[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

৩০. প্রথম দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে

প্রথম দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে মা আর মেয়ে এসে ঢুকছে একটা সদ্য ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে। মেয়ের বয়েস সতেরো, রোগা আর লম্বা; মায়ের বয়েস চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে। সবে মোটা হতে শুরু করেছে শরীর, অসভ্য ধরনের রঙিন মুখখানা দেখলেই তার পেশা মোটামুটি অনুমান করা যায়। আগেকার ফ্ল্যাটের ভাড়া ফাঁকি দিয়ে তারা এই নতুন জায়গায় এসেছে। জিনিসপত্র গোছাবার আগেই মা ক্লান্ত হয়ে হুইস্কি খেতে শুরু করে, হুইস্কি এবং মায়ের প্রতি মেয়ের একই রকম ঘৃণা। এদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় এরা খুব ঘনিষ্ঠ ধরনের শত্রু, পরস্পরের প্রতি স্নেহ ভালোবাসার তিলমাত্র অস্তিত্ব নেই। বাড়িটি ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে এক অতি গরিব পাড়ায়, কাছাকাছি রয়েছে কবরখানা, কসাইখানা আর কারখানার চিমনি অনবরত ধোঁয়া ওগরাচ্ছে। ঘরটিও অতি অস্বাস্থ্যকর ও অন্ধকার ও স্যাঁতসেঁতে। যার তুলনা দেওয়া হয়েছে, ‘ব্ল্যাক হোল অফ। ক্যালকাটা’র সঙ্গে।

একটু পরেই এক চোখে ঠুলি লাগানো জলদস্যুর মতন চেহারার একজন লম্বা লোক এসে হাজির হয়। সে আধা মাতাল ও মায়ের প্রাক্তন প্রেমিক। মা অবাক হয় তার এই প্রেমিককে দেখে। এত তাড়াতাড়ি সে কী করে তার নতুন ঠিকানা খুঁজে বার করল। আর লোকটি অবাক হল মেয়েকে দেখে, কারণ তার প্রেমিকার যে অত বড় মেয়ে আছে তা সে জানত না। মায়ের নাম হেলেন, মেয়ের নাম জো এবং এই লোকটির নাম পিটার।

পিটার বেশ একটা ফুর্তির মুডে আছে, হেলেনকে নিয়ে সে বেরুতে চায় কিংবা জোকে ঘরের বার করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতে চায়। জো প্রথম দর্শনেই পিটারকে অপছন্দ করেছে এবং সে কিছুতেই ঘরের বাইরে যাবে না। তাদের ওই একখানাই ঘর। হেলেনেরও আজ ওসবের প্রতি উৎসাহ নেই, এমনকী পুরুষ ও যৌন খেলা সে একেবারেই ছেড়ে দেবে বলে ভাবছে। পিটার তখন তাকে একটি ম্যাজিক শব্দ শোনায়, সে হেলেনকে বিয়ে করতে চায়। মা-মেয়ে কেউই প্রথমে একথা বিশ্বাস করে না। জো তার মায়ের সমস্ত দোষের তালিকা দেয় পিটারকে। পিটার তা শুনে হাসে। হেলেনও বলে, তুমি আমায় বিয়ে করবে কী, জানো আমি প্রায় তোমার মায়ের বয়েসি। তাতে পিটার সগর্বে জানায় যে মা-মা ধরনের মহিলাদের কাছ থেকে সে সবচেয়ে বেশি যৌন আনন্দ পায়! পিটারের পকেটে এক গাদা খুচরো টাকা ও অনেক মেয়েমানুষের ছবি। পিটার অবশ্য জলদস্যু নয়, পেশায় সে গাড়ির সেলসম্যান।

