[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

২৯. ইংল্যান্ডের নিসর্গদৃশ্য

ইংল্যান্ডের নিসর্গদৃশ্য সম্পর্কে সেখানকার কবি ও শিল্পীরা বরাবরই উচ্ছ্বসিত। রোমান্টিক প্রকৃতি বর্ণনা ইংরেজি কবিতায় যেমন সুন্দর আছে, অন্য ভাষায় তার তুলনা পাওয়া ভার। সেই জন্যই বোধহয় ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে এই নতুন দেশে এসে যখন আস্তে-আস্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন ম্যানহাটান দ্বীপ ছাড়িয়ে তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি দেখে হয়তো তারা মুগ্ধ ও চমকিত হয়েছিল। সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছিল নিজের দেশের। সেই জন্যই তারা এই এলাকার নাম রাখে নিউ ইংল্যান্ড। ম্যাসাচুসেটস, রোড আয়ল্যান্ড, কানেটিকাট ইত্যাদি জায়গা এই নিউ ইংল্যান্ডের মধ্যে পড়ে।

সত্যি বড় অপূর্ব এখানকার প্রকৃতি। নিউ ইয়র্ক শহর থেকে ট্রেনে চেপে খানিকটা দূরে গেলেই দুপাশের দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। খুব যে আহামরি সাংঘাতিক কিছু দ্রষ্টব্য ব্যাপার আছে তা নয়, ছোট-ছোট টিলা, হালকা-হালকা গাছ আর খুদে-খুদে নদী। সৌন্দর্য এটাই যে প্রকৃতিকে এখানে অবিঘ্নিত রাখা হয়েছে, গাছপালাগুলোকে হেঁটে-হেঁটে সাজানো হয়নি, নদীগুলো চলেছে আপন মনে। ঝোঁপঝাড়ে ফুটে আছে অজস্র ফুল। তাদের নামও বেশ মজার, বাটারকাপ, ইন্ডিয়ান পেইন্ট ব্রাশ, লেডিজ শ্লিপার, কুইন অ্যানিজ লেস, মারিপোসা লিলি, নিউ ইংল্যান্ড অ্যাস্টর। তাদের কতরকম রং।

একদিন এরকম একটা পথ দিয়ে গাড়িতে যেতে-যেতে আমাকে নদীর ধারের একটা জায়গা আঙুল তুলে দেখিয়ে একজন বলেছিলেন, ওই গাছতলায় আমার এক বান্ধবীর বিয়ে হল কিছুদিন আগে।

আমি জিগ্যেস করলুম, গাছতলায় বিয়ে?

তিনি বললেন, হ্যাঁ। খুব চমঙ্কার বিয়ে। পাত্র আর পাত্রী ছাড়া আরও আমরা দশ-বারোজন এসেছিলুম সকালবেলা। নদীর ধারে গাছের ছায়ায় বসে প্রথমে ছেলেটি আর মেয়েটি পরস্পরকে উদ্দেশ্য করে একটা করে কবিতা পড়ল। তারপর বরযাত্রী আর কন্যযাত্রীদের প্রত্যেককেই পড়তে হল নিজেদের পছন্দমতো একটা করে কবিতা। ব্যস, হয়ে গেল বিয়ে।

আমি আকুল, সতৃষ্ণ নয়নে অনেকক্ষণ সেই ছোট্ট নদীর ধারে ছায়াময় জায়গাটির দিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়েছিলুম অনেকক্ষণ।

