[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

৩৪. ওয়াশিংটন ডি সি বাস স্টেশনে পৌঁছতেই

রাত সাড়ে ন’টা আন্দাজ ওয়াশিংটন ডি সি বাস স্টেশনে পৌঁছতেই পরিচিত, সুদর্শন, দীর্ঘকায় মানুষটিকে দেখতে পেলুম। ভারী একটা ওভারকোট পরা, ফরসা গায়ের রং, মাথায় একটা টুপি থাকলেই সাহেব মনে হত। বাঁ হাতে বড় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ইনি রমেন পাইন, কলকাতার টিভি দর্শকদের নিশ্চয়ই মনে আছে এঁর কথা।

রমেনদা তাঁর সুস্থ হাতটি দিয়ে আমার সুটকেসটি তুলে নিতে যাচ্ছিলেন, আমি বললুম, আরে, ছাড়ুন, ছাড়ুন। আপনার হাতে কী হল? অতবড় ব্যান্ডেজ?

রমেনদা নির্লিপ্তভাবে বললেন, এই একটু পড়ে গিয়ে ফ্রাকচার হয়েছে। এমন কিছুনা।

–আপনি এক হাতে গাড়ি চালাবেন নাকি?

–কেন, তুমি ভয় পাচ্ছ?

আমি হেসে বললুম, না। আমার ভয় পাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। কারণ, আমি জেনে গেছি, গাড়ির অ্যাক্সিডেন্টে আমার মৃত্যু নেই। আমি ভাবছিলুম আপনার অসুবিধের কথা।

বাইরে ছিপছিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সুচ ফোঁটানো ঠান্ডা বাতাস। আমার হাত জমে আসছে, এবারে এক জোড়া গ্লাভস আর না কিনলেই নয়।

রাস্তা পেরিয়ে এসে একটু দূরে পার্ক করা লাল রঙের গাড়িটায় উঠে বসলুম। সিনেমার স্টান্টম্যানদের কায়দায় রমেনদা হুস করে দারুণ স্পিডে গাড়ি চালিয়ে দিলেন।

ওয়াশিংটন ডি সি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী হলেও জায়গাটি ছোট। এখানে যারা কাজ করে, তারা অনেকেই থাকে এর বাইরে। রমেনদা থাকেন ভার্জিনিয়ায়। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা বাইরের শীত থেকে রমেনদার অ্যাপার্টমেন্টের উষ্ণতায় পৌঁছে গেলুম। এই উষ্ণতা শুধু আবহাওয়ার নয়, আন্তরিকতারও।

অনেকদিন বাদে আমি বেশ একটা বাড়ি-বাড়ি পরিবেশ পেলুম। এর আগে যেসব বাঙালি পরিবারে গেছি, প্রায় সব জায়গাতেই স্বামী-স্ত্রীর সংসার ও একটি বাচ্চা, বড় জোর দুটি। তারা সন্ধে একটু গাঢ় হলেই শুতে চলে যায়, তারপর থেকে বাড়ি একেবারে চুপচাপ। রমেনদার দুটি মেয়েই বেশ বড় হয়েছে, ওদের ছেলেটিও অনেক রাত জাগে, সবাই মিলে এক সঙ্গে বসে আড্ডা দেওয়া যায়। ওঁদের ছেলে রঞ্জন অবশ্য একটাও কথা বলে না, সে শুধু দেখে, আর মজার কথা

শুনলে হাসে।

জুলি বউদির বোধহয় দুটি নয়, আটখানা হাত। একই সঙ্গে তিনি রান্না করছেন, জামাকাপড় কাচছেন, বিছানা পাতছেন, চা-কফি বানাচ্ছেন, ছেলেকে খাবার দিচ্ছেন, আমাদের জন্য বাদাম ও বরফ এনে দিচ্ছেন, অথচ এইসব কাজ করতে-করতেও আমাদের সঙ্গে বসে হাসিমুখে গল্পও করছেন। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। জুলি বউদির আরও নানান গুণপনার পরিচয় আমি আস্তে-আস্তে পেতে থাকি।

