ঋগ্বেদ ১০।০৬১
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ১০ম মণ্ডল সূক্ত ৬১
বিশ্বদেব দেবতা। নাভানেদিষ্ট ঋষি।
১। নাভানেদিষ্টের পিতা ও মাতা ও অপরাপর ভাগকারী ভ্রাতাগণ বিষয় ভাগ করিবার সময় নাভানেদিষ্টকে ভাগ না দিয়ারুদ্রের স্তব করিতে কহেন, তাহাতে নাভানেদিষ্ট রুদ্রের স্তব উচ্চারণ করিতে উদ্যত হইয়া অঙ্গিরাদিগের যজ্ঞানুষ্ঠানের মধ্যে উপনীত হইলেন এবং যজ্ঞের ষষ্ঠদিনে তাহারা যাহা বিস্মৃত হইয়াছিলেন, তাহা তিনি সপ্ত হোতাকে বলিয়া দিয়াযজ্ঞ সমাপন করাইয়া দিলেন।
২। রুদ্রদেব স্তবকৰ্ত্তাদিগকে ধনদান করিবার জন্য ও তাহাদিগের শত্রু নষ্ট করিবার জন্য অস্ত্রশস্ত্র ক্ষেপণ করিতে করিতে বেদীতে যাইয়া অধিষ্ঠান করিলেন, মেঘ যেমন জল বর্ষণ করে, তদ্রূপ রুদ্রদেব শীঘ্রগমনে উপস্থিত হইয়া বক্তৃতা করিতে করিতে চতুর্দিকে আপনার ক্ষমতা প্রদর্শন করিতে লাগিলেন।
৩। হে অশ্বিদ্বয়! আমি যজ্ঞে প্রবৃত্ত হইয়াছি, যে অর্ধ্বয্যু আমার হস্তের অঙ্গুলিধারণপূর্বক বিস্তর হোমের দ্রব্য সংগ্রহ করিয়া তোমাদিগের নাম নির্দেশসহকারে চরু পাক করিতেছেন, তোমরা সেই স্তবকারী অর্ধ্বয্যুর এই যজ্ঞোদ্যোগ দেখিয়ামনের ন্যায় দ্রুত বেগে যজ্ঞস্থানে ধাবমান হইয়া থাক।
৪। যখন কৃষ্ণবর্ণ গাভী লোহিতবর্ণ গাভীদিগের মধ্যে মিশাইয়া গেল, অর্থাৎ যখন রাত্রির অন্ধকার নষ্ট হইয়াপ্রাতঃকালের রক্তিমাভা দৃষ্ট হইল, তখন হে দ্যুলোকের পৌত্র অশ্বিদ্বয়! তোমাদিগকে আমি আহ্বান করি। তোমরা আমার যজ্ঞে আগমন কর, আমার অন্ন গ্রহণ কর, আমার গ্রহণকারী দুই ঘোটকের ন্যায় তাহা ভোজন কর। আমাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট চিন্তা করিও না।
৫। যে শুক্র, বীরপুত্র উৎপাদন করিতে সমর্থ, তাহা বৃদ্ধি পাইয়া নির্গত হইতে উন্মুখ হইল। তিনি তখন মনুষ্যবর্গের হিতার্থে তাহা নিব্রক করিয়া ত্যাগ করিলেন। আপনার সুশ্রী কন্যার শরীরে সেই শুক্র সেক করিলেন।
৬। যখন পিতা যুবতী কন্যার উপর (১) পূর্বোক্তরূপ রতিকামনা পরবশ হইলেন এবং উভয়ের সঙ্গমন হইল, তখন উভয়ে পরস্পর সঙ্গমে প্রচুর শুক্র সেক করিলেন। সুকৃতের আধার স্বরূপ এক উন্নত স্থানে সেই শুক্রের সেক হইল।
৭। যখন পিতা নিজ কন্যাকে সম্ভোগ করিলেন, তখন তিনি পৃথিবীর সহিত সঙ্গত হইয়া শুক্র সেক করিলেন। সুচারু ধীশক্তিসম্পন্ন দেবতারা তাহা হইতে ব্ৰহ্ম সৃষ্টি করিলেন এবং ব্রতরক্ষাকারী বাস্তোষ্পতিকে নির্মাণ করিলেন(২)।
৮। যেমন ইন্দ্র নমুচি বধকালে যুদ্ধে ফেন নিক্ষেপ করিতে করিতে আসিয়া ছিলেন, তদ্রূপ সেই বাস্তোষ্পতি আমার নিকট হইতে প্রতিগমন করিলে, তিনি যে পদে আসিয়া ছিলেন, সেই পদে ফিরিয়া গেলেন, অঙ্গিরাগণ আমাকে দক্ষিণস্বরূপ যে সকল গাভী দিয়াছেন, তাহা তিনি অপসারিত করিলেন না। স্পর্শকুশল, অর্থাৎ অনায়াসে গ্রহণ করিতে সমর্থ হইয়াও তিনি সেই সকল গাভী গ্রহণ করিলেন না।
