অর্জুন – ৯

বনবাস-পর্ব শেষ হলে পাণ্ডবরা বিরাটরাজার বাজবাড়িতে বিভিন্ন ছদ্মবেশে একবৎসর কাল কাটিয়ে দিয়েছেন। অর্জুন সেখানে বেণী বেঁধে হাতে বালা পরে রাজকন্যা উত্তরার নৃত্যগুরু সেজেছিলেন—এ ঘটনা সবার জানা। আমিও বিরাটরাজার বাড়ির শেষ দিকের কিছু ঘটনা পূর্বে উল্লেখ করেছি দ্রৌপদীর মনের গতির প্রসঙ্গে। সেখানে বৃহন্নলারূপী অর্জুনের মনের গভীর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি, যে দীর্ঘশ্বাস একটি জীবনের প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে—কেউ কখনও কারও মন বোঝে না, দ্রৌপদী! আমি এই মুহূর্তে সূক্ষ্ম-চিকন মনের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেব না, তবে আপাতত মহাভারতের বিরাট যুদ্ধের প্রস্তুতিতে মন দেব এবং অবশ্যই অর্জুনকে লক্ষ করব—কোথায় কীভাবে তিনি সক্রিয় এবং প্রতিক্রিয়। এ-কথা বলা বাহুল্য যে, ভারতযুদ্ধের পূর্বে বিরাটরাজার গোধন লুণ্ঠন করতে এসে দুর্যোধন দুঃশাসন কর্ণরা, এমনকী ভীষ্ম-দ্রোণ কৃপরাও অর্জুনের হাতে যে রকম নাকানি-চোবানি খেলেন, তাতে প্রাক্‌-যুদ্ধ প্রদর্শনী হিসেবে অর্জুনের সার্থকতা খুব বেশি মাত্রায় প্রমাণ হয়ে গেল।

মহাভারতের কবি অন্তত দশ-এগারো অধ্যায় জুড়ে অর্জুনের যুদ্ধ বর্ণনাই শুধু করেননি। এত বছরের পরিণতিতে তাঁর অস্ত্রমোক্ষনে শিল্পের সুষমা লেগেছিল কতটা—তারও একটা আভাস দিয়েছেন তিনি। যুদ্ধে লক্ষ্যভেদই যেহেতু অর্জুনের জীবনসাধনার প্রথম কল্প ছিল, তাই কোন কোন মহাস্ত্রের সুচতুর প্রয়োগে তিনি এই একক যুদ্ধ জয় করলেন—তার বর্ণনা মহাভারতের কবি ছাড়া অন্য কারও লেখনীতে পুনরাবৃত্তি দোষ ঘটাবে। তবে যুদ্ধের বাস্তব খবরটুকু দিতে হলে এ-কথা তো একবার বলতেই হবে যে কর্ণ, কৃপ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, ভীষ্ম, দুঃশাসন, দুর্যোধনের মতো মহাবীররাও ক্ষত্রিয়ের অপলায়নবৃত্তি ভুলে গিয়ে সার বুঝেছিলেন—যঃ পলায়তে স জীবতি—যে পালায় সেই বাঁচে। পালিয়ে গিয়েও সবাই মিলে আরও একবার তাঁরা যুদ্ধ করতে এসেছিলেন, কিন্তু এইবার অর্জুনের অস্ত্রে ক্রুরতার বদলে শিল্পীর স্পর্শ লাগল। সকলে একযোগে সম্মোহিত হয়ে পড়লেন অর্জুনের বাণে। এই অসাধারণ মুহূর্তেও অর্জুন প্রিয়শিষ্যা উত্তরার জন্য বিচিত্র বর্ণের উষ্ণীষ বস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। শত্রু-জয়ের সামর্থ্যে অর্জুন যখন প্রায় তৃপ্ত, সেই সময় সম্মোহনবাণের ঘোর কাটল দুর্যোধনের। জ্ঞান ফিরতেই তিনি ভীষ্মকে বললেন—এখনও এই লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন, এমন অস্ত্র প্রয়োগ করুন যাতে জীবনে আর কখনও পালাতে না পারে।