রমেনদা-জুলি বউদি এখানে সাত-আট বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। কলকাতাতেই থাকবেন ভেবেছিলেন, আমেরিকায় আর ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। টানা চার বছর কলকাতায় ছিলেন চাকরি জীবনের নানান দলাদলির সঙ্গে যুদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত আবার এদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। সে যাই হোক, কৈশোরের শেষ দিকটায় চার বছর কলকাতায় কাটানো ও পড়াশুনো করার ফলে ওঁদের দুই মেয়ে বাংলা তো শিখেছে বটেই, বাঙালি হিসেবে আত্মমর্যাদাবোধও এসেছে। আবার শৈশব ও যৌবনে আমেরিকায় এসেছে বলে ওরা অনেক ব্যাপারে স্বাবলম্বী ও জড়তাহীন। অর্থাৎ দু-দেশেরই গুণ বর্তেছে ওদের মধ্যে। মেয়ে দুটির নাম মুনু আর মোম।

আমরা পৌঁছনোর পরই রমেনদা পোশাক পালটে পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে ফেললেন। তারপর বললেন, বুঝলে নীললোহিত, তুমি আসবে বলে আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ফেলেছি। কদিন আর কোথাও বেরুব না, শুধু আড্ডা হবে।

প্রথম রাতে আড্ডা চলল প্রায় রাত দুটো পর্যন্ত। পরদিন আমরা চা খেলুম সকাল দশটায়। তারপর আবার আড্ডা। রমেনদা আগে থেকেই যে কত রকম খাদ্য পানীয় এনে জমিয়ে রেখেছেন, তার ঠিক নেই। মুনু আর মোম কলেজে পড়ে আবার চাকরিও করে, সারাদিন ধরেই তারা ব্যস্ত। কেউ ভোরে বেরিয়ে যাচ্ছে দুপুরে ফিরছে, কেউ দুপুরে বেরুচ্ছে, অন্য জন বেরুবার পর আর একজন ফিরছে, এই রকম চলতে থাকে রাত পর্যন্ত। এবাড়ির দুটি গাড়ির মধ্যে কে কোনটা নিয়ে কখন যাচ্ছে, তার হিসেব রাখতে হয় জুলি বউদিকে। কারণ, টুকিটাকি জিনিসপত্র কেনার জন্য তাঁকে প্রায়ই গাড়ি নিয়ে বেরুতে হয়।

রমেনদার মেজাজটা অনেকটা জমিদার ধরনের। যখন ছুটি নিয়েছেন, তখন আর বাড়ি থেকে বেরুবার কোনও মানে হয় না। বসবার ঘরে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবেন আর বারবার চা, কফি ও অন্যান্য জিনিসের হুকুম করবেন। আজকালকার স্বামীরা অবশ্য বউদের হুকুম করার সাহস পায় না, বউদের ভুরু তোলা কিংবা ঝাঁজালো কথা শোনার ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকাই বিংশ শতাব্দীর বাঙালি যুবকদের নিয়তি। অবশ্য বাড়িতে কুমারী কন্যা থাকলে স্নেহময় পিতার পক্ষে তাদের যেকোনও হুকুম করা যায়, মেয়েরা সাধারণত বাবার খুব বাধ্য হয়।

রমেনদা কিন্তু অকুতোভয়। তাঁর দুটি বড়-বড় মেয়ে থাকলেও তিনি মেয়েদেরও হুকুম করেন, বউকেও হুকুম করেন। জুলি বউদি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, দেখেছো, দেখেছ ও নিজে কোনও কাজই করবে না। সব সময় হুকুম! আমার যদিও ধারণা হয় যে, জুলি বউদি স্বামীকে দিয়ে কোনও কাজ করাতে ভরসাও পান না। ওর বদ্ধমূল বিশ্বাস যে, রমেনদা নিজের হাতে এক গেলাস জল গড়াতে গেলেও হয় মেঝেতে জল ফেলে কার্পেট ভেজাবেন অথবা গেলাসটা ভাঙবেন।

