ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরটি ব্যাংক, বারবণিতা ও বইমেলার জন্য বিখ্যাত। শহরটি পুরোনো নয় আবার নতুনও বলা যাবে না। নতুন বলা যাবে না এইজন্য যে এই নামের শহরটি জন্ম প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। তবু প্রাচীন নয় এই কারণে যে আসল শহরটির নব্বই ভাগই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। দু-একটা গির্জা ও প্রাসাদ ইত্যাদি ছাড়া মধ্যযুগীয় এই নগরীটির আসল সৌন্দর্যের বিশেষ কিছু চিহ্নই এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না, তার বদলে গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য কেজো, আঁটসাট, দেশলাই-এর বাক্সের মতন বাড়ি। মহাকবি গ্যেটে যেমন জন্মেছিলেন এই শহরে, সেই রকম ধনকুবের, আন্তর্জিাতক ব্যাংক-ব্যবসায়ী রথসিলড পরিবারের আদি নিবাসও ছিল এই শহরে। ফ্রাঙ্কফুর্ট নামটির মানে হল, ফ্রাংক জাতির যাতায়াতের রাস্তা, এক কালে ফ্রাংকরা এখান দিয়েই আলেমান্নিদের তাড়া করে গিয়েছিল।
বরাবরই ব্যাবসা বাণিজ্যের জন্যই এই শহরটির সমৃদ্ধির নানারকম বাণিজ্যমেলা এই শহরে বসছে প্রায় সাত-আটশো বছর ধরে। সেই বাণিজ্যমেলার সূত্র ধরে ডাচ ইটালিয়ান ও ফ্রেঞ্চ দালাল ও ফাটকাবাজেরা এখানে এসে আসর জমায় ও ব্যাংকের ব্যাবসা শুরু করে। আর যেখানেই টাকার ওড়াউড়ি সেখানেই রূপসি নারী ও শিল্পীদের আনাগোনা। ধনী ব্যবসায়ীরা কেউ-কেউ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করে, সেইজন্য ফ্রাঙ্কফুর্টে উচ্চাঙ্গের আর্ট গ্যালারি ও থিয়েটারেরও অভাব নেই। ইহুদিরা বাড়িয়ে তোলে এই শহরের ধনসম্পদ আর রিফিউজিরা সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস থেকে তাড়া খাওয়া প্রটেস্টান্ট নিয়ে আসে উন্নত মানের শিল্প-সংস্কৃতি। তারপর ফ্রাঙ্কফুর্ট যখন উন্নতির শিখরে তখন হিটলার আরম্ভ করল ইহুদি নিধন-বিতাড়ন যজ্ঞ, ইঙ্গ-মার্কিন বোমায় এই গর্বিত নগরীটি মিশে গেল ধুলোয়।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার এক-দেড় দশকের মধ্যেই আলাদিনের প্রদীপের দৈত্য এই শহরটিকে আবার নতুন করে নির্মাণ করেছে।
ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে সাহিতের আবহাওয়া বিশেষ নেই কিন্তু বই প্রচুর। বই এখানে একটি দ্রব্য। বাণিজ্য মেলায় অভিজ্ঞ এই নগর সারা বছর ধরেই নানারকম দ্রব্যের পরপর মেলা বসায়। আন্তর্জাতিক গাড়ির মেলা, জামাকাপড়ের মেলা, জুতো ও পশমের মেলা, সেইরকমই বইমেলা। এখানে বিশাল, বিস্তীর্ণ মেলা প্রাঙ্গণ আছে, অনেকগুলি বহুতল আধুনিক অট্টালিকা সমেত, তলা থেকে ওপরে ওঠার জন্য আছে এসকেলেটর আর মেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার জন্য বাস চলাচল করে, তাতে টিকিট লাগে না। শহরে সব বাস, ট্রাম, ট্রেন রুটেই মেলাপ্রাঙ্গণে যাওয়ার নির্দেশ আছে। মেলার জার্মান প্রতিশব্দ হল মেসে, সারা বছরই কোনও না কোনও মেলা চলে, অক্টোবরের গোড়ার বুক মেসে অনেকে বলে, এটাই নাকি এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বইমেলা।
