প্রথমে একটা ছোট্ট স্বপ্নের কথা বলি। প্রতিদিনই আমরা অনেক স্বপ্ন দেখি, অধিকাংশ স্বপ্নই পরে আর মনে থাকে না, ধূপের গন্ধের মতো মিলিয়ে যায়। কোনও-কোনওটি সকালে জেগে ওঠার পরেও কিছুক্ষণ মনে থাকে, দুয়েকটা বেশ স্থায়ী দাগ রেগে যায় স্মৃতিতে। এই স্বপ্নটা বেশ মনে আছে।
আমি একটি নদীতে নামছি একটু-একটু করে। প্রথমে হাঁটু জল, তারপর কোমর পর্যন্ত, তারপর বুক, আমি কিছুই পরে নেই, একেবারে নগ্ন। দিনেরবেলা নয়, রাত্তিরবেলা, আকাশে চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে। তারপর দেখলাম দূরে বড়-বড় পাহাড়, রাত্তিরবেলাও জ্যোৎস্নায় চকচক করছে শিখরের তুষার। সাঁতার কাটার বদলে আমি আস্তে-আস্তে ডুবে গেলাম সেই নদীর গভীরে, তারপরই দূরে কামানের গোলার মতো কীসের যেন প্রচণ্ড শব্দ হল।
ব্যাস, এখানেই স্বপ্নের শেষ।
স্বপ্নের অনেকে-অনেকরকম ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। অধিকাংশই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। একেকটা স্বপ্ন নিজের কাছেই একটা বাঁধা হয়ে থাকে। কলকাতা শহরে, বিছানায় শুয়ে হঠাৎ আমি একটা নদীতে ডুব দেওয়ার স্বপ্ন দেখলাম কেন? দিনেরবেলা নানান কাজে ব্যস্ত থেকে আমি তো কোনও নদীর কথা একেবারে চিন্তা করিনি। তা হলে কি এটা কোনও প্রতীক? এ আমার মৃত্যু-বাসনা? কিন্তু কোনও নদীতে ডুবে মরা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পূর্ববঙ্গে জন্ম, আমি বেশ ভালোই সাঁতার জানি।
তা হলে কি অতৃপ্ত বাসনা? তাই-ই বা কী করে হবে, আমি জীবনে বহুবার বহু নদীতে ডুব দিয়েছি, এমনকী বিশ্ববিখ্যাত নদী ড্যানিয়ুবেও সাঁতার কেটেছি।
সে যাই হোক, স্বপ্নের ব্যাখ্যা থাক। স্বপ্নে আমি কোন নদীটাকে দেখলাম? রাত্তিরবেলা কোনও পাহাড় ঘেরা নদীতে কখনও স্নান করিনি, সুতরাং এটা আমার পূর্বস্মৃতি হতে পারে না।
স্বপ্নে অবশ্য আমরা অনেক অদৃষ্টপূর্ব জায়গা দেখি। মনে-মনে অনেক নতুন দৃশ্য তৈরি করি। তবু অনেক ভেবে-ভেবে একদিন মনে হল, আমার স্বপ্নে দেখা নদীটি একেবারে কল্পিত নয়, অনেকটা পহেলগাঁও-এর লিদার নদীর মতো।
লিদার বা লিদ্দার বা লিডার নদীটি অনেকের কাছেই পরিচিত। কাশ্মীরের ভ্রমণকারীরা পহেলগাঁও যান। আর অমরনাথের তীর্থযাত্রীদের বারবার এই নদীকে প্রত্যক্ষ করতে হয়। কাশ্মীর বাঙালিদের খুবই প্রিয় জায়গা, এখন অনেক বছর ধরে অবশ্য সেখানে যাওয়া বিপজ্জনক, কখন উগ্রপন্থীদের গুলিতে প্রাণটি যাবে তার ঠিক নেই। আবার কবে ওই স্বর্গসম উপত্যকায় সহজ, সাবলীল ও স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করা যাব কে জানে! তাই লিদার নদীর তীরের একটি অভিজ্ঞতার কথা লিখতে ইচ্ছে হল। এর সঙ্গে আমার ওই স্বপ্নের অবশ্য কোনও যোগ নেই। লিদার নদীর জলে যেমন তীব্র স্রোত, তেমনই ঠান্ডার কামড়, ওখানে স্নান করতে কখনও ইচ্ছে হয়নি।