এডমন্টনে দীপকদা বলেছিলেন, আমাদের দেশের লোকদের সবচেয়ে সুখ কীসে জানো? খাবার পরে থালাটা রেখে উঠে যেতে পারে। আর এই দেশে আমাদের খাওয়ার পরে লঙ্গরখানার ভিখিরির মতন এঁটো থালাখানা হাতে নিয়ে উঠে যেতে হয়, তক্ষুনি গিয়ে থালাবাসন মাজতে হয়।

সত্যি কথা, এদেশে, সব জায়গাতেই ওই এক নিয়ম দেখেছি। এমনকী নিমন্ত্রিত অতিথিদেরও নিজের থালা ধুয়ে দেওয়াই প্রথা। একমাত্র রমেনদাকেই দেখলুম এ ব্যাপারে তোয়াক্কা করেন না। খাওয়ার পর বেমালুম এঁটো থালা টেবিলে রেখে উঠে যান। একবার রমেনদাকে এ ব্যাপারটা উল্লেখ করায় রমেনদা বললেন, আরে যাও, যাও ওসব থালাবাসন মাজায় আমি বিশ্বাস করি না। আমেরিকায় এসেছি বলে কি মাথাটাও বিকিয়ে দিয়েছি নাকি?

ওঁর দুই মেয়ে এই কথা শুনে খলখলিয়ে হাসে। মেয়েরা এই ব্যাপারে বাবাকে সস্নেহ প্রশ্রয় দেয়।

দু-দিন টানা আড্ডা মারার পর আমি একটু উসখুস করতে লাগলাম। আড্ডার চেয়ে প্রিয় জিনিস আমারও কিছু নেই। বাছা-বাছা দ্রষ্টব্য স্থানগুলো আমায় দেখতেই হবে, এরকমও কোনও ঝোঁক আমার নেই। অনেক কিছুই তো ছবিতে দেখা যায়। নতুন কোথাও এসে সেই জায়গাটা অনুভব করাই আসল ব্যাপার। কিন্তু স্মিথসনিয়ান ইনস্টিটিউট? সেখানে একবার না গেলে যে মনে ক্ষোভ থেকে যাবে!

একবার মিনমিন করে এই প্রসঙ্গ তুলতেই রমেনদা উদারভাবে বললেন, হবে, হবে! অত ব্যস্ততা কীসের?

জুলি বউদি রান্নাঘর থেকে বললেন, ওর কথা শুনলে তোমার আর কোনওদিনই যাওয়া হবে। না, নীলু। আমি বরং নিয়ে যাব তোমাকে।

পরদিন সকাল দশটায় জুলি বউদি আমায় স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের স্পেস মিউজিয়ামের দরজায় ছেড়ে দিয়ে বললেন, তুমি ঘুরে-ঘুরে দ্যাখো, তোমায় আমি আবার বিকেল ছ’টার সময় তুলে নিয়ে যাব এখান থেকে।

স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউট শুধু একটা বাড়িতে আবদ্ধ নয়, বিশাল একটি পাড়া জুড়ে এই ব্যাপার। একটি মাত্র হিসেব দিলে এই এলাহি কারবারের কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। এখানে যতগুলি দেখবার জিনিস আছে, তার প্রত্যেকটির সামনে যদি মাত্র এক মিনিট করে দাঁড়ানো যায়, তাহলেই সময় লাগবে আড়াই বছর!

