যুধিষ্ঠির – ৩

পাণ্ডব-কৌরবদের অস্ত্র শিক্ষা আরম্ভ হল। এই অস্ত্রশিক্ষার আসরে পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ একেবারেই যেন বেমানান। যে ধ্যান, যে নিষ্ঠা নিয়ে একজন উচ্চাশী ব্যক্তি অস্ত্রশিক্ষা করে, সেই ধ্যান কিম্বা সেই নিষ্ঠা অর্জুন-ভীম-অথবা কর্ণ-দুর্যোধনদের ছিল, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের তা ছিল না। অথবা সে উচ্চাশাও বুঝি ছিল না। তাঁর ধ্যান এবং নিষ্ঠা অন্যত্র ন্যস্ত হওয়ার ফলে, অস্ত্র-শিক্ষার আসরে তিনি ছিলেন প্রায় ফেল-করা ছাত্রটির মত। বনের প্রান্তভাগে দাঁড়িয়ে গাছের ওপর পক্ষী রেখে দ্রোণাচার্য যেদিন প্রথম অস্ত্র-পরীক্ষা নিলেন, সেদিন যুধিষ্ঠিরের কপালে তিরস্কার জুটেছিল। অস্ত্রগুরু বলেছিলেন— এখানে দাঁড়িয়ে ওই বৃক্ষশাখায় বসা মৃৎপক্ষীর চক্ষু, বাণবিদ্ধ করতে হবে তোমাদের। পাণ্ডব-কৌরব সকলে সার দিয়ে দাঁড়ালেন ধনুক-বাণ হাতে। সবাই গুরুর আদেশের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

প্রথমেই সর্ব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের পালা। জ্যেষ্ঠ বলে তাঁকেই প্রথমে ডাকলেন দ্রোণাচার্য। কী মিষ্টি করেই না দ্রোণাচার্য প্রশ্ন করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্নে প্রশ্নেই সরল সাদা অঙ্ক এক্কেবারে গুলিয়ে গেল। যুধিষ্ঠির সব দেখতে পাচ্ছেন— পাখি, গাছ, আচার্য, ভাইরা— সবাই তাঁর অঙ্কের গণ্ডির মধ্যে বাস করেন। তিনি এক দৃষ্টিতে বৃক্ষের উচ্চ-চূড়ে বসা পাখি দেখতে পান না, দেখতে পান না উচ্চাশার শেষ প্রান্তে রাখা হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসন। যে মুহূর্তে দ্রোণাচার্য বললেন— তোমার দ্বারা আর যাই হোক এই লক্ষ্যভেদ সম্ভব নয়, সেদিনই বোঝা গেছে হস্তিনাপুরের সিংহাসনের দিকেও তাঁর কোনও তীক্ষ্ণ এবং একক দৃষ্টি নেই। রাজা হওয়ার ব্যাপারে নিজের ওপর আস্থাও নেই তত। ভীম এবং অর্জুনের মতো অসাধারণ যোদ্ধা যাঁর ভাই এবং সঙ্কেত পাওয়া মাত্র যে ভাইরা তাঁর জন্য জীবন পর্যন্ত বলি দিতে পারেন, সেই ভাইদেরও যুধিষ্ঠির খুব বড় যোদ্ধা বলে ভাবেননি। ছোট বলেই হোক অথবা অতি কাছের লোক বলেই হোক, সব সময় যুধিষ্ঠিরের মনে সংশয় ছিল— ওরা বোধহয় পারবে না। অস্ত্র-পরীক্ষার রঙ্গস্থলে যুযুধান ভীম-দুর্যোধনের প্রায় সম-শক্তির যুদ্ধ দেখে তিনি কোনও ভরসা পাননি; অন্য দিকে অস্ত্র-কৌশলের অপূর্ব প্রয়োগে অর্জুন যখন একক হয়ে উঠেছিলেন রঙ্গস্থলে, ঠিক তখনই কর্ণ এসে অর্জুনের সমস্ত অস্ত্র-কৌশল পুনরাবৃত্তি করায় যুধিষ্ঠিরের ক্ষাত্র-তেজ মোটেই উদৃপ্ত হয়নি। যুধিষ্ঠির মনে মনে ভেবেছেন— কর্ণের মতো বীর দুনিয়ায় আর দুটি নেই—যুধিষ্ঠিরস্যাপ্যভবৎ তদা মতির্ন কর্ণতুল্যো’স্তি ধনুর্দ্ধরঃ ক্ষিতৌ।

যে দু-একটি উদাহরণ দিয়েছি— যেমন একটা— দুর্যোধন অন্যায় করলেও ভীমকে তা না বলতে দেওয়া, যেমন দুই— অসাধারণ হওয়া সত্ত্বেও অর্জুনের থেকে কর্ণকে বড় বলে ভেবে নেওয়া— এ সব থেকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে— যুধিষ্ঠির বুঝি খুব নরম মানুষ, মনোবলহীন, মেরুদণ্ডহীন। এমনকী দ্রোণাচার্যকে গুরুদক্ষিণা দেবার সময়ে পাণ্ডবরা যখন দ্রুপদকে জীবিত ধরার জন্য রথে চড়লেন— রথানারুরুহুস্তদা— তখন প্রথমে যাঁকে এই যুদ্ধে যেতে বারণ করা হল, তিনি যুধিষ্ঠির। অর্জুন তাঁকে পরিষ্কার বলে দিলেন— আপনি এইখানেই থাকুন, আপনাকে যুদ্ধে যেতে হবে না— যুধিষ্ঠিরং নিবাৰ্য্যাশু মা যুধ্যস্বেতি পাণ্ডবম্।

যেখানে দ্রুপদ-শাসনের সময় নকুল-সহদেবের মতো নগণ্য বীরকেও অর্জুন চক্র-রক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন, সেখানে যুধিষ্ঠিরের প্রতি অর্জুনের এই অনুরোধ আমাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এটা কি এক ধরনের গৌরব-গন্ধহীন অবহেলা, নাকি বেশি সম্মান দেওয়া! সামগ্রিক মহাভারতের বিভিন্ন উদাহরণে অবশ্য ক্রমশই পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, যুধিষ্ঠির পারবেন না বলে নয়, যুদ্ধ-বিগ্রহের মত স্থূল, পাশবিক হত্যাকাণ্ডে যুধিষ্ঠিরের মতো বিরাট পুরুষকে ভীম-অর্জুন কখনই জড়াতে চাননি। ভাবটা এই— আমাদের মতো ষণ্ডা-জোয়ান ভাইরা থাকতে দাদার যাওয়ার প্রয়োজন কী? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও— যখন একটি মায়ের গর্ভে অনেকগুলি সন্তানের জন্ম হত— তখনও কোনও কোনও পরিবারে আমরা বড়ভাইকে প্রায় পিতার আসনে বসতে দেখেছি। বর্ষাকালে পিতোপম জ্যেষ্ঠদাদাটিকে জোয়ান ছোটভাই কাঁধে করে নদী পার করে দিচ্ছে অথবা ভ্রাতা-ভগিনীকুলের বিবাদ-বিসংবাদের মধ্যে বড়দাদা এসে পড়ায় ঝগড়ার আসর স্তব্ধ হয়ে গেল— এরকম ঘটনা আমার নিজের চোখেই অনেক দেখা।

যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুনের বয়সের তফাত বেশি না হলেও পিতা না থাকার ফলে পাণ্ডব-পরিবারে যুধিষ্ঠির প্রায় পিতার আসনেই বসে গিয়েছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল যুধিষ্ঠিরের প্রখর ধর্মবোধ, নীতিবোধ, সত্যনিষ্ঠা। ধর্ম, নীতি, সত্যনিষ্ঠা যাঁর মধ্যেই প্রবল হবে, তিনি যে খানিকটা ধীর-স্থির-স্থবির হয়ে যাবেন— সে কথা খুব বেশি চিন্তা না করেও অনুমান করা যায়। এই ধীরতা এবং স্থিরতার সুফল, কুফল দুইই ফলেছে এবং তাও একেক জনের কাছে একেক ভাবে।

