বাংলাদেশে আমার বন্ধুরা
কলেজ জীবনে মনে হত, সমাজে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি, কোনও মন্ত্রীটন্ত্রি কিংবা জননেতা নন, বরং কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। চ্যান্সেলরও নন, কারণ তিনি আসেন পদাধিকার বলে। যেমন কোনও রাজ্যপাল কিংবা রাষ্ট্রপতি। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর চ্যান্সেলর বা আচার্য হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হন পশ্চিম বাংলার রাজ্যপাল। এঁরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তেমন বিদ্বান না হতেও পারেন। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর বা। উপাচার্য হিসেবে প্রকৃত কোনও উচ্চস্তরের বিদ্বান ব্যাক্তিকেই মনোনীত করা হয়। পরে অবশ্য জেনেছি, এটা সব সময় সত্যি নয়, এই মনোনয়নের মধ্যেও কিছু কিছু রাজনৈতিক কারসাজি থাকে। অল্প বয়সে তা জানতাম না, ভাইস চ্যান্সেলরদেরই মনে হত সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, তাঁরা অনেক দূরের মানুষ, তাঁদের দিকে আড়াল থেকে ভক্তিভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। কোনও উপাচার্যের সঙ্গে এক টেবিলে মুখোমুখি বসে কথা বলার সুযোগ পাওয়াটা সৌভাগ্যের পরাকাষ্ঠা।
কলেজ জীবনে সে সৌভাগ্য আমার হয়নি।
উপাচার্যদের শুধু দূর থেকে সমীহই করেছি, তাঁদের ব্যাক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি।
পরিণত জীবনে অনেক ধারণাই ওলট-পালট হয়ে যায়। এখন তো দেখি, অনেক উপাচার্য বিদ্বান হলেও আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। আমি শিক্ষা জগতে যাইনি, ছাত্র হিসেবে তেমন প্রতিভাবানও ছিলাম না। সুতরাং আমার পক্ষে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না কখনও। কিন্তু আমার কোনও কোনও বন্ধু উপাচার্য হয়েছে। সারা ভারতে অন্তত সাত আটজন উপাচার্যকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। তাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে চা খেয়েছি। এমনকী অন্যান্য পানীয়েরও সদ্ব্যবহার করেছি। অল্পবয়সের সেই অসাধ্য কল্প সাধ এ বয়সে মিটেছে। সমাজ জীবনে সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ কে?
বাছাবাছি করতে গেলে কত যে নাম বাদ দিতে হয় তার ঠিক নেই। আমার কাছে এ তালিকায় এক নম্বরে আছে ফিল্ম স্টুডিও-র মালিক। এটা নিতান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ব্যাপার, সাধারণভাবে এরকম বিচার করা যায় না। স্টুডিও-র মালিকদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই সজ্জন। কিন্তু আমার জীবনে প্রথম যে চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং স্টুডিও-র অধিকারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তাঁকে আমি ঘোরতর অপছন্দ করেছিলাম। শুধু অপছন্দ না, মনের মধ্যে অত্যন্ত বিরাগ ও ঘৃণা জন্মেছিল।