আমি ‘৮৬ সালেই এই বিশ্ব বইমেলা দেখতে গিয়েছিলাম। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নয়, যাওয়া আসার ভাড়া ও থাকা-খাওয়ার খরচের আশ্বাস পেয়ে ও আমন্ত্রিত হয়ে। এই বছরে মেলা কর্তৃপক্ষ মেলা শুরু হওয়ার আগে দুদিন ধরে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন। সেটির বিষয়; ইন্ডিয়া–চেইঞ্জ ইন কনটিনিউইটি। এই বছর ভারতের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল, ভারতের নামে তৈরি হয়েছিল একটি আলাদা প্যাভিলিয়ান। কেন হঠাৎ ভারতের প্রতি গুরুত্ব আরোপ? তার উত্তর জানি না। তবে এর আগে বই ও সাহিত্য নিয়ে এরকম সেমিনার ইত্যাদি হয়েছিল। আফ্রিকার পর ভারত, একটা বোধহয় যোগসূত্র আছে।
যাই হোক, এই সেমিনারে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল পঁচিশ জন ভারতীয় লেখক-লেখিকাকে। তাঁরা হলেন : অজ্ঞেয় (দিল্লি), মুলকরাজ আনন্দ (বম্বে), ইউ আর অনন্তমূর্তি (মহীশূর), অশোক মিত্ৰণ (মাদ্রাজ), মনু ভাণ্ডারি (দিল্লি), দিলীপ চিত্রে (বম্বে), কমলা দাস (প্রশ্নায়ারকুলম), অনীতা দেশাই (দিল্লি), বিজয় দান দেতা (যোধপুর), মহাশ্বেতা দেবী (কলকাতা), সিসিম ইজিকিয়েল (বম্বে), কুরাত-উল-আইন হায়দার (দিল্লি) বিষ্ণু খারে (দিল্লি), অরুণ কোলাটকর (বম্বে), সীতাকান্ত মহাপাত্র (ভুবনেশ্বর), আর কে নারায়ণ (মহীশূর), দয়া পাওয়ার (বম্বে), অমৃতা প্রীতম (দিল্লি), এ কে রামানুজম (শিকাগো), রঘুবীর সহায় (দিল্লি), কবিতা সিংহ (কলকাতা), বিজয় তেণ্ডুলকর (বম্বে), নির্মল ভার্মা (দিল্লি), সিতাংশু যশচন্দ্র (বরোদা) এবং বর্তমান লেখক।
এই তালিকায় দিল্লির প্রাধান্য থাকলেও তাঁদের মধ্যে আছেন অনেক ভাষার লেখক যাঁরা কার্যসূত্রে দিল্লিতে থাকেন। সব মিলিয়ে এইসব লেখকরা নির্বাচিত হয়েছেন বাংলা, গুজরাতি, হিন্দি, কানাড়া, মালয়ালম, মারাঠি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, তামিল, উর্দু, এবং ইংরাজি ভাষা থেকে। অসমিয়া, তেলেগু ইত্যাদি কেন বাদ গেল জানি না। নির্বাচনের মাপকাঠি হিসেবে প্রচার পুস্তিকায় বলা হয়েছে যে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ‘প্রবীণ ও তরুণ লেখকদের, কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার এবং অচ্ছুৎ ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সাহিত্যের প্রতিনিধিদের। নারী-লেখকেরা (আক্ষরিক অনুবাদ) ভারতীয় নারীদের সাহিত্যের প্রয়োজনীয় ভূমিকার কথা বলবেন।’
এই পঁচিশজনের মধ্যে অবশ্য অমৃতা প্রীতম এবং বিজয় তেণ্ডুলকর শেষ পর্যন্ত আসতে পারেননি। অমৃতা প্রীতমকে কট্টর ফেমিনিস্ট হিসেবে জানি, তিনি না যাওয়াতে ভারতীয় নারীদের বক্তব্য অনেকখানিই অব্যক্ত রয়ে গেল, আর বিজয় তেণ্ডুলকরের অনুপস্থিতিতে নাট্য জগতের কোনও প্রতিনিধিত্বই রইল না।
দু-দিনের চারবেলার সেমিনারের আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিল, ভারতীয় সাহিত্যের বিভিন্নতা বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্যের; ভারতীয় সাহিত্যের প্রকাশনা ও বই-ব্যাবসা; ভারতীয় সাহিত্যের সমাদর। বিভিন্নবেলায় সভাপতি ছিলেন ডঃ লোহার লুৎসে, পিটাই ওয়াইডহাস, ডঃ রাইমেনস্নাইডার এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। অলোকরঞ্জন এই পদে মনোনীত হয়েছিলেন বাঙালি বা ভারতীয় বলে নয়, একই সঙ্গে ভারতীয় ও জার্মান ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের জন্য। আমাদেরই সমসাময়িক এই কবি ও অধ্যাপকের এরকম সম্মাননায় আমি গর্বিত বোধ করেছি।
সেমিনার কেমন হয়েছিল? বেশ ভালোই তো হয়েছিল, যে-রকম সব সেমিনার হয়। এইসব সেমিনারে বক্তৃতা, হাস্য পরিহাস ও কৃচিৎ উত্তেজনার সঞ্চার হয়। কেউ কেউ মন দিয়ে শোনে, কেউ কেউ শুনতে-শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। বক্তাদের মধ্যে কেউ কেউ সর্বক্ষণ নিজে কী বলবে মনে মনে তার মহড়া দিয়ে যায়। কেউ-কেউ জ্বালাময়ী ভাষণ দেয় এবং অন্যদের ভাষণের সময় বাইরে সিগারেট টানতে চলে যায়। কেউ-কেউ বিনামূল্যে প্রাপ্ত প্যাডে পেন্সিল দিয়ে অনবরত কী নোট করে যায় কে জানে! কেউ অন্যের বক্তৃতার সময় পাশের লোকের সঙ্গে গল্প করে, কেউ কান চুলকোয়।
চার বেলাতেই সব লেখক-লেখিকারা ভাগ-ভাগ করে মাতৃভাষায় (ইংরেজিতে যাঁরা লেখেন তাঁর বিমাতৃভাষায়) নিজের রচনা থেকে খানিকটা অংশ পাঠ করেছেন। তারপর সেই অংশের পূর্বকৃত জার্মান অনুবাদ পড়ে দিচ্ছিলেন একজন অভিনেত্রী। আলোচনার ভাষা ইংরেজি (ভারতীয়দের ক্ষেত্রে, একজন শুধু হিন্দিতে বলেছিলেন) এবং জার্মান। তবে জার্মান দর্শক শ্রোতাদের জন্য জার্মান ছাড়া অন্য ভাষায় কিছু বলা হলেই সঙ্গে-সঙ্গে তার জার্মান অনুবাদ শুনিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এইসব ব্যবস্থা প্রায় নিখুঁত। প্রায় বললাম এই কারণে যে যন্ত্র সভ্যতায় অগ্রগণ্য জার্মান জাতির ব্যবস্থাপনাতেও দু’একবার মাইক্রোফোনের কিছু গোলমাল হয়েছিল।
এই আলোচনা সভা, কোনও খোলা জায়গাতে নয়, বইমেলার মধ্যেও নয়, নগরের কেন্দ্রস্থলে বসেছিল একটি ঐতিহাসিক কক্ষে। শ্রোতারা সবাই আমন্ত্রিত। শ্রোতারা অধিকাংশই বই প্রকাশনার ব্যাপারে জড়িত, কিছু ভারত-বিশেষজ্ঞ এবং ভারত-কৌতূহলী এবং কিছু স্থানীয় ভারতীয়, যাঁদের মধ্যে বাঙালি মুখ নজরে পড়ার মতন। শ্রোতারা প্রশ্নোত্তরে আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন।
