সাগর থেকে পাহাড় ২
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্পের চরিত্র দুটি জেলার সীমান্তে দাঁড়িয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। নিজের জেলা পেরিয়ে সে যাচ্ছে, পরের জেলাটি যেন এক অচেনা মহাদেশ। এই বিস্ময়বোধ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। যানবাহনের সংখ্যা ও প্রকার অনেক বেড়েছে। মিডিয়ার বিস্ফোরণ ঘটে গেছে, কোনও মানুষই এখন আর এত ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। জেলাগুলির মধ্যে কোনও সীমারেখাও নেই। আমি একটার পর একটা জেলা পেরিয়ে যাচ্ছি। চট করে কোনও প্রাকৃতিক আলাদা চেহারাও নজরে আসে না। তবে বর্ধমান ছাড়াতে না ছাড়াতেই চোখে পড়ে লাল ধুলো। বীরভূমে গ্রাম-ছাড়া রাঙা মাটির পথ প্রত্যাশিত, কিন্তু ওইদিক দিয়ে মুর্শিদাবাদে ঢুকলে মাটির রং আরও বেশি লাল মনে হয়। মুর্শিদাবাদের রাঙা মাটি নিয়ে কেউ গান লেখেননি। মালদহ থেকে পশ্চিম দিনাজপুরের দিকে এগুলে দু’দিকের রাস্তা একেবারে হলুদে-হলুদ, এর সঙ্গে এত অমলতাস গাছ আর কোথাও দেখিনি। অমলতাসের আর একটা নাম বাঁদরলাঠি। এমন চমৎকার গাছটির এই বিচ্ছিরি নামান্তর হল কী করে? আমরা যাকে বলি ঢাড়শ, ইংরেজরা কত সুন্দর করে তারই নাম রেখেছে লেডিজ ফিংগার!
শিলিগুড়ির দিকে গেছে যে জাতীয় সড়ক, তা একবার হঠাৎ বিহারে ঢুকে আবার পশ্চিমবাংলায় ফিরে আসে। বিহারে ওই অংশটিকে অন্যান্যবারের চেয়ে এবার বিশেষ আগ্রহ নিয়ে দেখতে-দেখতে এলাম। কারণ এখানে আমাদের বন্ধু এম কে আকবর নির্বাচন প্রার্থী। সাইকেল রিক্সার পেছনে তার ছবি। কিছুদিন আগেও সে ছিল সুদর্শন তরুণ যুবা। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মুখের ভাবভঙ্গি ভারিক্কি হয়েছে। তার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রচারের তেজ কম নয়। এবারের নির্বাচনে আকবর জিতলে ভারতীয় রাজনীতির কতটা লাভ হবে জানি না, কিন্তু আমরা একজন প্রতিভাবান সাংবাদিককে হারাব।
উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করার পরই বিরহ বেদনার মতন বুকটা খালি-খালি লাগে। দু’পাশে মাঠ। যেখানে মাঠ থাকার কথা ছিল না। কৈশোরে দেখা রূপ এখনো স্মৃতিতে লেগে আছে, কী নিবিড় সবুজ ছিল এইসব জায়গা, কত বিশাল বিশাল গাছ, তাদের বনস্পতি নামটাই মানাত। কোথায় অদৃশ হয়ে গেল সেইসব গাছ? চতুর্দিকে মানুষের কুঠারের চিহ্ন। শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে সেবক রোড ধরে করোনেশান ব্রিজের দিকে যেতে পড়ে বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্ট, একটা নাম করা গভীর অরণ্য কিন্তু এখন রাস্তার ধারে কিছু বড়-বড় গাছ রেখে দিয়ে ভেতরটা প্রায় সাফ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে ঝুপড়ি কলোনি। আবার জবর দখল, এরা অবশ্য যত দোষ নন্দ ঘোষ পাকিস্তান-বাংলাদেশের উদ্বাস্তু নয়, এরা আসে নেপাল থেকে। বছরের পর বছর ধরে এরা আসছে। সরকারি জমি দখল করে বসে যাচ্ছে। এদের নিয়ে তেমন হইচই শোনা যায় না। অবশ্য এরাও অতি গরিব মানুষ, নিশ্চয়ই বাধ্য হয়েই আসে।
