যুধিষ্ঠির – ৬

শুধু মহত্ত্ব, মহত্ত্ব আর বদান্যতা—শুধু এই নিকষ-ভাল দিয়ে যদি একটি মানুষের চরিত্র তৈরি হয়, তবে সেও বড় একঘেঁয়ে হয়ে ওঠে। যুধিষ্ঠিরও প্রায় তাই হয়ে উঠেছেন। তবু ভাল, যে পাশা-খেলার জন্য তাঁকে সবার কাছে দিনরাত ধিক্কার শুনতে হচ্ছে, সেই পাশাখেলাটা তিনি তত ভাল জানতেন না, অথচ পছন্দ করতেন। অসংখ্য ভালর মধ্যে এই একটুখানি মন্দ ছিল বলেই আবারও আমরা একটু হাঁপ ছাড়তে পারছি। যুধিষ্ঠিরের কী পাশাখেলার নেশা। অত গালমন্দ শুনে অত বিপদে পড়েও তাঁর লজ্জা নেই। বিরাটরাজার বাড়িতে অজ্ঞাতবাসের ছদ্মবেশ ধারণ করার আগে তিনি সহাস্যে বলছেন—আমি বেশ বিরাটরাজার সভাসদ সেজে থাকব। আমার নাম হবে কঙ্ক। বিরাটরাজার সঙ্গে পাশা খেলে তাঁর মনোরঞ্জন করব। যুধিষ্ঠির এবার পাশার খুঁটিগুলি স্মরণ করে অদ্ভুত উচ্ছ্বাসে বলে ফেললেন—ওঃ ভাবতেই কেমন লাগছে। বৈদূর্যমণির মতো নীল নীল ঘুঁটি, সোনার মতো হলুদ রঙের ঘুঁটি, লাল, সাদা এই চার রঙের ঘুঁটির সারি চালিয়ে যখন খেলব, তখন লাল-কালোর দান ফেলতে কী মনোরমই না লাগবে—কৃষ্ণাক্ষাল্লোহিতংশ্চৈব নির্বৎস্যামি মনোরমান্।

মহাকাব্যের কবি শুধু একখানি পাশার দান ফেলে দেবতা-প্রতিম যুধিষ্ঠিরকে আবারও এক মুহূর্তে মানুষ করে তুললেন। সারা বনপর্ব জুড়ে অসংখ্য ঋষি-মুনির বিচিত্র সদুপদেশ শুনতে শুনতে যুধিষ্ঠির প্রায় ধ্যানস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাঁকে দুর্যোধন এবং জয়দ্রথ যদি বা কিছু মনুষ্যোচিত মুক্তি দিয়ে থাকে, তবে বিরাটরাজার নতুন দেশও তাঁর কাছে এক নবতর মুক্তি, আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা যাই থাকুক—মানুষের মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধবাসরে এইজন্যই কি বিরাট-পর্ব পাঠের বিধি– epic relief? যাই হোক যুধিষ্ঠির একে একে তাঁর চার ভাইয়ের অজ্ঞাতবাসের পরিকল্পনাও শুনলেন। ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব—সবারই অজ্ঞাতবাসের পরিকল্পনা শুনে যুধিষ্ঠির এবার কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর কথায় এলেন। যুধিষ্ঠির বললেন—কৃষ্ণা-পাঞ্চালী আমাদের সকলের প্রিয়া পত্নী। মায়ের মতো তাঁকে যত্নে রাখা দরকার, জ্যেষ্ঠা ভগিনীর মতো সে আমাদের সম্মান পাবার যোগ্য—মাতেব পরিপাল্যা চ পূজ্যা জ্যেষ্ঠেব চ স্বসা।

বস্তুত এই একটি পংক্তির মতোই দ্রৌপদীর প্রতি যুধিষ্ঠিরের আপন মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে বলে মনে করি। তরুণ-তরুণীর সতত বাৰ্যমান প্রেম নয়, বিবাহিত যুবক-যুবতীর সতত সুলভ দাম্পত্য প্রেমও নয়—এ এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি। বেশি বয়সের পুরুষের সঙ্গে অল্পবয়সী বালিকার বিবাহ হলে, সে বালিকা যেমন দাম্পত্য প্রেমের পরিবর্তে স্বামীর স্নেহরসেই বেশি সিক্ত হয়, যুধিষ্ঠিরের কাছে দ্রৌপদীও প্রায় সেইরকম। সারাক্ষণের জ্ঞানচর্যা আর সত্যের নিষ্ঠায় যুধিষ্ঠির নিজের সংসারে বৃদ্ধ কর্তাটির মতো হয়ে গিয়েছেন। তিনি দ্রৌপদীর মতো এক রমণীর এক-পঞ্চমাংশ স্বামীত্ব লাভ করে, তাঁকে স্নেহ ছাড়া আর কীই বা দিতে পারেন? নতুন শ্বশুরবাড়ি যাবার মুখে কন্যার পিতা যেমন করেন, যুধিষ্ঠির সেই ভাবনায় বলে ওঠেন—অন্য বউ-ঝিরা যেমন ক্লিষ্ট-কর্ম করতে পারে, কৃষ্ণা যে তেমন কিছু পারেই না—ন হি কিঞ্চিদ্ বিজানাতি কর্ম কর্তৃং যথা স্থিয়ঃ। সে সুকুমারী, ছেলেমানুষ—সুকুমারী চ বালা চ—তার ওপরে রাজার ঘরের মেয়ে। যেখানেই গেছে, কাজকর্ম তো করতে হয়নি, শুধু ফুলের মালার গন্ধ, ময়না-গাঁটি আর জামা-কাপড়—এইগুলোই ও বোঝে—এতান্যেবাভিজানাতি যতো যাতা হি ভাবিনী। কী করে যে বিরাটরাজার ঘরে অন্যের অজ্ঞাত হয়ে দ্রৌপদী থাকবে—তাই তো ভাবছি।

যুধিষ্ঠিরের ভাবনাটুকু মিথ্যে নয়, কিন্তু এই ভাবনা যৌবনোদ্দীপ্তা রমণীর প্রেমিকের মতো, নাকি সুখচ্ছায়াপ্রতিপালিতা কন্যার পিতার মতো—তা সহৃদয়ের অনুভববেদ্য। আমরা জানি, দ্রৌপদী তাঁর কাজ খুঁজে পেয়েছিলেন বিরাটপত্নী সুদেষ্ণার কেশপরিচর্যায়। কিন্তু সারা বিরাটপর্বে যুধিষ্ঠিরের কৃত্য কিছু নেই, শুধু রাজার সঙ্গে পাশা-খেলা ছাড়া। এমনকী বিরাটপর্বের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে যদি রাজশ্যালক কীচকের উপদ্রব একটা রীতিমতো বড় ঘটনা হয়ে থাকে, তবে সেখানেও যুধিষ্ঠিরের অনুপ্রবেশ নিতান্তই সামান্য, যদিও সে অনুপ্রবেশ ঘটনার গুরুত্বে যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ। দ্রৌপদীর রূপে মোহাবিষ্ট কীচক যখন দ্রৌপদীকে প্রায় তাড়িয়ে নিয়ে এলেন রাজসভায় এবং বিচার-প্রার্থিনী দ্রৌপদীকে লাথিও মারলেন, তখন রাগে যুধিষ্ঠিরের কপালে ঘাম জমে গিয়েছিল—যুধিষ্ঠিরস্য কোপাত্তু ললাটে স্বেদ আগতঃ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই সময় ভীমও নিজের কাজে এসেছিলেন রাজসভায়। ভীমের হস্তনিষ্পেষণ এবং দাঁতের ঘর্ষণ দেখে যুধিষ্ঠির আকারে-ইঙ্গিতে কোনওমতে ভীমকে ঘরে পাঠান। অজ্ঞাতবাস প্রকট হয়ে যাবার ভয়ে অসম্ভব ক্রুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও যুধিষ্ঠির পাক্কা অভিনয় করলেন। দ্রৌপদীকে বললেন—তুমি সুদেষ্ণার ঘরে যাও। এখন রাগের সময় নয় বলেই তোমার গন্ধর্ব-পতিরা ছুটে আসছেন না। তুমি সময় বোঝো না, যাও এখন। শুধু শুধু বিনোদিনী নটীদের মতো রাজসভায় দাঁড়িয়ে থেকো না। মৎস্যরাজ বিরাটের পাশা-খেলার অসুবিধে হচ্ছে।

সত্যি কথা বলতে কি, দ্রৌপদী কেঁদে-কেটে, বিচার চেয়ে যেভাবে ‘সিন’ তৈরি করেছিলেন এবং রাজসভার সমস্ত লোক তাঁর চেহারা দেখে যেভাবে মর্যাদা দিচ্ছিল—এবং পূজয়তস্তাং তু কৃষ্ণাং প্রেক্ষ্য সভাসদঃ—তাতে তাঁর পরিচয় প্রকট হয়ে যেতে পারত। এমনকী যুধিষ্ঠিরের তিরস্কারের পরেও দ্রৌপদী রাগ করে বলেছিলেন—যাদের সবার বড়ভাই পাশা-জুয়া খেলে বেড়াচ্ছে, তাঁদের এত দয়া বলেই আমি সুখের সময়েও ভোগের মুখ দেখিনি। দ্রৌপদীর এই কথায় বিপদ ঘটতে পারত। রাগের মধ্যে দ্রৌপদী বুঝতেও পারেননি যে, যুধিষ্ঠির উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেই দিয়েছেন। যুধিষ্ঠির ভীমকে যেরকম ক্রোধে অধীর হতে দেখেছেন, তাতে তাঁর সন্দেহ ছিল না যে, ব্যবস্থা একটা হবেই। আর সেই জন্যই যুধিষ্ঠির তাঁর অনুজ্ঞা জানিয়ে দিয়েছিলেন শান্তভাবে—তুমি যাও সৈরিন্ধ্রী। তোমার গন্ধর্ব-স্বামীরা তোমার প্রিয় কাজটি করে দেবেন। যে তোমার অপ্রিয় কাজ করেছে, তাকে দণ্ড দিয়ে তোমার দুঃখ দূর করবেন তোমার গন্ধর্ব-স্বামীরা—ব্যপনেষ্যন্তি তে দুঃখং যেন তে বিপ্রিয়ং কৃতম্।

দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের মনোভাব বুঝতে পারেননি। শুধু শুধুই ভীমের কাছে অনুযোগ করছেন—যার স্বামী যুধিষ্ঠির, তার আবার সুখ? দ্রৌপদী সম্পূর্ণ তিন-অধ্যায় জুড়ে যুধিষ্ঠিরকে অকথ্য গালাগালি দিয়েছেন ভীমকে শুনিয়ে। কিন্তু এই প্রথম, মধ্যম-পাণ্ডব দ্রৌপদীর প্রতি সম্পূর্ণ সমব্যথী হয়েও যুধিষ্ঠিরের কথার মাত্রাটা বুঝিয়ে দিয়েছেন দ্রৌপদীকে। ভীম বলেছেন—আমি তখনই বিরাটরাজার সর্বনাশ করে ছাড়তাম, কিন্তু যুধিষ্ঠির আমাদের অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছেন, তাই কিছু করার ছিল না—অত্র মে কারণং ভাতি কৌন্তেয়া যৎ প্রতীক্ষতে। ভীম অনেকক্ষণ দ্রৌপদীর মুখে যুধিষ্ঠিরের তিরস্কার শুনে দ্রৌপদীকে বলেছেন—যা বললে, বললে। তোমার মুখে এই তিরস্কারের কথা যদি যুধিষ্ঠির শোনেন, তবে তিনি আত্মহত্যা করবেন—শৃণুয়াদ্ যদি কল্যাণি ধ্রুবং জহ্যাৎ, স জীবিতম্।

পিঠোপিঠি ভাই হওয়ার দরুন ভীম যুধিষ্ঠিরকে যত খারাপ কথাই বলুন, আজ প্রিয়া মহিষীর মুখে তাঁর জ্যৈষ্ঠ-স্বামীর অবমাননা শুনে ভীম কিন্তু ভীষণ দুঃখিত হয়েছেন। অপার ধৈর্য নিয়ে যুধিষ্ঠির যে শেষ দিনটির জন্য কীভাবে অপেক্ষা করছেন, সেটা বুঝেই ভীম দ্রৌপদীকে বলেছেন—রামচন্দ্রের প্রিয়তমা মহিষী সীতাকে রাবণ নিজের ঘরে চুরি করে নিয়ে গিয়ে নানা কষ্ট দিয়েছিল। সীতা কিন্তু শত দুঃখ সয়েও রামচন্দ্রকেই কায়মনোবাক্যে অনুসরণ করেছেন। সীতা, লোপামুদ্রা এঁরা যেমন গুণবতী, তুমিও তো সেইরকমই, দ্রৌপদী—তথা ত্বমপি কল্যাণি সর্বৈঃ সমুদিতা গুণৈঃ।

দ্রৌপদী লজ্জা পেয়েছেন। বলেছেন—মনের দুঃখ সইতে না পেরেই আমি এমন কুকথা বলেছি, আমার রাজাকে আমি তিরস্কার করছি না—অপারয়ন্ত্যা দুঃখানি ন রাজানমুপালভে। আমরা জানি, এরপর নির্বিঘ্নে কীচক-বধ হয়ে গেছে। ওদিকে অজ্ঞাতবাসের শেষ কল্পে কৌরবরা বিরাটরাজার দেশ আক্রমণ করেও কোনও ফল লাভ করতে পারেননি। অর্জুনের বাহুবলে বিরাটরাজ্য রক্ষিত হয়েছে। অজ্ঞাতবাসের নির্মোক মোচন করে পাণ্ডবরা যুধিষ্ঠিরকে বিরাটরাজার সিংহাসনেই বসিয়ে দিয়েছেন। পাণ্ডবদের পরিচয় আবিষ্কৃত হল। বিরাট অভিভূত হলেন। কুমারী উত্তরার সঙ্গে অভিমন্যুর বিয়ে দিয়ে বিরাটরাজা পঞ্চপাণ্ডবকে দিয়ে হীন কাজ করানোর ঋণ শোধ করলেন। উৎসবে আনন্দে বিরাটনগরী মেতে উঠল।

অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিরাটনগরীতে আমরা যুধিষ্ঠিরের সমর্থকদের সমবেত হতে দেখছি। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের আগে ঠিক যেমন দেখেছিলাম, এখানেও তেমনই যুদ্ধের উদ্যোগ-পর্ব শুরু হচ্ছে কৃষ্ণের কথার সূত্রপাতে। সভায় উপস্থিত বৃষ্ণি-বীরেরা, পাঞ্চালরা, কেকয় এবং মৎস্যদেশের প্রধানরা নিজ নিজ মত ব্যক্ত করছেন, আর সে সব মতামতের শুভাশুভ বিচার করে কৃষ্ণ তাঁর শেষ সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। বস্তুত যুদ্ধোদ্যোগের সময় থেকেই যুধিষ্ঠিরের ভার অনেক হালকা হয়ে গেছে। রাজনীতি যখন যুদ্ধের পরিণতির দিকে এগোচ্ছে, তখন সেই যুদ্ধাশ্বের লাগাম যুধিষ্ঠিরের হাত থেকে প্রধানত কৃষ্ণের হাতে চলে গেছে। কিন্তু তবুও লক্ষণীয় বিষয় হল, কুরুসভায় যখন দ্রুপদের পুরোহিতের মাধ্যমে সন্ধির প্রস্তাব গেল এবং ধৃতরাষ্ট্র তার উত্তরে পালটা-সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে সঞ্জয়কে পাঠালেন, যুধিষ্ঠির কিন্তু তখন আর পূর্বের যুধিষ্ঠির নেই। তাঁর প্রত্যয় দৃঢ়, কথাবার্তা স্পষ্ট এমনকী যুদ্ধেও তাঁর কোনও আপত্তি নেই।

দ্রুপদরাজার দূত মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে যুধিষ্ঠিরের হয়ে বেশ কড়া ভাষাতেই জানিয়ে গেছেন যে, কোনও অজুহাত চলবে না। পাণ্ডবদের পৈতৃক-রাজ্য ফিরিয়ে দিতেই হবে। সম্পূর্ণ কৌরব-সভার মধ্যে এই কঠিন ভাষার কিছু প্রতিক্রিয়াও হয়েছিল। স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত সূত সঞ্জয়কে যুধিষ্ঠিরের কাছে দূত হিসেবে পাঠাবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের মনে কূটবুদ্ধি তখনও কাজ করছিল। পাণ্ডবদের অমানুষিক শক্তি এবং সহায়ক মিত্র-রাজাদের কথা মাথায় রেখে তিনি পাণ্ডবদের সঙ্গে শান্তিই চাইছিলেন, কিন্তু রাজ্য দেবার অভিপ্রায় তাঁর এক বিন্দুও ছিল না। সঞ্জয়কে যখন দূত হিসেবে তিনি পাঠাচ্ছেন, রাজ্যখণ্ডের কথা তিনি উচ্চারণও করছেন না, কিন্তু পাণ্ডবরা যে কত ভাল, কত বীর, কত তাঁদের মাহাত্ম্য, এই সব স্তোকবাক্য দিচ্ছেন। ভীম-অর্জুন-কৃষ্ণ ইত্যাদি যুদ্ধবীরদের অমানুষী ক্ষমতার কথা তিনি জানেন, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন—ভীম, অর্জুন এমনকী কৃষ্ণকেও আমি তেমন ভয় পাই না—নাহং তথা হ্যর্জুনাদ্ বাসুদেবাদ্/ভীমাদ্বাপি যমযোর্বা বিভেমি—কিন্তু মহারাজ যুধিষ্ঠির যদি ক্রোধযুক্ত হন, তবে সেই ক্রোধকে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় করি—মন্যোরহং ভীততরঃ সদৈব।

ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে ‘অজাতশত্রু’ বলে ডাকেন। অতএব শত্রুহীন মানুষটির ক্রোধ যে ঠিক ভীম-অর্জুনের মতো নয়, সেটা তিনি জানেন। যুধিষ্ঠিরের তেজ ঠিক সাধারণের তেজ নয়, তাঁর তেজ ব্রহ্মচর্যের, তপস্যার, সত্যের। আর ঠিক সেই জন্যই তিনি যে ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হন, বুঝতে হবে অজস্রবার সেখানে ক্ষমা করাটা হয়েই গেছে এবং সেই ক্রোধ যুক্তিযুক্ত—– তস্য ক্রোধং সঞ্জয়াহং সমীক্ষ্য স্থানে জানন্ ভূশমস্মদ্য ভীতঃ। ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে অনেক কথা বলে দিলেন যুধিষ্ঠিরকে বলার জন্য।

সঞ্জয় বিরাটরাজার রাজধানীতে পৌঁছলেন ধৃতরাষ্ট্রের বার্তা নিয়ে। যুধিষ্ঠির কুরুবাড়ির সব মানুষের কুশল জিজ্ঞাসা করেছেন বটে কিন্তু প্রথম চোটেই তিনি ভীম-অর্জুনের অপ্রতিরোধ্য শক্তির কথাও ঘোষণা করেছেন। এ যেন অন্য এক যুধিষ্ঠির। সমস্ত বনবাস-কাল জুড়ে তিনি অজস্রবার তিরস্কার শুনেছেন দ্রৌপদীর কাছে, ভীমের কাছে। তবু তিনি উপযুক্ত সময়ের প্রতীক্ষা করেছেন। নিজের সত্যপথ থেকে চ্যুত না হয়ে পাশা-খেলার প্রায়শ্চিত্তও করেছেন। ইতিমধ্যে অর্জুন দিব্য-অস্ত্র লাভ করেছেন, রাজনৈতিক দিক দিয়ে পাঞ্চাল-যাদব এবং আরও সব রাজনৈতিক শক্তির সমবেদনা তাঁর দিকেই বর্ষিত হয়েছে। তিনি এবার দণ্ড-দানের জন্য প্রস্তুত। যুধিষ্ঠির নিজেই বলে দিয়েছেন—ভাল কথা বলেই হোক, ছেড়ে দিয়ে হোক—কোনও ভাবেই আমরা ধৃতরাষ্ট্রের সেই অহঙ্কারী পুত্রটিকে সুপথে আনতে পারিনি, অতএব এখন তো অন্যভাবে প্রস্তুত হতেই হবে—সর্বাত্মনা পরিণেতুং বয়ঞ্চ ন শকুমো ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রম্।

সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরকে একটু স্তোকবাক্য দেবার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে যুধিষ্ঠির সে সব কথা শুনতে চাননি। তিনি বলেছেন—এখানে সবাই আছেন—পাঞ্চালরা আছেন, যাদবরা আছেন, বিরাট আছেন, অতএব তোমার যা বলার, ধৃতরাষ্ট্র যা যা তোমাকে বলে দিয়েছেন, তা এঁদের সবার সামনে বল—যত্তে বাক্যং ধৃতরাষ্ট্রানুশিষ্টং/ গাবল্গণে ব্রহি তৎ সূতপুত্র। সঞ্জয় বললেন—ধৃতরাষ্ট্র শান্তি চান—শমং রাজা ধৃতরাষ্ট্ৰো’ভিনন্দন্। তোমরা প্রত্যেকে একেকজন ইন্দ্রের সমান বীর, সমস্ত ধর্মের নীতি-নিয়মও তোমরা জান। ঋজুতা-মৃদুতার মতো বড় গুণ যেমন তোমাদের আছে, তেমনই এক বিরাট বংশে তোমাদের জন্ম। তোমাদের তাই এমন কোনও হীন কর্ম মানায় না যা তোমাদের কলঙ্কিত করে।

দু’পক্ষের যুদ্ধ সম্ভাবনায় অযথা যে লোকক্ষয়ের সৃষ্টি হবে, সে ব্যাপারে পাণ্ডবদের দায়টুকুর কথাই ধৃতরাষ্ট্র বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন সঞ্জয়ের মুখ দিয়ে। জ্ঞাতিবধের মাধ্যমে যুধিষ্ঠিরের যে জয় আসবে সে জয় যে প্রায় পরাজয়েরই সমান—পরাজয়ো যত্র সমো জয়শ্চ—সে-কথা বলে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে একটু লজ্জাও দিতে চেয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্র দেখিয়েছেন—পাঞ্চাল-যাদবদের দ্বারা রক্ষিত পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করা যেমন সহজ নয়, তেমনই ভীষ্ম-দ্রোণ প্রভৃতি বীরের দ্বারা সুরক্ষিত কৌরবদের জয় করাও তত সহজ নয়। দু’পক্ষের এই তুল্যশক্তিতার প্রমাণ দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র আবারও বলেছেন—জয়ই হোক অথবা পরাজয়—এক্ষেত্রে কারওই সুবিধে হবে না। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নিরর্থক হবে—জয়ে চৈব পরাজয়ে চ নিঃশ্রেয়সং নাধিগচ্ছামি কিঞ্চিৎ।

ধৃতরাষ্ট্রের বাণী সঞ্জয় অনেক শুনিয়ে গেলেন এবং এই মুহূর্তে এই সব জ্ঞানের কথার পিছনে ধৃতরাষ্ট্রের যে একটা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে সেটা বুঝতে পেরে যুধিষ্ঠির যেন একটু বিরক্তই হলেন। তিনি বললেন—আমি কোন কথাটা এমন বললাম, সঞ্জয়! যাতে তোমার মনে হল আমরা যুদ্ধ চাই—কাং নু বাচং সঞ্জয় মে শৃনোষি/ যুদ্ধৈষিণীং যেন যুদ্ধাদ্ বিভেষি। যুদ্ধের চেয়ে যে শান্তি অনেক বড় জিনিস—এ আমরা বেশ জানি। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র তাঁর শতপুত্রের সঙ্গে আমাদের পাঁচ ভাইকে যোগ করে যে ভোগ লাভ করতে পারতেন, সে ভোগ এখন চলছে আমাদের বাদ দিয়েই এবং তাতেও কোনও তৃপ্তির লক্ষণ নেই। আগুনে ঘি দেবার মতো সেই ভোগেচ্ছা বেড়েই চলেছে—কামার্থলাভেন তথৈব ভূয়ো/ ন তৃপ্যতে সুর্পিষেবাগ্নিরিদ্ধঃ। আমরা জিজ্ঞাসা করি—সমস্ত রাজৈশ্বর্য লাভ করেও মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কেন দীনচেতা মানুষের মতো কথা বলছেন—লালপ্যতে সঞ্জয় কস্য হেতোঃ। তিনি তো সর্বদাই তাঁর মন্দবুদ্ধি-পুত্র এবং তাঁর মন্ত্রণাদাতা কুবুদ্ধি কতগুলি মানুষের কথাই শুনে চলেছেন। মহামতি বিদুর যে সমস্ত প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়েছিলেন, সে সব কথা তো কই তিনি একটুও শোনেননি। শোনেননি, কেননা তিনি সেইটাই করবেন, যা তাঁর ছেলের পছন্দ। এইভাবেই তিনি অধর্মের মধ্যে প্রবেশ করছেন—সুতস্য রাজা ধৃতরাষ্ট্রঃ প্রিয়ৈষী/ সংবুধ্যমানো বিশতে’ধর্মমেব।

পূর্বে ঘটা কিছু কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি করলেন যুধিষ্ঠির। সঞ্জয়কে তাঁর অন্তরের বোধটাও ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে যুধিষ্ঠির বললেন—সম্ভব নয়, সঞ্জয়! শান্তি জিনিসটা সত্যিই অসম্ভব। ধৃতরাষ্ট্রের ছেলের মন্ত্রী কারা দেখ। দুঃশাসন, শকুনি—এঁরা সব। এঁরা থাকতে কুরু-পাণ্ডবের মধ্যে শান্তি-স্বস্তি কিছু হবে না—কথং স্বস্তি স্যাৎ কুরুসৃঞ্জয়ানাম্। ধৃতরাষ্ট্র চাইছেন—তিনি তাঁর ছেলেদের নিয়ে নিরুপদ্রবে রাজ্য ভোগ করবেন, তেমন ভাবলে কি আর শান্তির পথ প্রশস্ত হবে, সঞ্জয়? ধৃতরাষ্ট্র প্রধানত কর্ণের ভরসায় আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে যাচ্ছেন, কিন্তু মনে রেখো, সঞ্জয়! বিপদকালে কর্ণ কোনও দিন অর্জুনের সামনে দাঁড়াতে পারেননি।

যুধিষ্ঠির নরমে-গরমে কথা শেষ করে নিজের সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন সঞ্জয়কে। তিনি বললেন—বুড়ো রাজা ধৃতরাষ্ট্র যদি এইভাবে স্বার্থবুদ্ধি নিয়েই চলেন, তবে পাণ্ডবদের কোপে দগ্ধ হবে সব। আর তুমি তো জান সঞ্জয়। আমরা সারা জীবন কত কষ্ট পেয়েছি, তোমার মুখ চেয়ে সে-কথা না হয় আর তুললাম না। কিন্তু আমাদের শেষ কথা শোনো—আগে যেমন ছিল তেমনটিই হোক আবার। দুর্যোধন আমাদের ইন্দ্রপ্রস্থ ছেড়ে দিক, আর সে যেখানে ছিল থাক, আমাদের আপত্তি নেই। তোমরা যদি এইভাবে পূর্বাবস্থায় ফিরে আস, তবেই তুমি যেমন বললে, সেই শান্তির পথ খোলা থাকবে, নচেৎ নয়—অদ্যাপি তত্তত্র তথৈব বর্ততাং শান্তিং গমিষ্যামি যথা ত্বমান্থ।

হস্তিনাপুর থেকে আসার আগে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র শান্তি-শান্তি করে সঞ্জয়ের মগজ-ধোলাই করে দিয়েছেন। অতএব যুধিষ্ঠিরের এত কথার পরেও আবারও তিনি শান্তির কথা বলেছেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির তবুও তাঁর কথায় আমল দেননি। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণকে কথা বলতে হয়েছে যুধিষ্ঠিরের কথা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সঞ্জয় যে যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য বুঝতে পারছেন না, তা মোটেই নয়। কিন্তু যেহেতু তিনি দৃতকর্মে নিযুক্ত, অতএব ধৃতরাষ্ট্রের কথার পিছনেই তাঁকে লেগে থাকতে হবে এবং তিনি তা ছিলেনও। শেষে সঞ্জয় বিদায় চেয়েছেন এবং এই বিদায়-বৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের কথার মাত্রা পরিবর্তিত হয়েছে। সঞ্জয়ের মাধ্যমে তিনি সকলকে, হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির সকলকে কুশল জানাচ্ছেন।

এই কুশল-পৃচ্ছার মধ্যে এমনই এক সর্বব্যাপিনী দৃষ্টি ছিল, যাতে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বা কুরুবৃদ্ধগণই শুধু নন, হস্তিনাপুরবাসী ব্রাহ্মণ-ভিক্ষু-তপস্বীরাই শুধু নন, এমনকী তাঁর কাছে মন্দ হওয়া সত্ত্বেও দুর্যোধন-দুঃশাসনও তাঁর কুশল-জিজ্ঞাসার অন্তর থেকে বাদ যাননি। একদিকে কুরুসভার দৌবারিক-গাণনিক ইত্যাদি ব্যক্তিরা যেমন যুধিষ্ঠিরের শুভেচ্ছা লাভ করেছেন সঞ্জয়ের মাধ্যমে, তেমনই শুভেচ্ছা পেয়েছেন কুরুবাড়ির মাতৃস্থানীয়ারা, রাজকন্যারা বা বধূরা। ভারী আশ্চর্য হস্তিনাপুরের দাস-দাসীদেরও ভোলেননি যুধিষ্ঠির, ভোলেননি, অন্ধ-কুব্জ-খঞ্জদের, ভোলেননি সমাজের নিন্দিত ভোগপ্রিয় বেশ্যাদেরও পর্যন্ত। তাঁদেরও কুশল বার্তা পাঠিয়েছেন যুধিষ্ঠির।

কিন্তু সকলের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়েও শেষে যুধিষ্ঠির বলেছেন—দুর্যোধন যে সমস্ত রাজাদের স্বপক্ষে পেয়েছেন আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য, তাঁদের মতো বীরযোদ্ধা পৃথিবীতে নেই—ন হীদৃশাঃ সন্তি অপরে পৃথিব্যাম্—কিন্তু শত্রু বিজয়ের জন্য আমার কাছে ধর্মই হল সবচেয়ে বড় শক্তি—মম ধর্ম এব মহাবলঃ শত্রুনিবৰ্হনায়। তবে হ্যাঁ সঞ্জয়! আমি এতক্ষণ ধরে যা বলেছি, তা শুধু ধৃতরাষ্ট্রকেই নয়, তুমি দুর্যোধনকেও শোনাবে। আর এটাও তাকে বলবে—যে, তোমার যেটা ভাল লাগছে, সেটাই সব সময় আমরা করে যাব না—নৈবং বিধাস্যাম যথা প্রিয়ং তে। হয় আমাদের পৈতৃক প্রাপ্য-অংশ আমাদের দিয়ে দাও, নয়তো যুদ্ধ কর—দদস্ব বা শত্ৰুপুরীং মমৈব যুধ্যস্ব বা ভারতমুখ্য বীর।

‘আমরা যুদ্ধ করব, দরকার হলে যুদ্ধ করব’—এমন কথা আমরা যুধিষ্ঠিরের মুখে একবারও শুনিনি। কিন্তু এখন তিনি মত প্রকাশ করছেন দৃঢ়ভাবে, বক্তব্য পেশ করছেন সুস্পষ্টভাবে। এখনও তিনি সঞ্জয়ের মাধ্যমে কুরুবৃদ্ধদের কাছে অনুনয় করে বলছেন—আমরা যুদ্ধ চাই না—অযুদ্ধং সৌম্য ভাষস্ব হিতকামে যুধিষ্ঠিরে—অথবা ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি এখনও জানাচ্ছেন—আমরা একসঙ্গেই বাঁচতে চাই, আপনি শত্রুদের কথা শুনবেন না—তাত সংহত্য জীবামো দ্বিষতাং মা বশং গমঃ—কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এটাও বলছেন—আমরা অনেক সহ্য করেছি, আর কিন্তু নয়। বনবাসের দিনগুলিতে আমরা যে কষ্ট সহ্য করেছি, তা আমরা মনে রাখিনি অথবা আমাদের বেশি শক্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা তার প্রতিবিধান আচরণ করিনি। কুরুবাড়ির সব মানুষেরাই এ-কথা মানবেন—বলীয়াংসো’পি সন্তো যৎ তৎ সর্বং কুরবো বিদুঃ। যুধিষ্ঠির স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—কৃষ্ণা-দ্রৌপদীকে রাজসভায় এনে যেভাবে তাঁকে অপমান করা হয়েছিল, তাতে জননী কুন্তীর অতিক্রমটুকুও দুর্যোধন-দুঃশাসনরা মনে রাখেনি, কিন্তু সে সব অন্যায়ও আমরা উপেক্ষা করতে পারি, কিন্তু এখন আর কোনও কথাই শুনব না। এখন আমাদের রাজ্যভাগ আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে—যথোচিতং স্বকং ভাগং লভেমহি পরন্তপ। আমরা পাঁচ ভাইয়ের জন্য পাঁচটি গ্রাম অন্তত চাই। তাতেই শান্তি আসতে পারে, নচেৎ নয়।

যাঁরা যুধিষ্ঠিরকে খুব দুর্বল বলে ভাবেন, তাঁদের এই সব জায়গাগুলি স্মরণ করতে বলি। কোনও সন্দেহ নেই যে, তৎকালীন সদোত্থায়ী ক্ষত্রিয়-রাজাদের নিরিখে যুধিষ্ঠির একেবারেই অন্যরকম। মহাভারতেই যেখানে তিনি ভীষ্মের কাছে রাজনীতির উপদেশ শুনেছেন এবং সেই উপদেশের মধ্যে যখনই রাজনীতির কূট বর্ণিত হয়েছে, তখনই অত্যন্ত বিব্রত হয়েছেন যুধিষ্ঠির। মহামতি ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে ‘অর্থ-বিনিশ্চয়’ নামে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় জুড়ে রাজনীতির মনস্তত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন। ভীষ্ম বলেছিলেন—রাজনীতিতে দয়া, মায়া, স্নেহের কোনও স্থান নেই। শুধু তাই নয়—রাজ্যলাভ এবং ধনলাভের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে তথাকথিত ন্যায়-নীতির ভাবনাটা এতই দূরে রাখতে হয় যে, হৃদয়হীনতা বা নৃশংসতাই সেখানে প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়াবে।

ভীষ্মের কথা শুনে যুধিষ্ঠির আঁতকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন—এ সব আপনি কী শোনালেন পিতামহ! এ তো অধর্মটাই ধর্ম হয়ে গেল, আর ধর্ম হয়ে গেল অধর্ম—অধর্মে ধর্মাং নীতে ধর্মে চাধর্মতাং গতে। আপনি যা বলছেন, তা তো মোটেই ভাল কথা নয়। রাজাদের যা করা উচিত বলে আপনি বলছেন, সে তো প্রায় দস্যুর মতো ব্যবহার এবং এই ব্যবহার আমরা বর্জন করতে চাই। আপনার মুখে এই সব নৃশংসতার ঔচিত্য শুনে আমার তো মূর্ছা যাবার জোগাড় হল আর আমার এতকালের ধর্ম-কর্ম সব তো চুলোয় গেল—সংমুহ্যামি বিষীদামি ধর্মো মে শিথিলীকৃতঃ।

সত্যি কথা বলতে কি, বাস্তবে এই হল যুধিষ্ঠিরের চরিত্র। দয়া-মায়াহীন কূট নৃশংস রাজনীতি তাঁর চরিত্রে নেই। হতে পারে, সেই অর্থে উত্থানশক্তিসম্পন্ন কোনও রাজার গুণই তাঁর মধ্যে নেই। কিন্তু তবুও তাঁকে দুর্বল বলা আমাদের পক্ষে খুব কঠিন। আপনিই ভাবুন—যেখানে পাঞ্চালী-কৃষ্ণার অপমান ঘটছিল, সেখানে একটি বিশাল সভাস্তম্ভ ভেঙে নিয়ে ভীমের পক্ষে দুর্যোধন-দুঃশাসনের মাথায় বাড়ি মারাটাই ছিল সোজা এবং স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে চুপ করে বসে যুধিষ্ঠিরের মতো সহ্য করাটাই সবচেয়ে কঠিন এবং অস্বাভাবিক, এবং অন্যের পক্ষে সেটা অস্বাভাবিক বলেই যুধিষ্ঠিরের পক্ষে সেটা স্বাভাবিক। ভীম-দ্রৌপদী বনবাস-কালে বহুবার যুধিষ্ঠিরকে প্ররোচনা দিয়ে বলেছেন—ওরা যখন আমাদের সঙ্গে কপট আচরণ করেছে, তখন আমরাই বা বনবাসের সত্য ভেঙে ওদের সঙ্গে শঠতা করব না কেন। শঠের সঙ্গে শঠ আচরণ করাই রাজনীতি।

কিন্তু রাজনীতি হলেও সেটা যৌধিষ্ঠিরী নীতি নয়। তাঁর জোর রাজনীতি নয়, ধর্মনীতি। আমার দুঃখ হয়, যে মহত্তম ব্যক্তিটি—‘রেজিস্ট নট ইভিল’ বলে দুনিয়া মাতালেন, তিনি একবার যুধিষ্ঠিরকে দেখলেন না। দেখলে বুঝতেন—রাজা এবং রাজনীতির সর্বাঙ্গীন পরিবেশের মধ্যে তিনি শুধু অপেক্ষা করে গেছেন—শত্রুকেও কতটা ক্ষমা করা যায়। দ্রৌপদীকে তিনি বুঝিয়েছিলেন—ক্ষমাই আমার একমাত্র শক্তি। দ্রৌপদী বোঝেননি, বুঝতে চাননি। কিন্তু আজকে তাঁর বনবাস-মলিন ক্লান্ত দিবসগুলির শেষে আবারও যখন ধৃতরাষ্ট্রের মুখে শান্তির মৌখিকতা শুনতে হচ্ছে যুধিষ্ঠিরকে, তখনই তিনি দৃঢ় হয়ে উঠছেন। ধৃতরাষ্ট্র এতটুকু রাজ্য ছেড়ে দেবেন না, দুর্বিনীত পুত্রকে তিনি এখনও সুরক্ষিত রেখে মুখে শান্তির কথা বলছেন—এ তো পরম অধর্ম। ন্যায়-নীতির এই অতিলঙ্ঘন যুধিষ্ঠিরকে আজ আপন প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় করে তুলেছে। এখন তিনি যে ক্ষমা অতিক্রম করে যুদ্ধের কথা বলছেন, তার কারণ অসাম-ক্ষমার শেষ প্রান্তে আছে দণ্ড, সেই দণ্ডই এখন ধর্ম হয়ে উঠেছে। আর দণ্ড ধর্মে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যুধিষ্ঠির তাঁর আপন ধর্মে দৃঢ় হয়ে উঠেছেন। তিনি দুর্বল নন! যেখানে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মনীতির সঙ্গতি ঘটবে, সেখানে তিনি একটুও দুর্বল নন, পরম শক্তিমান। তিনি তখন সঞ্জয়কে বলেন—আমরা শান্তির জন্য যতটা সমর্থ যুদ্ধের জন্যও ততটাই। আমরা মৃদুতার ক্ষেত্রে যতখানি সমর্থ, দারুণ নৃশংসতার ক্ষেত্রেও ততটাই—

