এই প্রথম এয়ারপোর্টে আমাকে কেউ পৌঁছে দিতে আসেনি। যদিও এবারেই আমি যাচ্ছি সবচেয়ে বেশি দূরে।
প্রথমবার যখন বিদেশে যাই, তখন সমস্ত এয়ারপোর্ট প্রায় ছেয়ে গিয়েছিল আমার বন্ধুবান্ধবে। সে কতকাল আগেকার কথা। তখন বিদেশ যাত্রা এখনকার মতন এমন জল-ভাত ছিল না। আর বাংলা কবিতা লিখে বিদেশে আমন্ত্রণ পাওয়া শুধু অভাবনীয় নয়, অবিশ্বাস্য মনে হত।
সেই প্রথমবার মনে হয়েছিল, আকস্মিকভাবে এই যে সুযোগ পেয়েছি, এই তো যথেষ্ট, আর কখনও যাওয়া হবে না, এবারেই প্রথম ও শেষ। আমার সেই যাওয়ার মূলেও ছিল প্রবল ইচ্ছাশক্তি। গরিবের ছেলে হলেও দৃঢ় সংকল্প ছিল, যে-কোনও উপায়ে বিশ্ব ভ্রমণে যাবই যাব। কোনও যোগ্যতা না থাকলেও জাহাজের খালাসির চাকরি নেব, রান্নাঘরের পাচকের তৃতীয় সহকারী হয়ে আলুর খোসা ছাড়াব, তবু তো দেখা যাবে অকূল সমুদ্রের রূপ, জাহাজ থামবে অচেনা বন্দরে-বন্দরে। কত ভ্রমণকাহিনিতে এরকম বিবরণ পড়ে উদ্দীপিত হয়েছি। বাঙালিদের মধ্যে বিশ্ব পর্যটক হিসেবে এক সময় খুব খ্যাতিমান হয়েছিলেন রামনাথ বিশ্বাস, তিনি ছিলেন আমার ছোটবেলার হিরো, ইস্কুল-বয়েসে সেই জলজ্যান্ত মানুষটিকে একবার দেখতে গিয়েছিলাম।
আমার সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় জাহাজে চাকরি নিয়ে অনেক বন্দর ছুঁয়ে এসেছেন। খুব সম্ভবত খানিকটা অগ্রজ শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত পড়াশুনো করার জন্যে যারা বিলেত-আমেরিকায় যেত, তারা সবাই গেছে জাহাজে, আমার চোখের সামনে দিয়েই প্রায় গেছেন নবনীতা দেবসেন (তখন শুধু দেব) আর প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত।
আমি জাহাজ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়েছি একটুর জন্য। ষাটের দশক থেকেই জাহাজগুলি যাত্রী বহন করা বন্ধ করে দিয়েছিল। বিমান যাত্রাই তখন সুলভ। আমেরিকার আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে দেওয়া হয়েছিল বিশ্ব-পরিক্রমার বিমানের টিকিট। এর পরে আন্দামানের স্বল্প দূরত্ব ছাড়া আমি আর কখনও জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দিইনি।
নানান কার্যকারণবশত আমার বিদেশ ভ্রমণ প্রথমবারেই শেষ হয়ে যায়নি। আরও আমন্ত্রণ পেয়েছি বহুবার। কিন্তু কলকাতা বিমানবন্দরে আমাকে বিদায় জানাবার জন্য আত্মীয়-বন্ধু শুভার্থীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছিল ক্রমশ। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সংখ্যাটা কমতে-কমতে একেবারে শূন্য হয়ে যাবে?