পাঞ্চালরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করে দ্রোণাচার্যকে রাজ্য দান করার এক বৎসর পর কুরুবাড়িতেও একটা লক্ষণীয় ঘটনা ঘটল। যুধিষ্ঠির যুবরাজ হলেন। হয়তো সেই ভীমের বিষপানের ঘটনা প্রচার না হওয়ায় এবং যুধিষ্ঠিরের সহনশীলতায় ধৃতরাষ্ট্র এতটাই বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে যে, যুবরাজের পদ নিয়ে তিনি দ্বিতীয়বার চিন্তা করেননি। মহাভারতের কবি লিখেছেন— যুধিষ্ঠির তাঁর ধৈর্য, স্থৈর্য, কোমলতা, দয়া-প্রণয়ের গুণে পিতাকেও অতিক্রম করেছিলেন— পিতুরর্ন্তদধে কীর্তিং শীলবৃত্তসমাধিভিঃ। কিন্তু আমরা জানি— এ সব গুণে তাঁর পিতা এমনিতেই পুত্রের চেয়ে খাটো ছিলেন, আর ওই সব গুণগুলি তাঁর যুবরাজ হওয়ার পরবর্তী পর্বের কোনও আকস্মিকতা নয়। হয়তো ওই গুণগুলি তাঁর জন্মগত বলেই শত অন্ধতার মধ্যেও ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে যুবরাজ না বানিয়ে পারেননি।

ধৃতরাষ্ট্রের এই মোহ বেশিদিন টেকেনি। ভীম-অর্জুনের বলবত্তা লোক-প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্য জুড়ে চাউর হয়ে গেল যে, অর্জুনের মতো বীর আর দ্বিতীয়টি নেই। আসলে যে সব রাজ্য পাণ্ডুও জয় করতে পারেননি, সে সব অর্জুন জয় করে এসেছিলেন। এর ওপরে ছিল অর্থ। ভীম এবং অর্জুন দুজনেই দক্ষিণ এবং পূর্বদেশ জয় করে রাশি রাশি অর্থ জমা করে দিয়েছিলেন কুরুদের রাজকোষে— ধনৌঘং প্রাপয়মাস কুরুরাষ্ট্রং ধনঞ্জয়ঃ। দেশজয় এবং রাজকোষবৃদ্ধি এই দুটিই হয়তো কুরুরাষ্ট্রের পক্ষে সন্তোষজনক এবং হিতকরই ছিল, কিন্তু এই হিতকর্ম পাণ্ডবদের মাধ্যমে ঘটায় তাঁদের ওপর ধৃতরাষ্ট্রের কেমন যেন রাগই হল। তিনি ফিকির খুঁজতে লাগলেন— কীভাবে পাণ্ডবদের তাড়ানো যায়। লক্ষণীয়, যুধিষ্ঠির যদি বা নিজগুণে কুরুরাষ্ট্রের যৌবরাজ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন, তবে সে পদ তাঁর নষ্ট হল ভীমার্জুনের শৌর্য-বীর্য অতিরিক্ত প্রকট হয়ে যাওয়ায়। ধৃতরাষ্ট্রের মন দূষিত হয়ে গেল, মতও পালটে গেল। তিনি এখন পাণ্ডবদের রাজ্য থেকে তাড়াতে চান।

কুরুরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষেরা, পৌরজনেরা যুধিষ্ঠিরকেই রাজা হিসেবে চাইছিলেন। তাঁর পিতা মারা গেছেন এই সহানুভূতির সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের শান্ত স্বভাব এবং মানসিক পরিণতি পুরবাসীদের মুগ্ধ করেছিল। গ্রামে-গঞ্জে সভায়-চত্বরে পুরবাসীদের মুখে যুধিষ্ঠিরের গুণগান শুনে দুর্যোধন ঈর্ষায় জ্বলতে থাকলেন— যুধিষ্ঠিরানুরক্তানাং পর্য্যতপ্যত দুর্মতিঃ। ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনেরা এমন আশঙ্কাও করেছিলেন যে, যুধিষ্ঠিরের জন্য পুরবাসীরা তাঁদেরও মেরে ফেলতে পারে— কথং যুধিষ্ঠিরস্যার্থে ন নো হন্যুঃ সবান্ধবান্।

এই সন্দেহ এবং ঈর্ষা দুইই অমূলক ছিল। পুরবাসীরা ভাবত— তরুণ যুধিষ্ঠির রাজা হয়ে বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র এবং ভীষ্মকে সসম্মানে খাওয়াবেন, পরাবেন। এমনকী ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররাও যুধিষ্ঠিরের সমাহৃত ভোগ থেকে বাদ যাবেন না। ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্মের প্রতি যুধিষ্ঠিরের অসম্ভব শ্রদ্ধা লক্ষ করেই পুরবাসীরা এই সমদৃষ্টি তরুণকে নিজেদের রাজা করবে বলে ভাবত— তে বয়ং পাণ্ডবজ্যেষ্ঠং তরুণং বৃদ্ধশীলিনম্‌। অভিষিঞ্চামঃ…..।

পুরবাসীদের এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবার আগেই দুর্যোধনের প্ররোচনায় পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন ধৃতরাষ্ট্র। বারণাবত জায়গাটা যে কত মনোরম, কত সুন্দর— এ সব কথা বারবার লোক দিয়ে পাণ্ডবদের কাছে বলালেন ধৃতরাষ্ট্র। তারপর নিজেই একদিন যুধিষ্ঠিরকে ডেকে বললেন— একবার ঘুরে এসো তোমরা। ভারী ভাল জায়গা। তার মধ্যে আবার মহাদেবের উৎসব লেগেছে সেখানে। তোমরা মাকে সঙ্গে নিয়ে বারণাবতে যাও। দানধ্যান কর, তারপর সুখে ফিরে এস।

যুধিষ্ঠিরের যে খুব যাবার ইচ্ছে ছিল, তা মোটেই নয়। বরঞ্চ এই আপাতমধুর প্রস্তাবের মধ্যে যে একটা ‘কু’ আছে— এটা তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে যে ভাবে বলছেন এবং বারণাবতে পাঠানোর জন্য তাঁর ইচ্ছেটা এতই বেশি প্রবল যে, যুধিষ্ঠির ভাবলেন— যদি না যাই, তা হলে হয়তো জোর করেই পাঠাবেন ধৃতরাষ্ট্র। তা ছাড়া কুরুরাষ্ট্র-যন্ত্রের মন্ত্রী সেনাপতি যতই তাঁর অনুরক্ত থাকুন, তাঁদের চালানোর শেষ শক্তি হলেন ধৃতরাষ্ট্র। এই অসহায়তার মধ্যে যুধিষ্ঠির যদি ধৃতরাষ্ট্রের কথায় সম্মতি না দেন, তবে অন্যভাবে বিপদ আসতে পারে— এই ভেবে যুধিষ্ঠির তাঁর কথায় রাজি হয়ে গেলেন— আত্মনশ্চাসহায়ত্বং তথেতি প্রত্যুবাচ তম্।

এই রাজি হওয়ার পর থেকেই অতি অল্প বয়সেও যুধিষ্ঠিরের অসম্ভব মানসিক পরিণতি আমরা লক্ষ করি। আমরা জানি, বারণাবতে পুরোচন নামক একটি বিশ্বস্ত ভৃত্যের দ্বারা দুর্যোধন সহজে দাহ্য একটি জতুগৃহ তৈরি করিয়েছিলেন। পাঁচ ভাই পাণ্ডব এবং কুন্তীকে জতুগৃহের আগুনে সুপরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে মেরে আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডে পাণ্ডবরা মারা গেছেন— এই প্রচার এবং অজুহাত আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন দুর্যোধন। ঠিক কী ঘটবে এটা যুধিষ্ঠির পূর্বাহ্নেই জানতেন না ঠিকই। কিন্তু সমাতৃক পাণ্ডবদের ইচ্ছা করেই যে বারণাবতে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে— সে-কথা যুধিষ্ঠির বুঝেছিলেন এবং ভাইদের সে-কথা তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন নিশ্চয় নইলে ধৃতরাষ্ট্র যেমনটি বলেছিলেন— তোমরা কদিন বারণাবতে কাটিয়ে আবার হস্তিনায় ফিরে এস— কঞ্চিৎ কালং বৃহৃত্যৈবং সুখিনঃ পুনরেষ্যথ— তাতে তো দুঃখের কিছুই ছিল না, বরং আনন্দেরই কিছু ছিল।

