[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

২৩. এক মুখচোরা বাঙালি ছোঁকরা

বেশ কয়েক বছর আগে এক মুখচোরা বাঙালি ছোঁকরা এসেছিল সানফ্রান্সিসকো শহরে। গ্ৰেহাউন্ড বাস ডিপোতে এসে নেমেছিল সন্ধেবেলা, সঙ্গে একটা মাঝারি ব্যাগ, বলতে গেলে প্রায় সহায়সম্বলহীন, নিছক ভ্রমণের জেদেই সে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

কোনও নির্দিষ্ট থাকার জায়গা না থাকলে সানফ্রান্সিসকো শহরটি সন্ধেবেলা একা পৌঁছবার পক্ষে মোটেই উপযুক্ত নয়। এই নগরীটি যেমন সুন্দরী তেমনই ভয়ংকরী। গোটা মার্কিন দেশেই অপরূপ সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশে আছে নিদারুণ হিংস্রতা। সেই ছেলেটির কোনও থাকার জায়গার ঠিক নেই, পকেটে টাকাপয়সা যৎসামান্য, নতুন শহরে এসে সে ওয়াই এম সি এ-তে ওঠবার চেষ্টা করে। এর থেকে সস্তায় আর কোথাও থাকা যায় না।

ছেলেটি বাস স্টেশনেই টেলিফোন ডিরেক্টরি দেখে ফোন করল ওয়াই এম সি এ-তে। নিদারুণ দুঃসংবাদ, সেখানে একটাও জায়গা খালি নেই, আগামী দু-দিনের মধ্যে কোনও জায়গা পাওয়া যাবে না। নাম লিখিয়ে রাখলে তারপর ঘর পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আজকের রাত্রিবাস কোথায় হবে?

ব্যাগটি পিঠে ঝুলিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। টিপি-টিপি বৃষ্টি পড়ছে। সেই সঙ্গে ছেলেটির গা ছমছম করছে। বন্দর-শহরে এমনিতেই লুঠেরা-বখেরাবাজ আর খুনে গুন্ডাদের আড্ডা থাকে, তার ওপরে সানফ্রান্সিসকো শহরে আছে একটি বিশাল চিনা উপনিবেশ। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রহস্য লহরি সিরিজে ভয়াবহ সব চিনে গুন্ডাদের কাহিনি সে পড়েছে, চিনে-খুনিদের ছুরিগুলো হয় সরু লিকলিকে, পিঠে গাঁথলে বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়, যাকে গাঁথা হল, সে কিছু না বুঝেই অক্কা পায়। রাস্তা দিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে-তাকাতে ছেলেটি হাঁটছে আর তার পিঠ শিরশির করছে।

ছেলেটির কাছে একটি মাত্র ঠিকানা আছে। সিটি লাইটস বুক স্টোরের আংশিক মালিক, তার নাম লরেন্স ফের্লিংগেটি। কবি অ্যালেন গিনসবার্গ এই ঠিকানাটা তাকে দিয়ে বলেছিল, যদি কখনও সানফ্রান্সিসকো যাও, এর সঙ্গে দেখা কোরো। ছেলেটি ভাবল, এখুনি কি একবার ফের্লিংগেটিকে ফোন করা উচিত? কিন্তু ওর কাছে কি আশ্রয় চাওয়া যায়? সাহেবদের বাড়িতে তো হঠাৎ কোনও অতিথি আসে না, এ দেশে সবই অ্যাপয়েন্টমেন্টে চলে। ছেলেটি লাজুক, তাই সে ফোন করল না, সস্তার হোটেল খুঁজতে লাগল।

একটার পর একটা হোটেলের দরজা থেকে ফিরে যাচ্ছে সে। কোথাও ঘর খালি নেই, কোথাও দাম অতিরিক্ত চড়া। এর মধ্যেই বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে সে, ভাগ্যিস সানফ্রান্সিসকোতে তেমন শীত পড়ে না। সারা আকাশ চিরে বিরাট-বিরাট বিদ্যুৎ আর প্রচণ্ড বজ্রের গর্জন হচ্ছে মাঝে-মাঝে, যেন আকাশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে।

ডাউন টাউন ছাড়িয়ে আসতেই রাস্তা একেবারে ফাঁকা, শুধু গাড়ি, কোনও পথচারী নেই। অচেনা শহরে এক কচি বয়েসের বঙ্গ সন্তান হেঁটে চলছে অসহায়ভাবে। এইরকম অবস্থায় একটা নেশার ভাব হয়, এক সময় সব ভয় কেটে যায়, মনে হয়, যা হয় হোক, চারটে ডাকাত ঝাঁপিয়ে পড়ুক, পেটে ছুরি চালিয়ে দিক, টাকা-পয়সা ব্যাগট্যাগ কেড়ে নিয়ে চলে যাক, কিছু যায় আসে না। দেখা যাক না কে কত মারতে পারে।

দূরে একটা হোটেলের আলো দেখা যাচ্ছে, ছেলেটি এগোচ্ছে সেই দিকে, হঠাৎ যেন মাটি কুঁড়ে দাঁড়াল তার সামনে একটা কালো দৈত্য। সাদা ধপধপে দাঁতে হেসে সে বলল, গট আ লাইট?

ছেলেটি প্রথমে দারুণ চমকে কেঁপে উঠলেও সঙ্গে-সঙ্গে স্থির হয়ে গেল। সে বুঝেছে যে চরম মুহূর্ত এসে গেছে। সে দেশলাই খোঁজার জন্য পকেটে হাত দেওয়া মাত্র এই কালো দৈত্যটি তার পেটে ছুরি মারবে। এই রকমই নিয়ম। বাধা দিয়ে কোনও লাভ নেই, কারণ এই কালো দৈত্যটি ইঁদুরছানার মতন তার টুটি চেপে ধরে শূন্যে তুলে লোপালোপি করতে পারে।

ছেলেটি অভিমানভরা কন্ঠে বলল, আমার কাছে তো দেশলাই নেই?

এই কথাগুলি বলায় এবং তার পরবর্তী উত্তর শোনার মাঝখানে যেন কেটে গেল একযুগ। এখনও সে মরেনি?নাকি ছুরি চালিয়ে দিয়েছে, সে টের পাচ্ছেনা?

কালো দৈত্যটির হাতে সিগারেটের প্যাকেট, তখনও ছুরি কিংবা রিভলভার দেখা যাচ্ছে না। সে বলল, হোয়াইয়ু গোয়িং, ম্যান!

অল্প দূরে ‘হোটেল সিসিল’ লেখা বাতি স্তম্ভটি দেখাল ছেলেটি আঙুল তুলে।

কালো দৈত্যটি কী যেন একটু চিন্তা করে বলল, কম কম।

তারপর সে ছেলেটির সঙ্গে-সঙ্গে চলতে লাগল। এতক্ষণেও মরে না যাওয়ায় ছেলেটি বেশ অবাকই হয়েছে। কালো মানুষটি তাকে এত দয়া করছে কেন? এত জনশূন্য রাস্তায় তাকে ঝট করে খুন করে ফেললে কেউ তো দেখবার নেই। অন্তত ব্যাগটা তো কেড়ে নিয়ে অনায়াসেই পালাতে পারে।

হোটেলের কাউন্টারে যে ফরসা মেয়েটি বসেছিল তার সঙ্গে কালো লোকটিই প্রথমে কিছুক্ষণ কথা বলল। সে কথার মর্মোদ্ধার করা শক্ত। তবে মনে হচ্ছে, কালো লোকটি ফরসা মেয়েটিকে বেশ অনুরোধ করছে।

একটু বাদে ফরসা মেয়েটি ছেলেটিকে বলল, শোনো, আমাদের হোটেলেও জায়গা নেই। এইরকম সময়ে তুমি হোটেল রিজারভেশন ছাড়াই সানফ্রান্সিসকো শহরে এসেছ? যাই হোক, তোমার বন্ধুর অনুরোধে একটা ব্যবস্থা করতে পারি, যদি তুমি রাজি থাকো।

ছেলেটি আকাশ থেকে পড়ল। বন্ধু? মাত্র দেড় মিনিট আগে দেখা, পরস্পরের নামও জানে, এর মধ্যে ওরা বন্ধু হয়ে গেল? এ আবার কী ধরনের চক্রান্ত?

মেয়েটি বলল, একটা ডবল বেড রুমে একটা বেড খালি আছে। যে লোকের ঘর, সে এখন নেই, যে-কোনও সময় এসে পড়তে পারে, তবে তাকে বলা আছে যে তার ঘরের অন্য বিছানাটি আর একজনকে দেওয়া হতে পারে। তুমি সেটা নিতে রাজি আছ?

অচেনা লোকের সঙ্গে রাত্রিবাস? সে কীরকম কে জানে? এই কালো লোকটি কোনও মতলবে নিয়ে তাকে ওই ঘরে ঢোকাচ্ছে? কিন্তু ভাড়া এত অবিশ্বাস্যরকমের সস্তা যে ছেলেটি এক কথায় বলতে পারল না।

কালো লোকটি কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে হঠাৎ বলল, হে! ইয়ু, লুক সো স্কেয়ার্ড…হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ।

ফরসা মেয়েটি কিন্তু হাসে না। সে বলল, যদি রাজি থাকো, তবে তোমার গাড়িটা পেছন দিকে রেখে এসে রেজিস্টারে নাম লেখো–

গাড়ি ছাড়া, এমনকী ট্যাক্সিও না নিয়ে, পায়ে হেঁটে কেউ সানফ্রান্সিসকো শহরে রাত্তিরবেলা হোটেল খুঁজতে বেরুতে পারে, এ কথা এরা বিশ্বাসই করতে পারবে না। খুনে-ছিনতাইবাজরা সবাই কি আজ ক্যাজুয়াল লিভ নিয়েছে?

ছেলেটি বলল, আমার গাড়ি নেই, কোথায় নাম লিখতে হবে বলো।

কালো লোকটি ঝুঁকে কাউন্টারের ওপাশ থেকে একটা দেশলাই তুলে নিয়ে কী একটা দুর্বোধ্য বিদায় বাক্য বলে হঠাৎ নেমে গেল রাস্তায়। মেয়েটি নিজেই ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে লিফটে উঠল, সাততলায় একটা ঘরের দরজা খুলে দিয়ে, এতক্ষণ বাদে একটু মুচকি হেসে বলল, হ্যাভ আ নাইস টাইম।

তারপরেই সে প্রায় একটা পাখির মতন উড়ে গেল ফুরুৎ করে।

এরকম অবস্থায় শুধু একটা কথাই মনে হয়, এ কোথায় এসে পড়লুম রে, বাবা!

ঘরটি মাঝারি, মধ্যে টেবিল ল্যাম্প সমেত ছোট টেবিল, দুপাশে দুটো খাট। একটি বিছানা নিভাঁজ পরিচ্ছন্ন, অন্য বিছানাটি এলোমেলো। ওয়ার্ডরোবের দরজাটা হাট করে খোলা, তার মধ্যে কয়েকটা জামা-প্যান্ট আর একটা ওভারকোট ঝুলছে। নীচে একটা সুটকেসও রয়েছে, সেটাও তালাবন্ধ নয়, উঁচু হয়ে আছে ডালাটা। এ ঘরের আসল মালিক কীরকম মানুষ কে জানে। ওভারকোটের সাইজ দেখে মনে হচ্ছে বেশ লম্বা-চওড়া। সে যদি এসে বলে তার কোনও জিনিস চুরি গেছে? কিংবা মাঝ রাত্তিরে সে যদি কোনও বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে এসে তাকে বলে, গেট আউট! না, না, গেট আউট তো ভদ্র ভাষা, সে নিশ্চয়ই বলবে, গেট দা হেল আউট অব হিয়ার!

ছেলেটি বিমর্ষভাবে নিজের খাটে বসে জুতো-মোজা খুলে ফেলল। তার মাথায় এখন আকাশপাতাল চিন্তা। রাস্তার কালো লোকটি কেন তাকে এই হোটেলে পৌঁছে দিয়ে থাকবার ব্যবস্থা করে দিল? বিনিময়ে পয়সাকড়ি কিছু চাইল না, একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত নেওয়ার জন্য দাঁড়াল না! ও কি দৈত্যকূলে প্রদ?কাউন্টারের মেয়েটি যাওয়ার সময় মুচকি হেসে গেল কেন? তাকে নিয়ে কোনও মজার খেলা হবে? এঘরের মালিক রাত্তিরবেলা এসে তাকে তুলোধোনা করবে?

বাঙালি ছেলেদের স্বভাব হচ্ছে এই যে, তারা এক কথায় মরে যেতে একটুও ভয় পায় না, কিন্তু মার খাওয়া বড্ড অপছন্দ করে।

ভয়ের সঙ্গে একটা খিদের সম্পর্ক আছে। ছেলেটি যদিও বিকেলবেলা একটা বেশ বড় হ্যামবার্গার আর কফি খেয়েছে, তবু এর মধ্যে তার খিদে পেয়ে গেল। কিন্তু খাবার জন্য তাকে আবার বাইরে যেতে হবে? কোনও দরকার নেই! তার ব্যাগে বিস্কুট, চিজ আর আপেল আছে।

কিন্তু খাওয়ার আগে অন্য একটা কাজের কথা তার মনে পড়ে গেল। সে যে এই শহরে এসেছে তা কেউ জানে না। এখন তো থাকবার জায়গা জুটেছে, এখন শ্রীযুক্ত লরেন্স ফের্লিংগেটির সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা যেতে পারে। রাত আটটাও বাজেনি, বইয়ের দোকান খোলা থাকাই সম্ভব। ঘরেই ফোন আছে, সহজেই সিটি লাইট বুক স্টোরস পেয়ে গেল সে। কিন্তু তারপরই দুঃসংবাদ। মিঃ ফের্লিংগেটি ইজ নট ইন টাউন! কাল-পরশু ফিরে আসতে পারেন। যাঃ, এ শহরের সঙ্গে ছেলেটির একমাত্র যোগসূত্রও নষ্ট। এখন যদি সে এখান থেকে নিঃশব্দে হারিয়ে যায়, কেউ টেরও পাবে না।

ঘরের সংলগ্ন একটি বারান্দাও আছে। আপেল কামড়াতে-কামড়াতে ছেলেটি খালি পায়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। এতক্ষণ বাদে তার খেয়াল হল যে প্রায় দু-ঘণ্টা আগে সে সানফ্রান্সিসকোয় পৌঁছলেও নানারকম দুর্ভাবনা নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিল যে এ-শহরের কিছুই তার চোখে পড়েনি। এ-শহরের এত নাম সে শুনেছে, কিন্তু এ পর্যন্ত সে দেখেছে শুধু কয়েকটি রাস্তা আর বড়-বড় বাড়ি, যা সব শহরেই আছে। এই বারান্দা থেকেও বিশেষ কিছু দেখা যায় না, তবে দূরে দেখা যাচ্ছে একটা উজ্জ্বল আলোর আভা, ওখানে কিছু আছে নিশ্চয়ই। এমন কিছু রাত হয়নি, এখনও সে বেরিয়ে শহরটা ঘুরে দেখে আসতে পারে, এইসব শহর রাত্রিরই শহর, এরা রাতমোহিনী। কিন্তু ছেলেটির আর উৎসাহ নেই, তার বিমর্ষ ভাব কিছুতেই কাটছেনা।

যে-কোনও বড় শহরেই একাকিত্ব অতি সাংঘাতিক। যেন দম আটকে ধরে। তা ছাড়াও এই ধরনের অদ্ভুত রাত্রির আশ্রয়ে সে কিছুতেই সুস্থির হতে পারছে না। কল্পনায় ইতিমধ্যে সে তার রুমমেটের প্রায় পঁচিশরকম চেহারা ভেবে ফেলেছে।

অনেকক্ষণ বাস জার্নি করে এসেছে বলে আজকের রাতটা সে বিশ্রামই নেবে ঠিক করল। সাহেবরা শ্লিপিং সুট পরে ঘুমোয়, ছেলেটির তা নেই, তার আছে পাজামা আর পাঞ্জাবি। যদি এই পোশাক দেখেই তার রুমমেট রেগে যায়? কিন্তু কী আর করা যাবে, উপায় তো নেই, সেই পোশাকেই শুয়ে পড়ল সে।

অবশ্য ঘুম আসবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। প্রতি মুহূর্তে সে তার রুমমেটের প্রতীক্ষা করছে। এই বুঝি দরজায় খুট করে একটা শব্দ হয়। যত রাত বাড়ছে, তত আশঙ্কা বাড়ছে। কারণ বেশি রাতে যে ফিরবে, সে নিশ্চয়ই বদ্ধ মাতাল হয়েই ফিরবে। ওরে বাপ রে, সাহেব-মাতাল, তার একটা কথাও বুঝতে পারা যাবে না…।

ছেলেটি নিজের ওপরেই ক্ষুব্ধ হয়ে ভাবল, দূর ছাই, কেন যে নাস্তিক হতে গিয়েছিলাম। নইলে এই সময়টায় তো ভগবানকেও ডাকা যেত উদ্ধার করে দেওয়ার জন্য।

একটু বাদে-বাদেই সে উঠে টেবল ল্যাম্প জ্বেলে ঘড়ি দেখছে। রাত সাড়ে দশটা…বারোটা…পৌনে একটা…দুটো…আড়াইটে…এখনও সে মক্কেলের ফেরার নাম নেই।

ফাঁসির আসামিও তো আগের রাত্রে ঘুমোয়, সেই রকম সে-ও ঘুমিয়ে পড়েছিল একসময়। কী একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যেতেই সে চোখ মেলে দেখল সকালের আলোয় ঘর ভরে গেছে। আর তার ঠিক মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। লোকটি অস্বাভাবিক লম্বা কিন্তু রোগা, চোখ দুটো একেবারে নীল, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, তার হাতে কী একটা অদ্ভুত জিনিস, মেশিনগান-টান কিছু হবে নিশ্চয়।

বোবায় ধরা মানুষের মতন সদ্য ঘুম ভাঙা ছেলেটি ভয়ার্ত আঁ আঁ শব্দ করে উঠে বসল। হাতজোড় করে বাংলায় ক্ষমা চাইতে গেল।

সেই রোগা লম্বা লোকটি কিন্তু খুবই বিনীতভাবে এবং নরম, পরিচ্ছন্ন ইংরেজিতে বলল, আমি খুব দুঃখিত, তোমার ঘুম ভাঙালুম। আমি জানতুম না আমার ঘরে কেউ আছে, অবশ্য আগে আমায় জানানো হয়েছিল কেউ এসে থাকতে পারে, আমি খুবই দুঃখিত, তুমি আবার ঘুমোও, আমি কোনও শব্দ করব না…।

লোকটির হাতে মেশিনগান নয়, একটা বেহালার বাক্স!

ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, না, না, আমি আর ঘুমোব না। আপনার যদি কোনও অসুবিধে হয়, আমি তা হলে বাইরে যেতে পারি।

নীল-চক্ষু লোকটি বলল, সে কি, বাইরে যাবে কেন? প্লিজ, তুমি আর একটু ঘুমোও, কিংবা যা খুশি করো, আমার কোনও অসুবিধে নেই। তুমি কি ইজিপ্টের লোক?

ছেলেটি বলল, না আমি ভারতীয়।

লোকটি বলল, দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলুম, তুমি খুব প্রাচীন কোনও দেশের মানুষ, তোমার ঘুমন্ত মুখে এমন একটা শান্তির ভাব ছিল যা আমাদের নেই।

একটু বাদেই খুব আলাপ হয়ে গেল দুজনের। নীল চক্ষু লোকটি একটি নাইট ক্লাবে বেহালা বাজায়। খুবই নম্র স্বভাবের মানুষ। দিনের বেলা সে ঘুমোয়। সন্ধে থেকে সারারাত সে ঘরে থাকে না। সুতরাং বাঙালি ছেলেটি সারাদিন ঘুরে বেড়াতে পারবে, সন্ধের পর এই ঘরটি তার নিজস্ব হয়ে যাবে।

এরপর দিনচারেক ছিল ছেলেটি ওই শহরে। তার একটুও অসুবিধে হয়নি, কোনও জোচ্চোর খুনে-বদমাইসের পাল্লায় পড়েনি। লরেন্স ফের্লিংগেটির সঙ্গে দেখাও হয়েছিল, খুব খাতির করেছিল। আর তার রুমমেটের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে একদিন বিনা পয়সায় নিয়ে গেল নাইট ক্লাবে। সেই কালো দৈত্যটির সঙ্গেও পরে দেখা হয়েছিল, অতিশয় সহৃদয় মানুষ…

এবার সানফ্রান্সিসকো ঢোকার মুখে আমার মনে পড়ছিল সেই আগের বারের অভিজ্ঞতার কথা। প্রথম রাত্রির ভয়াবহ স্মৃতি। এখন ভাবতে অবশ্য মজা লাগছে, কিন্তু সেদিন যে বেদম ভয় পেয়েছিলুম, তাও তো ঠিক।

এবার সানফ্রান্সিসকোতে প্রবেশ করছি সম্পূর্ণ অন্যভাবে। মদনদার ঝকঝকে নতুন মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে আমরা সবাই মিলে বাংলায় গান গাইতে গাইতে। যেন আমরা এই শহরটা জয় করতে চলেছি।