কুন্তী – ১

সবই কপাল গো দিদি, সবই কপাল। কপাল ভাল থাকলে হাজারো দোষ থাকুক, তবু লোকে সুখ্যাত করবে, আর কপালের জোর না থাকলে তার অবস্থাটা হবে ঠিক আমার মতো।

একাধারে দুঃখ, অভিমান এবং ক্রোধ মেশানো এই কথাগুলি শুনে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন অন্যতরা এক মহিলা। জিজ্ঞাসা করলেন—তোর কী এমন কপাল পুড়ল যে, সাত সকালেই বকর-বকর আরম্ভ করেছিস?

আজ থেকে বহুকাল আগে, মহাভারতের যুগ যখন চলে গেছে, শাস্ত্র আর আচারের বিষম বাঁধনে সমগ্র নারী সমাজকে যখন বেঁধে ফেলা হচ্ছে, তখন এই কথোপকথন চলছিল বলে আমরা মনে করি। যে ভদ্রমহিলা কপালের কারসাজি নিয়ে খুব চিন্তিত, তিনি—আর কিছুই নয়, হয়তো দু-একজন পুরুষ-পড়শির সঙ্গে একটু আধটু রসিকতা করে ফেলেছেন, তাতেই পাড়ার পাঁচজনে পাঁচ রকম গল্প বানিয়ে ফেলল। ভদ্রমহিলার নিন্দে হল যথেষ্ট।

তা এ রকম ঘটনা ঘটলে কার না দুঃখ হয়। মনের দুঃখে তথা সময়মতো বাথার ব্যথী আরও এক মহিলাকে সামনে পেয়ে তিনি প্রথমেই পুণ্যবতী পাঁচ কন্যের শিকড় ধরে টান দিলেন। পুণ্যবতী পাঁচ কন্যে মানে—সেই পাতকনাশিনী পাঁচ কন্যে, যাঁদের কথা সকালে উঠেই স্মরণ করতে বলেছেন শাস্ত্রকারেরা—অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।

আমাদের এই মহিলাটি অবশ্য রামায়ণ-বিখ্যাতা অহল্যা, তারা এবং মন্দোদরীকে দয়া করে ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর আক্রমণ এবং আক্রোশ প্রধানত দুজনকে লক্ষ করে—কুন্তী এবং দ্রৌপদী। কাজেই অন্যতরা যখন সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করল—কী এমন হল যে কপালের দোষ দিচ্ছ—তখন তিনি জিহ্বার বাঁধন খুলে মহাভারতের প্রবীণ এবং নবীনা—দুই নায়িকার মুখে ঝামা ঘষে দিলেন। বললেন—কপাল না তো কী? পাঁচ-পাঁচটা পুরুষ মানুষ ওই কুন্তীর সঙ্গে আশনাই করেছে, কামনা করে সঙ্গ দিয়েছে; আর তার ব্যাটার বউ দ্রৌপদী—তাকেও কামনা করেছে পাঁচ-পাঁচটা পুরুষ—পঞ্চভিঃ কামিতা কুন্তী তদ্‌বধূরথ পঞ্চভিঃ। তবু এঁরা হলেন গিয়ে সতী। তা, একে কপাল বলব না তো কী? পোড়া কপাল আমার! লোকেও এদের সতী বলে। তাই বলছিলাম—কপাল থাকলে কীই বা না হয়—সতীং বদতি লোকো’য়ং যশঃ পুণ্যৈরবাপ্যতে।

