[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

২৮. এখন নিউ ইয়র্কে রাত দেড়টা

এখন নিউ ইয়র্কে রাত দেড়টা, তা বলে কলকাতায় এখন ক’টা বাজে? খুব সম্ভবত দশ ঘণ্টার তফাত। অর্থাৎ কলকাতায় এখন বেলা সাড়ে এগারোটা। নিউ ইয়র্কে শনিবার রাত, কলকাতায় এখন রবিবারের দুপুর সবে মাত্র আসছে।

তখন পরিষ্কার দেখতে পেলুম কলকাতায় রবিবারের সকাল-দুপুরের ছবি। প্রত্যেক রবিবার আমাদের একটা আচ্ছা আছে। সাধারণত সেই আড্ডাটা সাড়ে এগারোটা-বারোটা থেকেই শুরু হয়, চলে বিকেল পর্যন্ত। কোনও-কোনও দিন সন্ধেও গড়িয়ে যায়। নিয়ম না-মানা, বলগা-ছাড়া আচ্ছা।

হঠাৎ আমার ভীষণ মনটা ছটফট করে উঠল। দূর ছাই, কিছছু ভালো লাগছে না! এই সাহেবদের দেশে আমি কী করছি? আমার এক্ষুনি চলে যেতে ইচ্ছে করছে। জলের মাছকে জলে ফিরিয়ে দিলেই যেমন সে সবচেয়ে সাবলীল থাকে, কলকাতাটা আমার সেই রকম নিজস্ব জলাশয়।

বেশ বড় অ্যাপার্টমেন্ট, তিন খানা শোওয়ার ঘর, একটা মস্ত লিভিং-কাম-ডাইনিং রুম। গৃহস্বামী অনুপস্থিত, আমাকে চাবি দিয়ে গেছেন, সারাদিন ঘুরে ফিরে এখানে রাত্রে চলে আসি।

কিছুতেই ঘুম আসছে না আজ। এক-একবার সব অন্ধকার করে দেখছি বাইরের আলো। আবার হঠাৎ সব ঘরের আলো জ্বেলে দিচ্ছি। কিছুরই অভাব নেই, ফ্রিজ-ঠাসা খাবার, সেলারে অনেক রকম পানীয়, তিনটে ঘরের তিন রকমের বিছানাতেই শুতে পারি, তবু মনে হচ্ছে এক ছুটে কলকাতায় গিয়ে নিজের বালিশে শুয়ে পড়ি।

মন খারাপটা শুরু হয়েছিল বিকেল থেকেই। নিউ ইয়র্কের মতন পেল্লায় শহরের রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ একজন চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় আশ্চর্যের কিছু না। কিন্তু পরপর দুদিন একই লোকের সঙ্গে এখানকার রাস্তায় দেখা হয়ে যাওয়া সত্যিই অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। আমার কিন্তু সেই রকমই হল।

গতকাল বিকেলে গুগেনহাইম মিউজিয়াম থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছি, একজন আমার পিঠে ঘুষি মেরে বলল, হ্যাল্লো, নীলু।

চমকে পেছন ফিরে আমার আক্রমণকারীকে দেখে আমি খুবই খুশি হলুম। এক একজন মানুষ থাকে, যাদের দেখলেই ভালো লাগে। এই মানুষটি সেইরকম।

ইংরিজি বানানে এর নাম জর্জ, কিন্তু আসল উচ্চারণ ইয়র্গো। এই ইয়র্গো একজন গ্রিক লেখক। কিছুদিন আগে একটা ছোট শহরে এর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। লেখক-টেখকদের সংস্পর্শে যেতে আমার ভয় করে, কারণ সাহিত্য-আলোচনা ফালোচনা আমার দ্বারা কিছুতেই হয় না। সাহেব-লেখকদের সম্পর্কে তো আমার আরও ভয়, ওদের সঙ্গে আবার ইংলিশে সাহিত্য আলোচনা করতে হবে, বাপরে!

