[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

২৫. দুর্ঘটনা তো সব দেশেই হয়

দুর্ঘটনা তো সব দেশেই হয়। তাদের চরিত্রও মোটামুটি একই রকম। দুর্ঘটনার পরবর্তী অংশটির অভিজ্ঞতাই আলাদা।

আমাদের বাসটি দুর্ঘটনা ঘটাল সকাল দশটার সময়, প্রকাশ্য দিবালোকে এবং অপেক্ষাকৃত নির্জন রাস্তায়। সারারাত আমরা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এসেছি, তখন কিছুই হয়নি, অথচ বিপদ ঘটল কিনা নিরাপদ সমতলে। গ্রে-হাউন্ড বাস এমনিতেই খুব নির্ভরযোগ্য, ড্রাইভাররা খুবই অভিজ্ঞ এবং পরে শুনেছিলাম, আমাদের বাসের ড্রাইভারটি টানা পঁচিশ বছর নির্ভুল বাস চালাবার জন্য অতি সম্প্রতি কোম্পানির কাছ থেকে মেডেল পেয়েছিল। কিন্তু সকাল দশটায় গ্রে হাউন্ড বাসটি একশো কুড়ি কিলোমিটার বেগে যাওয়ার সময় অন্য একটি ট্রাক তার নাকের কাছে ছোট্ট একটি ধাক্কা দিল, সঙ্গে-সঙ্গে দুই ড্রাইভারের শরীরই চিঁড়েচ্যাপটা। একে নিয়তি ছাড়া আর কীই-বা বলা যায়।

আমি প্রাণে বেঁচে যাওয়ার পর উলটো দিকের রাস্তায় ঘাসের ওপর বসে রইলুম। বারবার শরীরের নানা জায়গায় হাত বুলিয়ে দেখছি। চোখ দুটো ঠিক আছে, নাক ঠিক আছে, দুটো হাত, দুটো পা অক্ষতই আছে, মাথার খুলিও উড়ে যায়নি। বাঁ-ভুরুর ওপরে খানিকটা গর্ত হয়েছে। ডান পায়ের গোঁড়ালি মচকে গেছে, শুধু এইটুকুই যা বোঝা যাচ্ছে।

আমাদের বাসটির বডি কেটে-কেটে নামানো হচ্ছে অন্য যাত্রীদের। কজন নিহত, কজন আহত এখনই বোঝা যাচ্ছে না। অনেকেরই হাত-পা ভাঙা। পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স এত তাড়াতাড়ি চলে এল কী করে, সেটাই বিস্ময়ের। রাস্তা দিয়ে পুলিশ পেট্রোল অনবরত ঘোরে, তা ছাড়া রাস্তার অন্য যেসব গাড়ি এই দুর্ঘটনা দেখেছে, তারা ওয়্যারলেসে খবর দিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই, এক মিনিটও সময় নষ্ট হয়নি।

আমাদের দেশে এরকম একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেই তারপর যেন মাটি খুঁড়ে উঠে আসে হাজার-হাজার মানুষ, তারা ভিড় করে দাঁড়ায় এবং প্রবল চ্যাঁচামেচির মধ্যে তৎক্ষণাৎ দুর্ঘটনা বিষয়ে পাঁচ রকম গল্প তৈরি হয়ে যায়। এখানে দৃশ্যটি একেবারে অন্যরকম। এ-দেশের রাস্তায় মানুষ থাকে না, কয়েকটি যাত্রীগাড়ি থেমেছে বটে, কিন্তু তাদের কোনও সাহায্যের দরকার আছে কি না, এইটুকু জেনে নিয়েই চলে যাচ্ছে। এদেশের লোকেরা অকারণে কণ্ঠনালির ব্যবহার করে না। একটুও গোলমাল নেই। আমাদের মতন যেসব যাত্রীরা অনাহত হয়ে বসে আছি এক জায়গায়, সেখানেও সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা, শুধু একটি বাচ্চা ছেলে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। শিশুটির বয়েস পাঁচ-ছ’বছর, ফুটফুটে চেহারা, ওর সোনালি চুলে রক্ত মাখা। ওর মা একবার আমাদের জানিয়ে দিয়েছে যে ওই রক্ত ওই শিশুটির নয়, অন্য একজন আহত লোকের রক্ত ওর চুলে লেগে গেছে।

অজস্র মেরিপোসা আর বুনো লিলি ফুটে আছে রাস্তার ধারে। সেখানে পা ছড়িয়ে বসে আমি উদ্ধার কার্য দেখছি। শরীর ও মন অবশ হয়ে আছে, দৈবাৎ প্রাণ ফিরে পাওয়ার তীব্র আনন্দও বোধ করছি না।

