[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

২৬. নিউ ইয়র্ক শহরে হারিয়ে গেলে

নিউ ইয়র্ক শহরে হারিয়ে গেলে কোনও ক্ষতি নেই। যেকোনও সময়ে মাটির নীচে নেমে গেলেই হল, তারপর পাতালরেলে চেপে যেকোনও জায়গায় আবার থেমে মাটির ওপর উঠে পড়লেই চোখ জুড়িয়ে যাবে। এই শহরের যেকোনও জায়গাই দর্শনীয়।

গোটা আমেরিকার মধ্যে একমাত্র নিউ ইয়র্ক শহরে এসেই কলকাতার মানুষরা খুব স্বস্তি বোধ করবে। বেশ চেনা-চেনা লাগবে। রাস্তাঘাট মাঝে-মাঝেই ভাঙা, দু-এক জায়গায় খোদলে জল জমে আছে, পথচলতি লোকেরা খালি সিগারেটের প্যাকেট, কোকাকোলার টিন কিংবা চকলেটের রাংতা যেখানে-সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দেয় অবলীলাক্রমে। অনেক রাস্তাতে কলকাতার মতন ভিড়, নারীপুরুষরা ব্যস্ত সমস্তভাবে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে, কেউ কারুর দিকে না তাকিয়ে। রাস্তায় এত গাড়ি যে মাঝে-মাঝেই ট্রাফিক জ্যাম হয়।

ম্যানহাটন দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে আমার মনে এমনই কলকাতা-কলকাতা ভাব হয় তা আমি রাস্তার দু-পাশের আশি-নব্বইতলা বাড়িগুলোর কথা ভুলে যাই, দু-ধারের দোকানগুলোতে যেসব ফরেন জিনিস তাও খেয়াল থাকে না, আমি বরং এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনও ষাঁড়, কুষ্ঠরোগী ভিখারি কিংবা উলঙ্গ পাগল খুঁজি।

আমেরিকার আর কোনও শহরেই রাস্তা দিয়ে এত লোক হাঁটে না। ম্যানহাটনের প্রায় সব রাস্তাই যেন মানুষের ভিড়ে গিসগিস করছে। তার একটা কারণ, এখানে গাড়ি পার্ক করা প্রায় একটা অসম্ভব ব্যাপার, অফিসবাবুরা গাড়ি চড়ে এলে, দু-তিন মাইল দূরে গাড়ি রেখে বাকিটা পায়ে হেঁটে আসতে হবে বলে অনেকেই গাড়ি আনে না, ট্রেনে যাতায়াত করে। দ্বিতীয় কারণ, এ শহরে অনেকেরই গাড়ি নেই। এ শহরে অনেক গরিব লোক থাকে। আমাদের কলকাতায় যেমন কোটি-কোটিপতি মাড়োয়ারিরাও আছে আবার ফুটপাথে শুয়ে থাকা গরিবও অসংখ্য, সেই রকমই, নিউ ইয়র্কেও সাহেব-মাড়োয়ারি ও গরিবদের সহাবস্থান চলছে। তবে তফাতের মধ্যে এই যে, এখানকার সাহেব-মাড়োয়ারিরা আমাদের মাড়োয়ারিদের চেয়ে অনেক বেশিগুণ বড়লোক আর গরিবরাও রাস্তায় শোয় না, তারা লম্বা-লম্বা ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে আর শীতকালে প্রত্যেকের গায়েই একটা ওভারকোট চাপে। এখানকার রাস্তায় ষাঁড় বা উলঙ্গ পাগল নেই বটে কিন্তু গুপ্ত-ভিখিরি আছে। প্রকাশ্যে ভিক্ষে চাইলে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়।

এই শহরে এত গরিব তার কারণ প্রচুর বেকার ভাগ্যন্বেষী সারা পৃথিবী থেকেই নিউ ইয়র্কে এসে জোটে। তা ছাড়া, ইহুদি, পোর্টুরিকান, গ্রিক, ইটালিয়ান যারা আগে থেকেই এখানে এসে বসতি নিয়েছিল তাদের দেশোয়ালি ভাইরা এখনও অনবরত আসছে জীবিকার সন্ধানে, কোনও রকমে মাথা গুঁজে থাকছে। এত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আছে বলেই এ শহর শিল্প-সংস্কৃতিতে সকলের সেরা। গোটা আমেরিকার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এই নিউ ইয়র্ক। দেখা যাচ্ছে, শিল্প সংস্কৃতির ব্যাপারটা খুব বড়লোক কিংবা খুব গরিবরা সৃষ্টি করতে পারে না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।

