ভীম – ৩

বৈদিক ইন্দ্র দেবতা এবং বায়ু দেবতা সম্বন্ধে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা জানেন যে, বেদে ইন্দ্রেরই শ্রেষ্ঠত্ব সূচিত হয়েছে। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। বেদে বায়ু দেবতা সব সময়েই ইন্দ্রের সাহায্যকারীর ভূমিকায় আছেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং শত্রুর ওপর আঘাত হানার সময় বায়ু ইন্দ্রকে সাহায্য করেন—এটাই ইন্দ্রের আর বায়ুর বৈদিক পরিচিতি।

মাদাম বিয়ার্দো নামে এক ফরাসি বিদুষী ইন্দ্র আর বায়ুর এই বৈদিক ভূমিকাটি মহাভারতের অর্জুন এবং ভীমের ওপর চাপিয়েছেন। অর্জুন ইন্দ্রের পুত্র, ভীম বায়ুর পুত্র। মহাভারত যেহেতু বৈদিক যুগের অব্যবহিত পরেই লেখা হয়েছে, তাই মহাকাব্যের অর্জুন চরিত্রের মধ্যে বৈদিক বীরশ্রেষ্ঠ ইন্দ্রের এবং ভীমের মধ্যে বায়ুর সাহায্যকারীর ভূমিকার ছায়াপাত ঘটাটা অসম্ভব কিছু নয়। অন্তত এই বিদুষী ফরাসিনীর তাই ধারণা।

মহাভারতের মধ্যে অর্জুন প্রথম যে প্রকাশ্য যুদ্ধটি জয় করেছিলেন, সেই যুদ্ধটা হয়েছিল অর্জুন আর দ্রুপদের মধ্যে। দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে শিষ্যদের কাছে চেয়েছিলেন—পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে তারা জ্যান্ত ধরে আনুক, অন্য কিছু নয়। দুর্যোধন-কর্ণ সহ সমস্ত কৌরব দ্রুপদকে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এই সময়ে অর্জুন, নকুল এবং সহদেবকে সাধারণ সাহায্যে লাগিয়ে ভীমকে প্রধান সহায় করে যুদ্ধযাত্রা করলেন। ভীম গদা হাতে সৈন্যদের আগে আগে চললেন—সেনাগ্রগো ভীমসেনঃ।

ভীমকে দেখাচ্ছিল দণ্ডধারী যমের মতো। জলজন্তু যেমন স্বচ্ছন্দে সমুদ্রের একান্তে প্রবেশ করে ভীমও তেমনই স্বচ্ছন্দে ঢুকে পড়লেন পাঞ্চাল-সৈন্যের মধ্যে। এলোপাথাড়ি গদা চালিয়ে যুদ্ধ-দুর্মদ হাতিগুলির মাথা ফাটিয়ে দিলেন। ঘোড়া আর রথগুলিও ভীমের গদার বাড়ি থেকে রেহাই পেল না। রাখাল যেমন পাচনি হাতে করে বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে গরুগুলিকে চাবুক মারতে মারতে এগিয়ে যায়, ভীম ঠিক ততটাই সহজে গদার বাড়ি কশাতে কশাতে এগিয়ে চললেন শত্রু সৈন্যের মাঝখান দিয়ে—গোপাল ইব দণ্ডেন যথা পশুগণান্ বনে।

ভীমের সঙ্গে দণ্ডধারী যম আর দণ্ডধারী গোপালকের তুলনাটা আমার কাছে খুবই অর্থবহ। তবে সে কথা বলার আগে সেই বিদেশিনী মাদাম বিয়ার্দোর আরও একটা কথা বলে নিই। আমাদের দেশে প্রাচীনকালে যে বর্ণবিভাগ পদ্ধতি চালু ছিল, মাদাম তারও একটা প্রতিফলন দেখতে পেয়েছেন পাঁচ পাণ্ডবের মধ্যে।