৯। প্রজাবর্গের উৎপীড়নকারী ও অগ্নির দাহজনক রাক্ষসাদি সহসা এই যজ্ঞে আসিতে পারিতেছে না, যেহেতু রুদ্র যজ্ঞ রক্ষা করিতেছেন। রাত্রি কালেও বিবস্ত্র রাক্ষসেরা যজ্ঞীয় অগ্নির নিকট আসিতে পারে না। যজ্ঞের ধারণকর্তা সেই অগ্নি কাঠ গ্রহণপূর্বক এবং অন্ন বিতরণ করিতে করিতে উৎপন্ন হইলেন এবং রাক্ষসদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন।
১০। অঙ্গিরাগণ নয়মাস যজ্ঞ অনুষ্ঠানপূর্বক গাভী লাভ করে, তাহারা চমৎকার স্তবের সাহায্যে যজ্ঞবাক্য উচ্চারণ করিতে করিতে যজ্ঞ সমাপন করিলেন। তাহারা ইহলোক ও পরলোক উভয় স্থানে শ্রীবৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে এবং ইন্দ্রের নিকট গমন করিলেন। তাহার দক্ষিণা বিহীন যজ্ঞ অর্থাৎ সত্ৰ নামক যজ্ঞ অনুষ্ঠানপূর্বক অবিনাশী ফল লাভ করিলেন ।
১১। যখন সেই অঙ্গিরাগণ অমৃততুল্য দুগ্ধ দোহনকারিণী গাভী উজ্জ্বল ও পবিত্র দুগ্ধ যজ্ঞে বিনিয়োগ করিলেন, তখন চমৎকার স্তবের সাহায্যে নুতন সম্পত্তির ন্যায় অভিষিক্ত বৃষ্টিবারি প্রাপ্ত হইলেন।
১২। এইরূপ কথিত আছে যে, ইন্দ্র স্তবকৰ্ত্তাকে এত দূর স্নেহ করেন, যে যাহর পশু হারাইয়া গিয়াছে, সে নিজে জানিতে না জানিতেই সেই অতি ধনাঢ্য অতি কুশল নিষ্পাপ ইন্দ্র সমস্ত গোধন উদ্ধার করিয়া দেন।
১৩। সুস্থির ইন্দ্র যখন বহুবিস্তারী শুষ্ণের নিগূঢ় মৰ্ম্ম অনুসন্ধানপূর্বক নিধন করেন, কিংবা যখন নৃষদের পুত্রকে বিদীর্ণ করেন, তখন তাহার পারিষদগণ নানাপ্রকারে তাঁহাকে বেষ্টনপূৰ্ব্বক তাহার সঙ্গে গমন করেন।
১৪। যে সকল দেবতা স্বর্গের ন্যায় যজ্ঞস্থানে অধিষ্ঠান করেন, তাহারা অগ্নির তেজকে “ভর্গ” এই নাম দেন। তাহারা আর নাম জাতবেদা অগ্নি। হে হোমকারী অগ্নি! তুমিই যজ্ঞের হোতা। তুমিই অনুকুল হইয়া আমা দিগের আহ্বান শ্রবণ কর।
১৫। হে ইন্দ্র। সেই দুই উজ্জলমুর্তি রুদ্রপুত্র নাসত্য আমার স্তব ও যজ্ঞ গ্রহণ করুন। যেরূপ মনুর যজ্ঞে তাহারা প্রীতিলাভ করেন, তদ্রুপ আমি কুশ বিস্তার করিয়াছি, আমার যজ্ঞে প্রীতিলাভ করুন, প্রজাবর্গকে ধন প্রেরণ করুন এবং যজ্ঞ গ্রহণ করুন।
১৬। এই যে সর্বসৃষ্টিকারী সোম, যাহাকে সকলে স্তব করে, তাহাকে আমরাও স্তব করি। এই ক্রিয়াকুশল সোম নিজেই নিজের সেতু, ইনি জল পার হইতেছেন। যেরূপ দ্রুত গতিশালী ঘোটকগণ চক্রের পরিধি কম্পিত করে, তিনি কক্ষীবানকে এবং অগ্নিকে তেমনি কম্পিত করিয়াছিলেন।
১৭। সেই অগ্নি ইহলোক পরলোক উভয় স্থানের বন্ধু, তিনি তারণকর্তা; তিনি যাগকারী; অমৃততুল্য দুগ্ধদায়িনী গাভী যখন আর প্রসব হইত না, তখন তাহাকে প্রসববতী করিয়া তিনি দুগ্ধদায়িনী করিলেন। মিত্র ও বরুণকে উত্তম উত্তম স্তবের দ্বারা সন্তুষ্ট করি। চমৎকার স্তবের দ্বারা অর্য্যমাকে সন্তুষ্ট করি।
১৮। হে স্বর্গস্থ সূৰ্য! আমি নাভানেদিষ্ট, তোমার বন্ধু, অর্থাৎ আমি তোমাকে স্তব করিতেছি, আমার কামনা যে গাভী আত্মীয়(৩) লাভ করি। সেই দ্যুলোক আমাদিগের শ্রেষ্ঠ উৎপত্তি স্থান এবং সূর্যেরও অধিষ্ঠানভুত। আমি সেই সূৰ্য্য হইতে কয় পুরুষই বা অন্তর?।
