই, মার্গারিটও নেই।

মার্গারিট থাকত হস্টেলে অর্থাৎ ডর্মে। সেই সময় ছাত্র ও ছাত্রীদের আলাদা আলাদা ডর্ম ছিল, এখন তারা ইচ্ছে করলে একসঙ্গেই থাকতে পারে।

এক একদিন রাত একটা দেড়টায় আমি মার্গারিটকে ওর ডর্মে পৌঁছে দিতে আসতুম। প্রায় কাছাকাছি আসবার পর ও বলত, এবার তুমি একলা ফিরবে? চলো, আমি তোমায় খানিকটা এগিয়ে দিয়ে আসি।

আমি যতই বারণ করি, সে পাগলি কিছুতেই শুনবে না। জোর করে আসবেই। অনেকখানি চলে আসে। তখন আমি পুরুষ হয়ে সেই নিশুতি রাতে একটি যুব তাঁকে কী করে একলা ছেড়ে দিই। আবার আমি ফিরে যাই ওর সঙ্গে। আবার ও আমাকে এগিয়ে দিতে চায়। প্রথম যৌবনের সেই সব উলটো-পালটা খেলা।

মার্গারিটের মনটা ছিল জলের মতন স্বচ্ছ। টাকাপয়সার কোনও হিসেবই বুঝত না। যে কেউ চাইলে ওর যা কিছু সম্বল এক কথায় দিয়ে দিতে পারত। এমন প্রায়ই হয়েছে, আমাদের দুজনের কাছে একটাও পয়সা নেই, ঘরে কোনও খাবার নেই, আমরা খালি পেটে কবিতা পড়ে কাটিয়েছি। খিদের জ্বালা খুব অসহ্য হলে ঠিক খাওয়ার সময় কোনও বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছি, যাতে সে কিছু খেতে বলে। আমাদের বাড়ির নীচের তলাতেই থাকত পোল্যান্ডের একটি ছেলে, নাম ক্ৰিস্তফ, সে খুবই ভালো মানুষ, কিন্তু একটু কৃপণ স্বভাবের। আমি আর মার্গারিট দুজনে মিলে যে কত কৌশলে ক্রিস্তফের ঘাড় ভেঙেছি!

একদিন তিনজন দৈত্যাকার কালো মানুষকে মার্গারিট নিয়ে এসেছিল আমার ঘরে। তারা নাকি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলুম, ওরা বদ্ধ মাতাল আর ওদের মতলব খুব খারাপ। মার্গারিটকে সে কথা বললে ও বিশ্বাসই করতে চায় না। ওর ধারণা, পৃথিবীতে কোনও খারাপ মানুষ নেই।

সেই রকমই কোনও লোককে বেশি-বেশি বিশ্বাস করায় মার্গারিটের কিছু একটা সাংঘাতিক পরিণতি হয়েছিল। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমাকে সেই ঘটনার পূর্ণ বিবরণ কেউ জানায়নি। পল এঙ্গেল বলেছিলেন, সে বড় মর্মান্তিক ব্যাপার, সে তোমার শুনে কাজ নেই।

আমি আয়ওয়া শহরে আসতে চাইনি, কারণ আমি ভেবেছিলুম, মার্গারিটের স্মৃতির কষ্ট আমি সইতে পারব না। কিন্তু একলা-একলা অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর আমি হঠাৎ উপলব্ধি করলুম, কই, তেমন তো কষ্ট হচ্ছে না? আমি তো সব কিছুই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি। তবে কি আমার হৃদয় খুব কঠিন? সময়ের ব্যবধান কি এতখানি ভুলিয়ে দিতে পারে? ভুলিনি কিছুই, কিন্তু দুঃখের বদলে মার্গারিটের স্মৃতি আমার কাছে মধুর হয়ে আসছে।