কোনও গির্জার সিঁড়িতে কিংবা কোনও ফুটপাথের দোকানে বসে থেকে রাস্তায় লোক চলাচল দেখতেও বেশ লাগে। এত বিচিত্র রকমের মানুষ এক সঙ্গে আর কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। নিউ ইয়র্কের মতন স্বাধীন শহরও আর বুঝি নেই। যার যা খুশি করতে পারে। ধুতি, লুঙ্গি, আফ্রিকান জোব্বা কিংবা শুধু জাঙিয়া পরে রাস্তা দিয়ে হাঁটলেও কেউ ভ্রূক্ষেপ করবে না।

শুধু দুটি ব্যাপারে শহরের মেয়র সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। হরেকৃষ্ণ বৈষ্ণবের দল রাস্তায় যখন খুশি নাচানাচি শুরু করে দিত তাতে ট্রাফিক জ্যাম হয়ে যেত বলে এখন প্রকাশ্য রাস্তায় নৃত্য-গীত নিষিদ্ধ হয়েছে। আর, এখানকার কমবয়েসি ছেলেমেয়েদের বাতিক ছিল পথে হাঁটবার সময়ও রেডিয়ো বা টেপরেকর্ডার বাজানো। এতই তাদের সঙ্গীতপ্রীতি যে রাস্তায় যেতে যেতেও গান না শুনলে চলে না। কিন্তু অনেকে মিলে ওসব বাজালে তো বিচিত্র এক ক্যাকোফোনির সৃষ্টি হয়, সেই জন্য প্রকাশ্যে রেডিয়ো, টেপরেকর্ডার বাজানোও নিষেধ। এটা সাউন্ড পলিউশন রোধ করবার কারণে।

অবশ্য কমবয়েসি ছেলেমেয়েরা এতেও দমেনি। তাদের পকেটে বা কাঁধের ঝোলায় এখনও রেডিয়ো রেকর্ডার থাকে, আর দু-কানে লাগানো হেডফোন, অন্যদের বিরক্ত না করে তারা নিজেরা ঠিকই গান শুনতে-শুনতে যায়। এরকম হেডফোন আঁটা ছেলেমেয়ে দেখতে পাওয়া যায় প্রায়ই।

রাস্তায় ঘুরতে-ঘুরতে খিদে পেলেও কোনো অসুবিধে নেই নিউ ইয়র্কে। অজস্র সস্তায় খাবারের দোকান আছে এই শহরে। ড্রাগ স্টোর, হ্যামবাগরি, জয়েন্ট, পিৎসা হাট, হট ডগ কর্নার ইত্যাদি। ইচ্ছে মতন পৃথিবীর যে-কোনও দেশের খাবারও বেছে নেওয়ার সুবিধে আছে। চিনে জাপানি-ইটালিয়ান-গ্রিক-ভারতীয়-পাকিস্তানি-তিব্বতি ইত্যাদি। আমার মতন আরও অনেক বাঙালও তো নিউ ইয়র্কে যায়, তাদের দু-একটা কথা জানিয়ে দিচ্ছি। হ্যামবার্গারে কক্ষনো হ্যাম থাকে না, থাকে গো-মাংসের কিমা আর হট ডগের সঙ্গে কুকুরের কোনও সম্পর্ক নেই, ওটা শুয়োরের মাংস আর বিশুদ্ধ সর্ষে বাটার সঙ্গে রুটি। চিনে আর জাপানি খাবার প্রায় একই ভেবে যারা জাপানি দোকানে ঢুকবেন, তারাও ঠকবেন। জাপানি খাবারের দাম বেশি, পরিমাণে কম, স্বাদও ভালো না। মূল জাপানের কথা জানি না, নিউ ইয়র্কের জাপানি দোকানের এই অবস্থা। ভারতীয় দোকানে ঢুকলে আপনি ভারতীয় বলেই ভালো ব্যবহার পাবেন না, এ কথা আগেই বলে রাখছি। সস্তায় ভালো মাংস-রুটি খেতে হলে যাওয়া উচিত গ্রিক দোকানে।