পরের দৃশ্যে আমরা মা ও মেয়ের কথা শুনে জানতে পারি যে হেলেনের একবার বিয়ে হয়েছিল, তার স্বামী তাকে ডিভোর্স করেছে অনেক বছর আগেই। জো অবশ্য তার সেই স্বামীর সন্তান নয়। তাদের গ্রামের একটি আধপাগলা লোকের সঙ্গে মাত্র পাঁচ মিনিটের ভুলে জোর জন্ম। তবে, হেলেনের জীবনে সেটাই প্রথমবার। সেই হিসেবে জো পবিত্রতার সন্তান। জো ভাবে, তা বলে কি সেও পাগল হয়ে যাবে? জোর খাতায় হেলেন আবিষ্কার করে অনেকগুলো চারকোলে আঁকা ছবি, মেয়ের যে আঁকার এত ভালো হাত মা তা এই প্রথম জানল। মেয়েকে কোনও আর্ট স্কুলে ট্রেনিং নেওয়ার কথা সে বলে, কিন্তু মেয়ে রাজি নয়। কারণ মা তো তার পড়াশুনোর ব্যাপারে কোনও দিন মনোযোগ দেয়নি। তাতে মা নির্লজ্জভাবে জানায় যে সে নিজের প্রতি মনোযোগ দিয়েই আর অন্য কিছুর জন্য সময় পায়নি।

জো স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি কৃষ্ণাঙ্গ ছেলের সঙ্গে ভাব করে। ছেলেটি ভালো গান করে এবং নৌবিভাগে কাজ করে। ছেলেটি ওদের বাড়িতে ঢোকে না কিন্তু জো-কে কোনও নির্জন জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। জো বলে, জানি, তুমি আমার কাছে কী চাও। আমি তা দিতে পারি, কারণ তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ছেলেটি বলল, তুমি যা ভাবছ, আমি ঠিক তা-ই চাই, সেইসঙ্গে তোমাকে বিয়ে করতেও চাই। এনগেজমেন্ট রিং-ও সে আগেই কিনে রেখেছে। আংটিটা জো-র আঙুলে একটু ঢলঢলে হয়। সে সেটা একটা সুতোয় বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে রাখে।

এর মধ্যে পিটার এসে আবার উপস্থিত হয়। হেলেনকে বিয়ে করার ব্যাপারে সে এখনও সিরিয়াস। হেলেনকে নিয়ে সে বাইরে ফুর্তি করতে যেতে চায়। হেলেন যতক্ষণ সাজপোশাকে ব্যস্ত তখন জো-র সঙ্গে পিটারের কথা কাটাকাটির খেলা চলে। হেলেন এই অবস্থায় মেয়েকে সহ্য করতে পারে না। সে এখন হনিমুনে যাওয়ার আনন্দে মশগুল, মেয়েকে একলা এখানে রেখে যাওয়ার ব্যাপারে ক্ষণিক মাত্র চিন্তা করে, মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায় কি না একবার ভাবে। হনিমুনে এতবড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব শোনামাত্র বাতিল করে দেয় পিটার। হেলেন ও পিটার জো-কে ফেলে রেখেই চলে যায়। তারপর আসে জোর কৃষ্ণাঙ্গ প্রেমিকটি। সে মনভাঙা জো-কে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার পাশে শুয়ে পড়ে।

পরের দৃশ্যে দেখা গেল জো গর্ভবতী, তার কৃষ্ণাঙ্গ নাবিক প্রেমিকটি তাকে পরিত্যাগ করে সুদূর সমুদ্র যাত্রায় চলে গেছে। জিওফ নামে একটি আর্ট স্কুলের ছাত্র জো-র সঙ্গে থাকে। জিওফ একটু মেয়েলি ধরনের, তার মেয়েদের সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ নেই, সে কেক বানাতে পারে, ঘর পরিষ্কার করতে জানে, সে জো-র সেবা করে। এরকমভাবে এক সঙ্গে থাকতে-থাকতে ওদের মধ্যে একধরনের ভালোবাসা জন্মে যায়। জিওফ গর্ভবতী অবস্থাতেই জো-কে বিয়ে করে তার সন্তানের একটা পরিচয় দিতে চায়, জো এই দয়া নিতে রাজি হয় না। এমনকী সেই কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটির খোঁজখবর করতেও তার সম্মানে বাধে। সেই ছেলেটির প্রতি তার কোন রাগ নেই, সে যে সুন্দর গান গাইত সেই কথাই তার মনে পড়ে।