পহেলগাঁওতে আমি গেছি দুবার।
প্রথমবার গিয়েছিলাম বয়েজ স্কাউটদের সঙ্গে, সব মিলিয়ে বোধহয় পঞ্চাশজন, সকলেরই পরনে খাকি হাফপ্যান্ট ও সাদা শার্ট। দলবেঁধে ঘোরার মজা আছে ঠিকই, অনেক হইচই ও আমোদ হয়, কিন্তু নিসর্গ উপভোগ করা যায় না। সেবারে রিজার্ভ বাসে করে ঘোরা, চেঁচিয়ে গান গাওয়া, লুকিয়ে চুরিয়ে ব্র্যান্ডি পান, এই সবই মনে আছে, নদীর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক স্থাপনের স্মৃতি নেই।
দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে, তিনজনের ছোট্ট দল, কোনও কারণে সেবার পহেলগাঁওতে তখন ভিড়ও ছিল না। ঠিক করেছিলাম, ওখানে নিরিবিলিতে কয়েকটা দিন কাটাব।
পহেলগাঁওতে প্রচুর হোটেল আছে, আমাদের সাধ হল তাঁবুতে থাকার। হোটেলের ঘর অনেক আরামদায়ক, কিন্তু স্বাতী অতি রোমান্টিক, তাঁবুতে রাত্তিরযাপনই তার বেশি পছন্দ। আমাদের ছেলে পুপলুর তখন ছ-সাত বছর বয়স। তার কাছেও তাঁবুতে থাকা বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো।
অনেক তাঁবু ভাড়া পাওয়া যায়। দোকানের লোকরাই তাঁবু খাঁটিয়ে দিয়ে যায়, একখানা শোওয়ার ঘর, থালা-গ্লাস, চায়ের কাপ-ডিশ, সব কিছুর জন্যই আলাদা-আলাদা ভাড়া। আমরা অবশ্য রান্নাবান্নার ঝামেলার মধ্যে যাইনি। দু-বেলা খেয়ে আসতাম শহরের দোকান থেকে। রাত্তিরবেলা খেয়েদেয়ে তাঁবুতে ফেরাটাই ছিল সবচেয়ে কষ্টের। পহেলগাঁও দিনেরবেলা
চমৎকার, সন্ধের পর থেকেই খুব শীত পড়তে শুরু করে, রাত আটটা-নটার সময়ই বাইরে থাকলে ঠান্ডা বাতাস হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। হু হু হু হু করতে করতে স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান একসঙ্গে দৌড় লাগাতাম তাঁবুর দিকে।
তাঁবুতে ফেরার পরেও কনকনে বিছানায় শোওয়াও যেন এক শাস্তি। বিছানা গরম করার জন্য তার ওপর আমরা লাফালাফি করতাম কিছুক্ষণ।
একটা ব্যাপারে আমাদের খুব সাবধান থাকতে হত। পহেলগাঁও আসবার আগে শ্রীনগরের অদূরে নাগিন হ্রদের এক বজরাতেও আমরা কাটিয়েছি কয়েকটি দিন। সেখানে একদিন পুপলুকে প্রায় অবধারিত মৃত্যুর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছে কোনওক্রমে। আশপাশের কয়েকটি বজরায় থাকত কিছু সাহেব-মেম। তাদের ছেলেদেয়েদের সঙ্গে পুপলুর ভাব হয়ে গিয়েছিল, তাদের সঙ্গে খেলা করত। এক বজরা থেকে আরেক বজরায় লাফিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে পুপলু হঠাৎ জলে পড়ে যায়। একে তো জল দারুণ ঠান্ডা, তা ছাড়া তলাটা ঝাঁঝিতে ভরা। ওই ঝাঁঝিতে পা জড়িয়ে গেলে আর কিছুই করার থাকে না। আমি আর স্বাতী তখন বজরার ছাদে বসে এক ফেরিওয়ালার কাছে রংবেরঙের পাথর যাচাই