সেই রকমই একটা নিরিবিলি ছিমছাম, সুশ্রী জায়গার নাম স্কারসডেল। এখানে থাকেন ডঃ অম্বুজ মুখোপাধ্যায় এবং স্নিগ্ধা মুখোপাধ্যায়। অম্বুজ মুখোপাধ্যায় ভারতের বাইরে এসেছিলেন প্রথম যৌবনে, এখন তিনি প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পৌঁছে গেছেন। তিনি অধ্যাপক এবং শান্ত ধরনের মানুষ, চাকরির সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়টুকু বাড়িতে বসে শুধু বই পড়েন। কতরকম বই আর পত্রপত্রিকা, তার মধ্যে ‘দেশ’ এবং অনেক বাংলা বইও আছে। স্নিগ্ধা দেবী তাঁর জীবনের যেক’টা বছর স্বদেশে কাটিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি বছর কেটে গেল বিদেশে। কিন্তু কলকাতার বনেদি বাড়ির মহিলাদের মুখে যে একটা বিশেষ ছাপ থাকে, সে ছাপ তাঁর মুখে এখনও অক্ষুণ্ণ আছে। রূপও ফেটে পড়ছে এখনও।

এঁদের দুই ছেলেমেয়ে হস্টেলে থেকে পড়াশুনো করে। স্নিগ্ধা দেবীও সকালবেলা কয়েক ঘণ্টার জন্য একটা চাকরি করতে যান, ফিরে এসে শিল্পীর মতন যত্ন করে নানারকম রান্নাবাড়া করেন। শুধু নিজেদের জন্য নয়, এঁদের বাড়িতে প্রায়ই অতিথি আসে। এঁরা দু-তিন বছর অন্তর নিয়ম করে একবার দেশে যান।

এইসব বাড়িতে এলে মনে হয়, আমেরিকা আসলে খুব একটা কিছু দূরের দেশ নয়। এক সময় বাঙালিবাবুরা পশ্চিমে চাকরি করতে যেত, পশ্চিম মানে লাহোর, দেরাদুন, মীরাট এই ধরনের জায়গা। তখন সেই সব জায়গাই ছিল বহু দূরে। দু-তিন বছর অন্তর তাঁরাও বাংলাদেশে আসতেন ছুটি নিয়ে, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। সঙ্গে আনতেন প্রচুর রোমাঞ্চকর গল্প, মেওয়া-খোবানি জাতীয় নতুন ধরনের খাদ্য আর স্থানীয় রংচঙে পোশাক।

এখন মস্কো-নিউইয়র্ক-টরোন্টো হয়েছে সেই লাহোর, দেরাদুন, মীরাট।

অম্বুজবাবু ও স্নিগ্ধা দেবীকে পূর্ব উপকূলের বাঙালিরা প্রায় সকলেই চেনে। শুধু বাঙালি কেন, অনেক ভারতীয়রাও, কারণ প্রধানত এঁদেরই উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে ‘টেগোর সোসাইটি’। এই টেগোর সোসাইটির নানান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বাঙালি-অবাঙালি অনেকেই।

উত্তমকুমার এসে উঠেছিলেন এই বাড়িতে। তা ছাড়া হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, সুবিনয় রায় প্রমুখ আরও সব অনেক নামকরা মানুষ এবাড়িতে এসে থেকেছেন কিংবা অনুষ্ঠান করে গেছেন। কী একটা সূত্রে যেন সুনীলদা আর স্বাতীদি এখানে অতিথি। সেইজন্য আমারও নেমন্তন্ন হল।

সেইখানে খেলুম ইলিশ মাছ। ইলিশের মতন ইলিশ বটে। কলকাতার বাজারে মাঝে মাঝে এক রকম ইলিশ পাওয়া যায়, তাকে বলে খোকা ইলিশ। সেই অনুযায়ী ওই ইলিশকে বলা যায় মহারাজ ইলিশ। এক একটির ওজন আট-দশ পাউন্ড, চেহারাও অপূর্ব। এই মাছের স্থানীয় নাম শ্যাড। কিন্তু ইলিশ বলে চিনতে আমাদের কোনও অসুবিধেই হওয়ার কথা নয়। স্বাদ-গন্ধ সবই ঠিকঠাক। নিমন্ত্রিতরা সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। কিন্তু আমার মতন কাঠ-বাঙাল অত চট করে ইলিশকে সার্টিফিকেট দিতে পারে না। স্নিগ্ধা দেবীর রান্না অতি চমৎকার, আর সবই ঠিকঠাক আছে, কিন্তু মাছটা কেমন যেন একটু তুলতুলে ধরনের। পেটির মাছে সেই তৈলাক্ত তেজি ভাবটা যেন নেই।