জো-র যখন খুব অ্যাডভান্সড অবস্থা, সেই সময় এসে হাজির হয় তার মা হেলেন। বলা বাহুল্য, ফুর্তি শেষের পর পিটার তাকে পরিত্যাগ করেছে। সে জন্য অবশ্য হেলেনের আপসোস নেই, সে আগের মতোই চপলমতি, সে বারবার বলে, ইট ওয়াজ গুড হোয়াইল ইট লাস্টেড। মেয়ের বাচ্ছা হওয়ার সময় সে মা হিসেবে সত্যিকারের দায়িত্ব নিয়ে সাহায্য করবার আশ্বাস দেয়। তার আগে বাক্যবাণের জ্বালায় সে জিওফ-কে তাড়িয়ে দেয়, কারণ এরকম অ-পুরুষ পুরুষের সান্নিধ্য তার সহ্য হয় না। হেলেন তার ভবিষ্যৎ নাতি বা নাতনির জন্য অনেক খেলনাটেলনা কিনে আনে, কিন্তু যখন শোনে তার মেয়ের প্রেমিক ছিল কৃষ্ণাঙ্গ এবং বাচ্ছাটার রং ও কালো হতে পারে, তখন সে বিতৃষ্ণায় আবার মেয়েকে ছেড়ে চলে যায়।

নিঃসঙ্গ গর্ভবতী কুমারী জো খালি ঘরের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে একটি ছেলে-ভুলোনো ছড়া বলতে থাকে আস্তে-আস্তে।

এই হল ‘আ টেস্ট অফ হানি’ নাটকের কাহিনি। শেলাগ ডেলানি নামে একটি উনিশ বছরের ব্রিটিশ চাকুরে-মেয়ে এই নাটকটি রচনা করেছিল। এক সময় স্ট্রাটফোর্ডের থিয়েটার রয়ালে সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের অ্যাংরি ইয়ংম্যানদের পর শেলাগ ডেলানিকে বলা হয়েছে রাগি যুবতি। এখন নাটকটি চলছে ব্রডওয়ের সেঞ্চুরি থিয়েটারে। পাঁচটি মাত্রা চরিত্রের একটি পরীক্ষামূলক নাটক, তাও প্রচুর দর্শক টানে। নাটকটির কাহিনি আমি বিস্তৃতভাবে লিখলুম একটি আধুনিক নাটকের পরিপূর্ণ পরিচয় দেওয়ার জন্য। আমাদের কাছে এর বিষয়বস্তু খুবই ডিকাডেন্ট মনে হবে। এখানে যেন জীবনের সমস্ত মূল্যবোধই মূল্যহীন। তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার, আমাদের দেশে যেমন গরিবদুঃখীদের নিয়ে প্রগতিশীল নাট্যরচিত হয়, সেই রকম এই নাটকের পাত্রপাত্রীও পশ্চিমি সমাজের একেবারে নীচের তলার গরিবদুঃখী। প্রসঙ্গত এটাও উল্লেখযোগ্য যে এই নাটকে দৃশ্যত কোনওরকম অশ্লীলতা এমনকী সামান্য যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ দৃশ্যও নেই। দু-ঘণ্টার নাটকটি টানটান হয়ে জমে যায় শুধু এর তীক্ষ্ণ সংলাপের জন্য।

লংকার থিয়েটারে চলছে মার্কমেডফ-এর লেখা একটি অদ্ভুত নাটক ‘চিলড্রেন অফ এ লেসার গড’। নির্বাক ছায়াছবির মতন এটাও যেন নির্বাক নাটক। এই নাটকটি গড়ে উঠেছে মূকবধিরদের জন্য এক শিক্ষাকেন্দ্রের এক ছাত্রী ও তার শিক্ষককে নিয়ে। শিক্ষকটি কথা বলতে পারে। কিন্তু সে তার ওই ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে হাতের আঙুলের ভাষায়। আমরা দর্শকরা কেউ ওই আঙুল-ভাষা বুঝি না। তবু আস্তে-আস্তে জমে ওঠে নাট্য কৌতূহল। আমরা বোবাদের জগতকে অপূর্ণ, অসমাপ্ত, অক্ষম বলে মনে করি, কিন্তু ক্রমে-ক্রমে নাট্যকার দেখিয়ে দেন যে বোবাদের চোখে এই তথাকথিত সুস্থ জগতেও কত অপূর্ণতা, কত ব্যর্থতা।