প্রত্যেকবারই আর কেউ না হোক, স্বাতী অন্তত যায়। খুব ভোরে কিংবা মাঝরাত্তিরে ফ্লাইট হলে আমি নিষেধ করি, তবু সে শোনে না। আমার মা থাকেন বাগুইআটিতে, আমাকে দমদমে পৌঁছে দিয়ে স্বাতী আমার মায়ের সঙ্গেও দেখা করে আসতে পারে।
এবারেও আমার যাত্রা কাক-না-ডাকা ভোরে। অ্যালার্ম দিয়ে জাগতে হয়েছে রাত চারটের সময়। স্বাতী আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছিল, কিন্তু আগের রাতে তার জ্বর এসে গেল খুব। শেষ রাতে উঠে আমার জন্য চা তৈরি করে দিল ঠিকই, কিন্তু মুখ চোখের অবস্থা বেশ কাহিল, কাঁচুমাচু ভাবে বলল, শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে, আমি যদি তোমার সঙ্গে না যাই…। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, না, না, শুধু-শুধু যাওয়ার দরকার নেই, আজকাল তো এয়ারপোর্টের ভেতরে যাত্রী ছাড়া অন্যদের ঢুকতেই দেয় না, আমাকে নামিয়েই চলে আসতে হবে, আর এত ভোরে মা-কে জাগাবারও কোনও মানে হয় না–।
এসব বললাম বটে, কিন্তু কুয়াশামাখা প্রায়ান্ধকার রাস্তায় গাড়িতে একা যেতে-যেতে আমি স্মৃতিকাতরতা বোধ করছিলাম খানিকটা। কত দূর চলে যাচ্ছি, যদি আর ফেরা না হয়? যদিও এরকম চিন্তা অবান্তর, তবু মনে তো আসতেই পারে।
অন্যান্যবার কয়েকজন সঙ্গে আসে, বিশেষ ব্যবস্থা করে তাদের ভেতরে ঢোকানোও যায়, সুতরাং চেক-ইন করার পরও ঘণ্টাখানেক সময় পাওয়া যায় গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টার জন্য। এয়ারপোর্টে খবর দিয়ে রাখলে সিকিউরিটি কিংবা কাস্টমসের কোনও অফিসার এসে আমার দায়িত্ব নিয়ে নেন, আমাকে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। আমার পাসপোর্ট ও টিকিট তাঁরা নিয়ে ব্যবস্থা করে দেন সব কিছুর। খবর না দিলেও কেউ না কেউ চিনতে পারেন, এগিয়ে আসেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। অন্য যাত্রীদের তুলনায় আমি সুযোগ-সুবিধে একটু বেশি পাই। এবারে খবর দেওয়া হয়নি, এবং কেউ আমাকে চিনতেও পারল না। অর্থাৎ যাত্রা শুরুর আগে থেকেই একাকিত্ব।
বিশেষ খাতির যত্ন পাওয়ার যেমন তৃপ্তি আছে, তেমনি কিছু না পাওয়ারও কৌতুক বোধ থাকে। আমি লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে ভাবছি, কাস্টমস-সিকিউরিটি বা এয়ার লাইনসের কোনও বাঙালি অফিসার এসে বলবেন, এ কী, আপনি লাইনে দাঁড়িয়ে! আমাদের খবর দেননি কেন? এর ঠিক আগের বারই তো কাস্টমসের কয়েকজন তরুণ অফিসার আমাকে খাতির করে ভেতরে নিজেদের ঘরে বসিয়ে চা ও খাদ্যদ্রব্য দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন।