এই বাড়িতেই আলাপ হল দুজনের সঙ্গে। একটি মেয়ের নাম প্রীতি, সে আমাদের যাদবপুরের চন্দন সেনগুপ্ত নামে এক সুদর্শন ও মেধাবী যুবকের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ। চন্দনকে বেশি দেখা যায় না, সে খুবই লাজুক, তা ছাড়া নিজের কাজকর্মে খুব ব্যস্ত, সারাদিন অফিস করবার পর সন্ধের সময় সে আবার এক স্কুলে পিয়ানো শিখতে যায়। প্রীতি আগে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করত, এখন ছেড়ে দিয়েছে, তাই তার হাতে এখন অনেক সময়। প্রীতি আমাদের বন্ধু, ‘দার্শনিক ও পথপ্রদর্শিকা’ হয়ে পরে অনেক দ্রষ্টব্য স্থান নিয়ে গেছে।

প্রতি মেয়েটি গুজরাটি। চন্দনের সঙ্গে নিউইয়র্কেই তার পরিচয়। কলকাতায় না এসেই সে তার স্বামীর ভাষা বাংলা পড়তে, লিখতে এবং বলতে শিখে নিয়েছে। আমি অবশ্য আগেও অনেক জায়গায় দেখেছি যে গুজরাটি নারীপুরুষরা অনেকেই বেশ চট করে বাংলা শিখে নিতে পারেন। এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা মনে পড়ে গেল। বোম্বাইতে নলিনী মাডগাঁওকর নামে একজন কবি এবং অধ্যাপিকা বাংলা বলতে পারেন তো খুব ভালোই, লেখেনও চমৎকার। এই নলিনী গুজরাটের মেয়ে, এঁর স্বামী বলবন্ত মহারাষ্ট্রীয়। এই বলবন্ত-এর কৃতিত্ব আরও বেশি। ইনি কখনও একটানা কলকাতায় থাকেননি, শান্তিনিকেতন একবার দেখতে গিয়েছেন মাত্র, তবে নিজের শখে ইনি রবীন্দ্রসঙ্গীত এতই ভালো শিখেছেন যে বোম্বাইতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্লাস নেন। বলাই বাহুল্য এঁর ক্লাসের অনেক ছাত্রছাত্রীই বাঙালি। নতুন গান শেখাবার আগে বলবন্ত যখন ছাত্রছাত্রীদের সেই গানটা লিখে নেওয়ার জন্য ডিকটেট করেন, তখন মুশকিল হয় এই যে, অনেক বাঙালি ছাত্রছাত্রীই বাংলা অক্ষর লিখতে পারে না। তারা বলে, স্যার, গানের কথাগুলো আমাদের রোমান স্ক্রিপ্টে লিখিয়ে দিন।

প্রীতি বাংলা শিখেছে নিছক নিজের শখে, কেননা সে ইচ্ছে করলেই তার স্বামীর সঙ্গে ইংরেজিতে কথাবার্তা চালিয়ে দিতে পারত। তা ছাড়া সে কবিতা ভালোবাসে, গান ভালোবাসে, ছবি ভালোবাসে। সে কখনও শাড়ি পরে, কখনও স্কার্ট, কখনও বা গুজরাটি বা রাজস্থানি পোশাক, কিন্তু কখনও তার পোশাক বেশি জমকালো নয়, বরং তাতে সূক্ষ্ম রুচি মিশে থাকে।

