ভীম – ১

মহাভারতের একটি পুণ্য চরিত্র-বিশ্লেষণ করতে যাব, অথচ কেন যে আমার এমন একটা কুকথা মনে এল। সজ্জন পাঠকেরা আমার দু’গালে দুটো চড় কষিয়ে বলতে পারেন—তোমার কি মহাভারতের মতো বিশাল মহাকাব্যের গাম্ভীর্য এবং মাহাত্ম্য সম্বন্ধে কোনও বোধ নেই? কোথায় মহাভারতের এক অতি প্রিয় চরিত্র সম্বন্ধে তোমার গভীর শব্দ-রাশি ব্যবহার করবে, তা না যত সব চটুল কথাবার্তা আমদানি করে বিষয়ের অমর্যাদা ঘটাচ্ছ। এসব কথা আপনারা বলতেই পারেন। কিন্তু আমিও বা কী করি? আসলে চরিত্র হিসেবে ভীমের অতিরিক্ত জনপ্রিয়তার জন্যই আমাকে এই চটুল উপমাটি ব্যবহার করতে হচ্ছে।

আমার কলেজ জীবনের এক শিক্ষিত মারোয়াড়ি বন্ধু একটা ভারী মজার কথা বলেছিল। উল্লেখ্য, সে খুব চটুল হিন্দি সিনেমা দেখতে ভালবাসত। সাধারণ হিন্দি সিনেমার মূল ‘ফর্মুলাটা’ বোঝানোর জন্য সে আমাকে তার স্বভাবসিদ্ধ উচ্চারণে বলেছিল—বুঝেছিস! প্রথম দিকে নায়কের নানা ঝামেলা থাকে, তখন ভিলেন খুবসে ঢিসুম-ঢাসুম চালায়, আর ধর্মিন্দর মার খায়। তারপর ঘটনার জাল যখন গুটিয়ে আসে, তখন মারে, আর ভিলেন মার খায়। পাবলিক তখন খুশি হয়। তাদের ইচ্ছা পূরণ হয়, তাই তারা হাততালি দেয়।

বাস! আমার উপমান-উপমেয় ভাব এইটুকু বই নয়। ভীমের মহান চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমার যে হিন্দি-সিনেমার ‘ফর্মুলা’ মনে পড়ল—তার কারণ একটাই। ভীমের চরিত্র এত বেশি ইচ্ছাপূরক, এতই বেশি জনপ্রিয় যে, মহাভারতের বিশাল এবং জটিল প্রেক্ষাপটে কৌরবদের দাপট যখন বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে, তখন সেই বিষম পরিস্থিতি থেকে অবস্থা আপন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা এবং শেষ বিজয়ীর হাসিটি হাসা—এর জন্য ভীমের ওপর আপনার পক্ষপাত থাকবেই এবং তাঁর ক্রিয়াকলাপের জন্য হাততালি আপনাকে দিতেই হবে।

ভীমের জন্মলগ্নেই এমন একটা ‘স্টান্ট’ আছে, যা মহাভারতের পাঠক-শ্রোতা পাবলিককে ভীমের সম্বন্ধে পৃথক কোনও চেতনায় অবহিত করে রাখে। মহারাজ পাণ্ডু তখন বড় ভাই ধৃতরাষ্ট্রকে রাজ্যভার দিয়ে দুই সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে হিমালয়ের আকুল-শোভায় বনে বনান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পুত্র উৎপাদন করার শক্তি তাঁর ছিল না, কিন্তু নিজের পরকাল এবং বয়সোচিত স্নেহে তিনি পুত্ৰমুখ দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠলেন। পাণ্ডুর অনুরোধে এবং উপরোধে কুন্তী শেষ পর্যন্ত দুর্বাসা মুনির মন্ত্রে দেবতাদের আহ্বান করে পুত্র লাভ করতে চাইলেন।

প্রথমেই ধর্মকে আহ্বান করে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে পেলেন কুন্তী। আকাশবাণী হল—এ ছেলে ভারী ধার্মিক হবে, সত্যের পথ থেকে এ কখনও বিচ্যুত হবে না। বস্তুত এমন একটি ধার্মিক এবং জ্ঞানবান পুত্র যদি কোনও মুনি-ঋষি বা ব্রাহ্মণ-সজ্জনের ঘরে জন্মত, তাহলে তাঁর আর দ্বিতীয় কোনও কামনা থাকত না। প্রথম একটি ধার্মিক এবং ধর্মজ সন্তান লাভ করে পাণ্ডুও নিশ্চয় আনন্দ পেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষত্রিয়ের ঘরে, রাজার ঘরে ধর্ম এবং সত্যের যত মূল্যই থাকুক, সেই বেদের আমল থেকে ক্ষত্রিয়-বধূরা বীরপুত্রের জননী হতে চায়। পাণ্ডুও কি সে কথা বোঝেন না? বোঝেন। বোঝেন বলেই ধার্মিক ধর্মরাজ পুত্রলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে কাল বিলম্ব না করে পাণ্ডু কুন্তীকে বলেছেন—ক্ষত্রিয়ের কাছে শক্তি আর বলই সব, তুমি তাই মহাশক্তিধর এক পুত্র কামনা করো দেবতাদের কাছে—প্ৰাহুঃ ক্ষত্রং বলজ্যেষ্ঠং/বলশ্রেষ্ঠং সুতং বৃণু।

যা ভেবে পাণ্ডু বললেন, কুন্তীর মনেও বুঝি তাই ছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আহ্বান করলেন বায়ু-দেবতাকে। বেদ-পুরাণ সম্বন্ধে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা জানেন যে, বৈদিক দেবতা-মণ্ডলীর মধ্যে বায়ু-দেবতার গুরত্ব সাংঘাতিক। তাঁর শক্তি, বল, বীর্য দেবরাজ ইন্দ্রের থেকে কোনও অংশে কম নয়। আর পুরাণে বায়ুদেবতা যেভাবে কীর্তিত হয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে—শক্তি এবং বলবত্তার দিক দিয়ে তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের ঈর্ষার পাত্র ছিলেন। বায়ু যখন দেবমাতা অদিতির গর্ভে, তখনই তাঁর শক্তিবৃদ্ধির এমন ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল যে, ইন্দ্র নিজের শ্রেষ্ঠত্বের আসনটি নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে বায়ুকে খণ্ড খণ্ড করে কেটেও তাঁকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেননি। বায়ুর শক্তি কমেনি, যদিও ইন্দ্রের তুলনায় তিনি সামান্য ক্ষীণ হয়েছেন মাত্র।

এহেন বায়ু মনুষ্যলোকে কুন্তীর আহ্বান শুনেই উপস্থিত হলেন তাঁর কাছে। কুন্তী সলজ্জে বললেন—পুত্রং দেহি সুরোত্তম—এমন পুত্র, যে দেখতেও যেমন বিশাল, তেমনই শক্তিতে ক্ষমতায় সবার সব অহঙ্কার চূর্ণ করে দিতে পারে। ভীম জন্মালেন। অতিবল, অতিকায়, ভীম-পরাক্রম ভীম মায়ের কোলে শিশুর মূর্তিতে ধরা দিলেন বায়ু দেবতার আশীর্বাদের মতো।