অলমেব শমায়াস্মি তথা যুদ্ধায় সঞ্জয়।

ধর্মার্থয়োরলঞ্চাহং মৃদবে দারুণায় চ ॥

তুমি প্রস্থান কর সঞ্জয়। আশা করি কুরু-পাণ্ডবদের আবারও অক্ষত অবস্থায় দেখতে পাব।

সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরের সমস্ত বার্তা বহন করে নিয়ে এসেছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। কিন্তু যুধিষ্ঠির ভালই জানতেন যে, ধৃতরাষ্ট্র একটা কথাও শুনবেন না। এই বৃদ্ধের প্রতি তিনি করুণা করতেন। পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সব বুঝেশুনেও যে শেষ পর্যন্ত পুত্রের স্বার্থ দেখবেন—এই গ্রাম্য মনোবৃত্তির প্রতি যুধিষ্ঠিরের করুণা ছিল। যার জন্য সঞ্জয়ের মুখে ধৃতরাষ্ট্রের কথা শুনে তিনি নরমে-গরমে যা কিছুই বলুন, কৃষ্ণ যখন কৌরবসভায় শান্তির দূত হয়ে যাচ্ছেন, তখনই কিন্তু যুধিষ্ঠির তাঁর আপন-স্বরূপে ফিরে এসেছেন। কৃষ্ণের কাছে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের মনোগত ইচ্ছাটুকু ব্যক্ত করে বলেছেন—বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র তো আর আমাদের প্রতি সম আচরণ করবেন না। তিনি নিজেও লোভী, মনেও তাঁর পাপ আছে। তিনি চাইছেন—রাজ্যও দেব না, অথচ শান্তি হোক, যুদ্ধ-বিগ্রহে আপন পুত্রের পাছে ক্ষতি হয়—অপ্রদানেন রাজ্যস্য শান্তিমস্মাসু মার্গতি।

যুধিষ্ঠির দুঃখ করে বলেছেন—দুর্যোধনের সব কথা শুনেই লুব্ধ বৃদ্ধ আত্মীয়দের প্রতি অসদাচরণ করছেন। নইলে কত সামান্য একটা রাজ্যাংশ চেয়েছি বলো। কিন্তু দুষ্টমতি দুর্যোধন তাও দেবে না। সে ভাবছে সমস্ত রাজ্যখণ্ডের ওপর একমাত্র তারই অধিকার—ন চ তানপি দুষ্টাত্মা ধার্তরাষ্ট্ৰো’নুমন্যতে। কিন্তু আমাদের অবস্থাটাও তো দেখছ? ধন-সম্পত্তি অনেক লাভ করেও আমরা হারিয়েছি, দুঃখ-কষ্টও অনেক গেছে। কিন্তু দিনের পর দিন এই নির্ধনতা আর সইছে না। পত্র-পুষ্প-ফলহীন বৃক্ষে যেমন পাখি এসে বসে না তেমনই আমার নির্ধনতার জন্য আমার জ্ঞাতি-বন্ধুরা, ব্রাহ্মণ-সজ্জনেরা সকলেই আমাকে ত্যাগ করেছে—অপুত্রাদ্ অফলাদ্ বৃক্ষাদ্ যথা কৃষ্ণ পতত্রিনঃ। রাজনীতিজ্ঞ শম্বরাসুর বলেছিলেন—যার আজকের খাবার নেই, কালকে সকালে খাবার পয়সা নেই, তার চেয়ে করুণ অবস্থা কার হতে পারে—যত্র নৈবদ্য ন প্রাতভোজনং প্রতিদৃশ্যতে।

ভারী আশ্চর্যভাবে আমরা এই মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরের মুখে অর্থ বা ধন-সম্পত্তির মাহাত্ম্য শুনে রীতিমতো আলোড়িত হই। যুধিষ্ঠির এই কথা বলছেন—যার ধন নেই, সে মৃত ; যার ধন আছে, তারই জীবন আছে। ধনই পরম ধর্ম, সব কিছু ধনের ওপরেই নির্ভর করে—ধনমাহুঃ পরং ধর্মং ধনে সর্বং প্রতিষ্ঠিতম্।

আমরা জানি—এগুলি যুধিষ্ঠিরের অন্তরের কথা নয়। তাঁর পরম আদরণীয়, চার-চারটি ভাই এতকাল তাঁরই কারণে কষ্ট সহ্য করেছেন, প্রিয়া দ্রৌপদী রাজপুত্রী হয়েও এতকাল তাঁরই অপরাধে বিপর্যস্ত হয়ে আছেন। তার মধ্যে স্বার্থপর স্নেহান্ধ-রাজার পুত্রের কারণে অসভ্যতা যুধিষ্ঠিরকে ব্যথিত করেছে। যুধিষ্ঠির নিজে সদা সন্তুষ্টিতে বিশ্বাসী, কিন্তু ভাই এবং স্ত্রীর কারণে হয়তো তিনি আজ অর্থের প্রাধান্য খ্যাপন করছেন। এমনিতে যে তাঁর কাছে অর্থের কোনও প্রাধান্য নেই, তা আমরা বুঝব সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরে। তখন স্বয়ং অর্জুন অর্থের প্রাধান্য ঘোষণা করে যুধিষ্ঠিরকে রাজা হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির সেই অর্থের প্রাধান্য মানেননি। তিনি তখন অর্জুনকে খণ্ডন করেছিলেন ধর্মের প্রাধান্য খ্যাপন করে।

বস্তুত এখানেও শেষ পর্যন্ত তাই ঘটেছে। অর্থের মাহাত্ম্য ঈষৎ ঘোষণা করেই তিনি ধর্মের পরিধিতে ফিরে এসেছেন, ঠিক যেমন একটু আগেই সঞ্জয়ের কাছে যুদ্ধের সপক্ষে কথা বলেও তিনি আবারও যুদ্ধ-হিংসা-বর্জিত এক সুন্দর শান্ত জগতে উত্তরণ করছেন। কৃষ্ণকে তিনি বলছেন—দেখ কৃষ্ণ! আমাদের প্রথম বিকল্প হল যাতে আমরা কোনও উত্তেজনার মধ্যে না গিয়ে শান্তি লাভ করতে পারি, দুই পক্ষ সমানভাবে রাজসুখ ভাগ করে নিতে পারি—প্রশান্তাঃ সমভূতাশ্চ শ্রিয়ং তামশ্নুবীমহি। কিন্তু এখানে চরম পথটা হল কৌরবদের হত্যা করে রাজ্য লাভ করা। কিন্তু সেখানে আমাদের সঙ্গে যাদের কোনও সম্বন্ধ নেই তাঁদের বধ করা যেমন অন্যায় হবে, তেমনই অন্যায় হবে আমাদের গুরুজন এবং জ্ঞাতিদের বধ। সত্যি কথা বলতে কি যুদ্ধের মধ্যে কিছুই ভাল নেই—কিন্নু যুদ্ধে’স্তি শোভনম্।

যুদ্ধ-বিগ্রহ যুধিষ্ঠিরের কাছে এতটাই বিরক্তিকর ছিল যে, তিনি সামাজিক-সংস্কার ক্ষত্রিয়-সংস্কারের উর্ধ্বে উঠে যুদ্ধের নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন—আমাদের এই ক্ষত্রিয়-জাতির স্বধর্মটাই পাপ করা। জলের মধ্যে বড় মাছ যেমন ছোট মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে তেমনই ক্ষত্রিয়রাও অন্য দুর্বলতর ক্ষত্রিয়দের মেরে জীবন ধারণ করে—ক্ষত্রিয়ঃ ক্ষত্রিয়ং হন্তি মৎস্যো মৎস্যেন জীবতি। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে একান্ত আপন মত বোঝাচ্ছেন—এই দেখ না, যুদ্ধ লাগলে একজন মাত্র কৌশলী যুদ্ধবীর বহু লোককে মারছে, আবার কখনও বা বহুজনে মিলে একজনকে। একজন মহাবীর একটা কাপুরুষকে হত্যা করছে কখনও, কখনও বা এক সাধারণ যোদ্ধা অসামান্য এক যুদ্ধবীরকে মেরে ফেলছে—সুশুরঃ কাপুরুষং হন্তি অযশস্বী যশস্বিনম্।

যুদ্ধে সবটাই খারাপ। নিজের পক্ষের কোনও ক্ষতি হল না আর শত্রুপক্ষের সবটাই লোকসান—এমনটা হয় না। অতএব যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের নিটফল একটাই—ক্ষতি। আর যদি বা কোনওরকমে জয় এল, তা হলেও রাজকোষের অপচয় হবে সাংঘাতিক—যস্য স্যাদ বিজয়ঃ কৃষ্ণ তস্যাপ্যপচয়ো ধ্রুবম। যুদ্ধের এত দোষ কিন্তু সবার মুখ চেয়ে যুধিষ্ঠির এও বলতে পারছেন না যে, তাঁর এতটুকু লোভ নেই রাজ্যপাটে। এ যেন ভগবদগীতার সেই স্বধর্মপালন! নিরাসক্ত বিষয়-ভোগ। ক্ষত্রিয়ের পূর্বনির্দিষ্ট স্বধর্ম পালন করার জন্য তিনি রাজ্য-সম্পদ চান বটে কিন্তু তার জন্য কুলক্ষয় এবং মানুষের ক্ষতি তিনি চান না—ন চ ত্যক্তুং তদিচ্ছামো ন চেচ্ছামঃ কুলক্ষয়ম্। যুদ্ধ বন্ধ করার সমস্ত উপায় ব্যর্থ হলে যে যুদ্ধই হবে—এটা যুধিষ্ঠির জানেন, কিন্তু যুদ্ধ করাটা আসলে যে এক ধরনের পশুবৃত্তি সেটাও যুধিষ্ঠির জানেন।

যুদ্ধের মূল চেহারাটা দেখিয়ে যুধিষ্ঠির বলেছেন—জান কৃষ্ণ! এ হল কুকুরের মতো। বিশেষত এখন ধৃতরাষ্ট্র-দূর্যোধনের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের যে ধরনের কথাবার্তা, ভাব-বিনিময় চলছে তার সঙ্গে দুটি কুকুরের ঝগড়ার কোনও পার্থক্য নেই—তচ্ছুনামিব সম্পাতে পণ্ডিতৈরুপলক্ষিতম্। তিনি বলেছেন—কৃষ্ণ দেখ, দুটি কুকুর যখন ঝগড়া করে তখন প্রথমে দুটোই ল্যাজ উঁচিয়ে আসে, তারপর বিকৃত শব্দে পরস্পরের ছিদ্র অন্বেষণ করতে থাকে। সেই বিকৃত চিৎকারেই দুজনে দুজনের নিন্দা এবং নিজের প্রশংসা গাইতে থাকে। তারপর মাটিতে গড়াগড়ি, দন্ত-প্রদর্শনী, পুনরায় চিৎকার এবং তারপরেই ভীষণ যুদ্ধ—দন্তদর্শনমারাবস্ততো যুদ্ধং প্রবর্ততে। যুধিষ্ঠির বলেছেন—শেষ পর্যন্ত যে কুকুর বেশি বলিষ্ঠ, সেই তো জিতে যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই যুদ্ধ কালে মানুষের সঙ্গে কুকুরের কোনও তফাত রইল না—এবমেব মনুষ্যেষু বিশেষো নাস্তি কত্থন।

যুধিষ্ঠির যুদ্ধের ভাবনায় ক্লিষ্ট হন বলেই খুব সুন্দর তিনটি বিকল্পের কথা জিজ্ঞাসা করলেন কৃষ্ণকে। বললেন—আমরা উদাসীন থাকতে পারি, কিন্তু তাতে রাজ্য লাভ অসম্ভব। আমরা যুদ্ধ করতে পারি, কিন্তু তাতে আমাদেরও কুলক্ষয় ঘটবে। আর আমরা প্রণিপাত-বৃত্তি অবলম্বন করতে পারি, কিন্তু তাতেও কোনও লাভ নেই। কারণ পুত্র-স্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র আমাদের প্রণিপাত-বৃত্তিকে উপহাস করবেন এবং আমাদের দুর্বল ভাববেন—স পুত্রবশমাপন্নঃ প্রণিপাতং প্রহাস্যতি। অথচ ধৃতরাষ্ট্র আমাদের পিতার সমান, তিনি আমাদের পরম মাননীয় পূজ্য ব্যক্তি। এই রকম এক সংকটে আমাদের ধর্মও বজায় থাকে অথচ ঐহিক লাভও সম্পন্ন হয়—এমনটা যে কী করে হবে, কৃষ্ণ! সে শুধু তুমিই জান! তুমি ছাড়া আর আমাদের কেইই বা আছে বল—কো হি কৃষ্ণাস্তি নস্তাদৃক্ সর্বনিশ্চয়বিৎ সুহৃৎ।

‘ধর্মও বজায় থাকে অথচ ঐহিক লাভও ঘটবে’– এরকম একটা কথা ভীষণ রকমের ‘প্যারাডক্সিক্যাল’ মনে হতে পারে কিন্তু ভারতবর্ষের এই হল সমাজদর্শন। আমাদের চতুর্বর্গের প্রথম বর্গটি হল ধর্ম এবং এই ধর্মকে অর্থের সঙ্গেও লাগাতে হবে, কামের সঙ্গেও লাগাতে হবে। যে কোনও উপায়ে অর্থ-সম্পত্তি লাভ করছি, তা হবে না। ধর্ম অতিক্রম না করে আপন সমৃদ্ধি ঘটাতে হবে। কাম মানেই যথেচ্ছ ইন্দ্রিয়-চরিতার্থতা নয়। বিবাহের মাধ্যমে, পুত্রোৎপত্তির মাধ্যমে কামনাকে নিয়ন্ত্রিত করে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করাটাই ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য। যুধিষ্ঠির ধর্মের প্রতীক, এই পরম অদ্ভুত সঙ্কটে তিনি বিব্রত বোধ করছেন। কেমন করে ধর্মও থাকে অথচ অর্থ-সমৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য তিনি বিশেষ চিন্তিত—কথমর্থাচ্চ ধর্মাচ্চ ন হীয়েমহি মাধব।

অন্য দিকে আরও একটা ব্যাপার এখানে লক্ষণীয়। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের কাছে আত্ম-সমর্পণ করছেন। ভবিষ্যতে ভগবদগীতায় যে উপদেশ দেওয়া হবে—তুমি সমস্ত ধর্মত্যাগ করে আমার শরণ নাও, অর্জুন—এ উপদেশ অর্জুনকে দেওয়া হবে, কিন্তু যুধিষ্ঠির তা পূর্বাহ্নেই জানেন। পিতা-প্রতিম ধৃতরাষ্ট্রের কাছে রাজ্য যাচনা করে প্রত্যাখ্যাত হলে যুদ্ধের মাধ্যমে যে ধর্ম-সঙ্কট উপস্থিত হচ্ছে তার থেকে রেহাই পেতে হলে যে সর্বধর্ম ত্যাগ করে পরমেশ্বর-প্রতিম একজনের শরণ নেওয়া দরকার সে-কথা বুঝেই যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বলেছেন—এই রকম সঙ্কটে একমাত্র পুরুষোত্তম তুমি ছাড়া আমার আর কোনও গতি নেই। কারণ তুমি আমাদের প্রিয়, তুমি আমাদের প্রিয় কামনা কর এবং সমস্ত বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত, তাও তুমিই জান—প্রিয়শ্চ প্রিয়কামশ্চ গতিজ্ঞঃ সর্বকর্মণাম্।

কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর প্রিয়ত্বের সম্বন্ধ আবার এতটাই যে, যুধিষ্ঠির তাঁকে পরম পুরুষোত্তম জেনেও শত্রু-শিবিরে একা যেতে দিতে চান না। এমনই তাঁর মমতা যে, তিনি ভাবনা করছেন—একা কৃষ্ণকে পেয়ে দুর্যোধনরা যদি তাঁর ক্ষতি-সাধনে প্রবৃত্ত হন। যুধিষ্ঠির বলেছেন—না কৃষ্ণ! এটা আমার মোটেই ভাল লাগছে না। তুমি যত ভাল কথাই বলো, দুর্যোধন কিন্তু শুনবে না—দুর্যোধনঃ সূক্তমপি ন করিষ্যতি তে বচঃ। তার মধ্যে এখন তার স্বপক্ষীয় রাজারা তাকে ঘিরে রয়েছে। দুর্যোধন যা বলবে, তারা তাই করবে। তাদের সবার মাঝখানে তোমাকে একা ছেড়ে দিতে আমার মন মানছে না—তেষাং মধ্যাবতরণং তব কৃষ্ণ ন রোচয়ে।

কৃষ্ণের জন্য যুধিষ্ঠিরের এই প্রিয়ত্ব-মমত্বের মধ্যেও তাঁর তীক্ষ্ণ অনুমান-শক্তি কত নির্ভুল ছিল, তা আমরা দুর্যোধনের পরবর্তী আচরণে বুঝতে পারি। কৃষ্ণের শান্তির দৌত্য বিফলে যাবার পর দুর্যোধন যে তাঁকে বন্দি করবার অপচেষ্টা করবেন, এটা তাঁর বাবা ধৃতরাষ্ট্রও ভাবতে পারেননি, কিন্তু যুধিষ্ঠির বুঝেছিলেন। কৃষ্ণ ব্যর্থচেষ্ট হয়ে কুন্তীর কাছে ফিরে এসে বলেন—আর কিছুই হবার নয়। মহাকাল এদের গ্রাস করেছে। যাই হোক, আমি এখন পাণ্ডবদের কাছে ফিরে যাব, তোমার শেষ কথা যদি কিছু বলার থাকে তো বলো।

কুন্তী কাউকে প্রথমে কিছু বলেননি, শুধু যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন। একটু কটু ভাবেই বলেছেন যে,—কৃষ্ণ ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরকে বোলো, এতে তার ধর্মই নষ্ট হচ্ছে—ভূয়াংস্তে হীয়তে ধর্ম মা পুত্রক বৃথা কৃথাঃ। কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে তাঁর চিরন্তন কুলধর্ম স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন—ক্ষত্রিয়ের জন্ম পরমেশ্বরের বাহু থেকে এবং বাহুবলেই তাদের জীবিকা চলে। প্রজা-পালনের জন্য যদি ক্রুর কর্মও করতে হয়, তবে সেটাই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম—ক্রুরায় কর্মণে নিত্যং প্রজানাং পরিপালনে। এইভাবে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, রাজধর্ম এবং আপন পিতৃ-পিতামহের কুলধর্ম স্মরণ করিয়ে দিয়ে কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধ করে রাজ্য উদ্ধার করার পরামর্শ দিয়েছেন। একেবারে শেষে ক্ষত্রিয়াণী বিদুলার উপাখ্যান বর্ণনা করে কুন্তী বোঝাতে চেয়েছেন—এতে যদি তাঁর পুত্রের জীবন-নাশ ঘটে তাও ভাল, কিন্তু একজন ক্ষত্রিয়-ঘরের জাতক যুদ্ধ না করে ব্রাহ্মণের ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করুক—এটা কুন্তী চান না।

