ঋগ্বেদ ১০।০৮৮

ঋগ্বেদ ১০।০৮৮
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ১০ম মণ্ডল সূক্ত ৮৮
অগ্নি ও সূর্য্য উভয়ে মিলিত দেবতা। মূর্ধম্বান ঋষি।

১। পান করিবার উপযুক্ত যে হোমদ্রব্য, অর্থাৎ সোমরস, যাহা চিরকাল নুতন থাকে, যাহা দেবতার সেবন করেন, তাহা স্বর্গগামী আকাশস্পর্শ অগ্নিতে হোম করা হইয়াছে। সেই সোমরসের উৎপাদন পরিপুরণ ও ধারণের জন্য দেবতারা সুখকর অগ্নিকে বর্ধিত করেন।

২। অন্ধকার ভুবনকে গ্রাস করে। তাহাতে ভুবন অন্তর্ধান প্রাপ্ত হয়, অগ্নি জন্মিলে সেই সমস্ত ভুবন প্রকাশ পায়। সেই অগ্নির বন্ধুত্ব লাভে সকলেই প্রীত হয়, দেবতার, পৃথিবী, আকাশ, জল ও বৃক্ষাদি সকলই সন্তুষ্ট হয়।

৩। যজ্ঞভাগ গ্রাহী দেবতারা আমাকে প্রবৃত্তি দিয়াছেন, তাই আমি জরারহিত প্রকাণ্ড অগ্নিকে স্তব করিতেছি। তিনি নিজ কিরণে পৃথিবী, আকাশ উভয়ের মধ্যবর্তী স্থান এবং দ্যুলোক ও ভূলোক ছাইয়াফেলিলেন।

৪। তিনিই সর্ব প্রথম হোতা ছিলেন, দেবতারা তাহাকে পরিবেষ্টন করেন, যজমানগণ বর চাহিতে চাহিতে তাহাকে ঘৃতসংযুক্ত করেন। সেই অগ্নি পশু, পক্ষী, স্থাবরজঙ্গম, প্রভৃতি সকলি অবিলম্বে রচনা করেন।

৫। হে অগ্নি! হে জাতবেদা! হে ভুবনের মত মস্তকস্বরূপ! তুমি যখন দীপ্তসূর্যের সহিত একত্রে দণ্ডায়মান হও, তখন তোমাকে আমরা প্যান, এবং স্তবস্তুতির দ্বারা উপাসনা করি। তুমি দ্যুলোক ও ভূলোক পূর্ণ করিয়া যজ্ঞের উপযোগী হও।

৬। রাত্রিকালে অগ্নিই তাবৎ সংসারের মস্তকস্বরূপ হয়েন, পরে প্রাতে তিনি রূপে উদিত হয়েন। তিনি বিবেচনাপূর্বক সকল স্থানে শীঘ্র শস্ত্র বিচরণ করেন, ইহা যজ্ঞসম্পাদকারী দেবতাদিগেরই ক্রিয়াকৌশল।

৭। যে অগ্নি বিশেষ প্রজ্বলিত হইয়া সুশ্রী মূৰ্ত্তি ধারণ করিয়া আকাশে স্থান গ্রহণ করিয়া ঔজ্জ্বল্যের সহিত শোভা পাইতে লাগিলেন, সেই অগ্নি, শরীর রক্ষাকারী সকল দেবতা সূক্ত পাঠ করিতে করিতেহোমের দ্রব্য সমর্পণ করিলেন।

৮। দেবতারা প্রথমে সূক্ত সৃষ্টি করলেন, পরে অগ্নি, পরে হোমের দ্রব্য সৃষ্টি করিলেন। সেই অগ্নি ইহাদিগের শরীর রক্ষাকারী যজ্ঞস্বরূপ হইলেন, আকাশ, পৃথিবী ও জলের সহিত সেই অগ্নির পরিচয় আছে।

৯। যে অগ্নিকে দেবতারা উৎপাদন করিলেন, সর্বমেধ নামক যজ্ঞের সময় সে অগ্নিতে সকল বস্তুরই হোম হয় তিনি সকল গতি ধারণপূর্বক নিজ প্রকাণ্ড শিখাদ্বারা দ্যুলোক ও ভূলোকে তাপ দিতে লাগিলেন।

১০। দেবলোকে দেবতারা নানা ক্ষমতাদ্বারা কেবল স্তব সহকারেই সেই অগ্নিকে উৎপাদন করিলেন, যিনি দ্যাবাপৃথিবী পরিপূর্ণ করেন। সেই সুখকর অগ্নিকে তাহারা ত্রিবিধ করিয়া সৃষ্টি করিলেন। সেই অগ্নি নানা প্রকার বৃক্ষাদিকে পরিণত অবস্থায় উপনীত করেন।