সবচেয়ে আশ্চর্য হল তার ভ্রমণের নেশা। প্রীতি এক সময় ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করত, তখন কম দামে কিংবা বিনা দামে টিকিট পাওয়ার সুযোগ ছিল। এখন সে সুযোগ নেই, তবু তার সেই নেশা রয়ে গেছে। আমরা ভারতবর্ষে বসে ভাবি টোকিও, পিকিং বা কায়রো কত দূরে। কিন্তু নিউ ইয়র্কে এলে মনে হয় সারা পৃথিবীটাই খুব কাছে। এখানকার ছেলেমেয়েদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়, এই তো গত মাসে চিনে গিয়েছিলুম, পরশুই আবার ভিয়েনা যেতে হবে, সেখান থেকে ফিরেই আবার ভেনেজুয়েলায়…। প্রীতি বেড়াতে যায় বিনা উদ্দেশ্যে। তার স্বামীকে যখন অফিসের কাজে কোথাও যেতে হয়, তখন একা একা নিউ ইয়র্কে থাকতে ভালো লাগে না প্রীতির, সে-ও বেরিয়ে পড়ে পৃথিবীর পথে। ইজিপ্ট কিংবা মেক্সিকো কিংবা চিনে সে অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে একলা ঘুরে আসে। তবে এত দেশ ঘুরেও প্রতি দারুণ ভালোবাসে নিউ ইয়র্ক শহরটিকে। এরকম প্রাণবন্ত শহর নাকি আর একটাও নেই। এ বিষয়ে আমি ঠিক মতামত দিতে পারি না, কেন না আমি আর এ পৃথিবীর কতটুকু দেখেছি।

আমাদের সঙ্গে ডাউন টাউন বেড়াতে এসে ট্রেন থেকে নেমেই প্রীতি একটা বড় গোল বোতাম কিনে নেয়, তাতে লেখা, ‘আই লাভ নিউ ইয়র্ক।

আর একজনের নাম কামাল। তার পুরো নাম মুস্তাফা কামাল ওয়াহিদ, কিন্তু সবাই তাকে কামাল বলেই চেনে, এমনকী তাকে শুধু ‘কে’ বলে ডাকলেই নাকি চলে। কামাল হচ্ছে সেই ধরনের মানুষ, যার সঙ্গে যে-কারুর মাত্র পাঁচ মিনিট আলাপেই ভাব জমে যায়।

প্রথম আলাপে সাধারণত আমরা সৌজন্যবশত নমস্কার বলে চুপ করে থাকি। এর পর কে কথা শুরু করবে, তাই নিয়ে খানিকক্ষণ দ্বিধা চলে। কিন্তু কামাল ওই সব অযথা আদবকায়দার ধার ধারে না, প্রথম আলাপের সঙ্গে-সঙ্গেই সে আগ্রহী হয়ে পড়ে, সেই মানুষটির কাজকর্ম বিষয়ে জানতে চায়, এবং বিদেশে তার কোনও রকম সাহায্যের দরকার আছে কি না, তাই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। পরোপকার করাটা যেন তার ডাল-ভাত খাওয়ার মতন জীবনযাপনের একটা অতি স্বাভাবিক অঙ্গ।

কামাল চাকুরিজীবী নয়, সে ব্যাবসা করে। সে কীসের ব্যাবসা করে জিগ্যেস করলেই টপ করে উত্তর দেবে, আলপিন টু এলিফ্যান্ট যেকোনও কিছুর! এর সরল অর্থ হল, ভারতীয় উপমহাদেশের যেসব জিনিসের চাহিদা আছে আমেরিকায়, সেগুলো সে আনিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করে। যেমন চটের থলে, হ্যান্ডব্যাগ, পাথরের মূর্তি ইত্যাদি। কিন্তু কামালের সঙ্গে কয়েকদিন মেশার পর আমি বুঝতে পেরেছিলুম, খাঁটি ব্যবসায়ী হওয়া ওর দ্বারা কোনওদিন বোধহয় সম্ভব হবে না। কারণ ওর কোনও টাকার লোভই নেই। কিছু একটা করতে হবে, এই জন্য ও এক একদিন এক-একটা কাজের নেশায় ছোটে। কাজটা আসল নয়, ওই ছোটাতেই ওর আনন্দ। কামাল কোনও নেশা-ভাঙ করে না, পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি মনোযোগ নেই, খায়ও অতি সামান্য। মাঝে-মাঝে সে তার ভবিষ্যৎ কোনও ব্যাবসা থেকে লাখ-লাখ কিংবা কোটি-কোটি টাকা লাভের রঙিন স্বপ্ন শোনায়। একদিন আমি জিগ্যেস করেছিলুম, অত টাকা পেলেই বা তুমি তা নিয়ে কী করবে, কামাল? একটু থমকে গিয়ে ও উত্তর দিল, কাজে লেগে যাবে, অনেকের কাজে লেগে যাবে।