মধুর হেসে ভীষ্ম বললেন—এতক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলে তাও বোঝোনি, ধনুক বাণ হাত থেকে খসে পড়েছিল, তখন কোথায় ছিল তোমার এই বুদ্ধি আর কোথায় তোমার বীর্য। তবু অর্জুনের চরিত্র দেখো—আমাদের এই স্বলিত অবস্থাতেও শুধু নৃশংসতা হবে বলে আমাদের কাউকে প্রাণে মারেনি। ত্রৈলোক্য রাজ্য হাতে পেলেও নিজের ধর্মত্যাগ করে অন্যায় কাজটি সে করবে না এবং ঠিক সেই কারণেই আমরা এখনও বেঁচে আছি। ভীষ্মের এই কথাটা দ্রৌপদীর মূল্যায়নের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। ভীষ্মর কথায় লজ্জিত কুরুপুঙ্গব তাঁর বীরবাহিনী নিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন বটে, কিন্তু ভারতযুদ্ধের আগে এই যে এত বড় মহড়াটা হয়ে গেল, তাতে অর্জুন নিজে মানকিভাবে নিজের মধ্যেই বড় রকমের আস্থা খুঁজে পেলেন। তেমনই কৌরবদের মেরুদণ্ডপ্রমাণ ভীষ্ম-দ্রোণের কাছেও তিনি এগিয়ে রইলেন এক কাঠি।

ওদিকে বিরাটরাজ্যে ভারী মজার এক কাণ্ড ঘটে গেল। অর্জুন যদিও জানেন যে, তাঁদের অজ্ঞাতবাসের কাল শেষ হয়ে গেছে, তবু তিনি নিজে এই যুদ্ধ-জয়ের সূত্রে নিজেকে উজ্জ্বল করে বিরাটরাজার কাছে নিজের বা পাণ্ডবদের প্রকৃত পরিচয় দিতে চান না। এত বড় একটা কাজ করেও তিনি এতটাই লাজুক যে, কোনও ক্রমেই অজ্ঞাতবাসের অপরিচয় নিজে পুরোধা হয়ে ভেঙে দিতে চান না। যুদ্ধ-জয়ের সমস্ত কৃতিত্ব তিনি কুমার উত্তরের মাথায় চাপিয়ে সারথি বৃহন্নলার সুবাদে রাজার দ্বারে এসে পৌছলেন। ওদিকে রাজসভায় দুটি পৃথক ব্যক্তি দুটি পৃথক কারণে একেবারে গদগদ হয়ে আছেন। বিরাটরাজা কঙ্ক-যুধিষ্ঠিরকে একটু আগে সবিষাদে বলেছেন—সৈন্য-সামন্ত পাঠানো দরকার এখনই। ছেলেটা বেঁচে আছে কিনা কে জানে? যার রথের সারথি হয়েছে একটা হিজড়ে, সে কি আর বাঁচবে? বয়স্য স্বভাবে কঙ্ক-যুধিষ্ঠির হেসে বললেন—আপনার কোনও চিন্তা নেই মহারাজ! বৃহন্নলা যখন সারথ্য করছে, তখন আপনার গরু চুরি যাবে না, কুমারও যুদ্ধ জিতবে।