পাণ্ডু তখন বনে-বাদাড়ে ঘুরছেন, কুন্তীও বসে ছিলেন ছেলে কোলে নিয়ে। ছেলেটি ঘুমচ্ছিল। হঠাৎ, কথা নেই বার্তা নেই কোথা থেকে এক বাঘ দেখা গেল এবং তাৎক্ষণিক আত্মরক্ষার তাগিদে কুন্তী লাগালেন দৌড়। কথায় বলে মায়ের কোল থেকে ছেলে পড়ে না। কিন্তু প্রাবাদিক স্নেহের নিরিখে কথাটা যতই সত্য হোক, বাস্তবে মায়ের হাত ফসকে ছেলে মাটিতে পড়েও যায় কখনও। কুন্তীর ছেলেও পড়ে গেল। হঠাৎ করে বাঘের উৎপাত, কুন্তী ঘুমন্ত ভীমকে কোলের মধ্যে খেয়াল করেননি। অতএব শিশু ভীম পড়ে গেলেন মাটিতে। মাটিও নয়, পড়লেন একটা পাথরের ওপর। কিন্তু কী আশ্চর্য, ভীমের তো কিছু হল না, উলটে যে পাথরটার ওপর ভীম পড়ে গিয়েছিলেন, সেই পাথরটাই গেল ভেঙে—শিলা গাত্রৈ—র্বিচূর্ণিত।

আপনারা মানুষের মধ্যে এমন লোক দেখেছেন কিনা জানি না, তবে আমি—না, না, আমিও দেখিনি—তবে একটা ঘটনা বলতে আমি কৌতুক বোধ করি। আমাদের বাড়িতে একটি উড়িয়া ঠাকুর ছিল—বিশাল তার চেহারা, ছ’ফিটের ওপর লম্বা, উড়িষ্যাবাসীদের মধ্যে অমন চেহারা প্রায় দেখিনি। বিশেষত তাঁর হাতের তালু এবং পায়ের তালু ছিল এমন খড়খড়ে যে, বাটনা-বাটা শিলও তার কাছে বোধহয় কিছু নয়। টগবগে ভাতের হাঁড়ি সে কোনওদিন কিছু দিয়ে ধরত না, উনুন ঠিক করার জন্য উত্তপ্ত গরম কয়লা সে হাত দিয়েই নামাত। কোনওদিন সে মশারি টাঙাত না, বলত—আমার মশা লাগে না। আমি পড়ে গিয়ে একবার পায়ের একাংশে ব্যথা পেয়েছিলাম বলে আমাকে সেই ঠাকুর একবার ‘আয়োডেক্স’ মালিশ করে দিয়েছিল। ফল হয়েছিল এই—ব্যথার সঙ্গে জ্বলুনি শুরু হয়েছিল এবং পায়ের একাংশ সাময়িকভাবে লোমহীন হয়ে গিয়েছিল।

এই ঠাকুরের অসীম শক্তি এবং দৈহিক ক্ষমতা নিয়ে আমরা তাঁর সঙ্গে এবং অন্যের সঙ্গেও অনেক রঙ্গ-রসিকতা করতাম। একদিন কথা প্রসঙ্গে আমাদের এই পুরাতন ঠাকুরটি গল্প বলেছিলেন যে, তাঁর যৌবনকালে তিনি একটি মাঠে ক্ষেতি করছিলেন। জমিতে নিড়ানি দেবার সময় তাঁকে একটি সাপে কামড়ায় এবং এই কামড়ে তাঁর একটু সামান্য লেগেছিল বটে, তবে সাপটি শেষপর্যন্ত মারা যায়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছিলাম। বলেছিলাম—আপনার পায়ে কামড় দিয়ে ওই হতভাগ্য সাপটির বিষদাঁত ভেঙে যায় এবং সে লজ্জায় আত্মহত্যা করে। কিন্তু ঠাট্টা-ইয়ার্কি যতই করি, আমাদের পুরনো বাড়িতে পঁচিশ বছরের ঠাকুর-জীবনে এই ভদ্রলোককে অন্তত চার-পাঁচবার কাঁকড়া-বিছে কামড়াতে দেখেছি ; বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, একটু গরম ঘিয়ের প্রলেপ এবং একটু উঃ-আঃ ছাড়া এই ঠাকুর প্রায় নির্বিকার থাকতেন।

কাজেই এক্ষেত্রে ভীমের ব্যাপারেও আজগুবি কথা শোনার হাসিটুকু হেসেই আমাদের আরও বৃহত্তর গল্পের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এ ঘটনায় ব্যাসের ইঙ্গিত এইটুকুই যে, পাঁচ পাণ্ডবভাইদের মধ্যে ইনি একটু আলাদা। জন্মলগ্নেই সে যেহেতু পিতা পাণ্ডুকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে জন্মেছে, অতএব মহাভারতের পাঠক-শ্রোতাকে প্রস্তুত থাকতে হবে এই অনন্যসাধারণ ব্যক্তিটির যে কোনও অমানুষিক কাজের জন্য, যে কোনও অতিমানুষিক ক্রিয়া-কলাপের জন্য। ভীমের জন্মলগ্নে আরও একটা ইঙ্গিত ব্যাসের আছে। তিনি বললেন—ঠিক যেদিন ভীম জন্মালেন, সেইদিনই জন্মালেন ধৃতরাষ্ট্রের ছেলে দুর্যোধন। আমাদের মতো বাঙালদের মধ্যে একটা প্রবাদ আছে—রাশিতে পাড়া দিয়ে জন্মেছে। একই বাড়িতে দুই ভাইতে বনছে না অথবা ছেলে জন্মানোর পর পরই মায়ের মৃত্যুরোগ ধরল অথবা বাপ-ছেলেতে বনিবনা হচ্ছে না মোটেই—এইসব ক্ষেত্রে গেঁয়ো লোকেরা বলেন—রাশিতে পাড়া দিয়ে জন্মেছে।

বাঙাল ভাষায় ‘পাড়ানো’ অর্থ পা দিয়ে মাড়ানো। মহাভারতের অবশেষ যেহেতু আমরা জানি, তাই ভীম-দুর্যোধনের সম্পর্ক নিয়ে এখনই আমরা কথা বলব না। কিন্তু দুর্যোধন যে ভীমের জন্মরাশিতে পা দিয়েই জন্মেছিলেন—সেটার একটা প্রমাণ দাখিল করা যেতে পারে। মহাভারতের দক্ষিণ ভারতীয় সংস্করণগুলিতে অতিরিক্ত একটি শ্লোক দেখা যায়, তাতে লেখা আছে—সূর্য তখন আকাশের ঠিক মাঝখানটায়। চৈত্র মাস। শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী তিথি। মঘা-নক্ষত্রাশ্রিত সিংহরাশিতে ভীম জন্মালেন।

মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ বহু পরিশ্রম স্বীকার করে হয়তো প্রায় নির্ভুল গণনায় ভীম এবং দুর্যোধনের রাশিচক্র সহ জন্ম-পত্রিকা তৈরি করেছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে—মঘা-নক্ষত্রযুক্ত সিংহরাশিতে ভীম জন্মেছিলেন দুপুরবেলায়, আর দুর্যোধন জন্মেছিলেন ওই সিংহরাশিতেই। তবে তাঁর জন্ম-নক্ষত্র ছিল পূর্বফাল্গুনী এবং তিনি জন্মেছিলেন রাত্রে। ভীমের মিথুন লগ্ন, আর দুর্যোধনের তুলা। রাশিচক্রের বিশদ বিবরণে আমি যাচ্ছি না। আমার বক্তব্য শুধু এইটুকু যে, দুই সিংহরাশির জাতক শুধু দিন আর রাত্রির প্রভেদে জন্ম লাভ করে গ্রহ-নক্ষত্রের বিষম সমাবেশে পরস্পরের জন্মশত্রু হয়ে রইলেন। দ্বৈপায়ন ব্যাস ভীমসেনের জন্ম-চিত্র দেখাবার সঙ্গে সঙ্গেই এক লহমার জন্য দুর্যোধনের ওপর আলো ফেলেছেন। ভবিষ্যতে যিনি ভীমের চরম প্রতিস্পর্ধী হবেন—এক মুহুর্তের জন্য, নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে হলেও, তাঁকে চিনিয়ে রাখলেন ব্যাস। বললেন—ভীম যেদিন জন্মালেন সেদিনই জন্মালেন ধৃতরাষ্ট্রের প্রথম পুত্র দুর্যোধন।

দিনে দিনে অন্যান্য পাণ্ডবভাইদের সঙ্গে ভীমও বেড়ে উঠতে লাগলেন। পিতা পাণ্ডু যখন মারা গেলেন ভীমের বয়স তখন পনেরো বছর। মায়ের সঙ্গে ভাইদের হাত ধরে, শতশৃঙ্গ পর্বতের সরল প্রাকৃতিক পরিবেশ ছেড়ে, ভীম যখন হস্তিনাপুরে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সামনে এসে পৌঁছলেন, তখন শুধু বড় বড় চোখে শহর দেখা ছাড়া তাঁর আর কোনও জটিলতা ছিল না। মায়ের কাছে গল্প শুনেছেন নিশ্চয়ই যে, তাঁদের বাবা পাণ্ডু হস্তিনাপুরের রাজত্ব ছেড়ে বনে এসে বাস করেছিলেন। তাঁর বাবার রাজত্ব অন্ধ জ্যাঠা ধৃতরাষ্ট্র সামলাচ্ছেন, আসলে তিনি রাজা নন।

মুনি-ঋষিদের সঙ্গে সাদা-মাটা জামা কাপড় পরে পাণ্ডবরা যখন পাণ্ডুর ছেলের পরিচয়ে হস্তিনাপুরে পৌঁছলেন, তখন গোটা শহর ভেঙে পড়েছিল তাঁদের দেখতে। বাপ-মরা রাজা-বাপের ছেলেদের যখন এই অবস্থা, তখন ধৃতরাষ্ট্রের একশো ছেলে সোনার হার-মুকুট গায়ে-মাথায় চড়িয়ে খুড়তুতো ভাইদের দেখতে এসেছিল। পনেরো বছরের ছেলে, কিছুই কি আর বোঝে না। ঋষিরা পাণ্ডবদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভীমের পরিচয় দিয়ে বললেন—বায়ু দেবতার ঔরসে এই ছেলেটির জন্ম। ইনি মহাবল ভীমসেন।

পিতা পাণ্ডুর শ্রাদ্ধশান্তি মিটে গেল। পাণ্ডবভাইরা হস্তিনাপুরে আশ্রয় পেলেন। হ্যাঁ, খাওয়া-পরার অভাব ছিল না বটে, কিন্তু জ্যাঠার ছেলে দুর্যোধন ইত্যাদি একশো ভাইদের তুলনায় তাঁদের রাজপুত্রোচিত স্বাভাবিকতার অভাব ছিল। আসছি সে কথায়। উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও রাজার ছেলের প্রাধান্য যাঁরা পাচ্ছেন না, তাঁরা অন্যভাবে তাঁদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করবেন—তাতে আশ্চর্য কী! ছোটবেলায় খেলাধুলোর আসর থেকে পাণ্ডবদের এই প্রাধান্য লাভের চেষ্টা শুরু হল।

ব্যাস লিখেছেন—সব রকমের খেলাধুলোয় পাণ্ডবভাইরাই ছিলেন বেশি ওস্তাদ—বালক্রীড়াসু সর্বাসু বিশিষ্টাস্তে তদাভবন্। আর ভীমসেন? ভাইদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে লম্বা, সবচেয়ে শক্তিশালী, শরীরের ওজনও তাঁর সবার চেয়ে বেশি। কুরুভাইরা কথায় কথায় হিরে-মুক্তো গায়ে ছড়ায়, মুঠো মুঠো পয়সা ওড়ায়। পনেরো বছরের ছেলে কি কিছুই বোঝে না। তার ওপরে ভীমের স্বভাবটাই একটু ক্ষমাহীন, নৃশংস গোছের। অতএব খেলার আসরেও যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত, সেখানেও কৌরব-ভাইরা ভীমের হাত থেকে রেহাই পেতেন না। না, এই খেলার মধ্যে হয়তো প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কোনও বৃত্তি ভীমের ছিল না। মহাভারতের কবি অন্তত সেই দ্বেষ, সেই হিংসা কিছু দেখতে পাননি। তাঁর মতে—ভীমের দিক থেকে সবটাই ছিল বালকসুলভ চপলতা, হিংসা-দ্বেষ কিছু নয়—বাল্যান্ ন দ্রোহচেতসা।

আসলে ভীমের বিশাল শরীরে এতই শক্তি, এতই তাকত যে, অন্যান্য রাজপুত্রদের মতো শুধু ক্রীড়া-বৈচিত্র্য আবিষ্কার করে সে শক্তি ক্ষান্ত হত না। এই বিশাল শক্তির একটি নির্গম-পথের প্রয়োজন ছিল এবং কৌরব-ভাইদের সঙ্গে প্রতিযোগিতাই ছিল সেই শক্তির একমাত্র নির্গম পথ। এই প্রতিযোগিতা অত্যন্ত বিষম বলেই ভীমের দিক থেকে যা ছিল খেলা, অন্যের পক্ষে সেটাই ছিল নৃশংসতা।

আর তখনকার দিনের খেলায় তো অত কিছু বৈচিত্র্য ছিল না, কাজেই খেলার মধ্যে দুষ্টমিটাই ছিল প্রধান। আর দুষ্টুমির প্রতিযোগিতায় ভীমের সঙ্গে অন্যেরা পারবে কেন। যেমন ধরুন—দৌড়নো। ভীম নাকি ঝড়ের গতিতে দৌড়তে পারতেন। বায়ু দেবতার ছেলে বলে কথা, এই ক্ষমতা তো তাঁর থাকবেই। খেলার মধ্যে আর ছিল ‘লক্ষ্যাভিহরণ’ অর্থাৎ ধরুন—দূরে কোনও জায়গায় তালগাছ থেকে তাল পড়ল—কে আগে তুলে আনতে পারে? খাওয়া—খাওয়াটাও একটা খেলার মধ্যেই ছিল—কে কত খেতে পারে। দৌড়নো আর খাওয়ার খেলায় ভীমকে হারাবে—এমন ক্ষমতা কোনও ছেলেরই ছিল না। খেলা হিসেবে আর যেটাতে ভীম ভীষণ রকমের ওস্তাদ ছিলেন—ব্যাসের মতে সেটা খেলা, আধুনিক শহুরে মতে সেটা নোংরা দুষ্টুমি। শহুরে বললাম এইজন্যে যে, আমাদের ছোটবেলায় গাঁয়ে-গঞ্জে আমরা এই খেলা খেলেছি। এ খেলাটা হল ঢিল ছোড়া।

