রাত্রি ন’টা আন্দাজ টেলিফোন বেজে উঠল।
–তুমি খুব ব্যস্ত। একবার আসতে পারবে?
পরিচিত অধ্যাপকের স্ত্রীর গলা।
আবহাওয়া ভালো নয়, প্রায়ই বৃষ্টি হচ্ছে। সারাদিন সন্ধের পর ঝড়ের হাওয়া উঠেছে। অধ্যাপকের বাড়িতে পৌঁছলাম। সদর দরজা খোলাই ছিল, আমি না ডেকেই ভেতরে ঢুকে গেছি বহুবার! ওঁদের কুকুরটাও আমাকে চেনে।
বসবার ঘরে আলো জ্বলছে, কিন্তু শূন্য ঘর, বাইরের ঝড়ের শব্দ উঠছে শোঁশোঁ করে। কীরকম যেন অস্বাভাবিক লাগল–সারা বাড়িতে কোনও জনপ্রাণীর শব্দ নেই–মেরি আমাকে টেলিফোন করে হঠাৎ এ সময় ডাকলই বা কেন? কোনও বিপদ-আপদ হয়নি তো? কিন্তু বিপদ-আপদ হলে আমাকেই বা ডাকতে যাবে কেন? আমি কী করব, আমার আর কী করার ক্ষমতা আছে? আমি চেঁচিয়ে ডাকলুম, মেরি। মেরি!–শূন্য বাড়িতে আমার ডাক প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। কুকুরটা ছুটে এসে শুধু কুঁ-কুঁ করতে লাগলে পায়ের কাছে।
একটু পরে পায়ের শব্দ পেলাম। বেসমেন্ট অর্থাৎ মাটির তলা থেকে উঠে এল মেরি! পরনে একটা ঢিলে গাউন, শুকনো মুখ, একমাথা সাদা চুল এলোমেলো! ঈষৎ অপ্রস্তুতভাবে হেসে বলল, ইস, তুমি অনেকক্ষণ এসেছ বুঝি! তোমাকে কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ছি, ছি! আমি বেসমেন্ট গিয়ে বসেছিলাম, জানো, আমি ঝড়ের শব্দ মোটে সহ্য করতে পারি না।
অধ্যাপকের নাম করে জিগ্যেস করলুম, আলবার্ট কোথায়? পিতার বয়সি সেই অধ্যাপক এবং মায়ের বয়সি অধ্যাপকের পত্নী, কিন্তু এ দেশের নিয়ম নাম ধরে ডাকা। কথার ভঙ্গি এমন যেন তুমি করে কথা বলছি। এমন কোনও ঠাট্টা ইয়ার্কি নেই যা এঁদের সামনে করা যায় না। যদিও আমি ওঁর ছাত্র নই, অন্য সূত্রে পরিচয়, কিন্তু অন্তরঙ্গ ছাত্ররাও অধ্যাপকের সঙ্গে এই সুরেই কথা বলে।
মেরি বলল, আলবার্ট গেছে নিউ ইয়র্ক, তুমি জানোনা? সাতদিন আগে!
–সে কী, এই সাতদিন তুমি একা আছ?
মেরি বিষণ্ণ হেসে বলল, হ্যাঁ, আর কে থাকবে বলো! জানো, আজ অ্যালবার্টের প্লেনে চড়ে বোস্টন যাওয়ার কথা, এই ঝড়ের রাত আমার এমন ভয় করে!
–আমাকে হঠাৎ ডেকেছ? তোমার কোনও জিনিসের দরকার আছে? আমি এনে দেব?
–না, না। তোমাকে ডেকেছি একটু গল্প করার জন্য। তোমার যদি কোনও কাজ থাকে, তাহলে অবশ্য…না, না, ডোনট বি পোলাইট! তুমি সত্যি করে বলো, আমার জন্য শুধু…
আমি বিষম ব্যস্ত হয়ে বললুম, মোটেই না, আমার কোনওই কাজ ছিল না। আমি টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে বসে-বসে নভেল পড়ছিলুম। তার বদলে তোমার সঙ্গে গল্প করতে আমার অনেক ভালো লাগবে!