এরই মধ্যে দূতেরা এসে খবর দিল—কুরুরা পরাজিত, গোধন সম্পূর্ণ পাওয়া গেছে, কুমার উত্তর ভাল আছেন। যুধিষ্ঠির আরও একবার বললেন—উত্তরের বিজয়ে আমি খুব একটা আশ্চর্য হচ্ছি না, মহারাজ, যার সারথি বৃহন্নলা, জয় তার হবেই তো। কুমার উত্তরের গর্বে সেই সময় রাজার মন এত ভরে ছিল যে, তিনি যুধিষ্ঠিরের কথায় অত গুরুত্ব দিলেন না, বরঞ্চ উত্তরকে রাজদ্বারে বরণ করার জন্য উপযুক্ত ধুমধাম যাতে হয়, সেই প্রক্রিয়ায় মেতে উঠলেন। ধুমধামের ব্যবস্থা হচ্ছে। বিরাট এবার খুশ-মেজাজে দ্রৌপদীকে ডেকে বললেন—সৈরন্ধ্রী! পাশার ছকটা পেতে দাও তো, এক দান খেলে নেওয়া যাক। এদিকে যুধিষ্ঠিরের তখন মনটা ভাল নেই—অর্জুন যুদ্ধ-জয় করে এসেছেন, আর তার কৃতিত্ব দাবি করছেন সেদিনের ছেলে কুমার উত্তর। এ সব তাঁর ভাল লাগছে না। তিনি বললেন—এত খুশি হয়ে পাশা খেলতে নেই, রাজা। আপনি যুধিষ্ঠিরের কথা শোনেননি? খুশ মেজাজে পাশা খেলে সে সব হেরে গিয়েছিল। রাজা বললেন—কুছ পরোয়া নেই, খেলো পাশা।

পাশা-খেলা আরম্ভ হল—রাজা এবার বললেন—ভাবা যায় না, কঙ্ক। ওই মহা মহা কুরুবীরদের কুমার উত্তর একেবারে ঢিট করে দিয়েছে। যুধিষ্ঠির ঠাণ্ডা মাথায় বললেন—বৃহন্নলা যার সারথি সে জিতবেই বা না কেন? রাজা এবার রেগে বললেন—দেখো, বারবার আমার বীর পুত্রের সঙ্গে ওই হিজড়েটার কথা টেনে আনছো তুমি। শুধু আমার পাশা-খেলার বন্ধু বলে ছেড়ে দিলাম, নইলে আজকে বাঁচতে না। যুধিষ্ঠিরের মনটা আজকে বাধা মানছে না। হয়তো অজ্ঞাতবাসের দিন-শেষের কথা তাঁরও খেয়ালে ছিল, অন্যদিকে এমন একটা মুহূর্তে অর্জুনের গৌরব একটি বালকের মিথ্যা কৃতিত্বে আচ্ছন্ন হচ্ছে—এ যেন তাঁর সহ্যই হচ্ছিল না। তিনি এবার প্রায় পরিষ্কার করেই বলে ফেললেন—ওই ভীষ্ম, ওই দ্রোণ, ওই কর্ণ—ওঁদের সঙ্গে বৃহন্নলা ছাড়া আর কে লড়তে পারে? এরপর আরও কথা, আরও প্রশংসা, যুধিষ্ঠিরের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। রাজা পাশার ঘুটি দিয়ে যুধিষ্ঠিরের মাথায় আঘাত করলেন। রক্ত চুঁইয়ে পড়ল তাঁর কপাল থেকে।

