একজন ভারতীয় তরুণ আমেরিকায় প্রবাসজীবন সেরে দেশে ফিরছে। ফেরার পথে ইউরোপ দেখা তার অতিরিক্ত লাভ। কারণ ইউরোপ ঘোরার জন্য তার আলাদা প্লেনের টিকিট কাটতে হবে না। যে ইউরোপ অনেক ভারতীয় যুবার কাছেই স্বপ্নের জগৎ, আজ এই বিশেষ তরুণটির পক্ষে ইউরোপের যে-কোনও শহরের অজানা পথে পথে ঘুরে বেড়ানো কত সহজ। যেখানে ইচ্ছে যাও, যে হোটেলে ইচ্ছে বসে বিশ্রাম নাও, যে-কোনও স্মৃতিস্তম্ভের সামনের মাঠের ঘাসে শুয়ে থাকো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কোনও কাজ নেই, কোনও তাড়া নেই,–এমনকী বিস্ময়ও কোথাও বিপুল নয়। এক একটি জগৎবিখ্যাত দর্শনীয় স্থানের সামনে এসে সে বলতে পারে, জানতুম, এরকমই হবে। যতখানি কল্পনা করেছিলুম, তার চেয়ে বেশি কিছু দেখাতে পারেনি কেউ। তাই বুঝি সব ভ্রমণের সার মনসামথুরা ভ্রমণ।
ছেলেটি একটি কাজ করেছে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। বিদেশে গিয়ে খুঁজে-খুঁজে অপর ভারতীয়দের সঙ্গে দেখা করে সময় নষ্ট করেনি। যে-দেশে গেছে, সেখানে মিশেছে শুধু সেই দেশের লোকের সঙ্গে। আমেরিকানদের সঙ্গে কথা বলে সে চিনেছে আমেরিকা, ইংরেজদের সঙ্গে আলাপ করে ইংল্যান্ড, তেমনি ফরাসি দেশ ও জার্মানিতে এসে সে শুধু গ্রহণ করেছে ফরাসি ও জার্মান বন্ধু। ওসব দেশের কয়েকজনের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয়ের সূত্র ছিল, কোথাও চিঠিপত্রে, কোথাও বন্ধুর বন্ধু হিসেবে।
একমাত্র রোমেই তার পরিচিত কোনও ইতালীয় ছিল না। অথচ রোম দেখার আগ্রহ ছেলেটির অসীম, রোমের দু-হাজার বছরের পুরোনো স্টেডিয়ামের প্রাচীর এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। যে প্রাচীর সম্বন্ধে বলা হয়, যেদিন ওই প্রাচীর একেবারে ভেঙে পড়বে, সেদিন রোম শহরেরও পতন হবে। আর রোমের পতন হলে পৃথিবীরও পতন। সেই রোম দেখবে না? কিন্তু সেই রোম কি সে দেখবে পেশাদার টুরিস্টদের মতো কনডাকটেড টুরে? শুধু রোম কেন, সে দেখতে চায় ভেনিস, সম্পূর্ণ ইটালি। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ইটালিতে কোনও নির্ভরযোগ্য ইতালীয় বন্ধুর সন্ধান পাওয়া গেল না।
বরং ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে, জার্মানিতে যেখানেই রোম প্রসঙ্গে আলোচনা হয়, ওইসব দেশের লোকেরা সকলেই একবাক্যে বলত, রোমে যাচ্ছ? সাবধান!
রোমের সম্পর্কে ইওরোপের অন্যান্য দেশের অনেকের অভিযোগ এই যে রোমের মতো এমন শিল্প-সুষমামণ্ডিত প্রাচীন শহরে ভ্রমণ করতে যেতে সকলেরই লোভ হয়, কিন্তু রোম বা ইটালির যে-কোনও শহরই প্রায় জুয়াচোর-প্রতারকে ভরা। ইটালিতে জিনিসপত্র দরাদরি করে কিনতে হয়। রোমের হোটেলওয়ালাদের ব্যবহার সাংঘাতিক, অত্যন্ত ধুরন্ধর ব্যক্তি ছাড়া তাদের সঙ্গে বো ঝাঁপড়া করা সম্ভব নয়। যেমন প্রথমে হোটেলে যাওয়া মাত্রই তারা অসম্ভব হাসিখুশি ব্যবহারের সঙ্গে আশাতিরিক্ত সস্তা দাম চাইবে। প্রসন্ন পর্যটক সঙ্গে-সঙ্গে ঘর ভাড়া নিয়ে মালপত্র রেখে চাবি হাতে বেরিয়ে পড়লেন। কয়েকদিন পর ভ্রমণপর্ব সমাপ্ত করে হোটেল পরিত্যাগ করার সময়, যখন কাউন্টারে দাম চুকিয়ে দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন, তখন হাতে পেলেন তাঁর নিজস্ব হিসেবের দু-গুণ বা তিনগুণ একটি বিল। কী ব্যাপার? ঘর ভাড়া তো অনেক কম বলা হয়েছিল? আহা, সে তো শুধু ছিল ঘরভাড়া, তার সঙ্গে যোগ হবে ইলেকট্রিকের চার্জ, চাকরদের সার্ভিস, জলের খরচ, আর আপনাকে বলা হয়েছিল ছোট এক-বিছানা ঘরের খরচ, কিন্তু তার বদলে সে আপনাকে সুন্দর, প্রশস্ত, দু-বিছানার ঘর দেওয়া হয়েছিল!