কিন্তু ঘটনাটা যে এত সহজ নয়, এটা যে একরকমের নিবাসন, সে-কথা যুধিষ্ঠির বুঝেছিলেন বলেই পাণ্ডবরা ভীষ্ম-দ্রোণ-ধৃতরাষ্ট্রের মতো পূজ্যস্থানে প্রণাম জানানোর সময় কষ্ট-ক্লিষ্ট মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন— পাদৌ জগৃহুরার্তবৎ। এমনকী শুধু পাণ্ডবরাই নয়, কুরুরাষ্ট্রের পৌর, জনপদবাসীরাও ঘটনাটা বুঝেছিল। যুধিষ্ঠিরের ক’দিনের রাজত্বেই কুরুরাজ্যের প্রজারা যুধিষ্ঠিরকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যুধিষ্ঠিরের সুযোগ্য শাসন যে ধৃতরাষ্ট্র মেনে নিতে পারছেন না এবং সেই ঈর্ষা থেকেই যে তিনি রাজ্যের যুবরাজকে নির্বাসনে পাঠাচ্ছেন— প্রজাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। যুধিষ্ঠিরকে বিদায় নিতে দেখে বারবার তারা পাণ্ডবপিতা পাণ্ডুকে স্মরণ করছিল এবং তরুণ ভ্রাতুষ্পুত্রদের ধৃতরাষ্ট্র যে সহ্য করতে পারছেন না— এটাই তারা বিশ্বাস করছিল— রাজপুত্রান্‌ ইমান্‌ বালান্‌ ধৃতরাষ্ট্রো ন মৃষ্যতে।

যুধিষ্ঠিরের দিক থেকে এটা একটা বড় সুবিধে। কুরুরাষ্ট্র থেকে রাজা তাঁকে বিতাড়ন করলেও রাজ্যের প্রজারা তাদের পরিচিত জনপদ ছেড়ে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বারণাবতে যেতে চাইছে— গৃহান্‌ বিহায় গচ্ছামো যত্র রাজা যুধিষ্ঠিরঃ— এই জন-সমর্থন যুধিষ্ঠিরের কাছে এক বড় প্রাপ্তি এবং হয়তো এই প্রাপ্তি যুধিষ্ঠির বলেই। জন-সমর্থন এই পর্যায়ে চলে এসেছিল যে যুধিষ্ঠির এক সময় ধৃতরাষ্ট্রের সামনেই পৌরজনদের বলতে বাধ্য হলেন— আপনারা ঘরে ফিরে যান। ধৃতরাষ্ট্র যা চান, সেটা আমাদের মানতে হবে নিঃশঙ্কচিত্তে—অশঙ্কমানেস্তৎ কার্যম্‌। অর্থাৎ আশঙ্কা একটা আছেই এবং সেটা তিনি বলে ফেললেন খুব ‘ক্যাজুয়ালি’। কিন্তু এই আশঙ্কা এবং বিপন্ন মুহূর্তে এতগুলি মানুষ যে তার সমর্থনে এগিয়ে এসেছে, তার মান্যতা দিতে ভোলেননি যুধিষ্ঠির। তিনি বলেছেন— আপনারাই আমাদের বন্ধু— ভবন্তঃ সুহৃদো’স্মাকম্‌। সঠিক সময়ে যখন সত্যিই আপনাদের সাহায্যের প্রয়োজন হবে আমাদের— যদা তু কার্যমস্মাকং ভবদ্ভিরুপপৎস্যতে— তখন যেন আমাদের প্রিয় এবং হিতকার্যে আমাদের সহায় হবেন আপনারা।

বলতে পারেন, এ তো আর গণতন্ত্র নয় রে বাবা! যে, এত জনসমর্থনের প্রয়োজন আছে। আমরা বলি— কুরুরাষ্ট্রে রাজা যত বড় স্বেচ্ছাচারীই হন না কেন, জনসমর্থনের প্রয়োজন তাঁদেরও ছিল দুর্যোধন এবং ধৃতরাষ্ট্র যে পাণ্ডবদের সম্বন্ধে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়লেন, তার কারণ একটা যদি হয় ভীমাৰ্জুনের বলবত্তা, তা হলে অন্য কারণ যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে জনতার উদ্দাম উচ্ছ্বাস এবং আগ্রহ। দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে প্রথম নালিশ জানিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরের পেছনে এই জনসমর্থনের কথা মনে রেখেই— পৌরানুরাগ-সন্তপ্তঃ পশ্চাদিদমভাষত।

যুধিষ্ঠিরের পিছনে এই বিপুল জন-সমর্থনের অন্য একটা মূল্যও আছে। যে শৌর্য-বীর্যের আধিক্যে তৎকালীন রাজা একনায়ক স্বেচ্ছাচারীতে পরিণত হতে পারতেন, সেই শৌর্য-বীর্য যুধিষ্ঠিরের ছিল না। কিন্তু প্রজারঞ্জনের বৃত্তি, যা যে কোনও রাজার আদর্শ এবং কাম্য ছিল, অথবা যা শৌর্যের থেকেও বড় শক্তি, যুধিষ্ঠির সেই আদর্শে তাঁর রাজাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরিষ্কার বোঝা যায়— শুধু ভ্রাতা, বন্ধু, আর্হীয়স্বজন নয়, যুবরাজের সিংহাসনে বসে থেকে এতদিন তিনি সাধারণ মানুষকেও সমান চোখে দেখতে পেয়েছেন। যুধিষ্ঠিরের জোর এই সাধারণ-সমর্থনে এবং তিনি যখন বারণাবতে জতুগৃহের পথে রওনা হলেন, তখন এই সমর্থন হস্তিনাপুরে তাঁর জন্য মজুদ রইল।

বারণাবতে যাবার ব্যাপারে যুধিষ্ঠিরের মনে একটা আশঙ্কা এবং দ্বিধা ছিল, কিন্তু সেখানে ঠিক কী ঘটতে পারে, সে সম্বন্ধে কোনও পূর্ব ধারণা যুধিষ্ঠিরের ছিল না। কিন্তু পুরবাসীরা যখন চলে গেল, ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম-দ্রোণ ইত্যাদি গুরুস্থানে পাণ্ডবদের বিদায়-প্রণাম জানানো হয়ে গেছে, ঠিক তখনই বারণাবতের ভবিষ্যৎ যুধিষ্ঠিরের জানা হয়ে গেল। জানালেন সেই বিদুর। রাজবাড়িতে এখানে সেখানে লোক-জন দাঁড়িয়েই থাকে। বিদুর তাই কথ্য সংস্কৃত ভাষায় নিজের বক্তব্য জানালেন না। বিদুর এবং যুধিষ্ঠির— দু’জনেরই একটা সুবিধে ছিল— এঁরা সংস্কৃত ছাড়াও বিভিন্ন দেশি ভাষা জানতেন। প্রজা-সাধারণের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকার ফলে আর্যেতর দেশজ ভাষাগুলি দু’জনেরই ভাল আয়ত্ত ছিল। মহাভারত বলেছে— এঁরা ছিলেন ‘প্রলাপজ্ঞ’। ‘প্রলাপ’ শব্দটা শুনলে এখন উলটো-পালটা চেঁচানোর ব্যাপারটাই মাথায় আসে, কিন্তু বস্তুত প্রলাপ মানে এখানে সাধারণজনের আলাপের ভাষা এবং সে ভাষা সংস্কৃত-জানা সামাজিকদের বোধশক্তির বাইরে।