যুদ্ধের প্রতি হাজারো বিতৃষ্ণা নিয়েও যুধিষ্ঠিরও এখন আপন কুলধর্ম ক্ষত্রিয়-বৃত্তিতে পুনরাবর্তন করছেন। কৃষ্ণের কথা শুনে, ভীষ্ম বিদুরের কথা শুনে এবং জননী কুন্তীর কথা শুনে এখন তিনি রাজধর্মে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। কারণ আর অন্য কোনও উপায় তাঁর সামনে খোলা নেই। ভীম-অর্জুনকে তিনি বলেছেন—যা ঠেকানোর জন্য এই কষ্টকর বনবাস গ্রহণ করলাম, আজ তাই এসে উপস্থিত হল। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, অবশ্য দেখছি—চেষ্টা না করলেও যা হবার তাই হত—সেই যুদ্ধ করতেই হবে—যাদের বধ করা উচিত নয়, সেই সব নিরীহ মানুষকে মারতে হবে, মান্য গুরুজনদের হত্যা করতে হবে। কী অদ্ভুত এই বিবাদ—উপাবৃত্তঃ কলির্মহান্। অর্জুন এবং কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের এই বিষণ্ণ কথার কোনও প্রতিবাদ করতে পারলেন না। কিন্তু নিঃশব্দে তাঁরা এও বুঝিয়ে দিলেন যে, অবস্থার প্রয়োজনে যুদ্ধ তাঁদের করতেই হবে। অগত্যা যুধিষ্ঠির এই যুদ্ধবাদ মেনে নিলেন বৃহত্তর স্বার্থে, মেনে নিলেন কৃষ্ণের হাতে সমস্ত ভার সমর্পণ করে।

আরও একবার সেই ধর্মকথার তাৎপর্যটুকু এখানে বুঝে নেওয়া দরকার। লক্ষ করে দেখুন—এই যুদ্ধোদ্যোগের পর ভীষ্মের সেনাপতিত্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হবে এবং সেখানে অর্জুনের বৈক্লব্য দেখে পরম ঈশ্বর নামে প্রথিত ব্যক্তিটি অর্জুনকে গীতার উপদেশ করবেন। আশ্চর্য হল সারা জীবন যিনি ধর্ম-ধর্ম করে এসেছেন, সেই যুধিষ্ঠির কিন্তু এই উপদেশের আধার হলেন না। হলেন অর্জুন। আগেই এর সমাধান বলেছি। গীতার সমস্ত উপদেশ দিয়ে কৃষ্ণ অর্জুনকে যে যোগভূমিতে পৌঁছাতে চাইছেন, যুধিষ্ঠির পূর্বাহ্নেই সেখানে আরূঢ়। নিরাসক্ত কর্ম করা থেকে সর্ব-কর্মফল-ত্যাগ, এমনকী সমস্ত ধর্মত্যাগ করে যে ঈশ্বরের শরণাগতি—গীতার এই চরম এবং পরম উপদেশ পূর্বাহ্নেই যুধিষ্ঠিরের আত্মস্থ। রাজার সিংহাসনেও তাঁর লোভ নেই, বনবাসেও কোনও কষ্ট নেই তাঁর। ইন্দ্রপ্রস্থের সিংহাসনে বসেও তাঁর কোনও স্ফীতি ঘটেনি আবার বনবাসের মালিন্যও তাঁকে স্পর্শ করে না। শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও তিনি তাঁকে ছেড়ে দেন, চরমভাবে অপমানিত হয়েও শত্রুপক্ষের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গেও তাঁর সম-দুঃখভাব বিচলিত হয় না। ভগবদগীতোক্ত উপদেশের এমন ফলিত উদাহরণ যুধিষ্ঠির ছাড়া আর কেই বা হতে পারেন। আর ঠিক এতটাই নির্দ্ধন্ধ নিত্যসত্ত্বস্থ বলেই তিনি স্থিতধী, তিনি যুধিষ্ঠির।

যাই হোক, দার্শনিক যুধিষ্ঠিরের অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ শুরু হল এবং ওই আঠেরো দিনের যুদ্ধপর্ব যুধিষ্ঠিরকে একেবারে অস্থির করে দিল। আর এইটুকু সময়ের মধ্যে কত দুঃখজনক কাজই না তাঁকে করতে হয়েছে। মানবিকতার কত সঙ্কট, কত ধর্ম-সঙ্কট এই যুদ্ধকালেই তৈরি হয়েছে, তা শুধু যুধিষ্ঠিরই জানেন। যুধিষ্ঠিরের মনে আছে সেই নবম দিনটির কথা, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নবম দিন শেষ হয়েছে। সন্ধ্যার শেষ আলোটুকু মুছে যাবার পর পাণ্ডবশিবিরে যুধিষ্ঠিরের ঘরে রীতিমতো এক সভা বসে গেছে। পাঞ্চালরা, বৃষ্ণিরা সকলে পাণ্ডবদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। রাত্রি বাড়ছে—ততো রাত্রিঃ সমভবৎ সর্বভূতপ্রমোহিনী।

সমবেত সেনা-প্রধানেরা ভীষ্মের আক্রমণে পর্যুদস্ত, ব্যতিব্যস্ত। নয় দিনের যুদ্ধে কত নিরীহ সৈন্য ভীষ্মের হাতে প্রাণ দিয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। মর্মাহত রণক্লান্ত যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন—আর নয় কৃষ্ণ! নল-খাগড়ার বনে হাতি ঢুকলে যেমন মটাস মটাস করে সব ভেঙে যায় আমার সৈন্যদের সেই অবস্থা হয়েছে কৃষ্ণ। ইন্দ্র-বরুণকেও বোধহয় যুদ্ধে হারানো সম্ভব কিন্তু ভীষ্মকে নয়। আমার বুদ্ধি কত কম যে, আগে বুঝিনি, রণক্ষেত্রে আমাদের ভীষ্মের সম্মুখীন হতে হবে। আর সেইজন্যই আমার আজ এই করুণ অবস্থা। অতএব আর নয়, কৃষ্ণ! আমার পক্ষে আবারও বনে যাওয়াই ভাল—শ্রেয়ো মে তত্র বৈ গতম্। আমি আর যুদ্ধ করতে চাই না। ভীষ্মের বাণের সামনে আমার সৈন্যদের দেখে মনে হচ্ছে যেন আগুনে পিঁপড়ে পড়ছে। আমার ভাইরা তাঁর অস্ত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত। এ সবই আমার দোষ। আমার দোষেই আমার ভাইদের বনবাসের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, আমার দোষেই পাঞ্চালী কৃষ্ণার ওই অপমান। আর এই ভীষ্মের সাংঘাতিক কাণ্ড দেখে এখন আমার মনে হচ্ছে—বেঁচে থাকাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। যদি বাঁচি তবে শেষ জীবনটুকু ধর্ম আচরণ করে কাটাব—জীবিতস্যাদ্য শেষেণ চরিষ্যে ধর্মমুত্তমম্।

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের উদ্বেগ এবং আবেগ দুই বুঝলেন, তাঁকে সান্ত্বনাও দিলেন অনেক। এমনও বললেন যে, প্রয়োজনে তিনি পূর্ব-প্রতিজ্ঞা মিথ্যা করে অস্ত্র ধারণ করবেন ভীষ্মের বিরুদ্ধে। যুধিষ্ঠির বললেন—না কৃষ্ণ! আমাদের জন্য তুমি মিথ্যাপ্রতিজ্ঞ হও, এ আমি চাই না। বরঞ্চ আমরা ভীষ্মের কাছেই যাই। তিনি এক সময়ে বলেছিলেন—আমি দুর্যোধনের হয়ে যুদ্ধ করব বটে কিন্তু তোমাকে সৎপরামর্শ দেব সব সময়। কিন্তু দুঃখটা কোথায় জান, কৃষ্ণ! আমার বাবার বাবা ঠাকুরদাদাকে আমরা মারতে চাইছি, ক্ষত্রিয়-রাজার স্বধর্মটা কতটা ন্যক্কারজনক, আন্দাজ করতে পার—পিতুঃ পিতরমিষ্টঞ্চ ধিগস্তু ক্ষত্রজীবিকাম্?

যুধিষ্ঠির ভাইদের সঙ্গে নিয়ে, কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে পিতামহ ভীষ্মের কাছে গেলেন শেষ পর্যন্ত। কিন্তু অসহায় ধর্মজ্ঞ যুধিষ্ঠির যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন—কী করে আপনাকে জয় করব, পিতামহ! কী করেই বা আমরা রাজ্য লাভ করব—তখন কেমন লেগেছিল যুধিষ্ঠিরের। এত কষ্টকর কথা যুধিষ্ঠির কাউকে কোনওদিন বলেনি। তিনি রাজ্য চান না, ঐশ্বর্য চান না, কিন্তু শুধু ক্ষত্রিয়কুলে জন্মেছেন বলে তাঁকে তাঁর পরম-প্রিয় পিতামহের মৃত্যুর উপায় জানতে হচ্ছে পিতামহের কাছেই। তাও কী জন্য? তাঁর একান্ত অনাকাঙ্ক্ষিত অন্যের প্রাণের মূল্যে পাওয়া রাজত্বের জন্য। এমন রাজত্ব যুধিষ্ঠির অন্তত চান না।

দশম দিনের যুদ্ধে ভীষ্ম মারা গেছেন। কিন্তু তাতে যুধিষ্ঠিরের যন্ত্রণা কিছু কমেনি। দ্রোণাচার্যের সেনাপতিত্বের সময়ে তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর মুহূর্তটি নেমে এল—অভিমন্যুর মৃত্যু। যুধিষ্ঠির কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন নিজেকে। তিনি নিজেই যে সেই কৈশোর-গন্ধী নতুন যুবককে যুদ্ধে যেতে প্ররোচিত করেছিলেন। মহামতি দ্রোণাচার্যের চক্রব্যুহের কোনও দ্বার অরক্ষিত নেই। সেই ব্যুহ ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করে শত্রুক্ষয় করতে হবে এবং বেরিয়ে আসতে হবে আপন বুদ্ধিমত্তায়। অর্জুন নিজে অন্যত্র যুদ্ধে ব্যস্ত আছেন। এ দিকে দ্রোণাচার্য চক্রব্যুহ তৈরি করে অবিরাম পাণ্ডব-সৈন্য শাতন করে যাচ্ছেন। যুধিষ্ঠির ভীম সকলে প্রমাদ গণছেন সৈন্য-ক্ষয় দেখে। কিছু একটা করতে হবে।

বেচারা যুধিষ্ঠির! তিনি গুহা-নিহিত ধর্মের তত্ত্বও বুঝি সরলভাবে বোঝেন, কিন্তু যুদ্ধের কিছুই বোঝেন না। অথচ এমনই দুর্দৈব যে, অবস্থার চাপে পড়ে যুধিষ্ঠিরকেই যুদ্ধ-চালনার সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। দ্রোণের অবিরাম আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে—অভিক্রুদ্ধং দ্রোণং মত্বা যুধিষ্ঠিরঃ—পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ অভিমন্যুকে বললেন—অর্জুন এসে যাতে আমাদের গালমন্দ না করে, তুমি সেইরকম একটা কিছু কর, বাছা—এত্য নো নার্জুনো গর্হেৎ যথা তাত তথা কুরু। এই চক্রব্যুহ ভেদ করার শক্তি আমাদের কারও নেই। অর্জুন, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ-পুত্র প্রদ্যুম্ন এবং তুমি—এই চারজন শুধু এই বিশেষ ব্যুহভেদের রহস্য জান। কিন্তু পঞ্চম কোনও ব্যক্তি নেই যে জানে এ সম্বন্ধে। তাই আমি বলছিলাম—বাছা! তুমি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে প্রবেশ কর এই চক্রব্যুহের মধ্যে—ক্ষিপ্রমস্ত্রং সমাদায় দ্রোণানীকং বিশাতয়। নইলে আমাদের এই অক্ষমতা দেখে তোমার পিতা এসে আমাদের দুষবেন, বাছা।

সেই ভয়ঙ্কর বালক-কিশোর জ্যেষ্ঠ-তাতের কথা অমান্য করেননি। শুধু বলেছিলেন—পিতার কাছে আমি চক্রব্যুহে প্রবেশ করবার কৌশলটুকুই শিখেছি, কিন্তু এই ব্যুহ থেকে বেরবার উপায় আমি শিখিনি—নোৎসহে তু বিনির্গন্তুমহং কস্যাঞ্চিদ্ আপদি। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন—তুমি শুধু একবার, প্রবেশ পথটি তৈরি করে দাও—দ্বারং সংজনয়স্ব নঃ—তারপর আমরা তোমার পিছন পিছন ঢুকছি। কথাটার বিশ্বাসযোগ্যতা আরও বেশি হল মহাবলী ভীমের অনুধ্বনিতে। ভীম বললেন—আমি ঠিক তোমার পিছন পিছন—এই চক্রব্যুহের অন্তরে প্রবেশ করব। আর আমার সঙ্গে থাকবেন সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং বৃষ্ণিবীর সাত্যকি—অহং ত্বানুগমিষ্যামি ধৃষ্টদ্যুম্নো’থ সাত্যকিঃ।

নবযুবক অভিমন্যু যে এই সব মহাবীরদের অনুগমনের খুব অপেক্ষা করছিলেন, তা মনে হয় না। কারণ মহাবীরের যুদ্ধ-রোমাঞ্চ তাঁর সমস্ত শরীরে। কোনও বাধাই তাঁর কাছে বাধা নয়। কিন্তু যুধিষ্ঠির যে অনুগমনের কথা দিয়েছিলেন তা যেমন এক দিকে অভিমন্যুর সুরক্ষার কারণে, অন্যদিকে ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং সাত্যকিকে অবিশ্বাস করা যায় না বলেই। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন—তুমি একবার যদি ঢোকার পথটি করে দিতে পার তবে আমরা সব দিক রক্ষা করে তোমার অনুগমন করব—রক্ষন্তঃ সর্বতোমুখাঃ। আর ভীম বলেছিলেন—তুমি যদি একবার চক্রব্যুহের মুখটুকু ভেঙে দাও—সকৃদ্‌ভিন্নং ত্বয়া ব্যুহং—তা হলে অন্যদের আমরা ধ্বংস করে দেব—বয়ং প্রধ্বংসয়িষ্যামো নিঘ্নমানা বরান্‌ বরান্।

আমরা জানি যে, যুধিষ্ঠির-ভীমের ভাবনা সত্যে পরিণত হয়নি দ্রোণাচার্যের ব্যুহ নির্মাণ-কৌশলে এবং জয়দ্রথের পরাক্রমে। সৌভদ্র অভিমন্যু চক্রব্যুহের যে পথ দেখিয়েছিলেন, সে পথ দিয়ে কেউ প্রবেশ করতে পারেনি জয়দ্রথের অমানুষিক বীরত্বে—পান্ডূনাং দর্শিতঃ পন্থাঃ সৈন্ধবেন নিবারিতঃ। অভিমন্যু সপ্তরথীর অন্যায় আঘাতে মৃত্যুবরণ করছেন। মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে আজ আর স্থির রাখা যাচ্ছে না। প্রধানত তাঁরই প্ররোচনায় অভিমন্যু শত্ৰুব্যুহে প্রবেশ করেছেন, এখন তাঁর মৃত্যুর পর যুধিষ্ঠির কী করবেন? কী করে তিনি মুখ দেখাবেন অর্জুনের সামনে, কৃষ্ণের সামনে অথবা সুভদ্রার সামনে। অথচ এঁদেরই মুখ উজ্জ্বল করার জন্য তাঁদেরই প্রিয়-কামনায় তিনি অভিমন্যুকে এই ভীষণ যুদ্ধের মধ্যে পাঠিয়েছিলেন। অথচ তাঁদেরই সবচেয়ে অপ্রিয় ঘটনাটি ঘটে গেল—প্রিয়কামো জয়াকাঙক্ষী কৃতবানিদমপ্রিয়ম্। যুধিষ্ঠির সমস্ত ঘটনার মূলে নিজের লোভকেই দায়ী করছেন এখন। তিনি বলেছেন—মোহ থেকেই এমন লোভের সৃষ্টি হয়, নইলে অভিমন্যুকে যুদ্ধে পাঠানোর দোষটুকু আমি বুঝতে পারলাম না কেন—ন লুব্ধো বুধ্যতে দোষান্ মোহাল্লোভঃ প্রবর্ততে।

যুদ্ধের আগে উদ্যোগপর্বে যুধিষ্ঠির এই ভয়ের কথা উচ্চারণ করেছিলেন। বলেছিলেন—আমি যুদ্ধ চাই না, কৃষ্ণ! একজন কাপুরুষও যুদ্ধের সময় হঠাৎ করে এক মহাবীরকে মেরে ফেলে, অযশস্বী ব্যক্তি হত্যা করে যশস্বী-ব্যক্তিকে। সত্যিই তো এখানেও তাই হল। সপ্তরথী মিলে এক বালককে বধ করল। এবং এর ভবিষ্যত ফল কী হবে যুধিষ্ঠিরই একমাত্র তা আন্দাজ করতে পারেন। তিনি জানেন পুত্রশোকে আর্ত ক্রুদ্ধ অর্জুন পরের দিন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের চষে ফেলবেন এবং ভয়ংকর অনর্থপাত ঘটবে সেই কালে—পার্থঃ পুত্রবধাৎ ক্রুদ্ধঃ কৌরবান্ শোষয়িষ্যতি।

যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা দেবার জন্য স্বয়ং ব্যাস এসেছেন পাণ্ডব-শিবিরে। যুধিষ্ঠিরের মন মানেনি। অর্জুনের কাছে লজ্জা নয়, কৃষ্ণ কিম্বা সুভদ্রার কাছেও নয়। নিজের কাছে নিজেরই যুধিষ্ঠিরের লজ্জা। অর্জুন-বাসুদেবের প্রিয় কামনায় এবং অভিমন্যুর মুখ উজ্জ্বল করার জন্যই যুধিষ্ঠির তাঁকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি যা ভেবেছিলেন, তা হল না। আর সত্যিই তো, কী ছেলেমানুষের মতোই না তিনি ভেবেছিলেন। যুদ্ধবিদ্যার সারাংশটুকুও জানা থাকলে দ্রোণ-কর্ণ-অশ্বত্থামার মতো সাত মহারথ-যোদ্ধার শক্তি-বলয়ের মধ্যে এক বালককে কেউ প্রবেশ করতে অনুরোধ করে না, বিশেষত যে ব্যুহ-নিষ্ক্রমণের উপায় জানে না। তার ওপরে দ্বিতীয় ছেলেমানুষি নিজেদের ওপর ভরসা করা।

কিন্তু অসাধারণ অক্ষাত্রোচিত ছেলেমানুষির জন্যই যুধিষ্ঠির যুধিষ্ঠির। কনিষ্ঠ অর্জুন যুদ্ধের সম্পূর্ণ সময় ধরে ছেলেমানুষের মতোই যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করেছেন। এই যে এত বড় ঘটনাটা ঘটে গেল, এর জন্য তিনি যুধিষ্ঠিরকে একটি কুবাক্যও বলেননি। ভীম এবং অন্যান্য বীরেরা যে ব্যুহ-দ্বারে জয়দ্রথের পরাক্রমে নিরস্ত হয়েছেন, সেজন্য জয়দ্রথ-বধের বীরোচিত প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন অর্জুন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে কিছু বলেননি। একটি শিশুকে যেমন তার পিতা-মাতা সমস্ত বিপন্নতা থেকে আগলে রাখে, অর্জুনও তেমনই এই জ্ঞানবৃদ্ধ শিশু যুধিষ্ঠিরকে চিরকাল সমস্ত অস্ত্রাঘাত থেকে আগলে রেখেছেন। জয়দ্রথকে বধ করতে যাবার আগে নিজের শিষ্য যুযুধান সাত্যকিকে যুধিষ্ঠিরের সুরক্ষার ভার দিয়ে অর্জুন বলেছিলেন—জয়দ্রথকে হত্যা করাটা যেমন আমার সবচেয়ে বড় কাজ, ঠিক তেমনই বড় আরেকটা কাজ হল ধর্মরাজকে রক্ষা করা, তাঁকে বিপন্মুক্ত রাখা—

