শৈল শিখরে শীতের সন্ধ্যা-সকাল
মাথার মাংকিটুপিতে মুখের প্রায় অর্ধেকটা ঢাকা, দুহাতে নকল চামড়ার গ্লাভস, গলাবন্ধ ঝোলা কোট, পায়ে পেল্লায় ভারী জুতো, সব মিলিয়ে আমায় দেখতে কী রকম লাগছিল কে জানে! এই পোশাকে আমি অবশ্য এভারেস্টের চুড়োয় কিংবা দক্ষিণ মেরু অভিযানে যাইনি, ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম দার্জিলিং-এর ম্যালে। সময়টা অবশ্য মধ্য ডিসেম্বর।
আমার শীতকালে যেতে ইচ্ছে করে শীতের দেশে, বর্ষার সময় সমুদ্র কিনারে আর ঘোর অমাবস্যার রাতে মিশমিশে অন্ধকার জঙ্গলে। নিজের বাড়ির বিছানাটা সারা বছরই ভালো কিন্তু বাইরে বেড়াতে গেলে প্রকৃতির বাড়াবাড়িপনাই বেশি উপভোগ্য।
আমরা গরম দেশের মানুষ, আমাদের এখানে শীতকালটা যেন ভুল করে পরের বাড়ি ঢুকে লজ্জায় জিভ কেটে চলে যাওয়ার মতন। তাই যতটা পারা যায়, শরীরে শীত পুইয়ে নিতে ইচ্ছে করে। কাশ্মীর বা সিমলা পাহাড় তো অনেক দূরের এবং খরচের ব্যাপার, হাতের কাছেই আছে দার্জিলিং, তাই প্রতি শীতেই দার্জিলিং আমায় হাতছানি দেয়। শীতে দার্জিলিং-এর হোটেল শস্তা, জায়গা পাওয়ার জন্য মাথা ঘামাতে হয় না। বরং ওরা হাতে ধরে টানাটানি করে। সবচেয়ে বড় কথা, এই সময় দার্জিলিং-এ চেনা-আধচেনা, পছন্দের-অপছন্দের মানুষদের সঙ্গে দুবেলা গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে হয় না।
এই ডিসেম্বরে যখন দার্জিলিং যাই তখন অনেকে ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন, এবারে বেশি শীত পড়েছে, ফ্রস্ট বাইট হবে, নিউমোনিয়া লেগে যাবে, এমন সর্দি ধরবে যে বারো বছরের আগে ছাড়বে না ইত্যাদি। তাই আমি পোশাকের ব্যাপারে বড্ড বেশি-বেশি করে ফেলেছিলুম। ম্যালে খানিকক্ষণ ঘোরার পর বাঁদুরে টুপির জন্য আমার কান গরম হয়ে গেল, পিঠে কুলকুল করছে ঘাম, দুহাতে গ্লাভস পরে থাকাও ঝকমারির ব্যাপার, তাতে সিগারেট টানা যায় না।
ক্রমে খুলে ফেললুম মাথার টুপি ও হাতের গ্লাভস, কোটের দুটো বোতাম। খোলার পরও শীত ঝাঁপিয়ে এসে আক্রমণ করল না বরং আরামের প্রলেপ বুলিয়ে দিল। এখন বেশ সাবলীলভাবে হাঁটা যায়।
ম্যাল যতটা ফাঁকা হবে মনে করেছিলুম, ততটা ধু-ধু ফাঁকা নয়। ভেবেছিলুম, শুধু সাহেব মেমদেরই দেখব, কিন্তু বাঙালিও তো কিছু রয়েছে দেখছি। কেউ-কেউ এসেছে অন্য রাজ্য থেকে। শীতকালেই যে পাহাড় দেখতে হয়, তা বুঝেছে আমাদের দেশের মানুষ। অন্য সময় তো যখন তখন মেঘ, বৃষ্টি কিংবা কুয়াশা। অন্য সময় দার্জিলিং-এ এসে কাঞ্চনজঙ্ দেখবার সৌভাগ্য হয় ক’জনের। আর এখন তো সকাল থেকেই অঢেল কাঞ্জনজঙ্ঘা, যত খুশি দেখো, এমনকি এক এক সময় কাঞ্চনজঙ্ দারুণ সেজেগুঁজে ছবি তোলানোর জন্য পোজ দিয়ে থাকে, কিন্তু সেদিকে তাকাবার কথা মনেই পড়ে না। রোদ্দুর যে কত ঝকঝকে হতে পারে তা দেখতে হলেও শীতে পাহাড় চূড়ায় আসতে হয়।
পর্যটন দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর আমেদ সাহেবের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি সব সময় ফিটফাট সাহেব সেজে থাকেন। প্রত্যেক শীতে তিনি তাঁর পরিবারের লোকজনদের সমতলে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে থেকে যান এখানে। তাঁকে কথায়-কথায় বললুম, কী শীতের ভয় দেখাচ্ছিল সবাই? আপনাদের দার্জিলিং-এ শীত কোথায়? আমার তো একটা উলের গেঞ্জি আর একটা কোটেই বেশ চলে যাচ্ছে।
আমেদ সাহেব হাসতে-হাসতে বললেন, আর শীত চান? তাহলে টাইগার হিল চলে যান। সেটা তো আরও অনেক উঁচুতে, সেখানে বরফ পেয়ে যেতে পারেন।
আমি পরজন্ম মানি না কিন্তু পূর্বজন্ম মানি। পূর্বজন্মের সুকৃতি না থাকলে সব জায়গাতেই আমি বন্ধু পেয়ে যাই কেন? অচেনা মানুষও আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমেদ সাহেব সরকারি কাজে সেই বিকেলেই টাইগার হিল পরিদর্শনে যাবেন, আমাকেও তুলে দিলেন তাঁর জিপে। টাইগার হিলে আমি অনেকদিন আগে একবার গিয়েছিলুম, পায়ে হেঁটে। বড় দলের সঙ্গে। সেটা ছিল শরৎকাল। বৌদ্ধদের কী একটা পরবের মিছিল দেখেছিলুম মনে আছে। এবারেও ঘুম ছাড়াবার পর নিরিবিলি রোমাঞ্চকর রাস্তায় এক জায়গায় দেখি বৌদ্ধদের মিছিল। এই শীতের মধ্যেও তাদের মুখগুলি নিরভিমান, পোশাকে বর্ণবাহার আছে, কিন্তু আতিশয্য নেই। এখন গ্লাভস না পরে আর পারছি না আমি, আঙুলগুলো বেঁকে যাবে মনে হয়, কিন্তু এই পাহাড়িদের সবারই হাত নগ্ন।
টাইগার হিলের আদি বাংলোটি ইংরেজ পছন্দ। পাশে নতুন ডানা গজাচ্ছে। বাংলোর বাইরের বারান্দায় বেশ কয়েকজন জাপানি পর্যটক বসে আছে, প্রত্যেকের চেয়ারের নীচে একটি করে লাল গনগনে হিটার। হ্যাঁ, এখানকার ঠান্ডাটি হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়ার মতন বটে।
দুজন চেনা বাঙালির সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল। একজন হলেন কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত আর একজনকে আমি গল্প লেখক আদিনাথ ভট্টাচার্য বলেই চিনি, কিন্তু এখানে বোঝা গেল সেই রোগা পাতলা মানুষটি বেশ একজন হোমরাচোমরা, কর্মসূত্রে পর্যটক করপোরেশনের পরিচালক। জমে গেল আড্ডা, চায়ের সঙ্গে গরম-গরম পেঁয়াজি।
খানিক বাদে আদিনাথ ভট্টাচার্য প্রস্তাব দিলেন, চলুন, আর একটু ওপরে ওয়াচ টাওয়ার থেকে সূর্যাস্ত দেখে আসা যাক।
একটু ওপরে মানে অবশ্য বেশ ওপরে। হাঁটতে-হাঁটতে হাঁপিয়ে যেতে হয়। শীতের মধ্যে ভালো ব্যায়াম। একটি সুদৃশ্য গেট পেরিয়ে সিঁড়ি। একেবারে টঙে ওয়াচ টাওয়ার। তার একতলাটা এজমালি, দোতলায় উঠতে গেলে টিকিট কাটতে হয়, কেন না সেখানে বসবার জায়গা আছে। টিকিট কেটে ওপরে এসে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলুম। না, সূর্যাস্ত নয়। সূর্যবিহীন এক রঙের খেলা। সূর্য দেখা যাচ্ছে না। আকাশের এখানে-ওখানে সাদা মেঘ, তার এক এক প্রান্তে ম্যাজিকের মতন লাল রং জ্বলে উঠছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। যেন এক অদৃশ্য মশালধারীর দৌড়।
বাংলোয় ফিরে এসে আহারাদি হল বেশ প্রলম্বিত। আড্ডা চলল আরও লম্বাভাবে। এখানকার ম্যানেজার তামাং সাহেব প্রাক্তন ফৌজি মানুষ, ভূত-প্রেত, ঠাকুর দেবতা, সাপখোপের প্রচুর গল্প তাঁর স্টকে। বলার ভঙ্গিটি যেমন মজাদার, তেমনি রোমহর্ষক।
রাত সাড়ে বারেটার সময় তিনি গল্প সমাপ্ত করে বললেন, এবারে শুয়ে পড়ুন। ঠিক ভোর সোয়া চারটেয় সময় ডেকে দেব। চা খেয়ে সানরাইজ দেখতে যাবেন।
রাত সাড়ে বারোটায় শুয়ে ভোর সোওয়া চারটেয় ওঠা, পাগল নাকি? এখানে সানরাইজ দেখতেই সবাই আসে। উনি ধরেই নিয়েছেন আমরাও তার জন্য ব্যস্ত। আমার ধারণা হল, তামাং সাহেবের নিজেরই ঘুম ভাঙবে না।
শীতটা ঠিক কতটা তা বোঝাবার জন্য একবার বারান্দায় আসতেই হু-হুঁ হাওয়া আমার দু’গালে যেন থাপ্পড় কষাল। ভয়ে পালিয়ে এলাম ঘরের মধ্যে।
তারপর আর ঘুম আসে না। ঘরের মধ্যে দুটো হিটার জ্বলছে, বিছানায় দুখানি করে লেপ, তার নীচে গরম জলের বোতল, একটু পরেই আমার ঘাম বেরুতে থাকে। আবার লেপ সরালেই শীতে জমে যাওয়ার উপক্রম। তা ছাড়া, পায়ের কাছে বেশি গরম, মাথার কাছে বেশি ঠান্ডা। এ তো মহাজ্বালা!
হঠাৎ বাইরে হইচই শুনে ভাবলুম ডাকাত পড়ল নাকি? তা নয়। এরই মধ্যে সোওয়া চারটে বেজে গেছে। তামাং সাহেব আশ্রমিকদের জাগাবার জন্য ডাকাডাকি করছেন। ভেবেছিলুম আমাদের দলের কেউ যাবেন না। কিন্তু দেখি যে আদিনাথবাবু, আমেদ সাহেব, এমনকি শীতকাতুরে সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত পর্যন্ত একে-একে তৈরি। পুণ্যলোভ না প্রকৃতিপ্রেম? আপাতত ও দুটোই মাথায় থাকুক। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত আমায় অনেক ডাকাডাকি করলেন, আমি ঘাপটি মেরে পড়ে রইলুম।
ওরা চলে যাওয়ার বেশ খানিকটা পরে আমার সামান্য অপরাধ বোধ হল। ভোরের সূর্যকে এতটা হেলাতুচ্ছ করা ঠিক নয়। বিছানার লেপটাই গায়ে জড়িয়ে চলে এলাম বাইরের বারান্দায়। কিন্তু কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না, সামনে দিগন্ত জুড়ে শুধু নীল-নীল কুয়াশা। এমন ঠান্ডা যে মনে হল আমার নাকটা নেই। আঙুল দিয়ে দেখে নিতে হল, সত্যি সেটা খসে পড়েছে কি না। যাক আর কোনও দায়িত্ব নেই, ফিরে এসে সটান আবার বিছানায়, এবং বেলা আটটা পর্যন্ত টানা ঘুম।
জেগে উঠে শুনলুম, ওপর থেকে ভালোই সূর্যোদয় দেখা গেছে। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত এমনই অভিভূত হয়েছেন যে তিনি নিবিড় মনোযোগ দিয়ে কবিতা রচনা করছেন। সেটি শেষ হওয়ার পর অনুরোধ করলুম, পড়ে শোনাবেন আমাদের?
চমৎকার কবিতা, গভীর উপলব্ধি ও শব্দঝংকার বিশেষ ব্যঞ্জনাময়। সেই কবিতা শুনেই আমার অনেক পরিব্যাপ্ত সূর্যোদয় দর্শনের অনুভূতি হল।