শহরের লোকেরা নাক সিটকে বলতেই পারেন—অও ন্যাস্টি! কিন্তু গাঁয়ে-গঞ্জের খ্যাপা হাওয়ায় আমবাগানে যাঁরা ঢিল ছুড়ে বা গুলতি ছুড়ে আম পেড়েছেন, পেয়ারা পেড়েছেন, তাঁরা এই খেলার মাধুর্য এবং গুরুত্ব দুটোই উপলব্ধি করতে পারবেন। মহাভারতের খেলার মধ্যে অবশ্য ঢিল ছোড়ার সঙ্গে ধুলো ছোড়াও আছে এবং ব্যাস লিখেছেন—এই সব খেলায় ভীম ছিলেন ফার্স্ট—জবে লক্ষ্যাভিহরণে ভোজে পাংশুবিকর্ষণে। কিন্তু কৌরবকুমারদের সঙ্গে এই সব সাধারণ খেলায় অসংখ্যবার জিতে যাওয়ায় এই সব খেলা তাঁকে আর আকর্ষণ করত না। অতএব খেলার মধ্যে আপন বৈচিত্র্য আবিষ্কার করে তিনি নিজের তৃপ্তি ঘটাতে আরম্ভ করলেন আর তখনই এই খেলাই হয়ে উঠল কৌরবকুমারদের উৎপীড়নের বিষয়।

দুর্যোধনরা একশো ভাই। তাঁদের বেশ কয়েকজন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলা আরম্ভ করেছেন। খেলা বেশ জমে উঠেছে। এমন সময় ভীম এলেন হয়তো। খেলায় কোনও অংশ নেওয়া তাঁর কাছে পুরনো হয়ে গেছে। তিনি এসেই ঝপাঝপ কয়েকজন কৌরবকুমারকে তুলে নিয়ে গিয়ে কোথায় লুকিয়ে পড়লেন—গৃহ্য রাজন্ বিলীয়তে। এদিকে তো খেলা মাটি হয়ে গেল, আবার অন্যদিকে যেগুলিকে ভীম তুলে নিয়ে গেছেন, তাদের একজনের সঙ্গে আরেক জনের মাথার ঠোকাঠুকি করে দিয়ে বড়ই মজা পেতেন ভীমসেন—শিরঃসু বিনিগৃহ্যৈতান্ যোধয়ামাস পাণ্ডবঃ। গায়ে অসম্ভব জোর, অতএব কৌরবকুমারদের মাটিতে ফেলে তাদের ওপর চেপে বসে কারও মাথা, ঘাড় বা শরীরের অন্য কোনও অংশ ঘষে দিতেন মাটিতে। তারা কাঁদছে, এই অবস্থাতেও ঘষে দিতেন—চকর্ষ ক্রোশতো ভূমৌ সৃষ্টজানুশিরো’ংসকান্।

জলের মধ্যে খেলা হচ্ছে। জল ছোড়াছুড়ি, জলের মধ্যে সাঁতার, দাপাদাপি সবই চলছে। ভীম এসে একসঙ্গে দশ জন কৌরবকুমারকে, কাউকে হাতে, কাউকে চুলের মুঠি ধরে, কাউকে বগলে চেপে ধরে জলের তলায় বেশ খানিকক্ষণ চুবিয়ে রেখে দিলেন। তারপর যখন তাঁদের দম আটকে প্রায় মরার মতো অবস্থা হত, তখন তাঁদের ছেড়ে দিতেন ভীম—মৃতকল্পান্ বিমুঞ্চতি। কৌরব কুমারেরা গাছে উঠেছেন ফল পাড়তে, ভীম গিয়ে সেই গাছে এমন ঝাঁকুনি দিতে আরম্ভ করলেন যে, গাছ থেকে ফলের সঙ্গে কৌরবকুমাররাও ঝুপঝুপ করে মাটিতে পড়তে আরম্ভ করলেন—সফলাঃ প্রপতন্তি স্ম দ্রুতং ত্ৰস্তা কুমারকাঃ।

এই যেখানে অবস্থা, সেখানে কোনও কৌরবকুমারই ঘুসোঘুসি, দৌড়দৌড়ি বা কুস্তিতে ভীমের সঙ্গে পেরে উঠতেন না। আর পেরে উঠতেন না বলেই ভীম তাঁদের আরও বেশি চ্যালেঞ্জ করতেন—স্পর্ধমানো বৃকোদরঃ। ব্যাস লিখেছেন—ভীমের মনে কোনও হিংসা বা দ্বেষ ছিল না কৌরবদের প্রতি, তিনি এমনিই, দুষ্টুমি করেই এইসব কাণ্ডকারখানা করে বসতেন—বাল্যান্ ন দ্রোহচেতসা। আমাদের ধারণা—কুরুকুমারদের প্রতি হিংসা-দ্বেষ ভীমের সচেতন মনে না থাকলেও অবচেতনে ছিল। কারণ একই ধরনের ক্রীড়া-ব্যবহার ভীম তো তাঁর পিঠোপিঠি ভাই অর্জুন অথবা নকুল-সহদেবের সঙ্গে করতেন না।

আসলে পাণ্ডু মারা যাবার পর ধৃতরাষ্ট্রই তাঁর রাজ্য চালাচ্ছিলেন এবং দুর্যোধন-দুঃশাসন ইত্যাদি কৌরবকুমারদের ব্যবহারও হয়ে গিয়েছিল রাজপুত্রের মতো। পাণ্ডবদের প্রথম রাজধানী-প্রবেশের পর তাঁরা সালংকারে মৃতপিতৃক ভাইদের দেখতে এসেছিলেন এবং এর পরেও দুর্যোধনের যে সব ব্যবহার আমরা দেখতে পাব, তাতে স্পষ্টতই বোঝা যাবে যে, নিজেদের ভোগ-সুখের জন্য তাঁরা রাজকোষ এবং রাজযন্ত্র ব্যবহার করছিলেন—যা পাণ্ডবরা পারেননি। ভীম অসাধারণ শক্তিশালী অথচ কূটনৈতিক বুদ্ধিতে অতটা পোক্ত নয় বলেই তাঁর পনেরো-ষোলো বছরের খেলার কৌশলগুলির মধ্যে পাণ্ডবদের প্রতি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের বঞ্চনার ছায়াপাত ঘটছিল। তাঁর অবচেতন মনে কৌরবকুমারদের প্রতি তিনি ক্রমেই নিষ্ঠুর হয়ে উঠছিলেন এবং এই নিষ্ঠুরতার প্রকাশ ঘটছিল খেলার মধ্যে, ইচ্ছাকৃত রেষারেষির মধ্যে।

দিনের পর দিন ভীমের হাতে নাকানি-চোবানি খেয়ে কৌরবরাও ভীমের ওপর ক্ষেপে গেলেন এবং ভীমও তাঁদের এমন কিছু প্রিয় কার্য করছিলেন না। তা ছাড়া দেখুন—দুর্যোধন কিন্তু সেই পনেরো-ষোলো বছর বয়সেই নিজের আখের খুব ভালই বুঝতেন। কারণ ব্যাস লিখেছেন—দুর্যোধন যখন দেখলেন যে, কুন্তীর এই মেজ ছেলেটাই সবচেয়ে শক্তিশালী তখন তাঁর মন বলল—এটাকে ছলনা করে শিক্ষা দিতে হবে। ধর্মবোধ অথবা ন্যায়-অন্যায়ের চিন্তা দুর্যোধনের ছিল না এবং ভবিষ্যত ঐশ্বর্যের লোভ এবং মোহ তাঁর মনে এই দুষ্ট বুদ্ধির জন্ম দিয়েছিল যে, ভীমই তাঁর পথের কাঁটা—মোহাদ্ ঐশ্বর্য-লোভাচ্চ পাপা মতিরজায়ত। দুর্যোধনের এই ঐশ্বর্য-লোভ কি ভীমের অবচেতনে কিছুই ক্রিয়া করেনি?

ব্যাসের এই কথাটা থেকে বোঝা যায়—দুর্যোধন সেই বয়সেই বুঝে গিয়েছিলেন যে, রাজ্য ধৃতরাষ্ট্রের নয়। পাণ্ডবরা বড় হলে রাজ্য দাবি করবেনই। অতএব ভীম একাই যেখানে একশো ভাই কৌরবদের সব সময় ‘চ্যালেঞ্জ’ করছেন—স্পর্ধতে চাপি সহিতান্ অস্মন্ একো বৃকোদরঃ—সেখানে ভীম বড় হলে একটা ফ্যাকটর হয়ে দাঁড়াবেন। অতএব ওটাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কীভাবে সরিয়ে দিতে হবে—সে সিদ্ধান্তও তিনি একাই নিলেন। ঠিক করলেন—নগরীর উদ্যানে ভীম যখন ঘুমিয়ে পড়বেন হয়তো মাঝে মাঝেই এই ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস তাঁর ছিল—তখন ভীমকে গঙ্গার অতল জলে ফেলে দিতে হবে। আর ভীমকে এইভাবে শেষ করে দিয়েই যুধিষ্ঠির আর অর্জুনকে কারাগারে বন্দি করে রাখব। তারপর আর কী—সমস্ত রাজ্যই তখন আমার হাতের মুঠোয়—প্রসহ্য বন্ধনে বধ্বা প্রশাসিষ্যে বসুন্ধরাম্।

এত দূর পর্যন্ত যাঁর মনোবাসনা, তাঁর কি কিছুই প্রকাশ ঘটত না? আরে-ঠারে নিশ্চয়ই ঘটত; অতএব সচেতন মনে ভীমের হিংসা-দ্বেষ না থাকলেও অবচেতনে একটা প্রতিক্রিয়া অবশ্যই ছিল। তার ফলেই ভীমের ক্রীড়া-ব্যবহারে নিষ্ঠুরতার আভাস। আর সেই নিষ্ঠুর খেলা আর দুষ্টুমির জের টেনেই দুর্যোধনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত—ভীমকে এই পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিতে হবে।

যদি পাণ্ডবরা এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে তাঁদের সমস্যা ছিল। কারণ, রাজযন্ত্র তাঁদের হাতে ছিল না। পাণ্ডু বনে যাবার পর সপুত্রক কুন্তী যখন হস্তিনাপুরে ফিরেছেন, তখন যুধিষ্ঠিরের বয়স ষোলো আর দুর্যোধনের বয়স পনেরো। অর্থাৎ এই পনেরো বছর ধরে দুর্যোধন রাজপুত্রের মর্যাদায় মানুষ। দুর্যোধনের ন্যায়-অন্যায়ের বোধ কম ছিল, অতএব নিজের স্বার্থ-সাধনের জন্য রাজযন্ত্র ব্যবহার করার ব্যাপারে তাঁর কোনও নীতির বালাই ছিল না। দুর্যোধন ভীমের ছিদ্র খুঁজতে লাগলেন এবং ছিদ্র পাওয়ার আগেই তিনি যে কাজটা করে ফেললেন, সেটা হল—আশ্চর্য রকমের ভাল কতগুলি চাঁদোয়া বানিয়ে ফেললেন।

জলবিহার করার জন্য একটা জায়গা ঠিক হল গঙ্গার ধার ঘেঁষে। জায়গাটার নাম প্রমাণকোটি। সেখানে লোক-লস্কর লাগিয়ে অস্থায়ী কতগুলি ঘর তৈরি করা হল। এগুলি নিঃসন্দেহে এখনকার ‘টেন্ট’, তবে জবরদস্ত এবং সুন্দর ‘টেন্ট’। রঙবাহারি কাপড় আর এখনকার ‘ক্যাম্বিসে’র মতোই মোটা কম্বলের কাপড় দিয়ে ‘টেন্ট’—চেল-কম্বল-বেশ্মানি বিচিত্রাণি মহান্তি চ। ‘টেন্ট’গুলো তৈরি করা হল এমনভাবে যেন তার অধিকাংশটাই থাকে জলে এবং খানিকটা স্থলে—অনেকটা খুঁটিপোতা ‘জেটি’র মতো। সব ‘টেন্টে’র ভিতর সযত্নে সাজিয়ে রাখা হল লোভনীয় সব ‘গিফট’—ইচ্ছে করলেই নেওয়া যেতে পারে। ‘টেন্টে’র ওপরে পতাকা তুলে দেওয়া হল। দুর্যোধন এই অস্থায়ী নীরাবাসের নাম দিলেন—উদকক্রীড়ন। ভীমের কথা মাথায় রেখে দুর্যোধন খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থার ত্রুটি রাখলেন না। পাকা রাঁধুনি দিয়ে রান্না করিয়ে—চর্ব্য-চোষ্যের পাক সাজিয়ে রাখা হল স্থলাংশের ‘টেন্টে’।

সব যখন রেডি, তখন দুর্যোধন পাণ্ডবভাইদের বললেন—চল সবাই, জলবিহার করব গঙ্গায়। পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ ভোলেভালা যুধিষ্ঠির বললেন—ঠিক আছে—এবম্ অস্তু। পাণ্ডব-কৌরবরা তখন রথে আর হাতিতে করে নগরের বাইরে চললেন—প্রমাণকোটিতে। আগে ঠিক ছিল—নগরের উদ্যান-ভূমি থেকেই ঘুমন্ত ভীমকে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে—তন্তু সুপ্তং পুরোদ্যানে গঙ্গায়াং প্রক্ষিপামহে। এখন কিন্তু ভীষ্ম-বিদুর ইত্যাদি বড় মানুষদের চোখ এবং ঝামেলা এড়ানোর জন্য তিনি নগরীর বাইরে নিয়ে চললেন পাণ্ডবদের—নির্যজু-র্নগরাচ্ছূরাঃ।

আজ প্রমাণকোটির নীরাবাসে অঢেল মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা। দালান-বাড়িতে থাকা মানুষের অস্থায়ীভাবে ‘টোন্টে’ থাকতে বেশি ভাল লাগে। বিরাট ফুলের বাগান তৈরি হয়েছে সেখানে, দরবার-হল, চিলেকোঠা, ফোয়ারা—জলৈঃ সঞ্চারিকৈরপি, সিজিনাল ফ্লাওয়ার—পুষ্পৈ-র্যথির্তুকৈঃ—কী নেই সেখানে! বাগানে বসেই খাওয়া-দাওয়া আরম্ভ হল। দুর্যোধনের অর্ডারে একটার পর একটা খাবার আসছে। এ ওর মুখে দিচ্ছে, সে তার মুখে দিচ্ছে—ভারী অন্তরঙ্গ এবং আনন্দময় পরিবেশ। এরমধ্যেও দুর্যোধনের মাথাটা কিন্তু ঠিক আছে। হৃদয়ে জিঘাংসার ক্ষুরধারা, মুখে মিষ্টি কথা। কাজের লোকের উদ্দেশেই যেন চেঁচিয়ে বললেন—আরে সেই ভাল খাবারটা ভীমকে দিলিনে। ব্যবস্থা করার জন্য দুর্যোধন নিজেই উঠে গেলেন। সকলের অলক্ষে খাবারে বিষ মিশিয়ে তিনি কারও ওপরে বিশ্বাস না রেখে নিজের হাতে ভীমকে খাইয়ে দিলেন সেই খাবার। খাবারটা বাইরে থেকে দেখতে অমৃতকল্প—দুর্যোধনের মুখের মিষ্টি কথার মতো, কিন্তু খাবারের ভিতরে বিষ-দুর্যোধনের হৃদয়ের মতো।

ভীম অবিশ্বাস করলেন না। প্রথমত, খাবার বলেই। দ্বিতীয়ত, আপন জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ব্যাপারে কি এতটা আশঙ্কা যুক্তিযুক্ত ছিল? ভীম খেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধন মনে মনে সফলকাম হয়ে বাইরে সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন জলক্রীড়ায়। যাতে ভীমের বিষ-বিকার বসে বসে দেখার সুযোগ কেউ না পায়। তা ছাড়া এরই মধ্যে জলক্রীড়া হয়ে গেলে বিষক্রিয়ায় ভীমের মুর্ছা অথবা ঘুমের ভাবটাকে অতিরিক্ত জলক্রীড়ার ক্লান্তি বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে—মনে মনে এই বুদ্ধি করে দুর্যোধন সবাইকে জল-খেলায় আহ্বান জানালেন।

খুব খেলা হল। জল-ছোড়াছুড়ি, সাঁতার, ডুব-সাঁতার—সব কেরামতি শেষ করে শ্রান্ত-ক্লান্ত কৌরবভাইরা ঠিক করলেন—রাত্রে থেকেই যাবেন প্রমাণকোটির নীরাবাসে। ওদিকে সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে প্রচুর জল-খেলার ব্যায়াম এবং পরিশ্রম যখন শেষ হয়ে গেল, তখন ভীম তাঁর বালক-বাহিনী নিয়ে গঙ্গার তীরে উঠলেন বটে, কিন্তু ততক্ষণে তাঁর শরীরে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। তিনিও বললেন—রাত্রে আমি এখানেই থাকব। একটা জায়গা দেখে শুয়ে পড়লেন ভীম। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছিল। ভাবলেন—এই ঠাণ্ডা হাওয়ায় খানিকটা ঘুমোলেই সব যন্ত্রণার উপশম ঘটবে।

কৌরবভাইরা যে প্রমাণকোটিতে থেকে গেলেন, তার কারণ যতটা পরিশ্রম, তার চেয়ে অনেক বেশি হল দুর্যোধনের নির্দেশ। দুর্যোধনের সব ভাইরা হয়তো তাঁর মনের অসদিচ্ছাটুকু জানতেন না। কিন্তু এইটা জানতেন নিশ্চয়ই যে,—থাকব—এ কথা বলতে হবে। তা ছাড়া প্রমাণকোটির সাময়িক আবাসগুলিও তৈরি করা হয়েছিল থাকবার জন্যই। ভীম অবশ্য অতদূর পৌঁছতে পারেননি, তীব্র বিষক্রিয়ায় গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়ায় তিনি শরীর এলিয়ে দিলেন খোলা মাঠে, নীল আকাশের নীচে।

তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। প্রমাণকোটির নীরাবাসে কৌরবভাইরা দারুণ দারুণ জামা কাপড় পরে নতুন কোনও মজার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন—ক্রীড়াবসানে তে সর্বে শুচিবস্ত্রাঃ স্বলংকৃতাঃ। শুধু একটিমাত্র লোককে এই ক্রীড়া-কৌতুকের মধ্যে সাময়িকভাবে দেখা গেল না। তিনি দুর্যোধন। দুর্যোধন একা চলে গেলেন গঙ্গার তীরভূমির সেই প্রান্তে—যেখানে প্রথম রাত্রির অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন ভীমসেন।

দুর্যোধন শুকনো লতার বন্ধনে বেশ করে বাঁধলেন সংজ্ঞাহীন ভীমকে, যাতে ইচ্ছে করলেই বাঁধন খুলে কিছু করা না যায়। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় ভীমকে গঙ্গার গভীরে ফেলে দিয়ে তিনি নিজেকে মিশিয়ে দিলেন প্রমাণকোটির সান্ধ্য কৌতুকে, মজলিসে, আড্ডায়। মাত্র পনেরো-ষোলো বছর বয়সে একটি জল-জ্যান্ত খুন করার পরেও তাঁর রক্তচাপ একটুও বাড়ল না, মুখে ধরা পড়ল না এতটুকু বিকৃতি।

ভীম ডুবতে থাকলেন। জলের তলায় ডুবতে-ডুবতে, ডুবতে-ডুবতে একেবারে পাতালে নাগলোকে এসে পৌঁছলেন। মহাভারতের সমাজে মানুষের বিশ্বাস ছিল—জলের তলায় আছে নাগলোক। সেখানে সাপেরা থাকে। আর থাকেন সাপেদের রাজা বাসুকি। নিঃসংজ্ঞ অবস্থায় জলের তলায় তলিয়ে গিয়ে ভীম এসে পৌঁছলেন নাগ-ভবনে যেখানে নাগ-শিশুরা খেলা করছিল। ভীম তাদের গায়ের ওপর চেপে গেলেন, তারা তখন কামড়াতে আরম্ভ করল। বিষে বিষক্ষয় হয়ে গেল। সিদ্ধান্তবাগীশ টীকায় লিখেছেন—আগুনে পুড়ে সীসা যেমন সোনার ময়লা নষ্ট করে এবং নিজেও উবে যায়, তেমনই সাপেদের বিষ দুর্যোধনের কালকূট বিষ নষ্ট করে দিয়ে নিজেও শক্তিহীন হয়ে গেল—বিষস্য বিষমৌষধম্।