যথা পরমকং কৃত্যং সৈন্ধবস্য বধো মম।

তথৈব সুমহৎ কৃত্যং ধর্মরাজস্য রক্ষণম্॥

বেচারা যুদ্ধানভিজ্ঞ, ব্রাহ্মণ-স্বভাব যুধিষ্ঠির। সম্পূর্ণ যুদ্ধখণ্ডে তাঁর অবদানও ব্রাহ্মণোচিত এবং সত্যনিষ্ঠ, যদিও সেখানেও তাঁর বিপন্নতা তৈরি হয়েছে যুদ্ধের কারণেই। এই যে একটু আগে ভীষ্মের কাছেই তাঁর মৃত্যুর উপায় জেনে এলেন যুধিষ্ঠির, যুদ্ধ না করতে পারলেও এটাই যুদ্ধে তাঁর অবদান। আবার দ্রোণাচার্যকে যখন কেউই বাগে আনতে পারছেন না, তখনও এই যুধিষ্ঠিরই আবার পাণ্ডব-শিবিরের প্রধান আশ্রয় হয়ে উঠলেন। সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের পক্ষে সে ছিল এক রীতিমতো ধর্ম-সংকট। দ্রোণাচার্যকে যখন কিছুতেই রোখা যাচ্ছে না, তখন কৃষ্ণই এই পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন যে, এই ভয়ংকর মানুষটিকে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ দিতে হবে। কথাটা অর্জুনের কাছেও ভাল ঠেকেনি, যুধিষ্ঠিরও অতি কষ্টে এতে মত দিয়েছেন।

কৃষ্ণের কথা মতো ভীম অশ্বত্থামা নামে একটি হাতিকে মেরে কোনওমতে বাক্যে সত্যতা রক্ষা করে দ্রোণকে বলেছিলেন—অশ্বত্থামা মারা গেছেন। কিন্তু মুহূর্তের জন্য কম্পমান হলেও দ্রোণ ভীমের কথা বিশ্বাস করেননি। তিনি আরও বিপুল পরাক্রমে পাণ্ডবসৈন্য বধ করা আরম্ভ করেছিলেন। পাণ্ডব-পক্ষের যে বিপুল ক্ষয় আরম্ভ হয়েছিল, সে কথা মনে রেখে কৃষ্ণ দ্বিতীয়বার যুধিষ্ঠিরকে অনুরোধ করলেন অশ্বত্থামার মৃত্যু-সংবাদ দ্রোণকে দেবার জন্য। ভীমকে যখন প্রথমবার দ্রোণ-পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ রটনা করতে বলা হয়েছিল, তখন সে ব্যাপারটাই যুধিষ্ঠিরের মোটে ভাল লাগেনি। তিনি অতি কষ্টে কৃষ্ণের কথা মেনে নিয়েছিলেন—কৃচ্ছ্রেণ তু যুধিষ্ঠিরঃ। এখন কৃষ্ণ তাঁকেই বলছেন সেই সংবাদের পুনরাবৃত্তি করতে। কারণ সত্যবাদী যুধিষ্ঠির এই কথা উচ্চারণ করলে দ্রোণ তা বিশ্বাস করবেন।

যুধিষ্ঠিরের কাছে এ এক বিশাল ধর্ম-সংকট। কী করে তিনি এত বড় অন্যায়টা করবেন। কৃষ্ণ বললেন—না বলে উপায় নেই ধর্মরাজ! এই রকম ক্রুদ্ধ হয়ে দ্রোণ যদি আর আধ বেলা যুদ্ধ করেন—যদ্যর্ধদিবসং দ্রোণো যুধ্যতে মন্যুমাস্থিতঃ—তবে নিশ্চিত জেনে রাখুন আপনার পাণ্ডব-সেনার একটি সৈন্যও টিকবে না। অতএব এই সাংঘাতিক বিপদ থেকে সবাইকে রক্ষা করুন আপনি। অন্তত এই মুহূর্তে আপনার ধর্মসম্মত সত্য-রক্ষার চেয়ে মিথ্যাটাই অনেক বেশি শ্রেয়—সত্যাজ্জ্যায়ো’নৃতং বচঃ। মনে রাখবেন এতগুলো লোকের প্রাণ বাঁচানোর জন্য যদি আপনি মিথ্যা কথা বলেন, তবে মিথ্যার দোষ তাতে লাগে না—অমৃতং জীবিতস্যার্থে বদন্ন স্পৃশ্যতে’নৃতৈঃ।

যুধিষ্ঠিরের কাছে এই কথাগুলি খুব পরিচিত নয়। তাঁর কাছে যা অসত্য মনে হচ্ছে, সত্য-জ্ঞানের আধার কৃষ্ণের কাছে তা সত্য নয়। যুধিষ্ঠিরের সত্যের যুক্তি কিছু রুক্ষ-শুষ্ক বটে, তার মধ্যে নমনীয়তার কোনও অবকাশ নেই, কিন্তু কৃষ্ণের কাছে সেই যুক্তি পরিবর্তনীয়, নমনীয়। মহামতি বিমলকৃষ্ণ মতিলাল এই সত্য-যুক্তির পরমার্থতা নিয়ে তাঁর ‘নীতি যুক্তি ও ধর্ম’-এর মধ্যে অসামান্য আলোচনা করেছেন। ‘এথিকস’ এবং ‘মর‍্যালিটি’র প্রসঙ্গও সেখানে সুষ্ঠুভাবে আলোচিত, আমরা তাই সেই তাত্ত্বিক আলোচনা পড়ে নিতে বলছি অনুসন্ধিৎসু পাঠককে। আরও বলছি এই কারণে যে, তাঁর থেকে বেশি কিছু বলার ক্ষমতা আমাদের নেই। এখানে আমরা সেইটুকুই অবশ্য বলব, যা একান্তই যুধিষ্ঠির-সংক্রান্ত।

আমরা জানি—কৃষ্ণের ওপর আস্থা রেখে যুধিষ্ঠির এই অসত্য ভাষণ করেছিলেন সভয়ে এবং অনিচ্ছায় এবং অবশ্যই আপন-পক্ষের জয়ৈষণায়—তমতথ্যভয়ে মগ্নো জয়ে সক্তো যুধিষ্ঠিরঃ। অশ্বত্থামার মিথ্যা-মৃত্যুর সঙ্গে অশ্বত্থামা নামের হস্তীর অনুষঙ্গটুকু যতই সত্যভাষণের ভান তৈরি করুক কিন্তু যুধিষ্ঠির রেহাই পাননি। সারা জীবনের মধ্যে এই এতটুকু সত্য-চ্যুতিতে জীবনের শেষে তাঁকে একবার নরক-দর্শন করতে হয়েছিল—সেটা খুব বড় কথা নয়। কিন্তু ঐহিক চলমান জগতে তিনি যে মর্যাদা নিয়ে চলছিলেন, সেই মর্যাদা তাঁর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আরও একভাবে। মহাভারতের কবি একটি ঘটনার উল্লেখ করে কৃষ্ণের চাইতে যুধিষ্ঠিরের অনমনীয় রুক্ষ-সত্যকেই যেন সমর্থন জানালেন।

কবি লিখেছেন—আগে নাকি সত্যবাদিতার শাশ্বত কারণে যুধিষ্ঠিরের রথ সব সময় মাটি থেকে চার আঙুল ওপর দিয়ে চলত—তস্য পূর্বং রথঃ পৃথ্ব্যাশ্চতুরঙ্গুলমুচ্ছ্রিতঃ। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের এই মিথ্যা-উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সত্যরথ ভূমি স্পর্শ করল—তস্য বাহাঃ স্প্রৃশন্ মহীম্। জানি, বেশ জানি—এই ঘটনায় সত্যশীল যুধিষ্ঠিরের কত কষ্ট হল। যে সত্য রক্ষার মধ্যে তাঁর অহঙ্কার ছিল, তাঁর অনন্যসাধারণত্ব ছিল সেই সত্যের অভিমান-মঞ্চ থেকে নেমে আসতে হল যুধিষ্ঠিরকে। পরম ঈশ্বর বুঝি কোনও অহঙ্কারই সহ্য করেন না, সত্যের অহঙ্কারও নয়। তাঁর চতুরঙ্গুলি-উন্নত অলৌকিক সত্যরথ ভূমি স্পর্শ করে তাঁকে সবার সঙ্গে মিশিয়ে দিল। অলৌকিক দিব্য-আসন থেকে নেমে তাঁকে মনুষ্যোচিত ভূমি স্পর্শ করতে হল বহুজনের জীবনের কারণে। হয়তো মনুষ্যজগতে তারও প্রয়োজন আছে। রুক্ষ সত্যের নীতি জীবনের যুক্তির কাছে পরাজিত—এই সত্যও হয়তো তাঁর উপলব্ধি করার ছিল।

নীতির থেকে যুক্তিই যে এখানে বড় সত্য—সেটা সত্য-চ্যুত যুধিষ্ঠির মনে মনে না মানলেও, সে সত্যও তিনি বুঝতে পারলেন নিজের কারণে। সেখানে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তাঁকে এই যুক্তির ধর্ম শিখিয়ে দিল। আমরা দেখব—যুধিষ্ঠিরের মতো এত ধীর মানুষও কেমন অস্থির হয়ে পড়লেন। কর্ণের পৌনঃপুনিক আক্রমণে। বার বার তিনি পরাজিত হচ্ছিলেন কর্ণের কাছে। বার বার তিনি মার খাচ্ছিলেন। অবস্থা এমন চরমে পৌঁছল যে, অর্জুনের সামান্য অনুপস্থিতিতে ভীম-যুধিষ্ঠির—এই দুই ভাইকে প্রায় নাকাল করে তুলেছেন কর্ণ। ধর্মময় যুধিষ্ঠিরের অবস্থা এখন এমনই যে, শয়নে, স্বপনে, জাগরণে এখন তিনি শুধু দেখেন—ওই কর্ণ আসছেন মারতে, এই তিনি আসছেন যুধিষ্ঠিরকে ধরতে—পশ্যামি তত্র তত্রৈব কর্ময়মিদং জগৎ।

তাঁর এই অপার দুঃখ-ভয় ক্রোধে পরিণত হল এক সময়। একদিন তিনি অর্জুনকে বলেই ফেললেন—তুমি বনবাসের সময় দ্বৈতবনে দাঁড়িয়ে আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলে—কর্ণকে মারব—তার কী হল? আজকে কর্ণের সামনে ভীমকে ফেলে, আমাকে ফেলে তুমি যে পালালে সেটা কি খুব অর্জুনের মতো হল?

যুধিষ্ঠিরের পক্ষে এই মুহূর্তে অর্জুনকে বোঝা সম্ভব ছিল না। তাঁকে সব দিকে তাল রাখতে হয়। যেখানেই ফাঁক, সেখানেই অর্জুনের প্রয়োজন পড়ে। সেদিন দুর্ধর্ষ সংশপ্তকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল অর্জুনকে। কিন্তু যুধিষ্ঠির আর এ সব যুক্তি মানতে নারাজ। অর্জুনকে তিনি কেবলই গালাগালি দিচ্ছেন। এমনও বলছেন—কুন্তীর গর্ভে তাঁর জন্ম নেওয়াটাই বৃথা হয়েছে। আবার এমনও বলছেন—বাপু আগে বললেই পারতে অর্জুন! তখন তো খুব বলেছিলে—আমি এই করব, সেই করব। কিছুই তো পারছ না। ঘটোৎকচ মারা গেল, অভিমন্যু মারা গেল, এখন দেখছি দুর্যোধনই ঠিক বলেছিল—কর্ণের সামনে দাঁড়ানো তোমার কম্মো নয়। আমি মূর্খ বলে দুর্যোধনের কথায় বিশ্বাস করিনি, আর মুর্খের মতোই তোমার ভরসায় পাঞ্চাল-বৃষ্ণি-কেকয় ইত্যাদি রাজাদের ডেকে এনেছি যুদ্ধ করার জন্য। বৃথা সব বৃথা।

ক্ষোভে দুঃখে যুধিষ্ঠির শেষ কথা উচ্চারণ করলেন—কর্ণ তোমাকে একটি তৃণের সমান মনে করে। নইলে বার বার সে আমাকে এইভাবে নাকানি-চোবানি খাওয়াতে পারে—তৃণং চ কৃত্বা সমরে ভবন্তং/ ততো’হমেবং নিকৃতো দুরাত্মনা। যুদ্ধক্ষেত্রের হাল সে এমনভাবেই পরিবর্তন করে দিয়েছে, যাতে আমার মনে হয়েছে—আমার কোনও স্বজন-বান্ধব নেই। আর তুমি যে হাতে একটা সোনার বাটওয়ালা খড়গ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, আর কাঁধে এই গাণ্ডীব ধনু—এ শুধু তোমার অঙ্গশোভামাত্র—গাণ্ডীবং তালমাত্রম্। আমার ইচ্ছে—তোমার গাণ্ডীব-ধনুকখানি কৃষ্ণের হাতে দিয়ে তুমি যদি তাঁর রথের সারথি হতে, তো অনেক ভাল হত। অথবা তুমি যদি সত্যিই কর্ণকে না মারতে পার, তবে যে কাউকে তুমি গাণ্ডীবটি দান করে দাও, যে অন্তত তোমার থেকে বেশি অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী—দেহি-অন্যস্মৈ গাণ্ডীবমেতদদ্য/যো’স্ত্রেধভ্যধিকো নরেন্দ্রঃ। ধিক তোমার গাণ্ডীবকে! ধিক তোমার নিজের নাম লেখা বাণগুলিকে! ধিক তোমার কপিধ্বজ রথকে।

প্রক্ষেপবাদী পণ্ডিত-সজ্জনেরা যদি বলতেন—এই অংশটুকু মূল মহাভারতের কবির লেখা নয়, কারণ সমগ্র মহাভারতের মধ্যে কখনও যুধিষ্ঠিরকে এমন রাগ করতে দেখা যায়নি, কখনও তাঁকে এমনতর কটু কথা বলতে শোনা যায়নি, তা হলে আমাদের মতো মানুষকে হয়তো এই সময় চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে হত। সত্যিই তো যুধিষ্ঠিরের চরিত্রে স্থিরতা এবং ধৈর্যের যে ধারাবাহিকতা আছে, তাতে এই অসম্ভব রাগটুকু তাঁকে মানায় না। বিশেষত এই রাগ তিনি যার ওপরে করছেন, তিনি সদা-সর্বদা তাঁর অনুগামী শিষ্যের মতো আচরণ করেছেন, তাঁর অন্যায়ের সময়েও অর্জুন কখনও তাঁকে অতিক্রম করেননি। সেই অর্জুনকে তিনি যে ভাষায় অপমান করলেন এবং যার একাংশমাত্র এখানে আমরা উদ্ধার করেছি, তা অন্তত কোনওভাবেই যুধিষ্ঠিরোচিত নয়।

কিন্তু হয়। এমনটিই হয়। বার বার বলেছি এ-কথা। শত ধর্ম, শত সত্যের অন্তরালে যুধিষ্ঠিরও তো একজন মানুষ। মহাভারতের কবিকে যখন এ-কথা সপ্রমাণ করতে হয়, তখনই যুধিষ্ঠিরের গুণগ্রাহীদের মনে ধাক্কা লাগে। যুধিষ্ঠির-চরিত্রের এমনতর ব্যতিক্রম-ন্যাস পরোক্ষে সেই অসম্ভব সত্যই প্রমাণ করে যে, যুধিষ্ঠির মূলত সত্যবাদী, মূলত ধীর-স্থির। আরও একটা কথা হল—সত্যের নীতির চেয়ে প্রজ্ঞা এবং যুক্তির প্রয়োজনটাও যে জীবনে কখনও অপেক্ষিত, সেটাও যুধিষ্ঠির হাতে হাতে প্রমাণ পেয়ে গেলেন তাঁর কটু-ভাষণের উত্তরপর্বে। দ্রোণের মৃত্যুর পূর্বে সত্য-চ্যুত হয়ে তাঁর যদি কোনও মানসিক আঘাত লেগে থাকে, তবে সেই সাময়িক সত্য-চ্যুতির সার্থকতার প্রমাণ তাঁকে পেতে হল নিজের মাধ্যমেই।

অর্জুনকে যদি তিনি আরও পাঁচটা জঘন্য কথা বলে গালাগালি দিতেন, তা হলেও তিনি কোনওভাবেই যুধিষ্ঠিরকে কোনওভাবেই অতিক্রম করতেন না। সে কথা জোর দিয়েই বলা যায়, এমনকী অনেক প্রমাণ দিয়েও বলা যায়। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের শেষ কথা শুনেই অর্জুনকে আমরা তাঁর আপন প্রকোষ্ঠে ফিরে আসতে দেখছি। সেখানে তাঁর প্রাণসখা কৃষ্ণও বসে আছেন অনেকক্ষণ। তিনি অবশ্য অর্জুনের প্রতি যুধিষ্ঠিরের নিন্দাবাক্যগুলি কানে শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু কিছুই না বোঝার ভান করে বসে আছেন।

অর্জুন এলেন এবং এসেই একটি ক্ষুরধার তরবারি তুলে নিলেন হাতে। তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠভাই যুধিষ্ঠিরকে মারতে চান—জিঘাংসুৰ্ভরতর্ষভম্। এক মুহূর্তে কৃষ্ণ বুঝে গেলেন কী হতে চলেছে। তিনি একটু বোকা সেজে জিজ্ঞাসা করলেন—ঢাল-তরোয়াল নিয়ে চললে কোথায় ভায়া—উবাচ কিমিদং পার্থ গৃহীতঃ খড়গ ইত্যুত। এখন এই মুহূর্তে কারও সঙ্গে তোমার যুদ্ধ করতে হবে বলে তো জানি না। ওই যে ধৃতরাষ্ট্রের দুর্বুদ্ধি ছেলেগুলো, মধ্যম-পাণ্ডব তো শেষ করে এসেছেন তাঁদের। আর তুমি এই এক্ষুনি বলে গেলে—দাদা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করে আসি। তা দেখাও তো হল তাঁর সঙ্গে। আর তিনি তো ভালই আছেন—স রাজা ভবতা দৃষ্টঃ কুশলী চ যুধিষ্ঠিরঃ। তো হঠাৎ কার এমন খবর পেলে, যার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তরোয়াল নিয়ে দৌড়চ্ছ—কস্মাদ্ভবান্ মহাখড়গং পরিগৃহ্নাতি সত্বরঃ।

দুজনের এই কথোপকথনের মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে আসতেও দেখা গেল। অর্জুন তাঁর দিকে আঙুল দেখিয়ে কৃষ্ণকে বললেন—এই যে যিনি এক্ষুনি বললেন—তোমার ওই গাণ্ডীব ধনুকটি অন্যের হাতে তুলে দাও, তাঁর মাথাটা কেটে ফেলতে চাই আমি। সেটাই আমার নিয়ম—ছিন্দাম্যহং তস্য শিরঃ ইত্যুপাংশুব্রতং মম।

অর্জুনের নাকি প্রতিজ্ঞা ছিল—যে ব্যক্তি তাঁর গাণ্ডীব-ধনুর নিন্দা করবে, তিনি তাকে হত্যা করবেন। ক্ষত্রিয়ের প্রতিজ্ঞা সে বড় সাংঘাতিক জিনিস। প্রতিজ্ঞা রক্ষা করাই তাঁর ধর্ম। অর্জুন তাই এখন যুধিষ্ঠিরকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন। কারণ তিনিও ধর্ম-চ্যুত হতে পারেন না—প্রতিজ্ঞাং পালয়িষ্যামি হত্বৈনং নরসত্তমম্। তিনি কৃষ্ণকে বললেন—তোমার কী মত? আমার কি এটাই করা উচিত নয়? কৃষ্ণ অর্জুনকে একরাশ ধিক্কার দিয়ে বললেন—ছিঃ অর্জুন! তোমার বুদ্ধিটা এমন মোটা দাগের, তা তো জানতাম না। বেশ বুঝতে পারছি—তুমি বৃদ্ধ পণ্ডিত-জ্ঞানী ব্যক্তির সেবা করনি—ন বৃদ্ধাঃ সেবিতাস্-ত্বয়া। সময় উপস্থিত হলে কোনটা করা উচিত আর কোনটা করা উচিত নয়—সেটাই তুমি বুঝলে না। অথচ তুমি নাকি সত্য রক্ষা করতে যাচ্ছ? কবে কোন সময়ে বাচ্চা ছেলের মতো একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলে, আর সেই প্রতিজ্ঞা তোমার রাখতে হবে? মনে রেখো—যুধিষ্ঠির তোমার বড়ভাই। তাঁর মতো ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি এই পৃথিবীতে দুটো নেই, তিনি তোমার গুরু। আর তাঁকে কিনা তুমি হত্যা করার কথা ভাবছ—স গুরুঃ পাৰ্থ কস্মাত্ত্বং হস্তুকামো’ভিধাবসি?

