[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

৪২. স্কুলের বন্ধু সূর্য

নিউ ইয়র্কে আমার স্কুলের বন্ধু সূর্যর সঙ্গে দেখা হয়েছিল দৈবাৎ এক পার্টিতে। সে যে এদেশে আছে আমি জানতুম না, অনেকদিন ওর সঙ্গে যোগাযোগই নেই। কিন্তু স্কুলের বন্ধুদের কেউ কখনও ভোলে না। সুটটাই পরা লম্বা-চওড়া বলিষ্ঠকায় মানুষকে দেখেও আমি তার মুখে আদল পেলুম আমার সহপাঠী এক কিশোরের। তার কাছে গিয়ে কাঁধে চাপড় মেরে বলেছিলুম, সূর্য না? সূর্যও সঙ্গে-সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, নীলু? তুই?

আমার চেয়েও সূর্যই বেশি অবাক হয়েছিল। কারণ আমাকে ও কোনওদিন নিউ ইয়র্কে দেখবে, এরকম ওর সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না। আমার সহপাঠীদের মধ্যে অনেকেই জীবনে যথেষ্ট উন্নতি করেছে, সূর্য নিজেও একজন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু ওরা সবাই জানে, শুধু আমারই কিছু হল না, লেখাপড়াতেও সুবিধে করতে পারিনি, চাকরির ব্যাপারেও গা পাওয়া, আমি এখনও একটা ভ্যাগাবন্ডই রয়ে গেছি।

স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে ফর্মালিটির ব্যাপার নেই। সুতরাং অন্য কেউ এ পর্যন্ত যে কথা জিগ্যেস করেনি, সূর্য সরাসরি তাই জানতে চাইল, তুই এদেশে কী করে এলি রে নীলু? তোকে কে পাঠাল?

আমি বললুম, সুব্রতকে চিনতিস তো? সেই সুব্রতর মামার বিরাট ট্রাভেল এজেন্সি আছে। কেন জানি না, উনি আমায় খুব ভালোবাসেন। উনি আমায় বিনে পয়সায় একটা রিটার্ন টিকিট দিয়েছেন। আর দিয়েছিলেন দুশো ডলার। তাই নিয়ে ভেসে পড়েছি। তারপর এর-ওর বাড়িতে থাকছি। একদম টাকা ফুরিয়ে গেলে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে ভিক্ষে করি। হরে কৃষ্ণ হরে রাম গানটা এখানে বেশ চলে, সবাই পয়সা দেয়।

আমার কথাটা কতটা সত্যি আর কতটা ইয়ার্কি তা সূর্য হয়তো ঠিক বুঝল না। কিন্তু সে খুব আফসোস করতে লাগল। কারণ, পরের দিন সকালেই সে নাইজিরিয়া চলে যাবে। আমার সঙ্গে সময় কাটাতে পারবে না।

যাই হোক, সেই রাত্রে সূর্য আমাকে একটা চাবি দিয়েছিল। বলেছিল, তুই যদি কখনও শিকাগোর দিকে যাস, তাহলে আমার বাড়িতে একবার যাস। ছোট্ট জায়গা, কিন্তু তোর ভালো লাগবে। তুই ওখানে যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারিস। আমার স্টোরে দেখবি চাল-ডাল মজুত আছে প্রচুর, দেশ থেকে আনা আচার আছে। তুই রান্না করে খাবি। মাসদেড়েক পরেই আমি ফিরে আসব–।

আমি বলেছিলুম, তুই চাবি দিচ্ছিস, যদি আমার দিকে না যাওয়া হয়?

