[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

৪১. শিকাগো শহরের নামটি

শিকাগো শহরের নামটির মধ্যেই একটা রোমাঞ্চ আছে। বাল্যকাল থেকেই আমাদের কাছে এই শহরটির সঙ্গে দুটি নাম জড়িত। স্বামী বিবেকানন্দ এবং আল কাপন। অবশ্য বাংলায় স্কুল পাঠ্য বিবেকানন্দ-জীবনীতে এখনও এই শহরটির নাম চিকাগো কেন লেখা হয় তা জানি না। আর এযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ দস্যু আল কাপনের অনেক রোমহর্ষক কীর্তির কথাও আমরা নানান বইতে পড়েছি, ফিলমেও দেখেছি।

অনেকদিন আগে প্রথমবার শিকাগো শহরে পা দেওয়ার মুহূর্তেও আমার ধারণা ছিল, এই শহরের পথেঘাটে বুঝি সব সময় মাফিয়ারা গিসগিস করছে। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতায় আমার সেই ধারণা খানিকটা সমর্থিতও হয়েছিল। সেবারে উঠেছিলুম ডাউন টাউনে ওয়াই এম সি এ হস্টেলে। দুপুরবেলা খাবারের সন্ধানে সেখান থেকে সদ্য বেরিয়েছি, সাউথ ওয়াশ নামে রাস্তার ওপরে হঠাৎ দুদল লোক একটা খণ্ডযুদ্ধ শুরু করে দিল। ঠিক দু-মিনিটের মধ্যে এসে গেল পুলিশের গাড়ি, ততক্ষণে রাস্তা ফাঁকা, শুধু মাঝখানে পড়ে আছে একজন ছুরিবিদ্ধ মানুষ।

আমি এমনই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলুম যে পালাবার কথাও মনে পড়েনি। দাঁড়িয়ে ছিলুম দেওয়াল সেঁটে। একজন পুলিশ আড়চোখে কয়েকবার আমাকে দেখেও কিছু বলেনি অবশ্য। বোধহয় আমাকে ধর্তব্য বলেই মনে করেনি।

কোনও শহরে এসেই এরকম একটা প্রথম অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই সুখকর নয়। কিন্তু আরও কয়েকদিন কাটিয়ে দেওয়ার পর ওরকম দ্বিতীয় ঘটনা কিন্তু আমার আর চোখে পড়েনি। পরে আমার মনে হয়েছিল, শিকাগো শহর ওই ছোট্ট ঘটনাটি মঞ্চস্থ করেছিল বোধহয় শুধু আমাকেই ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য। নইলে, এরকম একটা দৃশ্য কলকাতা, দিল্লি, বোম্বাইতেও এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। মানুষ তো সব জায়গাতেই মানুষকে ছুরি মারছে, নইলে ছুরির ব্যাবসা চলবে কেন?

শিকাগো শহরকে আসলে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। অন্যান্য বড় শহরের মতনই এই শহরটি হিংস্র, তার বেশি কিছু নয়। এক সময় বোধহয় হিংস্রতর ছিল, কিন্তু সেই আল কাপনদের দিন আর নেই, এখনকার দিনের মাফিয়াদের কায়দা অনেক সূক্ষ হয়েছে, পথেঘাটে যখন তখন খুনোখুনির দরকার হয় না।

শিকাগো শহরের একটা উগ্র সৌন্দর্যও আছে। আমেরিকার একদিকে নিউ ইয়র্ক অন্যদিকে লস এঞ্জেলিস, মাঝখানে এই শিকাগো। দুই প্রান্তের দুটি শহরের তুলনায় শিকাগো-ও কিছুতেই কম যায় না। নিউ ইয়র্ক আর লস এঞ্জেলিস দুটিই সমুদ্র-উপকূলবর্তী, শিকাগোর কাছে সমুদ্র নেই বটে, তবে আছে লেক মিশিগান। এই হ্রদটিও সমুদ্র-প্রতিম, এর বুকে রীতিমতন জাহাজ চলে।