কৃষ্ণ বন্ধুভাবে অনেক গালমন্দ করলেন অর্জুনকে। কৌশিক নামে এক মুনির একটি বিশেষ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে তিনি জানালেন যে সময়কালে সত্য-কথা বলা বা প্রতিজ্ঞার সত্যতা-রক্ষাও কত অন্যায় ঘটাতে পারে। কৃষ্ণ বলেছিলেন—এমন ক্ষেত্র আসতেই পারে যেখানে সত্য জানলেও বা সত্য হলেও তা উচ্চারণ করা উচিত নয়, কখনও বা সত্যের বদলে মিথ্যা কথা বলাটাই পরম শ্রেয় এবং পরম সত্য বলে গণ্য হতে পারে—যত্রানৃতং ভবেৎ সত্যং সত্যঞ্চানৃতং ভবেৎ। বিশেষত একটা মিথ্যা যদি মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজে লাগে, তবে সেই মিথ্যা পরমধর্ম বলে গণ্য হবে।

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে এই কাজটাই করিয়েছিলেন দ্রোণ-বধের সময়। কৃষ্ণ আজকে যা অর্জুনকে বোঝাচ্ছেন, সেই পরম-তত্ত্ব যুধিষ্ঠির জানতেন বলেই পরম সত্যবাদী হয়েও তিনি তাঁর নমনীয়তাটুকু দেখিয়েছেন। কৃষ্ণের বক্তব্য ছিল—যেখানে সত্য বললে প্রাণিবধের সম্ভবনা, সে সত্য না বলাই ভাল এমনকী মিথ্যা বলাও ভাল—ভবেৎ সত্যম্ অবক্তব্যং বক্তব্যমনৃতং ভবেৎ। যুধিষ্ঠির যে দ্রোণ-বধের জন্য মিথ্যাবাক্য বলেছিলেন, তা বহু-জীবনের রক্ষার কল্পে। সে দিন দ্রোণবধের পূর্ব মুহূর্তে মিথ্যা-বাক্য উচ্চারণে সম্মত হওয়ায় যুধিষ্ঠিরের যদি কোনও খুঁতখুঁতি থেকে থাকে, তবে আজ কৃষ্ণের তত্ত্ববাক্য শুনে সেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তাঁর চলে গিয়ে থাকবে।

আরও বড় কথা যুধিষ্ঠির নিজেই এমন মৃত্যুর সামনে সেদিন এসে দাঁড়ালেন, যা তাঁর অকল্পনীয় ছিল। তাঁর শিষ্যের মতো ছোটভাই তাঁকে মারতে চাইছে। কৃষ্ণের বুদ্ধি-প্রজ্ঞা এবং সত্য নির্ধারণের অদ্ভুত বিচার অর্জুনকে তাঁর ক্রোধোদ্যম থেকে বিরত করেছে ঠিকই, কিন্তু যুধিষ্ঠিরও আরেকবার বুঝেছেন যে, দ্রোণ-বধের সময় মিথ্যা উচ্চারণ করে তিনি কোনও অন্যায় করেননি। আসলে অর্জুনের মধ্যে সেই উদার নমনীয়তা নেই যা যুধিষ্ঠিরের আছে। নইলে দ্রোণ-বধের সময় যে মিথ্যা-উচ্চারণের প্রস্তাব কৃষ্ণ দিয়েছিলেন, অর্জুন সেটাও মানেননি, অর্জুন তার প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সত্যবাদিতা থেকে চ্যুত হয়ে যাঁর ধর্মরথ ভূমি স্পর্শ করেছে, যার জন্য তাঁকে ভবিষ্যতে নরক-দর্শন করতে হবে, সেই যুধিষ্ঠিরও কিন্তু সত্যের বিচার করেন প্রজ্ঞা দিয়ে নমনীয়তা দিয়ে।

সত্যি কথা বলতে কি, যুধিষ্ঠিরকে অন্য জনে যতই বোকাসোকা ভাবুন, তাঁর সত্য-বুদ্ধি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত এবং সেইজন্যেই স্থান-কাল-পাত্র বুঝে তা নমনীয়ও বটে। আমরা দ্রোণ-বধের পূর্বে মিথ্যা-উচ্চারণ সম্বন্ধে যে খুঁতখুঁতির কথা কল্পনা করেছি, তা আমাদের কল্পনামাত্রই। বাস্তবে কিন্তু কৃষ্ণ যেই বলেছেন—– দ্রোণ-বধ সম্পন্ন হলে বহুজনের প্রাণ রক্ষা ঘটবে, যুধিষ্ঠির তাতে অনিচ্ছুকভাবে হলেও সম্মত হয়েছেন। তাঁর যে তর্কযুক্তিসম্মত এক সত্যের বোধ ছিলই, সে কথা অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের তিরস্কার-বাক্য থেকেই বোঝা যায়। আপন প্রতিজ্ঞা রক্ষার গোঁয়ার্তুমি থেকে সত্যচ্যুত হওয়াটাই অর্জুনের পরম ধর্ম হবে, সেটা বোঝানোর সময় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন—আজকে আমি তোমাকে যে সত্য-বিচারের আসল রহস্যটা জানাচ্ছি, তা শুধু আমি কেন, এ সত্য বোঝাতে পারতেন মহামতি ভীষ্ম অথবা বোঝাতে পারতেন সমস্ত ধর্মের রহস্য যিনি জানেন, সেই যুধিষ্ঠির—যদ্ ব্ৰূয়াত্তব ভীষ্মো হি ধর্মজ্ঞো বা যুধিষ্ঠিরঃ।

যুধিষ্ঠিরের প্রতি কৃষ্ণের এই অসম্ভব মর্যাদা থেকে প্রমাণিত হয় যে, সত্য অথবা ধর্ম সম্বন্ধে যুধিষ্ঠিরের দৃষ্টি কত ব্যাপক, কত উদার, কত পরিচ্ছন্ন এবং কতটা বহুজন-হিতৈষিণী। আবারও সেই পুরনো কথাটা ফিরে আসে—তিনি সব দেখতে পান। তাঁর মিথ্যাচারে দ্রোণ মারা গেলেন, সেটা বড় কথা নয়। রাজধর্মের নীতিতে কোনও না কোনওভাবে তাঁকে মরতেই হত। কিন্তু তাঁর অনৃত-সত্যের কারণে সাময়িকভাবে হলেও পাণ্ডব-সেনারা বেঁচে ছিলেন। এই মুহূর্তে সেই ভূতহিতৈষিণী বুদ্ধিতেই পাণ্ডব অর্জুন একভাবে তাঁর প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করলেন এবং সব যখন ঠিকঠাক হয়ে গেল অর্জুন অনেক ক্ষমাও চাইলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে।

ছোটভাইকে এইভাবে পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে দেখে আর যুধিষ্ঠির থাকতে পারলেন না। হাতে ধরে তাঁকে উঠিয়ে যুধিষ্ঠির জড়িয়ে ধরলেন অর্জুনকে। ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটির মতন করে ছোটভাই অর্জুনের কাছে যুধিষ্ঠির বললেন—দেখ ভাই! আমার সমস্ত সৈন্যদের সামনে কর্ণ আমার গায়ে আঁটা লোহার বর্মটি কেটে ফেলে দিল, আমার রথের ধ্বজা কেটে দিল। তাকে আঘাত করার জন্য আমি আমার মহাশক্তিটি উঠিয়েছিলাম, সেটাও দিল খান-খান করে। আমার রথের ঘোড়াগুলি, আমার ধনুক, বাণ সবই গেল কর্ণের আক্রমণে—কবচঞ্চ ধ্বজঞ্চৈব ধনুঃ শক্তি-র্হয়াঃ শরাঃ। এমন অদ্ভুত অপমান আমার কখনও হয়নি। সমস্ত সৈন্যদের সামনে এমন অপমান। এত অসহায় লাগছিল, মনে হচ্ছিল যেন এখনই মরে যাই—ব্যবসীদামি দুঃখেন ন চ মে জীবিতং প্রিয়ম্। এর পরেও কি আমি তোমাকে বলব না যে, আজই মারা চাই কর্ণকে।

অর্জুন যুধিষ্ঠিরের অসহায় অবস্থা এবং তাঁর অপমান হৃদয়ঙ্গম করে সেইদিনই কর্ণ-বধের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছেন। কর্ণ মারাও গেছেন যুধিষ্ঠিরের অভিলাষ মতোই। সেই দিনই। একজন যোদ্ধা হিসেবে যুধিষ্ঠির যে কত অসহায়, তা আমরা যুধিষ্ঠিরের শত স্বীকারোক্তিতেই বুঝেছি। কিন্তু একজন অস্ত্র-শিক্ষিত ক্ষত্রিয় একটি বিশেষ যুদ্ধে যতই অবসন্ন হন, তিনি যে একেবারে অশিক্ষিত নন, সেটা বোঝানোর জন্যই কি মহাভারতের কবি শল্যপর্বে তাঁকে নায়ক বানিয়ে দিলেন। মদ্ৰাধিপতি শল্যরাজ কম যোদ্ধা ছিলেন না। কিন্তু অনেক আগে থেকেই শল্যকে তিনিই হত্যা করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন কৃষ্ণকে, বুদ্ধিমান কৃষ্ণ শল্য বধের জন্য যুধিষ্ঠিরকেই উত্তপ্ত করে রেখেছিলেন। শল্যকে তিনি ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের থেকেও বড় যোদ্ধা বলে প্রতিপন্ন করে মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে তিনি বলেছিলেন—আপনি ছাড়া শল্যের কোনও প্রতিযোদ্ধা আমার চোখে পড়ছে না—তস্যাদ্য ন প্রপশ্যামি প্রতিযোদ্ধারমাহবে।

বস্তুত এ শুধুই যুধিষ্ঠিরকে প্রশংসার মাধ্যমে উত্তেজিত করা। কৃষ্ণ খুব ভালই জানতেন শল্য অন্তত ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ নন। অন্যদিকে ভীম, অর্জুনের মতো ভয়ঙ্কর যোদ্ধারা যুদ্ধ করতে করতে রীতিমতো ক্লান্ত। কিন্তু এই সত্যটাকে তিনি পরিবর্তন করে যুধিষ্ঠিরের উত্তেজনায় পরিণত করলেন। তিনি বললেন—ভীম-অর্জুনের ক্ষমতা হবে না শল্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার—তস্যাদ্য ন প্রপশ্যামি প্রতিযোদ্ধারমাহবে। একমাত্র তুমিই পার শল্যকে হত্যা করতে। যুধিষ্ঠির কি কৃষ্ণের বাষ্প-স্ফীত উক্তি কিছু বোঝেননি? নিশ্চয় বুঝেছেন। কারণ প্রশংসা বা নিন্দায় কাতর হওয়ার মতো ব্যক্তি তিনি নন।

এই একবার মাত্র যুধিষ্ঠিরকে ক্ষাত্র-তেজে ভূষিত করেছেন মহাভারতের কবি। শল্যকে বধ করবার সময় যুধিষ্ঠিরের সে কী চেহারা। শল্যের উদ্দেশে মহাশক্তি নিক্ষেপ করার সময় ক্রোধদ্দীপ্ত-নয়নে বাহু প্রসারণ করে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির প্রায় নাচছিলেন – প্রসার্য বাহুং সুদৃঢ়ং সুপাণিং/ক্রোধেন নৃত্যন্নিব ধর্মরাজঃ।

শল্য যে শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠিরের হাতে মারা গেলেন, যুধিষ্ঠির চরিত্রের এটা কোনও বৈশিষ্ট্যই নয়। মহান যোদ্ধারা সব হত হবার পর এই শল্যপর্বেই যুধিষ্ঠির-নকুল-সহদেবের মতো পাণ্ডবদের যুদ্ধ-প্রদর্শনীর অবসর তৈরি করেছেন মহাভারতের কবি। কিন্তু তবু আবারও বলি—যুধিষ্ঠিরের চরিত্রে এই শল্য-হত্যার গৌরব কোনও নতুন মর্যাদা যোগ করে না। সত্যি কথা বলতে কি, এত বড় একটা যুদ্ধ হয়ে গেল, অথচ সেখানে পাণ্ডব-জ্যৈষ্ঠ ক্ষত্রিয় যুধিষ্ঠিরের কোনও অবদান থাকবে না, এটা যেমন ‘মহাভারত-সূত্রধার’ কৃষ্ণও মানতে পারেননি, তেমনই মানতে পারেননি মহাভারতের কবি। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে অভিষিক্ত এক মহাবীর নায়ককে যুধিষ্ঠির মারলেন—এই ঘটনা বলে মহাকাব্যের কবি যুধিষ্ঠিরের ক্ষত্রিয়-জন্মের সার্থকতা যতটুকু নির্ণয় করেছেন, তার চেয়ে বেশি তাঁর ক্ষত্রিয়-জন্মের ঋণ শোধ করার সুযোগ দিয়েছেন। সারা জীবন একটি শত্রুও হত্যা করলাম না—এটা যেন কোনও ক্ষত্রিয়ের পরিচয় হতে পারে না—হয়তো এই কথা ভেবেই কবি এই যুদ্ধ-যজ্ঞের শেষ লগ্নে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের হাতে ভল্ল-মুষল তুলে দিয়ে শল্য-বধের আহুতি রচনা করেছেন। এইভাবে যুধিষ্ঠির হয়তো ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম শত্রুনাশ এবং প্রজাপালনের স্বধর্মে স্থিত হলেন।

অথচ যুধিষ্ঠির যে ক্ষত্রিয়োচিত কথাবার্তা মোটেই বলেন না, তা মোটেই নয়। উদ্যোগপর্বে সঞ্জয়ের সঙ্গে কথোপকথনে আমরা সেই পরিচয় পেয়েছি, আবারও সেই পরিচয় পাব যখন সমস্ত সৈন্য-সামন্ত হারিয়ে দুর্যোধন হ্রদে প্রবেশ করেছেন। দুর্যোধন যখন জল থেকে উঠতে বিলম্ব করছেন, তখন কঠিন ভাষায় যুধিষ্ঠির আক্রমণ করেছেন দুর্যোধনকে। বলেছেন—এখন কোথায় তোমার সেই অহঙ্কার, কোথায় তোমার সেই পৌরুষ, আর কোথায় তোমার সর্বক্ষণের হু-হুঙ্কার—ক্ক তে তৎ পৌরুষং যাতং ক্ক চ মানঃ সুযোধন। নিজেকে এত বড় বীর বলে জাহির কর তুমি, তো এই হ্রদের মধ্যে শুয়ে আছ কেন? হয় তুমি আমাদের হত্যা করে রাজ্য ভোগ কর, নয়তো আমাদের হাতে মৃত্যুবরণ কর তুমি। এই তো ক্ষত্রিয়ের ধর্ম—উত্তিষ্ঠ রাজন্ যুধ্যস্ব ক্ষত্রিয়ো’সি কুলোদ্ভবঃ।

দুর্যোধন সঙ্গে সঙ্গেই উঠলেন না। বললেন—ভয় নয় যুধিষ্ঠির! আমি বড় ক্লান্ত। তা ছাড়া যাঁদের জন্য আমি রাজ্য চেয়েছি, তাঁরা সকলেই এই মহাযুদ্ধে শেষ হয়ে গেছেন। সমস্ত ক্ষত্রিয়-বীর নিঃশেষ, পৃথিবী ক্ষীণরত্না, হতভাগ্য বিধবার মতো এই পৃথিবীকে ভোগ করার আর কোনও উৎসাহ নেই আমার—নাভ্যুৎসহাম্যহং ভোক্তুং বিধবামিব ঘোষিতম্। এই অসহায় বীরহীনা-পৃথিবী এখন তোমারই হোক যুধিষ্ঠির। আমি বনে চলে যাব, এ রাজ্য এখন তুমিই ভোগ কর—গচ্ছ ত্বং ভুক্তক্ষ রাজেন্দ্র পৃথিবীং নিহতেশ্বরাম্।

যুধিষ্ঠির এই কথার প্রতিক্রিয়া জানালেন যথেষ্ট তীক্ষ্ণভাবেই। বললেন—মেলা বকবক কোরো না, দুর্যোধন—আর্তপ্রলাপান্মা তাত। তোমার দয়ার দান আমি নিতে যাব কেন। দান গ্রহণ করা ব্রাহ্মণের ধর্ম, ক্ষত্রিয়ের নয়। তোমাকে যুদ্ধ-জয় করেই এই বসুন্ধরা ভোগ করতে পারব আমি—ত্বান্তু যুদ্ধে বিনির্জিত্য ভোক্তাস্মি বসুধামিমাম্। এই তুমি আগে আমাদের সূচ্যগ্র পরিমাণ ভূমি ছাড়তেও রাজি হওনি, কিন্তু এখন সহায়-সম্বল হারিয়ে সমস্ত পৃথিবী চাইছ—এর অর্থ কি আমি বুঝি না ভেবেছ—সূচ্যগ্রং নাত্যজঃ পূর্বং স কথং ত্যজতি ক্ষিতিম্? আসলে তুমি বাঁচার চেষ্টা করছ, দুর্যোধন। সেটা হবে না। আজ তোমাকে মরতেই হবে।

কথা-প্রতিকথা আরও খানিকক্ষণ চলল। দুর্যোধনও আর কটুকথা সইতে না পেরে জল থেকে উঠলেন এবং ভীম-দুর্যোধনের যুদ্ধ আরম্ভ হল। এই যুদ্ধের ফল কী হয়েছিল আমরা জানি। ভীমের গদাঘাতে দুর্যোধনের উরু-ভঙ্গ হয়েছিল। তিনি অসহায় অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছিলেন, তখনও তাঁর জ্ঞান আছে পরিষ্কার। ঠিক এই অবস্থায় মধ্যম-পাণ্ডব ভীমসেন ভূমিশায়িত দুর্যোধনকে চরম অপমান করতে লাগলেন। সমস্ত পুরনো কথা তুলে—দুর্যোধনের পূর্বকৃত সমস্ত অন্যায়ের কথা পুনরুচ্চারণ করে ভীম তাঁর মাথায় বা-পায়ে সামান্য আঘাত করলেন—পদা মৌলিমুপাস্প্রৃশৎ।