আশ্চর্য, এই রকম নাটকও দর্শক টানে। পশ্চিমি দেশগুলিতে নাটক দেখা একটা উচ্চস্তরের সামাজিক কাজ। যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত ও রুচিবান বলে মনে করেন, তারা নিয়ম করে নাটক দেখতে যান। নাটক দেখার দিনে তাঁরা বেশ যত্ন নিয়ে সাজগোজ করেন, এতে নাকি অভিনেতা অভিনেত্রীদের প্রতি বিশেষ সম্মান জানানো হয়। এই জন্যই অনেক সিনেমা হল খালি থাকে কিন্তু যেকোনও ভালো নাটকের টিকিট পাওয়াই মুশকিল। নাটকের টিকিটের দামও সাংঘাতিক, খুব কম করেও তিরিশ-পঁয়তিরিশ ডলার, অর্থাৎ আমাদের টাকার হিসেবে প্রায় তিনশো-সাড়ে তিনশো টাকা। ওদের টাকার হিসেবেও যদি ধরি, তা হলেও তিরিশ-পঁয়তিরিশ টাকা দিয়ে কজন আমাদের দেশে থিয়েটার দেখতে যাবে?

নাটকের টিকিট কিছু সস্তায় পাওয়ারও একটা ব্যবস্থা আছে। ব্রডওয়ে পাড়ার মাঝখানে একটা ছোট পার্কে একটা টিকিট কাউন্টার আছে। ও পাড়ার সব থিয়েটারেরই কিছু টিকিট বিক্রি হয় ওইখান থেকে, দাম অর্ধেক বা তিন চতুর্থাংশ। ভোরবেলা থেকে সেখানে লম্বা লাইন পড়ে। সংঘমিত্রা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আমাদের খুব ভাব হয়ে গেছে নিউইয়র্কে। নকশাল আন্দোলনের সময় কলকাতার অনেক বাবা-মা চেষ্টাচরিত্র করে তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বিলেত-আমেরিকায়। সংঘমিত্রা সেই রকমই একজন। কিছুদিন লন্ডনে পড়াশুনো করে তারপর বেশ কিছুদিন নিউ ইয়র্কে আছে। নাটক ও চলচ্চিত্র বিষয়ে তার খুব আগ্রহ। এই সংঘমিত্রাই আমাদের ওই সস্তায় টিকিট কাটার জায়গাটির সন্ধান দেয় এবং আমাদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে সে নাটক নির্বাচনেও সাহায্য করে।

টিকিটের দাম বিষয়ে একটি চমকপ্রদ সংবাদ এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। চার্লস ডিকেন্সের নিকোলাস নিকলবি উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়ে একটি ব্রিটিশ দল অভিনয় করছে ব্রডওয়েতে। নাটকটি চলবে টানা সাড়ে আট ঘণ্টা এবং এর টিকিটের দাম একশো ডলার অর্থাৎ ন’শো কুড়ি টাকা। সাড়ে আট ঘন্টা নাটক দেখার সুযোগ আর জীবনে ঘটবে না বলে বুক ঠুকে গিয়েছিলাম টিকিট কিনতে। কাউন্টারে গিয়ে শুনলুম আগামী দেড় মাস হাউস ফুল। এক মাস দশ দিন পরের একটা শো-র দুখানা টিকিট পাওয়া যেতে পারে বটে, তাও পার্শিয়াল ভিউ, অর্থাৎ কোনও থামের আড়ালে বসে দেখতে হবে। নমস্কার ঠুকে চলে এলুম সেখান থেকে।

সবাই জানে, আমেরিকানরা সদা ব্যস্ত জাতি। অথচ তারা সাড়ে আট ঘন্টার নাটকও ধৈর্য ধরে দেখতে জানে!

