কর্ণ – ১১

১১

আমরা যেখান থেকে আরম্ভ করেছিলাম, এখন আবার সেইখানে ফিরে যেতে চাই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। রণদুন্দুভির আওয়াজ, শিঙা, মাদল, শঙ্খ, কাড়ানাকাড়া সব স্তব্ধ। মাত্র একদিন আগেও যেখানে ধনুকের টংকার, দুই দুই প্রতিস্পর্ধী বীরের পরস্পর আক্ষেপ, বাণ কিংবা গদার ঝনঝনি শোনা গেছে, আজ সেখানে রাত্রির নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। এই গতকালও যেখানে অশ্বত্থামার ব্রহ্মশিরা আর অর্জুনের পাশুপত অস্ত্রের সংঘাতে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠেছিল, আজ সেখানে অরণ্যের স্তব্ধতা। ছিন্নশাখ বৃক্ষের মতো জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র অমলিন চোখে শুধু রাজসভায় বসে আছেন আর সঞ্জয় তাঁকে শুধু শত প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা দিচ্ছেন আর বলছেন—কেঁদে কী করবেন মহারাজ। এই বসুমতী এখন বড় নির্জন—নির্জনেয়ং বসুমতী শুন্যা সম্প্রতি কেবলা। সঞ্জয়ের ভাবটা এই যে, কাঁদারও যেন একটা লোকাপেক্ষা আছে। যিনি কাঁদছেন, তাঁর কাঁদা যদি লোকে না দেখে, না শোনে, তা হলে সে কাঁদার যেন জোর কমে যায়। এরই মধ্যে জননী গান্ধারী, পুত্রশোকে দীর্ণা গান্ধারী, কুরুকুলের সমস্ত কুলবধূদের নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। দিকে দিকে শুধু শব, ভগ্ন রথ-চক্র, ছিন্ন-উষ্ণীষ মৃত সৈনিক এবং সেনানায়কের ভিড়। একজন আরেকজনের শরীরের ওপর মরে পড়ে আছে, কারও দেহ শেয়ালে ছিঁড়ে খাচ্ছে, কারও চোখ উপড়ে নিয়েছে শকুনে, কেউ বা আলসে শত্রুর উৎক্ষিপ্ত গদাকে প্রিয়ার মতো জড়িয়ে ধরে মৃত্যুর শৃঙ্গার রচনা করেছে ভুয়ে—মুখটি নুয়ে পড়েছে চুম্বনের ভঙ্গিতে—শেরতে বিমুখাঃ শুরা দয়িতা ইব যোষিতঃ।

গান্ধারী একটি একটি করে তাঁর পুত্রদের স্পর্শ করছিলেন আর ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন। অথচ মনে মনে তিনি জানেন যে, প্রধান দোষটা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধনেরই। একটার পর একটা মরা ছেলের মুখ দেখে গান্ধারী এতই শোকাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে, একসময় তিনি শাপ দিতে উদ্যত হয়েছিলেন পাণ্ডবদের। শেষ পর্যন্ত ব্যাসদেবের অনুশাসনে গান্ধারী নিজের মধ্যে ফিরে আসেন এবং কুরুকুল ধ্বংস হল কেন, তার একটা অনবদ্য ব্যাখ্যা দেন তিনি। গান্ধারী বললেন—দুর্যোধন আর শকুনির অপরাধেই সমস্ত কুরুকুল ক্ষয় হয়ে গেল, আর এই ক্ষয়শাধনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হল কর্ণ আর দুঃশাসন—কর্ণ দুঃশাসনাভ্যাঞ্চ বৃত্তা’য়ং কুরুসংক্ষয়? গান্ধারীর ভাবটা এই যে, কুরুকুল যদি একটা গাছের মতো হয়, তা হলে সেই গাছটা কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্যোধন আর শকুনি কিন্তু গাছ কাটার ব্যাপারে কড়ুলের কাজটি করেছেন কর্ণ এর দুঃশাসন। গান্ধারী যখন এইসব তত্ত্বকথা বুঝতে পারেন তখন তিনি কুরুবংশের যোগ্যতম কুলবধূ, কিন্তু নিমেষে তাঁর অন্তর থেকে বেরিয়ে আসে জননী আর তখনই যুদ্ধক্ষেত্রের এক একটি শব তাঁর কাছে শত পুত্রের শত ইতিহাস রচনা করে। দুর্যোধনকে তিনি এক একবার দেখে আর মনে হয় এই আমার সেই অভিমানী হলে, যার জন্য পৃথিবীর সমস্ত বীরপুরুষেরা একসঙ্গে কোমর বেঁধেছিল। বিস্ময়ে •গান্ধারী কৃষ্ণকে ডেকে বলে—কৃষ্ণ দেখেছ এঁদের, সব যেন আমার দুর্যোধনের পোষ-মানা বাঘ, আজকে কেমন নিবোনো আগুনের মতো দেখাচ্ছে। আর এই যে জয়দ্ৰথ, কর্ণ—এরা কোনওদিন মারা যাবে—এ কেউ ভাবতে পেরেছিল—বিনাশঞ্চ কশ্চিন্তয়িতুমর্হতি?