আমরা যেখানে বসে আছি, সেই রাজ্যটির নাম ওয়াইওমিং। এখানে জনবসতি খুব বেশি নেই। মাইলপনেরো দূরে একটা ছোট শহর আছে, একটু পরেই সেখানকার নাগরিকরা এলেন আমাদের আতিথ্য দিতে। সঙ্গে দু-তিনজন ডাক্তারও এসেছেন। তাঁরা পরীক্ষা করতে লাগলেন আমাদের। গুরুতর আহতদের তো বার করার সঙ্গে-সঙ্গেই অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। কিন্তু আমাদের শরীরে সেরকম কিছু আঘাত না লাগলেও মানসিক আঘাত লেগেছে কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখতে চান।

একজন বৃদ্ধ ডাক্তার আমার সামনে এসে বললেন, জীবনে তো এরকম অনেক কিছু হয়ই। সুতরাং এখন আর দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই।

আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালুম।

ডাক্তারটি আবার বললেন, মানুষের জীবন অনেক কিছুই সহ্য করতে পারে, তাই না?

আমি আবার ঘাড় নাড়লুম।

ডাক্তারটি এবার বেশ ধমক দিয়ে বলল, সে সামথিং!

ওঃ হো, ইনি বুঝি ভাবছেন আমি আকস্মিক শক-এ বোবা হয়ে গেছি? সুতরাং জোর করে ঠোঁটে খানিকটা হাসি টেনে এনে বললুম, আই অ্যাম অল রাইট।

আমার পাশের যে তরুণী মেয়েটি আগাগোড়া চুপ করে ছিল, ডাক্তারবাবুটি তাকেও জেরা করলেন ওইভাবে। সে মেয়েটিও শুধু ঘাড় নাড়ছিল। ডাক্তারটি একবার তাকে জিগ্যেস করলেন, তুমি কথা বলতে পারো না? মেয়েটি জানাল, অকারণে কথা বলি না।

বিভিন্ন গাড়িতে তোলা হল আমাদের। মাইলপনেরো দূরের শহরটিতে এসে একটা বড় বাড়ির সামনে থামল গাড়িগুলো। সে বাড়ির একতলায় একটা হলঘর, মনে হল থিয়েটার হল, এর মধ্যেই অনেকগুলো ক্যাম্প খাট পেতে ফেলা হয়েছে। আমাদের বলা হল সেখানে শুয়ে পড়তে। শুয়ে পড়লুম। সঙ্গে-সঙ্গে এল চা আর ডো-নাট। শুধু চা খেয়ে ডো-নাটগুলো রেখে দিলুম। তারপরেই এল কোল্ড ড্রিংকস, পেপসি আর কোকা কোলার টিন। চায়ের পরেই এটা খেতে হবে? কিন্তু ওরা বলছে বলে খেয়ে নিচ্ছি। মনটা এমনই অবসন্ন যে যে-যা বলছে শুনছি।

তবু খানিকটা বাদে মনে হল, শুধু-শুধু এই দিনের বেলা রুগির মতন খাটে শুয়ে থাকব কেন? অনেক মহিলা আমাদের সেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন, আমাদের কার কী দরকার জিগ্যেস করছেন। এর মধ্যে একজন আমার কপালের ক্ষতটা সিল করে দিয়েছেন। আমি খাট থেকে উঠে বাইরে চলে এলুম। এখন আমাদের আবার পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেই তো হয়।

শুনলুম, তার উপায় নেই। টেলিভিশনের লোক, রেডিয়োর লোক, বিমা কোম্পানির লোক, গ্রে-হাউন্ড কোম্পানির লোক এবং পুলিশের কাছে আলাদা-আলাদা বিবৃতি দিতে হবে। একসঙ্গে সবার কাছে একেবারে বলে দিলে চলবে না, কেউ কোনও কিছু গোপন করছে কি না, কিংবা কেউ দুর্ঘটনার সঠিক কারণ সম্পর্কে কোনও আলোকপাত করতে পারে কি না তা জানবার জন্য ওরা নিজেরা গোপনে জেরা করবে। সব মিলিয়ে অনেক সময়ের ব্যাপার।

এরকম দুর্ঘটনা থেকে এদেশে অনেকে প্রচুর টাকা রোজগার করতে পারে। যারা আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত, তারা তো ক্ষতিপূরণ পাবেই। নিহতদের নিকট আত্মীয়রা যেমন খুশি টাকা দাবি করবে। যাদের কোনও বাইরের আঘাত লাগেনি, তারাও মানসিক আঘাত লেগেছে কিংবা গুরুতর কোনও কাজ নষ্ট হয়ে গেছে, এই দাবিতে এক লাখ দু-লাখ টাকা পেতে পারে। সেজন্য অবশ্য মামলা করতে হবে। পশ্চিমবাংলায় দ’খনোদের খুব মামলা করার ব্যাপারে সুনাম আছে, সে হিসেবে আমেরিকানরা প্রায় সবাই খুব দ’খনো। কথায়-কথায় মামলা করে। ‘আই উইল স্যু ইউ’ এটা একটা কথার লবজ। এমনকি বাবাও যদি ছেলেকে বা মেয়েকে খুব বকাবকি করে, তখন ছেলে-মেয়ে বলতে পারে, ড্যাডি, ইউ আর হর্টিং মাই ফিলিং! সেই অভিযোগে মামলা হয়। এবং প্রমাণিত হলে বাবাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।

কিন্তু মামলা-মোকদ্দমা করে বড়লোক হওয়ার সাধ আমার একটুও নেই, আমি এখন পালাতে পারলে বাঁচি।

আর একটি হল ঘরে জেরা চলছে। খুব সাজগোজ করা মহিলাদের ভিড়ও বাড়ছে। এক সময় কয়েকজন মহিলা একদিকের একটা টেবলে বিরাট এক ঝুড়ি আপেল এনে রাখলেন। আর কয়েকজন মহিলা আর একটা টেবলে রাখলেন এক ঝুড়ি আইসক্রিমের কাপ। তারপর দুদলই ডাকাডাকি করতে লাগলেন আমাদের।

এক সঙ্গে আপেল আর আইসক্রিম খাব? দুদলের পেড়াপিড়িতে নিতেই হল।

আর একটু পরে এসে গেল মিষ্টি বিস্কুট (এ দেশের ভাষার যার নাম কুকি) এবং ততোধিক মিষ্টি, তলতলে পিঠে (এ দেশে যার নাম পাই)। এ কী রে বাবা, এত সব খেতে হবে নাকি? একটু পরেই জানতে পারলুম যে এই ছোট শহরটির বিভিন্ন মহিলাদের ক্লাবের মধ্যে অতিথি পরায়ণতার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। দলে-দলে মহিলারা রুজ-লিপস্টিক মেখে, তাঁদের শ্রেষ্ঠ পোশাকটি পরে সাজো-সাজো রবে ছুটে আসছেন দুর্গতদের সেবা করবার জন্য। রোটারি ক্লাব, লায়ন্স ক্লাব, অল মাদারস ক্লাব, সিস্টারস অব চ্যারিটি–এঁরাও নাকি এসে পড়বেন খানিকটা পরেই। অনেকদিন এখানে নাকি এরকম বড় গোছের দুর্ঘটনা ঘটেনি, অনেকদিন এঁরা পরোপকার করবার কোনও সুযোগ না পেয়ে উপোসি ছারপোকা হয়ে আছেন, আজ এমন সুবর্ণসুযোগ কেউ ছাড়তে চান না।

একদিকে পুলিশ-ইনসিওয়েন্সের কাছে জেরা চলছে, অন্য দিকে আমরা অনবরত খেয়ে চলেছি। অত খাবার অবশ্য আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়। মহিলারা হাতে একটা কিছু খুঁজে দিচ্ছেন আর আমি বাইরে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে টপাস করে ফেলে দিচ্ছি। এইভাবেই, দুর্ঘটনার বিভীষিকা মন থেকে মুছে গিয়ে সব কিছুই বেশ হাসির ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। আমাদের উপকার করার জন্য সুন্দরী-সুন্দরী মহিলাদের চোখে মুখে কী দারুণ উৎকণ্ঠা। পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর একজন করে এসে জিগ্যেস করে যাচ্ছেন, তোমার কিছু লাগবে? তুমি কিছু অসুবিধে বোধ করছ? আমার কিছুই চাই না শুনে তাঁরা দারুণ নিরাশ হয়ে চলে যাচ্ছেন।

আমার সহযাত্রীদের মধ্যে দুজন ডাকাতের মতন চেহারার যুবক এক সময় আমার পাশে এসে বসল। এরা খুব সিগারেট খোর, সেইজন্যই এরাও আহত হয়নি। মাথার চুল উস্কোখুস্কো, লালচে চোখ, লম্বা গোঁফ দুজনেরই। খুব গম্ভীরভাবে এরা আমার সঙ্গে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে শুরু করল।