বলতে পারেন—এ আমার ভারী অন্যায়। মহাভারতের এক প্রবীণ নায়িকার চরিত-কথা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রথমেই এমনভাবে কথাটা আরম্ভ করলাম যাতে কুন্তীর মর্যাদা লঙ্ঘিত হতে পারে। অন্তত অনেকেই তাই ভাববেন। তবে আমার দিক থেকে সাফাই গাইবার দুটো রাস্তা আছে। এক প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর হয়তো বা উপরিউক্ত সংস্কৃত শ্লোকটি দেখে উৎসাহিত হয়েই কুন্তীর সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে মহামতি বঙ্কিমচন্দ্রের গালাগাল খেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর ‘কবিরত্নপ্রকরণে’ লিখেছিলেন— “কোনও সম্পন্ন ব্যক্তির বাটীতে মহাভারতের কথা হইয়াছিল। কথা সমাপ্ত হইবার কিঞ্চিৎ কাল পরেই বাটীর কর্তা জানিতে পারিলেন, তাঁহার গৃহিণী এবং পুত্রবধু ব্যভিচারদোষে দূষিতা হইয়াছেন। তিনি, সাতিশয় কুপিত হইয়া তিরস্কার করিতে আরম্ভ করিলে, গৃহিণী উত্তর দিলেন, আমি কুন্তী ঠাকুরাণীর, পুত্রবধু উত্তর দিলেন, আমি দ্রৌপদী ঠাকুরাণীর দৃষ্টান্ত দেখিয়া চলিয়াছি। …তাঁহারা প্রত্যেকে পঞ্চ পুরুষে উপগতা হইয়াছিলেন; আমরা তদতিরিক্ত করি নাই।”

বিদ্যাসাগরের এই উপাখ্যান প্রসঙ্গে বঙ্কিমের বক্তব্য ছিল—“এরূপ উপাখ্যান বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লিপিকৌশলেও সরস হয় নাই, অথবা তাঁহার নামের বা বয়সের গুণেও নীতিগর্ভ বা ভদ্রলোকের পাঠ্য বলিয়া গৃহীত হইবে না।”

দুই বিশাল ব্যক্তিত্বের এই তকাতর্কির নিরিখে বলতে পারি যে, চিরকালীন গৌরবের তিলক-আঁকা ব্যক্তি সম্বন্ধে অন্যথা ভাবনা অন্য সজ্জনের কটুক্তির কারণ ঘটায়। কুন্তীর সম্বন্ধে প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর মশাই কিছু অন্যথা লিখলেও বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তবে আমার কথারম্ভে বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তির পূর্ব-আলোচনা থাকায় আমার চপলতা কিছু কমে। আমার দ্বিতীয় সাফাইটা অন্য। সেটা হল—আমরা এমন একটা চরিত্র সম্বন্ধে কথা আরম্ভ করেছি, যিনি কোনও এলেবেলে ছিঁচকে সাহিত্যের নায়িকা নন। দ্রৌপদীকে বাদ দিলে মহাভারতের মতো বিরাট কাব্যের প্রথম ভাগের নায়িকা তো কুন্তীই। যিনি মহাকাব্যের নায়িকা হবেন, সঙ্গতভাবেই তাঁর চরিত্রের বিচিত্র দিক থাকবে এবং সেই চরিত্রের এদিক-সেদিক নিয়ে নানা জনে নানা প্রশ্নও তুলবে। সে সব প্রশ্ন ঠিক কি না এবং ঠিক হলে কতটা ঠিক, বেঠিক হলেই বা কতটা বেঠিক—সেটা কুন্তী-চরিত্রের আলোচনার পরিসরে আমাদের ভাবতেই হবে। ভাবতে হবে—আরও এমন কিছু আছে কিনা যাতে করে কুন্তী-চরিত্রের ধূলিমলিন অংশগুলি ধুয়ে মুছে যেতে পারে। দেখুন, মহাকাব্যের নায়িকারা কেউ আকাশ থেকে পড়া কল্পলোকের বাসিন্দা নয়। দোষে-গুণে তাঁরাও আমাদের মতো মানুষই। তবে কিনা তাঁদের চরিত্রে এমন মনোহরণ কতগুলি ‘বিশেষ’ আছে, যাতে তাঁরা আমাদের দৈনন্দিনতা অতিক্রম করে মহাকাব্যের রসোত্তীর্ণা নায়িকাটি হয়ে উঠেছেন। কুন্তী সেই হাজারো বিশেষ-থাকা এক নায়িকা। অথচ এমনিভাবে দেখতে গেলে আমাদের দেশে কত শত বিধবা পাবেন, যাঁরা বাপের বাড়ি, শ্বশূরবাড়ি কোথাও সুখে থাকেননি, স্বামীর সুখ পাননি, ছেলের সুখও পাননি—এখন মরার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এমনিতে কুন্তীও সেই রকম। এতই সাধারণ। কুন্তীর নিজের মুখেই কথাটা শুনুন।