তখনও আমি গদ্যলেখক হিসেবে তেমন পরিচিত নই, দু-চারখানা উপন্যাস লিখেছি, আর্থিক অসাচ্ছল্য পিছু ছাড়েনি। এমন সময় খবর এল, এক প্রযোজক আমার একটি বেশ দুর্বল উপন্যাস দিয়ে ফিল্ম বানাতে আগ্রহী। বাইরে তেমন প্রকাশ না পেলেও মনে-মনে দারুণ উৎফুল্ল হয়েছিলাম। টাকার যে দরকার খুবই। নুন আনতে আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। পরিচালকের প্রস্তাব অনুযায়ী ফিল্মটি হবে বাংলা ও হিন্দিতে। বাংলায় সামান্য টাকা পাওয়া যায়, হিন্দিতে অনেক বেশি। কত টাকা হতে পারে? এর আগে আমার বন্ধু অরবিন্দ গুহর ‘আপনজন’ নামে একটি ছোটগল্পের ওরকম ডাবল ভার্সান হয়েছিল, তখন শুনেছি, উনি পেয়েছেন কুড়ি হাজার টাকা। সে আমলে, সত্তর দশকে, কুড়ি হাজার টাকার মূল্য অনেক, আমার কাছে স্বপ্নেরও অতীত। তখন আনন্দ পুরস্কার ছিল এক হাজার টাকা। এখন পাঁচ লাখ।
পরিচালক আমাকে বললেন, টাকা-পয়সার ব্যাপারে তাঁর কোনও হাত নেই। সেটা ঠিক করবেন প্রযোজক। তিনি একটি স্টুডিও’র মালিক, ডিস্ট্রিবিউশন চেইন আছে, বিশাল ধনী। পরিচালকই আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন স্টুডিওতে। সেখানে মালিকের বিলাসবহুল কক্ষ, তেমন কক্ষে আমার আগে প্রবেশ করার বিশেষ সুযোগ ঘটেনি। মালিক মহাশয়ের মস্তবড় চেহারা, দৈর্ঘ্যে ততটা নয়, প্রস্থেই বেশি। তিনি বসে আছেন একটি সোফায়, তাঁর খুব কাছাকাছি একটি চেয়ারে একজন সাধারণ চেহারার রমণী, বোঝাই যায় তাঁর স্ত্রী নন, উচ্চপদস্থ কর্মচারীও নন, মহিলার পরনের শাড়িটি সস্তা ধরনের। অন্য দুজন পুরুষ কর্মচারী উপস্থিত। আমাকে ও পরিচালককে বসতে দেওয়া হল উলটোদিকের চেয়ারে। পরিচালকের খুব একটা ব্যক্তিত্ব নেই, মুখে একটা কৃতার্থ ভাব।
সেই ঘরে আমি ছিলাম চল্লিশ মিনিট। তার মধ্যে ওই মালিক ভদ্রলোক আমার রয়ালটি কুড়ি হাজার থেকে বারো হাজারে নিয়ে আসেন। এ ব্যাপারে তাঁর অসাধারণ প্রতিভা। তাঁর টাকা কমাবার পদ্ধতিটি এইরকম; কুড়ি তারিখে তাঁর জন্মদিন, সেই জন্য কুড়ি সংখ্যাটি টাকা-পয়সা সংক্রান্ত ব্যাপারে কখনও ব্যবহার করেন না। বেজোড় সংখ্যা তাঁর পক্ষে অপয়া। সুতরাং উনিশও চলবে না। তার মেয়ের বয়স আঠারো। সতেরো বাদ তো হবে। যোলো সংখ্যায় আগের ছবিটি বক্স অফিসে মার খেয়েছে ইত্যাদি। আমি কোনও কথাই বলতে পারছি না। উনি এই দরাদরির সময় মাঝে-মাঝেই বলছেন, ক্যাশ টাকা তাঁর রেডি আছে, একবার টাকার অঙ্কটা ঠিক হয়ে গেলেই তিনি সঙ্গে-সঙ্গে পেমেন্ট করে দেবেন পুরোটা, ধার-বাকির কারবার তিনি পছন্দ করেন না।
বারো হাজার নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন আমার বুক ধড়ফড় করতে শুরু করেছে। আরও কমবে? এর পরেই তো দশ। মনে-মনে কুড়ি হাজার নিয়ে কত কী করার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম। যাই হোক, দয়াপরবশ হয়ে তিনি বারোতেই থামলেন, বারো নাকি তাঁর লাকি নাম্বার। ততক্ষণে আমার অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। আমার গা ঘিন ঘিন করছে!
মালিকের পাশের মহিলাটির সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। আগাগোড়া সে নিঃশব্দ। কথা বলার মাঝেমাঝে মালিকটি সেই মহিলার ঊরুতে চাপড় মারছে। প্রথম প্রথম আমি অবাক হয়েছি। পরে আর ওদিকে তাকাইনি। মালিকটি এক-দেড় মিনিট অন্তর অন্তর মহিলার উরুতে চাপড় মেরেই চলেছে। এটা কী ব্যাপার!
