[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

আচমকা এক টুকরো ১

আচমকা এক টুকরো ১

মিহির বিশ্বাস ও তার স্ত্রী ভারতী, বাবলু সিরাজী ও তার স্ত্রী রুমা আমাকে ট্রেনে তুলে দিল। স্টেশনে পৌঁছতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল, প্রায় শেষ মুহূর্তে ছুটতে ছুটতে এসে উঠে পড়লুম কামরায়। ওই দম্পতির কাছে ভালো করে বিদায় নেওয়া হল না।

শুরু হল আমার স্টকলম থেকে অসলো যাত্রা।

ধুমপায়ীদের জন্য আলাদা ছোট ছোট কিউবিকল থাকে, আমার টিকিট সেইরকম একটি খোপে। আমি ছাড়া আর পাঁচজন যাত্রী ও যাত্রীণী। ট্রেন ছাড়ার পর কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকে, কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলে না। আমি আমার সহযাত্রীদের ভালো করে লক্ষ করলুম। এদের মধ্যে আমিই যে একমাত্র বিদেশি, তা আমার গায়ের রঙেই স্পষ্ট। সুইডিসরা বর্ণ-বিদ্বেষী না মোটেই, বিদেশিদের তারা অপছন্দ করে না। কিন্তু তারা স্বভাব-গম্ভীর, অন্যদের সঙ্গে সহজে কথা বলতে চায় না, বিশেষত দিনের বেলা।

দু-জোড়া নারী পুরুষ ও দুজন আলাদা পুরুষ। আমার বাঁ পাশে যে লোকটি বসে আছে, তার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। হাতে একগুচ্ছ বই, দেখলেই কেমন যেন অধ্যাপক-অধ্যাপক মনে হয়। তার উলটোদিকে গোলাপি স্কার্ট পরা যে যুবতীটি বসে আছে, তার মুখখানা হাসি মাখানো। এক একজনকে দেখলেই ভালো লাগে, এই মহিলাটি সে রকম। চশমা পরা পুরুষটি এবং এই মহিলা পূর্ব পরিচিত, উঠেই তারা একটা থলি থেকে দুটো আপেল নিয়ে খেতে লাগল, কিন্তু কেন যেন মনে হল এরা স্বামী-স্ত্রী নয়, হয়তো একই কলেজে পড়ায়, কিংবা প্রতিবেশী। আমার এ রকম মনে হওয়ার কোনও যুক্তি নেই, তবে ট্রেনের কামরায় সময় কাটাবার জন্য আমি অচেনা নারী পুরুষদের চরিত্র, জীবিকা ও পাশাপাশি দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে কতকগুলো ধারণা তৈরি করে নিই, অনেকসময় তা মেলে, তার চেয়েও বেশিরভাগ সময় আমার ধারণা মেলে না। তবু মনে মনে এই রকম অনুমানের খেলা খেলতে দোষ তো কিছু নেই।

এবারে এই ট্রেন যাত্রার অভিজ্ঞতা আমার কাছে বিশেষ স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

আমার ডানপাশে যে যুবকটি বসে আছে, তাকে দেখে মনে হয় কোনও কারখানার শ্রমিক, মাথার চুল রুক্ষ, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, জিনসের ওপর হলুদ গেঞ্জি পরা, ট্রেন ছাড়তে না ছাড়তেই সে একটা মোটা চুরুট ধরিয়ে জানালা দিয়ে চেয়ে রইল বাইরে।

আমি ধাঁধায় পড়লুম আমার সামনের একজোড়া নারী পুরুষকে নিয়ে। এদের পেশা কিংবা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক আন্দাজ করা শক্ত। পুরুষটির মতন এমন রূপবান মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ছ-ফুটের চেয়েও বেশি লম্বা মনে হয়, নিখুঁত স্বাস্থ্য, মাথার চুল সোনালি, চোখের মণি দুটি নীল। তার খয়েরি পোষাকটিও বেশ মুল্যবান। সুইডিসরা সকলেই প্রায় স্বাস্থ্যবান ও সুন্দর হয়, তবু তাদের মধ্যেও এমন সুন্দর পুরুষ দুর্লভ। এর বয়েস পঁয়তাল্লিশের বেশি হতেই পারে না।