নিউ ইয়র্কের মেয়র আর একটা খুব ভালো আইন জারি করেছেন। ম্যানহাটানে এখন আর ফাঁকা জমি একটুও নেই, থাকলেও আগুন দাম, অথচ জনসংখ্যা প্রত্যেক বছর বাড়ছে শহরটা ঘিঞ্জি হয়ে যাচ্ছে, সেই তুলনায় পার্ক বা জনসাধারণের বিশ্রামের জায়গা বাড়ছে না। বড়-বড় কোম্পানিগুলো ছোট বাড়ি কিনে নিয়ে সেখানে একশো তলা বাড়ি তুলে ফেলছে। সেই জন্যই এখন নিয়ম হয়েছে, ওই রকম বহুতল বাড়ি তৈরি করতে গেলেই গাড়ি রাখবার জায়গা করতে হবে মাটির নীচে আর এক তলাটা ফাঁকা রাখতে হবে। সেই এক তলার অর্ধেকটায় থাকবে বাগান আর বাকি অর্ধেকটায় খাবারের দোকান। সেখানে যে-কেউ এসে বসতে পারবে। মনে করুন, চৌরঙ্গিতে টাটা ম্যানসন কিংবা চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের মতন লম্বা বাড়িগুলোর একতলা থাকবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। আমাদের মেয়রহীন কলকাতায় এরকম আইন কে জারি করতে পারেন জানি না।

সেইরকমই একটা নতুন বাড়ির নীচের খাবারের দোকানে বসেছিলুম একটা সুপ নিয়ে। পাশেই ফোয়ারা, তলার জলের রঙিন মাছ খেলা করছে, তাই দেখছি। হঠাৎ আমার টেবিলের পাশে একজন কেউ এসে দাঁড়াল, দু-দিকের কোমরে দুটি আঙুল দিয়ে। আস্তে-আস্তে চোখ তুলে তাকিয়ে একটা হাসিমুখ দেখতে পেলুম।

–যামিনীদা!

তিনি বললেন, ওই দিকের টেবিলে বসে অনেকক্ষণ ধরে দেখছি, চেনা-চেনা মনে হচ্ছিল। তুই সত্যিই তা হলে নীলু?

আমি খুব একটা অবাক হইনি কিন্তু। নিউ ইয়র্কের রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘুরলে দু-চারজন বাঙালির সঙ্গে তো দেখা হবেই, চেনা কারুর সঙ্গে দেখা হওয়াও আশ্চর্য কিছু না। লন্ডনের মতন অত না হলেও নিউ ইয়র্কের বাঙালির সংখ্যা নেহাত কম নয়।

আমার পাশের চেয়ার টেনে নিয়ে বসে যামিনীদা বললেন, তুই জ্যান্ত এসেছিস না মরে ভূত হয়ে এসেছিস?

রাস্তায় বাস দুর্ঘটনায় যে সত্যিই মরে যেতে পারতুম, সে কথা চেপে গিয়ে বললুম, বালাই ষাট, মরব কেন?হঠাৎ ওকথা বলছ যে?

–ভাবছিলুম যে আমাদের দেশের বেকাররা আর কতদিন বেঁচে থাকতে পারে?

যামিনীদা ছিলেন কলকাতার কফি হাউসের ইনটেলেকচুয়াল। অনেক বিষয়ে পড়াশুনো। এখনও চেহারাটা বিশেষ বদল হয়নি দেখছি। মেদহীন ঝকঝকে শরীর। ঠোঁটের কোণে এমন একটা হাসি, যাতে মনে হয় সবসময় কিছু একটা উপভোগ করে চলেছেন।

–কবে এসেছিস?

–কাল!

–বাঙালের মতন এর মধ্যেই এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টার, স্ট্যাচু অব লিবার্টি ফিবার্টি সব দেখে নিয়েছিস তো?

উত্তর না দিয়ে আমিও মুচকি হাসলুম। আমিও নানা রকম হাসি দিতে জানি।

–শোন নিউ ইয়র্কে শুধু একরকমই দেখার জিনিস আছে, তা হল থিয়েটার। এরকম থিয়েটারের এক্সপেরিমেন্ট আর কোথাও হয় না। এসেছিস যখন, ভালো করে দেখে যা। ‘সত্যাগ্রহ’ নামে একটা থিয়েটার হচ্ছে, জানিস? দেখলে তোর মাথা ঘুরে যাবে।

আমি একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলুম। যামিনীদা এখনও ইনটেলেকচুয়াল আছেন, নিছক ডলার জমাবার ধান্দায় মজে যাননি।