এই নিকোলাস নিকলবি’ই কিন্তু ব্রডওয়ের দীর্ঘতম নাটক নয়। সংবাদপত্রে এই সম্পর্কে আলোচনায় দেখলুম, কয়েক বছর আগে আর একটা নাটক হয়ে গেছে, যার নাম ‘দা লাইফ অ্যান্ড ডেথ অফ জোসেফ স্ট্যালিন’, সেটির দৈর্ঘ্য ছিল সাড়ে বারো ঘন্টা। তার টিকিটের দাম কত ছিল কে জানে।

নিউ ইয়র্কের নাট্য আন্দোলন নানা ভাগে বিভক্ত। ব্রডওয়েতে দেখানো হয়, তথাকথিত কমার্শিয়াল নাটক। এ ছাড়া আছে অফ-ব্রডওয়ে, অফ-অফ ব্রডওয়ে। যেখানে চলে নানা রকম পরীক্ষা। অফ-ব্রডওয়ের একটি সাড়া জাগানো নাটকের নাম সত্যাগ্রহ। নাটকটি ইংরেজিতে হলেও এর গানগুলি সব সংস্কৃত ভাষায়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে অর্জুনের দ্বিধা ও গীতার জন্ম, দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধিজির সত্যাগ্রহ আন্দোলন, মার্টিন লুথার কিং-এর অহিংস প্রতিরোধ ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছে নাটকটি। টিকিট সংগ্রহের ঝঞ্ঝাটে নাটকটি শেষ পর্যন্ত আমার দেখা হয়ে উঠল না। তবে যামিনীদার মুখে শুনেছি এর সঙ্গীতের প্রয়োগ নাকি অপূর্ব।

ব্রডওয়ের পেশাদারি দলের নাটকগুলি দর্শক টানে জমজমাট অভিনয় দিয়ে এবং প্রোডাকশনের চাকচিক্যে। নাটকগুলির বিষয়বস্তুও বিচিত্র ধরনের। যেমন একটি নাটকের নাম ‘টেকসাসের শ্রেষ্ঠ ছোট্ট বেশ্যালয়’, আবার আর একটি নাটকের নাম ‘ইভিটা’। এর মধ্যে প্রথমটি দেখার সুযোগ আমার হয়নি, দ্বিতীয়টি দেখেছি। তার বিষয়বস্তুই অভিনব। ইভাপেরন-এর নায়িকা, যিনি নিজেও পরে কিছুদিনের জন্য রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সামান্য নীচু অবস্থায় থেকে এক মহিলার উত্থানের কাহিনিই এর উপজীব্য, এর মধ্যে এসেছে দক্ষিণ আমেরিকার সেই দেশটির জন জাগরণ ও বিপ্লব-উত্থান। সেগুলি মাঝে-মাঝে দেখানো হয়েছে টুকরো-টুকরো চলচ্চিত্রে, অনেকটা ডকুমেন্টরির কায়দায়। নাটকটি দেখতে-দেখতে মনে হয়েছিল, এই যদি পেশাদারি নাটক হয়, তা হলে আমাদের দেশের শৌখিন নাটক অনেক পিছনে পড়ে আছে।

থিয়েটার হলগুলি তাদের প্রাচীনত্ব যথাযথ বজায় রাখবার খুব চেষ্টা করে। আধুনিক সিনেমা হলগুলিতে অনেক রকম কায়দা, কিন্তু থিয়েটার হল যেন এখনও পঞ্চাশ বা একশো বছর পুরোনো অবস্থায় রয়ে গেছে। এরা সহজে ঐতিহ্য বদলাতে চায় না। তবে এই ধরনের প্রাচীন চেহারার মঞ্চ ও অডিটোরিয়মেও ইনফ্রারেড লিসনিং সিসটেম চালু করা হয়েছে, যার জন্য মঞ্চে মাইক্রোফোন ঝুলতে দেখা যায় না, আর যেকোনও জায়গায় বসলেই কুশীলবদের কণ্ঠস্বর একই রকম শুনতে পাওয়া যায়।

