একদিন বিকেলবেলা ভাবলুম, তা হলে নায়েগ্রাটা ঘুরে আসা যাক। এত কাছে এসে একবার নায়েগ্রা দর্শন না করে চলে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।
কাছে মানে অবশ্য তিনশো সাড়ে তিনশো মাইল। কলকাতা থেকে জলপাইগুড়ি যেমন কাছেই। বাসে লাগে ছ-সাত ঘন্টা। কেটে ফেললুম রাত্তিরের বাসের টিকিট। ঝাঁকুনিহীন রাস্তা, নিশ্চিন্তে ঘুমোননা যায়, ভোরবেলা চোখ মেলেই দেখলুম বাফেলো পৌঁছে গেছি।
প্রথমবার জব্বলপুর যাওয়ার সময় আমার ধারণা ছিল, ট্রেন থেকে নেমেই মার্বেল রক দেখতে পাব। কিন্তু জব্বলপুর স্টেশন থেকে কোনও পাহাড়ই দেখতে পাওয়া যায় না, মার্বেল রক দেখতে হয় নৌকোয় চেপে। সেই রকমই, আমার মনে বোধহয় এই রকম একটা ছবি ছিল যে বাফেলো স্টেশনে পৌঁছতে-না-পৌঁছতেই শুনতে পাব বিশাল জলপ্রপাতের শব্দ, বাতাসে উড়বে জলকণা, আকাশে আঁকা থাকবে রামধনু।
বলাই বাহুল্য, সেসব কিছুই দেখলুম না, বাফেলো বাস স্টেশনটি অন্য আর পাঁচটা স্টেশনেরই মতন। বরং একটু যেন নিষ্প্রাণ।
কোনও নতুন জায়গায় পৌঁছলে কিছুক্ষণ একটা অনিশ্চয়তার অস্বস্তি থাকে। এখানে অবশ্য আমার তা নেই। নিউ জার্সি থেকে ভবানী আর আলোলিকা আগেই এখানে ওঁদের আত্মীয় কল্লোল আর টুনুকে খবর দিয়ে রেখেছেন। আমার সঙ্গেও কল্লোলের একবার টেলিফোনে কথা হয়েছিল, সুতরাং সবই ঠিকঠাক। তবে, কার কাছে যেন শুনেছিলুম, কল্লোল একটু ঘুমকাতুরে, খুব ভোরে তাকে বাস স্টেশনে উপস্থিত হতে বলা একটা নিষ্ঠুরতা। আমি পৌঁছেছি ভোর সাড়ে পাঁচটায়। এক্ষুনি কল্লোলকে ফোন না করে আমি কফি আর হট ডগ নিয়ে বসে গেলুম এক জায়গায়। তারপর সময় আর কাটতেই চায় না। একটা স্থানীয় সংবাদপত্র টেনে নিলুম। এইসব স্থানীয় সংবাদপত্রগুলিতে এত বেশি স্থানীয় খবর থাকে যে তাতে বাইরের লোক কোনও রস পায় না। বাফেলো শহরের ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে এক পৃষ্ঠা জোড়া আলোচনা পড়ে আমার কী লাভ! কিংবা এখানকার পুরোনো জেলখানাটি ভেঙে আধুনিক ধরনের জেলখানা ভবন বানানো হবে কি না সে সম্পর্কে আলোচনা। আমি এখানে দু-এক দিনের বেশি থাকব না। ট্রাফিক জ্যামে ভোগবার ভয় আমার নেই কিংবা এখানকার জেলখানায় পদার্পণ করার গৌরবময় সুযোগও বোধহয় আমার জুটবে না।
সাতটা পনেরোর সময় যখন বাইরে বেশ চড়া রোদ উঠেছে, তখন আমি ফোন করলুম কল্লোলকে। সে বলল, নীললোহিত, তুমি এসে গেছ। দাঁড়াও, আমি এক্ষুনি আসছি। বাস স্টেশন থেকে ওদের বাড়ি যথেষ্ট দূরে। তবু সে প্রায় কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসে গেল ঝড়ের বেগে। দেখলেই বোঝা যায়, সে সদ্য বিছানা ছেড়ে উঠেই কোনও ক্রমে জামা-প্যান্ট গলিয়ে চলে এসেছে। চোখ এখনও ভালো করে খেলেইনি।
কল্লোলকে আমি আগে কখনও দেখিনি, কিন্তু প্রথম দেখেই চেনা-চেনা লাগল। পাতলা, মজবুত শরীর, মুখে হালকা দাড়ি। ওর চেহারাতেই যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছাপ আছে। ঠিক তাই, কল্লোল বসু যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার। আমি নিজে যদিও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকবার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারিনি, তবু বন্ধুবান্ধবদের পয়সায় চা-খাবার জন্য কলকাতা-যাদবপুর রবীন্দ্রভারতী ইত্যাদি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যন্টিনেই গেছি। সেই জন্য ছাত্রদের আলাদা-আলাদা টাইপগুলো জানি।