এবারে শেষ পর্যন্তও কেউ এল না। বরং কাউন্টারের তরুণীটি আমাকে বিপাকে ফেলে দিল। মেয়েটি বাঙালি নয়। আমার আজকাল একটা গোঁয়ার্তুমি হয়েছে, কলকাতায় থাকলে সব সময় বাংলা বলি, তা সে তাজ বেঙ্গল হোটেলই হোক বা বিমানবন্দরে। জানি, এসব জায়গায় অনেক অবাঙালি কাজ করে। তা বেশ তো, সকল ভাষাভাষীই স্বাগত, তা বলে কলকাতা শহরে চাকরি করতে হলে বাংলা ভাষাটা শিখে নিতে হবে না? প্লেনে ওঠার পর থেকে তো বাকি দিনগুলি ইংরিজিতে কাজ চালাতেই হবে, তার আগেকার কয়েক ঘণ্টাও বাংলা ছাড়তে হবে কেন? আমার বাংলা কথা শুনে এ তরুণীটি প্রথমেই আমাকে অপছন্দ করে বসল।
তরুণীটি আমার টিকিট উলটেপালটে দেখে বলল, এয়ারপোর্ট ট্যাক্স দিতে হবে।
আজকাল এয়ারপোর্ট ট্যাক্স টিকিটের সঙ্গেই জোড়া থাকে। এর আগে অনেকবার বিদেশ যাত্রায় আমাকে আলাদা করে এয়ারপোর্ট ট্যাক্স দিতে হয়নি। এবারে আমার আমন্ত্রণকারী আমাকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের টিকিট দিয়েছে। সে টিকিট সংগ্রহ করার জন্য আমাকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের শহরের কার্যালয়ে যেতে হয়েছিল দুবার। সেখানে একটি তরুণী কর্মী বলেছিল, তাদের কাছে টিকিট সম্পর্কে যে নির্দেশ এসেছে, তাতে পৃথিবীর বিভিন্ন এয়ারপোর্টের ট্যাক্স ধরা নেই। অনেকগুলি এয়ারপোর্ট আমাকে পার হতে হবে। তার জন্য আমাকে দিতে হবে সাড়ে চার হাজার টাকা। তা শুনে আমার চক্ষু কপালে ওঠার উপক্রম। আহ্বায়করা বারবার জানিয়েছেন, আমাকে বিনা পয়সায় টিকিট পাঠাচ্ছেন, আমার কোনও খরচ লাগবে না, তা হলে কলকাতায় বিমান-অফিস এতগুলো টাকা চাইছে কেন? তরুণীটি তার কোনও সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারল না, মোট কথা ওই সাড়ে চার হাজার টাকা না দিলে তার পক্ষে টিকিট দেওয়া সম্ভব নয়। অত টাকা আমি সঙ্গে নিয়ে যাইনি, পরদিন ভোরেই যাত্রা, সুতরাং ওখান থেকে বেরিয়ে সাড়ে চার হাজার ক্যাশ টাকা কোনওরকমে জোগাড় করে ফিরে আসতে হয়েছিল হুড়োহুড়ি করে।
মেয়েটি আমাকে টিকিট ও টাকার রসিদ দিয়েছিল, আমি বারবার তাকে জিগ্যেস করেছিলাম, আর কোথাও আমাকে কোনও ট্যাক্স দিতে হবে না তো? সে আশ্বস্ত করেছিল, না, সব দেওয়া হয়ে গেল। সে ঠিক কথা বলেনি। তার কথা প্রথম মিথ্যে প্রমাণিত হল দমদমে। পরে আরও হয়রান হতে হয়েছে।
দমদমের কাউন্টারের তরুণীটিকে আমি রসিদটি দেখিয়ে বললাম, এই তো সব এয়ারপোর্ট ট্যাক্স দেওয়া হয়ে গেছে।
মেয়েটি বাংলা বোঝে, কিন্তু বলবে না। সে অসহিষ্ণুভাবে খানিকটা রুক্ষ ইংরিজিতে বলল, তুমি টাকাটা দাও, না হলে পরের যাত্রীর জন্য জায়গা ছেড়ে দাও!
এসব ক্ষেত্রে তর্কাতর্কি করতে গেলে পেছনের যাত্রীদের কাছ থেকে কোনওরকম সহানুভূতি পাওয়া যায় না। কালহরণ তাদের অস্থির করে তোলে। কিন্তু একই বিমান কোম্পানির এক কর্মী আমাকে বলেছে, পৃথিবীর আর কোথাও আমাকে পয়সা খরচ করতে হবে না। আবার অন্য এক কর্মী বলছে, দেশের মাটিতেই আমাকে অতিরিক্ত কর দিতে হবে। এই গরমিলের কোনও মীমাংসা হবে না?
জানি, তর্কে কোনও সুরাহা হবে না। জীবনে অনেক অযৌক্তিক ব্যাপারই তো আমাদের মেনে নিতে হয় মুখ বুজে।
কিন্তু উপরন্তু মুশকিল এই, আমার কাছে তো একটাও ভারতীয় টাকা নেই। আনিনি। কোনও প্রয়োজনই বোধ করিনি। আমাকে যদি দু-একজন পৌঁছে দিতে আসত, তা হলে তাদের কাছ থেকে তিন-চার শো টাকা পাওয়া যেত নিশ্চিত। এই একটা একা-আসার অপকারিতা টের পাওয়া গেল।
অগত্যা বাক্স-প্যাঁটরা সেখানেই রেখে আমাকে গিয়ে লাইন দিতে হল ফরেন এক্সচেঞ্জ কাউন্টারে। নিজের দেশে ডলার ভাঙিয়ে টাকা হাতে নেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। দুর্লভ ডলার।
এক বিপত্তিকে অনুসরণ করে আসে আরও।
ফিরে আসার পর চেক-ইন কাউন্টারের তরুণীটি একটা দারুণ দুঃসংবাদ দিল।
দিনের বেলায় বিমান যাত্রায় আমি সব সময় জানলার ধারের আসন পছন্দ করি। কলকাতা থেকে সোজা লন্ডন দীর্ঘ সাড়ে দশ ঘণ্টার যাত্রা। ট্রেনে এই সময়টাকেও খুব বেশি মনে হয় না। মাটির সঙ্গে যোগ আগে বলেই হয়তো, তা ছাড়া মাঝখানের দু-একটা স্টেশনে থামে, নেমে হাত পা ছড়িয়ে নেওয়া যায়। বিমানে এই সময়টাই বেশি বেশি লম্বা হয়ে যায়, যেন কাটতেই চায় না। এতক্ষণ টানা বই পড়াও যায় না। মাঝে-মাঝে বাইরের আকাশের দিকে তাকালে চোখ জুড়োয়। আমি মেঘবিলাসী, মেঘের খেলা কখনও পুরোনো হয় না। পঁয়ত্রিশ হাজার ফিট, এভারেস্ট শিখরের চেয়েও অনেক বেশি উচ্চতায় মেঘের কত বৈচিত্র্য, পাহাড়-মেঘ, দুর্গ-মেঘ, অরণ্য-মেঘ, দুধসাগর-মেঘ, কতবার কত মেঘ দেখার স্মৃতি অমলিন হয়ে আছে। পরিষ্কার ঝকঝকে দিনে অত উঁচু থেকে পৃথিবীর ভূমিও দেখা যায়, সমুদ্র কিংবা হ্রদ, তুষারমণ্ডিত পাহাড়। একবার করাচি থেকে বেইজিং যাচ্ছিলাম, পরিষ্কার দেখা গিয়েছিল হিমালয়ের একটা অংশ পার হয়ে যাচ্ছি, তারপরই হঠাৎ মরুভূমি, টাকলা মাকান, দুদিকের প্রকৃতির এমনই কনট্রাস্ট যে রোমাঞ্চ হয়।
যারা হরদম বিমানে যাতায়াত করে, তারা অনেকেই জানলা পছন্দ করে না। তারা চায় ধারের সিট, যাতে ইচ্ছে মতন যখন তখন উঠে যাওয়া যায়। জানলার ধার থেকে কখনও টয়লেটে যাওয়ার জন্য বেরুতে গেলে পাশের যাত্রীদের খানিকটা অসুবিধে হয়ই। পাশের যাত্রীটি যদি চোখ বুজে থাকে, ঘুম ভাঙিয়ে তাকে পেরুতে লজ্জা করে। কয়েকজন আমাকে বলেছে, জানলার ধারে বসে দেখার কী আছে? খালি তো একঘেয়ে আকাশ কিংবা মেঘ! যাদের আকাশ এবং মেঘ একঘেয়ে লাগে, তারা ভিন্ন প্রজাতির মানুষ, তাদের সঙ্গে আমার বাক্য বিনিময় করতেও ইচ্ছে করে না, কিংবা, তাদের ভাষা আমি বুঝি না।
চেক-ইন কাউন্টারের মেয়েটি আমাকে বলল, জানলার ধারের সিট পাওয়া যাবে না। সব ভরতি হয়ে গেছে। আমি আকাশ থেকে পড়ার ভঙ্গিতে বললাম, আমি যে একটু আগে জানলার ধারের আসন চেয়ে গেছি। সে ফরাসি পুরুষদের কায়দায় কাঁধ ঝাঁকাল। শুধু তাই নয়, আমাকে একেবারে ধারের আসন বা আইল সিটও সে দিতে পারবে না। আমাকে বসতে হবে অন্য দুজনের মাঝখানে! অর্থাৎ লম্বা বিমান যাত্রায় সমচেয়ে কম আরামপ্রদ এবং অস্বস্তিকর জায়গা।
আমি বাংলায় কথা বলেছি বলেই কি মেয়েটি আমাকে এমন হেলা-তুচ্ছ করল? আমি বাংলায় তাকে একটা ধমক দিতেও পারতাম, কিন্তু অনেকেই জানে, আমি প্রকাশ্যে ঝগড়া খুব কমই করে থাকি। তবে নানা সময়েই মানুষের অসমীচীন ব্যবহারে ভেতরে-ভেতরে গজরাই। এমনকী যে সমস্ত গালাগালি জীবনে কখনও উচ্চারণও করি না, অব্যক্ত ভাষায় তাও অনেকের প্রতি বর্ষণ করেছি!
আমার সঙ্গে কেউ আসেনি, তাই আমাকে ডলার ভাঙিয়ে ভারতীয় টাকা নিতে হল এবং সেই দেরির জন্য আমাকে বঞ্চিত হতে হল আকাশ দেখার সুখ থেকে। এয়ারপোর্টে আগে থেকে জানিয়ে রাখলেও সবকিছু অন্যরকম হত। খাতির পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলেই কি এইসব আমার বেশি-বেশি গায়ে লাগছে? সাধারণ যাত্রীদের তো এরকমই হয়, মাঝখানের সিটে কেউ না কেউ তো বসবেই!
এমনও হয়েছে, এয়ারলাইন্সের কোনও অফিসার আমাকে চিনতে পেরে এবং অতিরিক্ত খাতির দেখিয়ে, আমার ইকোনমি ক্লাসের টিকিট থাকা সত্বেও বসিয়ে দিয়েছেন ক্লাব ক্লাসে কিংবা ফার্স্ট ক্লাসে। ফার্স্ট ক্লাসে তো রাজা-মহারাজাদের মতন আপ্যায়ন! সবচেয়ে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল জাপানে।
বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। নিপ্পন-বাংলা বন্ধুত্ব সমিতির আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম টোকিও শহরে। সেবারে আমার সঙ্গে ছিল বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদ আর কলকাতার আশিস সান্যাল। ফেরার দিনে এক দারুণ সঙ্কট। টোকিও শহরটি বিরাট লম্বা, আমরা যেখানে উঠেছিলাম, সেখান থেকে নরিতা এয়ারপোর্ট পৌঁছতে লাগে আড়াই ঘণ্টা। যে-বাংলাদেশি যুবকটি আমাদের পৌঁছে দেবে তার গাড়িতে, সে এল একটু দেরি করে, পথে যানজটে আটকে গিয়েছিল, আমাদের যাত্রা শুরুর পর বৃষ্টি নামল প্রবল তোড়ে এবং মাঝে-মাঝেই কঠিন কঠিন
যানজট। এই বৃষ্টি ও যানজট গন্তব্যে পৌঁছবার সময়ের মধ্যে গণ্য করা হয়নি, সুতরাং বিমানবন্দরে পৌঁছতে খুবই দেরি হয়ে গেল, সকাল এগারেটায় ফ্লাইট, আর মাত্র ন’মিনিট বাকি! কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে।
আমাদের টিকিট বাংলাদেশ বিমানের। কাউন্টার সামলাচ্ছে দুটি জাপানি মেয়ে। তারা জানাল যে আর কোনও উপায় নেই, মালপত্র সব তুলে দেওয়া হয়েছে, বিমান থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, এখন আর যাত্রী তোলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
রফিক ও আশিসের সেই প্রথম বিদেশ যাত্রা। ওদের তুলনায় আমি যেহেতু অনেকবার আন্তর্জাতিক বিমানে যাওয়া আসা করেছি, তাই আমি জানি, এ অবস্থায় অনুরোধও করা যায় না। আমাদের জন্য তো ফ্লাইট বিলম্বিত হতে পারে না। বৃষ্টি এবং যানজটের কারণে যে আমাদের পৌঁছতে দেরি হয়েছে, তার জন্য তো এয়ারলাইন্স দায়ী নয়।