ব্রডওয়ের আসল কৃতিত্ব তার মিউজিক্যালসগুলিতে। এমন সুচারু ও দক্ষ মিউজিক্যালস আর কোনও দেশে দেখা যায় না। আমি আর যেসব নাটক দেখেছি, তার মধ্যে এরকম একটি মিউজিক্যালের কথা বলি। নাটকটির নাম ‘কোরাস লাইন’ অসম্ভব জনপ্রিয় এবং অনেকগুলি পুরস্কার পেয়েছে। এর বিষয়বস্তু খুব সামান্য। একটি নাটকের কোরাস নাচ-গানের দৃশ্যের জন্য কয়েকজন নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী নেওয়া হবে। এর জন্য দরখাস্ত পড়েছে অসংখ্য, তার মধ্যে থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন ছেলে মেয়েকে ডেকে ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে। এইটুকুই গল্প। কত সামান্য এই চাকরি, তার জন্যই দেশের দূরদূরান্ত থেকে এসেছে যুবক-যুবতিরা, কেউ-কেউ অসাধারণ রূপসি ও রূপবান, কেউ এসেছে বাড়ি থেকে পালিয়ে, কেউ এসেছে খুবই গরিব ঘর থেকে, কেউ-কেউ এসেছে ভবিষ্যতে নায়ক বা নায়িকা হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে, কেউ এসেছে অসুখী সংসার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। এসেছে একটি জাপানি মেয়ে, দু-তিনটি কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে-মেয়ে। পঞ্চাশ জনের মধ্যে নেওয়া হবে মাত্র চার-পাঁচ জনকে, কে-কে হবে সেই সৌভাগ্যবান ও সৌভাগ্যবতী তা নিয়ে উৎকণ্ঠা থেকে যায় আগাগোড়া, পরীক্ষকের কাছে কেউ-কেউ আপ্রাণভাবে নেচে কুদে গেয়ে তাদের প্রতিভা প্রমাণের চেষ্টা করে, কেউ হঠাৎ নার্ভাস হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ফুটে ওঠে তাদের জীবনের রেখাচিত্র। সমস্ত সংলাপই গানে। নাটকটি দেখতে-দেখতে ধন্য-ধন্য করতে হয় এর পরিচালককে, যিনি এতগুলি নামহীন চরিত্রের প্রত্যেকেই জীবন্ত করে তুলতে পেরেছেন।

এই প্রসঙ্গ শেষ করার আগে আর একটি খবর দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ইংরাজিতে যাঁদের বলে ‘ফিলম বাফ’ আর বাংলায় বলে ‘সিনেমা আঁতেল’ তাঁরা নিশ্চয়ই ক্লদেৎ কোলবার্টের নাম শুনেছেন। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগে তিনি ছিলেন খুব নাম করা নায়িকা। সবাক যুগেও কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করে তিনি হারিয়ে যান। ক্লদেৎ কোলবার্ট বেঁচে আছেন কি না তা-ই জানে না এখন অনেকে। সেই ক্লদেৎ কোলবার্ট এক কাণ্ড ঘটিয়েছেন। ইনি মঞ্চেও প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী ছিলেন, ব্রডওয়েতে প্রথম মঞ্চ নাটকে নায়িকা হন ১৯২৭ সালে। তাহলেই ভাবুন, এর এখন কত বয়স হতে পারে। সেই ক্লদেৎ কোলবার্ট এতদিন বাদে ‘আ ট্যালেন্ট ফর মার্ডার’ নাটকে নেমে অভিনয়ের জোরে হইহই ফেলে দিয়েছেন। প্রতিদিন সে নাটক হাউস ফুল। এই রকমই আর একজন লরিন বাককল ছিলেন আগেকার দিনের নায়িকা, ক্যাসাব্লাঙ্কা ছবিতে অপূর্ব অভিনয় করেছিলেন, ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন হামফ্রি বোগার্টের স্ত্রী। সেই হামফ্রি বোগার্ট কবে মারা গেছেন, সেই সব সিনেমার যুগও কবে শেষ হয়ে গেছে, তবু নতুনভাবে মঞ্চে নেমে লরিন বাককল এখন জনপ্রিয় নায়িকা। অনুমান করুন তো, আমাদের চন্দ্রাবতী দেবী বা কানন দেবী কোন নাটকের নায়িকা হয়েছেন, আর সেই নাটক দেখার জন্য কলকাতার লোক রোজ ছুটে যাচ্ছে!