পরে শুনেছি, কোনও মেয়ের ঊরুতে চাপড় মারা নাকি ওই মালিকটির মুদ্রাদোষ। সেই জন্য সব সময় তাঁর পাশে একটি মেয়েকে বসাতে হয়। প্রত্যেকদিন এক মেয়ে না হলেও চলে। কর্মচারীরা মোটামুটি স্বাস্থ্যবতী কোনও মেয়েকে জোগার করে আনে, এ জন্য মেয়েটি তিরিশ টাকা পায়। অর্থাৎ প্রতিদিন তার ঊরুর ভাড়া তিরিশ টাকা।
মালিকটি ওই রমণীর সঙ্গে আর কোনও যৌন কদাচারে লিপ্ত হয় কি না, তা আমি জানি না। ওইসব ব্যক্তিদের অন্তরাল-জীবন নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোরও কথা নয়, কিন্তু প্রকাশ্যে এরকম অভ্যতা অমার্জনীয়। ধনী ব্যক্তিদের নানারকম মুদ্রাদোষ থাকে, কিন্তু অন্যদের সামনে এক মহিলার ঊরু চাপড়ানো, শুধু সেই মহিলার পক্ষেই অপমানজনক নয়, উপস্থিত অন্যদের প্রতিও চরম তাচ্ছিল্যের নিদর্শন।
সেদিন হাত পেতে সেই বারো হাজার টাকা নিয়েছিলাম বটে, কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে আর কোনওদিন কোনও প্রযোজক বা স্টুডিও মালিকের কাছে যাব না, তাতে আমার আর কোনও গল্পের সিনেমা না হয় না হোক! দরকার হলে তারা আমার কাছে আসবে। সত্যি আর কখনও যাইনি একমাত্র ব্যতিক্রম সত্যজিত রায়, তিনি অবশ্য প্রযোজক নন, পরিচালক। এবং শুধু পরিচালকই নন, জ্ঞানে-গুণে-ব্যক্তিত্বে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। সুকুমার রায়ের পুত্র, নিজেও লেখক, আমাদের সাহিত্য জগতেরই মানুষ। সত্যজিৎ রায়ের অসাধারণ ভদ্রতার কথাও এখানে লিপিবদ্ধ করে রাখা উচিত। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ কাহিনি নিয়ে তিনি যখন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভাবেন, তখন আমি নিতান্তই এক তরুণ লেখক, আর তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যাক্তিত্ব। তবু তিনি প্রথম দিন আমাকে টেলিফোন করার পর বলেছিলেন, এই গল্পটা নিয়ে আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা করা দরকার, কোথায় দেখা হবে? আমি কি আপনার বাড়িতে যাব, না আপনি আমার বাড়িতে আসতে পারবেন? আমি তখন দমদমের দিকে একটি ছোট দু-কামরার ফ্ল্যাটে থাকি, সেখানে অতবড় একজন মানুষকে (আক্ষরিক অর্থেও) বসাবার জায়গা ছিল না। আমিই গিয়েছিলাম তাঁর কাছে। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের আলোচনা আজও মনে গেঁথে আছে।
বহু বছর পরে, একবিংশ শতাব্দীতে পা দিয়ে আমি আর একবার একটি স্টুডিও-তে, ঠিক স্টুডিও নয়, ফিল্ম ভিলেজ বলা যায়, উপস্থিত হই। ঠিক গ্রামের মতোই সাজানো বিস্তৃত অঞ্চল, যেখানে কুঁড়েঘর, চেঁকিশাল, পুকুর যেমন আছে, তেমনি আছে পাকা বাড়ি, আধুনিক সুইমিং পুল ইত্যাদি। এবং রাজপ্রাসাদ কিংবা দুর্গের সেট মতো ফাঁকা জায়গা। অর্থাৎ যে-কোনও কাহিনিরই শুটিং হতে পারে এখানে। এই স্টুডিও তথা ফিল্ম ভিলেজটির মালিক আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করেছিলেন। ইনি নিজেও একজন লেখক, আমার চেয়ে অনেক বেশি খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় লেখক। হ্যাঁ, হুমায়ন আহমেদ! এই ফিল্ম ভিলেজটির নাম নুহাশ পল্লি, ঢাকা শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। হুমায়ূন এখন নিজেই নিজের কাহিনির চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। সেইসব চলচ্চিত্রে সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। হুমায়ুন আহমেদ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে। প্রথম জীবনে ফিল্ম প্রডিউসার তথা স্টুডিও-র মালিকদের সম্পর্কে আমার যে বিরাগ ছিল, হুমায়ুনের তা জানার কথা নয়। কিন্তু পরিণত জীবনে যাতে সেই গ্লানি সম্পূর্ণ ঘুচে যায়, নিয়তি নিৰ্বন্ধে হুমায়ূন যেন সেই কাজটিই করলেন।
দুবারই নুহাশ পল্লিতে গিয়ে আমি অপার, বিশুদ্ধ আনন্দ পেয়েছি!