করছি। চেঁচামেচি শুনে উঁকি মেরে দেখি পুপলু জলের মধ্যে খাবি খাচ্ছে। দুয়েক মিনিটের মধ্যে কিছু করতে না পারলে তার বাঁচার আশা নেই। আমি উঠে দাঁড়িয়ে লাফাবার জন্য গায়ের কোট খুলে ফেললাম। যদিও এক ঝলকের জন্য মনে হল, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লে আমি নিজেই ঝাঁঝির মধ্যে গেঁথে যাব, পুপলুকে তো ধরতে পারবই না, নিজেকে বাঁচানোই তখন কঠিন হবে। তবু, নিজের সন্তানকে উদ্ধার করার জন্য কিছু একটা তো করতেই হবে, সে সময় যুক্তিবোধ কাজ করে না। আমি লাফ মারার জন্য উদ্যত হয়েছি, ঠিক সেই মুহূর্তে কোথা থেকে এক শিকারাওয়ালা এসে ঝুঁকে পুপলুর চুলের মুঠি ধরে তুলে এনে আমাদের চিরকৃতজ্ঞপাশে আবদ্ধ করেছিল।
পহেলগাঁওতে এসে সেইজন্যই সে দুরন্ত বালককে সব সময় চোখে চোখে রাখতে হয়। কোনওক্রমে লিদার নদীর জলে পড়লে তাকে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। নদীর মধ্যে বড় বড় পাথর, তীব্র স্রোত, স্রোতের টানে কোনও পাথরে গিয়ে পড়লেই মাথাটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে।
তবু, রাত্তিরবেলা তাঁবুতে শুয়ে নিস্তব্ধতার মধ্যে নদীর অবিরাম কুলকুল ধ্বনি শুনতে পাওয়াও এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
লিদার নদীটি তেমন কিছু বড় নয়, যদিও দুটি নদী মিলে এখানে একটি নদী হয়েছে। কোলহাই হিমবাহ আর শেষনাগ থেকে বয়ে এসেছে দুটি ধারা, পাহাড় থেকে নেমে এসে মিলিত হয়েছে এই উপত্যকায়। অনেকে বলে লিদারের আদি নাম নীলগঙ্গা। পহেলগাঁও থেকে অনন্তনাগ পর্যন্ত বয়ে গিয়ে এই নদী মিশে গেছে ঝিলম নদীতে।
আমরা দিন চারেক চুপচাপ কাটিয়ে দিলাম পহেলগাঁওতে। অধিকাংশ সময় বসে থাকতাম নদীর ধারে। তাঁবুতে কিছু রান্না না করলেও চা তৈরির ব্যবস্থা ছিল, ফ্লাক্সে ভরা থাকত চা। পুপলু আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে পাথর নিয়ে খেলা করত। অবিরাম ঘোরাঘুরি কিংবা দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার ব্যাকুলতার বদলে কোনও একটা জায়গায় স্থির হয়ে কয়েকদিন বসে থাকলেই সেই জায়গাটির সৌন্দর্য সঠিক উপলব্ধি করা যায়।
আরও কয়েকদিন হয়তো থাকতাম, কিন্তু অমরনাথের তীর্থযাত্রীদের ভিড় শুরু হয়ে গেল। সুন্দরের লীলাভূমিতে বেশি মানুষের ভিড় আমার পছন্দ হয় না, তীর্থ দর্শনেরও কোনও লোভ নেই। অনেকেই হয়তো শুনলে বিশ্বাস করবে না একবার পূর্ণকুম্ভের স্নানের সময় আমি এলাহাবাদের সঙ্গমের কাছে এক তাঁবুতে টানা চোদ্দো দিন ছিলাম, কিন্তু একবারও ন দাঁত নেমে স্নান করিনি। ওই ধরনের পুণ্য অর্জনে আমি বিশ্বাস করি না। যে কোনও নদীতে ডুব দিলেই পুণ্য হতে পারে, শুধু-শুধু এক লক্ষ মানুষের সঙ্গে গাদাগাদি করে ওই সঙ্গমে গিয়ে ডুব দিতে হবে কেন?