কল্লোলকে যদিও এখনও ছাত্র-ছাত্র দেখায়, কিন্তু আসলে সে এখানে খুব দায়িত্বপূর্ণ কাজ করে। তার এখানকার কোম্পানি তাকে প্রায়ই চিনে পাঠায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে।
গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর কল্লোল বলল, বুঝলে ভাই, নীলু, প্রত্যেকদিন ভোরবেলা আমায় চাকরির জন্য দৌড়োতে হয়। এ দেশের চাকরিতে বড্ড খাঁটিয়ে মারে। আজ আমার ছুটির দিন, সেই জন্য বিছানা থেকে উঠতেই ইচ্ছে করছিল না।
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলুম, আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে আবার বলল, না, কিন্তু-কিন্তু করবার কিছুই নেই, আমাদের এখানে কেউ এলে আমরা খুব খুশি হই, খুব চুটিয়ে আড্ডা দিই।
আর কিছুক্ষণ যেতে-যেতেই ওর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল। বেরিয়ে পড়ল অনেক চেনা শুননা। ওর দুজন বন্ধু আমারও বন্ধু। তাদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল আন্দামান যাওয়ার পথে জাহাজে।
কল্লোল আমায় জিগ্যেস করল, তুমি তো এদেশের অনেক জায়গায় ঘুরছ। কেমন লাগছে?
এক কথায় এর উত্তর দেওয়া যায় না। আর যদি একটামাত্র শব্দেই উত্তর দিতে হয়, তা হলে বলতে হয়, ভালোই।
কল্লোল বলল, আমাদের মতন এত বেশিদিন থাকতে হলে ভালো লাগত না।
আমি চমকে উঠে বললুম, কেন, তোমার ভালো লাগে না?
–আমি তো প্রায়ই ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি!
এটা খুবই আশ্চর্যের কথা। কারণ, কল্লোলের দাদা-বউদি, বাবা-মা সবাই থাকেন এখানে। একই বাড়িতে নয়, কাছাকাছি। বলতে গেলে গোটা পরিবারটাই এ দেশে। সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত। তবু তার মন দেশের জন্য ব্যাকুল, এটা বিস্ময়কর তো বটেই।
বাফেলো শহরটি তেমন সুদৃশ্য নয়। কেমন যেন ন্যাড়া-ন্যাড়া ভাব। কল্লোলরা থাকে শহর ছাড়িয়ে খানিকটা বাইরে, ওদের রাস্তার নাম প্যারাডাইজ রোড, এই নামটিকে খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলা যায়। কিন্তু ওদের বাড়িটি চমৎকার। বাড়িটি নতুন কেনা হয়েছে, এখনও বেশি আসবাবপত্র আসেনি। এইরকম বাড়িই আমার দেখতে ভালো লাগে, বেশ একটা খোলামেলা ভাব পাওয়া যায়। অত্যধিক জিনিসপত্রে ঠাসা বাড়িগুলোতে ঢুকলে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে।
দরজা খুলে দিল কল্লোলের স্ত্রী টুনু। তাকে দেখে চমকে উঠলুম। ঠিক মনে হয় আগে দেখেছি। দেশপ্রিয় পার্কের সামনে কিংবা সাদার্ন এভিনিউ ধরে রঙিন ছাতা মাথায় এরকম একটি যুবতিকে কি আমি হাঁটতে দেখিনি? কিংবা ছবিতে দেখেছি? দক্ষিণ কলকাতার সুন্দরী বললেই এইরকম চেহারার একটি মেয়ের কথা মনে পড়ে।
কল্লোল তার স্ত্রীকে বলল, তুমি একে চা-টা খাওয়াও, আমি ততক্ষণে আর একটু ঘুমিয়ে নিই!