সূর্য বলেছিল, তাতে কোনও অসুবিধে নেই। চাবিটা তুই একটা খামে ভরে আমার ঠিকানায় পোস্ট করে দিবি। আর যদি যাস তো ফেরার সময় চাবিটা আমার লেটার বক্সে রেখে আসবি।

সূর্যর সেই চাবিটা এতদিন আমার পকেটেই রয়ে গেছে। শিকাগোতে এসে দোনামনা করতে লাগলুম, যাব কি যাব না। নিউ ইয়র্কে সেই দেখা হওয়ার পর মাস দেড়েক কেটে গেছে, এর মধ্যে সূর্য ফিরে আসতেও পারে। তাহলে একটা চান্স নেওয়া যাক। সূর্যকে পেলে কয়েকদিন বেশ চুটিয়ে ছেলেবেলার গল্প করা যাবে।

সিভার র‍্যাপিডস একটা ছোট্ট শহর। দোকানপাট বা রাস্তার বহর দেখলে অবশ্য ছোট্টত্ব বোঝবার উপায় নেই। কয়েকটি দোকান সত্যিই বিরাট। কিন্তু মার্কিন দেশের সিভার র‍্যাপিডস এর চেয়ে বড় শহর অন্তত দুশোটা আছে।

সূর্য তার বাড়ির অবস্থান বেশ ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। একটি বিরাট জলাশয়ের প্রান্তে একটি দশতলা অ্যাপার্টমেন্ট হাউস। বাড়িটিতে প্রায় চারশো অ্যাপার্টমেন্ট আছে। পুরো একটি পাড়াই বলা যায়। এই বাড়ির মধ্যেই রয়েছে দুটি ঢাকা সুইমিং পুল, যেখানে শীতকালেও সাঁতার কাটা যায়, দুটি টেনিস কোর্ট, তা ছাড়া সনা বাথ ও নানারকম খেলার ব্যবস্থা ও লাইব্রেরি। ইউনিভার্সিটির অনেক ছাত্র-ছাত্রী ও অধ্যাপক থাকেন এখানে।

সূর্য এখন ফেরেনি, একতলার অফিস ঘরে খোঁজ নিয়ে জানলুম। তারপর তাদের জানিয়ে আমি চলে এলুম সূর্যর ঘরের দিকে। ওর অ্যাপার্টমেন্ট আটতলায়। চাবি খোলার আগেই শুনতে পেলুম। ঘরের মধ্যে কারা যেন বেশ জোরে-জোরে কথা বলছে। তাহলে কি অন্য কেউ আছে? কিন্তু আমি এসে পড়েছি, এখন তো ফিরে যেতে পারব না। কয়েকবার বেল দিলুম, কেউ দরজা খুলল না। অথচ ভেতরে কথাবার্তা চলছেই। যা থাকে কপালে বলে ঘুরিয়ে দিলুম চাবি।

প্রথমে বসবার ঘর। সেখানে কেউ নেই। পাশে রান্নাঘর। উঁকি দিলুম সেখানে, কারুকে দেখতে পাওয়া গেল না। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে পাশের শয়ন কক্ষ থেকে। কয়েকবার সে দরজায় ঠকঠক করলুম, তাও কেউ সাড়া দিল না। তারপর সেই দরজাটা ঠেলে খুলে ফেলতেই রহস্যটা বোঝা গেল। টিভি-টা খোলা রয়েছে!

হ্যাঁ, ইস্কুল-জীবনেও সূর্য বেশ ভুলোমনা ছেলে ছিল বটে, এখানে এসেও শোধরায়নি। যাওয়ার সময় টিভি বন্ধ করতে ভুলে গেছে, দেড় মাস ধরে সেটা একটানা চলছে। দেশে ফিরে গিয়ে সূর্যর মাকে জানাতে হবে এ কথা।

সূর্যর অ্যাপার্টমেন্টটা বেশ বড়, একলা মানুষের পক্ষে অঢেল জায়গা। তার শয়নকক্ষের জানলা দিয়ে দেখা যায় সেই জলাশয়টি, আর বসবার ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যায় একটা জঙ্গল।

সূর্যর ভাঁড়ারেও অনেক জিনিস মজুত আছে, চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ, সূর্যমুখী তেল, আর নানা রকম গুঁড়ো মশলা, হলুদ-লঙ্কা-জিরে আরও কত কী। আর কিছু না হোক আমি খিচুড়ি খেয়েই বেশ কিছুদিন এখানে চালিয়ে দিতে পারব।