দৈর্ঘ্যে-প্রস্থেও শিকাগো বাড়ছে এবং ওপরদিকেও মাথা চাড়া দিচ্ছে। সিয়ার্স কোম্পানির বাড়ি যার নাম সিয়ার্স টাওয়ার, সেটা নাকি বর্তমান পৃথিবীর উচ্চতম হ। আরও অনেক লম্বা লম্বা বাড়ি দেখতে গিয়ে ঘাড় অনেকখানি পেছনে হেলে যায়। এর মধ্যে দু-একটি বিশাল বাড়ির নকশা তৈরি করেছেন বাংলাদেশের একজন স্থপতি। কোনও বাঙালির এমন কৃতিত্বের কথা জেনে আমার গর্ব হয়।

আগের বারে সফরে এসে আমি শিকাগোয় এত লম্বা বাড়ির ছড়াছড়ি দেখিনি। লেক মিশিগানের ধার দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে ঠিক জলের বুক থেকে উঠে যাওয়া এক-একটি প্রাসাদ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। সত্যি জলের ওপরে বাড়ি, কলকাতার অনেক মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিং-এর যেমন নীচের তলাটায় শুধু গাড়ি থাকে, এখানে সেরকম রয়েছে মোটরবোট।

আকাশের অবস্থা ভালো নয়। প্রায়ই গুঁড়ো-গুঁড়ো বরফ পড়ছে। শিকাগোর তুষার ঝড় বিখ্যাত, একবার শুরু হলে আর থামতে চায় না। খবরের কাগজে প্রায়ই সেরকম ঝড়ের পূর্বাভাসের কথা জানাচ্ছে। আমার ইচ্ছে শুধু শিকাগোর আর্ট গ্যালারিগুলো দেখে শেষ করা। কিন্তু তা-ও সম্ভব হবে কি না জানি না।

মদনদা যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু গৌতম গুপ্তর সঙ্গে। উঠেছি সেই গৌতম গুপ্তর বাড়িতে। শহরতলিতে সুন্দর নিজস্ব বাড়ি। স্বামী-স্ত্রী ও দুটি ছেলেমেয়ের ছিমছাম সংসার। আমি এখানে চমক্কার আরামে আছি, শুধু একটাই অসুবিধে, এখান থেকে মধ্য শহর বেশ দূরে। আমি সপ্তাহের মাঝখানে এসে পড়ে খুব ভুল করেছি। সারা সপ্তাহ এখানে সবাই খুব ব্যস্ত থাকে, বেরিয়ে যেতে হয় কাকডাকা ভোরে, আর সন্ধেবেলা পরিশ্রান্ত হয়ে ফেরার পর আর কারুর বেরুবার উৎসাহ থাকে না। তবে গৌতমবাবু দু-এক সন্ধে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছিলেন বলে আমি খুব লজ্জা পাচ্ছিলুম।

দুপুরের দিকে আমি একাই শহরে যাই ট্রেনে চেপে। এখানকার ট্রেনকে যদি আমাদের ট্রাম বলে গণ্য করা যায় তা হলে ভাড়া খুব বেশি। পাঁচ-ছ’ ডলার। আমার মতন পকেট-ঠনঠনদের বেশ গায়ে লাগে। এখানে অনেক দোকানের সেলে পাঁচ-ছ’ডলারে একটা জামা কিনতে পাওয়া যায়। সুতরাংট্রাম ভাড়া একটা জামার দামের সমান?

