হঠাৎ এক টুকরো
আমি যখন কলকাতার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, তখন গাড়িওয়ালা লোকদের ওপর আমার খুব রাগ হয়। কলকাতার রাস্তায় এত লোক যে ভালোভবে হাঁটাই যায় না। এই বর্ষার সময় যেখানে সেখানে জলকাদা জমে থাকে, তারই মধ্যে গাড়িগুলো এমন বেপরোয়াভাবে যায় যে সবসময় প্রাণটা হাতে নিয়ে থাকতে হয়। গাড়ির চাকায় ছেটকানো জল কাদা আমাদের গায়ে লাগে, কিন্তু গাড়ির ড্রাইভাররা তা গ্রাহ্যও করে না। অথচ রাস্তাগুলো তো আসলে পদাতিকদের জন্যই!
আবার আমিই যখন গাড়ি চড়ে যাই, তখন মনে হয় কলকাতা শহরের রাস্তায় লোকগুলো অতি অদ্ভুত। এরা কোনওরকম শহুরে নিয়মকানুন মানে না। ফুটপাথ ছেড়ে এরা যখন তখন রাস্তার মাঝখানে চলে আসে, এর মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালানো যে কত অসুবিধে তা এরা বুঝবে না। প্রায়ই দু’তিন বন্ধু রাস্তার মাঝখান দিয়ে গল্প করতে করতে যাচ্ছে, পেছনে গাড়ির হর্ন শুনলে একবার ফিরেও তাকায় না! হঠাৎ হঠাৎ এক একজন লোক ট্রাফিক কনস্টেবলের মতন হাত তুলে চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দেয় নিজে রাস্তা পার হওয়ার জন্য! অন্য যে-কোনও দেশ হলে এইসব লোককে অ্যারেস্ট করা হতো! যে-সব লোক রাস্তা দিয়ে ঠিকমতন হাঁটতে পারে না, তাদের শহর থেকে বার করে দেওয়া উচিত!
একবার দুর্গাপুর স্টেশনে এসে দেখি আমার ট্রেনটা সদ্য ছেড়ে দিয়েছে। পরের ট্রেন অনেক পরে, সেইজন্য আমি মরিয়া হয়ে ছুটতে ছুটতে চলন্ত ট্রেনেই উঠে পড়লুম। কামরাটার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, আমি দুম দুম করে ধাক্কা দিয়ে ভেতরের যাত্রীদের বলতে লাগলুম, খুলে দিন! খুলে দিন! ভেতর থেকে এক সঙ্গে তিন চারজন বললেন, জায়গা নেই, জায়গা নেই!
যেহেতু আমি কখনও, চিনেবাদাম বিক্রি করিনি কিংবা গান গেয়ে ভিক্ষে করিনি, সেইজন্য ট্রেনে ঝুলে ঝুলে যাওয়ার অভ্যেস আমার নেই। আমার রীতিমতন ভয় করছিল, যে-কোনও মুহূর্তে ইলেকট্রিক পোস্টে ধাক্কা লেগে মাথাটা ফেটে যাবে এই আশঙ্কা হচ্ছিল। ভেতরের লোকগুলো কী স্বার্থপর! আমি কাতরভাবে অনুরোধ করতে লাগলুম, দাদা, খুলে দিন, দয়া করে খুলে দিন, আমি পড়ে যাচ্ছি!
একটু পরে দরজাটা কেউ একটু ফাঁক করল, আমি কোনওরকমে বাঁদরের মতন শরীরটাকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে ঢুকে পড়লুম ভেতরে। এইভাবে চলন্ত ট্রেনে ওঠার জন্য অনেক লোকই বকুনি ও উপদেশ দিতে লাগল আমাকে। আমি চুপ করে সব মেনে নিলুম। ভেতরে সত্যিই খুব ভিড়, দাঁড়বারও জায়গা নেই। অধিকাংশ ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা যে-রকম হয়।
পরের স্টেশনে কোনও লোককে সেই কামরায় উঠতে দেওয়া হল না। কিন্তু ট্রেন চলতে শুরু করার পরই একাধিক লোক বন্ধ দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা দিয়ে অনুরোধ করতে লাগল, দাদা, খুলে দিন, খুলে দিন! ভেতরের লোকেরা ধমকে বলতে লাগলেন, জায়গা নেই, জায়গা নেই!
আমি চুপ করে রইলুম। এই লোকগুলোকে দরজা খুলে দিতে বলার সাহস আমার নেই। তা ছাড়া আমি এখন ভেতরের লোক হয়ে গেছি, আমার মানসিকতাও যেন সঙ্গেসঙ্গে বদলে গেছে। এখন আমার মনে হচ্ছে, এর মধ্যে আবার দু’জন বাইরের লোকের জায়গা কী করে হবে? আমি। চুপ করে থাকি, বাইরের দু’জন লোক অবিরাম দরজায় ধাক্কা দিয়ে চলে!