অন্যের কাছে যা প্রলাপের মতো বিদুর সেই লুপ্তবর্ণ-বিকৃতবর্ণ দেশজ ভাষায় যুধিষ্ঠিরকে বুঝিয়ে দিলেন— বারণাবতে যে ঘরে তাঁরা থাকবেন, সে ঘর তৈরি হয়েছে অতিদাহ্য পদার্থ দিয়ে। আগুন লাগানোর লোক যে কাছেই থাকবে, সে-কথা বলে দেবার পর কীভাবে ইদুরের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকতে হবে, কীভাবে সজারুর মতো সুরঙ্গ কেটে পালাতে হবে— সব কথা অস্পষ্ট ইঙ্গিতে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন বিদুর। বিদুরের ভাষা এমন ছিল যে, জননী কুন্তী পর্যন্ত অবাক হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন বিদুর যে ঘাড় নেড়ে নেড়ে ভিড়ের মধ্যে কী বলে গেল, আর তুমিও বাছা! ঘাড় নেড়ে নেড়ে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে গেলে— এ সব কথার মানে কী, কিছুই তো বুঝলাম না— ত্বয়া চ তথেত্যুক্তো জানীমো ন চ তদ্‌বয়ম্। যুধিষ্ঠির মাকে বেশি আতঙ্কিত করেননি— কিন্তু দুর্যোধনের আগুন লাগানোর পরিকল্পনা এবং তা থেকে কীভাবে বাঁচতে হবে, সে বিষয়ে বিদুরের উপদেশ মাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন।

বারণাবতে পোঁছে পাণ্ডবরা পুরবাসীদের কাছে বিপুল সংবর্ধনা লাভ করলেন। জতুগৃহে আগুন লাগানোর জন্য দুর্যোধন আগে থেকেই যাকে নিযুক্ত করেছিলেন, সেই পুরোচন যুধিষ্ঠির এবং তাঁর পরিবারবর্গকে প্রথমে একটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুললেন, তারপর সেখানে পাণ্ডবরা দশদিন থাকার পরেই তাঁদের তিনি ‘শিবভবন’ বলে এক নতুন বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এই শিবভবন আসলে শিব নয়, অশিব, অমঙ্গলের আসন— শিবাখ্যম্ অশিবং তদা— জতুগৃহ।

যুধিষ্ঠির বাড়িতে ঢুকেই ঘি, গালা, চর্বির গন্ধ পেলেন। ভীমকে আড়ালে ডেকে নিয়ে এসে ব্যাপারটা তিনি বলেও দিলেন। ভীমকে বললেন এই জন্য যে, ভীমই তাঁদের মধ্যে সরলতম ব্যক্তি যিনি যখন তখন যা কিছু করে ফেলতে পারেন। কিন্তু ওই ভীমকেই আবার যদি ঠিকভাবে চালনা করা যায়, তবে অভীষ্ট লাভ আশার অতীত হয়ে দেখা দিতে পারে। যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন— ভাল ভাল শিল্পীদের দিয়ে এই বাড়ি তৈরি করিয়েছে দুর্যোধন। সহজে আগুন লাগানোর যত মশলা আছে— শণ, ধুনো, সুজো, কাঁচলা— সব মিশিয়ে এই বাড়ি তৈরি করেছে দুর্যোধন। আর ওই যে পুরোচন নামে নিপাট ভাল মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছ, ও কিন্তু আমাদের পুড়িয়ে মারার জন্য ছোঁক-ছোঁক করছে।

সব শুনে সরল ভীম বললেন— এতই যদি সব বুঝতে পারছেন, দাদা!— যদীদং গৃহমাগ্নেয়ং বিহিতং মন্যতে ভবান্‌— তবে আমরা ভালয় ভালয় আমাদের সেই পুরনো বাড়িটাতেই ফিরে যাই না কেন? যুধিষ্ঠির বললেন— না ভাই! তা হবে না। আমরা যে পুরোচন কিংবা দুর্যোধনকে সন্দেহ করছি, সে ভাবটাই দেখানো যাবে না। আমরা যথাসাধ্য আত্মরক্ষার চেষ্টা করব, কিন্তু সন্দেহের কোনও চিহ্নই ফুটে উঠবে না আমাদের চোখে-মুখে। নতুন বাসস্থানও একটা চুপি-চুপি খুঁজে নিতে হবে, কিন্তু আমাদের থাকতে হবে এখানেই— ইহ যত্তৈ র্নিরাকারৈ র্বস্তব্যমিতি রোচয়ে।

কে বলে যুধিষ্ঠিরের সাহস নেই। যুধিষ্ঠির জানেন— রাজবাড়ির রাজনীতির মধ্যে অনেক বাঁকা গলিঘুজি আছে। তিনি ইচ্ছে করলে ভীমকে দিয়ে পুরোচনকে মেরে ফেলতে পারতেন, জতুগৃহখানি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে পারতেন সবার সামনে, কিন্তু তাতে যুধিষ্ঠিরের দিক থেকে জবাবদিহির অন্ত থাকত না। পুরোচন কুরুবাড়ির বিশ্বস্ত ভৃত্য। দুর্যোধন তাকে অপকর্মে নিযুক্ত করেছেন ঠিকই, কিন্তু রাজা ধৃতরাষ্ট্রের যে এই কর্মে সায় আছে— সে-কথা যুধিষ্ঠির বোঝেন। আর বোঝেন বলেই তিনি জানেন যে পুরোচনকে হঠাৎ মেরে ফেললে প্রশ্ন উঠবে অন্যভাবে। অন্যদিকে বারণাবতে যে বাড়িটায় পাণ্ডবরা থাকবেন সেটা পাণ্ডবদের জন্যই তৈরি হচ্ছে তা খুব ঘটা করে প্রচার করা হয়েছিল এবং তারপর বানানো হয়েছিল জতুগৃহ। কিন্তু বাড়িটা যে জতুগৃহ, এই খবরটা দুর্যোধন-ধৃতরাষ্ট্র ছাড়া কুরুবাড়ির বৃদ্ধ পুরুষেরা কেউই জানতেন না। যুধিষ্ঠির এমন একটা খেলা খেলতে চান যাতে কোনওভাবেই গৃহ-দাহনের দায় তাঁর ওপরে এসে না পড়ে। যুধিষ্ঠির চান— পুরোচনই ওই ঘরে আগুন লাগাক, এবং তারপর ভীষ্ম প্রভৃতি কুরুজ্যেষ্ঠরা এই কাজের জন্য দায়ী করুন দুর্যোধনকে— ধর্ম ইত্যেব কুপ্যেরন্‌ যে চান্যে কুরুপুঙ্গবাঃ।

যুধিষ্ঠির রাজোচিত দুঃসাহসে জতুগৃহেই বাস করতে চেয়েছেন এবং ভীমকে বুঝিয়েছেন— আমরা নতুন জায়গায় এসেছি, এখানে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই, কিন্তু দুর্যোধন নিজের রাজধানীতে মন্ত্রী-অমাত্যের সমর্থন পাচ্ছেন। টাকা-পয়সা ছড়িয়ে যে একটা কিছু করব, তারও উপায় নেই, আমাদের কিচ্ছুটি নেই, কিন্তু দুর্যোধনের সহায়-সম্পত্তি সবই আছে। আজকে আমাদের দিক থেকে কোনও বিপরীত আচরণ ঘটলে দুর্যোধন সৈন্য-সামন্তের বল আমাদের ওপর প্রয়োগ করবে, এবং তাতে আমাদের মরতেও হতে পারে— হীনকোষান্ মহাকোষঃ প্রয়োগৈ র্ঘাতয়েদ্‌ ধ্রুবম্। যুধিষ্ঠির বিদরের ইঙ্গিত মাথায় রেখে ভীমকে বলেছিলেন— এই বাড়িতে আমরা থাকব এবং বাড়ির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে ইদুরের মতো লুকিয়ে থাকব, যাতে ওপরে আগুন লাগলেও গর্ত-গুহায় আঁচ না লাগে।