১১। যজ্ঞভাগ গ্রাহী দেবতারা যখন এই অগ্নিকে আর অদিতি পুত্র সূৰ্য্যকে আকাশে স্থাপন করিলেন, যখন তাহারা উভয়ে যুগ্মৰূপী হইয়া বিচরণ করিতে লাগিলেন, তখন তাবৎ প্রাণিবর্গ তাহাদিগকে দেখিতে পাইল।

১২। দেবতারা তাবৎ মনুষ্যের হিতকারী অগ্নিকে সমস্ত ভুবনের জন্য দিনের কেতুস্বরূপ করিয়াছেন। সেই অগ্নি বিশিষ্ট দীপ্তিশালী প্রভাতকে বিস্তার করেন এবং যাইতে যাইতে শিখাদ্বারা অন্ধকার সমস্ত নষ্ট করেন।

১৩। ক্রিয়াকুশল যজ্ঞভাগ গ্রাহী দেবতারা অবিনাশী ও তাবৎ মনুষ্যের হিতকারী অগ্নিকে উৎপাদন করিয়াছেন। ইনি যখন স্থূল ও বৃহৎ হয়েন, তখন আকাশে চিরকাল বিচরণশীল নক্ষত্রকে দেবতার সমক্ষেই প্রভাহীন করিয়া দেন।

১৪। বৈশ্বানর অগ্নি নিত্য নিত্য দীপ্তিশালী হয়েন, সেই ক্রিয়াকুশল অগ্নির অনুগ্রহ লাভের জন্য মন্ত্রপাঠ করছি। তিনি আপন মহিমাদ্বারা দ্যুলোক ও ভূলোক আচ্ছাদন করেন এবং উর্ধে ও নিম্নে উত্তাপ দেন।

১৫। কি দেবতা, কি পিতৃলোক, কি মনুষ্যবর্গ, ইহাদিগের আমি দ্বিবিধ গতি শ্রবণ করিয়াছি। এই বিশ্বভুবন অগ্রসর হইতে হইতে সেই গতিপ্রাপ্ত হয়, অর্থাৎ যে কেহ মাতা পিতার মধ্যে জন্মলাভ করে(১), তাহাদিগের ঐ দুই ব্যতীত গতি নাই।

১৬। যে সুৰ্য্য মস্তক, অর্থাৎ উধস্থান হইতে জন্মিয়াছেন, যাহাকে স্তবের দ্বারা পরিতুষ্ট করা হয়, তিনি যখন বিচরণ করেন, তখন দ্যাবাপৃথিবী তাহাকে ধারণ করেন, সেই পরিত্রাণকর্তা কখন নিজ কম্মে শৈথিল্য করেন না, তিনি দীপ্তি পাইতে পাইতে সকল ভুবনের দিকে অতি সুখে অবস্থিত থাকেন।

১৭। যে স্থানে নিম্নস্থিত অগ্নি আর উর্ধস্থিত অগ্নি পরস্পর এই বলিয়া বিবাদ করেন যে, আমরা উভয়েই যজ্ঞ সম্পাদন করিয়া থাকি, কিন্তু আমাদের উভয়ের মধ্যে অধিক জ্ঞানী কে? তখন বন্ধুগণ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করিলেন বটে, কিন্তু যজ্ঞ অনুষ্ঠানকারীদিগের মধ্যে কে ঐ প্রশ্নের নির্ণয় করতে পারে।

১৮। হে পিতৃগণ! তোমাদিগের নিকট তর্ক বিতর্কের কথা কহিতেছি, কেবল উত্তমরূপে জানিবার জন্য জিজ্ঞাসা করিতেছি যে, অগ্নি কয় জন, সূৰ্য্য কয় জন, উষা কয় জন, জলই বা, অর্থাৎ জলদেবীই বা কয় জন?

১৯। হে বায়ু! যে পর্যন্ত রাত্রিগণ ঊষার মুখের আচ্ছাদন খুলিয়া না দেন, তখনই নিম্নস্থিত পার্থিব অগ্নি আসিয়া ষজ্ঞের নিকট স্থান গ্রহণ করেন, তিনি হোতা, তিনিই স্তোত্রকারী।

————

(১) সায়ণ কহেন, ভগবদগীতা অনুসারে মোক্ষ আর সংসার, এই দুই গতি আছে। কিন্তু এ ব্যাখ্যা আধুনিক, বৈদিক নহে।