যামিনীদা বললেন, আর যদি দৃশ্য দেখতে চাস, তা হলে ঠিক সন্ধের একটু আগে ব্রুকলিন ব্রিজের ওপর দাঁড়াবি। শেষ সূর্যের আলোয় দেখতে পাবি ঠিক যেন সোনা দিয়ে তৈরি ম্যানহাটান, ঠিক যেন অমরাবতী। ব্রুকলিন ব্রিজের ওপর সেই বিখ্যাত কবিতাটা পড়েছিস? ওই যে ইয়ের লেখা, কী যেন নাম, ওই যে লোকটা আত্মহত্যা করেছিল…

–হার্ট ক্রেন।

যামিনীদা ভুরু কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। আমি একখানা সাহেব-কবির নাম বলে ফেলেছি, আন্দাজে কি না বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর হোহো করে হেসে উঠে বললেন, ও, মনে পড়েছে, তুই তো আগেও একবার নিউ ইয়র্কে এসেছিলি, এসব তোর জানা। তাই না? কোথায় উঠেছিস?

আমি গ্রিনিচ ভিলেজের একটা সস্তা হোটেলের নাম বললুম।

–চল, তোর মালপত্তর নিয়ে আসি। তুই আমার ওখানে থাকবি। কিন্তু তোকে রান্না করতে হবে। তোর বউদি গত কাল বোস্টন চলে গেছেন, আমাকেও যেতে হবে দু-একদিনের মধ্যে। তুই একা থাকতে পারবি তো?

–অন্যের বাড়িতে একা থাকার মতন আনন্দের আর কিছু আছে কি?

–আমি গত বছরই একবার কলকাতায় গিয়েছিলুম, সুতরাং কলকাতার খবর মোটামুটি জানি। তোর খোঁজ করেছিলুম, তুই ছিলি না শহরে।

–হয়তো আসামে বা মধ্যপ্রদেশে গিয়েছিলুম।

–সবসময় টোটো করে ঘুরে বেড়াস বুঝি? চল, উঠে পড়া যাক। বাইরে বেরিয়ে যামিনীদা একটু থমকে দাঁড়িয়ে কিছু চিন্তা করে বললেন, তুই এক কাজ কর, নীলু, তুই হোটেলে চলে যা। আমাকে দু-একটা কাজ সারতে হবে। তোকে রাত্তিরের দিকে আমি হোটেলে ফোন করব। কিংবা, আমার বাড়ির ঠিকানা দিলে তুই রাস্তা চিনে চলে আসতে পারবি?

আমি বললুম, কেন পারব না? তুমি কোন পাড়ায় থাকো?

–ব্রুকলিনে। তা হলে তাই কর, মালপত্র নিয়ে তুই আমার অ্যাপার্টমেন্টে চলে আয়। বেশি রাত করবি না, রাস্তাঘাট ভালো না, সন্ধে-সন্ধে চলে আসবি। আমি না থাকলেও গণেশ বলে একটা সাউথ ইন্ডিয়ান ছেলে থাকবে। খুব ভালো ছেলে, তাকে তোর কথা বলে রাখব।

এরপর যামিনীদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি সময় কাটাবার জন্য মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লুম।

নিউ ইয়র্কের মিউজিয়ামগুলোর বর্ণনা দিতে গেলে সাত কাণ্ড রামায়ণ লিখে ফেলতে হয়। সে কাজ জ্ঞানী-গুণীরা করবেন। মেট্রোপলিটান মিউজিয়ামের এমন একটা বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য কোনও দেশের মিউজিয়ামে দেখিনি। এখানে প্রতিটি ছবির তলায় লেখা আছে সেই ছবি আঁকার ইতিহাস, সমসমায়িক ঘটনা, সেই ছবি সম্পর্কে তখন কে কী মন্তব্য করেছিলেন ইত্যাদি। মোটেই রসকষহীন তথ্য নয়, প্রত্যেকটাই পাকা হাতের রচনা এমনই সরস যে না পড়ে উপায় নেই। সেই লেখা পড়বার পর আবার নতুনভাবে ছবিটা দেখতে ইচ্ছে করে। ইম্প্রেশনিস্টদের মাত্র পঁচিশ ছাব্বিশখানা ছবি দেখতেই আমার ঘণ্টাতিনেক লেগে গেল। এখনও বাকি আছে ঘরের পরঘর। শত-শত ছবি। আমি অবশ্য একটানা বেশিক্ষণ ধরে শিল্প উপভোগ করায় বিশ্বাস করি না। তিন ঘণ্টা যথেষ্ট।