শ্রোতাদের মধ্যে নাকি জার্মান লেখকরা কেউ ছিলেন না কিংবা জার্মান লেখকদের সঙ্গে ভারতীয় লেখকদের ঠিক মতন পরিচয় বা মেলামেশার সুযোগ করিয়ে দেওয়া হয়নি, এরকম অভিযোগ ভারতীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে কেউ-কেউ করেছেন।
প্রত্যাশা বেশি থাকলে আশাভঙ্গের সম্ভাবনাও বেশি থাকে। আমার সেরকম কিছু প্রত্যাশা ছিল না, জার্মান লেখকদের সঙ্গে পরিচয় বা আলাপ আলোচনার জন্য আমার কোনও ব্যগ্রতাও ছিল না। আমি গিয়েছিলাম বিনা পয়সায় ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে। সেই আনন্দে। আমি মনে করি, প্রত্যেক লেখকেরই বিশ্ব ভ্রমণ করা উচিত, কারণ লেখকেরা তো নিছক কোনও দেশের অধিবাসী নন, তাঁরা এই পৃথিবীর একজন মানুষ, তাঁদের রচনায় পৃথিবী শব্দটা আসে অসংখ্যবার, অথচ তাঁরা পৃথিবীটা স্বচক্ষে দেখবেন না? পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ লেখকেরই নিজের দেশের বাইরে পা বাড়াবার সুযোগ নেই, (অনেকে নিজের দেশটাও পুরোপুরি ঘুরে দেখতে উৎসাহ পান না, তাও অবশ্য স্বীকার করা উচিত) ইচ্ছে থাকলেও অর্থের অনটন এবং ফরেন এক্সচেঞ্জের ঝামেলার জন্য প্রবাসে যাওয়া সম্ভব হয় না। জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাসের মতন পশ্চিমি লেখকরা যেমন দুর্দশা নগরী কলকাতাকে সশরীরে অনুভব করার জন্য মাসের পর মাস এখানে থেকে যেতে পারেন। সেইরকম কোনও ভারতীয় লেখকের যদি মনে হয় জার্মান জাতির মানসিক অবধাগতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য ওদেশে কয়েক মাস থেকে আসা দরকার, তিনি তা পারবেন না, সেটা প্রায় এক অসম্ভব প্রস্তাব।
বিদেশের বেশ কয়েকটি সেমিনার দেখে আমার এই উপলব্ধি হয়েছে যে স্বদেশের সেমিনারগুলির সঙ্গেও তার কোনও তফাত নেই। দু-তিন দিনের সেমিনারে পৃথিবীর কোনও উপকার হয় না। কোনও ক্ষতিও হয় না। সাহিত্য বিষয়ক সেমিনারে সাহিত্যের গায়ে আঁচড়ও লাগে না। কিছু কথার খেলা হয়, সেমিনারের বাইরে কফিখানায় বা পানশালায় চমৎকার গুলতানি হয়। সেমিনারের প্রত্যক্ষ উপকারিতা তাতে গৌরী সেনের টাকায় প্রবাস ভ্রমণ হয়। কেউ সেই সুযোগে আর্ট গ্যালারি, থিয়েটার ও গ্রন্থাগার দেখে আসে, যার সামর্থ্য থাকে সে বিদেশি দ্রব্যের শপিং করে। প্রবীণ ঔপন্যাসিক আর কে নারায়ণকে জার্মান টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি ফ্রাঙ্কফুর্টে কেন এসেছেন? সুরসিক বৃদ্ধ মৃদুহাস্যে চোখের চশমা খুলে বললেন, এসেছি দু’এক জোড়া চশমা কিনতে। শুনেছি ফ্রাঙ্কফুর্টে ভালো চশমা পাওয়া যায়।
আমি মোটেই আশা করিনি যে ভারতীয় সাহিত্যের সেমিনার হচ্ছে বলেই জার্মান জনগণের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগবে। এরা ব্যস্ত মানুষ, এদের অন্যান্য ভালো-ভালো কাজ আছে। জার্মান লেখকরাই বা কেন ভারতীয় সাহিত্য বিষয়ক সেমিনার শুনতে রবাহূত, অনাহূত, এমনকী নিমন্ত্রিত হলেও ছুটে আসবে? আফ্রিকা বা ভারত সম্পর্কে যাদের মনে দয়া-দাক্ষিণ্যের ভাব আছে তাদের কথা আলাদা। আমাদের দেশে যদি কোরিয়ান বা অস্ট্রেলিয়ান (কথার কথা) সাহিত্যের দু-একজন প্রতিনিধি আসে, সরকারি বা কোনও দূতাবাসের উদ্যোগে সেমিনার হয়, যেমন প্রায়ই হয়, তাতে আমরা, ভারতীয় লেখকরা কি ছুটে যাই? আমন্ত্রণ পেলেও তো গড়িমসি করি। অবশ্য পশ্চিমি কয়েকটা দেশ বা সোভিয়েত দেশের লেখক প্রতিনিধি এলে তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য যে আমন্ত্রণ আসে, তার সঙ্গে খাদ্য-পানীয়ের চাপ প্রলোভন থাকে, এই গরিব দেশের অনেক লেখক সেইসব সমাবেশে গেলেও আমি কোনও দোষ দেখি না। জার্মানিতেও কোনও আমেরিকান, ফরাসি, ইংরেজ, রুশ লেখক এলে জার্মান লেখরাও তাঁদের সঙ্গে আলাপ করতে যাবেন হয়তো, খাদ্য-পানীয়ের লোভে নয়, আগে থেকেই ওইসব লেখকের নাম জানেন কিংবা তাঁদের রচনা পড়েছেন বলে। ভারতীয় লেখকদের ক্ষেত্রে সে প্রশ্নও ওঠেই না। এবারে ফ্রাঙ্কফুর্টের এই দলের দুই প্রধান প্রবীণ মূলকরাজ আনন্দ এবং অজ্ঞেয়কেও বিশেষ কেউ চেনেন বলে মনে হল না। মিডিয়া ওদের বিশেষ পাত্তা দেননি।
আমি তো ঠিক করেই ফেলেছি, কলকাতায় বিদেশি কোনও লেখক এলে, তিনি বা তাঁরা যদি আমার বাড়িতে দেখা করতে আসেন তো খুব ভালো কথা, সময় থাকলে নিশ্চিত আমি তাঁদের জন্য সময় ব্যয় করব, চা-টা খাওয়াব, গল্প করব, কিন্তু আমি নিজে থেকে তাঁদের সঙ্গে কোথাও দেখা করতে যাব না। কী দরকার। নিজের বাড়িতে বসে যদি আমি বাংলাভাষা খানিকটা গর্বিত ভাব পোষণ করি, তাতে এমনকী দোষ হয়? অবশ্য যে বিদেশি লেখকের লেখা আমি আগে পড়েছি বা যাঁর লেখা আমার প্রিয়, তাঁর ক্ষেত্রে এ নিয়ম খাটে না। প্রিয় লেখকের কাছে তো আমি একজন পাঠক মাত্র, তাঁর কাছে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে তো অসুবিধের কিছু নেই।
আরও একটা কথা এই প্রসঙ্গে মনে আসে। কোনও একটা জাতির প্রতিনিধিত্ব করা একটা বিড়ম্বনা। বিদেশে আমার গায়ে কেউ ভারতীয় বলে মার্কা মেরে দিলে আমার অতি বাজে লাগে। যখন আমি একলা থাকি, তখন তো আমি বাঙালিও নই, ভারতীয়ও নই, একজন শুধুই মানুষ, গোটা মানব সভ্যতার একজন অংশীদার, তাই না? শেকসপিয়ার-ডিকেন্স, টলস্টয়-গোর্কি, উগো-বদলেয়ার, গ্যেটে-হাইনে পড়ার সময় কি তাঁদের জাতের বিচার করি, না মনে করি ওরা আমাদের আত্মীয়? হ্যামলেটের শোকগাথায় আমাদের চক্ষু সজল হয় কেন, ইংল্যান্ড বা ডেনমার্কের রাজবংশের খুনোখুনিতে একজন ভারতীয় হিসেবে আমার কী আসে যায়! ডস্টয়েভস্কি বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের মানুষ কি কোনও বিশেষ দেশ বা জাতির সীমানায় আবদ্ধ? বিদেশের কোনও কোনও সাহিত্য সমাবেশে এক এক সময় আমার চিৎকার করে, রুক্ষ কণ্ঠে বলতে ইচ্ছে হয়, না, না, আমি ভারতীয় নই, ভারতীয় নই, আমি একজন মানুষ, মানুষ!
