[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

২২. পৃথিবীটা যে আসলে কত ছোট

পৃথিবীটা যে আসলে কত ছোট তার প্রমাণ পেলুম এক রাতে।

জয়তীদিদের এক আত্মীয়ের আত্মীয়-বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গেছি, প্রচুর লোকজন সেখানে, একতলা-দোতলা জুড়ে নিমন্ত্রিতরা ঘোরাঘুরি করছে। আমি যথারীতি বসে আছি এক কোণে একটা চেয়ারে, হঠাৎ এক সময় একজন কেউ ঘুরে-ঘুরে বলতে লাগল, এখানে নীললোহিত নামে কে আছে? তার ফোন এসেছে।

বিশ্বাস করাই শক্ত আমার পক্ষে। এই অচেনা বাড়িতে আমায় কে ফোন করবে? আমি যে এখানে থাকব, তা তো কারুর জানার কথা নয়। এমনকী এই সন্ধেবেলাতেও আমি দোনামোনা করছিলুম আসব কি না। তা ছাড়া এই মাঝরাতে কে আমার খোঁজ করবে?

উঠে গিয়ে ফোন ধরে বললুম, হ্যালো?

প্রথমে একটা হাসির শব্দ। তারপর একটি নারী কণ্ঠ প্রশ্ন করল, কোনও সুন্দরী মেয়ের পাশ থেকে তোমায় উঠে আসতে হল বুঝি? ডিসটার্ব করলুম তো?

শুনেই চিনেছি, আমার বন্ধু বরুণ চৌধুরীর স্ত্রী মীনার গলা।

কলকাতা ছাড়ার কয়েকদিন আগেই ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এর মধ্যে ওদের মার্কিন দেশে বেড়াতে আসা আশ্চর্য কিছু নয়, কিন্তু আমায় এখানে টেলিফোন করা পরমাশ্চর্য ব্যাপার। কারণ, এ বাড়ির টেলিফোন নাম্বার আমি নিজেও জানি না।

তারপর বরুণ চৌধুরী বলল, খুব টোটো করে ঘুরে বেড়াচ্ছ তো, কিন্তু আমরা ঠিক ধরে ফেলেছি।

কথায়-কথায় জানলুম, ওরা রয়েছে শ’ তিনেক মাইল দূরে মার্সেড শহরে। দিন দু-এক আগে লাস ভেগাস যাওয়ার পথে এসেছে ওখানে, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ভাই ডাক্তার চিত্ত চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। সেখানে আজ সন্ধেবেলা আড্ডা দিতে দিতে আমার প্রসঙ্গ উঠেছিল। কোথায় আমাকে পাওয়া যেতে পারে? আমি ভ্রাম্যমাণ, আমার কোনও ঠিকানা নেই। কিন্তু আমার সম্পর্কে একটা ব্যাপার অনায়াসে আন্দাজ করা যায়, আমি নিশ্চয়ই পয়সা বাঁচাবার জন্য কোনও হোটেলে উঠব না, কোনও বাঙালির বাড়িতেই আশ্রয় নেব। লস এঞ্জেলিস-এ বাঙালির সংখ্যা কম নয়, ঠিক কোন বাড়িতে আমি উঠব তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। তবু ওরা অসম্ভবকেও সম্ভব করেছে। কয়েক জায়গায় ফোন করে নাম জেনেছে আমার আশ্রয়দাতার। সেখানে ফোন করে জেনেছে আমি নেমন্তন্ন খেতে এসেছি এখানে।

টেলিফোনে এমনভাবে ওদের সঙ্গে গল্প হল, যেন এলগিন রোডের সঙ্গে গড়িয়াহাটের আচ্ছা।

মিনা ও বরুণ চৌধুরী দুদিন পরে এসে পৌঁছবে লস এঞ্জেলিসে, আর আমাদের কাল সকালেই এ জায়গা ছেড়ে যাওয়ার কথা। জিয়া আর প্রিয়া উতলা হয়ে উঠেছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য, তা ছাড়া দীপকদার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।

কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ায় এসে সানফ্রান্সিসকো যাওয়া হবে না, এ কি চিন্তা করা যায়? বিশ্বের বিখ্যাত নগরীগুলিকে যদি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় লাইন দিয়ে দাঁড় করানো যায়, তাহলে অনেক বিচারকই সান ফ্রান্সিসকোকে প্রথম স্থান দেবেন। আমি অবশ্য দেব না, কারণ বিচারক হিসেবে আমি বড্ড খুঁতখুঁতে। এখনও পৃথিবীর যেসব স্থান আমি দেখিনি, আমার মনে হয়, তারা আরও বেশি সুন্দর। সানফ্রান্সিসকো আমার আগে একবার দেখা।

