[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

২৪. এবার তাহলে সেই ঘটনাটা লিখি

এবার তাহলে সেই ঘটনাটা লিখি? যে-ঘটনাটার এক চুল এদিক-ওদিক হলেই আমি এতদিনে স্বর্গে গিয়ে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের সঙ্গে বেলের পানা খেতুম কিংবা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিমপাতার রস খেতে-খেতে আধুনিক কবিতা বিষয়ে তর্ক করতুম কিংবা কার্ল মার্কসের সঙ্গে চা খেতে-খেতে চিন ও রাশিয়ার ঝগড়া বিষয়ে তাঁর মতামত জেনে নিতুম। কিংবা ওসব কিছুই না করে একালের উর্বশী মেরিলিন মনরোর সাহচর্য লাভে ধন্য হতুম।

কিন্তু একটুর জন্য আমি আমার নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসাবার সেই সুবর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি।

মদনদাদের সঙ্গে দিন দু-এক তো দারুণ হইচই করে কাটল সানফ্রান্সিসকো শহরে। যেমন সুন্দর শহর, তেমনই ঝকঝকে দিন আর নরম রাত্রি। এই শহরটির বৈশিষ্ট্য হল, যে-কোনও দিকে মিনিট পাঁচ-দশ গেলেই সমুদ্র চোখে পড়ে। এই শহরে এখনও আছে পুরোনো আমলের ট্রাম, আবার এমন অত্যাধুনিক বহুতল বাড়ি আছে যে দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। শহরের মাঝামাঝি রয়েছে বিরাট চিনে পাড়া, যেখানে গেলে মনে হয় মূল চিন ভূখণ্ডে পৌঁছে গেছি। রাস্তায় টাটকা চিনে শাক সবজি বিক্রি হচ্ছে, সিনেমা হলে চিনে ছবি, ব্যাঙ্কের নাম চিনে ভাষায় লেখা। এখানকার কোনও কোনও চিনে খুবই বড়লোক। একবার শুনেছিলুম, কোনও একজন। চিনে ব্যাঙ্কার গোটা সানফ্রান্সিসকো শহরটাই কিনতে চেয়েছিল।

নানান দ্বীপের সঙ্গে সানফ্রান্সিসকো শহরটি জোড়া। এখানকার গোল্ডেন গেট ব্রিজ জগদ্বিখ্যাত। এমন নিখুঁত স্মার্ট চেহারার ব্রিজ দেখলে সত্যিই আনন্দ হয়। কোনও প্রয়োজন নেই, তবু এমনি এই ব্রিজে বারবার এপার-ওপার হতে ইচ্ছে করে। যে-দ্বীপটিতে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় অধিষ্ঠিত, মূল শহরের সঙ্গে সেই দ্বীপটি একটি সাড়ে আট মাইল লম্বা ব্রিজ দিয়ে জোড়া। অবশ্য এক লাফে সমুদ্রলঙ্ঘনের সময় হনুমান যেমন মাঝখানে একবার এক ডুবো পাহাড়ে একটু পা ছুঁয়েছিল, সেই রকম এই সাড়ে আট মাইল লম্বা ব্রিজটিও একবার এক জায়গায় কিছু পাথরের স্কুপে পশ্চাৎদেশ ঠেকিয়েছে।

একদিন সকালবেলা গিয়েছিলুম বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে। হার্ভার্ড বা ইয়েলের মতন তেমন কুলীন নয় বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়, তবু এর খ্যাতি অন্য কারণে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই নানান আন্দোলনের জন্ম হয়েছে, সিভিল রাইটস, উইমেনস লিব, ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ, আণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বিরোধী মিছিল ইত্যাদি। অনেক হাঙ্গামা হয়েছে এখানে, পুলিশি আক্রমণে অনেক রক্ত ঝরেছে, তবু এখানকার ছাত্রছাত্রীরা অসম সাহস দেখিয়েছে।