–মোটেই না, আমি জানি! বুড়ির সঙ্গে গল্প করতে কার ভালো লাগে। কারুর না! তোমার বয়সি ছেলেদের তো নয়ই, এমনকী বুড়োদেরও নয়! কিন্তু আজ বড় মন খারাপ, খুব একা-একা লাগছে, কিছুতেই চুপ করে বসে থাকতে পারছিলুম না। এসো না হয়, আমরা দুজনে বসে একসঙ্গে টেলিভিশন দেখি!
না, থাক! টেলিভিশন আমার অসহ্য লাগে। বরং গল্প করি এসো!
মেরি খানিকটা হাসল। তারপর বলল, আমিও যে টেলিভিশন খুব ভালোবাসি তা নয়, কিন্তু বুঝলে, একা থাকলে অনেকটা সঙ্গ দেয়। আচ্ছা, তুমি কী ড্রিংকস নেবে বলো? আমি নিয়ে আসি, তারপর গল্প করা যাবে।
আমি নাম বললুম।
মেরি রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে পানীয় তৈরি করতে গেল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে দূর থেকে ওঁর দিকে চেয়ে রইলুম। বার্ধক্যে ওঁর শরীর একেবারে ভেঙে না দিয়ে বরং অন্য ধরনের সৌন্দর্য এনে দিয়েছে। আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের বৃদ্ধাদের মতো, ওদের পোশাক পরিচ্ছেদে অবহেলা নেই। স্বামী বিখ্যাত অধ্যাপক, প্রায়ই নানান কাজে এখানে ওখানে যেতে হয়। প্রায়ই খবরের কাগজে স্বামী সম্পর্কে প্রশস্তি বেরোয়। সুতরাং ওকে দেখলে মনে হয় সুখী মহিলা। কোনও অতৃপ্তি থাকার কথা নয়।
কিন্তু এই ঝড়ের রাত্রে দেখে বুঝতে পারলুম কত অসহায়। নিজের মুখে প্রায় ভিখারিনীর মতো স্বীকার করলেন, একা থাকতে ওঁর খারাপ লাগছে। এ কথা সাহেব-মেমরা কেউ মুখে বলে না। কত পরিবারকে দেখেছি, এ দেশের সর্বত্র, ইওরোপেও, সন্ধেবেলা কী দারুণ বিষণ্ণ। কিছু করার নেই। খবরের কাগজ মুখে নিয়ে বসে থাকা, অথবা টেলিভিশনের সামনে ঝিমোনো। বিশেষ করে বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের কিছু করার নেই। ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা বাড়িতে থাকে। মেয়েরা চলে যায় পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে পার্টিতে। অথবা এক বাড়িতেও থাকলে ছেলে-মেয়ে বাপ-মার সঙ্গে বসে সন্ধেবেলা গল্প করতে আসে না। রবিবার গির্জাতে গিয়ে যা একটু গল্প-গুজবের সুযোগ, আর নানা ধরনের ক্লাবের মিটিং-এ কিছুটা পরনিন্দা পরচর্চা। এ-ছাড়া আর সঙ্গ নেই। বুড়ো-বুড়িদের পার্টিতেও ডাক পড়ে খুব কম। বাড়িতে পুজো করারও প্রথা নেই যে, আমাদের দেশের ঠাকুমা-দিদিমার মতো দিনরাত ঠাকুরঘরে পড়ে থাকবে।
মেরির দুই মেয়ে এক ছেলে। এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, ফিলাডেলফিয়ায় থাকে। ছেলে থাকে জাপানে। আরেক মেয়ের বিয়ে হয়নি, কিন্তু তার বিষম ঘোড়া পোষার শখ। শহর থেকে চল্লিশ মাইল দূরে একটা ফার্মে ওদের দশটা ঘোড়া আছে, মেয়ে সেখানেই থাকে একা। সপ্তাহে একবার হয়তো বাপ-মার সঙ্গে দেখা করে যায়। এদের কারুর কোনও ভয় ডর নেই, মেয়ে থাকে একা সেই নির্জন ফার্মে, দুটো ভয়ংকর কুকুর তাকে পাহারা দেয়। আর মা আছে একা। এই নির্জন বাড়িতে ঝড়ের রাত্রে সম্পূর্ণ একা।