কিন্তু আমাদের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতি। বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট সপ্তাহে মাত্র একবার, অর্থাৎ আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও সাতদিন। রফিক আজাদের ভিসার সেদিনই শেষ দিন, জাপানে ভিসার ব্যাপারে খুবই কড়াকড়ি। তা ছাড়া, এই সাতদিন আমরা থাকব কোথায়? জাপান পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ।
রফিক আজাদের গোঁফ বিখ্যাত, তার মুখমণ্ডলে সেটাই সবচেয়ে দর্শনীয়। কিন্তু জাপানের রাস্তাঘাটে একজনও গোঁফওয়ালা মানুষ দেখা যায় না। ওদেশের সম্রাট ছাড়া কেউ গোঁফ রাখে না, তাই রফিক লজ্জায় ও ঝোঁকের মাথায় তার গোঁফ কামিয়ে ফেলেছিল। একেই তো গোঁফের অভাবে সে ম্রিয়মাণ, তার ওপর ভিসা ফুরিয়ে যাওয়া–এই সংকটে সে একেবারে চুপ। আমিও ধরেই নিয়েছি আজ আর যাওয়া হবে না এই সাতদিনের জন্য অন্য ব্যবস্থা চিন্তা করতে হবে। শুধু আশিস সান্যাল উত্তেজিতভাবে বারবার বলতে লাগল, আমাদের যেতেই হবে, যে-কোনও উপায়ে, আমরা থাকব কোথায়, ভিসাও ফুরিয়ে গেছে, আমাদের কাছে আর টাকাও নেই…। তার এই সরল স্বীকারোক্তি ও দাবিতে জাপানি মেয়ে দুটি একটুও বিচলিত হয় না, তারা যন্ত্রের মতন নিয়ম মেনে চলে। আশিসের প্রতি তারা একটিই বাক্য ব্যবহার করে, পৃথিবীর বহু এয়ারলাইন্সের কর্মী নানা অবস্থায় এই বাক্যটি যখন তখন বলে, লন্ডনেও আমাকে আর একবার শুনতে হয়েছিল, সে কাহিনি পরে বলা যাবে) সে বাক্যটি হল, দ্যাটস ইয়োর প্রবলেম! অর্থাৎ এয়ারলাইন্সের যদি কোনও গাফিলতি না থাকে, তা হলে তুমি যে বিপদে পড়েছ, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে যাব কেন? তোমার থাকায় জায়গা, ভিসা, টাকাপয়সা আছে কিনা, তা নিয়ে তুমি মাথা ঘামাও!
আশিস তাতেও নিরুদ্যম হল না। আশঙ্কায় তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত আশিসেরই জয় হল প্রকারান্তরে। সে বারবার একই কথা বলায়, একটি মেয়ে খানিকটা বিরক্ত হয়ে টেলিফোন তুলে বলল, টক টু দ্য ম্যানেজার। অর্থাৎ বাংলাদেশ বিমানের ম্যানেজার সেই এয়ারপোর্টেরই কোথাও বসে আছেন। বাংলায় কথা বলার সুযোগ পেয়ে আশিস নবোদ্যমে সব বলতে লাগল আবার, ম্যানেজার মশাই তাকে থামাবার চেষ্টা করে জানাতে লাগলেন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে এভাবে দেরি করা যায় না। কথার তোড়ের মধ্যে আশিস একবার আমার নাম উচ্চারণ করে বলল, আমাদের সঙ্গে ইনি রয়েছেন, কলকাতায় তাঁর আগামীকালই খুব জরুরি কাজ আছে। ম্যানেজার জিগ্যেস করলেন, কী নাম বললেন? আশিস আবার আমার নাম বলায় ম্যানেজার বললেন, দাঁড়ান, আমি আসছি।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে দীর্ঘকায় সুদর্শন ম্যানেজারবাবু হন্তদন্ত হয়ে এসে তিনজনের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, আপনাদের মধ্যে উনি কোন জন?