কিন্তু ইয়র্গোর চেহারায় কিংবা ব্যবহারে একদম সাহিত্যিক-সাহিত্যিক ব্যাপার নেই। বেশ রুক্ষ চেহারা, নাকের নীচে ঝোলা গোঁপ, অতিরিক্ত ধূমপানের জন্যই বোধহয় দাঁত একটু ক্ষয়ে গেছে। গোঁফের ফাঁক দিয়ে ও মিচকি-মিচকি হাসে আর সবসময় মজার কথা বলতে ভালোবাসে। সাহিত্য ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য বহু বিষয়ে ওর টগবগে আগ্রহ। যদিও গ্রিসে ইয়র্গো খুব নাম করা নাট্যকার এবং চলচ্চিত্রনাট্যকার। নিজের দেশে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়েছে। লেখক হিসেবে ওর খুব সম্মান আছে। পুরো নাম ইয়র্গো কুরটিস।

প্রথম দিন আলাপেই ইয়র্গো আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলে চমকে দিয়েছিল। সেটা ছিল বেশ বড় গোছের একটা সম্মিলন, নানা জাতের লোক, তার মধ্যে সাহেবই বেশি। সবাই সবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কথা বলছে, এর মধ্যে ইয়র্গো এক সময় আমার পাশে এসে ওর স্বভাবসিদ্ধ মুচকি হেসে বলল, একটা জিনিস লক্ষ করেছ, নীলু? আমরা যারা কালো লোক, আমরা কক্ষনো কোনও পার্টির ঠিক মাঝখানে থাকি না, আস্তে-আস্তে কোনও না কোনও দেওয়ালের দিকে সরে যাই। তুমি দ্যাখো, সব কালো লোকরাই দেওয়ালের পাশে।

আমি চমকে ইয়র্গোর দিকে তাকিয়ে ছিলুম। ও নিজেকে কালো লোক বলছে কেন? গ্রিকরাও তো পুরোপুরি সাহেব। আর ইয়র্গোর গায়ের রং-ও হাতির দাঁতের মতন।

–তুমি নিজেকে কালো বলছ কেন, ইয়র্গো? আমরা ভারতীয়রা কালো হতে পারি, কিন্তু তুমি….

–আরে, কালো মানে তো গরিব! গ্রিকরাও আমেরিকানদের তুলনায় ভীষণ গরিব! সুতরাং তোমরা আমরা সমান। আর গায়ের রং-এর কথা যদি বলো, তা হলেও, ইওরোপের দেশগুলো, যেমন সুইডেন, নরওয়ে, ওয়েস্ট জার্মানি–ওরা গ্রিকদের প্রায় কালোর মতনই অবজ্ঞা করে বুঝলে?

আমি বললুম, তুমি সত্যি আমাকে নতুন কথা শোনালে, ইয়র্গো। আমরা বাঙালিরা এখনও কোনও সুন্দর দেখতে ছেলের বর্ণনা দিই ‘গ্রিক যুবকের মতন’ কিংবা ‘তরুণ গ্রিক দেবতা’।

ও বলল, সে তো তিন হাজার বছর আগেকার গ্রিসের মানুষের কথা তোমরা ভাবো। মুশকিল হচ্ছে কী, সবাই ক্লাসিকাল আমলের গ্রিসের কথা জানে, কিন্তু এখনকার গ্রিসের অবস্থা কেউ জানারও চেষ্টা করে না। আমরা আবার বড়লোক হই, তখন আবার সুন্দর হয়ে যাব। তোমরা ভারতীয়রাও যদি এখন হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাও, তাহলেই দ্যাখো, তোমাদের ওই জলপাই রঙের চামড়া নিয়ে ইংরেজিতে কাব্য লেখা হবে, মেমসাহেবরা তোমার পেছনে ছুটোছুটি করবে।…

এ হেন ইয়র্গোকে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় হঠাৎ দেখতে পেলে আমার তো ভালো লাগবেই। ইয়র্গো একটি ছোট শহরের মাঝারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ পেয়ে কয়েক মাসের জন্য এখানে এসেছে।

আমি মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে বাংলায় কথা বলি। ও বাংলা এক বর্ণও বোঝে না। কিন্তু আমাকে ও বলেছিল যে বাংলা শব্দ ঝংকার শুনতে ওর ভাল লাগে।

আমি ওর হাতে চেপে ধরে বললুম, কী গো ইয়র্গো সাহেব, তুমি কোথা থেকে হঠাৎ এখানে উদয় হলে? আকাশ থেকে খসে পড়লে নাকি?

ইয়র্গো আমার প্রশ্ন বুঝল না বটে কিন্তু উত্তরে বলল, এই নিউ ইয়র্কে কয়েকদিনের জন্য একটু ফুর্তি করতে এসেছি। শুনেছিলুম নিউ ইয়র্কের পথে পথে জুনিপার ফুলের মতন ছড়ানো থাকে সুন্দরী মেয়ে, যেন কারুর দিকে একটু ভুরুর ইশারা করলেই সঙ্গে সঙ্গে আসে। দুদিন ধরে ভুরুর ইশারা করতে-করতে আমার চোখ ব্যথা হয়ে গেল। কই একজনও তো এল না।

ইয়র্গো ভালো ইংরিজি জানে না। ভাঙা-ভাঙা বলে। মাঝে-মাঝে ঠিক শব্দটা খুঁজে না পেয়ে হাওয়ায় হাতড়াতে থাকে।

কোনও সাহেবের মুখে ভাঙা ইংরিজি শুনলে আমার বড় আরাম হয়। আমিও তার সঙ্গে বেশ স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারি।

ইয়র্গোর কথা শুনে আমি হাসতে লাগলুম।

ইয়র্গো জিগ্যেস করল, তুমি কোনও বান্ধবী পেয়েছ নিউ ইয়র্কে?

আমি ডান হাতের বুড়ো আঙুল নেড়ে বললুম, লবডঙ্কা।

ইয়র্গো প্রথমে একটা গ্রিক গালাগালি দিল। সেটা নিশ্চয়ই শালার প্রতিশব্দ। তারপর বলল, আমাদের দেশের যেসব লেখকরা এদেশ ঘুরে গিয়ে ভ্রমণ কাহিনি লেখে, সব্বাই ডাহা গুল মারে।

দুঃখের বিষয় এরকম সরস গল্প আমরা বেশিক্ষণ জমাতে পারিনি। কারণ কাল বিকেলে আমাদের দুজনেরই তাড়া ছিল। আমার একটা থিয়েটার দেখতে যাওয়ার কথা, ইয়র্গো কেটে রেখেছে একটা ফরাসি সিনেমার টিকিট। সুতরাং কাছাকাছি একটা ম্যাকডোনাল্ডের দোকানে ঢুকে আমরা চটপট কফি খেয়ে নিলুম এবং লিখে দিলুম পরস্পরের ঠিকানা।

কিন্তু ঠিকানা খুঁজে যোগাযোগ করবার আগেই আজ সন্ধেবেলা আবার ইয়র্গোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল রাস্তায়। একই থিয়েটার দেখে বেরুলাম দুজনে।

আজ ইয়র্গোর সঙ্গে একটি স্বাস্থ্যবতী যুবতী, ঝলমলে মুখ, ডাগর-ডাগর চোখ, তার স্কার্টে অত্যুজ্জ্বল লাল-নীল ফুল।

ইয়র্গো আর আমি প্রথম বিস্ময় বিনিময় করবার পর সে জিগ্যেস করল, নীলু, আজ এর পর তোমার কোনও কাজ আছে? কোথাও যাবার কথা আছে?

আমি কাঁধ ঝাঁকালুম। অর্থাৎ সেরকম কোনও কথা থাকলেও কিছু আসে যায় না।

–তাহলে কিছুক্ষণ কোথাও বসে আড্ডা মারা যাক? হ্যাঁ?

–নিশ্চয়ই!

মেয়েটি পৃথিবীর দুর্বোধ্যতম ভাষায় ইয়র্গোকে কী যেন বলল। ইয়র্গোও সেই একই ভাষায় উত্তর দিয়ে তারপর আমাকে আবার মিষ্টি ভাঙা ইংরিজিতে বলল, এই মেয়েটি থাকতে চাইছে না, ওর বাবা ওর সঙ্গে আজ দেখা করতে আসবে বলছে, তা হলে ওকে ছেড়ে দিই, কী বলো।

আমি আর কী বলব, হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলুম। মেয়েটিও আমার দিকে একঝলক হেসে গুডবাই বলে নেমে গেল মাটির তলায় ট্রেন ধরতে।

কিছুক্ষণ ইয়র্গো আর আমি পাশাপাশি হাঁটবার পর আমি বললুম, এই তো আজ বেশ একটি সুন্দরী সঙ্গিনী পেয়ে গিয়েছিলে দেখছি!

ইয়র্গো দারুণ বিরক্তির সঙ্গে বলল, দূর দূর! ও তো গ্রিক মেয়ে! এখানে এসে উঠেছি এক গ্রিকের বাড়িতে, নেমন্তন্ন খাচ্ছি গ্রিকদের বাড়িতে, আলাপ হচ্ছে গ্রিক মেয়েদের সঙ্গে…তাহলে আর নিউ ইয়র্কে আসা কেন? এথেন্সেই তো এসব পাওয়া যায়। আমার নাম শুনলে গ্রিক মেয়েরা আমার সঙ্গে প্রেম করতে আসে, নিউ ইয়র্কেও সেই একই ব্যাপার!