টুনু শুধু উজ্জ্বল রূপসি নয়, তার বেশ একটা ব্যক্তিত্ব আছে। খুব সুন্দর গল্প বলতে পারে সে। লুচি ভাজতে-ভাজতে সে আমায় অনেক গল্প শোনাল। সত্যিই সে দক্ষিণ কলকাতার একটি বিখ্যাত পরিবারের মেয়ে। অনেক ভাইবোনের সঙ্গে সে মানুষ হয়েছে, সেই সব স্মৃতি তার মনে এখনও জ্বলজ্বল করে। তার মায়ের অনেক কথা সে এমন চমৎকারভাবে বর্ণনা করল যে আমার মনে হল, টুনু যদি লিখত, তা হসে সে নিখুঁত চরিত্র সৃষ্টি করতে পারত।
টুনুর যে মানুষের চরিত্র পর্যবেক্ষণ করার বিশেষ ক্ষমতা আছে, তার পরিচয় পরে আরও পেয়েছি। আমরা যাদের কাছাকাছি যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না, যেমন কোনও নামকরা সাহিত্যিক বা সিনেমা পরিচালক বা অভিনেতা-অভিনেত্রী বা গায়ক-গায়িকা, তাঁদের অনেককেই এরা বেশ ভালো চেনে। যাঁরা নিউ ইয়র্কে বেড়াতে আসেন, তাঁরা অনেকেই একবার নায়েগ্রা দেখবার জন্য বাফেলো ঘুরে যান। তাঁদের আতিথ্য দেয় কল্লোল বা তার দাদা কুশল। কলকাতা থেকে কখনও নাটকের দল বা গানের দলও নিয়ে যায় এরা। মৃণাল সেন, উত্তমকুমার, শর্মিলা ঠাকুর, স্মিতা পাতিলের মতন সব খ্যাতিমানরা এখানে এসে থেকেছেন শুনেই তো আমি রোমাঞ্চিত বোধ করলুম। ভাগ্যিস নেহাত চেনাশুনোর জোরে আমিও এখানে জায়গা পেয়ে গেছি!
বিখ্যাত লোকদের নানান দুর্বলতাও বেশ লক্ষ্য করে দেখেছে টুনু। স্মিতা পাতিলের বেশি বেশি বিদ্যা জাহিরপনা কিংবা শর্মিলা ঠাকুরের মেমসাহেবির নানা কাহিনি শুনে আমি বেশ কৌতুক বোধ করি।
দুপুরবেলা কল্লোলের দাদা-বৌদি এসে পড়ায় আরও জমাট আড্ডা জমে গেল। কলকাতা থেকে কত দূরে এই বাফেলো, কিন্তু আড্ডাটা ঠিক কলকাতার মতন।
কুশলের খুব ঝোঁক সিনেমার দিকে। সে বাংলা সিনেমার অনেক খবর রাখে, একটা মুভি ক্যামেরা কিনেছে। কোনও একদিন সে নিজেই একটা ফিলম তুলবে।
এইবার তো একবার নায়েগ্রা দেখতে যেতেই হয়। কিন্তু কে নিয়ে যাবে?কল্লোল বলল, আমি নিয়ে যাচ্ছি, কুশল বলল, না, না, তুই থাক আমি নিয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ দুজনের কারুর খুব ইচ্ছে নেই। কল্লোলের বউদি কিংবা টুনু যে যাবে না, তা তারা আগেই বলে দিয়েছে। এই অনিচ্ছে খুব স্বাভাবিক। আমার বন্ধু পার্থসারথি চৌধুরি এক সময় ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন দার্জিলিং-এ। কলকাতা থেকে যারাই বেড়াতে যেত সকলেই বায়না ধরত টাইগার হিলে বিখ্যাত সূর্যোদয় দেখার। এইভাবে দু’বছরে অন্তত পঞ্চাশ বার টাইগার হিলে গিয়ে সূর্য ওঠা দেখতে হয়েছে তাঁকে। আমিই তো তাঁর সঙ্গে অন্তত তিনবার গেছি। তার ফলে টাইগার হিলে সূর্যোদয়ের ব্যাপারটা নিশ্চয়ই খুব বীভৎস ও বিকট মনে হয় এখন তাঁর কাছে। কেন যে লোকে ভোরবেলা উঠে ওই জিনিস দেখবার জন্য ছোটে।