রফিক ও আশিস আমাকে দেখিয়ে দিল।
তিনি তো খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে জিগ্যেস করলেন, ‘পূর্ব পশ্চিম’ আপনিই লিখেছেন?
কী করে প্রমাণ করব যে উক্ত উপন্যাসটি লেখার মতন অপকর্ম আমিই করে ফেলেছি? কিংবা এই ব্যক্তিটি যদি ওই বইটি পড়ে খুবই বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে থাকেন (হতেই পারেন) তা হলে এখন, এই অবস্থায় পূর্ব পশ্চিমের পিতৃত্ব স্বীকার করা কিংবা অস্বীকার করা, কোনটা সঙ্গত হবে? এমন বলাই যায়, না, না। আমি নই, একই নামের অন্য ব্যক্তি।
আমাকে মুখে কিছু বলতে হল না। আশিসই অত্যুৎসাহে জানাল, হ্যাঁ। হ্যাঁ, উনিই।
এবারে ভদ্রলোক সবিস্ময়ে কয়েক পলক আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কী আশ্চর্য কোয়েনসিডেন্স, আমি সেই বইটাই একটু আগে পড়ছিলাম, ফার্স্ট পার্টের দুশো সাঁইত্রিশ পৃষ্ঠায়, আর আপনি এখানে–
তৎক্ষণাৎ তিনি ফোনে প্লেনটি থামাবার নির্দেশ দিলেন। আমাদের মালপত্র চেক-ইন হল না। কনভেয়ার বেল্টে চাপাবার সময় নেই, সেগুলি হাতে নিয়েই আমাদের দৌড়তে হল, ম্যানেজার মহোদয় নিজেও আমাদের একটি সুটকেস বইতে লাগলেন, প্লেনে আবার সিঁড়ি জোড়া হল। বড় বড় সুটকেস সঙ্গে নিয়ে এয়ারক্রাফটের মধ্যে যাওয়া যে সম্ভব, তাই-ই আমি জাগে জানতাম না। শুধু তাই নয়, আমাদের বসিয়ে দেওয়া হল ফার্স্ট ক্লাসে, এবং ম্যানেজারের নির্দেশ মতন সমস্ত যাত্রা-সময়টিতে বিমান কর্মীরা আমাদের তোয়াজ করতে লাগলেন অনবরত। সেই দিনই প্রথম মনে হয়েছিল, ভাগ্যিস দু-চারখানা বই লিখে ফেলেছিলাম, তাই তো আজ উদ্ধার পাওয়া গেল সমূহ দুর্বিপাক থেকে।
বাংলার গ্রন্থ রচনার জন্য অপ্রত্যাশিত খাতির পেয়েছিলাম জাপানে, বাংলাদেশ বিমানের কাছ থেকে, আর বাংলায় কথা বলার জন্য আমারই নিজের জায়গা কলকাতার বিমান বন্দরে আমাকে পেতে হল এমন তাচ্ছিল্য? হয়তো তা নয়, আমি বেশি-বেশি স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছি, মেয়েটি সূক্ষ্মভাবে তার কর্তব্য করে যাচ্ছে মাত্র। তবু, জানলা দিতে না পারার জন্য সে একটু সামান্য দুঃখ প্রকাশ করলেও তো পারত।
এই দমদমেই আর একবার একটি মজার কাণ্ড হয়েছিল।