এইবারে জার্মান সংবাদপত্রগুলি, বেতার ও দূরদর্শন দুজন ভারতীয় লেখক-লেখিকার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিল। সেই দুজন হলেন দয়া পাওয়ার এবং মহাশ্বেতা দেবী। দয়া পাওয়ারের কোনও লেখা আমি আগে পড়িনি, শুধু এইটুকুই জানি যে তিনি একজন দলিত লেখক, জাতে হরিজন, তাঁর কাছাকাছি মানুষের কথাই লেখেন। আমাদের মহাশ্বেতা অতি শক্তিশালিনী লেখিকা, ইদানীং তিনি আদিবাসী-উপজাতীয়দের কথাই প্রবলভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর সম্মানে আমাদের গর্ব। জার্মান মিডিয়ায় হরিজন-আদিবাসী প্রসঙ্গেই বারবার উত্থাপিত হচ্ছিল। দলিত, নির্যাতিত, হরিজন, আদিবাসী; উপজাতি, সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে সহানুভূতি নিশ্চিত শ্রদ্ধেয়, কিন্তু ধনতান্ত্রিক দেশগুলির মিডিয়া যখন ভারতের এই দিকটিরই বেশি প্রচার করে, তখন কীরকম যেন একটা সন্দেহ হয়!
ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক মেসের কর্তৃপক্ষ দুদিনের সেমিনার শেষ হতেই আমাদের বিদায় সম্ভাষণ জানাননি। পরবর্তী সাতদিনের বইমেলা দেখার ও থেকে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। সে জন্য তাঁরা অশেষ ধন্যবাদাহ। কিন্তু থাকার ব্যবস্থাটি যে খুব একটা উপভোগ্য ছিল, সত্যের খাতিরে সেকথা বলা যাবে না। আমাদের অবশ্য ভারতের লম্বা রাস্তার পাশেপাশে ধাবার হোটেলে খাঁটিয়ায় শুয়ে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আছে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেও কত রাত কাটিয়েছি, সেই তুলনায় সাহেবদের দেশে যে-কোনও হোটেলের সাদা বিছানা তো স্বর্গ। তবু কেন যেন মনে হচ্ছিল, শ্বেতাঙ্গ জাতের লেখকরা এলে নিশ্চিত উৎকৃষ্টকর আপ্যায়ন পেতেন। আন্তর্জাতিক অতিথি সৎকারে একটা নির্দিষ্ট মান আছে। এর কিছু দিন আগেই আমরা কয়েকজন ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ভারত-উৎসবের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমেরিকা সফরে গিয়েছিলাম। সেখানে দরিদ্র ভারত মাতা তাঁর সন্তানদের কিন্তু আন্তর্জাতিক মানেই রক্ষণাবেক্ষণ করেছিলেন।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাটি বিরাট তো বটেই এবং বিচিত্র প্রকৃতির। এ এমন এক মেলা যেখানে বই অঢেল, দর্শকও প্রচুর কিন্তু একজনও ক্রেতা নেই। কলকাতার বইমেলার সঙ্গে তো মেলেই না, এমনকী মেলা বলতে আমরা যা বুঝি তার সঙ্গেও মেলে না। বই কি মেয়েদের মুখ বা জঙ্গলের হরিণ বা শিল্পীর তুলির টান, যা শুধু দেখতেই সুখ? বই দেখতে-দেখতে, ঘাটতে-ঘাটতে যদি হঠাৎ একটি বই পছন্দ হয়, পকেট যদি তখন একেবারে নিঃস্ব না হয়, তাহলে তখুনি সেই বইটি পড়ার জন্য হস্তগত করার ইচ্ছে দমন করা কি ভয়াবহ কোনও অবদমনের পর্যায়ে পড়ে না? এই অবদমনের কোনও মানসিক চাপ নেই? ব্যবসায়ী শহর ফ্রাঙ্কফুর্টে বইমেলায় খুচরা বই বিক্রির কোনও ব্যবস্থা নেই। এখানে এক দেশের প্রকাশকরা আসেন অন্যদেশের প্রকাশকদের সঙ্গে দরাদরি ও চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে, অনুবাদ সত্ব, সংস্করণ ক্রয় হ্যানোত্যানো নিয়ে কথাবার্তা হয়, নিছক একজন পাঠক বা বইপ্রেমীর কোনও ভূমিকা নেই। বইমেলা নাম হলেও এটি আসলে একটি বাণিজ্যমেলা, বা উদ্দেশমূলক প্রদর্শনী, এখানে লেখকদের বিশেষ যাতায়াত নেই। পরে একসময় গুন্টার গ্রাস কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তিনি ওই বইমেলায় কদাচিৎ যান।
সাতটি প্যাভেলিয়ান ভরা অসংখ্য বই। দু-একদিন ঘুরে-ঘুরে দেখার পর ক্লান্ত লাগে, একঘেয়ে লাগে। দর্শকদের হাতে শুধু বিভিন্ন প্রকাশকের পুস্তক তালিকা, কেউ-কেউ আবার বিনামূল্যে প্রাপ্তব্য নানানরকম মনোহারী ঠোঙা সংগ্রহ করতে আগ্রহী। একটি গোটা প্যাভিলিয়ান এবারে আলাদাভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের গ্রন্থাবলির জন্য। মণ্ডপটির সম্মুখভাগ সুন্দরভাবে সজ্জিত, সেখানে ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন। এ ছাড়া অনেকগুলি ছোট বড় দোকানে ভারতের বিভিন্ন ভাষার প্রকাশকরা তাঁদের বই সাজিয়ে বসেছিলেন। এ বছর ভারতের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া সত্বেও এই মণ্ডপটিতে জন সমাগম হয়েছে সবচেয়ে কম। বিশ্ব সাহিত্যে এবং বিশ্বের বইয়ের বাজারে ভারতের ভূমিকা এখন নগণ্য। ল্যাটিন আমেরিকার যে-কোনও ছোট দেশের তুলনায়ও ভারতীয় লেখকদের বইয়ের অনুবাদ অনেক কম। পশ্চিমি দেশগুলির ঝোঁক এখন চিনের দিকে, ভারত যেন শুধুই ধর্ম আর দারিদ্র্যের দেশ। ভারতেও যে আধুনিক সাহিত্য রচিত হয় তা অনেকেই জানে না, জানার জন্য মাথাব্যথাও নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নে তবু যা ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদ হয়, পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে তার দশ ভাগের একভাগও না। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা কর্তৃপক্ষ অবশ্য আগামী বছর থেকে রবীন্দ্রনাথের নামে একটি পুরস্কার ঘোষণা করেছেন।
বইমেলার দিনগুলি আমাদের কাছে কিছুটা উপভোগ্য হয়েছিল বাঙালি আড্ডায়। এ বছর বইমেলা ও দুর্গাপুজো প্রায় কাছাকাছি সময়ে পড়েছিল। ফ্রাঙ্কফুর্টেরাইন-মাইন ক্লাব নামে একটি বাঙালিদের ক্লাব আছে, তাঁরা পুজোর আয়োজন করেন। ফ্রাঙ্কফুর্টে বিদেশির সংখ্যা কম নয়, প্রতি সাত জনে একজন তবে তাদের মধ্যে যুগোশ্লাভ, ইটালিয়ান, তুর্কি, স্প্যানিয়ার্ড ও গ্রিকরাই বেশি। ভারতীয়দের সংখ্যা অকিঞ্চিৎকর, তবু তারই মধ্যে বাঙালিদের উপস্থিতি বেশ চোখে পড়ে। এখানকার বাঙালিরা বেশ করিতকর্মা, এবং অতিথিপরায়ণ ও সজ্জন। দুর্গাপুজোর