নায়েগ্রা সম্পর্কেও কল্লোলদের এই রকমই মনোভাব হবে নিশ্চয়ই।
আমি সঙ্কুচিত বোধ করলুম একটু। বেশ তো আড্ডা হচ্ছে, এই আড্ডা ভেঙে নায়েগ্রা কি দেখতেই হবে? না দেখলেই বা ক্ষতি কী? ছবি টবিতে তো অনেকবার দেখা আছে।
কিন্তু আমাকে বাফেলোতে এসেও নায়েগ্রা না দেখে ফিরে যাওয়ার রেকর্ড করতে দিতে ওরা রাজি নয়। এবং অতিরিক্ত ভদ্রতা দেখিয়ে দুই ভাই-ই এক সঙ্গে যেতে উদ্যত হল, আমার আপত্তি তারা শুনল না।
ওদের বাড়ি থেকে নায়েগ্রা প্রায় দশ-বারো মাইল দূরে। কিংবা কিছু বেশিও হতে পারে। গুড়ো-গুঁড়োবৃষ্টির মধ্যে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল, জলপ্রপাতের দিকে।
নায়েগ্রা নদীতে আমেরিকা ও কানাডার সীমানা। নদীটি যেখানে প্রপাতিত হয়েছে, সেই মুখের কাছটাতেই একটা দ্বীপ, ফলে প্রপাতটি দু-ভাগ হয়ে গেছে। এক দিকেরটি আমেরিকার, অন্য দিকেরটি কানাডার। তবে এই একটা ব্যাপারে কানাডা জিতে আছে, তাদের দিকের নায়েগ্রাই বিশাল এবং আসল দর্শনীয়। শুধু আমেরিকান দিকটি দেখে ফিরে এলে কিছুই প্রায় দেখা হয় না।
আগে ভারতীয়দের কানাডায় যাওয়ার ব্যাপারে কোনও বাধা ছিল না। এই যাত্রার প্রথমে আমিই তো কানাডায় ঢুকেছি বিনা বাধায়। কিন্তু এর মধ্যে খালিস্তান আন্দোলনকারী একদল শিখ কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ফলে কানাডার সরকার এখন ভারতীয়দেরও বিনা ভিসায় কানাডা সীমান্ত পার হতে দেয় না। আমি অবশ্য এই সব খবর টবর জেনে আগেই ওয়াশিংটন ডি সি থেকে ভিসা করিয়ে এসেছি।
বিশাল ব্রিজ পেরিয়ে চলে এলুম কানাডার দিকে। কল্লোল ও কাজলের ভিসার দরকার নেই, কারণ ওরা আমেরিকায় বসবাসকারী। জলপ্রপাতটির দিকে এগোতে এগোতে আমি একটু-একটু নিরাশ হলুম। মানুষের দাপটে প্রকৃতির মহিমা এখানে খর্ব হয়ে গেছে। আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে ডঃ লিভিংস্টোন যেদিন প্রথম ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত আবিষ্কার করেন, তাঁর সেই বিস্ময়ের কথা আমরা একটু-একটু অনুমান করতে পারি। একদিন এখানেও নিশ্চয়ই জঙ্গল-টঙ্গল ছিল, তার মধ্যে এই এক নদীর বিরাট অধঃপতন নিশ্চয়ই সবাইকে চমকে দিত। কিন্তু এখন এই জলপ্রপাতকে উপলক্ষ করে গড়ে উঠেছে রীতিমতন এক বাণিজ্য কেন্দ্র। প্রচুর দোকানপাট, হোটেল, টাওয়ারে উঠে দেখবার ব্যবস্থা, রাত্তিরবেলা আলোকসম্পাত, আরও কত কাণ্ড! প্রকৃতি নিয়ে এমন ব্যাবসাদারি আমার পছন্দ হয় না। হোটেল-ফোটেল থাকবেই জানি, কিন্তু কিছুটা দূরে সেসব করা যেত না? অন্তত এক মাইল ফাঁকা জায়গা দিয়ে হেঁটে হঠাৎ দেখতে পেলে কত বেশি ভালো লাগত! তার বদলে গাড়ি চেপেই উপস্থিত হলুম একেবারে নায়েগ্রার গায়ের ওপর।