সুতরাং কারুর পক্ষেই পুরোটা দেখা সম্ভব নয়। যার যাতে আগ্রহ, সে শুধু সেই অংশটুকু দেখে। তার মধ্যে স্পেস মিউজিয়াম অবশ্য দ্রষ্টব্য। আকাশ ও মহাকাশ বিষয়ে এমন বিপুল সম্ভার পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। এখানে সবই গোটা-গোটা ব্যাপার। চার্লস লিন্ডবার্গ যে প্লেনটি চেপে প্রথম আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলেন, সেটা অটুট অবস্থায় রয়েছে এখানে। যেসব রকেট মহাশূন্য থেকে ফিরে এসেছে, সেরকম কয়েকটি রাখা আছে। এগুলো দেখলেই রোমাঞ্চ লাগে। নীল আর্মস্ট্রং যে যানটি চেপে চাঁদে নেমেছিলেন, দেখলুম সেটাও। শুধু এই প্রদর্শনী ভবনটিই যে কত বিরাট, তা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। মানুষের আকাশে ওড়ার প্রথম চেষ্টা থেকে আধুনিকতম আবিষ্কার পর্যন্ত দেখানো হয়েছে স্তরে-স্তরে। কোথাও রয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এক-একটি দৃশ্যের মডেল। আমরা অবশ্য প্রদর্শনীর মডেল বলতেই

ভাবি কৃষ্ণনগরের ছোট-ছোট পুতুল। এখানে সবই জীবন-প্রমাণ সাইজের, কোথাও তার চেয়েও বড়।

একটি ফিলমের কথাই বলি। এরকম ফিলম দেখার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আগে হয়নি। এখানে নানান বৈজ্ঞানিক ব্যাপার নিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ার তোলা ফিলম দেখাবার ব্যবস্থা আছে, আমার মাত্র দুটিই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ে টিকিট কেটে লাইন দিয়ে ঢুকলুম। বসবার ব্যবস্থা বেশ উঁচু গ্যালারির মতন। ছবি দেখার পরদা অন্তত ছ’ গুণ বড়। অর্থাৎ একটি হাতি, বা নারকোল গাছ বা ছোট ডাকোটা প্লেনকে দেখা যায় তাদের অবিকল আকারে। একটা বাংলো বাড়ির ছবি ঠিক সেই বাড়িটিরই সমান। প্রথম ফিলমটি হচ্ছে একটি আগেকার দিনের চারটি ডানাওয়ালা, প্রপেলার সমেত বিমানের অ্যাডভেঞ্চার। বিমানটি যখন একটা নির্জন নদীর খাতে ঘুরতে-ঘুরতে পড়ে যাচ্ছিল, তখন আমি আঁতকে উঠে আমার চেয়ারের হাতল শক্ত করে চেপে ধরেছিলুম। যেন আমিই সেই বিমানে বসে আছি। আমিই পড়ে যাচ্ছি। সত্যিকারের বিমান যাত্রায় আমার কখনও এরকম ভয় হয়নি।

আর একটি ছবি পৃথিবীতে জীবনবেচিত্র্য বিষয়ে। এই ছবির নির্মাতার ভারতবর্ষ সম্পর্কে দুর্বলতা আছে, কারণ বারবার ভারতবর্ষের ছবি ফিরে-ফিরে আসছিল আর আমি উৎফুল্ল হচ্ছিলুম। ছবির কলাকৌশলে আমি নিজেই যেন উপস্থিত হচ্ছিলাম ভারতবর্ষের গঙ্গাতীরে।

ওয়াশিংটন ডি সি-তে যিনি বেড়াতে যাবেন তিনি এই ফিলমগুলি না দেখলে এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হবেন।

এর পাশাপাশি আছে মুদ্রার বিবর্তনের প্রদর্শনী, অস্ত্রের বিবর্তন, প্রাণীতত্ব, ভূতত্ব, ভাস্কর্য, চিত্রকলা ইত্যাদি। আমি দুদিনে শুধু ওই আকাশযান ও অভিব্যক্তিমূলক চিত্রকলার প্রদর্শনী দেখে উঠতে পেরেছি।

স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটউটের পুরো পাড়াটা বাইরে থেকে ঘুরে দেখতেও ভালো লাগে। মনে হয় যেন প্রাচীন রোমের কোনও অভিজাত এলাকায় এসে পড়েছি, বাড়িগুলি এই রকম। এদের অনেক টাকা, পৃথিবীর যে-কোনও প্রান্ত থেকে দুর্লভতম শিল্প সামগ্রী সংগ্রহ করতে এরা সদা উৎসাহী।