এরকম অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছে। এই যুবক দুটি নিশ্চয়ই মেক্সিক্যান। এরা ভারতীয়দের দেখলেই নিজেদের স্বজাতি বলে ভুল করে। আমি দু-হাত নেড়ে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে আমি স্প্যানিশ ভাষা জানি না। ওরা মানতে চায় না। ওদের মুখে ভয়ের ছাপ। এমনও হতে পারে, ওরা বে-আইনিভাবে মেক্সিকো থেকে স্টেটসে ঢুকে পড়েছে। আর ধরা পড়ার সম্ভাবনাও ছিল না, কিন্তু এই দুর্ঘটনার পর পুলিশ জেরা করার সময় ওদের কাছে কাগজপত্র দেখতে চাইবে। আমাকেও এর মধ্যে একবার পাসপোর্ট দেখাতে হয়েছে।

ওরা দুজনে একসঙ্গে অনেক কথা বলে যেতে লাগল আমাকে। আমি এক বর্ণ বুঝলুম না, তবু ওরা বলবেই। মহা মুশকিলে পড়া গেল। ওদের দুটি সিগারেট দিয়ে একটুক্ষণের জন্য নিরস্ত করে আমি উঠে গিয়ে পরোপকারী মহিলাদের কয়েকজনকে ইংরিজিতে বললুম, আপনারা কেউ স্প্যানিশ ভাষা জানেন? তাহলে ওই লোক দুটির খুব উপকার হয়। ওদের কথা কেউ বুঝতে পারছে না।

ওই মহিলারা কেউ স্প্যানিশ জানেন না বটে, তবে ওঁদের একজনের স্বামীর বন্ধু কিছুদিন মেক্সিকোতে ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ স্বামীর বন্ধুকে ফোন করলেন। এবং সে ভদ্রলোক আসতে রাজি হওয়ায় ভদ্রমহিলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তাকে আনতে। পরোপকারের একটা সুযোগ পেয়ে সে মহিলার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, অন্যদের দিকে তিনি একটা গর্বিত দৃষ্টি দিয়ে চলে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে প্রাশান জেনারেলের মতন চেহারার একজন মহিলা এসে ঘোষণা করলেন যে অতিথিদের দুপুরের আহারের ভার তিনি নিয়েছেন। অতিথিরা যেন দয়া করে তাঁর পিছু পিছু আসেন।

এতক্ষণ ধরে এত রকমের খাওয়ার পর এর মধ্যেই আবার দুপুরের খাওয়া? মাত্র একটা বাজে। আমরা কেউ উঠছি না, মহিলা আবার বললেন, দয়া করে আসুন, দেরি করবেন না, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।

অগত্যা আমাদের যেতেই হল। খানিকটা হাঁটা পথে আমরা গেলুম আর একটি বাড়িতে। এটাও কারুর ব্যক্তিগত বাড়ি নয়, একটা কোনও প্রতিষ্ঠান। আমরা ঢুকলুম পেছনের দরজা দিয়ে। বিশাল ডাইনিং হলে অনেক টেবল পাতা। আমরা অনাহত বাসযাত্রী বাইশ-তেইশ জন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলুম। আমাদের দেওয়া হল, এক প্লেট ভুট্টা সেদ্ধ, রুটি-মাখন, একটা বোল ভরতি সুপ, তাতে বেশ বড়-বড় মাংসের টুকরো আর একটা আপেল। বেশ পুষ্টিকর খাদ্যই বলতে হবে, কিন্তু কেন জানি না, সে খাবারের মধ্যে আমি জেলখানার গন্ধ পেলুম। অবশ্য এ কথাটা কারুকে বলা যায়না।

ফিরে গিয়ে আবার বসলুম জবানবন্দি দিতে। গ্রে-হাউন্ড কোম্পানি আমাদের জন্য আলাদা একটা বাস আনিয়ে রেখেছে এর মধ্যে, এখানে আমাদের কাজ মিটে গেলেই রওনা করিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু কতক্ষণে মিটবে ঠিক নেই। আমার সহযাত্রীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অনেক কিছু দাবি করেছে। পুলিশের লোক বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চায়, দুর্ঘটনার জন্য আসল দোষটা কার। আর ইনশিয়োরেন্সের লোক এই সময় চোখ পাকিয়ে থাকে। অর্থাৎ এর উপরেই অনেক কিছু নির্ভর করছে। আমি কারুর সাতে-পাঁচে নেই, আমি যা সত্যি কথা তাই বলছি, অর্থাৎ আমি পেছন দিকে বসেছিলুম, আমি কিছু দেখিনি।

সাড়ে তিনটে বাজতে-না-বাজতেই গটগট করে ঢুকলেন আর কয়েকজন মহিলা। আবার আমাদের খাবার খেতে যেতে হবে? আমরা আকাশ থেকে পড়লুম। এর মধ্যে আবার খাবার? এ কি পাগলের কাণ্ড নাকি?