তার পাশের মহিলাটি প্রায় বুড়ি, মুখে ভাঁজ পড়ে গেছে, চোখের নীচে ক্লান্তির ছাপ, কোনও রকম প্রসাধন নেই, নস্যি রঙের চুল, একটা দোমড়ানো মোচড়ানো হলদে গাউন পরা। সে ওই রূপবান পুরুষটির মাসি-পিসি বা বড়জোর বউদি হতে পারে, কিন্তু সে প্রেমিকার ভঙ্গিতে পুরুষটির কাঁধে মাথা হেলিয়ে বসেছে।

ট্রেন ছাড়ার মিনিট পাঁচেক পরেই রূপবান পুরুষটি, ধরা যাক তার নাম ইংগমার, এই সুইডিস নামটি আমাদের কাছে পরিচিত, সে তার ঝোলা থেকে একটি ওয়াইনের বোতল ও কয়েকটি কাগজের গ্লাস বার করল। কর্ক ক্রু দিয়ে ছিপিটি খুলে, গেলাসে ঢালতে-ঢালতে আমার দিকে চেয়ে পরিষ্কার ইংরিজিতে জিগ্যেস করল, তুমি একটু নেবে কি?

আশ্চর্য, কামরায় অন্য কারুকে জিগ্যেস করল না, শুধু আমাকেই সাধল কেন? আমি বিদেশি বলে? কিংবা আমি তার মুখোমুখি বসে আছি, সেইজন্য চক্ষুলজ্জায়?

আমি বোতলের লেবেলটা দেখে নিয়েছি, ফরাসি বোর্দে ওয়াইন, সাদা রঙের। এই সুরা আমার বিশেষ প্রিয়, কিন্তু ওই লোকটি আমার সঙ্গে ভদ্রতা করেছে, আমার পক্ষেও ভদ্রতা হবে প্রত্যাখ্যান করা। ওদের দুজনের পক্ষে একটি বোতল এমন কিছু বেশি নয়, তাতে ভাগ বসানো উচিত নয়।

আমি সবিনয়ে বললুম, ধন্যবাদ। আমি খাব না।

সে তবু জিগ্যেস করল, তুমি বুঝি অ্যালকোহল স্পর্শ করো না।

আমি বললুম, অন্য সময়ে পান করি, এখন ইচ্ছে করছে না।

সুইডিসরা কেউ কেউ চমৎকার ইংরিজি বলে, কেউ কেউ কিছুই জানে না প্রায়। ইংগমারের পাশের প্রৌঢ়াটি সুইডিস ভাষায় আমার সম্পর্কে কিছু জিগ্যেস করলেন। ইংগমার আমার কোনও পরিচয় জিগ্যেস না করেই তার সঙ্গিনীকে বলল, এই বিদেশিটি ভারতীয়। ওরা অনেকেই মদ্য বা মাংস খায় না।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ইংগমার বলল, আমি দুবার বোম্বাই শহরে গেছি, জাহাজে। ভারতীয়দের দেখলেই চিনতে পারি। অথবা তুমি কি পাকিস্তানি?

আমি সহাস্যে বললুম, না তুমি ঠিকই ধরেছ, আমি ভারতীয়। তুমি জাহাজে করে বোম্বাই গিয়েছিল, তুমি কি নাবিক?

সে বলল, না। তখন শখ হয়েছিল, সে প্রায় দশ বারো বছর আগের কথা।

প্রঢ়াটি তৃষ্ণার্তের মতন তার গেলাসটি এক চুমুকে শেষ করে আবার সেটি ভরতি করার জন্য বাড়িয়ে দিল। ইংগমার তাকে দ্বিতীয়বার গেলাস দেওয়ার আগে তার ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন দিল একটি।

এই সময় অন্যদিকে তাকাতে হয়। আমি বাঁ-পাশের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলুম। চশমা পরা লোকটি এবং গোলাপি স্কার্ট পরা সুন্দরী পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে চলেছে, কিন্তু একটুও শব্দ হচ্ছে না। ওদের দুজনের হাতের আঙুলগুলো নানা রকম খেলা করছে। বোবারা এ রকম আঙুলের চিহ্ন দিয়ে কথা বলে। এরা দুজনই বোবা? চশমা পরা তরুণটি যদি বোবা হয়, তা হলে তো সে অধ্যাপক হতে পারে না। আর ওই হাস্যমুখী সুন্দরীটি, যাকে দেখলে মনে হয় জীবন সম্পর্কে তার কোনও অভিযোগই নেই, সে কি বাক্যহীনা হতে পারে? সে একবার শব্দ করে হাসল। যার হাসির আওয়াজ এত মিষ্টি, সে কথা বলতে পারে না?