এ সম্পর্কে একটি কাহিনি আছে। একবার এই সংস্থার কর্তৃপক্ষ আগাগোড়া সোনা দিয়ে একটি মূর্তি গড়িয়ে রাখার সংকল্প করলেন। সেইজন্য তাঁরা আমেরিকার সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্করের কাছে জানতে চাইলেন, তাঁর ইচ্ছে মতন পারিশ্রমিক পেলে তিনি খাঁটি সোনার কোনও ভাস্কর্য গড়তে পারবেন কি না। ভাস্করটি উত্তর দিয়েছিলেন, কেন পারব না, নিশ্চয়ই পারব। তবে তৈরি করার পর আমি মূর্তিটি কালোরং করে দেব।

প্রথম দিন জুলি বউদি এলেন আমাকে তুলে নিতে। বাড়ি ফেরার পথে জুলি বউদি বললেন, একটু মাছ কিনতে হবে, তুমি যাবে আমার সঙ্গে মাছের দোকানে?

ভাগ্যিস রাজি হয়েছিলুম, তাই আর একটা নতুন জিনিস দেখা হয়ে গেল। অবশ্য বাজারে যেতে আমার সব সময়ই ভালো লাগে।

এ দেশের সব গ্রসারি স্টোরেই মাছ পাওয়া যায়। নানা রকমের মাছ, কুচো মাছ, কাটা মাছ, বড়-বড় আস্ত মাছ, আধ সেদ্ধ মাছ, কিন্তু সবই ফ্রোজেন। বরফে জমিয়ে কাঠ। বাড়িতে এনে সেগুলো অনেকক্ষণ ধরে থ করার পর রাঁধতে হয়।

কিন্তু জুলি বউদি আমায় নিয়ে এলেন টাটকা মাছের বাজারে। এ-এক অপূর্ব বাজার, এখানে প্রত্যেকটি দোকানই ভাসমান। বন্দরের জেটির চার পাশ ঘিরে রয়েছে অনেকগুলো লঞ্চ। সেই সব লঞ্চের বারান্দা কিংবা সামনে পেতে রাখা পাটাতনেই বিক্রি হচ্ছে মাছ। খুব ছেলেবেলায় দেখা পদ্মার বুকে ইলিশ মাছের নৌকোগুলোর কথা মনে পড়ল। এখানেও এক-এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এক-একটা ছোঁকরা হাঁকাহাঁকি করছে, এদিকে আসুন, এদিকে, ভালো মাছ, টাটকা মাছ!

মাছ অনেক রকম, ভেটকির মতন, কাতলার মতন, পার্শের মতন, বান মাছের মতন, আড় মাছের মতন। সবই কিন্তু মতন, আসল নয়, এগুলো সামুদ্রিক মাছ। আরও নানা রকম অদ্ভুত চেহারায় মাছ, যার সঙ্গে আমাদের চেনা কোনও মাছই মেলে না। সামুদ্রিক জীবজন্তুও বিক্রি হচ্ছে মনে হয়। একমাত্র চিংড়িটাই আসল। তবে বাগদা বা গলদা নয়, কলকাতার বাজারে যাকে বলে চাবড়া চিংড়ি, সেইগুলোই রয়েছে। অর্থাৎ সাদা রঙের চিংড়ি।

জুলি বউদি অনেক চিংড়ি কিনলেন। এক দোকানে বেশ বড়-বড় কাঁকড়া রয়েছে, তা দেখে জুলি বউদির চোখ চকচক করে উঠল। আমায় জিগ্যেস করলেন, তুমি কাঁকড়া খাও, নীলু?

আমি হুতোমের অনুকরণে উত্তর দিলুম, জলচরের মধ্যে নৌকো, খেচরের মধ্যে ঘুড়ি আর চতুষ্পদের মধ্যে খাট ছাড়া আমি সবই খাই!