কুন্তী এখন জীবনের চরম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে। বারো বছর ছেলেরা বনে বনে ঘুরে বেড়িয়েছে, এক বছর তাঁদের কাটাতে হয়েছে লুকিয়ে-চুরিয়ে, নিজেদের গোপন করে। তেরো বছর পর আবার দুর্যোধন তাঁদের রাজ্যপ্রাপ্তির অধিকার অস্বীকার করেছেন। এবার কৃষ্ণ এসেছেন দুর্যোধনের কাছে পাঁচ পাণ্ডবভাইয়ের জন্য পাঁচখানা গ্রাম যদি অন্তত পাওয়া যায়। কৃষ্ণ এসে বিদুরের সঙ্গে পূর্বেই কথা বলেছেন। এখন বিকেলবেলায় সাঁঝের আঁধার যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন তিনি উপস্থিত হয়েছেন নিজের পিসি কুন্তীর কাছে—নতমুখ, লজ্জায় ম্লান। এক মুহূর্তে সারা জীবনের সমস্ত ক্ষোভ এক জায়গায় জড়ো করে কুন্তী ছেলেদের কুশল জানতে চাইলেন। ছেলে, ছেলের বৌ, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর সবার সম্বন্ধে কথা বলে কুন্তী এবার কৃষ্ণের কাছে নিজের গোপন করুণ কথাটা এক নিঃশ্বাসে বললেন। বললেন নিজের ভাইয়ের ছেলে কৃষ্ণের কাছে; তিনি ঘরের লোক এবং ঘরের কথা সব জানেন। কৃষ্ণ নইলে, নিজের গভীর অন্তরের কথাটা মহাকাব্যের প্রবীণা নায়িকার মুখ থেকে এমন করে বেরত কিনা সন্দেহ!

কুন্তী বললেন—বাপেরবাড়ি বলো আর শ্বশূরবাড়ি বলো—কোনও জায়গাতেই আমার কপালে সুখ লেখা ছিল না। দু জায়গাতেই আমার জুটেছে লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা—সাহং পিত্রা চ নিকৃতা শ্বশুরৈশ্চ পরন্তপ। এই শ্লোকের মধ্যে কুন্তী জন্মদাতা বাবার কথা বলেছেন, যে বাড়িতে এসে তিনি কুন্তী হলেন, সেই বাড়ির কর্তা তাঁর পালকপিতা মহারাজ কুন্তিভোজের কথা বলেননি। আর বলেছেন শ্বশূরদের কথা—অর্থাৎ শ্বশূর এখানে একজন নয়। অনেকগুলি শ্বশূর বা শ্বশূরস্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁর দুঃখের জন্য দায়ী—শ্বশুরৈশ্চ পরন্তপ। যিনি পাণ্ডুর সত্যিকারের বাবা সেই শ্বশূর ব্যাসদেবের সম্বন্ধে কুন্তীর কোনও বক্তব্য নেই। বক্তব্য নেই তাঁর সম্বন্ধেও, যিনি পাণ্ডুর নামে বাবা, সেই বিচিত্রবীর্য শ্বশূর সম্বন্ধেও। কারণ তাঁকে পাণ্ডুই দেখেননি তো কুন্তী! তাহলে যাঁদের ওপরে কুন্তীর অভিমান তাঁদের একজন হয়তো পিতামহ ভীষ্ম, যিনি শ্বশূর না হলেও প্রায় শশূরই, কারণ শ্বশুরের প্রথম সম্বন্ধটা তাঁর সঙ্গেই হতে পারত। আরেক জন হলেন ধৃতরাষ্ট্র, যিনি ভাশূর। ভাশূর কথাটা সংস্কৃতে ‘ভ্রাতৃশশূর’ শব্দ থেকে আসছে; ধৃতরাষ্ট্র তাই শ্বশূর পর্যায়েরই মানুষ। এই ভ্রাতৃশ্বশূর বা ভাশুরের সম্বন্ধে কুন্তীর ক্ষোভ আছে যথেষ্ট। এবং সে ক্ষোভের কারণও আছে যথেষ্ট।