কী এমন হল যে, যুধিষ্ঠির মার খেয়েও নিজেকে সংযত রাখতে পারছেন না; বিশেষত আশ্রয়দাতা রাজা যদি একটু পুত্র-প্রশংসা করে আনন্দ পান—তাতেই বা তাঁর কী আসে যায়! আমাদের ধারণা—যুধিষ্ঠিরের এই বাঁধ-ভাঙা বাক্যরাশির পিছনে আছে তাঁর অন্তর্নিহিত আনন্দ। অজ্ঞাতবাস শেষ হয়ে গেছে, এখন আর তিনি মনে মনে অন্তত কারও আশ্রিত নন। আর প্রথাগত কোনও মহাযুদ্ধের আগেই এমন একটা যুদ্ধ যে অর্জুন জিতে এলেন, তাতে যুধিষ্ঠির আশ্রয়দাতাকে প্রতিদান দেওয়ার সুযোগ পেলেন। সবই সম্ভব হয়েছে অর্জুনের জন্য, অথচ অর্জুন সে কৃতিত্ব পাচ্ছেন না—এই দ্বন্দ্ব তাঁকে একদিকে যেমন বিষাদগ্রস্ত করছে, তেমনই অন্যদিকে তাঁর স্তম্ভিত ভ্রাতৃগর্ব উদ্বেলিত করে তুলছে। যুধিষ্ঠির জানেন না যে, এই কৃতিত্বের জন্য অর্জুন নিজেই লালায়িত নন। কুমার উত্তরকে তিনি আগেই বলে দিয়েছেন—তুমি বলবে—তুমিই এই যুদ্ধ জিতেছে—ত্বমাত্মনঃ কর্ম কৃতং ব্রবীহি। কিন্তু কুমার যখন নিজের কথা বলতে পারলেন না এবং যুদ্ধ-জয়ের কৃতিত্ব চাপিয়ে দিলেন কল্পলোকের এক দেবকুমারের ওপর, তখন অর্জুন আর কী করেন! তিনি দুদিন ধরে কুমার উত্তরের সঙ্গে গোপন পরামর্শে মেতে থাকলেন—কেমন করে, কোন নাটকীয়তা সৃষ্টি করে—মন্ত্ৰয়িত্বা তু কৌন্তেয় উত্তরেণ রহস্তদা-মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে আরও উজ্জ্বলভাবে বিরাটের সামনে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, যাতে তিনি একেবারে বিস্ময়ে আকুল হয়ে ওঠেন, আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে যান।

সেদিন থেকে তিনদিনের মাথায় পাণ্ডবরা নিজেদের অজ্ঞাতবাসের অন্তরাল ভেঙে ফেললেন। বিরাটেশ্বর আনন্দে, বিহুলতায় নিজের মেয়ে উত্তরাকে তুলে দিতে চাইলেন অর্জুনের হাতে। অর্জুন বললেন—অন্তঃপুরে তাকে বড় কাছে থেকে আমি দেখেছি। যা কিছু তার গোপনীয় এবং যা প্রকাশ্য—সবই আমার জানা। সে আমাকে পিতার মতো বিশ্বাস করে। তা ছাড়া এতদিন আচার্যের মতো তাকে নৃত্যশিক্ষা দিয়ে এখন আর সম্ভব নয় তাকে বিয়ে করা। আর পাঁচজনেই বা কী বলবে? পুরোটা বছর আমি তোমার বয়স্থা মেয়ের সঙ্গে দিন কাটিয়েছি, এখন তাকে হঠাৎ বিয়ে করলে লোকে আমার শুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, আমাকে সন্দেহ করবে। তাঁর চেয়ে এই ভাল—তোমার মেয়ে আমি নিশ্চয় নেব, তবে সে আমার ছেলের বউ হিসাবে, নিজের নয়।

অর্জুনের কথার প্রত্যেকটি যুক্তি ছিল অকাট্য। সে যুক্তি একদিকে যেমন তাঁর নিজের জিতেন্দ্রিয়তার পরিচয় বহন করে, তেমনই অন্যদিকে সে যুক্তি তাঁর প্রৌঢ় পিতৃত্বের গৌরবে সচেতন। তিনি এটা বেশ বুঝেছেন যে, তাঁর যা বয়স হয়েছে, তাতে এখন আর বিবাহ মানায় না। বিশেষত যে বালিকা এখনও পুতুল খেলার জন্য বৃদ্ধ কৌরবদের রঙিন উষ্ণীষ কামনা করে, সে যে প্রবীণ অর্জুনের শয্যাসঙ্গিনী হতে পারে না—সেটা তিনি বুঝেছেন। বাস্তববোধই তাঁকে নবীন অভিমন্যুর জন্য পুত্রবধু নির্বাচনে সাহায্য করেছে। তেরো বৎসর কঠিন বনবাস-কষ্টের পর কোনও নবীনা বধূ তাঁর লক্ষ্য হতে পারে না, তাঁর লক্ষ্য এখন হৃত মর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠা।