[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

২১. যাঁর বাড়িতে উঠেছি

লস এঞ্জেলিসে আমরা যাঁর বাড়িতে উঠেছি, ধরা যাক, তাঁর নাম তাপসবাবু। তিনি ছেলেবেলায় কোনও বইতে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি সুন্দর বর্ণনা পড়ে ঠিক করেছিলেন, জীবনে কোনও না কোনওদিন ক্যালিফোর্নিয়া দেখতে যাবেনই। তারপর চাকরি জীবনে নানা জায়গা ঘুরতে-ঘুরতে, ইউরোপ হয়ে, শেষ পর্যন্ত সেই ক্যালিফোর্নিয়াতেই থিতু হয়ে বসেছেন। এবং তাঁর স্বপ্ন ভঙ্গ হয়নি, তাঁর কল্পনার ক্যালিফোর্নিয়ার সঙ্গে বাস্তবের জায়গাটিও মিলে গেছে।

ইওরোপেও এরকম একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, যিনি স্কুল জীবনে মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘লাফা যাত্রা’ পড়ে মনে মনে সংকল্প নিয়েছিলেন যে-কোনও উপায়ে একদিন না একদিন তিনিও হিচ হাইকিং করে সারা ইওরোপ ঘুরবেন। আজ তিনি কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে ইওরোপ প্রবাসী। এখন আর হিচ হাইকিং করেন না অবশ্য। নিজের গাড়ি চালিয়েই যখন তখন ফ্রান্স থেকে জার্মানি কিংবা সুইটসারল্যান্ড কিংবা ইতালি চলে যান।

ক্যালিফোর্নিয়ার তাপসবাবুর চেহারা আর পাঁচজন বাঙালিবাবুর মতন হলেও তিনি কিন্তু আর বাঙালি নন। তিনি এখন আমেরিকান। বেশ কয়েক বছর আগেই তিনি পুরোদস্তুর মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়েছেন, এখানকার নির্বাচনে ভোট দেন, এখানকার ফুটবল খেলায় তাঁর নিজস্ব প্রিয় দল আছে, সেই দলের জয়ে তিনি উল্লসিত হন, পরাজয়ে মূহ্যমান। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ব্যাপারে তাঁর কোনও আগ্রহ নেই। ভারতবর্ষ এখন তাঁর পূর্বপুরুষদের দেশ। যেমন অনেক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান মাঝে-মাঝে পূর্বপুরুষদের দেশ দেখবার জন্য আয়ারল্যান্ডে কিংবা জার্মানিতে কিংবা রাশিয়ায় যায়, সেই রকম তাপসবাবুও ক্বচিৎ কখনও কলকাতায় যাওয়ার কথা ভাবেন। ওঁর স্ত্রী-ও অবশ্য বাংলার মেয়ে। ঝুমুর দেবী পড়াশুনো করতে বিদেশে এসেছিলেন, তারপর চাকরি, তারপর এর সঙ্গে পরিচয় এবং বিবাহ। ঝুমুর দেবীর বরং প্রাক্তন স্বদেশ সম্পর্কে টান একটু বেশি মনে হয়। নানা প্রসঙ্গে সেই কথা এসে পড়ে। এই ঝুমুর দেবী আমাদের দীপকদার মাসতুতো কিংবা পিসতুতো বোন।