লম্বা, সুগঠিত চেহারা কামালের বয়স বছর পঁয়তিরিশেক হবে। আমি তার নাম দিয়েছি গেছোবাবা। কামালও একজন গ্লোব ট্রটার বা বিশ্ব পথিক। আজ নিউ ইয়র্ক, কাল কলকাতা, পরশু ঢাকা, তারপর কাঠমান্ডু, তারপর লন্ডন, তারপর টরেন্টো, তারপর আবার কলকাতা..এইরকম চলে তার বছরে তিন-চারবার। কিন্তু কামাল ঠিক ভ্রমণকারী নয়, সে নতুন দেশ বা প্রকৃতি দেখবার জন্য ঘোরে না। কিংবা এতবার ঘোরাঘুরিতে ওর ওসব আগেই দেখা হয়ে গেছে বলে এখন আর ওসব দিকে তাকায় না। সে ঘুরে বেড়ায় তার স্বপ্নের ব্যাবসার অছিলায়। কোনও একদিন সে এক কোটি টাকা লাভ করবে, যে টাকাটা, ‘অনেকের কাজে লাগবে’।

যে সন্ধেবেলা কামালের সঙ্গে আলাপ, সেদিনই সে ওয়াশিংটন ডি সি থেকে একটানা গাড়ি চালিয়ে এসেছে স্কারসডেলে। আধ ঘণ্টাখানেক গল্প করবার পরই হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বলল, একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়েছে, এক্ষুনি ঘুরে আসছি। চলে গেল চল্লিশ মাইল দূরে। ফিরে আসার পর আমাদের আলোচনায় একটু উঁকি দিয়েই কামাল বুঝল যে আমাদের সিগারেট ফুরিয়ে গেছে, এখানে কোথায় সিগারেট পাওয়া যায়, সেই কথা ভাবছি অমনি আবার বেরিয়ে গেল কামাল, সেই রাত্রে কোথা থেকে যেন নিয়ে এল এক পাহাড় সিগারেট! আমি লক্ষ করলুম, সে পাঁচ মিনিটও এক জায়গায় চুপ করে বসে কথা বলতে পারে না।

খাওয়াদাওয়ার পর সবে আমরা জমিয়ে গল্প করবার জন্য বসেছি, কামাল আবার দপাস করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলি! সকলের প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল যে সে সেই রাত্রেই বস্টন চলে যাবে। সবাই অবাক। স্নিগ্ধা দেবী কামালের রাত্রিবাসের জন্য বিছানার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন পর্যন্ত। কিন্তু কামাল বলল, শুধু-শুধু রাত্তিরটা নষ্ট করে কী লাভ! ভোরের মধ্যে বস্টন পৌঁছে গেলে কাল সকাল থেকেই আবার কাজ করা যাবে!

সত্যি-সত্যি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল কামাল। সারা রাতের যাত্রা। দু-একজন আশঙ্কা প্রকাশ করল, একলা গাড়ি চালাতে-চালাতে ঘুমিয়ে পড়বে না তো! স্নিগ্ধা দেবী বললেন, না, ওর এরকম অভ্যেস আছে। আমারও মনে হল, ঘুমোবে না, চোখ চেয়ে-চেয়েই ও সেই অলীক রঙিন স্বপ্নটা দেখতে-দেখতে রাত্রির অন্ধকার পার হয়ে যাবে।