আমরা জানি, যুধিষ্ঠিরের স্থিরবুদ্ধিতে এবং বিদুরের সাহায্যে পাণ্ডবরা মাকে নিয়ে জতুগৃহের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা বড় কথা নয় এবং সেটা যুধিষ্ঠিরের মহাবুদ্ধির পরিচয়ও নয় কিছু। যুধিষ্ঠির ভীম নন, কিম্বা অর্জুনও নন। তিনি আজকে যা করেন, তার ফল হয় সুদূরপ্রসারী। একটি মায়ের সঙ্গে পাঁচটি ব্যাধ যুবক জতুগৃহের আগুনে পুড়ে মরেছিল বটে কিন্তু যুধিষ্ঠিরের বুদ্ধিতে বারণাবতের সমস্ত জনপদবাসীর সমবেদনা পাণ্ডবদের অনুকূলে বাহিত হয়েছিল। তারা ছি-ছিক্কারে গালাগালি দিয়েছিল দুর্যোধন এবং ধৃতরাষ্ট্রকে— নূনং দুর্যোধনেনেদং বিহিতং পাপকর্মণা। এ গালাগালির জের হস্তিনাপুর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনেরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি পাণ্ডবরা বেঁচে আছেন। তাঁরা ঘটা করে পাণ্ডবদের শ্রাদ্ধশান্তিও করেছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, ভীষ্ম-দ্রোণের মতো বৃদ্ধদের তথা জনপদবাসীদের সমস্ত অনুকম্পা পাণ্ডবদের জন্য জমা হয়ে রইল এবং তা রইল যুধিষ্ঠিরের সঠিক পরিচালন-শক্তিতে।

জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে পাণ্ডবরা যখন শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে বনের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তখন সদা জাগরূক ভীমসেনকে আমরা রাগে ফেটে পড়তে দেখেছি, হাতে হাত ঘষতে দেখেছি। তাঁকে বলতে শুনেছি— ব্যাটা দুর্যোধন! তোর ওপরে ঠাকুরের অসীম দয়া। নইলে, এখনও পর্যন্ত যুধিষ্ঠির তোকে মেরে ফেলার হুকুম দিচ্ছেন না আমাকে? এতদিনে কর্ণ-শকুনি আর তোর ভাইদের সঙ্গে তুইও যমালয়ে যেতিস ব্যাটা। কিন্তু আমি নাচার, দাদা যুধিষ্ঠির এখনও পর্যন্ত তোর ওপর ক্রুদ্ধ হননি— কিনু শক্যং ময়া কর্তুং যত্তে ন ক্রুধ্যতে নৃপঃ।

সত্যিই যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ হন না। যেটাতে রাগ হওয়া উচিত, তাতেও তাঁর রাগ হয় না। একই ঘটনায় অন্তত দশ জন বড় মানুষের যে প্রতিক্রিয়া হয়, যূধিষ্ঠিরের তা হয় না। যুধিষ্ঠিরের ধৈর্য এবং স্থিরতার নিরিখে যদি পৃথিবীর অন্য কীর্তিমান পুরুষের প্রতিক্রিয়াগুলি লক্ষ করা যায়, তবে অন্য কার্তিমানদের কীর্তি লঘু হয়ে যাবে। যুধিষ্ঠির জানেন— ক্রোধের জন্ম হয় অভীষ্ট বস্তুর কামনা প্রতিহত হলে। যুধিষ্ঠির তাই এমন কিছু কামনা করেন না, যার অপ্রাপ্তি তাঁর মনের মধ্যে ক্রোধের জন্ম দেবে। তিনি রাজসিংহাসন চান না, এমনকী দুর্যোধন বিপন্ন হন, তাও তিনি চান না। কারণ দুর্যোধনের বিপন্নতা মানে তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র, জননী গান্ধারী! যুধিষ্ঠির সকলকে নিয়ে থাকতে চান অক্ষোভ, অক্রোধের স্বর্গভূমিতে। যুধিষ্ঠির জানেন— ক্রোধ অল্পসত্ত্ব ব্যক্তির অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। মহামনা ব্যক্তির ক্ষমাসুন্দর চোখটি ছিল বলেই দুর্যোধনের মতো ব্যক্তির দিকে তিনি সাবহেলে তাকিয়ে থাকতে পারেন, অন্যেরা তা পারেন না এবং পারেন না বলেই বিপ্রতীপভাবে তিনি যুধিষ্ঠির, অন্যেরা নন, অন্যান্যদের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের প্রতিক্রিয়া মেলে না।

সময়ে দেখা যাবে, হিড়িম্বার মতো তথাকথিত রাক্ষসীর সঙ্গেও যুধিষ্ঠির একমত হতে পারেন, কিন্তু ভীমের সঙ্গে পারেন না। হিড়িম্বা মনে মনে ভীমকে পতিত্বে বরণ করেছিল। বনের পথে যেতে যেতে সে অনুরাগিণীর সমস্ত আকুতি নিয়ে জননী কুন্তীকে বলেছিল— আপনি এবং আপনার পুত্র ভীম যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান করেন তবে আমি বাঁচব না— প্রত্যাখ্যাতা ন জীবামি সত্যমেতদ্‌ ব্রবীমি তে। শতবার অনুরুদ্ধ হয়েও ভীম তো ননই, কুন্তীও বিবাহের কোনও অনুমোদন দিতে পারেননি। কারণ যুধিষ্ঠির এখনও কোনও কথা বলেননি। পাণ্ডব-পরিবারের প্রত্যেক ব্যক্তির ভাল-মন্দ, করণীয় এবং অকরণীয় বিষয়গুলি প্রধানত নির্ভর করত যুধিষ্ঠিরের ওপরে। শেষ কথা এবং শেষ সিদ্ধান্ত প্রধানত তাঁর। সিদ্ধান্ত ভাল না খারাপ, তার বিচার হয়েছে ঘটনার ফলোদয়ের পর। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ ছিল সবসময়ই যুধিষ্ঠিরের হাতে।

হিড়িম্বা বলেছিলেন—বিপদের সময় যে নিজের এবং পরের ধর্ম রক্ষা করে, ধর্ম সেই বোঝে।

আর ধর্ম থেকে বিচ্যুতি মানেই ধার্মিকের বিপদ—আপৎসু যো ধারয়তি ধর্মং ধর্মবিদুত্তমঃ। হিড়িম্বা আরও একটা সুন্দর কথা বললেন। বললেন—ধর্ম প্রাণ রক্ষা করে, ধর্ম প্রাণ দেয়। ধর্মকে তাই লোকে ‘প্রাণদ’ প্রাণদাতা বলে। মানুষকে প্রাণ দেওয়ার মধ্যে কি নিন্দা থাকতে পারে—পুণ্যং প্রাণান্ ধারয়তি পুণ্যং প্রাণদমুচ্যতে।

কথা শুনেই বোঝা যায়—সেকালের রাক্ষস-রাক্ষসীরা কোনও আজব জন্তু নন। হিড়িম্বা ভীমকে দেখে ভালবেসে ফেলেছেন, মনে মনে তাঁকেই স্বামী হিসেবে বরণ করেছেন। ভীমকে ছেড়ে অন্য পুরুষের প্রতি আসক্ত হওয়া তাঁর কাছে ধর্মহানি তো বটেই, এবং তা আত্মহত্যার সামিল। এই মুহূর্তে স্বয়ং ভীম, জননী কুন্তী এবং অন্যান্য পাণ্ডব ভাইরাও বনের পথে চলছিলেন সম্মুখে দৃষ্টি রেখে। হিড়িম্বা তাঁদের পিছন পিছন আসছিলেন এবং কখনও বা জননী কুন্তী তাঁর কথা শুনছিলেন সানুকম্পায়। কিন্তু যেই মাত্র রাক্ষসীর মুখে প্রাণদায়ী ধর্মের কথা উচ্চারিত হল, সেই মুহুর্তেই পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির মুখ ঘুরিয়ে পৃষ্ঠগামিনী হিড়িম্বার সম্মুখে দাঁড়িয়েছেন। রাক্ষসীকে সমর্থন করেছেন পূর্ণ প্রাণে—তুমি যা বলেছ, হিড়িম্বা; সব সত্য—এবমেব যথাথু ত্বং হিড়িম্বে নাত্র সংশয়ঃ।