এ ছাড়া, রোমের কুলিরা নাকি মালপত্র নিয়ে দরাদরি করে খুব। ট্যাক্সিওয়ালা এক নম্বরের ফেরেববাজ। অনেক ট্যাক্সির মিটার থাকে না বা মাঝপথে সুযোগ বুঝে মিটার খারাপ হয়ে যায়, তারপর গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যা-তা ভাড়া হেঁকে বসে। ইটালির রেস্টুরেন্টগুলোও জোচ্চুরির জায়গা, একই খাবার একজন ইতালীয় খেয়ে গেল যে দাম দিয়ে, আরেকজন বিদেশিকে সেজন্য দিতে হল ডবল। অনেক সময় ইটালির আর ইংরেজি দু-ভাষায় আলাদা মূল্য তালিকা ছাপা থাকে, কিন্তু ভাষা অনুযায়ী দামের অনেক হেরফের। আর সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে দাম নিয়ে বা টাকাপয়সা নিয়ে কোনও বিদেশি যখন তর্ক করতে চায়, তখন হঠাৎ সুযোগ মতো ইতালীয়রা একবর্ণও ইংরেজি বা কোনও বিদেশি ভাষা না বোঝার ভান করে উলটে, দুর্বোধ্য ইটালিয়ানে কী যেন বকবক করে যায়।
এইসব অভিযোগ ভারতীয়টি শুনল ইওরোপের অনেকগুলো দেশে। প্রমাণ হিসাবে, সদ্য ইটালি ফেরত একজন ফরাসি তাকে খবরের কাগজের একটি অংশে আঙুল দিয়ে দেখাল। খবর বেরিয়েছে, ভেনিসের কয়েকটি হোটেলে পুলিশ অকস্মাৎ হানা দিয়ে শাসিয়েছে যে বিদেশিদের কাছ থেকে যদি আবার বেশি দাম নেওয়া হয় তবে ওইসব হোটেলের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে। সুতরাং আশা করা যায় রোমের বিশাল বিমানবন্দরে আত্মীয়হীন নির্বান্ধব দেশে ছেলেটি যখন প্লেন থেকে নামল, তখন সে হয়তো মনে-মনে দুর্গা নাম জপ করেছিল একবার। আগে থেকেই সে ঠিক করে নিয়েছিল রোমে ট্যাক্সি চাপবে না, কুলির হাতে মালপত্র সঁপে দেবে না, হোটেলের ঘর নেবে খুব সাবধানে।
এয়ার টার্মিনালের একটু দূরেই কয়েকটি হোটেলের নাম জ্বলছে আলোতে। দুটি ভারী সুটকেস দু-হাতে বয়ে নিয়ে ছেলেটি চলেছে হোটেলের নাম পড়তে-পড়তে। ক্লান্ত চেহারায় ওরকম সুটকেস বওয়া, রাস্তার লোক দেখছে ফিরে-ফিরে। ছেলেটি হাঁটতে-হাঁটতেই মনে-মনে ইটালির মুদ্রা লিরার সঙ্গে টাকা কিংবা ডলারের হিসেব ঝালিয়ে নিচ্ছে যাতে ওদিক দিয়ে অন্তত কেউ ঠকাতে না পারে। সামনে একটি হোটেল দেখেই ঢুকে পড়লে। একটিই ঘর খালি আছে। কত ভাড়া? বেশ সস্তা। সেয়ানা ছেলেটি প্রশ্ন করল, পরে আর কী-কী চার্জ দিতে হবে?ভদ্র ম্যানেজার স্পষ্টভাবে বললেন, আর কিছু না, সার্ভিস চার্জ পর্যন্ত না, এবং ওই টাকার মধ্যেই সকালের জল খাবার, এক বেলা খাবার ধরা আছে। আশ্চর্য, এ হোটেলটিকে দেখা যাচ্ছে দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ।