এবার সবাই আমরা একযোগে প্রতিবাদ করলুম। ভদ্রমহিলারাও নাছোড়বান্দা, প্রত্যেকের কাছে গিয়ে বলতে লাগলেন, প্লিজ এসো, তোমাদের খাবার টেবলে দেওয়া হয়ে গেছে, নষ্ট হবে, প্লিজ এসো।

পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বাধ্য হয়েই যেতে হল আমাদের। এবারেও সেই দুপুরের জায়গাটাতেই। তবে এবারের সেখানকার ডাইনিং হলে আরও পঞ্চাশজন নারী পুরুষ বসে আছে। এবারেও আমাদের দেওয়া হল সেই ভুট্টা সেদ্ধ, সেই রুটি-মাখন, সুপ আর আপেল। এ কি, এরা কি ভুলে গেছে নাকি যে আমরা দুপুরে একবার খেয়েছি? অন্য যারা বসে আছে তারা সবাই কী রকম যেন চোখ করে চেয়ে আছে। আমার ঠিক পাশের টেবিলেই বসে আছে খুব লম্বা মতন একটি যুবতি, তার চোখ দুটি ছলোছলো, সে অযাচিতা হয়েই আমাকে বলল, জানো, আমি কবিতা লিখি, কিন্তু আমার কবিতা কেউ পড়ে না। আমার সব কবিতা নদী নিয়ে, ছোট নদী, বড় নদী, লাল নদী, নীল নদী, কিন্তু কেউ পড়ে না।

কথাগুলো শুনে আমার বুক দুরদুর করতে লাগল। আর একজন বলল, একটা বাস উলটে গেছে, তাতে এক হাজার জন লোক মরে গেছে, তাই না? কিংবা দুহাজার? তিন হাজার? চার হাজার? কিছু দূর থেকে কে যেন একটা আপেল ছুঁড়ে মারল, সেটা দুম করে লাগল দেওয়ালে। তারপর আরও পাঁচ-ছ’টা আপেল এসে পড়ল দেওয়ালের দিকে। অনেকে একসঙ্গে ‘হা-হা’ করে হেসে উঠল।

আমার এক সহযাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, ও বয়! দিজ আর অল নিজ! বলেই সে দৌড় লাগাল।

তা হলে তো দুপুরে আমার ঠিকই মনে হয়েছিল। এখানকার খাবারে জেলখানার গন্ধ। এটা একটা মানসিক রোগগ্রস্তদের প্রতিষ্ঠান। আমার সহযাত্রীরা সবাই সরে পড়তে লাগল। আমার পাশের লম্বা মেয়েটি তখনও ঝুঁকে পড়ে আমায় কী সব বলছে, আমি যেতে পারছি না। ভয়ে আমার বুক কাঁপছে। একবার যদি এদের মধ্যে আটকে পড়ি, জীবনে বোধহয় আর কখনও বেরুতে পারব না। আমি উঠে দাঁড়াতেই লম্বা মেয়েটি দু-তিনটে আপেল আমার হাতে ঠেসে দিয়ে বলল, এগুলো নাও। আমি বললুম, না, না, আমার চাই না। অন্য টেবল থেকে কয়েকজন আপেল নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে।

অন্য দিকে তাকিয়ে দেখি, আমার যেসব সহযাত্রী চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, মেট্রন-ধরনের মহিলারা তাদের তাড়া করতে-করতে বলছে, এই, যাচ্ছ কোথায়। খেয়ে যাও। না খেয়ে যেতে পারবে না। তাহলে কি ওরাও পাগল। পাগলেরাই আমাদের ডেকে এনেছে।

দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি দৌড় মারলুম। সোজা গিয়ে উঠে বসে রইলুম আমাদের জন্য নির্দিষ্ট বাসটায়। বাপরে বাপ, ওয়াইওমিং-এর পাগলদেরও এত পরোপকারের নেশা? নমস্কার ওয়াইওমিং, তোমাকে সারাজীবন মনে থাকবে।