অফিসে আমার ঘরে প্রায়ই খুব ভিড় হয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ লোকই কাজের কথা সংক্ষেপে সেরে নিতে জানে না। আবার অনেক লোক জানেই না, তারা সঠিক কী চায়, সেইজন্য তারা শুধু ভূমিকাই করে চলে, আসল কাজের কথা আর বলেই না, সেইজন্য মাথা ঠান্ডা রাখা এক এক সময় খুব শক্ত হয়। একদিন আমার টেবিলের সামনে এই রকম তিন-চার জন ভিজিটর রয়েছে, এরই মধ্যে নীচ থেকে আমাদের রিসেপশনিস্ট ফোন করে জানালেন, একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে, নাম বলছে না, বলছে, আপনার সঙ্গে চেনা আছে।
আমি বিরক্তভাবে বললুম, অপেক্ষা করতে বলুন! খালি হলে আমি ডাকব!
এরপর দু’ঘণ্টা কেটে গেছে। আমি কাজে ব্যস্ত ছিলুম, সেই লোকটির কথা আর আমার মনেই পড়েনি। হঠাৎ খেয়াল হতেই রিসেপশনিস্টকে ফোন করলুম। সে বলল, সেই ভদ্রলোক তো প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে চলে গেছেন! আপনি ডাকেননি। ভদ্রলোক কিছু না বলেই চলে গেলেন।
সামান্য অনুতপ্ত হলুম। কে ছিল লোকটি? সে বলেছিল আমার চেনা, কিন্তু নাম জানায়নি কেন? সে বোধহয় রাগ করে চলে গেছে। আমার যে ঘর ভরতি লোক ছিল, তা-কি সে বুঝবে? অনেক লোক এসে একসঙ্গে বিরক্ত করলে মাথার ঠিক রাখা যায়? একটু পরেই অবশ্য ভুলে গেলুম লোকটির কথা।
হঠাৎ একদিন আমায় বিশেষ জরুরি কাজে পাসপোর্ট অফিসে যেতে হয়। দু’দিন বাদেই আমাকে বিদেশে যেতে হবে, শেষ মুহূর্তে আমি আবিষ্কার করেছি যে আমার পাসপোর্টের বয়েস পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে, সেটা রিনিউ না করালে যেতে পারব না। ব্যাপারটা অতি সামান্য, একটা রাবার স্ট্যাম্পের ছাপ দেওয়া শুধু।
কিন্তু পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখি সেখানে বিরাট ভিড়, মস্তবড় লাইন, হুলুজুলু ব্যাপার। এই লাইনে দাঁড়ালে আমার সারাদিন কেটে যাবে, এতটা সময় দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
ওই অফিসের একজন অফিসারের সঙ্গে আমার কিছুটা চেনাশুনো আছে, দেখা করতে চাইলুম তার সঙ্গে, কিন্তু ভিতরের মহলের দরজায় একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, সে আমায় ভেতরে যেতে দেবে না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কোনও অফিসারের সঙ্গে দেখা করা যানো না। কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট করব কী করে? আসবার আগে আমি অন্তত পনেরো বার টেলিফোনে সেই অফিসারটিকে ধরবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কলকাতা শহরে সবচেয়ে দরকারের সময়েই তো টেলিফোনগুলো মৃত হয়ে যায়। পাসপোর্ট অফিসের ফোন একবারও বাজেনি! দ্বাররক্ষীটিকে আমার জরুরি দরকারের কথা বোঝাতে গেলুম, সে পুরোটো না শুনেই বলল, পাসপোর্ট জমা দিয়ে যান, সাহেবের সঙ্গে দেখা হবে না।
তখন আমি একটা শ্লিপ লিখে খুব কড়া গলায় তাকে বললুম, তোমার সাহেবকে এটা দেখাও, তিনি আমায় চিনতে পারবেন।
আমার মুখের ওপরেই সে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে চলে গেল। এবং একটু বাদেই ফিরে এসে বলল, সাহেব বলেছেন, আজ দেখা হবে না, পরে আসবেন!
আমি এমনই অপমানিত বোধ করলুম যে আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল, মনে হল, সেই মুহূর্তে আমি অজ্ঞান হয়ে যাব। এরকম আমার হয়, কেউ অপ্রত্যাশিতভাবে অপমান করলে আমি চোখে অন্ধকার দেখি। দেয়াল ধরে অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিলুম। অফিসারটি আমার নাম দেখেও চিনতে পারল না? তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে, তাও সে একবার ডাকল না আমাকে?
এমনও হতে পারে অবশ্য যে বেয়ারাটি আমার স্লিপটা দেখায়ইনি অফিসারটিকে। এমনিই ফিরে এসেছে। কিন্তু এর সঙ্গে তো ঝগড়া বা মারামারি করে কোনও লাভ নেই? এখন আমি কী করব?
সৌভাগ্যবশত পাসপোর্ট অফিসের একজন মহিলা অফিসার সেদিন আমায় দেখে চিনতে পেরেছিলেন এবং অনেক সাহায্য করেছিলেন।
কাজ সেরে বেরিয়ে আসবার পর আমার মনে পড়ল সেই লোকটির কথা, আমার অফিসে যাকে আমি নীচে বসিয়ে রেখেছিলাম, পরে তাকে ডাকতেই ভুলে গেছি। সে কী ভেবেছিল আমার সম্পর্কে?