একদিন দুপুরে বউদির হাতের অতীব সুস্বাদু রান্না খেয়ে সবে মশলা চিবুচ্ছি, এমন সময় বাইরের দরজায় একটা গাড়ি থামল। তারপর এ বাড়ির বেলই বেজে উঠল। বউদি দরজা খুলতেই একটি আঠারো-উনিশ বছরের বাঙালি তরুণ ভেতরে এসে বলল, উঃ রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। যা ঘুরতে হয়েছে না।

ছেলেটিকে আমিও চিনি না, বউদিও চেনেন না।

সে আবার আমার দিকে চেয়ে বললেন, চলুন, চলুন, ব্যাগ গুছিয়ে নিন। আমি বেশি দেরি করতে পারব না।

আমি অবাক হয়ে বললুম, আমায় যেতে হবে? কোথায়?

ছেলেটি একটু ধমকের সুরে বলল, কোথায় মানে? আমাদের বাড়িতে।

আমি আমতা-আমতা করে বললুম, না, মানে, আমি তো আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। তা ছাড়া আমি এখানে তো বেশ ভালোই আছি।

ছেলেটি বলল, এখানে আপনি ভালো নেই, তা কি আমি বলেছি? এই বউদি নিশ্চয়ই আপনাকে অনেক যত্ন করেছেন। অনেক যত্ন তো পেয়েছেন, এবারে আমাদের ওখানে চলুন।

তারপর বউদির দিকে ফিরে সে বলল, কি বউদি, বলুন! আপনার এখানে তো ক’দিন রইলই। এবার নীলুদার কয়েকটা দিন আমাদের কাছে থাকা উচিত নয়?

বউদি বললেন, আপনাকে তো চিনতে পারলুম না।

ছেলেটি বলল, আমার নাম বললেও আমায় চিনতে পারবেন না। তা ছাড়া নাম দিয়ে কী দরকার?মনে করুন আমি একজন মানুষ। আমার সঙ্গে যেতে আপনার আপত্তি আছে নীলুদা?

আমি বললুম, না, না, আপত্তি থাকবে কেন?তবে ঠিক বুঝতে পারছি না কোথায় যেতে হবে।

ছেলেটি এবার আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, মনে করুন আপনাকে আমি কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছি। তারপর আপনার বাড়ির কাছ থেকে র‍্যানসম দাবি করব। কত চাওয়া যায় বলুন তো?

আমি বললুম, আমার বাড়ির লোক বলবে, ওকে যদি আর কখনও না ফেরত পাঠাও তা হলে বরং দু-চার পয়সা দিতে পারি।

ছেলেটি হাহা করে হেসে উঠল।

ছেলেটিকে প্রথম দর্শনেই আমার দারুণ ভালো লেগে গিয়েছিল। ওর মুখে সারল্য আর দুষ্টুমি সমানভাবে মিশে আছে।

সে আবার বলল, আমি কিন্তু সত্যিই আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছি। আমার দাদা বলল, নীললোহিত এসে শিকাগো শহরে থাকবে অথচ আমাদের বাড়িতে একবারও আসবে না? যা তো, ধরে নিয়ে আয়।

–তোমার দাদা কে ভাই?

–সুব্রত চৌধুরি।

এবারে আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। এই সুব্রত চৌধুরিকেও আমি কখনও চোখে দেখিনি বটে, তবে দু-একবার টেলিফোনে কথা হয়েছে। আমার এক বন্ধুর বন্ধু। কিন্তু শুনেছিলুম যে সে এখন পড়াশুনো নিয়ে খুব ব্যস্ত, তাই শিকাগোতে এসে তার সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। আমি শিকাগোতে এসে যে গৌতম গুপ্তর বাড়িতে উঠেছি, সে খবর ওরা পেল কী করে কে জানে?

বউদির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমি আমার পোটলাপুঁটলি নিয়ে উঠলুম ছেলেটির গাড়িতে। গাড়ি ছাড়বার পর আমি জিগ্যেস করলুম, আমার নাম নীলু, তোমার নামটা এবারে জানতে পারি কি?

সে বলল, আমার নাম টুটুল। হোল ওয়ার্লড আমাকে এই নামে চেনে।

আমি বললুম, তা তো বটেই। এই নাম আমি কত জায়গায় শুনে এসেছি।

–আমি যেতে-যেতে কয়েকবার রাস্তা ভুল করব, পুলিশ টিকিটও দিতে পারে, তবে ভয় নেই, অ্যাকসিডেন্ট হবে না। আমি খুব ভালো গাড়ি চালাই।

–আমার অ্যাকসিডেন্টের কোনও ভয় নেই। গোটা একটা বাস উলটে গেলেও আমি অক্ষত থেকেছি। একবার আমি একটা প্লেনে উঠতে পারিনি সময়ের অভাবে, সেই প্লেনটাই দুর্ঘটনায় পড়ে চুরমার হয়ে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমি অমর।

টুটুল হোহো করে হেসে উঠে বলল, যাক বাঁচা গেল। আমি ভেবেছিলুম, আপনি গম্ভীর লোক। আমি গম্ভীর লোকদের বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না।

–আমি কিন্তু একবার কথা বলতে শুরু করলে আর থামি না। আমায় জোর করে থামাতে হয়।

গাড়িটা প্রায় একটা মাঠের মধ্যে পৌঁছে গিয়ে থামল। টুটুল বলল, এইবার কোন দিকে? দেখা যাক, ম্যাপে কী বলে!

টুটুলের চেহারাটা এতই বাচ্চা যে ওর লাইসেন্স আছে কি না তাতেই সন্দেহ হতে পারে। আমার অবশ্য এরকম উলটোপালটা গাড়ি চালানো বেশ ভালোই লাগে। সবাই কি পৃথিবীর সব কিছু ঠিকঠাক নির্ভুলভাবে চালিয়ে যাবে?

অবশ্য খুব বেশি ঘুরতে হল না, বিকেলের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলুম ওদের বাড়িতে। আলাদা বাড়ি না, অ্যাপার্টমেন্ট, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার একেবারে গায়েই বলতে গেলে। মিশিগান হ্রদও খুবই কাছে।

অ্যাপার্টমেন্টে আপাতত আর কেউ নেই। মাঝখানের বসবার ঘরটি দেখলে মনে হয় এই মাত্র যেন এখানে খুব তুমুল আড্ডা চলছিল, হঠাৎ সবাই এক সঙ্গে উঠে গেছে।

টুটুল এরই মধ্যে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসে বলল, শোনো, নীলুদা, তুমি কী-কী। দেখতে চাও সব ছকে ফ্যালো। তোমাকে আমরা প্রত্যেকটি জিনিস ঘুরে দেখিয়ে দেব। তুমি গঙ্গানগরের নাম শুনেছ?

–গঙ্গানগর?

–শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত সাহেবরা গঙ্গা নাম দিয়ে একটা নতুন শহর বানাচ্ছে। সেটা আমি ছাড়া তোমায় আর কেউ দেখাতে পারবে না।

–বাঃ, খুব চমৎকার।

–এখন তুমি একটু একা থাকো। ইচ্ছে হলে কিচেনে গিয়ে চা-টা বানিয়ে নিতে পারো। খিদে পেলে ফ্রিজ খুলে দেখে নিও কী পাও। আর হুইস্কি টুইস্কি পান করতে চাইলে তাও পেয়ে যাবে। এবাড়িতে আমরা কেউ ড্রিংক করি না, তবে অতিথিদের জন্য সব রাখি। আমি এখন একটু ঘুরে আসছি, আমার ক্লাস আছে।

বলেই সে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। একটি অপরিচিত বাড়িতে আমি সম্পূর্ণ একা। প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগলেও সেটা কাটিয়ে ফেললুম।

আরাম কেদারায় বসে বইটই পড়ছি, এমন সময় দরজায় খুটখুট শব্দ হল। কেউ যেন খুব সন্তর্পণে তালা খুলছে। এই রে, চোরটোর নয়তো। শরীরে একটা শিহরন খেলে গেল।

দরজা খুলে ঢুকল একজন বলিষ্ঠকায় তরুণ। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, আপনিই কি সুব্রত চৌধুরি?