বিকেল পড়ে গেছে, ফিরে এলুম হোটেলে। বিল চুকিয়ে বেরিয়ে এলুম মালপত্র নিয়ে। ব্রুকলিন ব্রিজ পার হওয়ার সময় একবার মনে করলুম হার্ট ক্রেনের কবিতা, আর একবার দেখে নিলুম যামিনীদা-বর্ণিত সোনার ম্যানহাটান। সূর্যাস্তের আলোয় হর্মসারিকে সত্যিই ওরকম দেখায়।

যামিনীদার বাড়িতে রাত্তিরটা খুব জমে গেল। যামিনীদা এরই মধ্যে ভাত-ডাল-বেগুনভাজা আর দু-তিনরকম মাছ রান্নার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। দক্ষিণ ভারতীয় ছেলেটির নাম বোধহয় গণেশন, তাকে বাংলায় গণেশ বলে ডাকা হয়। সে যামিনীদার এখানে থেকে লেখাপড়া করছে। মৃদুভাষী ছেলেটি ইংরিজি মিশিয়ে মোটামুটি বাংলা বলে। গৌতম আর সংঘমিত্রা নামে এক তরুণ দম্পতি এসেছে। শুরু হয়ে গেল তুমুল আড্ডা।

যামিনীদা ওঁর চাকরি জীবনের কয়েকটা ঘটনা বললেন। ওঁর বর্তমান চাকরিটা, আমাদের চোখে বিচিত্র মনে হবে। উনি এখানকার লেবার ইউনিয়নের সেক্রেটারি জাতীয় কিছু। এ দেশের লেবার ইউনিয়ন অসম্ভব শক্তিশালী, ইচ্ছে করলে তারা সারা দেশ কাঁপিয়ে দিতে পারে। ইউনিয়নের কাজ চালাবার জন্য এরা মাইনে করা প্রফেশনাল লোক রাখে। যামিনীদা বললেন, বুঝলি, এদেশে এসে অনেকদিন সরকারি কাজ করেছি। তারপর এক সময় মনে হল, এবার অন্য দিকটা একটু দেখা যাক তো। তাই শ্রমিকদের দলে ভিড়েছি।

ভাবতে ভালো লাগে যে কলকাতার এক বাঙালির ছেলে মার্কিন দেশের শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে ওদেশের সরকারের সঙ্গে বো ঝাঁপড়া করে।

খেতে বসে যামিনীদার আর একটা বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পেলুম। এতদিন বিদেশে থেকেও উনি বাংলা বলার সময় অনর্থক ইংরিজি মিশিয়ে দেন না, বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির খবর রাখেন, মনে প্রাণে সম্পূর্ণ বাঙালি। কিন্তু খাওয়ার টেবিলে উনি একেবারে সাহেব। টেবিলে এক ফোঁটা জল বা একটা ভাত পড়লে চলবে না তক্ষুনি পরিষ্কার করতে হবে। সাইড ডিসে স্যালাড যেমন তেমন করে দিলে চলবে না, সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে হবে। আলাদা-আলাদা মাছের ঝোলের জন্য আলাদা আলাদা হাতা চাই। একজন কে যেন ডালের হাতাটা মাছের ঝোলে ডোবাতে উনি একেবারে হায়হায় করে চেঁচিয়ে উঠলেন। ওতে নাকি সব স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। উনি বললেন, বুঝলি না, পরিবেশনটাই তো একটা আর্ট, আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা যখন বড় থালায় ভাত পরিবেশন করতেন, কী রকম পরিপাটি করে সাজিয়ে দিতেন…।

আমরা খাওয়া শুরু করেছি, যামিনীদা ঘুরে-ঘুরে পরিদর্শন করছেন, আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি বসবেন না?

যামিনীদা বললেন, না, আমি তো এসব খাই না, পরে একটা যা হোক বানিয়ে নেব।

–সে কী? আপনি এই ভালো-ভালো মাছ খাবেন না?

–না রে, আমি রাত্তিরে দুটো স্যান্ডুইচ ছাড়া আর কিছু খাই না।

তারপর একটু থেমে, আবার মুচকি হেসে বললেন, আমার কাছে কয়েকটা বাংলা কবিতার বই আছে, কিছু গানের রেকর্ড আছে, মাঝে-মাঝে সেই কবিতাগুলো পড়ি কিংবা গান শুনি, তখন আমি বাংলাদেশে ফিরে যাই মনে-মনে। বাঙালি থাকবার জন্য আমার ভাত কিংবা ইলিশ মাছ খাবার দরকার হয় না।