আবার এর উলটোটাও দেখা যায়। পনেরো-কুড়ি বছর ধরে প্রবাসী বাঙালি দম্পতির হঠাৎ একদিন মনে হয়, আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে, এবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশে ফেরা যাক। বিশেষত ছেলেমেয়েরা বড় হতে শুরু করলেই মন এরকম উন্মনা হয়। এ দেশের নিয়ম অনুযায়ী ছেলেমেয়ে আঠারো বছর বয়সে পা দিলে ঘরছাড়া হয়ে যাবেই। সারা জীবনে আর ক’বার তাদের মুখ দেখতে পাওয়া যাবে সেটাই সন্দেহ। স্বাবলম্বিনী হওয়ার আগেই মেয়ে তার বয় ফ্রেন্ডের সঙ্গে ডেটিং করতে চলে যাবে, সারারাত হয়তো বাড়িই ফিরল না। বাঙালি বাবা মায়েদের হৃদয় এখনও এটা ঠিক মেনে নিতে পারে না। সুতরাং তার আগে আগেই যদি দেশে ফেরা যায়…। সমস্যা অনেক, এখানকার জীবনযাত্রার মান দেশে ফিরে গিয়ে পাওয়া অসম্ভব। একটা ভদ্রমতন, সম্মানজনক চাকরি পাওয়াও খুব শক্ত, উপযুক্ত বাসস্থান জোগাড় করারও সমস্যা আছে। গুণী সন্তানদের দেশে ফিরিয়ে আনবার জন্য ভারত সরকার অনেক রকম ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে শোনা যায়। তবে অবস্থাটা অনেকটা সেই রকম, ‘খোকন, সত্বর ফিরিয়া আইস। মা শয্যাশায়ী। তুমি যাহা চাহিয়াছিলে তাহাই পাইবে–’ এই বিজ্ঞাপন বেরুবার পর খোকন যেদিন সত্যিই বাড়ি ফিরে এল, সেদিন তার পিঠে বাবা-জ্যাঠার লাঠির ঘা পড়তে লাগল দমাদ্দম করে। তবু, এরকম ঝুঁকি নিয়ে স্বামী ফিরে আসতে চাইলেও স্ত্রীর দ্বিধা কাটতে চায় না। অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝাঁপ দিতে পুরুষরা যতটা উৎসুক, মেয়েরা ততটা নয়।

অবশ্য, পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের ছোট করবার জন্য এ কথা বলছি না। হিসেবি, কৃপণ, ভীতুর ডিম পুরুষ মানুষ কি নেই? পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি বেপরোয়া, দুঃসাহসিনী নারীও আমি দেখেছি। আসল কথাটা হল, বিদেশে মেয়েরা অনেকখানি স্বাধীনতা পায়, যতটা সমান অধিকার সেখানে ভোগ করে, যেমন আত্মসম্মান বজায় রেখে চলতে পারে, তেমন তো দেশে ফিরে এসে পারে না। তাই তারা ইতস্তত করে বেশি। অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী এ ব্যাপারে একমত, তবু সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হয়। ছেলেমেয়েদের মতামতেরও তো প্রশ্ন আছে। যেসব শিশুরা এইসব দেশে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, এখানেই বেড়ে উঠেছে, এখানকার তুষারের মধ্যে খেলা করেছে, এখানকার স্কুলে বন্ধুবান্ধব পেয়েছে, এখানকার জল হাওয়া রোদে যাদের শরীর গড়ে উঠেছে, তাদের তো এইসব জায়গাই প্রিয় হবে। বাংলার মাটি কিংবা কলকাতার ধুলো সম্পর্কে তো তাদের কোনও নস্টালজিয়া থাকার কথা নয়।

অনেকরকম বাঙালির সঙ্গে দেখা হয় এখানে ঘুরতে-ঘুরতে। একদিন একটা বাড়িতে গেছি। পাশের ঘরে একজনের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠেছিলুম। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এদেশে এসেছেন নাকি? ঠিক যেন তিন পয়সার পালার সংলাপ শুনছি! পরে আলাপ হল, অজিতেশ নন, তাঁর ভাই মোহিতেশ। একইরকম গলার আওয়াজ, একইরকম সদালাপী ও সুরসিক। তবে দৈর্ঘ্যে অজিতেশের চেয়ে একটু কম। মোহিতেশ একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, পেট্রোল অনুসন্ধানের ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ, একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির উচ্চপদে কাজ করতেন, আমরা থাকতে থাকতেই ওঁর আরও উঁচু পদে প্রমোশন হল। দেশের প্রতি ওঁর আন্তরিক টান আছে, দেশের অবস্থার জন্য উনি গাঢ় দুঃখ বোধ করেন। দেখা হলেই এ বিষয়ে আলোচনা হত। ভারতবর্ষের তো এমন দরিদ্র থাকার কোনও কারণ নেই, খাদ্যে ভারত স্বয়ম্ভর, যন্ত্রপাতি উৎপাদনেও কারুর থেকে পিছিয়ে নেই। অভাব শুধু পেট্রোলের, যা ছাড়া আধুনিক সভ্যতা অচল। যত বৈদেশিক মুদ্রা ভারত রোজগার করে, তা সবই খরচ হয়ে যায় শুধু পেট্রোল কেনবার জন্য। মোহিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে ভারতেও যথেষ্ট পেট্রোল আছে, কিন্তু তা উদ্ধার করার জন্য যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা যে কেন গ্রহণ করা হচ্ছে না তা কে জানে। একজন আন্তর্জাতিক পেট্রোল বিশারদের মতে, বড়-বড় নদীগুলোর মোহনায় পেট্রোল পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। সেই অনুযায়ী গঙ্গার মোহনায় নিবিড় অনুসন্ধান হল না কেন? মোহিতেশ আরও বললেন, জানেন ভারত সরকার অনেক সময় আমেরিকা বা কানাডা থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে যান, তাদের মাইনে হয় ভারতীয় বিজ্ঞানীদের চেয়ে পঁচিশ-তিরিশ গুণ বেশি। এরকম পরিবেশে কাজ হয়? অথচ, অনেক ভারতীয় বিশেষজ্ঞ (যেমন মোহিতেশ নিজেই একজন, এটা আমার সংযোজন) এদেশে অনেক আমেরিকান-কেনেডিয়ানের চেয়ে উঁচু পোস্টে, বেশি মাইনের কাজ করেন।

বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ভালো ছাত্র ছাড়াও আরও অনেক রকম বাঙালির সন্ধান পাওয়া যায় এদেশে। ট্যাক্সি চালক কিংবা হোটেলের পরিচারক হিসেবে কোনও বাঙালিকে দেখলে চমকে উঠি। অনেক ভাগ্যান্বেষী বাঙালি এদেশে এসে ভাগ্য ফিরিয়ে ফেলেছে। বাঙালি ব্যাবসা করছে শুনলে আমরা এখনও আশ্চর্য হই। কিন্তু আলামোহন দাস ধরনের দু-একজন বাঙালিকেও এদেশে দেখা যায়। অবশ্য পাঞ্জাবি এবং গুজরাতিরাই এ ব্যাপারে অনেক বেশি অগ্রণী।

একজন বাঙালি যুবকের সঙ্গে আলাপ হল এখানে। প্রথম কিছুদিন টুকটাক চাকরি ও নানারকম কষ্ট সহ্য করবার পর এখন তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর ব্যাবসা রিয়েল এস্টেটের, অর্থাৎ জমি ও বাড়ি বিক্রি করা। ক্যালিফোর্নিয়ায় জনসংখ্যা হু-হুঁ করে বাড়ছে, সেই জন্য বাড়ির খুব চাহিদা। ইনি পতিত জমি উদ্ধার করে সেখানে বাড়ি তৈরি করে বিক্রি করেন। এই ব্যাপারে তাঁর বেশ সুনাম হয়ে গেছে। ভারতীয় ব্যাবসায়ীরা দেশ থেকে যেসব অভিজ্ঞতা নিয়ে যান, তার মধ্যে প্রধান হল ঘুষ দেওয়া। ঘুষের ব্যাপারে বেশ একটা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আছে। সেখানে ভারতীয়রাও পিছপা হয় না। ওই যুবকটির কাছ থেকে একটা গল্প শুনেছিলুম। উনি এক জায়গায় জমি কিনে অনেকগুলি বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু সেই জায়গাটি বসত বাড়ির উপযুক্ত নয়, এই কারণ দেখিয়ে নগর স্থপতি প্ল্যানটি বানচাল করে দিলেন। তখন উনি নগরীর মেয়রকে প্রস্তাব দিলেন যে আস্ত একটি বাড়ি তাকে উপঢৌকন দেবেন। সঙ্গে-সঙ্গে সব প্ল্যান পাস হয়ে গেল। আমেরিকায় সব কিছুই তো বড়-বড়, তাই ঘুষের ব্যাপারটাও ছোটখাটো হলে চলে না। পঞ্চাশ-একশো টাকা ঘুষ দিতে গেলে এরা খুব নীতিবাগিশ হয়ে যাবে, কিন্তু এক লাখ টাকা দিলে আনন্দের সঙ্গে লুফে নেবে। ঘুষ নিয়ে ধরা পড়াটা দারুণ অপরাধ। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট কার্টারের ভাই তার দাদার নাম ভাঙিয়ে এক জাপানি কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিল, কাগজওয়ালারা সেটা ফাঁস করে দিয়ে বেচারিকে একেবারে নাজেহালের একশেষ করে দিয়েছে।

লস এঞ্জেলিসের অনেক দোকানের বাইরে দুটি বিজ্ঞাপন দেখে আমি বড় মজা পেয়েছি। একটি হল, ‘এখানে খাঁটি ইম্পোর্টেড জিনিসপত্র পাবেন।’ আর অন্যটি ‘আমরা আসল বিদেশি জিনিস রাখি।’ ফরেন জিনিসের প্রতি ভারতীয়দের আসক্তি নিয়ে আমরা অনেক ঠাট্টা ইয়ার্কি করি। কার বাড়িতে ক’টা ইম্পোর্টেড গুডস আছে, তাই দিয়ে ঠিক হয় সামাজিক পদমর্যাদা। এইসব ফরেন বা ইম্পোর্টেড গুডস বলতে অধিকাংশ সময়েই বোঝায় আমেরিকান। অথচ খোদ আমেরিকাতেও বিদেশি ও ইম্পোর্টেড জিনিসের প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন থাকে। আবার মনে হল, মানুষের চরিত্র সব জায়গাতেই এক।

আমেরিকানদের কাছে এই লোভনীয় বিদেশি দ্রব্য অবশ্য সবই প্রায় জাপানি। বিশেষত জাপানি গাড়ি ও গাড়ির পার্টস!

লস এঞ্জেলিস ছাড়বার আগের দিন আমরা গেলুম সান ডিয়েগোর ‘সমুদ্র জগৎ’ দেখতে। অনেক দেশ ঘুরে অনেক কিছু দেখতে-দেখতেও এরকম অনুভূতি খুব কমই হয় যে, আঃ, আজ এটা যা দেখলুম, এটা একেবারে অকল্পনীয় ছিল। সান ডিয়েগোতে এসে আমার সেইরকম অনুভূতি হয়েছিল। এ একেবারেই অভাবনীয় এবং সত্যিকারের নতুন।

সান ডিয়েগোতে প্রধান দ্রষ্টব্য দুটি, চিড়িয়াখানা এবং সমুদ্র জগৎ। পুরো একদিনে একটার বেশি দেখা যায় না। সময়াভাবে আমাদের যেকোনও একটা বেছে নিতে হবে, তাই আমরা ‘সমুদ্র জগৎ’ যাব ঠিক করলুম। অন্যটি দেখিনি বলে জানি না আমাদের নির্বাচন ঠিক হয়েছিল কি না, কিন্তু যা দেখেছি, তার তুলনা নেই।

লস এঞ্জেলিস থেকে সান ডিয়েগো ঘণ্টাতিনেকের পথ। একদিন সকালে আমরা সবাই মিলে সেজেগুঁজে বেরিয়ে পড়লুম। জিয়া আর প্রিয়া নামের বালিকা দুটির উৎসাহই বেশি, কারণ, এর মধ্যে দু-একদিন ওদের বাড়িতে রেখে আমরা বড়রা একটু আলাদা ঘোরাঘুরি করেছিলুম। আবার আমরা সকলে এক সঙ্গে। জয়তীদি যেদিন শাড়ি পরেন সেদিন তাঁর চেহারা একরকম, আবার যেদিন জিনস পরেন সেদিন একেবারে সম্পূর্ণ অন্যরকম। তা ছাড়া শাড়ি পরলে উনি বেশ নরম মেজাজে থাকেন আর দুঃখী দুঃখী বাংলা গান করেন। আর যেদিন জিনস পরেন সেদিন একেবারে টম বয়। কোনদিন কোনটা পরবেন, সেটা অবশ্য ওঁর খেয়ালের ওপর নির্ভর করে। আজ জয়তীদি নিজে জিনস পরেছেন তো বটেই, ওঁর লাজুক মেজদিকেও ওই পোশাক পরিয়েছেন। মেজদির ধারণা, উনি শাড়ির বদলে জিনস পরেছেন বলে সারা পৃথিবীর লোক ওঁর দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও এখানকার লোকেরা কে কী পোশাক পরল তা নিয়ে ক্ষেপও করে না। বাচ্চা মেয়ে দুটি সব সময়ই জিনস পরে। আর দীপকদার পোশাক তো একটাই। একটা রংচটা জিনস আর একটা মেটে সিঁদুর রঙের ইষৎ ছেঁড়া গেঞ্জি। ছ’দিন সাত দিন ধরে দীপকদাকে ওই একই বস্ত্রে দেখা যায়। জয়তীদির ঝাঁজালো অনুরোধে উনি যদি বা কোনও এক সকালে পাট ভাঙা জামা-প্যান্ট পরলেন, কিন্তু বিকেলেই তা ছেড়ে আবার জিনস ও গেঞ্জিতে প্রত্যাবর্তন। আজ আমি ও শিবাজিও জিনস পরে ফেলায় আমাদের পুরো দলটাকেই জিনস পার্টি বলা যায়।