তরুণটি বলল, না। আমার নাম বাবলু। আপনি নীলুদা তো?

টুটুল আপনাকে ঠিক মতন নিয়ে এসেছে, কোনও অসুবিধে হয়নি?

আমি বললুম, না, না। খুব মজাসে গল্প করতে-করতে এসেছি।

–ও খুব ভালো গাড়ি চালায়, তবে রাস্তা ভুলে যায়। আপনি কিছু খেয়েছেন? খাবার বানিয়ে দেব।

–না, না, আমার খিদে পায়নি। দুপুরে খুব ভারী লাঞ্চ খেয়েছি।

বাবলু তবু চা তৈরি করে ফেলল। তারপর খুব কাঁচুমাচুভাবে বলল, আপনার কি একটু একা থাকতে কষ্ট হবে? আমি এতক্ষণ চাকরি করে এলুম, এবার একটা ক্লাস করতে যাব। টুক করে ঘুরে আসব, অ্যা?

আবার আমি একা। আধঘন্টা বাদে আবার দরজায় সেই রকম খুটখাট শব্দ। আমি ভাবছি, এবার কি টুটুল ফিরল, না অন্য কেউ?

দরজা খুলে প্রথমে ঢুকল একটি মেয়ে। মাথায় কোঁকড়া চুল, মুখখানা প্রতিমার মুখের মতন। আমায় দেখে সে একটু থমকে গেল। তারপর ঢুকল একজন ফরসা চেহারার যুবক, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা।

আমি জিগ্যেস করলুম, কাকে চাই? আপনারা ঠিক বাড়িতে এসেছেন তো?

ফরসা যুবকটি হেসে বলল, আপনিই নিশ্চয়ই নীললোহিত? আমার নাম পিন্টু।

আমি বললুম, টুটুল, বাবলু, পিন্টু। বাঃ, খুব চমৎকার নাম। কিন্তু এর মধ্যে সুব্রত চৌধুরি কে?

পিন্টু বলল, আমিই। আর এ আমার স্ত্রী প্রভাতি।

প্রভাতি বলল, ও মা, এই নীললোহিত? আমি ভেবেছিলুম বুঝি ভারিক্কি চেহারার কোনও লোক হবে।

পিন্টু বলল, আজ কার ভাত রাঁধার টার্ন?

প্রভাতি বলল, তোমার।

–কিন্তু আমার যে রাত্তিরে একটা ক্লাস আছে।

–তা হলে ভাতটা আমি করে দিচ্ছি। বাবলু এসে মাংস রাঁধবে।

একটু বাদেই আবার বেরুতে হবে। সুব্রত পুরো পোশাক ছাড়ল না। চায়ের কাপ নিয়ে বসে সে বলল, আপনার কোনও অসুবিধা হবে না। আমরা সবাই পড়ি আবার চাকরিও করি। তবে পালা করে একজন আপনাকে সঙ্গ দেব। আর রাত্তিরে আড্ডা হবে একসঙ্গে। তারপর শনিবার রবিবার এলে তো খুব বেড়ানো যাবে কেমন?

আমি বললুম, আমার একা থাকা নিয়ে আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি মাঝে-মাঝে একাই বাইরে থেকে ঘুরে আসব।

সুব্রত বলল, একা ঘুরবেন? গাড়ি ছাড়া? দেখুন, এই জানলার কাছে আসুন।

সুব্রত জানলার পরদা সরাল। বাইরে অঝোর ধারায় বরফ পড়ছে। এর মধ্যে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