মহাভারতের এই নাগলোকের কল্পনায় আমার নিজের দুটো কথা আছে। বস্তুত ইতিহাসের প্রমাণ দিয়ে বলা যায় যে, মহাভারতের কালে নাগ একটি প্রধান উপজাতি ছিল। আধুনিককালের হাজারো উপাধির মধ্যে ‘নাগ’ উপাধি এখনও যথেষ্ট আছে। হয়তো এই নাগেরা সাপের ‘টোটেম’ ব্যবহার করত। সেকালের আর্যগোষ্ঠীর সঙ্গে নাগদের অনেক মারামারি, লাঠালাঠি হয়েছে। নাগরা শেষপর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে, কতক জায়গায় আপোষ-মীমাংসাও হয়েছে। শেষে ভালবাসাও হয়েছে। কৃষ্ণ এবং কালীয়-নাগের দৃষ্টান্ত, অর্জুন এবং নাগকন্যা উলুপীর দৃষ্টান্ত এখানে স্মরণ করা যেতে পারে।

আমাদের ধারণা—ভীম জলের তলায় সম্পূর্ণ ডুবে যাননি। দুর্যোধন তাঁকে জলে ফেলে দিয়েছিলেন ঠিকই, ভীমও লতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জলে ডুবেছিলেন, নিঃশ্বাসও তাঁর রুদ্ধ হয়ে আসছিল কিন্তু যে কোনও ভাবেই হোক—তাঁর উষ্ণীষ-বন্ধনের প্রান্তভাগ দেশে অথবা রঙিন উত্তরীয় দেখে নাগ-জাতির মানুষেরা তাঁকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিল। উদ্ধারের পর উপজাতীয় মানুষের ঘরোয়া প্রাচীন চিকিৎসা—ছ্যাঁকা-দাগা জড়ি-বুটির সাহায্যে ভীমের শারীরিক বিষ নাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভীম চেতনা লাভ করেছেন এবং তিনি তাদের মারতে আরম্ভ করেছেন।

নাগেরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুখিয়া বা প্রধান বাসুকির কাছে—নাগেদের মধ্যে যে যখনই প্রধান হত সেই ‘বাসুকি’ উপাধি পেত—অতএব সেই বাসুকির কাছে ‘রিপোর্ট’ করল। বাসুকি দলবল নিয়ে গিয়ে দেখলেন—ভীম। যেহেতু বাসুকি তাঁকে চিনতে পেরেছেন, তাতে ধারণা হয়—ভীমের কৌলিক গোষ্ঠীর সঙ্গে এই নাগগোষ্ঠীর পূর্ব-পরিচয় ছিল এবং তাদের জনপদও খুব দূরে ছিল না। বাসুকি তো বরেন্দ্র অথবা বৈদিক ব্রাহ্মণদের মতো ভীমের সঙ্গে রীতিমতো এক আত্মীয়তার সূত্রও আবিষ্কার করে ফেলেন। ভীম নাকি তাঁর নাতির নাতি—তদা দৌহিত্র-দৌহিত্রঃ পরিষ্বক্তঃ সুপীড়িতম্।

কুন্তীর বাবা শূরের মাতামহ নাকি বাসুকি। সেই সম্বন্ধে নাতির নাতি ভীমকে দেখে বাসুকি এতই খুশি হলেন যে, তিনি ভীমকে টাকা-পয়সা, মণি-রত্ন উজাড় করে দিতে চাইলেন। কিন্তু ওই যে বলেছি—নাগরা হয়তো সাপ-টাপ নন, তাঁরা হয়তো কোনও প্রাচীন উপজাতির মানুষ। বাসুকির কথা শুনে তাঁর অনুচর তাঁর নিজের স্বভাবসিদ্ধ চালে বলল—এই ছেলেটাকে দেখে আপনার যখন এত খুশ্ পয়দা হয়েছে, তবে ইয়াকে আমরা রস খাওয়াব, রস—রসং পিবেৎ কুমাররা’য়ং ত্বয়ি প্রীতে মহাবলঃ।

লোকটি নিজেদের আনন্দ এবং উৎসবের প্রতীক হিসেবে অতিথি ভীমকে ‘রস’ খাওয়াতে চায়। উপজাতি অথবা আর্যগোষ্ঠীর বাইরে এই জনপদে অভ্যর্থনার সব চাইতে বড় অঙ্গ হল এই ‘রস’। বাসুকি রাজা মানুষ এবং আর্যগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর যাতায়াত তথা পারিবারিক সম্পর্কও আছে। অতিথি আপ্যায়নের জন্য তিনি তাই আর্যপ্রথা অনুসরণ করে ধন-রত্নের উপহার দিতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর অনুচর তাঁর মালিককে খুশি হতে দেখে নিজেদের পরিচিত প্রথা অনুযায়ী ভীমকে রস-পান করাতে চায়। সে বলে টাকা-পয়সা উপহার দিয়ে কী হবে—কিমস্য ধনসঞ্চয়ৈঃ—ইয়াকে রস খাওয়াব।

এই ‘রস’ অবশ্যই মদ্য যা এক পাত্তর খেলে হাজার হাতির বল পাওয়া যায় শরীরে—বলং নাগসহস্রস্য যস্মিন্ কুণ্ডে প্রতিষ্ঠিতম্। এরা রাজা-মহারাজার মতো শোভন সুরাপাত্রে রস পান করে না। কড়া মদ গলাধঃকরণের জন্য এদের জালার মতো কতগুলি পাত্র আছে, যাকে ভদ্র ভাষায় বলে ‘কুণ্ড’। বিষে পীড়িত, শক্তিহীন শরীরে টাকা-পয়সার চেয়ে রস-পানের প্রস্তাবই ভীমের বেশি ভাল লাগল। ভীম একেবারে পুজো করার মতো পুব-মুখ করে বসে এক এক নিঃশ্বাসে একেক পাত্তর মদ চড়াতে লাগলেন। এইভাবে আট পাত্তর শেষ করে বাসুকির দেওয়া বিছানায় একটি প্রগাঢ় ঘুম দিলেন ভীমসেন।

আসলে এ সব জায়গা ভীমের খারাপ লাগার কথা নয়। তিনি নিজে বড় আর্যোচিত ভদ্রতা-শৃঙ্খলার ধার ধারতেন না। তাঁর শক্তি, মেজাজ এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভবগুলিও খুব আর্যোচিত নয়। পরে সে সব কথা আসবে। কিন্তু এখন দেখুন—এই যে তিনি কোথায় এসে আট-পাত্তর সুরা পান করে বাসুকির বিছানায় শুয়ে পড়লেন—নিশ্চিন্ত মনে—তাঁর একটুও মনে হল না যে, তাঁর ভাইয়েরা, তাঁর মা কত চিন্তা করছেন, কত খুঁজছেন ভীমকে।

প্রমাণকোটিতে জলের খেলা শেষ হতেই পাণ্ডবরা বাড়ি ফিরলেন। সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে দুর্যোধন ফিরলেন সবার পরে। একেবারে নিশ্চিত হয়ে যে, ভীম মারা গেছেন। সরলমতি যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের প্যাঁচপোচ কিছুই বুঝতে পারেননি। ভীমকে না দেখে তিনি ভাবলেন—সে নিশ্চয় আগেই বাড়ি চলে গেছে অথবা কোথাও শুয়ে ঘুম লাগিয়েছে। ভীমের হয়তো এই অভ্যাস ছিল—যেখানে সেখানেই তিনি ঘুমিয়ে পড়তে পারতেন।

ঘুমের কথাটা মাথায় রেখেই পাণ্ডবভাইরা ভীমকে মাঠে, ঘাটে, বনে সব জায়গায় খুব খানিকটা খুঁজলেন। তারপর বাড়ি ফিরেই মাকে জিজ্ঞাসা করলেন—মা, ভীম এখানে ফিরে আসেনি তো? বাগান, বন—যত জায়গা আছে, সবই তো দেখলাম। কিন্তু তাকে তো কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। তার কাপড়-জামা, জিনিস-পত্তর কিছুই তো দেখছি না। যুধিষ্ঠির ব্যস্ত হয়ে বললেন—ভীম এখানে ফিরে এসে কোথায় গেল? আপনি কি তাকে কোথাও পাঠিয়েছেন?