পরদিন একটা ডলারের ট্রাভেলার্স চেক ভাঙানো দরকার। ম্যানেজারকে বলল। ম্যানেজার বললেন এখন তো পুরো টাকাটা নেই আপনি চেকটা রেখে অর্ধেক টাকা নিয়ে যান, বিকেলে বাকি টাকাটা নেবেন। কী সর্বনাশ। কোন ভরসায় রেখে যাবে, যদি বিকেলে বাকি টাকাটা দিতে অস্বীকার করে! অনেক টাকা অথচ ম্যানেজার চেকটির জন্য হাত বাড়িয়ে আছে। একটা মুশকিল এই, আমাদের পরিচিত ভারতীয় ছেলেটি একটু লাজুক ধরনের। মুখের ওপর কোনও লোককে অবিশ্বাস করতে পারে না। অনিচ্ছা সত্বেও চেকটি রেখেই এল, সারাদিন কাটল বিরস মনে। বিকেলবেলা স্নান সেরে জামা-কাপড় বদলাচ্ছে, দরজায় টোকা দিয়ে ম্যানেজার এসে বাকি টাকাটা দিয়ে গেল।
সন্ধেবেলা ডিনার খেতে ঢুকল একটা রেস্টুরেন্টে। যে-কোনও রেস্টুরেন্ট, আগে থেকে নাম জানা। তার টেবিলের উলটোদিকে একজন ইটালিয়ান। সবরকম খাবার-দাবারের নাম জানে নাবলে ইটালিয়ান ভদ্রলোক যে-যে খাবারের নাম বললেন ইতালীয় ভাষায়, ছেলেটিও ঠিক সেইগুলোই পুনরুক্তি করে গেল। তারপর খেতে লাগল ঠুকঠাক করে, ধীরেসুস্থে। বেশ সুখাদ্য। অন্য লোকটি চেনা খাবার চটপট খেয়ে দাম দিয়ে উঠে গেলেন। ছেলেটি আড়চোখে দেখে নিয়েছিল, তিনি কত দাম দিচ্ছেন। এবার দেখা যাক, একই খাবারের জন্য তার কাছে কত দাম চায়। অবাক কাণ্ড, তাকে বিল দেওয়া হল একটু কম টাকার। উচ্চারণের দোষে বুঝতে না পেরে, তাকে নাকি সুপ দেওয়া হয়েছে একটা অন্য কম দামের।
সত্যি আশ্চর্য কথা, রোমে তার সাতদিনের অবস্থানে একটি লোকও তার সঙ্গে দুর্ব্যহার করেনি। কেউ তাকে ঠকাবার চেষ্টা করেনি। একেবারেই প্রতারিত না হতে পেরে বিরক্ত বোধ করে, সে শেষ চেষ্টা হিসেবে একবার ট্যাক্সিও চেপে বসল। গন্তব্যে পৌঁছবার পর দেখা গেল, তার কাছে একটা বড় নোট, ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে পুরো খুচরো নেই। ড্রাইভারটি তখন পঞ্চাশ লিরা কম নিয়েই বলল, ঠিক আছে, আর দিতে হবে না! ছেলেটি বলল, না, না, তা-কি হয়, আমি টাকাটা ভাঙিয়ে নিচ্ছি কোথাও। ড্রাইভারটি চমৎকার হেসে বলল, গ্রাৎসি সেনর! ব্যস্ত হওয়ার কী আছে। আপনি না হয়, পরে অন্য কোনও ড্রাইভারকে বকশিশ দিয়ে দেবেন।
ভ্যাটিকান দেখে ফেরবার পথে বিকেলে বাসে যাওয়ার সময় ছেলেটির পাশে এক সুন্দরী সম্রান্ত মহিলা বসেছেন, বারবার তাকাচ্ছেন ছেলেটির দিকে। তারপর জিগ্যেস করলেন, তুমি কোন দেশের? ছেলেটি জানাল। ভদ্রমহিলা বললেন, আমি তোমাদের ভারতবর্ষ সম্পর্কে খুব কম জানি। কিন্তু কি সুন্দর তোমার গায়ের রং। পাকা জলপাইয়ের মতো। এমন রং আমি পেলে ধন্য হয়ে যেতাম!–এরকম কথা সারা পশ্চিম জগতে অন্য কোনও অপরিচিত মেয়ে বলেনি। ছেলেটির মন পূর্ণ হয়ে গেল।
রোম, এ কী রহস্য তোমার। অর্ধেক পৃথিবীর কাছে শুনে এসেছি তোমার অধিবাসীদের বদনাম। অথচ ছেলেটি ভাবল, আমার অভিজ্ঞতা অপরূপ সুন্দর, নিখুঁত, সারা পশ্চিম জগতের মধ্যে সবচেয়ে সু-ব্যবহার পেলাম। উপরন্তু একটি সুন্দরী মহিলার মুখে আমার গাত্রবর্ণের স্তুতি। ভাবতে ইচ্ছে হয়, রোম যেন এই ভারতীয় ছেলেটিকে বিশেষ রকম আন্তরিকতা দেখিয়েছে।