লস এঞ্জেলিস থেকে সানফ্রান্সিসকো যাওয়ার পথে মাঝামাঝি জায়গায় বেকার্সফিল্ড নামে একটা মাঝারি শহর আছে। এখানে থাকেন ডাক্তার মদনগোপাল মুখোপাধ্যায়, তিনি আগে থেকেই কড়ার করে রেখেছেন, তাঁর ওখানে একবার যেতেই হবে।

পরদিন সকালে জয়তীদি ও মেজদিরা গেলেন লস এঞ্জেলিস-এর বাজার উজাড় করে আনতে, আমি আর দীপকদা আড্ডা দিতে বসলুম। শিবাজি তার অতি প্রিয় একটা ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুম।

দীপকদা পদার্থ বিজ্ঞানী, কিন্তু আধুনিক সাহিত্য থেকে শুরু করে সমাজতত্ব এমনকী মহাকাশ অভিযান পর্যন্ত নানান বিষয়ে তাঁর উৎসাহ ও পড়াশুনো, সুতরাং তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে বসলে কখন যে সময় কেটে যায়, বোঝাই যায় না।

বেরুতে-বেরুতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেল। এক হিসেবে এটা আমাদের উলটো যাত্রা। কানাডা থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় আসবার সময় আমরা সানফ্রান্সিসকোকে পাশ কাটিয়ে লস এঞ্জেলিসে এসেছিলুম। যে পথ দিয়ে আমরা এসেছিলুম, অনেকটা সেই পথ ধরেই ফিরে যাচ্ছি।

বেকার্সফিল্ডে পৌঁছতে কেন যে আমাদের রাত দুটো বেজে গেল তা জানি না। মাত্র আড়াইশো মাইলের ব্যাপার, তাই তাড়া ছিল না। দীপকদা দু-তিনবার কফি খাওয়াবার জন্য গাড়ি থামিয়েছেন। অবশ্য বেকার্সফিল্ডে এসে ঠিকানা খুঁজতেও অনেকটা সময় গেছে। এত রাতে কি কারুর বাড়িতে যাওয়া যায়? পাড়া একেবারে শুনশান। বাড়িগুলো দেখলেই বোঝা যায় বেশ অভিজাত পাড়া। কোনও বাড়িতে আলো জ্বলছে না। এদেশে রাস্তায় কুকুর থাকে না, নইলে এই নিঝুম রাতে আমাদের গাড়ি থেকে নামতে দেখলে নিশ্চয়ই কুকুর তেড়ে আসত।

কিন্তু সন্তর্পণে গিয়ে বেল টেপা মাত্র দরজা খুলে গেল। ডাঃ মুখার্জি আমাদের প্রতীক্ষায় জেগেই ছিলেন। সহাস্য মুখে বললেন, আসুন, আসুন।

ডঃ মদনগোপাল মুখোপাধ্যায় অতি সদালাপী ও অমায়িক মানুষ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আমার মদনদা হয়ে গেলেন। অবশ্য নামটা যত ভারিক্কি, সেই তুলনায় বয়েস বেশি নয়। নিম্ন চল্লিশেই তিনি ক্যানসার বিশেষজ্ঞ হিসেবে এদেশে যথেষ্ট খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।

আমরা অনেকগুলো মানুষ, সকলের জন্যই আলাদা-আলাদা ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। এত রাত্রে আর আড্ডা জমবে না, আমরা শুয়ে পড়ার উদ্যোগ করলুম। আমাদের মধ্যে শিবাজিকেই বেছে নিয়ে মদনদা বললেন, দেখবেন, মনের ভুলে যেন জানালা খুলে ফেলবেন না। তা হলেই পুলিশ ছুটে আসবে।

কাছাকাছি কয়লাখনি আছে বলেই বোধহয় লস এঞ্জেলিস-এর তুলনায় বেকার্সফিল্ড একটু গরম। সুতরাং রাত্রে জানলা খুলতে আপত্তি কেন?