জুলি বউদি মুখ ম্লান করে বললেন, আমিও কাঁকড়া খুব ভালোবাসি, আমার ছেলেমেয়েরাও ভালোবাসে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে কী জানো, তোমার রমেনদা নিজে তো কাঁকড়া খায়ই না, বাড়িতে রান্না হলেও সে গন্ধ সহ্য করতে পারে না।

একই চিন্তা করে জুলি বউদি আবার বললেন, এক কাজ করলে হয়। কাঁকড়া নিয়ে তো যাই। ও বাথরুমে ঢুকলে রান্না করে ফেলব। ও বাথরুমে ঢুকলে অন্তত এক ঘন্টা লাগে, তার মধ্যে রান্না হয়ে যাবে। তারপর…তারপরও ও যদি এবার বাড়ি থেকে বেরোয়, তখন আমরা চট করে খেয়ে নেব। কী বলো? ঘরে রুম ফ্রেশনার ছড়িয়ে দেব, তাহলে ও আর গন্ধ পাবে না।

সেই রকমই হল। কাঁকড়া কিনে নিয়ে যাওয়া হল, রমেনদা স্নান করতে ঢুকলে রান্নাও সেরে ফেলা হল। কিন্তু খাওয়া হবে কী করে? রমেনদার অফিস ছুটি, ওঁর তো বাড়ি থেকে বেরুবার কোনও প্রয়োজনও নেই, ইচ্ছেও নেই। জুলি বউদি মাঝে-মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছেন, মেয়েরা মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি করছে, কিন্তু রমেনদার বাইরে বেরুবার কোনও লক্ষণই নেই।

জুলি বউদি একবার জিগ্যেস করলেন, তুমি ড্রিংকস বা সিগারেট কিনতে যাবে না?

রমেনদা গম্ভীরভাবে বললেন, আমার সব স্টক আছে।

ঘন্টাখানেক বাদে একটা টেলিফোন এল। ওঁদের এক মেয়ে ফোন করছে ইউনিভার্সিটি থেকে। তার গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে। এখন সে কী করবে?

রমেনদা দারুণ বিরক্ত হয়ে উঠলেন। এখন তাঁকে যেতেই হবে। তিনি না গেলে গাড়ি সারাবার কোনও ব্যবস্থা করা যাবে না।

রমেনদা বললেন, এই জন্যই আমি আমেরিকান গাড়িগুলো একদম পছন্দ করি না। এর চেয়ে আমাদের দেশের অ্যামবাসেডর গাড়ি কত ভালো! পানের দোকানেও পার্টস পাওয়া যায়, যে কেউ সারিয়ে দিতে পারে। এখানে গাড়ি খারাপ হলেই খরচের রাম ধাক্কা।

অন্য গাড়িটা নিয়ে রমেনদা বেরিয়ে গেলেন। আমরা অমনি তাড়াতাড়ি কচর মচর করে কাঁকড়া খেয়ে নিলুম। যে মেয়েটি আত্মত্যাগ করল, তার জন্য কিছুটা রেখে দেওয়া হল আলাদা করে। সে পরের দিন কোনও এক সুযোগে খেয়ে নেবে। রমেনদা ফেরার আগেই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলা হল সব কিছু।

রমেনদা ফিরলেন অনেকটা প্রসন্ন মুখে। গাড়িটার বিশেষ কিছু হয়নি, স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শুধু, আবার ঠিক হয়ে গেছে।

এবার আমায় অফিসিয়ালি খেতে বসতে হল রমেনদার সঙ্গে। কিন্তু আমি আর খাব কী করে, পেটে আর জায়গা নেই। খাবারগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছি শুধু।

রমেনদা মুখ তুলে বললেন, কী যে আজে-বাজে রান্না করো, ও বেচারি খেতেই পারছে না। ভালো কিছু করতে পারো না? এখানে ভালো কাঁকড়া পাওয়া যায়, কাল কাঁকড়া এনে নীললোহিতকে খাইয়ো!

রমেনদা এবার জুলি বউদির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।