গরিব মানুষ গাছ কাটে, কিন্তু বড় বড় গাছ কেটে অরণ্য নির্মূল করে না, সে সাধ্য তাদের নেই। এই বৃক্ষকূল ধ্বংস করার পেছনে আছে ব্যবসায়ীরা। শিলিগুড়ি শহরে এরকম অনেক হঠাৎ বড়লোক গজিয়ে উঠেছে, যারা ধ্বংস করছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। এদের কেউ নিবারণ করে না, বরং আমলা এম এল এ মন্ত্রীরাও এদের মদত দেয়, এসব শোনা যায়।
চতুর্দিকের গাছপালা কাটতে কাটতে দিন দিন লম্বায় ধ্যাড়েঙ্গা হচ্ছে শিলিগুড়ি শহর। আমরা শহর বিরোধী নই। কিন্তু শিলিগুড়িকে দেখলেই বলতে ইচ্ছে করে, দাও ফিরে সে অরণ্য, লও হে নগর। দেখতে-দেখতে কত বড় হয়ে গেল দৈত্যের ছানার মতন, কোনও পরিকল্পনা নেই, কোনওরকম সৌন্দর্য রক্ষার চেষ্টা নেই। যেখানে সেখানে বাড়ি তৈরি হচ্ছে, আর দোকানপাট। গাড়ি-রিকশার সংখ্যা ধাঁধাঁ করে বাড়ছে। হিল কাট রোডে প্রতিদিন প্রায় সর্বক্ষণ ট্রাফিক জ্যাম। দোকানের ঠাসা জিনিসপত্র ও কিছু কিছু মানুষের ভাবভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়, টাকা উড়ছে চতুর্দিকে। কলকাতার পরেই পশ্চিম বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শিলিগুড়িতেও বাঙালিদের প্রাধান্য নেই। পঁয়ষট্টি সালের চিন-ভারত যুদ্ধের পর এই শহরের প্রাধান্য বেড়েছে, সেই সঙ্গে হয়ে দাঁড়িয়েছে স্মাগলারদের একটা বড় কেন্দ্র। তাদের কেউ ঘাঁটায় না। পুলিশ এবং সবক’টি রাজনৈতিক দলই তাদের অনুগ্রহপুষ্ট। আমাকে একজন বললেন যে তিনি এখানকার দু-একটি বেকার ছেলের চাকরি ব্যবস্থা করে দিতে চেয়েছিলেন, তারা নেয়নি। নামে বেকার হলেও অন্যভাবে তাদের উপার্জন যথেষ্ট।
অদূরেই জলপাইগুড়ি শহরের চরিত্র আলাদা। জলপাইগুড়ি পুরোনো শহর। বাঙালি সংস্কৃতির ছাপ এই শহরে ঢুকলেই টের পাওয়া যায়। এককালে এখানকার অনেক পরিবারেরই কোনও না কোনও চা বাগানে কিছুটা শেয়ার ছিল, সেই জন্য সচ্ছলতাও ছিল, এখন চা বাগান সব অবাঙালিরা কুক্ষিগত করেছে, জলপাইগুড়ির বাঙালি পাড়াগুলি বেশ মলিন।
দুই শহরে টের পাওয়া যায় নির্বাচনী জ্বর। প্রচারের পালা শেষ হয়ে আসছে। মেঘলা আকাশ। গরম নেই, তাই দিন দুপুরেও সাইকেল মিছিল। গাড়িতে-গাড়িতে চিৎকার চলছে। দেয়াল লিখনগুলিতে ছবি, পালটা দাবি, প্রতিশ্রুতি, অপরের প্রতি ব্যঙ্গোক্তি পড়তে পড়তে আমি ভাবছিলাম, উত্তর বাংলায় এত বৃক্ষ নিধনের ফলে যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে চলেছে, এটা একটা বিরাট সমস্যা, অথচ যে বিষয়ে তো কোনও দল একটাও কথা বলেনি, গাছ কাটা বন্ধ করা কিংবা পরিবেশ সুস্থ-সুন্দর করে তোলাটা কি রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে পড়ে না? আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলি এখন আর কোনওরকম সামাজিক ভূমিকা নেয় না। ক্ষমতা দখলই যেন শুধু ধ্যানজ্ঞান। যারা ক্ষমতায় যায় না, তারাও কী যেতে পারে না মানুষের কাছে?কুসংস্কার, অপরিচ্ছন্নতা, সাধারণ স্বাস্থ্যরক্ষা বিধি, এইসব বিষয়ে তারা কখনও একটা কথাও বলে? সেইজন্য সবাই যেন ধরে নিয়েছে, সরকারি প্রশাসন যা করার করবে। অন্যদের কিছু করণীয় নেই।
এর ব্যতিক্রম দেখলাম, জলপাইগুড়ি শহরে। জলপাইগুড়ি ওয়েল ফেয়ার অর্গানাইজেশান একটি সম্পূর্ণ বেসরকারি, অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। একদল তেজি যুবক-যুবতী এর সংগঠন কর্মী। এই প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখ করছি, তার কারণ সারা দেশের কাছেই এই ধরনের প্রতিষ্ঠান আদর্শ স্বরূপ হতে পারে। সরকার যেসব ক্ষেত্রে ব্যর্থ বা উদাসীন, হাসপাতালগুলির ব্যবস্থা যেখানে যথেষ্টর চেয়েও অনেক কম, সেইসব জায়গায় এরা এগিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষদের নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করবার জন্য। এঁরা নানা ধরনের পঙ্গু অসহায় রোগী এমনকী, ক্যানসারের রোগীদেরও চিকিৎসা ও স্বনির্ভরতায় ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেছেন তো বটেই, এদের কাজ কিন্তু যে-কোনও সেবা প্রতিষ্ঠানের চেয়েও অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ। এরা একটা প্রেসার গ্রুপ। এরা সরকারি গাফিলতির খবর পেলেই দল বেঁধে গিয়ে চাপ দেয়। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার কিংবা থানার দারোগা কারুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে এরা গিয়ে ঘিরে ধরে, প্রতিকার এবং ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে, এদের স্বার্থহীনতা এমনই বলিষ্ঠ যে এখন যে-কোনও রাজনৈতিকদলই এদের বাধা দিতে ভয় পায়।
নির্বাচনী প্রচার শুনতে শুনতে আর একটা কথা মনে হচ্ছিল, সারাদেশে প্রচারযন্ত্র এমন জোরালো ও সরব তো আর কখনও হয় না। প্রতিটি শহরে গ্রামেগঞ্জে এখন সমস্ত পার্টির প্রচার চলেছে। এত বড় প্রচার যজ্ঞের আয়োজন করার সাধ্য কোনও সরকারের নেই। বিপুল ব্যয়বহুল এই প্রচার ব্যবস্থাকে শুধু ভোটের আবেদন, ও পরস্পরের প্রতি গালাগালি ছাড়াও অন্য কোনও কাজে লাগানো যায় না? প্রতিটি বক্তৃতার শেষে মাত্র দু-মিনিট প্রতিটি বক্তা যদি বলেন, আচ্ছা, এতক্ষণ তো ভোটের কথা হল, এবার অন্য একটা কথা শুনুন। গাছ আমাদের বন্ধু। আমরা যদি এলোপাথারি সব গাছ কাটতে থাকি। তা হলে কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেব। তখন কোথায় থাকবে সরকার, আর কোথায় থাকবে ভোট।