আর ঠিক এইখানেই যুধিষ্ঠির। যে মুহূর্তে ধর্মের নীতি তাঁর মনে সঠিক স্বরূপ নিয়ে দাঁড়াবে, তখনই তিনি মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়াবেন, সমর্থন করবেন রাক্ষসীকেও—তুমি যা বলেছ, তাই ঠিক এবমেব যথাথু ত্বং—ধর্ম যে প্রাণ দেয়, ধর্ম যে প্রাণদ৷ যুধিষ্ঠির হিড়িম্বার মুখে যা শুনেছিলেন, আমরা ভবিষ্যতেও দেখব—সেই ‘প্রাণদ’ ধর্মের কথা তিনি মনে রেখেছেন আজীবন৷ হিড়িম্বাকে খুশি হয়ে অনুমতি দিয়েছেন—দিনের বেলায় তুমি নিয়ে যাও আমার ভাইকে, যথেচ্ছ বিহার কর, কিন্তু রাত্রি হওয়ার আগেই তাঁকে ফিরিয়ে দেবে আমাদের কাছে৷ পাণ্ডবরা বনের পথে চলেছেন৷ নানা বিপদ আসে রাতের বেলাতেই৷ ভীমকে তখন সঙ্গে দরকার৷ অতএব সব দিক রেখেই তিনি হিড়িম্বাকে প্রিয়মিলনের অনুমতি দিলেন সানন্দে।

আসলে ধর্ম ব্যাপারটা সমস্ত ব্যাপ্তি নিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে ধরা দেয়৷ এই ধর্ম ফুল-বেলপাতা-নৈবেদ্যর ধর্ম নয়। বিচিত্র এবং বিষম পরিস্থিতিতে যেটা ন্যায়-নীতির যুক্তি সিদ্ধ করে, যেটা সাধারণ মানদণ্ডে ‘হওয়া উচিত’ বলে মনে হবে, সেটাই যুধিষ্ঠিরের ধর্ম। পথ চলতে চলতে আপন ভ্রাতার প্রণয়প্রার্থিনী তথাকথিত এক রাক্ষসী রমণীর একনিষ্ঠ অনুরাগের মধ্যে যখন ধর্মের সংজ্ঞা খুঁজে পান যুধিষ্ঠির, তখনই বুঝতে হবে তিনি কোনও সাধারণ মানুষ নন। কোথায়, কখন, কোন ঘটনায় তিনি ধর্মের সংজ্ঞা খুঁজে পাবেন, এই অনিশ্চয়তার মধ্যে চলতে চলতেই আমাদের যুধিষ্ঠিরকে চিনে নিতে হবে৷ অনুরাগিণীর ভালোবাসার মধ্যেও যে ধর্ম আছে এবং সেই ধর্ম স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে যে কোনও লজ্জা বা সংকোচ নেই এ-কথা রাক্ষসীই বলেছিল—যেন যেনাচরেদ্ধর্মং তস্মিন্ গর্হা ন বিদ্যতে৷ কিন্তু রাক্ষসীর প্রণয় স্বীকার করে নিতে স্বয়ং ভীমের কিছু সংকোচ ছিল হয়তো৷ জননী কুন্তী হিড়িম্বার অনুনয়ে বিচলিত ছিলেন ঠিকই, কিন্তু পুত্রেরা কেউই কিছু বলছে না দেখে তিনিও জোর করে কিছু বলেননি৷

কিন্তু লজ্জা-সংকোচের বিচার ছাড়াও এই কাজটা করলে আমার স্বার্থ থাকবে, এটা করলে আমার ভাল লাগবে, সেটা করলে আমার পারিবারিক সুবিধে হবে—এই নিজের ভাল-মন্দ, পরিবারের স্বার্থ, লজ্জা-সংকোচ—সব কিছুর ওপরে উঠে একেকটি পরিস্থিতিতে নিজের স্বার্থ, নিজের মান-মহিমা-গরিমাকে গৌণ করে দেখার মধ্যেই যুধিষ্ঠিরের ধর্মের সংজ্ঞা। যুধিষ্ঠিরকে তাই দেখতে হবে নতুন আলোয়, সার্বিক নীতিবোধের সুষম মাত্রায় এবং স্বয়ং ব্যাসের দৃষ্টিতে। বনের পথ ছেড়ে পাণ্ডবরা যখন বাসস্থান খুঁজে বেড়াচ্ছেন লোকালয়ের মধ্যে, তখন ব্যাস এসেছিলেন বনভূমিতে। দুর্যোধনেরা সবাই যে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারবার জন্যই নির্বাসনে পাঠিয়েছেন—এ-কথা ব্যাস জানতেন। বনভূমির মধ্যে জীবিত পাণ্ডবদের দেখে তাঁর স্নেহবৃত্তি উদ্‌বেলিত হয়ে উঠেছিল। কুন্তীকে তিনি আশীর্বাদ করে বলেছিলেন—বেঁচে থাকো মা! তোমার এই বড়ছেলে চিরন্তন ধর্মের নিত্যকালের আশ্রয়। দেখে নিয়ো, সে তার সত্যধর্ম বজায় রেখেই এই পৃথিবীর আধিপত্য লাভ করবে—জীব পুত্রি সুতস্তে’য়ং ধর্মনিত্যো যুধিষ্ঠিরঃ।

‘ধর্মনিত্য’। যুধিষ্ঠিরের বিশেষণ হিসেবে এই যে বিশেষণটি বাসের মুখ দিয়ে বেরুল, এটা কোনও মৌখিকতার আড়ম্বরমাত্র নয়। ‘ধর্মনিত্য’ কথাটা যে যেভাবেই অর্থ করুন, আমরা মনে করি একটি মানুষের মনের মধ্যে যদি নিরন্তর ঔচিত্যের চর্চা হতে থাকে তবে সেই চর্চাই যুধিষ্ঠিরের সহজাত সঙ্গী, এমনকী যুধিষ্ঠির যদি রাজসিংহাসনে বসতে চান, তবে সেখানেও ঔচিত্যের চর্চা বজায় রেখেই তা চান, নচেৎ নয়। যুধিষ্ঠিরের ধর্ম শুধু তাঁকে বাঁচায় না, তাঁর ধর্ম তাঁর চারপাশে থাকা পরিবার, পরিজন এমনকী তাঁর অনাত্মীয়দেরও বাঁচানোর চেষ্টা করে।

‘ধর্মনিত্য’ কথাটা বললে মনে হতে পারে—এ বুঝি যুধিষ্ঠিরের সহজাত গুণ, এই বিশাল মনুষ্যসমাজ এবং বহিঃপ্রকৃতি থেকে যেন তাঁর শেখার কিছু নেই। আমরা বলি—‘হ্যাঁ, ধর্ম তাঁর নিত্যসঙ্গীই বটে, কিন্তু তিনি ধর্ম এবং নীতিবোধের প্রকৃষ্টতম আধার বলেই, বাহ্য-জগৎ এবং মনুষ্য-সমাজের চিরন্তন নীতিগুলিও তাঁর হৃদয়ে গভীর ছায়া ফেলে এবং যুধিষ্ঠির তখন শেখেন। একজন পুরুষকে ভালবেসে সেই রাক্ষসী রমণী যখন পরম আকুতিতে আত্মনিবেদন করেছে, তখন সেই রমণীর কাছেই তিনি ভালবাসার ধর্ম শেখেন। সোচ্ছ্বাসে বলেন, যা বলেছ ঠিক, এটাই ধর্ম—এবমেতদ্‌ যথাথু ত্বম্‌। একইভাবে এই শেখার নমুনাটুকু আবার দেখতে পাব একচক্রা গ্রামে। সেই গ্রামে এক ব্রাহ্মণ বক-রাক্ষসের খাবার জোগাড় করতে না পেরে নিজেই মরতে চেয়েছিলেন। পাণ্ডবরা কুন্তীর সঙ্গে সেই ব্রাহ্মণের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণের বিপদ দেখে কুন্তী নিজে ভাঁকে কথা দিয়েছিলেন—আমার একটি পুত্র বক-রাক্ষসের খাবার পৌঁছে দেবে। সে আগে অনেক রাক্ষস-খোক্কস মেরেছে, গায়েও প্রচুর শক্তি। রাক্ষসরা তাকে কিছুই করতে পারবে না। আপনি নিশ্চিন্ত হন—অমার ওই ছেলেটিই বক-রাক্ষসের খাবার পৌঁছে দিয়ে আসবে—রাক্ষসায় চ তৎ সর্বং প্রাপয়িয্যতি ভোজনম্‌।

আমরা বেশ জানি—কুন্তী ভীমের কথা ভেবেই ব্রাহ্মণকে বিপৎ-ত্রাণের কথা দিলেন। কিন্তু কথাটা যুধিষ্ঠিরের কানেও গেল। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই যুধিষ্ঠির একেবারে অস্থির হয়ে পড়লেন। আমরা আগে বলেছি—ভীম অর্জুন যত বড় বীরই হন না কেন, যুধিষ্ঠির যে তখনও তাঁদের খুব বেশি ভরসা করতেন, তা নয়। এর কারণ এই নয় যে, যুধিষ্ঠির তাঁদের বীর ভাবতেন না; আসলে পিতৃহারা ভাইগুলিকে তিনি এমনভাবেই পিতার মতো আগলে রাখতে চাইতেন যে, জেনেশুনে কোনও বিপন্নতার মুখে ঠেলে দিতে তাঁর চিন্তা থেকে যেত। জতুগৃহে আগুন লাগানো হবে—এ ঘটনা তাঁর জানা ছিল, হিড়িম্বার সঙ্গে ভীমের বাহুযুদ্ধও তিনি দেখেছেন, কিন্তু এ যে বক-রাক্ষস। একটি নগরের সে রাজা, নগরের সমস্ত মানুষ তার ভয়ে তটস্থ। মা হয়ে কুন্তী কী করে তাঁর ছেলেকে এই বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন—এই কথা যুধিষ্ঠির বুঝতে পারছেন না।

হিড়িম্বা কিংবা বক-রাক্ষসকে আমাদের রূপকথার রাক্ষস ভাবার কোনও কারণ নেই। সোজা কথায় এঁরা আর্যেতর জনজাতির মানুষ হতে পারেন অথবা আজকালকার দিনে একেকটি পাড়ার আধিপত্য যেমন একেকজন গুণ্ডা-মস্তানের হাতে থাকে এঁরাও তেমনই পেশিশক্তিবিশিষ্ট মানুষও হতে পারেন। গিরীন্দ্রশেখর বসু মহাশয় রাক্ষস বলতে গুণ্ডা-বদমাশই বুঝিয়েছেন এবং তা যদি হয় তবে পেশিশক্তির লড়াইতে ভীমের সঙ্গে পেরে ওঠা যে সে-কালে কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না, সেটা তাঁর মা-জননী বুঝলেও যুধিষ্ঠির বুঝতে পারছেন না। যুধিষ্ঠির বললেন—মা! ভীম কি নিজের ইচ্ছেয় এই কাজ করতে যাচ্ছে, না আপনি তাকে বলেছেন। জননী স্বীকার করলেন যে, তিনি বলেছেন ভীমকে রাক্ষসের কাছে যেতে। যুধিষ্ঠির বললেন—আপনি পরের ছেলের জন্য নিজের ছেলেকে বিপদে ফেলতে উদ্যত হয়েছেন, এটা কেমন কথা হল—কথং পরসুতস্যার্থে স্বসুতং ত্যক্তুমিচ্ছসি? কোন মানুষ আপনার এই কাজ সমর্থন করবে? নিজের পুত্রত্যাগ কি কোনও ধর্মে সইবে, বিশেষত মায়ের ধর্মে?

বস্তুত এমন একটা প্রতিক্রিয়া যেন যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে আশা করা যায় না। পরের উপকারের জন্য যুধিষ্ঠির আত্মবলি দেবেন না, এবং সে কাজে তিনি বাধা দিচ্ছেন— এমনটি যেন যুধিষ্ঠিরের কাছে আশা করা যায় না। যিনি স্বর্গে যাবার পথে অধম কুকুরটিকে পর্যন্ত ত্যাগ করেননি, তিনি নীচ স্বার্থপরের মতো কথা বলছেন— এ যেন বিশ্বাস করা দুরূহ। লক্ষণীয়— এখানেও যুধিষ্ঠিরের ধর্মবোধ কাজ করছে এবং সে ধর্ম পারিবারিক ধর্ম। পিতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে তিনি ছোটভাইদের সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। তিনি জানেন— ভীমের কোনও বিপদ হলে লোকে তাঁকেই দুষবে। ভীমকে রক্ষা করা তাঁর পারিবারিক দায় এবং সে দায়ও যুধিষ্ঠিরের কাছে ধর্ম। তা ছাড়া কিছু স্বার্থও আছে, অবশ্য সেটাও পারিবারিক স্বার্থ। যুধিষ্ঠির নিজেকে কোনওদিনই খুব একটা বিশাল যুদ্ধবাজ মানুষ বলে ভাবেন না, অথচ নিজের জননী এবং ভাইদের স্বার্থেই তাঁর পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করার দায়িত্ব আছে। যুধিষ্ঠির জানেন, যুদ্ধ যদি লাগে তবে অর্জুনের মতো ভীমও তাঁর অন্যতম ভরসা। যুধিষ্ঠির বললেন— যার শক্তিতে আমরা দুর্যোধনদের মেরে এতকালের হৃতরাজ্যটা পেয়ে গিয়েছি বলে মনে করি, সেই ভীমকে তুমি এইভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছ মা। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? বেশ বুঝতে পারছি, সারা জীবন দুঃখ-কষ্ট সয়ে-সয়ে তোমার জ্ঞান বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে— ক্কচিনু দুঃখৈর্বুদ্ধিস্তে বিলুপ্তা গতচেতসঃ।

কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বোঝালেন— বুদ্ধিশুদ্ধি সব ঠিকই আছে বাবা। আমার মাথায় কোনও গোলমাল হয়নি। তবে কী জান, এই ব্রাহ্মণের বাড়িতে আমরা সুখে বাস করছি এতকাল। দুর্যোধন আজও টের পায়নি— আমরা বেঁচে আছি। আমাদের বাড়িওয়ালা ব্রাহ্মণ এত উপকার করেছেন, আমি শুধু সেই উপকারের প্রতিদান দিচ্ছি, বাবা— তস্য প্রতিক্রিয়া পার্থ ময়েয়ং প্রসমীক্ষিতা। আরও একটা কথা। একজন সাধারণ লোক উপকার পেলে যতটুকু প্রত্যুপকার করার কথা ভাবে একজন বড়মানুষ তার থেকে বেশি উপকার করার চেষ্টা করেন। ভাবটা এই, অন্তত তোমার তাই করা উচিত— যাবচ্চ কুর্যাদন্যো’স্য কুর্যাদ্‌ বহুগুণং ততঃ। আজ ভীম যদি বিপন্ন ব্রাহ্মণের এই উপকারটুকু করে তবে দুটি কাজ হবে একসঙ্গে। এক, উপকারের প্রত্যুপকার, দুই, ধর্ম, বিপন্নকে রক্ষা করার ধর্ম— প্রতীকারশ্চ বাসস্য ধর্মশ্চাচরিতো মহান্‌।

সেই শব্দটা আবার কানে এল যুধিষ্ঠিরের। ধর্ম। পারিবারিক ধর্মের চেয়েও মানুষের ধর্ম বড়। শুধু ব্রাহ্মণ নয়, একেবারে শূদ্র পর্যন্ত সর্বস্তরের সমস্ত মানুষের বিপৎ-ত্রাণের ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে বুঝিয়ে কুন্তী বললেন— আমি ব্যাসের কাছে এই কথাগুলি শুনেছি। ধর্মনিত্য যুধিষ্ঠির— এমন স্বচ্ছ তাঁর হৃদয়াধার যেখানে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে ধর্মশব্দের উচ্চারণ মাত্রেই তাঁর ‘বিশদীভূত-মনোকুরে’ সেই ধর্মের ছায়া পড়ে। যুধিষ্ঠির তখন শেখেন। হিড়িম্বার কাছে এক ধর্ম শেখেন, মায়ের কাছে আরেক ধর্ম শেখেন, বিদুরের কাছে শেখেন অন্য এক ধর্ম। এমনি করে শিখতে-শিখতেই ধর্মনিত্য যুধিষ্ঠিরের ধর্মময় মনোজগৎ ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হয়। মায়ের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই যুধিষ্ঠির বলে ওঠেন— উপপন্নমিদং মাতঃ— আপনি যা বলেছেন তা সবাংশে ঠিক। একদিকে হিড়িম্বার অনুরাগের ধর্ম, অন্যদিকে নিজের পরিবারের চেয়ে বেশি পরের উপকারের ধর্ম— এই দুই বিপ্রতীপ ধর্মের প্রশ্নে যুধিষ্ঠিরের প্রতিক্রিয়া একই। যুধিষ্ঠির শিখে নিয়েছেন, অন্যের ধর্ম আত্মসাৎ করেছেন।

বক-রাক্ষস ভীমের শক্তির কাছে পর্যুদস্ত হল, সে মারা গেল। এই ঘটনার পরেই আমরা একচক্রা গ্রামের যেখানে পাণ্ডবরা এতকাল বাস করছিলেন, সেখানে এক ব্রাহ্মণকে সমাগত দেখছি। ব্রাহ্মণ কথায় কথায় দ্রোণাচার্য এবং পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের চিরশত্রুতার কাহিনী শোনালেন। শোনালেন দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর অনুষ্ঠিত হবে— এই জব্বর খবর যুধিষ্ঠির এবং অন্যান্য পাণ্ডবদের মনে যে খুব দোলা লাগিয়েছিল— তা মোটেই নয়। কিন্তু পাণ্ডবজননী কুন্তী পুত্রদের বিয়ে দেবার বাসনা করছিলেন মনে মনে। হয়তো সেই কারণেই তিনি পুত্রদের কাছে পাঞ্চালরাজ্যে যাওয়ার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন, যদিও তাঁর অজুহাত ছিল একেবারেই অন্যরকম। পাঞ্চালদেশে ভাল ভিক্ষা মিলবে এবং দেশটাও খুব সুন্দর। এটাই ছিল তাঁর অজুহাত।

পাঞ্চালে যাত্রা করার ব্যাপারটা প্রায় স্থিরই হয়ে গিয়েছিল। এই গমনোন্মুখ অবস্থায় আমরা স্বয়ং ব্যাসদেবকে উপস্থিত হতে দেখছি সেই বন্য গ্রামের ভিতর। একটা ঘটনা এখানে লক্ষ করার মতো দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রের জতুগৃহের চক্রান্তের পর পাণ্ডবদের যাত্রাপথে আমরা দু’বার ব্যাসকে পাণ্ডবদের কাছে ঘুরে যেতে দেখলাম। ব্যাসদেব কৌরব-পাণ্ডবদের এক পিতামহ। নিজ মুখেই তিনি বলেছেন— তোমরা এবং ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা, দু’পক্ষই আমার কাছে সমান— সমাস্তে চৈব মে সর্বে যুয়ং চৈব ন সংশয়ঃ। কিন্তু আজকে তোমরা যেভাবে বিপন্ন হয়ে আছ এবং তোমাদের যা বয়স, তাতে এখন তোমাদের ওপরেই আমার স্নেহ বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে— তস্মাদভ্যধিকঃ স্নেহো যুম্মাসু মম সাম্প্রতম্‌।

পাণ্ডব-কৌরবের বংশকর পিতামহ যেভাবে পাণ্ডব-পক্ষপাতী হয়ে পড়েছেন, তার একটা বড় কারণ অন্তত যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠিরের ওপর তাঁর বড় ভরসা। যুধিষ্ঠির একদিন ধর্মের দ্বারা পৃথিবী জয় করে ধর্মানুসারে রাজ্য শাসন করবেন— ধর্মেন পৃথিবীং জিত্বা…প্রশাসিষ্যতি ধর্মরা এই ভাবনা ব্যাসের মনে দৃঢ়মূল। যুধিষ্ঠির তাঁর এতদিনের ধৈর্য এবং কষ্টসহিষ্ণুতার মধ্য দিয়েই ব্যাসের এই পক্ষপাত জয় করে নিয়েছেন। আজ পাঞ্চাল-যাত্রার মুখে আবার ব্যাসের সঙ্গে দেখা হল। দ্রৌপদীর প্রসঙ্গ এবং পাঞ্চাল-যাত্রার পরামর্শ তাঁর মুখ দিয়েও শোনা গেল। মুনিশ্রেষ্ঠ ব্যাসের এই পক্ষপাতের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি ঘটনা ঘটল পাঞ্চাল-যাত্রার পথে। অর্জুনের সঙ্গে গন্ধর্ব চিত্ররথের যুদ্ধ এবং বন্ধুত্বের পর পাণ্ডবরা পুরোহিত নির্বাচন করলেন ধৌম্যকে।

মনে রাখতে হবে— পুরোহিত নিবার্চন মানে একজন পুরুতঠাকুর ঠিক করে আসা নয়। সেকালের দিনে পুরোহিতরা ক্ষত্রিয়-রাজাদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে অংশগ্রহণ করতেন। মন্ত্রিত্ব থেকে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছিল এই পুরোহিতের পদমর্যাদা। সূর্যবংশীয় দশরথ-রামচন্দ্রের মতো রাজারা পুরোহিত বশিষ্ঠের আজ্ঞাধীন ছিলেন। পুরোহিতরা যেরকম রাজাদের বৈদিক যাগ-যজ্ঞ করাতেন, তেমনই তাঁদের কাছেই রাজনীতি এবং দণ্ডনীতি শিখতেন ক্ষত্রিয়-পুরুষেরা। রাজারা যতক্ষণ পর্যন্ত কোনও বিশিষ্ট পুরোহিতের সঙ্গে যুক্ত না হতেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের রাজনৈতিক সত্তা সম্পূর্ণ হত না। পাঞ্চাল যাত্রার পথে যুধিষ্ঠির ভাইদের সঙ্গে নিয়ে ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠ দেবলের ছোটভাই ধৌম্যের সঙ্গে পরিচিত হলেন। পাণ্ডবরা সকলে তাঁকে পৌরোহিত্যে বরণ করলেন।

ধৌম্যের মতো গুরু লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডবরা যে শুধু নিজেদের অভিভাবকযুক্ত মনে করলেন তাই নয়— নাথবন্তমিবাত্মানং— তারা মনে করলেন— রাজ্য এবং পাঞ্চালী-দ্রৌপদী দুইই তাঁদের করতলগত— তে সমাশংসিরে লব্ধাং শিয়ং রাজ্যঞ্চ পাণ্ডবাঃ। আসল ঘটনা হল, ধৌম্যের সঙ্গে পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের রাজনৈতিক শিক্ষা আরম্ভ হল। যে শিক্ষা এতদিন বিদুরের মাধ্যমে ইতস্তত লাভ করছিলেন যুধিষ্ঠির তার পাকাপাকি ব্যবস্থা হল ধৌম্যকে গুরু হিসেবে পাবার সঙ্গে সঙ্গে। ‘ধর্মনিত্য’ যুধিষ্ঠিরের রাজনীতির শিক্ষা আরম্ভ হল রাজ্যহীন অবস্থায়, বনপথে। পাণ্ডবরা ধৌম্যকে নিয়েই পাঞ্চালে পৌঁছলেন।