হিসেব করে দেখলুম, আমি প্রায় পাঁচ মাস ধরে ইউরোপ, কানাডা ও আমেরিকায় চরকি বাজির মতন ঘুরছি। এখন এখানে কয়েকদিন একেবারে চুপচাপ বিশ্রাম নিলে মন্দ হয় না। এই শহরে আমায় কেউ চেনে না। আমিও কারুকেই চিনি না। সুতরাং এখানে আমার হবে অজ্ঞাতবাস।

প্রথম দুদিন একলা এই অ্যাপার্টমেন্ট-এ কাটিয়ে দিলুম। একবারের জন্যও বাইরে পা দিইনি। অবশ্য ঠিক একলা নয়, টেলিভিশন আছে সর্বক্ষণের সঙ্গী। প্রথম এসে সেই যে এক ডেকচি খিচুড়ি বেঁধেছি, চারবেলা ধরে তা-ই খাচ্ছি। ফ্রিজে রাখা খিচুড়ি জমে একেবারে শক্ত হয়ে যায়। তার থেকে এক স্লাইস কেটে নিই, ঠিক যেন মনে হয় খিচুড়ির কেক। সেটার সঙ্গে একটু জল মিশিয়ে গরম করে নিলেই হল। খাবারটা আমি বিছানায় শুয়ে-শুয়েই সেরে নিই। রাত্তিরবেলা টিভি-তে সলিড গোল্ড অনুষ্ঠানে নর্তকীদের নাচ, আমি বিছানায় অর্ধেক হেলান দিয়ে শোওয়া, হাতে খাবারের পাত্র রোমান সম্রাটের সঙ্গে আমার তফাত কী? ছবিটাকে আর একটু নিখুঁত করার জন্য আমি এতে একটা সুরার পাত্র যোগ করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু সূর্যর ঘরে ওয়াইন-জাতীয় কিছু নেই, আছে মস্ত বড় কোকাকোলার বোতল। তার থেকেই ঢেলে নিই গেলাসে, কেউ যদি ছবি তোলে তাহলে এই কোকাকোলাকেই রাম মনে হবে।

তৃতীয় দিন সকালে প্রাণটা একটু আনচান করতে লাগল। আর কিছু নয়, ডিমের জন্য। পশ্চিমি সভ্যতা আমাদের প্রত্যেক দিন সকালে ডিম খাওয়ার বদ অভ্যেস ধরিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া খিচুড়ির সঙ্গে ডিম ভাজা অতি উপাদেয়।

আসবার দিন কাছেই একটা শপিং মল দেখে এসেছিলুম। নিজের গাড়ি না থাকলে এখন বেশি দূরে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কাল সন্ধে থেকে তুষারপাত থামলেও রাস্তায় জমে আছে বরফ। তা ছাড়া, তুষারপাতের সময়ই শীত একটু কম থাকে, রোদ উঠলেই কনকনে শীত। ধরাচুড়ো সব পরে নিয়ে বেরুলাম। কাছেই একটা ব্যাঙ্কের মাথায় তাপাঙ্ক নির্দেশক ঘড়ি আছে। সেখানে দেখলুম, শূন্যের নীচে সাত ডিগ্রি নেমেছে। এই তো সবে শুরু। এখনও ক্রিসমাসের একুশ দিন বাকি। এই সব অঞ্চলে শূন্যের নীচে তিরিশ পর্যন্ত নেমে যায়।

শপিং মলে গিয়েই একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। সামনেই একটা ছোটখাটো ভিড়, মানুষজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এর আগে এ দেশের কোথাও কোনও রাস্তায় এরকম গোল হয়ে দাঁড়ানো ভিড় দেখিনি। এদেশের রাস্তায় পকেটমার ধরা পড়ে না, গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট হলেও অন্য কেউ গ্রাহ্য করে না, এমনকী কেউ কারুকে খুন করলেও অন্যরা ফিরে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে যায়।

এগিয়ে গিয়ে উঁকি মেরে আরও অবাক হলুম। ভিড়ের মাঝখানে একটা বিরাট শিংওয়ালা হরিণ। হরিণটির একটা পা কোনও কারণে জখম হয়েছে, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেও সে পারছে না। আমাদের দেশে এরকম একটা ব্যাপার হলে সবাই উত্তেজিতভাবে চ্যাঁচামেচি করত, এখানে জনতা একেবারে নিস্তব্ধ। আমি একজন বয়স্ক লোককে ফিসফিস করে জিগ্যেস করলুম ঘটনাটা কী? উনি আমাকে সংক্ষেপে জানিয়ে দিলেন।