মদনদা বুঝিয়ে দিলেন যে, প্রত্যেক দরজা-জানালায় বার্গলার্স অ্যালার্ম লাগানো আছে। চোর ডাকাত কিছু ভাঙবার চেষ্টা করলেই শুধু যে এখানেই সতর্ক ঘন্টা বেজে উঠবে তা নয়, থানায় একটা বোর্ডে আলো জ্বলে উঠবে, তা দেখে বোঝা যাবে, কোন বাড়িতে হানাদার এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসে যাবে।

এ দেশের পুলিশ খুব ভালো দারোয়ানগিরি করতে পারে।

পরদিন বেশ বেলা করে উঠে ঘুরে-ঘুরে দেখলুম মদনদার বাড়ি। এর আগে যত বাঙালির বাড়িতে গেছি, এত বড় ও ঝকঝকে তকতকে বাড়ি আর দেখিনি। বাড়ির সঙ্গে আছে বাগান, সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট ইত্যাদি। দুটি বসবার ঘর, যার মধ্যে একটির নাম ফ্যামিলি রুম। অর্থাৎ একটিতে বাইরের লোক এলে বসানো হবে, অন্যটিতে বাড়ির বাচ্চারা খেলবে কিংবা বড়রা টিভি দেখবে। সেইরকম খাবারের ঘরও দুটি। একটি বাইরের লোকদের জন্য বেশি সাজানো, অন্যটি প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য। এ ছাড়া আছে বার কাউন্টার। ঠিক যেন সিনেমার বাড়ি। বসবার ঘরের কার্পেট এত গভীর যে পা ডুবে যায়।

এইসব বাড়িতে ঘোরাফেরা করতে অস্বস্তি লাগে। কখন যে কোথায় দাগ লেগে যাবে, কিংবা মেঝেতে সিগারেটের ছাই ফেললে কী কেলেঙ্কারি হবে, এই চিন্তাতেই সর্বক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু গৃহস্বামী ও গৃহস্বামিনীর ব্যবহারের আন্তরিকতায় এই অস্বস্তি দূর হয়ে যায়। যারা বস্তুর চেয়ে মানুষকে বেশি মূল্য দেয়, তাদের কাছে কোনও অসুবিধে নেই। ডলিবউদি চমৎকার হাসিখুশি মানুষ, ওঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে, তাদের নাম মিষ্টি আর মিঠাই। বোঝাই যাচ্ছে, ডলিবউদি সন্দেশ-রসগোল্লা খুব ভালো বানাতে পারেন।

মদনদা খুব ব্যস্ত ডাক্তার হলেও তাঁর নানা রকমের শখ আছে। উনি বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ও তলোয়র সংগ্রহ করেন, বই ও ছবি কেনেন। এ ছাড়া আছে ওঁর গাড়ির শখ। আপাতত ওঁর চারখানা গাড়ি। মার্সিডিজ, ক্যাডিল্যাক, বি এম ডব্লু ও আর একটা কী যেন! নীহাররঞ্জন গুপ্তর রহস্য-উপন্যাসে রাজা মহারাজারা সবসময় ক্যাডিলাক গাড়ি চেপে আসত, সেই ক্যাডিলাকে

আমিও চাপব ভেবে বললুম, ক্যাডিলাক! ওরেঃ বাবা!

আমার দিকে অন্যরা এমনভাবে তাকাল, যেন আমি একটা ঘোর বাঙাল!

ক্যাডিলাকের তুলনায় মার্সিডিজ বেঞ্জ, বি এম ডব্লু নাকি আরও উঁচু জাতের গাড়ি। বিশেষত যে গাড়িটার নাম আগে শুনিনি, শুনলেও মনে রাখতে পারি না, দুশো চল্লিশ না চারশো আশিকী যেন, সেটা নাকি পৃথিবীর সেরা।

দীপকদা সেই গাড়িটার পিঠে সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললেন, বুঝলেন মদনবাবু আমারও খুব গাড়ির শখ। কিন্তু আমি মাস্টার মানুষ, এসব গাড়ি কেনবার কথা ভাবতেই পারি না।

মদনদা ভদ্রতা করে বললেন, বাঃ, আপনিও যে এত বড় পনটিয়াক গাড়িটা এনেছেন, এটা কম কীসে?