অমরনাথের পথে, চন্দনবাড়ি পর্যন্ত আমরা ঘোড়ায় চেপে ঘুরে এসেছি একদিন। পুপলুর রোমাঞ্চটাই আমরা উপভোগ করেছি বেশি। ওই বয়েসের ছেলেরা ঘোড়ায় চাপলেই নিজেকে রাজপুত্র বা সেনাপতি-পুত্র বলে ভাবে। হাতে থাকে কাল্পনিক তলোয়ার। পুপলু তখন রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটা মুখস্থ বলতে পারত।
চন্দনবাড়ির কাছে দেখেছি, লিদার নদীর জল প্রায় দুধের মতো সাদা। নদীর সঙ্গে আমরা নারীর তুলনা দিতেই পছন্দ করি। কিন্তু লিদার নদীকে দেখে আমার দুর্দান্ত প্রাণশক্তি সম্পন্ন এক কিশোর বলে মনে হয়েছে।
একদিন একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটেছিল। দুপুরবেলা নদীর ধারে একটা পাথরে হেলান দিয়ে শুয়ে আছি আমি। রোদ্দুর একেবারে নরম মখমলের মতো। এক সময় শনশন করে হাওয়া বইতে লাগল। শীত সবসময় বাতাসের সওয়ার হয়ে আসে। বরফ পড়লেও তেমন শীত করে না, বাতাস বইলেই কাঁপুনি শুরু হয়।
বেশি গরম জামা আনিনি, সব রয়েছে তাঁবুর মধ্যে। সেখান থেকে সোয়েটার-শাল নিয়ে আমার জন্য স্বাতী উঠে দাঁড়িয়েই, এই এই বলে চিৎকার করে উঠল।
স্বাতীর গলায় জড়ানো ছিল একটা চিত্র-বিচিত্র সিল্কের স্কার্ফ, সেটা হাওয়ায় উড়ে গেছে।
পাছে পুপলু সেটা ধরতে যায়, তাই এক হাতে তাকে নিষেধ করে আমি ছুটে গেলাম। স্কার্ফটা সুতো কাটা ঘুড়ির মতো দুলতে-দুলতে উড়ছে। স্কুল বয়সে আমার খুব ঘুড়ি ওড়ানোর নেশা ছিল, রাস্তায় অনেকবার ভোকাট্টা ঘুড়ি ধরার জন্য ছুটেছি। তখন দিকবিদিক জ্ঞান থাকে না, অনেক ছেলে এই অবস্থায় গাড়ি চাপা পড়ে, আমারও দুয়েকবার সেরকম সম্ভাবনা হয়েছিল।
এবারেও সেরকম হল। স্কার্ফটা যে নদীর দিকে উড়ে যাচ্ছে আমি তা খেয়াল করলাম না। আমার চোখ ওপর দিকে। পিছন থেকে স্বাতী এবং আরও কয়েকজন লোক চিৎকার করছে, আমি শুনতে পাচ্ছি না। একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে আমি পড়লাম জলে।
না, ততটা জলে নয়, যাতে স্রোতে আমাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। কেউ এসে ধরবার আগেই আমি উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হলাম। তবে, অন্ধের মতো ওইভাবে ছুটলে, পাথরে ধাক্কা না খেলে, আমার কপালে ঘোর বিপদ ছিল। স্কার্ফটা জলে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে।
পাথরটাই আমাকে বাঁচাল? কিংবা নদী। আমি জানি, কোনও নদীই কোনওদিন আমাকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাবে না।