যুদ্ধিষ্ঠির কিন্তু ভীমের এই আচরণ সহ্য করতে পারলেন না। তাঁর মধ্যে জেগে উঠল সেই সর্বভূতৈষিণী বৃত্তি, সেই নীতিবোধ, সেই ধর্ম-সংস্কার। নৃত্যপর, ক্রুদ্ধ ভীমসেনকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন—তোমার শত্রুতার ঋণ শেষ হয়ে গেছে, ভাই! তোমার যে প্রতিজ্ঞা ছিল—দুর্যোধনের উরু ভঙ্গ করবে—সে প্রতিজ্ঞাও পূর্ণ হয়ে গেছে—গতো’সি বৈরস্যানৃণ্যং প্রতিজ্ঞা পূরিতা ত্বয়া। কিন্তু এখন এঁর মাথায় এমন করে লাথি মেরো না, ভীম! তুমি মর্যাদা অতিক্রম করছ। মনে রেখ, ইনি একজন রাজা। ইনি আমাদের জ্ঞাতি তার ওপরে ইনি এখন শক্তিহীন হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। যিনি এক অক্ষৌহিনী সেনার নায়ক, সেই রাজার মাথায় লাথি মারা যায় না—মা স্প্রাক্ষীৰ্ভীম পাদেন রাজানং জ্ঞাতিমেব চ। এঁর যা অবস্থা তাতে এঁকে হত্যাও করা যায়, কিন্তু অপমান করা যায় না।

দুর্যোধনের মৃত্যুতে যুধিষ্ঠিরের চোখে জল এসেছে। দুর্যোধনের কাছে গিয়ে তিনি সান্ত্বনা-বাক্য উচ্চারণ করেছেন বৎস! দুঃখ কোরো না। তোমার কৃতকর্মের ফল ভোগ করছ। লোভ আর অহঙ্কারে তুমি তোমার মৃত্যু ডেকে এনেছ বটে, তবু এই মৃত্যু বীরের মৃত্যু। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু হারিয়ে আমরা রইলাম দুঃখভোগের জন্য। তুমি বীরের মৃত্যু বরণ করে স্বর্গে যাও, আর আমরা কুরুবাড়ির বিধবাদের অভিশাপে ক্লিষ্ট হতে হতে ভোগ করে যাব।

এই করুণ সুর যুধিষ্ঠিরের হৃদয়ে বেজেছে আজীবন। পুত্রহারা গান্ধারীর দিকে তিনি তাকাতে পারেননি। তাঁর কাছে গিয়ে বলেছেন—আমাকেই অভিশাপ দাও মা। আমিই তোমার পূত্রহন্তা, এই বিশাল ধ্বংসের জন্য আমিই দায়ী। যুদ্ধের শেষে অতি সংবেদনশীল যুধিষ্ঠির দেখলেন—একটি মানুষও সুখে নেই। যুদ্ধে অবশিষ্ট এমন একটি মানুষ নেই যে বলতে পারে—আমি আমার কোনও স্বজন হারাইনি। অথবা আমার কোনও ক্ষতি হয়নি। এই ভয়ঙ্কর ক্ষয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে কী করে একটা মানুষ রাজা হবার কথা ভাবতে পারে, সে-কথা যুধিষ্ঠিরের ভাবনায় আসে না। অথচ এই ধ্বংসস্তুপের ওপরেই পাণ্ডবদের রাজপ্রাসাদ রচনা হবে, যুধিষ্ঠিরকে হতে হবে রাজা। সময়কালে রাজা হওয়াটাও যে কেমন নিয়তির অভিশাপের মতো, তা যুধিষ্ঠির ছাড়া আর কে এমন করে বুঝবেন।

সারা জীবন অনেক দুঃখ সয়েছেন যুধিষ্ঠির। কিন্তু তিনি বুঝি সবচেয়ে বড় আঘাত পেলেন নিজের মায়ের কাছেই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে মৃত-জনের উদ্দেশে জল-তর্পণ করার জন্য গঙ্গায় নামতেই যুধিষ্ঠির শেষ ধাক্কা খেলেন। জননী কুন্তীর মুখে সেই দুরুচ্চার শব্দ শুনতে পেলেন—ওরে কর্ণের উদ্দেশে এক অঞ্জলি জল দিস তোরা। সেই তোদের সবচেয়ে বড়ভাই—স হি বঃ পূর্বজো ভ্রাতা ভাস্করান্মজ্য*জায়ত।

কথাটা শুনে মায়ের ওপর যতটা রাগ হয়েছে যুধিষ্ঠিরের, ঠিক ততটাই দুঃখ হয়েছে তাঁর : রাগ এইজন্য যে, কুন্তী আগে কেন বলেননি, আর দুঃখ এইজন্য যে, কর্ণকে আগে ভাই বলে বুঝতে পারলে কুরুক্ষেত্রের এত বড় যুদ্ধটাই বোধহয় আর হত না। অন্তত অনেক কিছুই অন্য রকম হত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে যুধিষ্ঠিরের মতো অসুখী মানুষ বোধহয় আর কেউ ছিলেন না। যুদ্ধে যে পরিমাণ মানুষ হতাহত হয়েছে, তাতে যুধিষ্ঠির সুখী ছিলেন না মোটেই। এখন সেই দুঃখের ওপরে কর্ণের যথার্থ পরিচয় তাঁকে আরও কষ্ট দিচ্ছে। এক দিকে তিনি ভাবছেন—কর্ণের মতো কাউকে বড় ভাই হিসেবে পেলে তাঁর জীবনে অপ্রাপ্য কিছু থাকত না, অন্য দিকে একান্ত আপন ভাইটির শোচনীয় মৃত্যুর পর তিনি এখন নিজেকে স্বার্থপর, লোভী বলে মনে করছেন—অজানতা ময়া ভ্রাতা রাজ্যলুব্ধেন ঘাতিতঃ। বলছেন—আমি না জেনে রাজ্যের লোভে নিজের ভাইকেই মেরেছি।

বস্তুত যুধিষ্ঠিরের এই অনুতাপ কর্ণকে দিয়েই শুরু হয় বটে, কিন্তু আস্তে আস্তে সমস্ত মৃত মানুষের মুখগুলিই তাঁর অন্তরে ছায়া ফেলতে থাকে, এবং তিনি সকলের জন্যই শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। একশো ভাইয়ের কলরব-সমন্বিত কুরুবাড়িটি সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় যুধিষ্ঠির আর সেদিকে তাকাতে পারছেন না। কৌরবদের কাছ থেকে পাওয়া শত অপমান মাথায় রেখেও তিনি নিজেকেই এই ভয়ঙ্কর পরিণতির জন্য দায়ী করছেন। বলছেন—আমি মথুরা-দ্বারকায় গিয়ে ভিক্ষে করতাম, সেও ভাল ছিল, তা হলে জ্ঞাতিদের পরিবার এইভাবে নিষ্পুরুষ হয়ে যেত না, আর আমিও এমন দুর্গতি লাভ করতাম না। ধিক্ আমাদের ক্ষত্রিয়ের রাজধর্ম, ধিক আমাদের শক্তিমত্তা আর পৌরুষ—ধিগস্তু ক্ষত্রিয়াচারং ধিগস্তু বল-পৌরুষম্।

ঠিক এই রকম কথা আমরা আগেও যুধিষ্ঠিরের মুখে শুনেছি। এখনও আবার শুনছি। যুদ্ধের উদ্যোগ যখন চলছে, তখন এ সব কথা শুনেছি, আবার শুনছি যুদ্ধশেষের পর। মাঝখানের ওই আঠারো দিন যুদ্ধের সময়টুকু যুদ্ধিষ্ঠির যেন সামান্য ক্ষত্রিয়-বৃত্তি গ্রহণ করেছেন। ভীষ্ম-দ্রোণের মতো যোদ্ধাদের কীভাবে ভাবে হত্য করা যায়, সে ব্যাপারে তিনি যেমন মাথা ঘামিয়েছেন, তেমন কর্ণকে তাড়াতাড়ি বধ করার জন্যও তিনি যথেষ্ট উন্মাদনা তৈরি করেছেন। দুর্যোধনকে শেষ করার ব্যাপারেও তিনি যে সব কথা-বার্তা বলেছেন, তাও যথেষ্ট ক্ষত্রিয়োচিত।

কিন্তু আঠারো দিনের এই ক্ষত্রিয়সুলভ উৎসাহ-উদ্দীপনা যুধিষ্ঠিরের আন্তর-প্রকৃতির সঙ্গে মেলে না। একটি লম্বা-চওড়া সুন্দর মানুষকে যদি পুলিশের ইউনিফর্ম তথা বুট-জুতো পরিয়ে দেওয়া যায়, তবে সাময়িকভাবে সে যেমন পুলিশের মতো গট-মট করে চলে, যুধিষ্ঠিরের এই আঠারো দিনের আচরণও প্রায় সেই রকম। এমনকী যুদ্ধ চলা-কালীন ভীষ্মের বধ-রহস্য জেনে নেওয়া, দ্রোণের মৃত্যুর জন্য মিথ্যা-শব্দ উচ্চারণ করা, তথা কর্ণের তেজে ভীত হয়ে অর্জুনকে অপমান করা—এগুলির মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থৈষণার পরিচয় থাকলেও যুধিষ্ঠিরের প্রকৃত স্বভাবের নিরিখে আমরা এগুলিকে তাঁর যুদ্ধকালীন অস্থিরতার মধ্যেই গণ্য করতে চাই এবং এই অস্থিরতা এসেছে যুদ্ধের মতো দ্রব্যগুণে। নইলে এটা যুধিষ্ঠিরের চরিত্র নয়।

রাজধর্মের মতো বঞ্চনাময় তথা ছলনাময় বস্তু কখনও যুধিষ্ঠিরের আদর্শ নয়। যে কারণে যুদ্ধশেষের পরম-লগ্নে যখন তাঁর হস্তিনাপুরের সিংহাসন লাভ করে উৎফুল্ল হওয়ার কথা, তখন তিনি ক্ষাত্রধর্মকে ধিক্কার দিয়ে বনচারী ঋষি-মুনির ক্ষমা, অহিংসা সত্যের জয়গান গাইছেন। একেকটি মানুষের জন্মের পিছনে পিতা-মাতার কত তপস্যা, কত স্বার্থত্যাগ জড়িত আছে, তার পালন-পোষণ এবং স্নেহের মধ্যে মাতা-পিতার কত আশা কত আকাঙ্ক্ষা ফলবতী হয়। যুধিষ্ঠির এখন শত্রু-মিত্র সকল মানুষের কথা চিন্তা করছেন—যারা এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এসে তাদের জন্মলাভের সামান্য সার্থকতাও খুঁজে পেল না—ন তে জন্মফলং কিঞ্চিদ্ ভোক্তারো জাতু কর্হিচিৎ। মহাযুদ্ধে মানুষের এই ভয়ঙ্কর ক্ষয় দেখে, বিশেষত জ্ঞাতি ভাইদের কুল একেবারে উৎসন্ন হয়ে যাওয়ায় যুধিষ্ঠির আর রাজা হতেই চাইলেন না।

যুধিষ্ঠিরের স্বভাব এবং স্বরূপ এটাই। যে উত্থানশক্তি এবং যে নির্মমতা একজন রাজার প্রয়োজনীয় গুণের মধ্যে পড়ে, যুধিষ্ঠির নিজেকে তার যোগ্য মনে করেন না এবং সেটা তাঁর স্বভাবও নয়। তিনি অর্জুনকে বললেন—এখন রাজ্যে আমার কোনও প্রয়োজনই নেই ভাই। মায়া-মমতা ত্যাগ করে আমি বনে চলে যেতে চাই। বরঞ্চ এই নিষ্কণ্টক রাজ্য তুমি ভোগ কর—প্রশাধি ত্বমিমামুর্বীং ক্ষেমাং নিহতকণ্টকাম্। অর্জুন বললেন—এ তুমি কী বলছ, দাদা! এই অমানুষিক কষ্ট করে আমরা রাজ—ঐশ্বর্য লাভ করলাম, আর তুমি বলছ কিনা সব ত্যাগ করে বনে চলে যাবে—যৎ কৃত্বামানুষং কর্ম ত্যজেথা শ্রিয়মুত্তমাম্।

অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে রাজার ধর্ম বোঝানোর চেষ্টা করলেন। চতুর্বর্গ-সাধনের মধ্যে চতুর্থ-বর্গ মোক্ষসাধনের পথ যে রাজার জন্য নির্দিষ্ট নয়, তাঁকে যে প্রজা-পালন এবং রাজ্য-বিস্তারের জন্য সদা-সর্বদা সমৃদ্ধিকামী হতে হবে, অর্থলাভেব চেষ্টা করতে হবে—এসব অর্থশাস্ত্রীয় তত্ত্ব যুধিষ্ঠিরকে খুব করে বোঝালেন অর্জুন। যুধিষ্ঠির যে একটুও বুঝলেন, তা কিন্তু নয়। ভীম এবং অন্যান্য ভাইদের কথা, দ্রৌপদীর কথা, এমনকী কৃষ্ণ এবং ব্যাসের সান্ত্বনাবাক্যেও তিনি রাজা হতে রাজি হলেন না। যুধিষ্ঠিরের এই রকম মানসিক অবস্থায় কৃষ্ণের পরামর্শে তাঁকে মহামতি ভীষ্মের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। সম্পূর্ণ শান্তিপর্ব এবং অনুশাসনপর্ব জুড়ে রাজধর্ম এবং তৎসংক্রান্ত বিষয় যুধিষ্ঠিরকে শোনানো হল।

যুধিষ্ঠির শুনলেন, অনুধাবন করলেন, প্রশ্ন করলেন, রাজধর্মের নানান কুটিল বক্তব্য শুনে আঁতকেও উঠলেন বহুবার। ভীষ্ম এবং বিভিন্ন ঋষি-মুনির বিশাল জ্ঞানগর্ভ উপদেশ যুধিষ্ঠিরের কী কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা এই অল্প পরিসরে বোঝানো সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু বলা যায়—রাজধর্মের মধ্যে ঐহিক সুখৈষণা আছে, তার সঙ্গে প্রজাপালনের মতো মহদ্‌বৃত্তি জড়িত থাকলেও সেই-রকম সুখ যুধিষ্ঠির চান না এবং সে সুখ তাঁর মনোমতও নয়। তবু সব কিছুর পরে এটা তিনি বুঝলেন যে, রাজা তাঁকে হতেই হবে। রাজা তিনি হলেনও। রাজাদের বিধিবদ্ধ পথে তিনি অশ্বমেধ-যজ্ঞও করলেন। দান-দক্ষিণা, মান-পরিচর্যার দীক্ষা নিয়ে যে বিরাট যজ্ঞ তিনি সম্পন্ন করলেন, তাতে তাঁর আত্মতুষ্টি কিছু ঘটল বটে, তবে তিনি যে শান্তি পেলেন তা বলা যায় না।

যুধিষ্ঠির রাজা হবার পর তাঁর দিক থেকে সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি তাঁর ব্যবহার। এই বৃদ্ধের কাছ থেকে তিনি অনেক দুঃখ পেয়েছেন, কিন্তু কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের উত্তর-পর্বে হত-পুত্র এই বৃদ্ধের প্রতি তিনি করুণা কিম্বা মায়া-মমতাই শুধু দেখাননি, ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি এমন সম্মানে রেখেছিলেন যেন তিনি নিজেই তাঁর আজ্ঞাবহ ভৃত্যমাত্র—ধৃতরাষ্ট্রং পুরস্কৃত্য পৃথিবীং পৰ্য্যপালয়ন্। বিদুর এবং সঞ্জয় সদা-সর্বদা ধৃতরাষ্ট্রের পরিচর্যায় নিযুক্ত ছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক এমন কোনও বিষয়ই ছিল না যে ব্যাপারে যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রকে জিজ্ঞাসা না করে কিছু করেছেন—পাণ্ডবাঃ সর্বকার্যানি সংপৃচ্ছন্তি স্ম তং নৃপম্। জননী গান্ধারীর মর্যাদাও ছিল অনুরূপ। স্বয়ং কুন্তী তাঁর দেখাশোনার ভার নিয়েছিলেন এবং রাজরানি দ্রৌপদী এবং সুভদ্রা নজর রাখতেন এই দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অশন, শয়ন এবং পরিধানের ওপর—শয়নানি মহার্হানি বাসাংস্যাভরণানি চ।

যুধিষ্ঠির তাঁর সমস্ত ভাইদের তথা আত্মীয়-পরিজনদের কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে কেউ কোনওভাবে ধৃতরাষ্ট্রের অবমাননা না করে। যুধিষ্ঠিরের ভয়ে কেউ এই অবমাননা করার সাহসও পাননি এবং কেউ কোনওদিন ধৃতরাষ্ট্র বা দুর্যোধনের সম্বন্ধে একটি কটু কথাও বলার সাহস দেখাননি—উবাচ দুষ্কৃতং কশ্চিদ্ যুধিষ্ঠিরভয়ান্নরঃ।

একমাত্র মধ্যম-পাণ্ডব ভীমসেন। যুধিষ্ঠির যেমন বলতেন তেমনই তিনি করতেন বটে, কিন্তু আড়ালে-আবডালে তিনি বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মনে দুঃখ দিতে ছাড়তেন না। ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর সামনে তিনি বেশ কয়েকবার শুনিয়ে-শুনিয়েই বলেছেন যে, কীভাবে তিনি আপন ভুজবলে দুর্যোধনকে বধ করেছেন। যুধিষ্ঠির এ সব কিছুই জানতেন না—নাম্ববুধ্যত তদ্‌রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও কোনওদিন লজ্জায় যুধিষ্ঠিরকে এ কথা জানাননি। কিন্তু এই দুঃখ ধৃতরাষ্ট্রকে সংসারে নির্বিণ্ণ করে তুলছিল।

যুধিষ্ঠিরের রাজত্বকাল পনেরো বছর কেটে গেছে। ধৃতরাষ্ট্র এই সময়ে একদিন যুধিষ্ঠিরের কাছে অনুমতি চাইলেন বানপ্রস্থে যাবার জন্য। যুধিষ্ঠির ভীষণ রকমের দুঃখ পেলেন। পুত্রহারা এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জন্য তাঁর সমব্যথা ছিল এতটাই যে, তিনি কোনওভাবেই এই বিদায়-যাত্রা ভালভাবে নিতে পারলেন না। শোকে দুঃখে তিনি অধীর হয়ে উঠলেন। এই পনেরো বছর পর রাজ্য, রাজসমৃদ্ধি আবারও তাঁর কাছে অকিঞ্চিৎকর মনে হল। ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি অনেক অনুনয় করেছেন, দুঃখ করে এমনও বলেছেন—আমরা কার কাছে আর যাব বলুন। আপনিই তো আমাদের মাতা-পিতা—ভবতা বিপ্রহীণা বৈ কং নু তিষ্ঠামহে বয়াম্।

ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বনযাত্রা করেছেন। গান্ধারীর সঙ্গে কুন্তীও যাচ্ছিলেন তাঁর হাত ধরে নিয়ে। যুধিষ্ঠির ভেবেছিলেন—জননী কুন্তী তাঁদেরই মতো ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীকে এগিয়ে দিচ্ছেন বুঝি। কিন্তু মাঝপথে কুন্তীও যখন বললেন—তিনি আর রাজধানীতে ফিরবেন না, তখন যেন বাজ পড়ল যুধিষ্ঠিরের মাথায়। তিনি কোনওভাবেই আর নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছেন না।। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী, বিদুর-সঞ্জয় এবং সর্বোপরি জননী কুন্তীর এই বনপ্রস্থান যুধিষ্ঠিরের কাছে দ্বিতীয় আঘাত। বার বার তিনি এঁদের জন্য রাজধানী ছেড়ে বনে গেছেন এবং এক সময় কালের নিয়মে এঁদের মৃত্যুশোকও সহ্য করেছেন।

মাত্র ছত্রিশ বছর হস্তিনাপুরে রাজত্ব করেছেন যুধিষ্ঠির। মহাকাব্যের কবিরা একেক রাজাকে যেখানে হাজার-দশ-হাজার বছরের রাজত্ব দিয়ে সুখী করেছেন, সেখানে যুধিষ্ঠিরকে দিয়েছেন মাত্র ছত্রিশ বছর। তাও সে রাজত্বকাল সুখে কাটেনি। যুদ্ধোত্তর শোক-পর্ব, বিশ্বস্ত বৃদ্ধদের বিদায়, প্রিয়-সুহৃৎ কৃষ্ণের লীলা-সম্বরণ—এই সব কিছু তাঁকে দেখে যেতে হয়েছে।

আর নয়, এবার যুধিষ্ঠির নিজেই মহাপ্রস্থানে উদ্যত। উত্তরা-গর্ভজাত পরীক্ষিৎকে সিংহাসনে বসিয়ে ভাইদের নিয়ে সস্ত্রীক তিনি মহাপ্রস্থানে বেরিয়েছেন। পথের মধ্যে দ্রৌপদী এবং ভাইদের মৃত্যু হল, একক যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গে রইল শুধু ধর্ম। মানুষের মৃত্যুকালে যে শ্লোক উচ্চারিত হয়—জায়া-জননী, ভাই-বন্ধু কেউ তোমার সঙ্গে নেই, আছে শুধু তোমার ধর্ম। আজ এই স্বর্গারোহণের পথে তিনি চিরান্বিষ্ট ধর্মকে সঙ্গে পেয়েছেন। সেই শতশৃঙ্গ পর্বতে যুধিষ্ঠিরের জন্মলগ্নে যিনি অলক্ষিতে যুধিষ্ঠিরের অন্তরে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন, সেই ধর্ম আজ যুধিষ্ঠিরের অনুযায়ী। যাকে সামনে রেখে, যে ধর্মের আদর্শ সামনে রেখে যুধিষ্ঠির তাঁর সম্পূর্ণ জীবৎকাল অতিবাহিত করেছেন, সেই ধর্ম আজ প্রভুভক্ত কুকুরের মতো তাঁর অনুযায়ী। যখন ভাই-বন্ধু, পুত্র-পরিবার কেউ তাঁর সঙ্গে নেই, তখন তাঁর একাকিত্বের সঙ্গী হয়েছেন স্বয়ং ধর্ম। স্বর্গের আধিপত্যের মূল্যেও তিনি ধর্মকে ত্যাগ করতে পারেন না।

প্রথমেই বলেছিলাম—যুধিষ্ঠির সবাইকে দেখতে পান। ভগবদগীতায় স্থিতধী মুনির যে সম-দৃষ্টির মাহাত্ম্য কীর্তন করা হয়েছে, সেই সম-দৃষ্টির কারণেই শত্রুবৎ ধৃতরাষ্ট্রের প্রতিও তাঁর পিতার মতো শ্রদ্ধা এবং একটি আশ্রিত কুকুরের প্রতিও তাঁর অত্যাগ-দৃষ্টি। শাস্ত্রকার যে বলেছিলেন—কুকুর আর চণ্ডালের প্রতিও পণ্ডিতের দৃষ্টি দেবতা-ব্রাহ্মণের চেয়ে কিছু কম হয় না—শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতা সমদর্শিনঃ। আজ এই স্বর্গারোহণের মুহূর্তে যুধিষ্ঠির দেখালেন যে, তিনি সেই যোগারূঢ় ব্যক্তি, যিনি সম-দৃষ্টির মাহাত্ম্যে একাকী স্বর্গারোহণ করেন, অথচ তিনি সেই সাধারণ মানুষও, যিনি লোকধর্মে মিথ্যা উচ্চারণ করতেও বাধ্য হন। যুধিষ্ঠির হলেন সেই মূর্তিমান প্রয়াস, যিনি জীবনের জটিল-কুটিল চক্রের মধ্যেও যথাসম্ভব সত্যে প্রতিষ্ঠিত থাকতে চান। তিনি সম্পূর্ণ সত্য নন, তিনি সত্যে প্রতিষ্টিত থাকার মূর্তিমতী চেষ্টা, তিনি স্বয়ং ধর্ম নন, তিনি ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকার আজীবন প্রয়াস।

যার সমস্ত জীবনের ওপর দিয়ে বঞ্চনা, লাঞ্ছনা এবং এত বড় একটা যুদ্ধ বয়ে গেছে, সেই সঙ্কুল জীবনের মধ্যেও ন্যায়-নীতি-ধর্মকে সামনে রেখে চলা যে কত কঠিন, তা সবচেয়ে ভাল বোঝা যায় কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের দার্শনিক পটভূমিকায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ বলে পরিচিত, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমি ধর্মক্ষেত্র বলে পরিচিত এবং যুধিষ্ঠির নিজে ধর্মরাজ। কথাটা একটু বুঝিয়ে বলতেই হবে।

মহাভারতের আদিপর্বে একবার, উদ্যোগপর্বে আরেকবার যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে বলা হয়েছে—যুধিষ্ঠির এক ধর্মময় মহাবৃক্ষের মতো এবং এই মহাবৃক্ষের কাণ্ড হলেন অর্জুন। মহাবলী ভীমসেন এই বৃক্ষের শাখা, নকুল-সহদেব এই বৃক্ষের পুষ্প-ফল, আর বৃক্ষের মূল-স্বরূপ হলেন কৃষ্ণ, যিনি জ্ঞান (গো-পৃথিবী, জ্ঞান) এবং ব্রাহ্মণ্যের ধারক—গোব্রাহ্মণহিতায় চ। লক্ষণীয় অন্য সকলে, এমনকী কৃষ্ণও এই বৃক্ষের একটি অঙ্গ মাত্র, কিন্তু সম্পূর্ণ মহাবৃক্ষটিই হলেন যুধিষ্ঠির অর্থাৎ ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব এবং কৃষ্ণও ধর্মময় যুধিষ্ঠিররূপী মহাবৃক্ষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।

ভারতবর্ষের ‘ধর্ম’ অথবা আরও পরিষ্কার করে বলি হিন্দুধর্ম—ফুল, বেলপাতা, নৈবেদ্যের ধর্ম নয়, শাক্ত-বৈষ্ণব অথবা পাশুপুতের ধর্ম নয়, এই ধর্ম হল জীবন, যা সমস্ত মানুষকে ধারণ করে, সমস্ত মানুষের মঙ্গল করে। স্মরণ করুন যুধিষ্ঠিরের কথা। যুদ্ধোদ্যোগের পূর্বে তিনি সঞ্জয়ের মাধ্যমে কুরুবাড়ির সবার উদ্দেশে তাঁর শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রথমে দুর্যোধন-দুঃশাসন ইত্যাদি সবার কুশল প্রশ্ন করেছেন, কর্ণ শকুনিও এই শুভেচ্ছার অন্তর থেকে বঞ্চিত নন। ধৃতরাষ্ট্রের রাষ্ট্রযন্ত্রের অধিকারী মন্ত্রী, অমাত্য, গজারোহী, অশ্বারোহী পুরুষ থেকে আরম্ভ করে দারোয়ান পর্যন্ত সবার মঙ্গল কামনা করেছেন যুধিষ্ঠির।

আমরা এখনও পর্যন্ত এই মঙ্গলপ্রশ্নে আশ্চর্য হচ্ছি না। এমনকী আশ্চর্য হচ্ছি না—যুধিষ্ঠির যখন সঞ্জয়কে বললেন—কুরুবাড়ির বৃদ্ধা স্ত্রীলোক যারা, তাঁদের আমরা মায়ের সমান দেখি। সঞ্জয় তুমি সেই বৃদ্ধা মায়েদের জিজ্ঞাসা কর—তাঁদের ছেলেরা তাঁদের সঙ্গে নরম ব্যবহার করে তো? তাঁদের ছেলেরা সবাই সুখে বেঁচে আছে তো? তারপর বোলো—যুধিষ্ঠির তার ছেলেপিলে নিয়ে ভালই আছে। লক্ষণীয়, একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক সংসারে কীসের আশায় বেঁচে থাকেন, যুধিষ্ঠির তা জানেন। একই রকমভাবে জানেন রাজরানিরা কীসের আনন্দে বেঁচে থাকে। যুধিষ্ঠির বলেছেন—সঞ্জয়! রাজরানিদের কুশল জিজ্ঞাসা করে বোলো—তাঁরা তাঁদের বিলাসদ্রব্য প্রসাধন-সুরভি ঠিকঠাক পান তো? শ্বশুরদের সঙ্গে তাঁদের সুসম্পর্ক আছে তো? যুধিষ্ঠির জানেন, অত্যন্ত আধুনিকভাবে জানেন যে, ওই একটি জায়গায় রাজরানিদেরও অসন্তুষ্টির কারণ ঘটে। কিন্তু পুত্রবধু-স্থানীয়দের কাছে শ্বশুরপ্রতিম যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত—মায়েরা সব। যুধিষ্ঠির তোমাদের ওপর খুব খুশি আছেন।

সংসারের এই বড় বড় সম্পর্কগুলি সম্পর্কে সবারই খেয়াল থাকে বলে যুধিষ্ঠিরের কুশল-পৃচ্ছায় এ পর্যন্তও আমরা আশ্চর্য হইনি। কিন্তু কুরুবাড়ির উঠোনে খেলে বেড়ায় সেই বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলি। যুধিষ্ঠিরের কল্পনার চোখে এখন তারা বড় হয়ে উঠেছে। যুধিষ্ঠির সঞ্জয়কে বললেন—তুমি তাদের ঘরে গিয়ে আমারই মতো জড়িয়ে ধরে বলবে—তোমরা সবাই একটা করে মনের মতো বর পাও—কল্যাণা বঃ সন্তু পতয়ো’নুকূলাঃ। কিন্তু এবার কী বলব? কী সাংঘাতিক পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা এই ধর্মশুদ্ধ ব্যক্তিটির। কীরকম সর্বাশ্লেষী তাঁর হৃদয়বৃত্তি। এবার যুধিষ্ঠির বললেন—যাদের দেখতে ভাল লাগে, যাদের কথা শুনতে ভাল লাগে, খুব গয়না পরে, খুব সাজে, সেই সুখশালিনী সেই বেশ্যাদের কাছে গিয়েও আমার হয়ে কুশল জিজ্ঞাসা কোরো বেশস্ত্রিয়ঃ কুশলং তাত পৃচ্ছেঃ।

যেখানে রাজবাড়ির দারোয়ানদেরও খবর নিয়েছেন যুধিষ্ঠির, সেখানে কুরুবাড়ির দাস-দাসীদের শুভেচ্ছা-আশীর্বাদ জানানোটাও যুধিষ্ঠিরের পক্ষে আশ্চর্য কিছু নয়। কিন্তু রাজধানী ছেড়ে চলে আসবার সময় যে সমস্ত অঙ্গহীন, কানা, খোঁড়া, বামন আর গরিব লোকদের ঝোপড়ি বেঁধে রাজপথের প্রান্তে পড়ে থাকতে দেখেছেন যুধিষ্ঠির, তারা সবাই তাদের পুরনো জায়গাতেই বহাল আছে কিনা, দুর্যোধনের কাছ থেকে তারা অন্নবস্ত্রের সংস্থান লাভ করে কিনা, সে সম্বন্ধে বিলক্ষণ চিন্তা আছে যুধিষ্ঠিরের—ক্কচিদ্ বৃত্তির্বর্ততে বৈ পুরাণী, ক্কচিদ্ ভোগান্ ধার্তরাষ্ট্রো দদাতি। অন্ধ যারা, বধির যারা—রাজমিস্ত্রী, ছুতোর, চর্মকার—যারা হাতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে—অন্ধাশ্চ সর্বে বধিরাস্তথৈব/ হস্তাজীবা বহবো যে’ত্র সন্তি—তাদের উদ্দেশে যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য—তোমাদের কুৎসিত কাজ করতে হয় বলে কোনও দুঃখ যেন মনে না থাকে। হয়তো পূর্বজন্মের পাপ ছিল কিছু তার শোধ দিতে হচ্ছে তোমাদের। কিন্তু তাই বলে দুঃখ রেখো না মনে—মা ভৈষ্ট দুঃখেন কুজীবিতেন।

ভাবতে পারেন, যে যুধিষ্ঠিরকে আমরা ব্রাহ্মণ্য, জ্ঞানচর্চা আর সত্যের মহিমায় ভাস্বর দেখেছি, তাঁর কাছে অন্ধ, বধির, বেশ্যাদের দুঃখও কিছু কম নয়। এই সর্বাশ্লেষী দৃষ্টিই কিন্তু যুধিষ্ঠিরের ধর্ম। যুধিষ্ঠির এই ধর্মের প্রতিষ্ঠা করতে চান জগতে। বিপ্রতীপভাবে দুর্যোধন হলেন লোভ, অহঙ্কার আর অভিমানের প্রতীক। যুধিষ্ঠির সেই সর্বনাশা বৃত্তিগুলো রোধ করে সর্বশ্লেষী মঙ্গলের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু মুশকিল হল—লোভ-মোহ-অহঙ্কারের রাজ্যটাকে মিষ্টি কথা আর সাধুবাদে বিধ্বস্ত করা যায় না। তারা মঙ্গলের রাজ্য ইন্দ্রপ্রস্থটাও পাশার চালে দখল করে বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করে। সেই সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে গেলেও একটা প্রলয়ের মতো ধ্বংস দরকার। সেই ধ্বংসই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ।

এই যুদ্ধে যুধিষ্ঠির আছেন, কিন্তু তিনি যুদ্ধ করতে পারেন না। তাঁর ধর্মরাজ্যের বিস্তার সুগম করে দেয় অনুরূপ ক্ষাত্রশক্তি, যে শক্তি কল্যাণের জন্য লড়াই করে। এই যুদ্ধের মূল অবলম্বন তাই অর্জুন এবং ভীম। অর্জুনের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের সম্পর্ক শুধু ভ্রাতার নয়, শিষ্যের—ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য। অহঙ্কারের প্রতীক দুর্যোধনকে ধ্বংস করতে গেলে অর্জুনের মতো পরিশীলিত ক্ষাত্র-শক্তিতে কাজ হয় না, তার জন্য দরকার উদ্দাম প্রলয়—যা ভীমের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়। লক্ষ করে দেখবেন—ভীম যেমন যুধিষ্ঠিরকে মেনে চলেন, তেমনই তিনি অর্জুনকেও মেনে চলেন। তিনি উদ্দাম রাজদণ্ড—রাশ ছেড়ে দিলেই ছারখার করে দেবেন সব। ধর্মশুদ্ধ যুধিষ্ঠির তাই ভীমকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, তাঁর নিয়ন্ত্রণ বাঁধা আছে পরিশীলিত ক্ষাত্রশক্তির প্রতীক মহাভারতের নায়ক ‘রাজা’ অর্জুনের হাতে। অর্জুনের মাধ্যমেই জগতে ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়। অর্জুন নিজে তথাকথিত রাজা হবেন না, তিনি ধর্ম ফিরিয়ে এনে ধর্মকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করেন—রাজা থেকে আরম্ভ করে ক্ষুদ্র সৈনিক চলতে থাকে সেই ধর্মের শাসন অনুসারে।

কৃষ্ণ হচ্ছেন ধর্মময় যুধিষ্ঠিররূপী বৃক্ষের মূল। দুষ্টের বিনাশ আর শিষ্টের পালনের জন্য তাঁর আবির্ভাব। রাজসূয়যজ্ঞের আগে থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের উদ্যোগ পর্যন্ত তিনি বৃক্ষমূলের রস-সঞ্চার করেন সমস্ত ধার্মিক লোকের অন্তরে। শান্তি-সন্ধির বার্তা বহন করেন শত্রুর কাছেও। কারণ তাঁরও কাজ অধর্মের গতি রুদ্ধ করে ধর্ম ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তিনি নিজের হাতে তা করেন না, রাজা বা নায়কের মাধ্যমে তা করেন। অর্জুন সেই রাজার স্বরূপ, নায়কের স্বরূপ। ক্ষাত্রবৃত্তির কেন্দ্রস্থলে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কৃষ্ণ সেই রাজাকে উপদেশ দেন ভগবদ্‌গীতা। তাঁর সারথি হয়ে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেন যুদ্ধ করবার জন্য। সমাজকে ধারণ করার কাজ ব্রাহ্মণদের। তাঁরা ধর্মের কথা বলেন, ধর্মকে রক্ষা করতে চান। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের তাই এত মাখামাখি। জাতিবর্ণের বিচারেও যুধিষ্ঠিরকে ক্ষত্রিয় না বলে ব্রাহ্মণই বলা উচিত। তবে দোহাই আপনাদের এখানে ব্রাহ্মণ শব্দের অর্থ একটি পৈতে এবং সমাজের চরম সুবিধা-ভোগী শ্রেণীমাত্র বুঝবেন না। এখানে ব্রাহ্মণ্যের অর্থ সর্বাশ্লেষী সেই ধর্ম, বিশ্বজনের হিতবৃত্তি।

‘গো’ মানে পৃথিবী এবং জ্ঞান, দুয়ে মিলে ব্রাহ্মণ্য। ব্রাহ্মণ্যের হিতের জন্য কৃষ্ণ অর্জুনের মতো পরিশীলিত ক্ষাত্র-শক্তিকে ব্যবহার করেন। আর অর্জুন তাঁর পরিশীলনের মাধ্যমে অপরিশীলিত ক্ষাত্র-শক্তি ভীমকে নিয়ন্ত্রণও করেন আবার প্রয়োজনে তার রাশ ছেড়ে দেন ধ্বংসের জন্য—যে ধ্বংসের মধ্য থেকে নতুন এক সমাজ, নতুন এক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। সেই রাষ্ট্র এবং সমাজের আদর্শ হল ধর্ম। ধর্মময় যুধিষ্ঠিরের অভিষেক হয় সেই রাষ্ট্রে—যেখানে রাজরানি থেকে কিশোরী বালিকাটি তার প্রার্থিত বস্তুটি লাভ করবে, যেখানে রাজ্যের সেনাপতি থেকে আরম্ভ করে অন্ধ-বধির পর্যন্ত সক্ষমতা এবং অক্ষমতার বৃত্তি লাভ করবে, যেখানে পুরাতন ধ্বংসের সজীব-অবশিষ্ট ধৃতরাষ্ট্রের জন্যও এমন ব্যবস্থা করা হয়, যাতে তাঁরও মনে হয়—তিনি আগের মতোই আছেন—বিজহার যথা পূর্বং ঋষিভিঃ পর্যুপাসিতঃ। পুরাতনের সঙ্গে নতুনের পরম্পরা যুধিষ্ঠিরের দৃষ্টিতে এই রকমই। যুধিষ্ঠির তাই ভারতবর্ষের পুণ্যভূমিতে ধর্মময় এক মহীরুহ।