গান্ধারী ছিন্ন-ভিন্ন দুর্যোধনের দেহ জড়িয়ে ধরে স্নেহ-তর্পণ করলেন মৃত্যুপথযাত্রী পুত্রের! দেখলেন দুঃশাসনকে, বিকর্ণকে, একে একে সব পুত্রকে। দেখলেন পাণ্ডবকুলের অঙ্কুর অভিমন্যকেও, দেখলেন দুর্যোধনের ঘরে নিজের নাতি—লক্ষ্মণকেও। এবারে আস্তে আস্তে তিনি এসে পৌঁছেছেন কর্ণের কাছে, তাঁর ছেলের আবাল্য বন্ধু, দুর্যোধনের সুখে সুখী, তাঁরই দুঃখে দুঃখী—সেই কর্ণ। কর্ণ যেখানে মৃত পড়ে আছেন সেখানে প্রচুর রক্ত জমে আছে। অন্যান্য বীরের মতো রথে যুদ্ধ করতে করতে তাঁর মৃত্যু হয়নি। তাঁর মৃত্যু হয়েছে ভূমিতে, এইজন্য যুদ্ধরথ তাঁর রক্তের প্রাপ্য অংশ না পেয়ে অভিমানে রণক্ষেত্রে ছেড়ে চলে গেছে আর রক্তপিপাসু কুরুক্ষেত্রের মাটি জমাট হয়ে গেছে কর্ণের দেহ থেকে গড়ানো চাপ চাপ রক্তে।

চাপ চাপ রক্তের মধ্যেই মৃত কর্ণ শুয়ে আছেন, শান্ত সমাহিত—শোণিতৌঘপরীতাঙ্গং শয়ানং পতিতং ভুবি। কর্ণের শরীর থেকে তাঁর ছিন্ন মুণ্ডটি আলাদা অন্য এক জায়গায় পড়ে আছে, কারণ অর্জুন যখন মাটিতে দাঁড়ানো কর্ণের মাথাটি ‘অঞ্জলিক’ বাণ দিয়ে কেটে ফেলেছিলেন তখন সেটা আগে ছিটকে মাটিতে পড়েছিল, তারপর পড়েছিল কর্ণের শরীর—তৎ প্রাপতচ্চাঞ্জলিকেন ছিন্নম/অথাস্য কায়ো নিপপাত পশ্চাৎ। জননী গান্ধারী এসে নিশ্চয় তাঁর ছিন্ন মুণ্ডটি এনে কর্ণের ধড়ের সঙ্গে জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করলেন, ঠিক যেমন ভেঙে-যাওয়া মাটির পুতুল জোড়া দেবার চেষ্টা করি আমরা। নিশ্চয়ই জোড়া লাগল না এবং তার কারণও আছে। পরিত্যক্ত রণক্ষেত্র জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু শেয়াল, শকুন আর অন্যান্য মাংসাশীর দল। এইসব প্রাণীরা কর্ণের দেহটা ছিঁড়ে-কুড়ে খেয়ে অল্পই অবশিষ্ট রেখেছে—অল্পাবশেষো’পি কৃতো মহাত্মা। কৃষ্ণপক্ষে চতুর্দশীর চাঁদের যতখানি ক্ষয় যায় কর্ণের শরীরের এখানে ওখানে ততটাই খেয়ে ফেলেছে শেয়ালে শকুনে। এই বীভৎস চেহারা দেখে গান্ধারীরও যেন আর দেখতে ইচ্ছে করছে না। মুখে বলছেন—চতুর্দশীর ক্ষীণ চাঁদ যেমন চোখে একটুও ভাল লাগে না, তেমনি শেয়ালে-খাওয়া শরীর দেখতে একটু ভাল লাগছে না আমার—ন নঃ প্রীতিকরঃ শশীব/কৃষ্ণস্য পক্ষস্য চতুর্দশাহে। তবু গান্ধারী কর্ণের কাটা মুণ্ডটি নিশ্চয় এনে রাখলেন তাঁর কর্তিত স্কন্ধের কাছে। আলুলায়িতা জননী এবার আনত হলেন ভুমিতে। সস্নেহে কর্ণের শিরচুম্বন করলেন, মস্তক আঘ্রাণ করলেন—কর্ণস্য বক্‌ত্রং পরিজিঘ্ৰমানা। এই আঘ্রাণের সঙ্গে সঙ্গেই যেন কর্ণের ওপর পূত্র দুর্যোধনের সখ্যগন্ধ ভেসে এল গান্ধারীর নাকে। আবারও কেঁদে উঠলেন গান্ধারী। কর্ণের মৃত্যুর সঙ্গে দুর্যোধনের মৃত্যু একাকার হয়ে গেল শোকের কান্নায়—কর্ণস্য বক্‌ত্রং পরিজিঘ্ৰমানা-রোরূয়তে পুত্রবধাভিতপ্তা। শৈশবের অজ্ঞানে এক মায়ের অননুভূত চুম্বনে যাঁর জীবন আরম্ভ হয়েছিল, মৃত্যুর অজ্ঞানে আরেক মায়ের অননুভূত চুম্বনে তাঁর জীবন শেষ হয়ে গেল। শুধু যে চুম্বন কর্ণের জীবনে সত্যি হয়ে রইল, সে সূতমাতা রাধার চুম্বন কর্ণ তাই পাণ্ডব হয়েও পাণ্ডব নন, কৌন্তেয় হয়েও কৌন্তেয় নন। কৌরবদের আশ্রয়স্থল হওয়া সত্ত্বেও কর্ণ কৌরব নন। তিনি নিতান্তই রাধেয়।