আমরা যেদিন গেলুম, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি। সব দিক অসম্ভব শান্ত। এখানে-সেখানে ঘাসের ওপর অলসভাবে শুয়ে আছে এক জোড়া করে ছেলেমেয়ে, অতিরিক্ত পড়ুয়া কেউ-কেউ সাইকেলের পেছনে এক গাদা বইপত্র চাপিয়ে চলেছে লাইব্রেরিতে। আমেরিকার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসই এত বড় যে ভেতরে বাস চলে, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার জন্য। বার্কলের ক্যাম্পাস যেন আরও বড়। কতটা যে বড় তা এক সঙ্গে দেখবার জন্য একটা ব্যবস্থা আছে। মাঝামাঝি একটা জায়গায় আমাদের মনুমেন্টের মতন একটা স্তম্ভ আছে, তার ভেতরে লিফট চলে, আট আনার টিকিট কাটলেই ওপরে ওঠা যায়।

ওপরে উঠে শুধু যে চোখ জুড়িয়ে গেল তাই নয়, একটা দীর্ঘশ্বাসও পড়ল। আমাদের দেশে এমন সুন্দর ক্যাম্পাস কোনওদিন হবে না? শান্তিনিকেতনে অনেক গাছপালা আছে, কিন্তু বার্কলে ক্যাম্পাসের বড়-বড় বৃক্ষরাজি ও ফুলের সৌন্দর্য আরও অনেক বেশি। তা ছাড়া, পেছনে রয়েছে পাহাড়ের পটভূমি আর তিন দিকে সমুদ্র।

এই প্রসঙ্গে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা একটু বলি। বার্কলে শুধু চোখে দেখেছি কিন্তু সেখানকার কারুর সঙ্গে আলাপের সুযোগ সেদিন হয়নি। কিন্তু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটা চমকপ্রদ তথ্য জানি। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড-ইয়েলের মতন অভিজাত তো নয়ই, পড়াশুনোর কৃতিত্বেও বার্কলের চেয়েও কিছু নীচে। তবু সেই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই বেয়াল্লিশজন নোবেল লরিয়েট অধ্যাপক থাকেন। তাহলে হার্ভার্ড-ইয়েল-বার্কেলেতে ওনারা কতজন আছেন কে জানে!

যাই হোক, আমাদের সানফ্রান্সিসকো সফরের পালা এবার ফুরিয়ে এল। সব সুখের দিনই তো একদিন-না-একদিন শেষ হয়। এবার মদনদারা ফিরে যাবেন, আমাকে একলা যেতে হবে অন্যদিকে।

ওঁরা সবাই মিলে আমায় তুলে দিতে এলেন গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশনে। এরা বাস ডিপো বলে, স্টেশন বলে, ঠিকই বলে। বড়-বড় শহরের বাস স্টেশন অনেক রেল স্টেশনের চেয়ে বড়। যাত্রীদের জন্য ওয়েটিং প্লাটফর্মে এক-একটি চেয়ারের হাতলের সঙ্গে ছোট-ছোট টিভি সেট লাগানো আছে, যাতে তাদের সময় কাটাতে অসুবিধে না হয়।

আমার বাসটি এক্ষুনি ছাড়বে। আমি ‘একেলা এসেছি এই ভবে, একেলাই চলে যেতে হবে’ এই গান গাইতে-গাইতে উঠে পড়লুম। জানলার কাছে গিয়ে ওঁদের দিকে একটু হাত দেখাতেই বাস চলতে শুরু করল। তারপরই ঢুকে পড়ল অন্ধকার সুড়ঙ্গে। ব্যাস, আবার শুরু হল আমার একাকী ভ্রাম্যমান জীবন।

গ্রে-হাউন্ড বাসের চেহারা বাইরে থেকে এমন শক্তপোক্ত যে কুকুরের বদলে গন্ডারের সঙ্গেই এর তুলনা দেওয়া উচিত। ভেতরটা অবশ্য শীততাপ এবং শব্দ নিয়ন্ত্রিত, একশো কুড়ি মিটার বেগে বাস চললেও ভেতরে বসে বিশেষ কিছু টের পাওয়ার উপায় নেই। পেছনে বাথরুম আছে। আপাতত প্রায় বেয়াল্লিশ ঘণ্টা আমাকে এই বাসে থাকতে হবে, সুতরাং আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার সহযাত্রীদের দেখে নিলুম। জনাআষ্টেক চিনে, জনাপনেরো কালো মানুষ, জনাকুড়িক ফরসা। খয়েরি বলতে আমি একাই। আমার পাশে বসেছে..এখানে আমার খুব লিখতে ইচ্ছে করছিল যে আমার পাশে বসেছে একটি ফুটফুটে সুন্দরী তরুণী মেয়ে, অধিকাংশ ভ্রমণ কাহিনিতেই যেমন হয়ে থাকে। কিন্তু আমার যা ভাগ্য! আসলে আমার পাশে বসেছে এক বুড়ি মেমসাহেব, যার মাথার উলকো-ঝুলকো চুল দেখলে মনে হয় নির্ঘাত উকুন আছে।

বুড়ি মেমদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য কোনও চেষ্টা করতে হয় না, এরা নিজেরাই আলাপের জন্য মুখিয়ে থাকে। বুড়োবুড়িরা এদেশে অতি নিঃসঙ্গ, তাদের কথা শোনবার সময় কারুর নেই, তরুণ সমাজ তাদের পাত্তাই দেয় না। সেইজন্য এরাও নতুন লোক দেখলেই কথার ফোয়ারা ছুটিয়ে দেয়।

মুশকিল হচ্ছে এই যে, এরাও অনেকেই বার্ধক্যটাকে প্রসন্নভাবে মেনে নিতে পারে না। প্রাণপণে বয়েসটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে যায় শেষ দিন পর্যন্ত। আমার পাশে যে বুড়ি মেমসাহেব বসে আছেন, তিনি নিশ্চয়ই আমার দিদিমার বয়েসি, কিন্তু ঠোঁটে ও গালে উগ্র রং মাখা, পোশাকের রং খুনখারাবি, একটা বিরাট চকোলেট-বার নিয়ে কচরমচর করে খাচ্ছেন। বেশ একটা লাল পেড়ে সাদা খোলোর শাড়ি পরিয়ে, চুল টানটান করে আঁচড়ে দিলে এবং মুখে এক খিলি পান গুঁজে দিলে বরং বেশ মানিয়ে যেত।

বুড়ি মেমটির সঙ্গে যেন আমার কতকালের চেনা এই ভঙ্গিতে সে প্রথমেই আমাকে জিগ্যেস করলেন, তুমি কি রিনোতে নামবে?

দু-দিকে ঘাড় নেড়ে আমি বললুম, না।

তিনি বেশ অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, নামবে না? পঁয়তাল্লিশ মিনিট থামবে?

এবার মুখে কোনও উত্তর না দিয়ে আমি ‘সে দেখা যাবে এখন’ এই রকম একটা ভাব করে কাঁধ ঝাঁকালুম। তারপরই কথাবার্তা থামাবার জন্য খুলে ফেললুম একটা বই।

রিনো শহরটির বিষয়ে আমি জানি। লাস ভেগাস যেমন বিশ্ববিখ্যাত জুয়া খেলার জায়গা, তার কাছাকাছি এই রিনো শহরটিও জুয়ার জন্য প্রসিদ্ধ। লাস ভেগাসে আমাদের বাস থামবে না, কিন্তু রিনোতে চা খাবার স্টপ আছে। সব রেস্তোরাঁর মধ্যেই জুয়া খেলার যন্ত্র বসানো থাকে, অনেক যাত্রী ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ভাগ্য ফেরাবার চেষ্টায় লেগে যায়।

এ কথা ঠিক, আমেরিকার সমস্ত জুয়ার আসরে বুড়িদের সংখ্যারই প্রাধান্য। এটাও তাদের নিঃসঙ্গতা কাটাবার একটা উপায়।

গ্রে-হাউন্ড বাসের ড্রাইভারদের ভাবভঙ্গি উচ্চ পদস্থ অফিসারের মতন। খুব সম্ভবত সেই রকমই মাইনে পায়। এরা স্বভাব-গম্ভীর ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে না, কিন্তু মাঝে-মাঝে বক্তৃতা দেয়। সেজন্য এদের কাছে মাইক্রোফোন থাকে। বক্তৃতায় এরা বাস যাত্রার নিয়মকানুন স্মরণ করিয়ে দেয় এবং মেজাজ প্রসন্ন থাকলে কখনও-কখনও পথের দুপাশের বিশেষ দ্রষ্টব্য জিনিসগুলো সম্পর্কেও দু-চার কথা বলে।

অনেকের ধারণা, বাস থাকলেই একজন কন্ডাকটর থাকবে, সেইজন্যই জানিয়ে দিতে চাই যে গ্রে-হাউন্ড বাসে ড্রাইভারই একমাত্র কর্মচারী।

আমাদের বাসটা ছাড়বার একটু বাদে ড্রাইভার মহোদয় যে বক্তৃতাটি দিলেন, তা শুনে তো আমার মাথায় হাত। নতুন নিয়মে বাসে ধূমপায়ী এবং অধূমপায়ী এলাকা ভাগ করা হয়েছে। একদম পেছন দিকের তিনটি রো-তে যারা বসেছে, শুধু তারাই সিগারেট টানার অধিকারী, বাকি সিটের যাত্রীদের ধূমপান নিষিদ্ধ।

আমি তো আগে এই কথাটা চিন্তাই করিনি। তাড়াতাড়ি উঠে সামনে যে-জায়গা পেয়েছি, তাতেই বসে পড়েছি। জায়গাটা অবশ্য ভালোই, সামনের দিকে, ড্রাইভারের কাছাকাছি এবং জানলার পাশে। কিন্তু বিয়াল্লিশ ঘণ্টা সিগারেট না খেয়ে থাকতে হবে? অবশ্য তিন-চার ঘণ্টা অন্তর-অন্তর বাস এক-একটি স্টেশনে থামবে, সেখানে নেমে ফুকফুক করে দু-একটা সিগারেট টেনে নেওয়া যায়, কিন্তু তাতে কি আরাম হয়! সিগারেট তো আর শারীরিক ক্ষুধাতৃষ্ণা মেটাবার কোনও খাদ্য-পানীয় নয়, সিগারেট হল মনকে আকাশে ভাসাবার জন্য একটা বায়ু যান। মন যখন চাইবে তখন না পেলে আর পকেটে সিগারেট রাখার কী মানে হয়।

বেশ মনমরা হয়ে গেলুম।

আমার চোখ বইয়ের প্রতি নিবদ্ধ দেখেও বুড়ি মেম একটুবাদে জিগ্যেস করলেন, তুমি মেক্সিকো থেকে এসেছ?

না।

–সাউথ আমেরিকা?

–না।

–আরব দেশ? ইরান?

না।

–তুমি কোথা থেকে এসেছ?

–সান ফ্রান্সিসকো থেকে।

–ও!

আমি ইচ্ছে করেই ভারতবর্ষের নাম করলুম না, তা হলেই অনেক কথা বলতে হবে। যাকে তাকে ভারতবর্ষ বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। বুড়ি মেমসাহেবের মুখ থেকে আমি পরিষ্কার জিনের গন্ধ পাচ্ছি। বাস ছাড়বার দেড় ঘণ্টার মধ্যেই উনি দু-বার বাথরুম ঘুরে এসেছেন। খুব সম্ভবত বাথরুমে গিয়ে উনি জিনের বোতলে একটা করে চুমুক দিয়ে আসছেন। আমি যে বাথরুমে গিয়ে সিগারেট টেনে আসব তার উপায় নেই, কারণ ড্রাইভার সাহেব আগেই নিষেধ করে দিয়েছেন, ওটা নাকি বিপজ্জনক।

রিনো শহরের কাছাকাছি আসতেই বুড়ি মেমের কী উৎসাহ। ঝলমলে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এসে গেছে। এসে গেছে। তুমি আমি এক সঙ্গে খেলব। শোনো, এক মেশিনে বেশিক্ষণ খেলতে নেই, কমপিউটার প্রোগ্রামিং করা থাকে, সেই জন্য নানান মেশিনে চান্স নিতে হয়।

রিনোয় আমি নামলাম ঠিকই, কিন্তু চট করে চলে গেলুম উলটোদিকের অন্ধকারে। তারপর একটুবাদে চুপিচুপি একটা কফি কাউন্টারে বসলুম। বুড়ি মেম সাহেবের পাল্লায় পড়ে জুয়া খেলতে হলেই গেছি আর কি। পকেট যে গড়ের মাঠ তা তো ও জানে না।

ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে ফিরে এলুম বাসে। বুড়ি মেমসাহেব এখনও ফেরেননি। ড্রাইভার যাত্রী সংখ্যা গুণে দেখলেন একজন কম। এইরকম অবস্থায় রেস্তোরাঁয় মাইক্রোফোনে ঘোষণা করে দেওয়া হয় যে অমুক নম্বর বাস এক্ষুনি ছাড়বে, যাত্রীদের শেষ আহ্বান জানানো হচ্ছে।

এর পরেও বুড়ি মেমসাহেব এলেন না। বাস ছেড়ে দিল। তাহলে কি ওঁর এখানেই নেমে যাওয়ার কথা ছিল? সেটা তো বুঝিনি, একটু পরেই আমার নজরে পড়ল, ওপরের র‍্যাকে একটা নীল ব্যাগ রয়েছে, ওটা তো বুড়ি মেমের। তাহলে? আমি উত্তেজিতভাবে উঠে গিয়ে ড্রাইভারকে কথাটা বললুম। তাঁকে বোঝাবার জন্য আমাকে ব্যাপারটা দু-তিনবার বলতে হল। ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যাগটা একবার দেখে নিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমায় বলল, ফরগেট ইট!

আমার কেমন যেন একটা অপরাধ বোধ হল। বুড়ি মেম কি নীল ব্যাগটা ভুল করে ফেলে গেছে? অথবা, এখানে তার নামবার কথা ছিল না, জুয়ায় মেতে গিয়ে ও ওখানেই থেকে গেল। আমি সঙ্গে থাকলে হয়তো ওকে ফিরিয়ে আনতে পারতুম।

এরপর ঘুমিয়ে পড়লুম। মাঝরাত্রে একবার চোখ মেলে দেখলুম এর মধ্যে কোনও এক স্টেশন থেকে একজন মাঝবয়েসি সাহেব উঠে আমার পাশের সিটে বসেছে। কিছুই শেষ পর্যন্ত খালি থাকে না, প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না।

তারপর খানিকটা ঘুম আর খানিকটা জাগরণে কাটতে লাগল সময়। এর মধ্যে পাহাড়, গভীর অরণ্য, মরুভূমি পেরিয়ে ছুটতে লাগল বাস। মাঝে একবার ড্রাইভার বদল হয়ে গেল।

সকাল সওয়া ন’টায় বাস থামল সল্টলেক সিটিতে। সেখানে পেছনের সিট থেকে নেমে গেল একজন, অমনি আমি পড়িমরি করে ছুটে গিয়ে বসে পড়লুম সেই সিটে। যাক নিশ্চিন্ত আশ্রয় পাওয়া গেছে। নিজের জিনিসপত্র সেখানে রেখে নামলুম ব্রেকফাস্ট খেতে।

বাস ছাড়ল দশটায়। পাঠক বিশ্বাস করুন, এবার কিন্তু সত্যিই আমার পাশের সিটে এক তরুণী নারী বসেছিল। সে অবশ্য আমার সঙ্গে কথা বলার কোনও চেষ্টাই না করে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। আমি আরাম করে একটা সিগারেট ধরালুম। পেছনের দিকের সিটে একটু ঝাঁকুনি লাগে, তা হোক, চলন্ত বাসে যেতে-যেতে সিগারেট খাওয়ার আনন্দই আলাদা।

এর পর দশমিনিটও কাটেনি, আমার সিগারেটটা সবে মাত্র শেষ হয়েছে, এমন সময় কী যেন হল। আমি সিট থেকে লাফিয়ে উঠে বাসের ছাদে ধাক্কা খেয়ে তারপর লুটিয়ে পড়লুম মাটিতে। প্রথমে মনে হল মরে গেছি। কিন্তু শরীরে কোনও ব্যথা নেই। তারপরই শুনতে পেলুম, তিন চারজন একসঙ্গে চিৎকার করছে। হি ইজ ডেড। হি ইজ ডেড।

কে মারা গেছে? আমি? কোনও রকমে উঠে দাঁড়ালুম। বাসের সমস্ত লোক চিক্কার করছে, কয়েকজন কাঁদছে। অন্যদের কথায় বুঝতে পারলুম, মারা গেছে ড্রাইভার। উঁকি দিয়ে দেখলুম, ড্রাইভারের শরীর একেবারে ছিন্নভিন্ন, বাসের সামনের দিকটা তুবড়ে ঢুকে এসেছে ভেতরে।

কিন্তু ড্রাইভারহীন বাস তখনও চলছে।

হয়তো কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার, কিন্তু মনে হচ্ছিল অনন্তকাল। সারা বাস জুড়ে ভয়ার্ত চিৎকার আরও বেড়ে গেল, কারণ, পরিষ্কার বোঝা গেল, বাসটা রাস্তা ছেড়ে পাশের খাদের দিকে নামছে। কত নীচে আছড়ে পড়বে কিংবা কোথায় ধাক্কা খাবে জানি না। সিনেমায় এইরকম সময় দেখা যায় দপ করে একটা শব্দ হয়ে পেট্রোল ট্যাঙ্ক ফেটে যায়, তারপরে সমস্ত বাসটায় আগুন জ্বলে। আমার ঠিক ওই সিনেমার দৃশ্যের কথাই মনে হচ্ছিল, প্রতীক্ষা করছিলুম কখন আগুন জ্বলবে।