এটা মানতে কোনও বাধা নেই যে, যুধিষ্ঠির খাতায়-কলমে যতই ক্ষত্রিয় হন না কেন, স্বভাবে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ। ইতিহাসে-পুরাণে ব্রাহ্মণের যে সব গুণ বা ক্রিয়াকলাপ সচরাচর দেখা যায়—তা সবই প্রতিষ্ঠিত দেখি যুধিষ্ঠিরের মধ্যে। মাদাম বিয়ার্দোর ভাষায়—Yudhisthira, though a Ksatriya on the most superficial level of the story, represents some characteristic features of the brahmana. ভীম আর অর্জুনের সঙ্গে একদিকে যেমন তাঁদের বড় ভাই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের পার্থক্য আছে, তেমনই পার্থক্য আছে ছোট দুই ভাই নকুল-সহদেবের সঙ্গেও। আবার ওই যে দুই ভাই ভীম আর অর্জুন—তাঁরাও কিন্তু শক্তি আর ক্ষমতার চরিত্রভেদে পরস্পর পরস্পরের থেকে আলাদা।

যুধিষ্ঠির যেখানে ন্যায়, সত্যনিষ্ঠা, ক্ষমা, ধৈর্য এবং সর্বোপরি ধর্মের প্রতীক, সেখানে আসলে তিনি একজন ব্রাহ্মণের প্রতিনিধি। কারণ উপরিউক্ত গুণগুলি একজন আদর্শ ব্রাহ্মণেরই গুণ। বলা বাহুল্য—যে, ব্রাহ্মণ অথবা ব্রাহ্মণ্য বলতে আমি অদ্যকালের মহামহিম ঐতিহাসিকদের ‘ব্রাহ্মণ’ বা ‘ব্রাহ্মণ্য’ বোঝাচ্ছি না। কারণ ব্রাহ্মণ শব্দটি উচ্চারণমাত্রেই এঁরা সমাজের নিপীড়নকারী এক উচ্চ বর্ণ বোঝেন অথবা ব্রাহ্মণ্য বলতে শুধুই ‘বুর্জোয়াসি’। আমি ওপরে যে গুণগুলির কথা বলেছি সেই গুণগুলি একান্তভাবে ব্রাহ্মণোচিত বলে শাস্ত্রে নির্দিষ্ট হয়েছে বলে সেই নিরিখেই যুধিষ্ঠিরকে আমরা ধর্মের প্রতীক এক ব্রাহ্মণের লক্ষণে ভূষিত দেখতে পেয়েছি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠার অর্থ তাই ধর্মের প্রতিষ্ঠা, ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠা, সত্য, ক্ষমা বা ন্যায়ের প্রতীকী প্রতিষ্ঠা।

এই ব্রাহ্মণোচিত ধর্মকে ব্রাহ্মণ প্রতিষ্ঠা করেন না ; করেন ক্ষত্রিয়, করেন রাজা। ভীম আর অর্জুন সেই ক্ষাত্রশক্তির প্রতীক, রাজার প্রতীক। পৃথিবী কর্মভূমি। স্বর্গ বা অন্তরীক্ষলোকে সত্য বা ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন ইন্দ্র। তিনি দেবতাদের রাজা। বেদে ইন্দ্র এবং বায়ু—দুজনেই যুদ্ধবীর, যুদ্ধের দেবতা। ‘ক্রুড’ যে ক্ষাত্রশক্তি, তারই প্রতীক হলেন ভীম। আর ‘রিফাইনড’ রাজার যে ক্ষাত্রশক্তি, তার প্রতীক হলেন অর্জুন। রাজা যতই ‘রিফাইনড’ হন অন্যায়ের চুড়ান্ত হলে নৃশংস ক্ষাত্রশক্তি ছাড়া তাঁর পক্ষে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। ভীষণ যুদ্ধের সময়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আঘাত হানার সময় ভীমকে তাই সব সময়েই অর্জুনের পাশে দেখেছি সাহায্যকারীর ভূমিকায়। ভীম যেমন যুধিষ্ঠিরের বশংবদ তেমনই—ছোট ভাই হওয়া সত্ত্বেও—অর্জুনেরও বশংবদ।