কুন্তীর মাতৃ-হৃদয় হা-হা করে উঠল। বললেন—সে তো এখানে ফেরেনি। তোমরা আবার যাও। চারদিকে খুঁজে দেখো। কুন্তী সঙ্গে সঙ্গে ছোট দেওর বিদুরকে ডাকিয়ে বললেন—কৌরব-পাণ্ডব সবাই মিলে নগরের বাগানবাড়িতে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে শুধু ভীমকেই দেখা যাচ্ছে না। তুমি পাণ্ডবভাইদের সঙ্গে গিয়ে একবার খুঁজে দেখো। বিদুর গেলেন, পাণ্ডবরাও অনেক খুঁজলেন ভীমকে। কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও। ভীমের বলবত্তা এবং দুঃসাহস নিয়ে জননী কুন্তীর দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। বিশেষত কৌরব-জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন যে তার এই মেজ ছেলেটিকে কখনওই ভাল চোখে দেখে না—সেটা কুন্তী এই মুহূর্তে বলেও ফেললেন। রাজ্যলোভী দুর্যোধন যে যখন তখন ভীমকে মেরে তাঁর পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে পারেন—সেই কথা ভেবে কুন্তীর হৃদয় আকুল হয়ে উঠল।

বিদুর কুন্তীকে অনেক সান্ত্বনা দিয়ে বাড়ি গেলেন বটে, কিন্তু কুন্তী তাঁর অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে ভীষণ আশঙ্কায় দিন কাটাতে লাগলেন। এদিকে ভীম বাসুকির জলপুরীতে আদরে আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়ে এমন ঘুম ঘুমোলেন যে, সাতদিন কেটে গেল, তবে তার হুঁশ হল। প্রভুত পরিমাণ রসপান করে গায়ে যখন হাতির মতো বল ফিরে পেয়েছেন তিনি, তখন তাঁর ঘুম ভাঙল। মনে নিশ্চিন্দি না থাকলে কি এমন ঘুম আসে। আট দিনের দিন নাগরাজ বাসুকিরই মনে হল—এবার ভীমের যাওয়া দরকার। তিনি ভীমকে বলেই ফেলেন—তোমাকে না দেখে তোমার মা-ভাইরা ভীষণ দুশ্চিন্তা করছেন নিশ্চয়, তুমি স্নান-খাওয়া সেরে এক্ষুনি রওনা হও—গচ্ছাদ্য স্বগৃহং স্নাতঃ।

আমি বেশ জানি—এ যদি যুধিষ্ঠির কিংবা অর্জুন হতেন, তাহলে তাঁদের অবচেতন মনের দুশ্চিন্তাই তাঁদের অত ঘুমোতে দিত না, অথবা ঘুম ভাঙলে অতিথি-পরায়ণ গৃহস্বামীকেও বলতে হত না যে, এবার তোমার বাড়ি যাওয়া উচিত। আসলে ভীমের প্রকৃতিটাই এইরকম। বাসুকির কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি রওনা হলেন না। স্নান করে নতুন জামা কাপড় পরে, ভাল রকম খাওয়া-দাওয়া করে, নাগদের দেওয়া ভূষণ-অলংকারে সেজে তিনি নাগদের সঙ্গে রওনা দিলেন নিজের দেশে। নাগেরা তাঁকে একেবারে হস্তিনাপুর নগরের প্রান্তে—যেখান তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন সেই নগরপ্রান্তে বনের কাছে রেখে গেল। ভীম সেখান থেকে সোজা চলে এলেন মা-ভাইদের কাছে। আনন্দ-মিলনের মধ্যে প্রণাম, নমস্কার আর আলিঙ্গনের পালা যখন মিটল, ভীম তখন দুর্যোধনের সমস্ত কুক্রিয়ার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন মা-ভাইদের কাছে।

ভীমের কথার মধ্যে ভয়ঙ্কর রকমের স্পষ্টতা ছিল। দুর্যোধনের ব্যাপারে তাঁর ক্ষোভ এবং রাগ কোনওটাই নিশ্চয়ই চাপা থাকছিল না। ভীমের প্রতি শত-স্নেহ থাকা সত্ত্বেও ভীমের এই স্পষ্টতা যুধিষ্ঠিরের ভাল লাগছিল না। তিনি একটু রেগেই বললেন—চুপ করো ভীম! এ সব কথা এত স্পষ্ট করে তুমি বোলো না—তুষ্ণীং ভব ন তে জল্প্যমিদং কাৰ্য্যং কথঞ্চন।

আসলে রাজনৈতিক দিক দিয়ে পাণ্ডবভাইরা বড়ই দুর্বল। তাঁদের বাবা রাজা ছিলেন। তিনি মারা গেছেন। হস্তিনাপুরে তাঁরা তখন ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রয়ে বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন মাত্র। বাবা রাজা ছিলেন বলে—তাঁর ছেলেকে রাজ্য দেওয়া দূরে থাক—রাজযন্ত্রের ওপরে তাঁদের তখনও কোনও অধিকারই জন্মায়নি। যেখানে দুর্যোধনের মুখের কথায় গঙ্গার ধারে তাঁর খেলার জন্য ঘর-বাড়ি তৈরি হচ্ছে, সেখানে পাণ্ডবভাইরা তখনও অস্তিত্বের যন্ত্রণায় ব্যস্ত। এই অবস্থায় শুধু মাত্র গায়ের জোর আছে বলেই ভীমের এই স্পষ্টবাদিতা যুধিষ্ঠিরের ভাল লাগেনি। কিন্তু ভীম এত সব বুঝতেন না। বুঝতেন না বলেই দুর্যোধনের অপব্যবহার তিনি সবিস্তারে বলেছেন এবং তাঁর বলার মধ্যে এমন আভাস নিশ্চয় ছিল যে, ওই ঘটনা পাঁচ কান করতেও তিনি দ্বিধা করবেন না। যুধিষ্ঠির সেই জায়গাটায় ভীমকে আঘাত করেছেন। ভীম নত-মস্তকে দাদার কথা মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, পাণ্ডবভাইদের মধ্যে ভীমই ছিলেন প্রথম, যিনি দুর্যোধনের প্রতিহিংসার প্রথম বলি হয়েছিলেন। দুর্যোধনের ওপর ভীমের আমৃত্যু আক্রোশের নিরিখে পনেরো ষোলো বছরের একটি জ্ঞাতিভাইয়ের ওই বিষম আচরণ ভুলে গেলে চলবে না।