কিন্তু শ্বশূরবাড়ি তো হাজার হলেও পরের বাড়ি। তাকে আপন করে নিতে হয় চেষ্টায়, সাধনায়। বলতে পারি পাণ্ডুর অকালমৃত্যুতে এবং শ্বশুরের মতো অন্যান্যদের অনাদর, অবহেলায় শ্বশূরবাড়িকে আর আপন করে নেওয়া সেরকমভাবে সম্ভব হয়নি কুন্তীর পক্ষে। কিন্তু এই শ্বশূরকুলের ওপর যত না রাগ আছে কুন্তীর, তার থেকে অনেক বেশি রাগ আছে তাঁর নিজের বাপের বাড়ির ওপর। এ এক অদ্ভুত মনের জগৎ যেখানে কুন্তী একা, নিঃসঙ্গ। তাঁর দুঃখ, তাঁর ক্ষোভ—পিতা-মাতার সহৃদয়তা নিয়ে বোঝবার মতো কেউ ছিল না সংসারে, এখনও নেই। আজ পরিণত বয়সে তিনি এমন একজনের কাছে তাঁর মনের ব্যথা ব্যক্ত করছেন, যিনি তাঁর বাপের বাড়ির লোক। অথবা এমন একজনের কাছে, যাঁর কুন্তীর সমতুল্য অভিজ্ঞতা খানিকটা আছে।

অভিজ্ঞতা মানে এই নয় যে, দুজনের বয়স সমান, অতএব একে অপরকে বয়সোচিত জ্ঞান দান করে যাচ্ছেন। এখানে অভিজ্ঞতাটা সমান ঘটনায়, অথবা প্রায় সমান পরিস্থিতিতে। কৃষ্ণকেও কৃষ্ণের বাবা বসুদেব বন্ধু নন্দ গোপের কাছে রেখে এসেছিলেন বৃন্দাবনে। বেশ অনেক বয়স পর্যন্ত কৃষ্ণ নন্দরাজাকেই নিজের বাবা বলে জানতেন। সেই জায়গা থেকে কৃষ্ণ অনেক কষ্টে, অনেক বিপরীত পরিস্থিতির মধ্যেও আপন ক্ষমতায় নিজের পিতা-মাতার কাছে চলে এসেছিলেন।

কিন্তু কুন্তীর ব্যাপারটা আরও করুণ। কথাটা একটু খুলে বলি। একটি নিঃসন্তান দম্পতি যখন পিতৃমাতৃহীন একটি শিশুকে পুত্র হিসেবে পালন করেন, সেই শিশু বড় হয়ে নিজের পরিচয় জানলে, তার এক রকম মনের গতি হয়। বয়ঃপ্রাপ্ত এই শিশুটির চেয়ে তার মনের গতি কিন্তু আরও বিচিত্র হবে, যার বাবা-মা বেঁচে আছেন, অথচ নির্বোধ বয়সে যাকে দত্তক দেওয়া হয়েছিল অন্যের কাছে। পরিস্থিতি কিন্তু আরও জটিল এবং কঠিন মনস্তত্ত্বের পরিসর হয়ে দাঁড়াবে যদি এমন একজনকে দত্তক দেওয়া হয়—যে তার বাবা-মায়ের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন। খেলাধূলার বয়স যায়নি, কিন্তু বাবা-মাকে যে শিশু নিজের ভালবাসার মাধুর্যে চিনে গেছে, তাকে যদি অন্যের কাছে দত্তক দেওয়া যায়, তবে তার মনের যে জটিল অবস্থা হয় কুন্তীরও তাই হয়েছে।

কুন্তী কৃষ্ণকে বলেছেন—আমি নিজেকে দোষ দিতে পারি না, এমন কী দোষ দিই না দুর্যোধনকেও। সমস্ত দোষ আমার জন্মদাতা পিতার—পিতরন্ত্বেব গর্হেয়ং নাত্মানং ন সুযোধনম্‌। আমি যখন বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে খেলা করি, তখন আমাকে তোমার ঠাকুরদাদা, অর্থাৎ আমার বাবা তাঁর বন্ধু কুন্তিভোজকে দিয়ে দিলেন।

কুন্তী এইটুকু বলেই থামেননি। আরও কটা কথা বলেছেন। আজকের নারী-স্বাধীনতার প্রবক্তাদের মুখে নতুন কী কথা শুনব? তাঁরা বলেন—স্ত্রীলোককে সেকালে গয়নাগাটি, ধনসম্পত্তির মতো ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁদের স্বাধীন সত্তার কথা সচেতনভাবে কেউ ভাবেননি। ভাবতে অবাক লাগে আজ থেকে প্রায় দু’ হাজার-আড়াই হাজার বছর আগে কুন্তীর মুখ দিয়ে এ কী কথা বেরুচ্ছে? কুন্তী বলছেন—যাঁদের টাকা-পয়সা আছে, তাঁরা যেমন দেদার টাকা-পয়সা দান-ছত্তর করে নাম কিনতে চান, আমার বাবাও তেমনই আমাকে তাঁর বন্ধুর কাছে দত্তক দিয়ে বেশ নাম কিনলেন। আমাকে দিয়ে দিলেন যেন আমি একটা টাকার থলে—ধনং বৃত্তৈরিবার্পিতা।

বাংলায় যা বলেছি, মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ তাই বলেছেন কুন্তীর কথাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। তিনি বলেছেন—দাতা হিসেবে খ্যাতি পাওয়ার জন্য ধনী ব্যক্তি যেমন অক্লেশে ধন দান করেন, আমার বাবাও তেমনই অক্লেশে বন্ধুর কাছে দত্তক দিয়েছিলেন আমাকে—বৃতর্বদান্যত্বেন খ্যাতৈর্ধনং যথা অক্লেশেন অর্প্যতে, তদ্‌বৎ যেনাহম্‌ অর্পিতা।

কুন্তী সেকালের পুরুষ-শাসিত সমাজের এক প্রধান প্রতিভূকে, যদুবংশীয় পিতৃতান্ত্রিকতার প্রতীক নিজের বাবাকে যে ভাবে, যে ভাষায় নিন্দা করেছেন, আজ দু’ হাজার বছর পরে আধুনিক নারী প্রগতিবাদীরা এর থেকে বেশি কী বলবেন? কুন্তী বলেছেন—বাবা এবং শ্বশূর—দুই পক্ষই আমাকে বঞ্চনা করেছে, আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কী, দুঃখের চূড়ান্ত হয়েছে আমার—অত্যন্ত দুঃখিতা কৃষ্ণ কিং জীবিতফলং মম।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়—শ্বশূরবাড়িতে বিশেষত ধৃতরাষ্ট্রের কাছে ক্রমাগত বঞ্চনা পেতে পেতে আজ তাঁর মনের অবস্থা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যাতে তাঁর ক্ষোভ সমস্ত কিছু ছাপিয়ে একেবারে তাঁর জন্মদাতা পিতা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অন্তত এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে যে, কুন্তী এমন একজন অতিসংবেদনশীল স্পর্শকাতর মহিলা, যাঁকে বাল্যকালের সেই ঘটনাটি এখনও পীড়া দিয়ে চলেছে। তাঁকে যখন কুন্তিভোজের কাছে দত্তক দেওয়া হয়, তখন তাঁর পুতুল-খেলার বয়স হয়ে গিয়েছিল বলেই পিতা বলে চিহ্নিত ব্যক্তিটি সম্বন্ধে তাঁর সচেতনতাও যথেষ্টই হয়ে গিয়েছিল। যে শিশু বাবা-মাকে বাবা-মা বলেই ভালবেসে ফেলেছে, তাকে যদি হঠাৎ দত্তক দিয়ে দেওয়া হয়, তবে তার যে কিছু নিরাপত্তাবোধের অভাব ঘটে—সে কথা বোধকরি খুব কঠিন মনস্তত্ত্বের তত্ত্বকথা নয়, একেবারে সাধারণ কথা। ছোটবেলায় এই নিরাপত্তাবোধের অভাব কুন্তীর কাছে এতটাই ‘শকিং’ হয়ে গেছে যে, তাঁর মানসিক গতি-প্রকৃতিও সেইভাবেই গঠিত হয়েছে, জটিলতাও কিছু এসেছে।