মেরি যে আমাকে ডেকেছে, সে যে শুধু আমাকে স্নেহ করে সেই জন্যই নয়, আমি বিদেশি বলে প্রত্যাখ্যানও করব না। কিন্তু আমার বয়সি এ দেশের কোনও ছেলে-মেয়েকে ডাকলে মোটেই আসত না, হয়তো মুখের ওপরই ঠাট্টায় প্রত্যাখ্যান করে উঠত। দরকার ছাড়া কেউ কারুকে ডাকে নাকি? শুধু এক বুড়ির সঙ্গে গল্প করার জন্য? অসম্ভব! অন্য কোনও বুড়ো বুড়িকেও ডাকা যায় না। সেও নির্জন, সেও একাকিত্বে অসুখী, কিন্তু কেউ কারুর কাছে স্বীকার করবে না সে কথা। সে যে বিষম লজ্জার। এমনকী আমাকেও যদি মেরি প্রায়ই ডাকে, আমারও হয়তো আসতে ভালো লাগবে না, আমিও হয়তো মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে এড়াবার চেষ্টা করব। আগেও তো করেছি আমার বুড়ো বাড়িওলা যখন আমার ঘরে এসে অনাবশ্যক গল্প করে দেরি করেছে, আমি ব্যস্ততার ভাব করে সরে পড়েছি।
অথচ মেরির সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালোই লাগে। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং রসিকতা জ্ঞান আছে। কোনওরকম কুসংস্কার নেই। বহু জিনিস সম্পর্কে ভালো পড়াশুনো আছে। কিন্তু যখনই নির্জনতার প্রসঙ্গ আসে, তখনই আমার অস্বস্তি হয়। মনে হয়, কোনও মানুষেরই নির্জনতা আমি স্পর্শ করতে পারব না। আমার সাধ্য নেই, কারুর একাকিত্ব ঘোচাবার। আমি সে-মন্ত্র জানি না। আমি বসে বসে কথা বলতে পারি, কিন্তু যখনই মনে হবে, এ-সব কথাই আসলে মূল্যহীন, আসলে একজন মানুষকে কিছুক্ষণ সঙ্গ দেওয়া, তার একাকিত্ব ভুলিয়ে রাখা, তখনই আমার অস্বস্তি লাগে, আমার মনে হয়, আমিও খুব দূরে সরে যাচ্ছি, দূরে সরে গিয়ে কোথায় আমিও বিষম একা হয়ে পড়লাম।
মেরি পানীয় এনে বসল আমার সামনে। কী যেন দু-একটা কথা বলে সামান্য হাসাহাসি করলুম। একটু বাদেই সবিস্ময়ে লক্ষ করলুম, অনেকক্ষণ আমরা কথা না বলে চুপচুপ বসে আছি। আমাদের কথা ফুরিয়ে গেছে। তখন মেরি বলল, তুমি শুনবে, আমি পিয়ানো বাজাব? তোমার খারাপ লাগবে না তো?
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম।
উঠে গিয়ে মেরি পিয়ানোর সামনের টুলে বসল। একা একা বুঝি পিয়ানো বাজানো যায় না। তার জন্যও একজন সঙ্গীর দরকার হয়।
বাইরে তখন ঝড়ের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পিয়ানোর টুং টাং শব্দ শুনতে আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। আমার মনে হল, মেরি তো এমনিতে কাঁদতে পারবে না মন খুলে। তবু, এই পিয়ানোর শব্দের মধ্যে কিছুক্ষণ কেঁদে নিক!