এই যে দুই ভাই মিলে দ্রোণাচার্যের মান রক্ষার জন্য পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে শাসন করতে চললেন—এখানে অর্জুন রথে চড়ে চলেছেন রাজার মতো। অস্ত্রপরীক্ষার দিনের সেই পাখির চোখের মতো তাঁর একমাত্র লক্ষ্য দ্রুপদকে জ্যান্ত ধরা। কিন্তু ‘ক্রুড’ ক্ষাত্র শক্তির প্রতীক, নৃশংসতার প্রতীক ভীম, যুদ্ধের প্রান্তরে নেমে এলোপাথাড়ি গদা চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। নিরীহ অথবা দোষী—এসব বিচার তাঁর কাছে নেই, তাঁর মূল কথা তাঁকে বাধা দেওয়া চলবে না। অর্জুন হয়তো এই এলোপাথাড়ি ভাবটা পছন্দ করেন না, কিন্তু এই মুহূর্তে তার প্রয়োজন আছে বলে বাধাও দেন না। ফলে ভীম বাড়তেই থাকেন, এগিয়ে যেতে থাকেন বিনা বিচারে। কারণ শত্রু সৈন্যের মধ্যে সাময়িক বিভীষিকা তৈরি করার প্রয়োজন অর্জুনেরও আছে।

কিন্তু যে মুহূর্তে রাজ-স্বভাব অর্জুনের কার্যসিদ্ধ হয়ে যায় অর্থাৎ দ্রুপদকে তিনি ধরে ফেলেন, সেই মুহুর্তে তাঁর মুখ দিয়ে সবিনয় আদেশ নেমে আসে বড়ভাই ভীমের উদ্দেশে। তিনি বলে ওঠেন—আর্য ভীম! মহারাজ দ্রুপদ, বংশ-সম্বন্ধে কুরুবীরদের আত্মীয়। আপনি আর অযথা তাঁর সৈন্যক্ষয় করবেন না—মা বধীস্তদ্বলং ভীম গুরুদানং প্রদীয়তাম্—আপনারা গুরুদক্ষিণার ব্যবস্থা করুন।

ঠিক এই মুহূর্তে আমরা ভীমের সম্বন্ধে পূর্বে উল্লিখিত সেই উপমা দুটি স্মরণ করব। দন্ডধারী যমের মতো, আর দণ্ডধারী গোপালকের মতো। আমার মতে অর্জুন যদি রাজপ্রতিম হন তবে ভীম তাঁর দণ্ডের মতো। মনুমহারাজের মতো স্মৃতশাস্ত্রকারেরা লিখেছেন—রাজদণ্ড এমনই একটা প্রখর বস্তু যা দণ্ড-প্রণেতার অনবধানে সমস্ত কিছু ছারখার করে দিতে পারে। রাজা সব সময় বিপক্ষ ব্যক্তির শক্তি, বিদ্যা এবং অন্যান্য গুণাগুণ মাথায় রেখে দণ্ড প্রয়োগ করবেন। ভীম যেহেতু ‘ক্রুড’ ক্ষাত্রশক্তির প্রতীক, তাই তাঁর দণ্ড-বিধানের মধ্যে পরিমিতির বোধ থাকে না। তাঁর দণ্ড একবার মুক্ত হলে, তা সব কিছু শেষ করে নিয়ন্ত্রিত হতে চায় না। রাজা বা পরম যুদ্ধবীর হিসেবে অর্জুনের কাজ হল এই ‘ক্রুড’ ক্ষাত্রশক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করা। নৃশংসতা বা সাময়িক বিভীষিকা দেখানোর প্রয়োজন মিটতেই পরিণত ক্ষাত্রশক্তি তাই যমদন্ড-স্বরূপ নৃশংস ক্ষাত্রশক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করছে—আপনি অযথা দ্রুপদের সৈন্যক্ষয় করবেন না। মহাভারতের মধ্যে ভীমকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা বারবার অর্জুনকে এই নিয়ন্তার ভূমিকায় দেখতে পাব। এসব কথা পরে আবার আসবে।