আমরা ইস্কুলের ভূগোলে ‘নায়েগ্রা’ নামটাই পড়েছি, কিন্তু বানান অনুযায়ী এর সঠিক উচ্চারণ বোধহয় ‘নায়েগরা’ কিংবা ‘নায়েগারা’। আমরা অবশ্য নায়েগ্রাই বলব। প্রথম দর্শনে এর বিশালত্ব সত্যিই বুকে ধাক্কা মারে। আমরা ছেলেবেলায় রাঁচির হুডু জলপ্রপাত দেখে মুগ্ধ হয়েছি। হঠাৎ সেই হুড়ুর কথা মনে পড়ায় একটু দুঃখ হয়। হুডুও বেশ জমকালো জলপ্রপাত ছিল, এখন শুকিয়ে গেছে, কেন তা কে জানে! নায়েগ্রা যাতে শুকিয়ে না যায়, সেজন্য অবশ্য দুই দেশের সরকার আগেই চুক্তি করে রেখেছে, জলবিদ্যুতের জন্য কেউই নির্দিষ্ট পরিমাণ জলের বেশি টানতে পারবে না।
কল্লোল ও কাজল জানাল যে নায়েগ্রা জলপ্রপাতের একেবারে তলা পর্যন্ত নৌকোয় যাওয়ার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এখন শীত পড়ে যাওয়ায় সেই নৌকো সার্ভিস বন্ধ আছে। আর কিছুদিন পরে এই জলপ্রপাতটিই বরফে জমে যাবে প্রায় সবটা। এখন আর একরকমভাবে খুব কাছাকাছি গিয়ে দেখা যায়। সেখানে আমার যাওয়া উচিত।
ওরা দুই ভাই আমার জন্য অনেক স্বার্থত্যাগ করেছে, কিন্তু সেই পর্যন্ত আর কেউ সঙ্গে যেতে রাজি হল না। ওরা আমাকে ব্যবস্থাটা বুঝিয়ে দিয়ে ওপরে অপেক্ষা করতে লাগল।
পাথর কেটে বিরাট সুড়ঙ্গ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সেখানে নামতে হয় লিফটে। তারপর ভাড়া করা ওয়াটার প্রুফ ও জুতো পরে যেতে হয় এক ল্যাবিরিনথের মধ্য দিয়ে। এখানেই সাহেব জাতির কারিকুরি। অত বড় সাংঘাতিক এক জলপ্রপাতের একেবারে মাঝখানে নিয়ে যায় দর্শকদের। হাত বাড়ালেই জল ছোঁয়া যায়। অবশ্য জল ছুঁতে গেলে আর রক্ষে নেই, প্রচণ্ড ঝাঁপটে টেনে নিয়ে যাবে কিংবা হাত ভেঙে দেবে।
এখানে সঙ্গী হিসেবে এক বাঙালি দম্পতিকে পেয়ে আমার বেশ সুবিধেই হল। বেশ বাংলায় গল্প করতে-করতে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে দেখা গেল বিভিন্ন সুড়ঙ্গ থেকে বিভিন্ন রকমের এই বিশাল ব্যাপারটি। ওপরে উঠে আসবার পর আমাদের খুশি করবার জন্যই যেন কুয়াশা কেটে গিয়ে বেরিয়ে এল রামধনু। বেশ ছবি-টবিও তোলা হল।
ফেরার পথে কল্লোল হঠাৎ জিগ্যেস করল, নীলু, তুমি এবারে পুজো সংখ্যাগুলো পড়েছ; তোমার সঙ্গে কিছু আছে?
আমি বললুম, না, আমি তো চার পাঁচ মাস ধরে ঘোরাঘুরি করছি। এ বছরই প্রথম একটাও বাংলা পুজো সংখ্যা চোখে দেখিনি।
কল্লোল বলল, জানো, আমি যখন প্রথম এদেশে প্লেন থেকে নামি, আমার হাতে ছিল দু তিনটে মোটা-মোটা পুজো সংখ্যা। বেরুবার সঙ্গে-সঙ্গে পুজো সংখ্যা না পড়লে আমার ভাত হজম হত না। তারপর প্রথম কয়েক বছর দেশ থেকে পুজো সংখ্যা আনাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতুম। এখন…সব কিছু বদলে গেছে…বছরের পর বছর কেটে যায়, একটাও পুজো সংখ্যা চোখে দেখি না! মানুষ এভাবেও বদলে যায়।