সময় তাঁরা সাহিত্য সভারও আয়োজন করেছিলেন, সেই উপলক্ষে স্বদেশ থেকে কয়েকজন বিশিষ্ট লেখককে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এসেছিলেন সমরেশ বসু, বুদ্ধদেব গুহ, বিজয়া মুখোপাধ্যায় কলকাতার প্রকাশকদের মধ্য থেকে গিয়েছিলেন সুপ্রিয় সরকার, বিমল ধর, অভীককুমার সরকার, অরূপকুমার সরকার, প্রসূন বসু, বাদল বসু ও আরও কেউ কেউ, এদের মধ্যে কয়েকজনের স্ত্রী। আমার স্ত্রী স্বাতীও গিয়েছিল দেব-দর্শন মানসে। পশ্চিম জার্মানির অন্যান্য শহর থেকে বেড়াতে আসা বেশ কয়েকজন বাঙালি পুরুষ ও রমণীরও সাক্ষাৎ পেয়েছি। সুতরাং মেলায় কিছুক্ষণ ঘুরেই ফিরে আমরা এসে বসতুম বাংলা বইয়ের দোকানে। দু-পাঁচ মিনিটের বেশি ইংরিজি বলতে হলে আমি ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে উঠি, বাংলা আড্ডাতেই আমার পরম সন্তোষ। দেশে যাঁদের সঙ্গে প্রায়ই সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়, বিদেশে গিয়েও তাঁদের কারু সঙ্গে দৈবাৎ দেখা হলে সেই আড্ডায় একটা অন্যরকম স্বাদ আসে।
কলকাতায় কোনও বইয়ের দোকানে বেশিক্ষণ বসে থাকার সুযোগ আমাদের হয় না। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কফুর্টে বাংলা বইয়ের দোকানে বসে আমি দেখেছি বিদেশি দর্শকদের ভাবলেশহীন মুখ। যেসব বিখ্যাত বাংলা বই স্বদেশের শত-সহস্র পাঠকের মন আন্দোলিত করেছে, সেই বই সম্পর্কে বিদেশি পাঠকের বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই। কেনই বা থাকবে? ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য, সেই ভাষাই আবার মানুষের বিরাট ব্যবধানের সৃষ্টি করেছে। চিত্রশিল্প কিংবা গণিতের আন্তর্জাতিক সমমর্মিতা আছে, সাহিত্যের নেই। সাহিত্যকে নির্ভর করতে হয় অনুবাদের ওপর। তা বলে নিজেদের উদ্যোগে প্রকৃতভাবে ভারতীয় সাহিত্যের ইংরেজি-ফরাসি-জার্মান অনুবাদ করানোর আমি পক্ষপাতী নই। তাতে কিছু সুফলও হয় না। ওদের যদি ইচ্ছে হয় ওরা করে নেবে, না করলেও ক্ষতি কিছু নেই। প্রায় পনেরো-ষোলো কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে, তাদের জনই কি বাংলা সাহিত্য যথেষ্ট নয়? ওরা যদি বাংলা সাহিত্য না পড়ে তাহলে ওরাই ক্ষতিগ্রস্ত হল, সারা জীবন একটা ভালো সাহিত্যের সন্ধান পেয়ে কিছুটা মূর্খ থেকে গেল। সেই তুলনায় আমরা বাংলাও পড়ি আবার কিছু কিছু ইংরেজি ফরাসি-জার্মানি ইত্যাদি সাহিত্যেরও রসগ্রহণ করি। সুতরাং ওদের তুলনায় নিশ্চিত আমরা শিক্ষিততর।
সাতদিনের বইমেলায় পুরো সাতদিন থাকা হয়নি। শুধু ঘুরেঘুরে বই দেখা, খুচরা-খাচরা সাহিত্য-বাসর ও আড্ডার পক্ষেও সাতদিন বড় লম্বা সময়, তাই দিন চারেক পরেই আমরা কয়েকজন বেরিয়ে পড়লুম জার্মানির অন্যান্য অঞ্চল ভ্রমণে। টাটকা বাতাসে নিশ্বাস ও দু’ চক্ষু ভরে সবুজ দেখার আনন্দ তো সব দেশেই সমান।