আপাতত ভীমকে দেখুন। অর্জুনের আদেশের মতো অনুরোধে ভীম থামলেন বটে,—কারণ, অর্জুনের ওই বিশাল ব্যক্তিত্ব তাঁর পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না—কিন্তু ভীম তাঁর যুদ্ধ-ধর্মে তৃপ্ত না হয়েই যুদ্ধে ক্ষান্তি দিলেন—অতৃপ্তো যুদ্ধধর্মেষু ন্যবৰ্তত মহাবলঃ। অপরিশীলিত ক্ষাত্রশক্তি পরিণত রাজশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে সে ভীমের মতো থামতে বাধ্য হয় বটে, কিন্তু তার দুর্দম মনোলোকের নৃশংসতা যেহেতু বল্গাহীনভাবে নৃশংসতার আনন্দেই মুক্ত হয়েছিল তাই হঠাৎ নিয়ন্ত্রিত হলে ছুটন্ত ঘোড়া যেমন বিকট শব্দে চিঁ-হিঁ-হিঁ করে খানিকটা দাপিয়ে থেমে যায়, ভীমও সেই রকম থেমে গেলেন। কিন্তু মনের মধ্যে ছোটাটা রয়েই গেল, সুযোগ পেলেই সে ছুটবে।

বলা বাহুল্য, অপরিশীলিত অথবা অনিয়ন্ত্রিত ক্ষাত্রশক্তির প্রয়োজনীয়তার কথাও আমরা উল্লেখ করেছি। বস্তুত এই ধরনের শক্তির মধ্যে যে বিশাল উৎসাহ, বিপুল দৈহিক শক্তি এবং বিরল কর্মক্ষমতা থাকে, তাকে কাজে লাগালে কী অসাধারণ ফল পাওয়া যেতে পারে মহাভারতের ভীমই বোধহয় তার প্রথম এবং শেষ উদাহরণ। আমরা একে একে তাঁর নিয়ন্ত্রণের জায়গাগুলিও দেখাব, অনিয়ন্ত্রণের জায়গাগুলিও দেখাব।

একটা কথা এখানে বলে নেওয়া ভাল যে, প্রধানত ভীম আর অর্জুনের শক্তির নিরিখেই দ্রুপদ শাসনের এক বছরের মাথায় ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজের পদ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভীম অবশ্য এই সময়ে একটু ‘হায়ার স্টাডিজে’ মন দিলেন। তিনি নিয়মিত গদাশিক্ষা করতে আরম্ভ করলেন বলরামের কাছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা—দ্রোণাচার্য যেহেতু প্রধানত তীর-ধনুকের শিক্ষাতেই কৃতবিদ্য ছিলেন, তাই ভীমের দিক থেকে গদা-শিক্ষার নূতনতর কৌশল আয়ত্ত করার একটা তাগিদ ছিল। এই কারণেই বলরামের কাছে তিনি নিয়মিত গদাঘাতের পাঠ নিতে আরম্ভ করলেন—সংকর্ষণাদ্ অশিক্ষদ্ বৈ শশ্বচ্ছিক্ষাং বৃকোদরঃ।

ভীমের অমানুষিক শক্তি এবং অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষার পরাকাষ্ঠায় দুর্যোধন যেমন জ্বলে-পুড়ে মরছিলেন, ধৃতরাষ্ট্রও তেমনই জ্বলে যাচ্ছিলেন। ফলে পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠিয়ে দুর্যোধন যখন তাঁদের পুড়িয়ে মারবার পরিকল্পনা করলেন, ধৃতরাষ্ট্রও তাতে বাধা দিলেন না। পাণ্ডবরা বারণাবতে পোঁছে দশ দিন একটা অন্য বাড়িতে থাকলেন। দুর্যোধনের চর পুরোচন বারণাবতের জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারবার ভার নিয়েছিল। সে দশ দিন পাণ্ডবদের অন্য বাড়িতে রেখে বেশ সাধু-সাধু ভাব করে বললে—এখানে ‘শিবভবন’ বলে একটা দারুণ বাড়ি তৈরি হয়েছে—সেইখানেই আপনাদের পাকাপাকি থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।

পুরোচনের কথায় পাণ্ডবভাইরা কুন্তীকে নিয়ে শিবভবনে ঢুকলেন। যুধিষ্ঠির বিদুরের কাছে অনেক আগেই এই আগুন-ঘরের ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। এখন বাড়িতে ঢুকেই ঘি-গালা আর চর্বির গন্ধ পেয়ে যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন—যত রকম দাহ্য পদার্থ আছে, তা সবগুলি মিশিয়ে এই বাড়ি তৈরি হয়েছে। সাধাসিধে ভীম বললেন—তা হলে আমরা ভালয় ভালয় সেই বাড়িতেই ফিরে যাই—যেখানে আমরা আগে ছিলাম—তত্রৈব সাধু গচ্ছামো যত্ৰ পূর্বোষিতা বয়ম্। যুধিষ্ঠির অনেকক্ষণ ভীমকে দুর্যোধনের প্যাচ-পয়জার সব বুঝিয়ে দিলেন। বললেন—এই বাড়িতেই আমরা থাকব এবং সময় মতো আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে যাব।

জতুগৃহের বিস্তৃত বিবরণে আমরা যাচ্ছি না। শুধু এইটুকু এখানে বলব যে, বিদুরের পরামর্শমতো যে সুড়ঙ্গটি কাটা হয়েছিল জতুগৃহ থেকে বন পর্যন্ত, সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে মা-ভাইদের আগে বের করে দিয়ে ভীমই সেই জতুগৃহে আগুন লাগালেন এবং নিজে বেরিয়ে গেলেন সবার শেষে। রাত্রির অন্ধকারে মা-ভাইরা পথ চলতে কষ্ট পাচ্ছিলেন। ভীম সেই অবস্থায় মাকে তুলে নিলেন কাঁধে আর ছোট যমজ ভাই দুটিকে নিলেন কোলে। যুধিষ্ঠির আর অর্জুনও ভীমের হাতে ভর দিয়েই চললেন। হয়তো এই বর্ণনার মধ্যে সামান্য অতিশয়োক্তি থাকতে পারে, কিন্তু এটা মিথ্যে নয় যে, অন্য ভাইরা পর্যায়ক্রমে ভীমের শরীরে ভর দিয়েই বনের পথটুকু পাড়ি দিয়েছিলেন।

বিদুরের পরিকল্পনামতো নির্দিষ্ট স্থানে গঙ্গার এক ঘাটে নৌকো বাঁধাই ছিল। সকলে নৌকোয় উঠে অন্য পারে এলেন বটে কিন্তু সেটাও একটা বন এবং রাত তখনও ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। রাতের তারা চিনে তাঁরা দক্ষিণ দিকে চললেন বটে কিন্তু পথ চলার ক্ষমতা প্রায় কারওই নেই। অবস্থা দেখে যুধিষ্ঠির আবার ভীমকে বললেন—তুমি যেভাবে আমাদের নিয়ে পথ চলছিলেন ভীম সেইভাবেই আমাদের নিয়ে চল। আবার কুন্তী উঠলেন কাঁধে, ভাইরাও চললেন ভীমকে জাপটে ধরে।

ভীম পথ চলতে পারতেন খুব জোরে আর চলার পথে গাছের ঘষা কি কাঁটা-গাছের কাঁটায় ভীমের কিছুই হয় না। শরীরে যেমন বল, চেহারাও তেমনই দশাসই। মহাভারতের বর্ণনামত—ফরসা তাল গাছের মতো লম্বা তাঁর চেহারা, অর্জুনের থেকেও তিনি বারো আঙুল লম্বা—গৌরস্তাল ইবোন্নতঃ, প্রাদেশেনাধিকো’র্জুনাৎ। তাই বলে রোগা ঢ্যাঙা নয়, ভীমের কাঁধটা সিংহের মতো, বুকের ছাতি এই বিশাল, গায়ে মত্ত হাতির শক্তি।

ফলে মা-ভাইদের পর্যায়ক্রমে কাঁধে-পিঠে নিয়ে জোরে হাঁটতে তাঁর কোনও সমস্যাই হল না। তবু কষ্ট হল সেই সব জায়গায় যেখানে পথ সমতল নয় আর পাহাড়ের চড়াই-উতরাই যেখানে। এসব জায়গায় ভাইদের ছেড়ে দিলেও মাকে তিনি কাঁধ থেকে নামাননি, নিজের কষ্ট হলেও মাকে কষ্ট পেতে দেননি—কৃচ্ছ্রেণ মাতরঞ্চৈব সুকুমারীং যশস্বিনীম্। এইরকম ভাবে চলতে চলতে এক বনের কাছে এসে তাঁরা থামলেন।