আমি যতদূর জানি, বাঙালি লেখকদেরও প্রায় একই অবস্থা। তারাও বিদেশে গেলে বাঙালিদের বাড়িতে ওঠে। বাঙালিদের নানান বাড়িতে নেমন্তন্ন খায়। তবে বাঙালি মেয়েরা লেখকদের নাম শুনে প্রেম করতে আসে কি না তা অবশ্য আমি জানি না। অন্তত আমার কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই।

ইয়র্গো জিগ্যেস করল, নিউ ইয়র্ক তোমার কেমন লাগছে?

আমি পালটা প্রশ্ন করলুম, কারুর কি খারাপ লাগতে পারে?

ও বলল, ইত ইজ এ গ্রেত সিতি…সবসময় জীবন্ত…এত রকমের নাটক…এত ধরনের ফিল্ম…মিউজিক কনসার্ট…আর্ট গ্যালারিগুলো তো আছেই, সব দেখে শেষ করা যায় না…বাত আই দোনত লাইক ইত! ইত ইজ দিপ্রেসিং!

রাস্তায় দুপাশের অতিকায় বাড়িগুলো দেখিয়ে ইয়র্গো আরও কী যেন বলতে গেল, ভাষা না খুঁজে পেয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে, ঠোঁট উলটে বুঝিয়ে দিল।

তারপর থমকে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করল, তুমি কখনও উজো খেয়েছ? আজ দেখলুম এখানকার দোকানে পাওয়া যায়। দেখেই কেমন মন খারাপ হয়ে গেল। তুমি খাবে?

–উজো কী?

–আমাদের গ্রিসের দেশি মদ। খেয়ে দ্যাখোনা একটু।

–কেন খাব না? জানো, আমার মা আমায় ছেলেবেলাতেই শিখিয়ে দিয়েছেন, পরের বাড়িতে গিয়ে এটা খাব না, সেটা খাব না বলতে নেই। যে যা দেবে মুখ বুজে খেয়ে নেবে।

ইয়র্গো এক গাল হেসে বলল, চলো তাহলে।

ম্যানহাটানে বার অসংখ্য। কিন্তু উজো অতি সস্তা দামের পানীয়, বারে বোধহয় সার্ভ করে না। তা ছাড়া আমরা দুজনেই গরিব দেশের মানুষ, ডলারকে ভক্তি করি। বারে বসে পেগের দামে অনেক খরচ পড়ে যাবে।

হাঁটতে-হাঁটতে আমরা গ্রিনিচ ভিলেজে এসে পড়েছি। ইয়র্গো সট করে এক দোকান থেকে এক বোতল উজো কিনে নিয়ে এল। তারপর বলল, এখানেই কোথাও বসে যেতে হবে। দাঁড়াও ব্যবস্থা করছি।

রাত প্রায় দশটা বাজে। গ্রিনিচ ভিলেজের সেই আগেকার রবরবা এখন আর নেই। বাউণ্ডুলে শিল্পী সাহিত্যিকরা নগর-উন্নয়নকারীদের অত্যাচারে অনেকেই এ পাড়া ছেড়ে পালিয়েছে। তবু এখনও এখানকার পথে বেশ ভিড়।

একটা ফাঁকা ধরনের রেস্তোরাঁর ফুটপাথের টেবিলে বসলুম আমরা। পরিচারিকাকে ডেকে খুব সরলভাবে ইয়র্গো বলল, আমাদের দু-কাপ কফি দাও। আর দুটো কাঁচের গেলাস দাও। আর বেশ বড় এক জাগ জল দাও। আমরা কফির দাম দেব কিন্তু কফি খাব না। আমরা অন্য জিনিস খাব।

মেয়েটি বিনা বাক্যব্যয়ে কফি, গেলাস ও জল নিয়ে এল। তারপর জিগ্যেস করল, তোমরা কী খাবে?

কাঁধের ঝোলা থেকে বোতলটি বার করে ইয়র্গো গেলাসে ঢালল। আমাকে বলল, প্রথমে নিট খেয়ে দ্যাখো। যদি বেশি কড়া লাগে, তাহলে জল মিশিয়ে নিও। তবে তাড়াতাড়ি খেও না কিন্তু, হঠাৎ কিক করে।

পরিচারিকাটি ইয়র্গোর গেলাসটা তুলে নিয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দিল। একটুক্ষণ সময় নিয়ে জিনিসটা উপলব্ধি করে সে বলল। হ্যাঁ, খেতে পারো। আমি ঘুরে-ঘুরে আসব, আমাকে একটু একটু দিও।

আমি প্রথমে সাবধানে চুমুক দিলুম। মোটেই অচেনা লাগল না। উজো একেবারে জলের মতন স্বচ্ছ পানীয়। সাঁওতাল পরগনায় আমি অনেকবার মহুয়া খেয়েছি, স্বাদটা অনেকটা সেই রকমই লাগল। কিংবা গোয়ার কাজু ফেনির মতনও বলা যায়। মেক্সিকোর টাকিলা আমি অনেকবার খেয়েছি, তার চেহারা ও স্বাদও এর কাছাকাছি। জল না মিশিয়েই দুজনে চুমুক দিতে লাগলুম চুকচুক করে।

একটুবাদে ইয়র্গো বলল, তুমি গ্রিসে যাওনি, না? চলে এসো। ছোট-ছোট দ্বীপ…গ্রিসে এলে তুমি বুঝতে পারবে জল কত সুন্দর দেখতে হয়। এই যে নিউ ইয়র্ক শহর, এটা কি মানুষের বসবাসযোগ্য? দেখলে মনে হয় না এটা দৈত্যদের জন্য বানানো হয়েছে? তার বদলে…গ্রিস…মানুষ আর প্রকৃতি সেখানে এখনও এক সঙ্গে মিশে আছে অনেকখানি…অভাব আছে, দারিদ্র্য আছে…কিন্তু এখনও মানুষের মন টাটকা আছে…

ব্যস, অমনি শুরু হয়ে গেল আমার বুকে ব্যথা। কলকাতা শহরের রূপের কোনও খ্যাতি নেই, কিন্তু সে যে বিষম আপন, তাই নিউ ইয়র্কের তুলনায় সেই মুহূর্তে কলকাতাকে মনে হল স্বর্গের মতন প্রিয়। গ্রিসের মতন আমাদের বাংলা হয়তো তত সুন্দর নয়, কিন্তু তারও তো একটা আলাদা রূপ আছে। শুধু বাংলা কেন, গোটা ভারতবর্ষটাই তো আমার। সেই জনম দুখিনী দেশটার জন্য টনটন করতে লাগল হৃৎপিণ্ড।

দুজনে মিলে ফিসফিস করে গল্প করতে লাগলুম দুজনের দেশের। বোতল প্রায় শেষ। আমার এখন একা থাকতে ইচ্ছে করছে খুব। শেষের দিকে পরিচারিকাটি খুব ঘনঘন এসে চুমুক দিচ্ছিল গেলাসে, আমি তাই ইয়র্গোকে বললুম, এর দিকে ভুরুর ইশারা করলে বোধহয় কাজ হবে। তুমি চেষ্টা করে দ্যাখো না।

ইয়র্গো পরিচারিকাটির নামধাম জিগ্যেস করল। তারপর সে বসে যেতেই বলল, ধুর। ও তো ইটালিয়ান। সবেমাত্র কিছুদিন হল এসেছে। আমাদের গ্রিসেও তো কত ইটালিয়ান মেয়ে কাজ করতে যায়।

হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে ইয়র্গো বলল, আমরা বড্ড সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছি, না? এটা ছেলেমানুষি হয়ে যাচ্ছে। চলো, অন্য কোথাও যাই, যেখানে অনেক লোক, সেখানে খানিকটা হইচই করব…।

কিন্তু খানিকবাদে আমি ইয়র্গোর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এলুম। ফেরার পর অবশ্য বুঝলুম ভুল করেছি। এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারছি না। কলকাতা যেন বিরাট এক লাটাই গুটিয়ে আমায় ঘুড়ির মতন টানছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ফিরে যাই। আমার কাছে রিটার্ন টিকিট আছে। বিমান কোম্পানিকে ফোন করব, যদি পরের ফ্লাইটেই জায়গা পাওয়া যায়! কিন্তু এত রাত্রে…।

শুধু আমার মন নয়, আমার শরীরও যেন কলকাতার জন্য মোচড়াচ্ছে। এখন রোববার সাড়ে এগারোটা, আড্ডাধারীরা যে-যার বেরুচ্ছে বাড়ি থেকে এই সময়। আজ কোথায় আড়া? এর বাড়ি, বা ওর বাড়ি, না তার বাড়ি! কিংবা লেকের গাছতলায় চেয়ার টেবিলে।

নিজেই এক সময় হেসে উঠছি। আমি এত সেন্টিমেন্টাল? তা হোক, এখন সম্পূর্ণ একা, যতই সেন্টিমেন্টাল হই, যতই ছেলেমানুষি করি, কেউ তো দেখছে না।

হঠাৎ মনে হল, এখন একটু বাংলায় কথা বললে তবু ভালো লাগবে। অনেক দিন দীপকদা জয়তীদির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ওঁদের ওখানে এখন কত রাত? যাই হোক, ওঁদের জাগানো যেতে পারে। আমি টেলিফোন তুলে ওঁদের নম্বর ঘোরালুম।