আমি গাড়ি বিষয়ে কিছুই বুঝি না। আমার ধারণা, যে গাড়ি থেমে থাকে না, চলে, সেটাই ভালো। শুধু-শুধু বেশি দামের গাড়ি কেনার কী মানে হয় কে জানে। যাই হোক, পর্যায়ক্রমে মদনদার সব গাড়িতেই একবার করে চেপে জীবন ধন্য করে নিয়েছি, বিশেষ তফাত অবশ্য বুঝতে পারিনি।

উন্মুক্ত জায়গায় লোহার ঘোরানো উনুন এনে সন্ধেবেলা বারবিকিউ ডিনার হল। এই ব্যাপারটা দীপকদাও বেশ ভালো পারেন, এডমানটনে আমাদের একাধিক দিন খাইয়েছেন। পুরুষ রাঁধুনিদের একটা স্বভাব হল, তাঁরা কে কার চেয়ে ভালো রান্না করেন, তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। দীপকদা বারবার বলতে লাগলেন, মদনবাবু, আপনি আঁচটা একটু বেশি করে ফেলেছেন। আর মদনদা বলতে লাগলেন, আরে মশাই, আমি বারবিকিউ করতে-করতে ঝুনো হয়ে গেলুম, যে-কোনও রেস্তোরাঁয় চাকরি পেতে পারি…। শেষ পর্যন্ত ডলিদি বললেন, তোমরা দুজনেই সরো তো, আমি দেখছি।

মদনদা খুব দুর্লভ জাতের ওয়াইন সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, ঝলসানো মাংসের সঙ্গে সেই আঙুরের রস যা জমল, তা আর বলার নয়। মেয়েদেরও জোর করে খাওয়ানো হল খানিকটা করে ওয়াইন, কিংবা খুব একটা জোর করতে হয়নি বোধহয়, প্রথম গেলাসের পর নিজেরাই বাড়িয়ে দিয়েছেন দ্বিতীয় গেলাস। অল্পতেই ওঁদের ফুরফুরে নেশা হয়, একটু পরেই শুরু হল জয়তীদি ও মেজদির গান। প্রথমে ‘জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’, তারপর যার যেটা মনে পড়ে। একটু পরে আমরা ছেলেরাও হেঁড়ে গলায় যোগ দিলুম। সত্যিই যেন চাঁদের আলোয় পিকনিক হচ্ছে। অফুরন্ত আনন্দ।

তখনও আমরা বুঝতে পারিনি, মিলিতভাবে এটাই আমাদের শেষ রাত।

মদনদা এক সময় একটা প্রস্তাব দিলেন, কাল থেকে তিনি কয়েকদিনের ছুটি নিচ্ছেন, সবাই মিলে একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেলে হয় না?

মদনদা ছুটি নিচ্ছেন শুনে আমরা অবাক হলুম। ডাক্তাররা কখনও ছুটি পায় নাকি? মদনদা এখানকার একটি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত, তা ছাড়া তাঁর প্রাইভেট প্র্যাকটিসের এলাকা বহুদূর বিস্তৃত। চারখানা গাড়ি থাকা সত্বেও তিনি একটি ছোট প্লেন কেনার কথা ভাবছেন। নিজেই চালাবেন। প্লেনে রুগি দেখার অনেক সুবিধে, অনেক সময় বাঁচে।

–সত্যি ছুটি নিচ্ছেন?

মদনদা বললেন যে, অনেকদিন ছুটি নেওয়া হয়নি, কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি, সুতরাং তাঁর মন উচাটন হয়ে উঠেছে।

কাছাকাছির মধ্যে দুটির যে-কোনও একটি জায়গায় যাওয়া যায়। লাস ভেগাস কিংবা সানফ্রান্সিসকো। দু-জায়গাই দু-রকম আকর্ষণ। মদনদার ঝোঁক লাস ভেগাসের দিকেই বেশি। শিবাজি প্রচুর সিনেমায় লাস ভেগাস দেখেছে, সে-ও লাফিয়ে উঠল। দীপকদারও অনিচ্ছে নেই। মেজদি দুটো জায়গাতেই যেতে চান।

কিন্তু এই পৃথিবী বিখ্যাত জুয়ার শহরে যেতে আমিই প্রথম আপত্তি তুললুম। আমার মনের মধ্যে একটা বিষম জুয়াড়ি আছে। কিন্তু লাস ভেগাসে জুয়া খেলতে যাব; সে মুরোদ আমার কোথায়? ‘যত সাধ ছিল সাধ্য ছিল না’। পকেট গড়ের মাঠ নিয়ে কেউ জুয়ার আসরে যায়? সেই জন্যই আমি এখন মনে-মনে একা-একা জুয়া খেলা পছন্দ করি।

মদনদা বোঝালেন যে, লাস ভেগাসে শুধু জুয়া নয়, নাচগানের অনেকগুলো শো হয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা সেখানে আসে। এই তো ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা দলবল নিয়ে সেখানে একটা শো করছেন। কিন্তু তাতেও আমি গললুম না, কারণ একেবারে গরিব হয়ে লাস ভেগাসে যাওয়া যায় না। আর জুয়ার শহরে গিয়ে জুয়া খেলব না, শুধু নাচ-গানের আসরে যাব, তারই বা কোন মানে হয়?