কথায় বলে—ঘোড়া পেলে খোঁড়া হয়। এক জায়গায় যখন তাঁরা সবাই বসার জায়গা পেলেন, তখন পরিশ্রমে পিপাসায় আর ঘুমে তাঁদের চোখ জড়িয়ে এল। জননী কুন্তী বললেন—পাঁচ ছেলের মা হয়ে আজ আমি পিপাসার জল জোটাতে পারছি না। কথাটা হয়তো তিনি অন্য ছেলেদের লক্ষ করেই বলেছেন, কিন্তু তাঁদের তখন নড়বার ক্ষমতা নেই। আর মায়েরা যেমন হন, মাঝে মাঝে বেবুঝের মতো একই কথা বার বার বলতে থাকেন—পুত্ৰান্ ভূশমথাব্রবীৎ।

এইসব জায়গায় ভীমের কোনও তুলনা নেই। মায়ের জন্য ভাইদের জন্য তাঁর বড় মায়া হল। একটা বটগাছের তলায় মা-ভাইদের বসিয়ে ভীম জল আনতে ছুটলেন। সে কি একটুখানি পথ। প্রায় দুই ক্রোশ পথ গিয়ে ভীম দেখলেন—বিশাল জলাশয়। তাঁর নিজের তখন কী অবস্থা। জল দেখা মাত্র আগে ঝাঁপিয়ে খানিকটা স্নান করে নিলেন। তারপর পদ্ম-পাতার পাত্রে জল নিয়ে চারদিক মুড়িয়ে পদ্মের পুটক বেঁধে অনেকগুলি পুটক নিয়ে এলেন গায়ের চাদরে ফেলে।

দুই ক্রোশ পথ! এসে দেখলেন—সব ঘুমিয়ে পড়েছে। মা-ভাইদের এই বিজন বনে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে ভীমের যেমন কষ্ট হল, মায়া হল, তেমনই রাগ হল দুর্যোধনের ওপর। রাজমাতা কুন্তী মাটিতে শুয়ে আছেন, রাজা হবার যোগ্য বড় ভাই যুধিষ্ঠির মাটিতে শুয়ে আছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যোদ্ধা ছোট ভাই অর্জুন মাটিতে শুয়ে আছেন অথবা এখনও কোলে-ওঠা সুন্দর যমজ ভাই দুটি মাটিতে শুয়ে আছেন—এই বিপরীত অবস্থাটা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না।

মনের যন্ত্রণায় তিনি মনে মনেই বলে উঠলেন—ব্যাটা ধৃতরাষ্ট্র! ব্যাটার গণ্ডায় গণ্ডায় বদমাস কতগুলো ছেলে, তার মধ্যে রাজ্যের লোভ, খল স্বভাব, আর স্বার্থসিদ্ধি করতে ওস্তাদ—দুষ্টেনাধর্মশীলেন স্বার্থনিষ্ঠৈকবুদ্ধিনা। ব্যাটা আমাদের নির্বাসন দিয়ে পুড়িয়ে মারবার কৌশল করেছিল। শুধু ভাগ্যিবলে বেঁচে গেছি—কথঞ্চিদ্ দৈবসংশয়াৎ। ভীম মনে মনে বলেই চললেন—আর ওই ব্যাটা দুর্যোধন! তোর ভাগ্যি ভাল এখনও দাদা যুধিষ্ঠির তোকে মেরে ফেলতে বলছে না। নইলে তোর ওই কর্ণ, শকুনি আর ছোট ভাইগুলির সঙ্গে তোকেও আমি কবেই যমালয়ে পাঠাতাম।

রাগের চোটে ভীম হাতে হাত ঘষতে আরম্ভ করলেন। তাঁর নিঃশ্বাস দীর্ঘতর হল। মাটিতে শুয়ে-থাকা শ্রান্ত ক্লান্ত ভাইদের দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে তাঁর রাগ কমেও এল। তাঁর দায়িত্ববোধ এমনই যে, অতটা পথ মা-ভাইদের কোলে পিঠে টেনে এনে তিনি নিজে যখন চরম পরিশ্রান্ত, সেই অবস্থায় তিনি সবার জন্য জল আনতে গেলেন দুই ক্রোশ পথ হেঁটে। আবার এসে যখন দেখলেন—সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছেন, তখন তিনি বিনা কোনও অভিমানেই, সবার সুরক্ষার জন্য জেগে বসে রইলেন—জজাগার স্বয়ং তদা।’