কাছাকাছি কোনও জঙ্গল থেকে এই হরিণটা হঠাৎ শহরে চলে এসেছে। দিনের আলোয় এরকমভাবে কোনও হরিণকে কেউ আগে কখনও আসতে দেখেনি। হরিণটা কেন এসে পড়েছে কে জানে! কিন্তু শপিং মলের সামনে অজস্র গাড়ির সামনে পড়ে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এদিকে-ওদিকে ছুটতে শুরু করে। গাড়ির চালকরা ওকে বাচাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ওরই দোষে একটা গাড়ির সঙ্গে ওর ধাক্কা লেগেছে।

হরিণটার টানা-টানা কাজল আঁকা চোখ, মাথায় শিং-এর ডালপালা, গায়ের চামড়া হলুদ আর সবুজ মেলানো। অতবড় শরীরটা নিয়ে সে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছে।

এ দেশের মানুষ হরিণ খুব ভালোবাসে। গোটা আমেরিকা জুড়ে সরীসৃপের মতন অসংখ্য রাস্তা, তার অনেক রাস্তাই গেছে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। সেসব রাস্তায় যেতে-যেতে অনেক বোর্ড দেখেছি, কশান! ডিয়ার ক্রসিং। সেই সব জায়গা দিয়ে সাবধানে, আস্তে গাড়ি চালানো নিয়ম। একদিন রাত্তিরবেলা দীপকদাদের সঙ্গে গাড়িতে আসতে-আসতে হেড লাইটের আলোয় এরকম একটা হরিণকে রাস্তা পার হতেও দেখেছিলুম। কিন্তু শহরের মোটর গাড়ির জঙ্গলের মধ্যে এরকম একটি বন্য হরিণকে কেমন যেন করুণ আর বেমানান লাগে।

হরিণ মারার ব্যাপারে অনেক বিধিনিষেধ আছে। অথচ আহত হরিণটিকে জঙ্গলে কী করে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, তাই বা কে জানে। পুলিশ এসে গেছে, নানান রকম জল্পনাকল্পনা চলছে। হরিণটা এত জোর শিং ঝাঁকাচ্ছে যে কাছে গিয়ে ওকে ধরাও খুব শক্ত। এদেশের যা ব্যাপার, হয়তো বিশাল এক ক্রেন এনে হরিণটাকে তুলে নিয়ে যাবে। সে দৃশ্য দেখবার জন্য আমি আর সেখানে দাঁড়ালুম না।

সূর্যর অ্যাপার্টমেন্টে থাকার সময় আমার আর একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল।

প্রথম দিন ডিম ভাজতে গিয়েই ঘরের মধ্যে কোথায় যেন বেশ জোরে প্যাঁক করে একটা শব্দ হল। একলা ঘরে এরকম কোনও শব্দ শুনলে চমকে উঠতেই হয়। আওয়াজটা এমন যেন কোনও দুষ্টু ছেলে লুকিয়ে থেকে তালপাতার সানাই বাজাচ্ছে। আরও দু-বার ওইরকম প্যাঁক প্যাঁক হতেই কারণটা আন্দাজ করতে পারলুম।

আমার আনাড়ি হাতে ডিম ভাজার জন্য তেল ঢালতে গিয়ে সসপ্যানে একটু বেশি তেল পড়ে গেছে। গ্যাসের আঁচটাও বেশি। তাই ধোঁয়া হয়েছে। ওই প্যাঁকটা হচ্ছে স্মোক অ্যালার্ম। এইসব বড়-বড় বাড়িতে আগুন লাগার খুব ভয়। তাই একটু ধোঁয়া উঠলেই সাবধান করে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে।

স্মোক অ্যালার্ম যন্ত্রটা আমি আগে দেখেছি। কিন্তু এই অ্যাপার্টমেন্টে সেটা কোথায়? খুঁজে দেখলুম, বসবার ঘরের আর শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে দুটো সেই গোল যন্ত্র লাগানো আছে।

ধোঁয়া যতক্ষণ না বেরুবে ততক্ষণ মাঝে-মাঝেই এরকম প্যাঁকপ্যাঁক চলবে। শীতের জন্য জানলা খোলার কোনও উপায় নেই। কে যেন আমায় বলেছিল, জল ছিটিয়ে দিলে ওই প্যাঁকপ্যাঁকানি বন্ধ হয়। কিন্তু জল ছিটাতে আমি সাহস না করে ফ্রিজ থেকে বরফের ট্রে বার করে একটা যন্ত্রের ওপর চেপে ধরলুম। তাতে সাময়িকভাবে সে শান্ত হল।

কিন্তু ততক্ষণে আমার ভয় ঢুকে গেছে। আজই আমি ডিম কিনতে গিয়ে এক দোকানে বেশ টাটকা বাঁশপাতা মাছ দেখতে পেয়ে লোভের বশে কিনে এনেছি। এদেশে এসে বহুদিন কুচো মাছ খাইনি। ভেবেছিলুম মাছ ভাজা খাব।

কিন্তু ধোঁয়াহীন মাছ ভাজা কী করে সম্ভব, তা তো আমি জানিনা।

একদিন বাদ দিয়ে পরের দিন ভরসা করে শুরু করলুম মাছ ভাজতে। আঁচ খুব কম, তেলও দিয়েছি যৎসামান্য। বরফের ট্রে-ও রেডি রেখেছি। একটু পরেই শুরু হল পর্যায়ক্রমে প্যাঁকপ্যাঁক। বরফের ট্রে চেপে ধরলুম, কোনও কাজ হল না। ডিমের ধোঁয়া যদি বা সহ্য করেছে, মাছের ধোঁয়া কিছুতেই সহ্য করছে না।

দরজায় কে যেন বেল দিল। আমি দরজা খুলতেই একজন কৃষ্ণকায় লোক রাগি মুখে ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে বলল, হোয়াটস হ্যাপেনিং?

আমি তাকে ব্যাপারটা বোঝাতে যেতেই সে পুরোটা না শুনে দু-দেওয়াল থেকে টপটপ যন্ত্র দুটো খুলে ফেলল। তারপর সে-দুটো টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে আর কোনও কথা না বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তারপর আওয়াজ একেবারেই বন্ধ।

আমি মনে-মনে বললুম, কে-হে তুমি উপকারী বন্ধু?

এরপর আমি নিশ্চিন্তে মাছ ভাজলুম। ঘর ধোঁয়ায় ভরতি হয়ে গেল। কিন্তু কেউ আর প্যাঁকপ্যাঁক করল না।

দু-তিনদিন নিশ্চিন্তে কাটল। তারপর হঠাৎ একদিন মাঝরাত্তিরে আমি আঁতকে উঠলুম। দুটি যন্ত্রই পর্যায়ক্রমে প্যাঁকপ্যাঁক শুরু করেছে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলুম। সত্যি কি তাহলে ঘরে আগুন লেগেছে?

সমস্ত অ্যাপার্টমেন্টটা খুঁজে দেখলুম তন্নতন্ন করে। কোথাও আগুন নেই, ধোঁয়া নেই, কোনও আলো জ্বলছে না। কোনও গরম-জলের কলও খোলা নেই। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলুম না। সারারাত ওইরকমই চলল। আমার চোখের পাতা এক হল না।

সকালবেলা খালি পায়েই সেই যন্ত্রদুটো নিয়ে ছুটলুম একতলার অফিসে। সেখানকার তরুণীটিকে খুব উত্তেজিতভাবে এই অলৌকিক ঘটনাটা বোঝাতে যাচ্ছিলাম, তরুণীটি খুব শান্তভাবে বলল, ও, ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে। তারপর সে আরেকটু ব্যাখ্যা করল, ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে এরকম আওয়াজ করে জানিয়ে দেয়।

ধন্য, বাবা যন্ত্র। আমরা তো জানতুম, ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে সব জিনিসই চুপ মেরে যায়। মরা ব্যাটারির এমন ডাক আমি আগে কখনও শুনিনি।