বস্তুত দত্তক দেওয়ার সূত্রে এই পিত্ৰন্তরের ঘটনা যদি না ঘটত, তা হলেও কুন্তীর জীবনের ঘটনাগুলি একইরকম ঘটতে পারত কিংবা ঘটতে পারত অন্য কোনও উৎপাত। দত্তক নেওয়া মেয়ে বলেই মহারাজ কুন্তিভোজ কুন্তীর বিয়ে কিছু খারাপ দেননি। তা ছাড়া এ বিয়ের ব্যাপার-স্যাপার কৃষ্ণের পিতামহ আর্যক শূর অথবা কৃষ্ণপিতা বসুদেব কিছুই জানতেন না এমনও মনে হয় না। আর সবচেয়ে বড় কথা কুন্তী হস্তিনাপুরের অধিপতি পাণ্ডুকে বরণ করেছিলেন স্বয়ম্বরসভায়, স্বেচ্ছায়। পাণ্ডুও ভালই রাজত্ব চালাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি যে মারা যাবেন, তাই বা কে জানত? অথবা কে জানত প্রজ্ঞাচক্ষু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র তাঁর সঙ্গে এত অপব্যবহার করবেন?

আসলে অবস্থার গতিকে সবই যখন বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছে—স্বামী মারা গেছেন, শ্বশূরবাড়িতে নিজের অধিকার নেই, সন্তানেরা বনবাসের কষ্ট ভোগ করলেন এবং এখন সমস্ত শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁরা স্বরাজ্য উদ্ধার করতে পারছেন না—এমন অবস্থার গতিকে কুন্তীর সমস্ত রাগ গিয়ে জমা হয়েছে জন্মদাতা পিতার ওপরেই। অভিমান হচ্ছে—যার পিতা সেই শৈশব অবস্থায় পিতৃস্নেহে বঞ্চিত করে একটি শিশু কন্যাকে অন্যের কাছে দত্তক দিয়েছেন, তার আর জীবনের মূল্য কী—কিং জীবিতফলং মম। অথবা কুন্তী তাঁর পিতার ওপর অভিমানে তাঁর জীবনের ঘটনার শৃঙ্খল অন্যভাবে সাজাতে চান—অর্থাৎ যদি তাঁর পিতা কুন্তিভোজকে দত্তক না দিতেন, তা হলে স্বয়ম্বরসভায় পাণ্ডু আসতেন, যদি পাণ্ডুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে না হত, তা হলে…ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমরা জানি—এসব কথা ঠিক নয়। এসব কথা কুন্তী এইভাবেই ভেবেছিলেন কি না, তাও মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। কিন্তু এটা বুঝতে কোনও অসুবিধা নেই যে, পিতার ওপর তাঁর এই অসম্ভব আক্রোশ এসেছে তাঁর সারা জীবন ভোগান্তিরই ফলে। বিশেষত পাণ্ডুর জীবনাবসানের পর শ্বশূরকুলে পাঁচটি সন্তান নিয়ে তাঁকে এতই কষ্ট পেতে হয়েছে যে, তাঁর পিতার সম্বন্ধে এই অভিমান তাঁর মনের অবস্থাকে আরও জটিলতর এবং দ্বন্দ্বময় করে তুলেছে বলে আমরা মনে করি। কুন্তী-চরিত্র বিশ্লেষণের সময় তাঁর পিতার সম্বন্ধে এই অভিযোগ আর কোনওভাবে কাজ করেছে কি না তাও আমরা খেয়াল করার চেষ্টা করব।