প্রথমবার গিয়েছিলাম, হুমায়ূনের মেয়ের বিয়েতে। খুবই বর্ণাঢ্য বিবাহ-উৎসব হয়েছিল ঢাকাতে, তারপর একটি দাওয়াত নুহাশ পল্লিতে। হুমায়ূন আমন্ত্রণ করার সময় জানিয়েছিল তার মেয়ে নাকি বলেছে, তার দু’চারখানি গয়নার বদলে সে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামের এক লেখককে বিয়ের উৎসবে অতিথি হিসেবে পেতে চায়। সম্ভবত কথাটি সত্যি নয়। হুমায়ূন রসিকতার ছলে এমন অনেক গল্প বানায়, আমি জানি। কিন্তু সত্যি না হলেও এরকম গল্প শুনলে যে-কোনও লেখকের বক্ষ উত্তাল হয়।
এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্যে আমরা ঢুকেছিলাম নুহাশ পল্লিতে। কয়েকশো মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল দুপাশে। হুমায়ুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু করিম একজন আর্কিটেক্ট, সে আমাকে বলেছিল, আমার আর স্বাতীর জন্যই ওখানকার অতিথিশালায় সদ্য আধুনিক বাথরুম বানানো হয়েছে। তার দেয়ালের রং তখনও কাঁচা। হয়তো, এটাও কথার কথা, তবু এরকম মধুর মনোরঞ্জনের কথাই-বা কে বলে!
দ্বিতীয়বার গেলাম আরও এক আশ্চর্য কারণে।
হুমায়ুনের একটা ফিল্মের শুটিং-এর শেষ দিন, সব ফিল্ম ইউনিটেই এই দিনটিতে একটা উৎসবের মতো হয়। ক্যাম্প ফায়ার, নাচ-গান-হই-হুল্লা, উদ্দামতা হয়। এটা শুধুই ইউনিটের নিজস্ব ব্যাপার। আমি সম্পূর্ণ বাইরের লোক, সে ফিল্মটি সম্পর্কেও কিছু জানি না। তবু সেই উৎসব-উদযাপনের দিনে সস্ত্রীক আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কলকাতা থেকে।
এই নুহাশ পল্লিতে আমি প্রতিবারই দেখেছি মাজহারুল ইসলামকে, অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক। মাজহার এই ডাকনামেই সে পরিচিত। গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ, কিন্তু অত্যন্ত সুদর্শন এই যুবকটির স্বভাব যেমন প্রীতিময়, তেমনই সে খুবই পরিশ্রমীও উদ্যমী। মাজহারের অন্য তিন বন্ধু মাসুম, কমল ও নাসেরও তার মতোই উদ্যমী। পারস্পরিক বো ঝাঁপড়া ও আত্মিক সম্পর্ক অত্যন্ত গাঢ়। এমনটা সচরাচর চোখে পড়ে না। এই চার বন্ধু অতি অল্প সময়ের মধ্যে অন্যদিন পতিকাটিকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, আর তাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও প্রচুর বই প্রকাশ করছে। এই পত্রিকা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ুনের চলচ্চিত্র প্রযোজনার ব্যাপারে মাজহারের কোনও আর্থিক সংযোগ আছে কি না, তা জানি না। তবে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাই বেশি চোখে পড়ে। ওডহাউসের একটি উপন্যাসে আছে যে, একজন প্রকাশক একজন লেখিকাকে চুমু খাচ্ছে। ওডহাউস তাতে মন্তব্য করেছিলেন, কোনও প্রকাশক কর্তৃক কোনও লেখিকাকে চুম্বন অবশ্যই বিশ্ব রেকর্ড কারণ লেখক-প্রকাশকের এরকম হৃদ্যতার কোনও উদাহরণ নেই। সব লেখকই প্রকাশকদের সন্দেহের চোখে দেখে। সাহেবদের দেশেই যদি এই অবস্থা হয়, আমাদের দেশে তা আরও বাস্তব সত্য। কিন্তু এক্ষেত্রে হুমায়ূনের সঙ্গে অন্যপ্রকাশের যে পরস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক, তা খুবই ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য হতে পারে।
অন্যদিন সম্পাদক মাজহার আর লেখক হুমায়ূন আহমেদ থাকে ধানমন্ডির একই বাড়িতে, দুটি পাশাপাশি ফ্ল্যাটে প্রতিবেশী। দু’তরফেই পারিবারিক সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ। এ ফ্ল্যাটের রান্না ও ফ্ল্যাটে যায়। অবাধ মেলামেশা।
ঢাকা শহরে আমার পরিচিতের সংখ্যা নেহাত কম নয়। একাত্তর সালের পর থেকে যাতায়াত করছি নিয়মিত, আড্ডা জমেছে অনেক বাড়িতে। বীথি ও গাজী শাহাবুদ্দীনের বাড়ি প্রায় আমাদের নিজের বাড়ির মতো। বেলাল চৌধুরী আমার সহোদরের মতো এবং নিত্য সহচর। ইদানীং কয়েক বছর ধরে ঢাকায় গেলেই একদিন না একদিন হুমায়ূন-মাজহারের ব্যবস্থাপনার আসরে যেতেই হয়। সে আসর হতে পারে ঢাকা ক্লাবে কিংবা অন্যত্র, কিন্তু বাড়ির মধ্যে অন্তরঙ্গ আচ্ছাই আমার বেশি পছন্দ। কয়েক বছর ধরে ওদের যৌথ ফ্ল্যাটে আড্ডাই বেশি জমে।
মাজাহারকে চিনি বেশ কিছুদিন। তার আগ্রহ আতিশয্যে প্রতি বছর অন্যদিন ঈদসংখ্যাতে একটা উপন্যাস লিখে থাকি। বাংলাদেশের অন্য প্রকাশকরা আমাকে পরিত্যাগ করেছে, তাদের কারুরই আর মুখ দেখি না, শুধু মাজহারই আমাকে আকর্ষণ করে আছে। কয়েক বছর আগেও সে নিয়মিত কলকাতা আসত সদলবলে। এখানেও বেশ আড্ডা জমত, তার বাবার চিকিৎসার জন্যও মাজহারকে আসতে হত। তারপর একটা দুঃখজনক ঘটনার পর সে আর তেমন আসে না। একবার নিউ ইয়র্ক শহরে হুমায়ুন, করিম, মিলন, কমল ও মাজহার একসঙ্গে এসেছিল, খুব আড্ডা জমেছিল মনে আছে।
এখন ঢাকাতে হুমায়ূন কিংবা মাজহারের আমন্ত্রণ পেলে আমি খুবই উৎফুল্ল বোধ করি। মাজহারের ব্যবস্থাপনা নিঃশব্দ। সে নিজেকে একটু আড়ালে রাখতে ভালোবাসে। আমার স্ত্রী স্বাতীর সঙ্গে মাজহারের স্ত্রী ও অন্যদের সম্পর্ক আত্মীয়তার মতো।
হুমায়ূনের সঙ্গে আড্ডার প্রধান অঙ্গ গান-বাজনা। হুমায়ুন খুবই সঙ্গীতপ্রিয়। তার ফিল্মগুলোতে সে নিজেই গান লেখে। তবে গায়ক সে নয়। তার নাটক ফিল্ম ইউনিটের অনেকেই উপস্থিত থাকে আড্ডায়, গায়ক-গায়িকার অভাব নেই। হুমায়ুনের স্ত্রী শাওনও একজন ভালো গায়িকা। আমি ও স্বাতী ওর গানের ভক্ত। সুতরাং গানের সুর সব ছোটখাটো কথাবার্তা ছাপিয়ে যায়।
হুমায়ূন গান ভালোবাসে, গানের সমঝদার এবং মাঝেমাঝে সে যেসব টুকটাক গল্প ছাড়ে, তা অনবদ্য। রসিকতায় সে প্রায় সৈয়দ মুজতবা আলির সমতুল্য। হুমায়ুনের এইসব রঙ্গরসিকতা কেউ লিখে রাখলে তা অনায়াসে হুমায়ুন কথামৃত হিসেবে স্থায়ী মূল্য পেতে পারে।
বিমান ভাড়া দিয়ে, সম্পূর্ণ বিনা স্বার্থে হুমায়ূন আমাকে ও স্বা তাঁকে কেন ঢাকায় নিয়ে যায় মাঝেমাঝে, তা আজও জানি না। সাধারণভাবে বলতে পারি, পশ্চিম বাংলার তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেশি অতিথিবৎসল। বাংলাদেশের কোনও পরিচিত মানুষ কলকাতায় আমাদের বাড়িতে এলে আমরা বড়জোর চা-বিস্কুট কিংবা দুটো-একটা মিষ্টিদ্রব্য সামনে রাখতে চাই। অনেকটাই ফর্মাল ধরনের খানিকটা পশ্চিমি সফিসটিকেশনের অনুকরণে। আর বাংলাদেশের বন্ধুরা ঢাকায় গেলে বিরিয়ানি খাওয়াতে চায়। দুপুরে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়ের জন্য জোরাজুরি করে। ব্রেকফাস্টেই কাবাব-কোর্মা খাওয়ানোর চল বাংলাদেশ ছাড়া গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে আর কোথাও নেই।