আমার ডানপাশের চুরুট-ফোঁকা যুবকটি বাইরের দিকেই তাকিয়ে আছে, অন্য কারুর সম্পর্কে তাঁর কোনও আগ্রহই নেই।

আমি সিগারেট ধরালুম। ইংগমার আমার প্যাকেটটা চেয়ে নিয়ে দেখল। তারপর বলল, ভারতীয় সিগারেট।

তার সঙ্গিনীটি তাকে কিছু বলল। তখন ইংগমার আমার দিকে তাকিয়ে জানাল যে তার বান্ধবী এই বিদেশি সিগারেট একটু চেখে দেখতে চাইছে, সে কি একটি নিতে পারে?

আমি ধন্য হয়ে বললুম, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আমার কাছে আরও অনেক আছে। তোমরা পুরো প্যাকেটটাই নিতে পারো।

ইংগমার জানাল যে সে ধূমপান করে না। সে একটিই সিগারেট নিয়ে তার বান্ধবীকে দিয়ে প্যাকেটটা আমাকে ফেরত দিল।

ইংগমার ধূমপান করে না। অথচ এই কামরায় উঠেছে, শুধু তার বান্ধবীর জন্য। কী না ওই বান্ধবীর ছিরি। এমন রূপবান পুরুষ এদেশে অসংখ্য তরুণী বান্ধবী পেতে পারে। সে ওই বিচ্ছিরি বুড়িটাকে এত আদর যত্ন করছে কেন, বুড়িটার কি অনেক টাকা আছে?

ইংগমার বলল, সে নাবিক নয়। তা হলে তার-জীবিকা কী? চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, সে বেশ সচ্ছল। সিনেমায় নামলে সে অনেক নামকরা নায়কদের ভাত মেরে দিতে পারত। এমন সুপুরুষ হলিউডের নায়কদের মধ্যেও কম আছে।

ওদের ওয়াইনের বোতল এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে, আর একটি খোলা হয়েছে। কিন্তু প্রৌঢ়াটি এর মধ্যেই বেশ বেচাল। এক বোতল সাদা ওয়াইনের এমন কিছু নেশা হওয়ার কথা নয় এত তাড়াতাড়ি। নিশ্চয়ই ওই প্রৌঢ়াটি ট্রেনে ওঠার আগে খেয়ে এসেছে অনেকটা। এখন দুপুর তিনটে বাজে, এর মধ্যেই মাতাল।

সুইডেনে মদ খাওয়ার চল বেশি। শুক্রবার-শনিবার সন্ধের পর অনেক রাস্তায় মাতালদের ঢলাঢলি দেখা যায়। স্বভাব-গম্ভীর সুইডিসরা মদ খাওয়ার পর বেশ খোলামেলা হয়ে যায়। অচেনা লোকের গলা জড়িয়ে ধরে কথা বলে, স্টকহলমের রাস্তায় এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। কিন্তু দিনের বেলায় এই কাণ্ড?

বোধহয় যাত্রাপথে নিয়ম নাস্তি।

চশমা পরা লোকটি ও গোলাপি স্কার্ট পরা তরুণী অনবরত হাত নেড়ে চলেছে, মাঝেমাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। এমন নিঃশব্দ আচ্ছা আমি আগে কখনও দেখিনি। তারা আমাদের সম্পর্কেই আলোচনা করছে কি না, তা বোঝবার উপায় নেই। তরুণীটি শুধু হেসে উঠছে এক একবার।

ইংগমারের প্রৌঢ়া বান্ধবীটি হঠাৎ আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে জোরেজোরে কী যেন বলল। বেশ রাগ রাগ ভাব। কী ব্যাপার, এ কি বিদেশিদের পছন্দ করে না? আমার সিগারেটটা ভালো লাগেনি? পুরোটাই তা শেষ করল, এখন আমাকে ধমকাচ্ছে। ইংগমার আমাকে বলল, আমার বান্ধবী বলছে, তুমি ওকে সিগারেট দিয়েছ। তুমি আমাদের ওয়াইন একটু খাবে না কেন?

ওদের দ্বিতীয় বোতলটাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। শুধু এক ঢোঁক ওয়াইন খেয়ে আমার কী হবে? অমি বিনীতভাবে বললাম, না, থাক।

প্রৌঢ়াটি আমার প্রত্যাখ্যান বুঝতে পেরে খুঁসে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে, টলতে টলতে আমার কাছে এসে গেলাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, খা খা।

এদেশে কেউ এঁটোকাটা মানে না। সুরা ও নারীর ওষ্ঠ কখনও এঁটো হয় না। অপরের গেলাসে চুমুক দিতে আমি অন্য সময়ে আপত্তি করি না। কিন্তু এই মাতাল মহিলাটির ঠোঁটের কোণে গ্যাঁজলা, এর আগে দু-একবার থুতু ফেলেছে মাটিতে। সব মিলিয়ে একটা নোংরা নোংরা ভাব, আমার ঘেন্না করল। আমি বললুম, প্লিজ প্লিজ আমি খাব না।

আমাকে জোর করে খাওয়াবার জন্যে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আমার গায়ে। তার পাতলা পোষাকের আড়ালে বিশাল দুটি স্তন বেশ শিথিল, আমার মনে হল দুটো নরম বালিশ কেউ চেপে ধরেছে আমার গায়ে। আমি মুখ সরিয়ে নিলেও খানিকটা ওয়াইন ছলকে পড়ল আমার গায়ে। খুবই বিরক্তি বোধ হলেও তা প্রকাশ করার নিয়ম নেই এদেশে, আমি রুমাল দিয়ে গা মুছতে লাগলুম।

ইংগমার টেনে সরিয়ে নিল তার বান্ধবীকে, তাকে আদর করে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল। ফিসফিস করে বলতে লাগল কত কী প্রেমের কথা।

একটু পরেই সেই প্রৌঢ়া বমি করে ভাসিয়ে দিল ইংগমারের পোষাক।

ইংগমার একটুও রাগ করল না, সে পেপার ন্যাপকিন দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল নিজেকে। কামরায় কেউ একটা কথা বলল না। ইউরোপীয়দের এই এক চমৎকার স্বভাব, অন্যের ব্যাপারে কিছুতেই নাক গলায় না, অকারণে কোনও মন্তব্যও করে না। সুইডিসরা আরও বেশি নিস্পৃহ ধরনের।

বমি করার পরেও প্রৌঢ়াটি হাত বাড়িয়ে বোতলটি নিয়ে বাকি ওয়াইনটুকু শেষ করতে যাচ্ছিল, ইংগমার জোর করে সেটি কেড়ে নিল। রমণীটি শুরু করে দিল চিৎকার।

তখুনি ট্রেন এসে থামল একটা স্টেশনে। ইংগমাররা সেখানে নামছে। তার বান্ধবী কিছুতেই নামতে চায় না। সে সমানে হাত-পা ছুড়ছে ও ওয়াইন চাইছে। ইংগমার এবার সাহায্য চাইল আমার ডান পাশের চুরুট-ফোঁকা ছোঁকরাটির। সে উঠে প্রৌঢ়াটির দু-হাত চেপে ধরল। দুজনে মিলে প্রায় চ্যাংদোলা করে মাতালিনীকে নামিয়ে দিল প্ল্যাটফর্মে।

নীরব বাক্যালাপকারী দুই নারী-পুরুষও নেমে গেল এই স্টেশনে। আমাদের সঙ্গে তারা কোনও কথা বলেনি। কিন্তু যাওয়ার সময় তারা ছুঁড়ে দিয়ে গেল খানিকটা হাসি।

আবার ট্রেন চলার পর আমার একমাত্র সহযাত্রীটি এতক্ষণ বাদে মুখ খুলল। নম্রভাবে জিগ্যেস করল, তুমি ভারতের কোন শহরে থাকো?

আমি কলকাতার নাম বলতেই সে জানালো যে সে কলকাতায় তিনবার গেছে বিশেষ গবেষণার কাজে। সে একটু একটু বাংলাও জানে। মাছের বংশ বিবর্তন নিয়ে তার গবেষণা। সে সুন্দরবন অঞ্চলে কয়েকটা মাছের ভেড়িতেও কাজ করেছে।

হা কপাল, আমি যাকে শ্রমিক ভাবছিলুম, সে একজন উচ্চাঙ্গের গবেষক।

এই কলকাতা-ফেরত যুবকটির সঙ্গে আগে পরিচয় হলে আমি অনেক গল্প করতে পারতুম।

আমি তাকে জিগ্যেস করলুম, আচ্ছা, ওই যে ওই পাশের দুজন এতক্ষণ হাত নেড়ে আঙুলের ভাষায় কথা বলছিল, ওরা কি ইয়ে…. মানে… বোবা?