চমৎকার এদের সংসারটি। একটা মেসের ঘর বলে মনে হতে পারত। কিন্তু প্রভাতি থাকায় পারিবারিক আবহাওয়াটা বজায় আছে। প্রভাতিও বলতে গেলে বাচ্চা মেয়ে, মাত্র কিছুদিন আগে তার বিয়ে হয়েছে, তার দুই দেওর তাকে নানান ছুতোয় রাগিয়ে দেয় মাঝে-মাঝে।

এ দেশে পড়াশুনোর শেষ নেই। মধ্য বয়েসেও অনেকেই ছাত্র থাকে। এদের মধ্যে সুব্রত ইঞ্জিনিয়ার ও খুব বড় চাকরি করে, তবু সে আরও দু-একটি কোর্স নিয়ে যোগ্যতা বাড়াচ্ছে। তার ছোট দুই ভাইকে সে একে-একে আনিয়েছে দেশ থেকে। ওদের আরও দুই দাদা থাকেন এ দেশে।

পিন্টুবাবলু-টুটুল আর প্রভাতি যেমন অতিথিবৎসল আর পরোপকারী তেমনি লাজুক। ওরা নিজেদের বিষয়ে কিছু বলে না, কিন্তু দুদিনেই বুঝতে পারলুম, শিকাগোতে কোনও ভারতীয় কোনও বিপদে পড়লে ওরা নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করবার জন্য ছুটে যায়। কার থাকার জায়গা নেই, কে হঠাৎ এয়ারপোর্টে এসে পড়েছে কিন্তু গাড়ি পাচ্ছে না, সবই ব্যবস্থা করা যেন ওদের দায়িত্ব। শুধু ভারতীয় কেন, বাংলাদেশেরও অনেকে এসে থেকে যায় ওদের কাছে।

সকালে উঠে আমি বসবার ঘরে একটা চেয়ারে বসি। ওরা তিন ভাই আর প্রভাতি দাবা খেলার মতন কখনও দুজন থাকে দুজন বেরিয়ে যায়। কখনও একজন একটা আইটেম রান্না করে চলে যায়, আর একজন এসে অন্য কিছু রান্না করে। এরই ফাঁকে-ফাঁকে আড্ডা। আমিই শুধু কনস্ট্যান্ট ফ্যাক্টর।

তারপর এল শনিবার। আজ সবার ছুটি। আজ তো বেড়াতে যেতেই হবে। কিন্তু সারাদিনই ছুটি যখন, তখন তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই। কাপের পর কাপ চা খেয়ে যাচ্ছি। ভাইদের মধ্যে বাবলু নিঃশব্দ কর্মী। আড্ডার ফাঁকে-ফাঁকে সে সংসারের অনেক কাজ সেরে ফেলে। আবার বাইরেও ঘুরে আসে। টুটুল সবচেয়ে ছোট ভাই এবং আদরের, তাকে বিশেষ কাজ দেওয়া হয় না। আর সুব্রত এই পরিবারের কর্তা হিসেবে চেয়ারে বসে নানান রকম নির্দেশ দিতে ভালোবাসে।

হঠাৎ এক সময় খেয়াল করলুম সন্ধ্যে হয়ে গেছে। সারাদিন আমরা একভাবে বসে আড্ডা দিয়েছি। বাইরে বরফ পড়ছে অঝোরে। এখন আর বেরুবার কোনও মানে হয় না। আমারও খুব একটা গরজ নেই। ঠিক হল, পরদিন আমরা খুব ভোরে উঠে তৈরি হব।

পরের দিন রবিবার। সেদিন আমরা ঘুম ভেঙে প্রথম কাপ চা খেলুম দুপুর সাড়ে বারোটায়। আজও বরফ পড়ার বিরাম নেই। কে আর এই দুর্যোগে বেরুতে চায়।

এর মধ্যে আমি যেন ওদের আত্মীয় হয়ে গেছি। বাইরে বরফ আর ঠান্ডা, তার চেয়ে ঘরের মধ্যেকার আন্তরিকতা ও আড্ডার উষ্ণতা অনেক বেশি উপভোগ্য।