নুহাশ পল্লিতে দ্বিতীয়বার যখন যাই, সেই সময়ের ঘটনা আমার জীবনে অবিস্মরণীয়।
ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেছি, ঢাকা শহরে প্রবেশ করাই হল না, মাজহার ও তার ‘অন্যদিন’ পরিবারের বন্ধুরা আমাকে ও স্বা তাঁকে গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে এল সোজা বেশ কিছু দূরের নুহাশ পল্লিতে। নিজের পত্রিকায় ঈদসংখ্যার লেখা দেওয়ার জন্য মাজহার মাঝেমাঝে বেশ অভিমানের সঙ্গে তাড়া দেয়, কিন্তু যখন আমন্ত্রণ জানায়, তখন কোনও দাবিই থাকে না তার।
নুহাশ পল্লিতে যেমন আছে গ্রাম্য পুকুর, তেমনি আছে অত্যাধুনিক সুইমিং পুল। সেই সুইমিং পুলে সারা শরীর পানিতে ডুবিয়ে, হুমায়ুনসমেত আরও দশ বারোজন আমরা আড্ডা দিয়েছিলাম প্রায় চার ঘণ্টা। সেরকম জলজ আচ্ছা আমার জীবনে অবিস্মরণীয়। সে আড্ডার কারও কারও নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। আড্ডায় ছিলেন ‘প্রথম আলো’ সম্পাদক মতিউর রহমান, উপসম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ, কবিবন্ধু বেলাল চৌধুরি, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, স্থপতি ফজলুল করিম, টিভি অভিনেতা জাহিদ হাসান ও স্বাধীন, চলচ্চিত্র নায়ক ফেরদৌস, আলোকচিত্রী নাসির আলি মামুন, অন্যদিন-এর প্রধান সম্পাদক মিজানুর রহমান মাসুম ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সিরাজুল কবীর চৌধুরী।
সন্ধের পর শুরু হল ক্যাম্পফায়ার। বেশ বড় করে আগুন জ্বালা হয়েছিল, তাই ঘিরে বসা। তারপর শুরু গান-বাজনা, কবিতা পাঠ, ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা। আমি বাচ্চা বয়সে বয়েজস্কাউট ছিলাম, তখন বাইরের কোনও শহরে আউটিং-এ গিয়ে ক্যাম্পফায়ার হত, সবাইকেই দেখাতে হত কিছু না কিছু কেরামতি। ফিল্মের শেষ দিনে ক্যাম্পফায়ারে আমি একলাই গেছি, দিঘা সমুদ্র সৈকতে, শমিত ভঞ্জের কোনও একটি ফিল্মের শেষ সন্ধায়। সেই ফিল্মে আমি কিছু সংলাপ লিখে দিয়ে সাহায্য করেছিলাম, সেইটুকুই যোগাযোগ, সেই কারণেই যোগাযোগ। ভালো লেগেছিল, কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, এরই মধ্যে প্রযোজক, শমিত ভঞ্জের সঙ্গে গোলযোগ শুরু হয়েছিল, তারপর তিক্ততা, আমি বিনা বাক্যব্যয়ে সে জায়গা ছেড়ে চলে গিয়ে সমুদ্রের ঢেউ-এ চাঁদের দোলা দেখছিলাম।
এখানে এই ফিল্মের সঙ্গে আমার কোনও সংশ্রবই নেই, এই ক্যাম্পফায়ারে আমার ভূমিকা শুধু শ্রোতার। তবু, অনেক গায়ক-গায়িকাই আমাকে উদ্দেশ করে নিবেদন করেছিল কিছু-কিছু। বড় ভালো লাগছিল, বড় ভালো লাগছিল, বড় ভালো লাগছিল!
আমাদের বাড়ি ছিল মাদারিপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানকার বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। ঐতিহাসিক কারণে। তার জন্য বুকে এখনও একটু-একটু চিনে ব্যখা হয়, তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। তবু, এ কথাও ঠিক, ঢাকায়, পূর্ব পাকিস্তান পরবর্তী বাংলাদেশে এসে অনেকের কাছে যেমন আন্তরিক, আত্মীয়ের মতো নিবিড় ব্যবহার পেয়েছি, সেই তুলনায় যা হারিয়েছি, সেইসব বাড়ি-ঘর অতি তুচ্ছ। ভালোবাসা ছাড়া আর কোনওকিছুরই কোনও মূল্য নেই।