কিছুতে ধাক্কা লেগে বাসটা উলটে গেল একদিকে, কিন্তু আগুন জ্বলল না। সেই ধাক্কার সময় আমি আবার মাটিতে গড়াগড়ি খেলুম। তখনও মনে হল, মরিনি? বেঁচে আছি? হ্যাঁ, বেঁচেই তো আছি। বাসটা যেদিকে উলটে গেল, আমি ছিলাম তার ওপরের দিকে। কয়েকজনের গায়ের ওপর পড়েছিলুম, আমার ওপর সেই মেয়েটি। অত্যন্ত সাহসিনীর মতন সে আগাগোড়া চুপ করে ছিল। কোনওরকমে এটা সেটা ধরে উঠে দাঁড়ালুম দুজনে। এতক্ষণে অনেকে দমাদ্দম লাথি মারছে বাসের জানলায়। যে-কোনও মুহূর্তে আগুন জ্বলবে। একটা জানলা ভেঙে যেতেই আমরা কয়েকজন লাফিয়ে পড়লুম সেখান থেকে। অত উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ায় আমার একটা গোঁড়ালি মচকে গেল, সেই আমার প্রথম ব্যথা। তরুণী মেয়েটিকে আমরা কয়েকজন সাহায্য করলুম নামবার জন্য, তারপর সবাই আগুনের ভয়ে দৌড়ে গিয়ে উঠলুম উলটো দিকের রাস্তায়।

আগুন অবশ্য শেষ পর্যন্ত জ্বলেনি। আমাদের বাসটার সঙ্গে একটা ট্রাকের ধাক্কা লেগেছিল, দুটোই ছিল দুর্দান্ত স্পিডে, সামান্য ধাক্কাই যথেষ্ট। দুই গাড়ির ড্রাইভারই মারা গেছে সঙ্গে-সঙ্গে। ট্রাকটাও উলটে পড়ে আছে একটু দূরে।

দু-তিন মিনিটের মধ্যে যেন মন্ত্রবলে গোটাদশেক পুলিশের গাড়ি-দমকল-অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল। আমাদের বাস থেকে যাত্রীদের উদ্ধার কার্য চলছে, আমি দূরে বসে অলস চোখে দেখছি। থ্যাঁতলানো-চ্যাপটানো, হাত-পা ভাঙা এক-একটা শরীর বেরুচ্ছে, বাসের বডি কেটে-কেটে বার করা হচ্ছে। সামনের দিকটায় যাত্রীরাই নিহত ও আহত হয়েছে বেশি।

হঠাৎ আমার একটা সাংঘাতিক উপলব্ধি হল। খানিকটা আগেই আমিও তো সামনের দিকে বসে ছিলাম। সিগারেট খাওয়ার টানে পেছনে চলে গিয়েছি। যদি না যেতাম! তাহলে এতক্ষণে আমিও ওই রকম থ্যাঁতলানো একটা শরীর, হাত কিংবা পা নেই…। ভেবেই আমার শিহরন হল।

কে বলে সিগারেটের উপকারিতা নেই? জয় সিগারেট।

তক্ষুনি সিগারেট ধরালুম একটা। কিন্তু আমার হাত কাঁপছে। সিগারেটে কোনও স্বাদ পাচ্ছি। কপাল থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে, কপালে যে কেটে গেছে তা খেয়ালই করিনি এতক্ষণ।

আমি মরে যেতে পারতুম, আমি মরে যেতে পারতুম। দশ-বারো মিনিট আগে সামান্য একটা সিদ্ধান্তের জন্য…। যদি পেছনের সিটটা খালি না হত, তাহলে এতক্ষণে এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে আমি একটা লাশ হয়ে যেতাম?

কে যেন বলেছিল মৃত্যুর উপলব্ধি খুব মহান? আমার তো সেরকম হল না? মৃত্যুর অত কাছাকাছি যাওয়ার পর আমি বেশ কিছুক্ষণ যেন বোধহীন, জড়ের মতন হয়ে রইলাম।