সেবারে যাচ্ছিলাম মস্কো, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ানের আমল, সেখানকার সরকারের আমন্ত্রণ বলে টিকিট দেওয়া হয়েছিল এরোফ্লোট বিমানের। সে সময়ে এরোফ্লোটের কোনও সিট নাম্বার থাকত না। যাত্রীরা সবাই সমান, আগে থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে যে যেখানে দৌড়ে গিয়ে বসতে পারে। সেবারে আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আমাদের বিশেষ পারিবারিক বন্ধু রণজিৎ গুহ, রাইটার্স বিল্ডিংস থেকে জেলখানা, সব জায়গার কর্তাব্যক্তিদের চিনতেন তিনি। এরোফ্লোটের কাজকর্ম দেখাশুনো করতেন এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসাররা, সেখানে রয়েছে আমার ছোট শ্যালিকার স্বামী পার্থ মুখোপাধ্যায়। সুতরাং আমাকে বিশেষ খাতির দেখাবার জন্য অনেকেই ব্যস্ত। অন্য যাত্রীরা একজনও ওঠার আগে আমাকে নিয়ে আসা হল ফাঁকা এয়ারক্র্যাফটে। একেবারে সামনের দিকে পা-ছড়াবার মতন আরামদায়ক জায়গায় জানলার ধারে বসিয়ে দেওয়া হল, তারপর উঠল অন্য যাত্রীরা। একটু বাদে সিঁড়ি পড়ে গেল, দরজা বন্ধ হল, তবু বিমানটা ছাড়ে না, নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও। জানলা দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি, তখনও রণজিৎদা, স্বাতী ও আরও অনেকে দাঁড়িয়ে আছে টারম্যাকের এক প্রান্তে। হাওয়া-সেবিকারা ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছে, তাদের চোখে মুখে উদ্বেগের ছাপ। ক্রমে জানা গেল যে, সবাই বসার পর যাত্রী-যাত্রিণীদের মাথা গুনে নেওয়ার একটা প্রথা আছে, বিমান কর্মীরা অনেকে মিলে যতবার গুনছেন, কিছুতেই হিসেব মিলছে না, বেশি হয়ে যাচ্ছে একটি মাথা। শেষ পর্যন্ত সবার বোর্ডিং কার্ড পরীক্ষা করে দেখা হতে লাগল। আমার বোর্ডিং কার্ডটা বার করার পরই বোঝা গেল, সেটির তলার অংশ ঘেঁড়া হয়নি। দু-তিনজন হাওয়া-সেবিকা তাদের সুন্দর মুখে এমন ক্রোধ-চঞ্চল নয়নে তাকাল, যেন আমাকে একেবারে ভস্ম করে দেবে! আমার জন্যই দেরি। আমার জন্যই বিমানটি মাটি ছেড়ে উড়তে পারছিল না। আমি অপরাধী মুখে বারবার ক্ষমা চেয়েছিলাম, যদিও প্রত্যক্ষভাবে আমি দায়ী নই।
অনেকবারই অনেক রকম ঘটনা ঘটেছে, তবে এবারের মতন এমন মুখ চুন করে কখনও দেশ ছাড়িনি। অন্যবার দু-চারজন যাত্রী-যাত্রিণী অন্তত চেনা বেরিয়ে যায়। এবারে একজনও সেরকম কেউ ডেকে কথা বলল না, ইমিগ্রেশন-কাস্টমস-সিকিউরিটিতে কোনও ব্যক্তিই পাসপোর্টে আমার নাম দেখেও উচ্চবাচ্য করল না। যেন নিজের দেশ নয়, আমি অন্য কোনও অচেনা দেশের বিমানবন্দরে বসে আছি।
এবারের বিদেশ যাত্রা সম্পর্কে আমার বেশ বেশিই আগ্রহ ও উদ্দীপনা ছিল, এখন সব যেন চুপসে গেছে, যেন মনে হচ্ছে, আমাকে পাঠানো হচ্ছে নির্বাসনে। আর কোনও দিনও ফেরা হবে না।