১৯। এই আমার উৎপত্তিস্থান, এই স্থানেই আমার নিবাস; এই সকল দেবতা আমার আত্মার; আমি সকলই। স্তোতাগণ যজ্ঞ হইতে সর্ব প্রথম উৎপন্ন হইয়াছেন। এই যজ্ঞ স্বরূপা গাভী নিজে উৎপন্ন হইয়া এই সমস্ত উৎপাদন করিয়াছেন।
২০। এই অগ্নি আনন্দের সহিত গমন করিয়া চতুর্দিকে স্থান গ্রহণ করিতেছেন, ইনি উজ্জ্বল, ইহলোকে ও পরলোকে সহায়, এবং কাষ্ঠদিগকে পরাভব করেন, ইহার শিখাশ্রেণী উর্ধে উঠিতেছে। ইনি স্তবের যোগ্য, ইহার মাতা অরণি, এই সুস্থির সুখকর অগ্নিকে শীঘ্র প্রসব করিতেছেন।
২১। আমি নাভানেদিষ্ট উত্তম উত্তম স্তব উচ্চারণ করিয়া শ্রান্ত হইয়াছি, আমার স্তুতিবাক্যগুলি ইন্দ্রের প্রতি গিয়াছে। হে ধনশালী অগ্নি! শ্রবণ কর। আমাদিগের এই ইন্দ্রকে যজ্ঞদান কর। আমি অশ্বমেধ যজ্ঞকারীর পুত্র, আমার স্তবে তুমি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইতেছ।
২২। হে বজ্রধারী ইন্দ্র! হে নরপতি! তুমি জানিবে যে, আমরা প্রভূত ধনের কামনা করিয়াছি। আমরা তোমার নিকট স্তব প্রেরণ করিয়া থাকি, হোমের দ্রব্য দিয়া থাকি, আমাদিগকে রক্ষা কর। হে হরিদ্বয় ঘোটক বিশিষ্ট ইন্দ্র! তোমার নিকট গমনপূর্বক আমরা যেন অপরাধী না হই।
২৩। হে উজ্জ্বলমূৰ্ত্তি মিত্র ও বরুণ! গাভীর কামনায় অঙ্গিরাগণ যজ্ঞ করিতেছিলেন, সর্বত্রগামী যম স্তবের ইচ্ছায়তাহাদিগের নিকট গমন করিলেন, আমি নাভানেদিষ্ট সেই স্তব বলিয়া দিলাম এবং যজ্ঞ সম্পন্ন করিয়া দিলাম, সেই হেতু আমি তাহাদিগের অত্যন্ত প্রিয় বিপ্র হইলাম।
২৪। এক্ষণে আমরা গোধন পাইবার জন্য অবলীলাক্রমে স্তব করিতে করিতে জয়শীল বরুণের নিকট যাইতেছি। শীঘ্রগামী ঘোটক সেই বৰুণের পুত্র। হে বরুণ! তুমি মেধাবী ও অন্নদানও করিয়া থাক।
২৫। হে মিত্র ও বরুণ! অনুসম্পন্ন পুরোহিত স্তব সমূহ প্রয়োগ করিতেছেন, অভিপ্রায় এই যে, তোমরা আমাদিগের প্রতি আনুকূল্য করিবে, কারণ তোমাদিগের বন্ধু অতি হিতকর। তোমাদিগের বন্ধুত্বলাভ হইলে সকল স্থানেই স্তুতি বাক্য সকল উচ্চারিত হইবে। চির পরিচিত পথ যেরূপ সুখকর হয় তদ্রুপ তোমাদিগের বন্ধুত্ব যেন আমাদিগের স্তুতিবাক্য সকল সুখকর করে।
২৬। পরমবন্ধু সেই বরুণ দেবতাবর্গ সমেত উত্তম উত্তম স্তব ও নমোবাক্য প্রাপ্ত হইয়া বৃদ্ধি প্রাপ্ত হউন। গাভীর দুগ্ধের ধারা তাহার যজ্ঞের জন্য বহমান হইতেছে।
২৭। হে দেবতাগণ! তোমরাই যজ্ঞলাভের অধিকারী। আমাদিগের উত্তমরূপ রক্ষার জন্য তোমরা সকলে মিলিত হও। হে অঙ্গিরাগণ! তোমরা উদ্যোগী হইয়া আমাকে অন্ন দিয়াছ, তোমাদিগের মোহ নষ্ট হইয়াছে, তোমরা এক্ষণে গোধন লাভ কর।
————
(১) পিতা রুদ্র, কন্যা ঊষা। সায়ণ।
(২) বাস্তোষ্পতির জন্ম বিবরণ ঋগ্বেদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত আধুনিক বলিয়া বোধ হয়। বিবরণটি পৌরাণিক গল্পের মতো, ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের পূর্বে বাস্তোষ্পতির নাম পাইয়াছি, কিন্তু তাঁহার জন্মের এরূপ গল্প পাই নাই।
(৩) সূর্য্যের পুত্র মনু, মনুর পুত্র নাভানেদিষ্ট। সায়ণ।