লাস ভেগাস যাওয়ার বিরুদ্ধে আর একটা বড় যুক্তি, আমাদের সঙ্গে বাচ্চারা রয়েছে, তারা ওখানে কী করবে? ওই শহর বাচ্চাদের জন্য নয়।

পরদিন বেরিয়ে পড়ল দুটো গাড়ি।

সানফ্রান্সিসকো যাওয়ার আগে, আমরা ঠিক করলুম, একটু মার্সেড ঘুরে যাওয়া হবে। যদি সেখানে মীনা ও বরুণ চৌধুরীকে এখনও পাওয়া যায়। কিন্তু পৌঁছে দেখলুম পাখি উড়ে গেছে। বরুণ ও মীনার উপস্থিতির উত্তাপ এখনও রয়েছে সেখানে, কিন্তু ওরা চলে গেছে লস এঞ্জেলিসে। সেখান থেকে ওদের ধরে আনা যায় না? মাত্র দুশো মাইল, যাওয়া-আসায় বড়জোর ছ’ঘণ্টা লাগবে। ফোন করা হল ওদের, কিন্তু উপায় নেই, ওরা জানাল যে, পরদিনই ওদের এদেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্লেনে রিজার্ভেশান হয়ে আছে।

চিত্ত চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী আলো, দুজনেই ডাক্তার। আমাদের পেয়ে হইহই করে উঠলেন। আমাদের কিছুতেই ছাড়বেন না। চিত্তর বাড়ির সুইমিং পুলের ধারে বসে আড্ডা হল অনেকক্ষণ। এর আগেই আমরা চুপিচুপি ঠিক করে রেখেছি যে, এখানে রাত কাটানো হবে না, আজ রাত্তিরের মধ্যেই সানফ্রান্সিসকো পৌঁছতে হবে।

চিত্ত আর তার স্ত্রীকে অনেক বুঝিয়ে, খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা যখন বিদায় নিয়ে বাইরে এসে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, তখন জয়তীদি বললেন, ওঁরা আর সানফ্রান্সিসকো যাবেন না। ওঁরা এবার বাড়ির দিকে রওনা হবেন।

প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। এতদূর পরিকল্পনা করে এসে হঠাৎ এরকম সিদ্ধান্ত? কিন্তু, জয়তীদি বললেন, এতদিন ধরে গাড়িতে ঘুরে-ঘুরে ওঁর মেয়েরা ক্লান্ত। কানাডায় ফিরে স্কুলে যাওয়ার আগে দু-একদিন বিশ্রাম নেওয়া দরকার। সানফ্রান্সিসকো ওঁরা আগে দেখেছেন, সুতরাং…বিশেষত আমাদের নিয়ে ঘোরাবার জন্য মদন মুখার্জিকে যখন পাওয়া গেছেই..।

জয়তীদির সঙ্গে আমরা যুক্তিতে হেরে গেলুম। কোনও যুক্তি না থাকলেও অবশ্য উনিই জিততেন। এক একজনের ইচ্ছেটাই যুক্তি। ঠিক হল, ওঁর মেজদি আমাদের সঙ্গেই যাবেন, পরে তাঁকে কানাডায় পাঠিয়ে দিলেই হবে।

একটা ব্যাপারে আমি সাহেব। বিদায় নেওয়ার সময় বেশি বেশি আবেগের বিমোচন আমার পছন্দ হয় না। বাঙালিদের তো আশিবার আসি না বললে বিদায় নেওয়াই হয় না ঠিক মতন। আমি দীপকদার গাড়ির কাছে গিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে শুধু বললুম, আচ্ছা, আবার দেখা হবে। তারপর উঠে পড়লুম মদনদার গাড়িতে।

দুটো গাড়ি দুদিকে চলে গেল।