জিনস নামের এই প্রায় চটের কাপড়ের প্যান্টালুন এক সময় ছিল আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণির পোশাক, এখন বাকি সবাই জিনস পরে, শুধুশ্রমিক শ্রেণি অন্য পোশাকে বাবুয়ানি করে।

প্রশান্ত মহাসাগরের পাশ দিয়ে দিয়ে চমৎকার পথ। দীপকদার গাড়িটি বাতানুকূল, তা সত্বেও আমরা কাঁচ নামিয়ে দিলুম সমুদ্রের হাওয়া খাওয়ার জন্য। দূর থেকে সান ডিয়েগোকে অলকাপুরীর মতন সুন্দর দেখায়। এক সময় আমাদের গাড়ি এসে থামল সি ওয়ার্ল্ড-এর গেটের সামনে। ডিজনিল্যান্ডের মতন এখানেও দশ টাকার টিকিট কিনে ঢুকলে সারাদিন ধরে সব কিছু যতবার খুশি দেখা যায়।

দেখবার যে কতরকম জিনিস, তার ইয়ত্তা নেই। এখানেও সেই আমেরিকান বিশালতা। অল্পে সন্তুষ্ট হওয়ার জাত এরা নয়। ডিজনিল্যান্ডে যেমন অনেক উদ্দাম কল্পনাকে চাক্ষুষ করা হয়েছে নানারকম যন্ত্রপাতি দিয়ে, এখানে তেমন শুধু জল ও জলজ প্রাণীর খেলা। না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

সমুদ্রের জলকে টেনে আনা হয়েছে অনেকখানি ভেতরে। এক এক জায়গায় বাঁধন দিয়ে সেখানে স্টেডিয়াম বা গ্যালারি বা সিনেমা হলের মতন, সেখানে বসে-বসে প্রতিবার এক-একটি অদ্ভুত জিনিস প্রত্যক্ষ করছি।

ডলফিন বা শুশুক মানুষের পোষ মানে জানতুম, কিন্তু হাঙর? সিন্ধুঘোটক, এমনকী তিমি? মানুষের এই বিস্ময়কর ক্ষমতায় স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। ওয়ালরাস ও ডলফিন নিয়ে নাটক, কালো তিমি মাছের নাচ? এর মধ্যে কোনওটাই কৃত্রিম বা সাজানো নয়। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে এসব দেখতে-দেখতে আমাদের কৌতূহল ও বিস্ময় ক্রমশই বেড়ে যায়। এসব দৃশ্য দেখবার, বর্ণনা করবার নয়। তবে শামুর কথা বলতেই হয়। শামু একটি খুনি তিমির আদরের ডাক নাম। তার ওজন সাত টন না চোদ্দো টন কত যেন। পৃথিবীর বৃহত্তম এবং ভয়ংকরতম প্রাণী। গ্রিক দেবতার মতন রূপবান একজন যুবকের নির্দেশে সে নানান খেলা দেখায় আমাদের, এমনকী একবার হুকুম শুনে জল থেকে তিরিশ-চল্লিশ ফিট উঁচুতে লাফিয়ে উঠে আমাদের অভিবাদন জানায়। যুবকটি তাকে এক বালতি মাছ খেতে দিয়ে আদর করে এবং শামুর পিঠে চড়ে বসে। তারপর সেই অতিকায় তিমি ও গ্রিক দেবতা জলের ওপর দিয়ে চলে যায় রূপকথার জগতে।

এইসব দেখতে-দেখতে আমি জিয়া ও প্রিয়ার দিকে তাকাই। বালিকা দুটির চোখের মুগ্ধতা দেখে বোঝা যায়, ওরা এখানে নেই, ওরা রয়েছে এখন ওদের কল্পলোকে।