ছেলেটি বলল, না, না। ওরা তো প্ল্যাটফর্মে নেমেই স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে লাগল। ওই চশমা পরা পুরুষটি একজন সেলসম্যান। সে আমাকে এখানকার একটা হাসপাতালের কথা জিগ্যেস করল।

তা হলে ওরা এখানে শুধু হাত নেড়ে কথা বলছিল কেন?

বোবা না হলেও আজকাল অনেকে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ শিখে নেয়। তাতে সুবিধে কত বলো। ট্রেনের কামরায় সবাই মিলে কথা বললে গোলমাল হয়, ওদের কথা বলার কোনও শব্দ নেই। ওরা অনেক গোপন কথা আলোচনা করতে পারে। আমিও ওই ল্যাঙ্গোয়েজ একটু একটু জানি। ওদের কথা কিছু কিছু বুঝতে পারছিলুম। ওরা তোমাকে নিয়েও আলোচনা করছিল।

তাই নাকি, কী বলছিল?

তোমার গায়ে যখন বয়স্কা মহিলাটি ওয়াইন ঢেলে দিল, তখন ওরা বলল ভারতীয়রা খুব ভদ্র হয়, তাই কিছু বলল না। ওই বুড়িটার উচিত ছিল ভারতীয়টির কাছে ক্ষমা চাওয়া। ছি ছি, কী লজ্জার কথা।

না, না, তাতে কী হয়েছে। ভদ্রমহিলার বেশি নেশা হয়ে গিয়েছিল।

ওরা মাদাম টুনিলকে চিনতে পারেনি। তুমি তোমার সামনের ব্যক্তিটিকে চিনতে পেরেছিলে? কাগজে ছবি দেখোনি?

আমি তোমাদের দেশে মাত্র কয়েকদিন আগে এসেছি, কারুকেই চিনি না। ওই সুদর্শন পুরুষটি খুব বিখ্যাত ব্যক্তি বুঝি?

মোটামুটি বিখ্যাত। ওর নাম ওলাফ গোল্ডবার্ন। স্টকহলম থিয়েটারে বেশ নাম করা অভিনেতা। দু-একটি ফিল্মেও নেমেছে। আর ওর সঙ্গের মহিলা–

ওই বয়স্কা মহিলা ওর বান্ধবী?

ওই মহিলার নাম মাদাম টুনিল। উনি এককালে আরও বেশি বিখ্যাত ছিলেন। মঞ্চে বহু নাটকের নায়িকা হতেন। সিনেমায় ইচ্ছে করে নামেননি কখনও। গানও গাইতেন চমৎকার। একবার অসুস্থ হয়ে দুবছর আর মঞ্চে নামতে পারেননি। সেই অসুখে গলা নষ্ট হয়ে যায়। তারপর পরপর দুটো নাটক একবার জমেনি, দর্শকরা ওঁকে আর চায় না। এখন স্টেজ থেকে একেবারে বাদ পড়ে গেছেন। কেউ চান্স দেন না। মদ খেয়ে, অত্যাচার করে উনি নিজেকে নষ্ট করে ফেলেছেন, দুবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। ওর আর কোনও বন্ধু নেই। ওলাফ ওকে এখানে একটা হাসপাতালে ভরতি করে দিতে এনেছে। আমি মাদাম টুনিলের ভক্ত ছিলাম একসময়, খুব বড় অভিনেত্রী ছিলেন, এখন কী অবস্থা হয়েছে! দেখে কষ্ট হচ্ছিল।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললুম।

আমার একটিমাত্র অনুমান কাছাকাছি গেছে। ওলাফ অর্থাৎ মনে মনে আমি যার নাম দিয়েছিলুম ইংগমার, তাকে দেখে আমার সিনেমার অভিনেতাদের কথা একবার মনে হয়েছিল,

সে সত্যিই একজন অভিনেতা।

ওই আধ-বুড়ি, মাতাল, পাগলাটে স্বভাবের প্রাক্তন অভিনেত্রীকে কত যত্ন করে, কত আদরে সে নিয়ে আসছিল, একবারও রাগ করেনি। কোনও নাম করা সুদর্শন অভিনেতা কি কোনও বাতিল, প্রাক্তন, অসুন্দরী বুড়ির জন্য এতটা করে?

কিংবা এটাও ছিল ওই রূপবান পুরুষটির অভিনয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *