যুধিষ্ঠির – ২

নিরন্তর মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে একজন শান্ত মানুষের যে কী অবস্থা হতে পারে যুধিষ্ঠির তা জানেন। কারণ তিনি নিজেই সেই অবস্থার শ্রেষ্ঠতম শিকার। কৃষ্ণ আজ তাঁকে মনের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করতে বলছেন, কিন্তু কৃষ্ণ জানবেন কী করে যে, যুধিষ্ঠিরের এই যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে তাঁর জন্ম-লগ্ন থেকেই।

পাণ্ডু যখন জানতে পারলেন যে, তাঁর পত্নী কুন্তী দুর্বাসার মন্ত্রবলে ইচ্ছানুরূপী দেবতাকে পুত্রার্থে আহ্বান জানাতে পারো, তখন প্রথমেই তিনি ধর্মরাজের কথা ভেবেছিলেন। কুন্তীকে তিনি বলেছিলেন— তুমি ধর্মকে আহ্বান কর। ধর্মের ঔরসে আমরা যে পুত্র পাব, তার মন কখনও অধর্মের দিকে যাবে না— দত্তস্যাপি চ ধৰ্মেন নধর্মে রংস্যতে মনঃ। আমার প্রজারাও তাকে সাক্ষাৎ ধর্ম বলে মেনে নেবে। সমস্ত কুরুবংশের মধ্যে সেই হবে শ্রেষ্ঠ ধার্মিক।

কুন্তী স্বামীর কথা শুনে শুভদিনে শুদ্ধাচারে ধর্মদেবের পূজা করলেন। তারপর তাঁকে আহ্বান করলেন দুর্বাসার মন্ত্রে। ধর্মদেব উপস্থিত হলেন এবং মিলিত হলেন কুন্তীর সঙ্গে। সময়োচিত গর্ভধারণ সম্পূর্ণ হল। জ্যৈষ্ঠ মাসের এক দুপুর বেলায়, সূর্য যখন মধ্যাহ্ন গগন থেকে তাঁর সহ-কিরণে পৃথিবীকে তপ্ত করে দিয়েছেন, সেই সময়ে কুন্তীর জ্যেষ্ঠপুত্র জন্মালেন। তাঁর জন্ম-লগ্নেই আকাশ থেকে দৈববাণী হল— এই বালক হবে ধার্মিকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সত্যবাদী এবং রাজা— এষ ধর্মভূতাং শ্রেষ্ঠো ভবিষ্যতি নরোত্তমঃ। পাণ্ডুর এই প্রথম পুত্রের নাম হবে যুধিষ্ঠির।

আশ্চর্য লাগে আমাদের— জন্ম-লগ্নেই যে মানুষটির ওপর নরোত্তম ধার্মিকের এক মার্কা মেরে দেওয়া হল, সদা-সত্য কথনের বিশাল মর্যাদায় যে শিশুটিকে চিহ্নিত করা হল, সারা জীবন ধরে সেই ধর্ম আর সেই সত্যবাদিতা তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে এক পরম তত্ত্বের মতো, আদর্শের মতো। সারাক্ষণ তাঁকে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে আমি ঠিক কাজটিই করছি তো? ধর্ম থেকে, সত্য থেকে আমি বিচ্যুত হচ্ছি না তো? অন্য কেউ পাশা খেললে দোষ নেই, যুধিষ্ঠির পাশা খেললেই তিনি ধর্মচ্যুত। স্ত্রীকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে না পারলে অন্যের ক্ষেত্রে তা পৌরুষের অপমান, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের ক্ষেত্রে তা ধর্ম-চ্যুতি।

আরও আশ্চর্য— কী বিপ্রতীপ মাহাত্ম্যই না তাঁর কাছে আশা করা হয়েছে! একদিকে তিনি ধার্মিক শ্রেষ্ঠ নরোত্তম হবেন, সত্যবাদী হবেন, আর একদিকে তিনি রাজাও হবেন— বিক্রান্তঃ সত্যবাক্ চৈব রাজা পৃথ্ব্যাং ভবিষ্যতি। ধর্ম, সত্য এবং রাজত্ব— একই ব্যক্তির মধ্যে চরম বিপ্রতীপ এই তিনটি গুণের সমাহার যেখানে সমস্ত মানুষের আশার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, সেই ব্যক্তিকে মনের সঙ্গে কীরকম সংগ্রাম করতে হয়, তা একমাত্র যুধিষ্ঠিরই জানেন। হয়তো বা জানেন কৃষ্ণও; নইলে জীবনের শেষ কল্পে এসে যুধিষ্ঠিরের যখন রাজা হওয়ার সময় এসেছে তখনই তিনি এই মানস-যুদ্ধের কথা তুলবেন কেন? আসলে যুধিষ্ঠিরের জীবনে যখন রাজা হওয়ার সময় এসেছে, ধর্ম আর সত্যের পরীক্ষা তখন শেষ হয়ে গেছে। তার রাজা হওয়া তাই ঠিক ইতরজনের রাজা হওয়ার মতো নয়। ধর্ম সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হলে, তবেই যুধিষ্ঠিরের রাজ-যোগ উপস্থিত হয়। কারণ, তিনি ধর্মরাজ।

ঠিকুজি-কুষ্ঠিতে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের জানাই— ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ পণ্ডিতেরা বলেন ৫১৬৮ বছর পূর্বের জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে ঠিক দুপুরবেলায় যুধিষ্ঠির জন্মলাভ করেন। তাঁর জন্মরাশি বৃশ্চিক। সিংহ লগ্ন। হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মশাই অন্যান্য পণ্ডিতদের সাহায্যে যুধিষ্ঠিরের রাশি-নক্ষত্র বিচার করে তাঁর ভাগ্যফল ঘোষণা করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে তাঁর চরিত্রে অসাধারণ ধর্মপ্রবণতার সঙ্গে প্রবল রাজযোগও উপস্থিত। মধ্যজীবনের বনবাস বা অরণ্যচারিতাও কোষ্ঠীর বাইরে নয়। ধনবত্তার সঙ্গে আছে পুত্রহানি। চরম মানসিক অশান্তির সঙ্গে উৎকৃষ্ট ভ্রাতৃযোগ এবং পত্নীযোগও লক্ষণীয়। শেষ বয়সে মঙ্গলের দশায় রাজ্যলাভের কথাও গণতকারেরা ঘোষণা করেছেন।

যুধিষ্ঠিরের কোষ্ঠী দেখে পণ্ডিতেরা বিচার করতে থাকুন। আরও গভীরভাবে, আরও নিখুঁত করে। কিন্তু আমরা জানি, মানুষের জীবন কোষ্ঠীর নিয়মে চলে না। যুধিষ্ঠিরেরও চলেনি। কোষ্ঠীতে আছে, তিনি ধার্মিক হবেন; কিন্তু যুধিষ্ঠিরের ধর্ম যে কত কঠিন, কত বড়— তা শুধু তাঁর জীবন দিয়েই প্রমাণ করা যায়। একই রকমভাবে যুধিষ্ঠিরের রাজযোগ, যুধিষ্ঠিরের স্ত্রীযোগ। তাঁর সফলতা এবং অতি অবশ্যই তাঁর বিফলতাও কখনও অন্য কোনও লোকের মতো নয়। অন্য ধার্মিকের মতোও নয়, অন্য রাজার মতোও নয়, এমনকী অন্য অসফল মানুষের মতোও নয়। যুধিষ্ঠির যেখানে ধার্মিক, প্রেমিক অথবা রাজা, সেখানে শুধু একজনের সঙ্গেই তাঁর তুলনা করা যায়— তিনি স্বয়ং যুধিষ্ঠিরই। যুধিষ্ঠির যা চাইছেন সেটাই হল আসল যুধিষ্ঠির বা সেটাই যুধিষ্ঠিরের আদর্শ, সেখানে তিনি উপমান। বাস্তব-জীবনে যুধিষ্ঠির যা করতে পেরেছেন, সেখানে যদি কোনও অসাফল্য থাকে, তবে সেই অসাফল্যের কারণ কখনওই প্রায় তিনি নন এবং সেই অসাফল্যের জায়গাটাতেই মানুষ যুধিষ্ঠিরকে প্রায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে। এই মানুষের পরিসরেই যুধিষ্ঠির উপমেয়-মাত্র। তাঁর সঙ্গে তুলনা করতে হবে আদর্শ যুধিষ্ঠিরের। এ বড় কঠিন কাজ তবু মানুষ যুধিষ্ঠিরকে পেতে হলে তাঁর জীবনের প্রথম পদক্ষেপ থেকে স্বর্গারোহণের পথ পর্যন্ত আমাদের অতি সাবধান হয়ে চলতে হবে।

কেমন লেগেছিল সেই দিনটি অথবা সেই মুহূর্ত, যখন উতলা বসন্তের হাওয়ায় পাণ্ডুর দ্বিতীয়া-পত্নী মাদ্রীর চিৎকার ভেসে এল— দিদি, আসুন শিগ্‌গির। আমি মরেছি। কুন্তী তাঁর তিন পুত্র আর নকুল-সহদেবকে সঙ্গে নিয়ে মাদ্রীর কাছাকাছি যাবার আগেই তাঁকে নিরস্ত হতে হল। মাদ্রী পুনরায় চিৎকার করে বললেন— তুমি একাই এস দিদি! ছেলেরা ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাক— একৈব ত্বমিহাগচ্ছ তিষ্ঠত্ত্বত্রৈব দারকাঃ। বেশ বুঝতে পারি— পাণ্ডু তাঁর প্রিয় পত্নীর সঙ্গে হঠাৎ সঙ্গমে রত হলে মাদ্রী অসংবৃত ছিলেন। তাই পাণ্ডুকে কিম মুনির শাপে মৃত অবস্থায় কোলে শুইয়ে রেখেও মাদ্রীকে ছেলেদের ব্যাপারে সাবধান-বাণী উচ্চারণ করতে হয়েছে। কিন্তু ঠিক এই অবস্থায়, কুন্তী যখন একা মাদ্রীর নিকটতর হলেন, তখন চারটি ছোট ছোট ভাইদের আগলে দাঁড়িয়ে জ্যেষ্ঠ-পাণ্ডব যুধিষ্ঠির কী ভাবছিলেন?

কী ভাবছিলেন, মহাভারতের কবি তা বলেননি। কিন্তু আমরা জানি— যুধিষ্ঠির অন্তত পিতা পাণ্ডুর আকালিক সঙ্গম-তাড়না নিয়ে গবেষণা করছিলেন না। বরঞ্চ পিতার আকালিক মৃত্যুতে শতশৃঙ্গ পর্বতের উপত্যকা-ভূমিতে দাঁড়িয়ে জ্যেষ্ঠ-পাণ্ডব এই মুহূর্তে যে একাকীত্বের মধ্যে পতিত হলেন, সে বুঝি তিনি ছাড়া আর কেউ অনুভব করলেন না। তখন তাঁর ষোলো বছর মাত্র বয়স। পাণ্ডু এবং মাদ্রীর শবদেহ নিয়ে যে দিন শতশৃঙ্গবাসী ঋষিরা হস্তিনাপুরে উপস্থিত হলেন, তখন তাঁর সঙ্গে আছেন সেই চার ভাই এবং জননী কুন্তী। ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডুর বনগমনের পর থেকে রাজত্ব চালাচ্ছিলেন। তিনি কুন্তীকে চেনেন বটে, কিন্তু পাণ্ডুর পুত্রদের তিনি তখনও চেনেনই না।

কুন্তী এবং পাণ্ডব-পুত্রদের দেখবার জন্য সমস্ত হস্তিনাপুর সেদিন ভেঙে পড়েছিল। পাণ্ডুমাতা অম্বালিকা থেকে আরম্ভ করে ভীষ্ম, বিদুর, সত্যবতী সকলেই সেদিন কুরুসভার প্রাঙ্গণে উপস্থিত। কেমন লেগেছিল যুধিষ্ঠিরের, যখন তিনি ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রকে সুবর্ণভূষণে মণ্ডিত অবস্থায় দেখতে পেলেন— ভূষিতা ভূষনৈশ্চিত্রৈঃ শতসংখ্যা বিনির্যযুঃ। জানি, ভাল করে জানি, যুধিষ্ঠিরের কিছুই মনে হয়নি। তিমি ভীম নন, অর্জুন নন, তিনি যুধিষ্ঠির। কী আশ্চর্য এই নামটা! যাঁরা যুদ্ধ করতে জানেন, যুদ্ধ জিততে জানেন, তাঁদের নামের সঙ্গে যুদ্ধ শব্দটার কোনও যোগই রইল না। অথচ যিনি যুদ্ধ করতে জানেন না, যুদ্ধ জয় করতে পারেন না, অস্ত্র পরীক্ষার আসরে যাঁকে আচার্যের তিরস্কার শুনতে হবে, তাঁকে জন্ম-লগ্নেই নামকরণ করা হল যুধিষ্ঠির— অর্থাৎ যুদ্ধের সময়েও তাঁর মস্তিষ্ক স্থির থাকবে। এইখানেই স্মরণ করতে হবে কৃষ্ণের সেই অনবদ্য উক্তি— এ যুদ্ধ ধনুক-বাণ দিয়ে হয় না, সৈনিক-ভৃত্যদের দিয়েও এ যুদ্ধ হয় না, বন্ধু বান্ধবের সাহায্য নিয়েও এ যুদ্ধ জয় করা যায় না— যত্র নৈব শরৈঃ কাৰ্য্যং ন ভূত্যৈ ন চ বন্ধুভিঃ। এ হল নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ। এ যুদ্ধে চিরকাল তাঁকে স্থির থাকতে হবে বলেই জন্ম-লগ্নেই ধর্মদেবের দেওয়া সেই নাম— যুধিষ্ঠির ইতি খ্যাতঃ পাণ্ডোঃ প্রথমজঃ সুতঃ।

শতশৃঙ্গবাসী মুনিরা পাণ্ডুর স্থলাভিষিক্ত কার্যকারী রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যুধিষ্ঠিরের পরিচয় দিয়ে বললেন— সাক্ষাৎ ধর্ম থেকে পাণ্ডুর এই জ্যেষ্ঠপুত্র জন্মগ্রহণ করেছে, এর নাম যুধিষ্ঠির— সাক্ষাদ্‌ ধর্মাদ্‌ অয়ং পুত্ৰস্তত্র জাতো যুধিষ্ঠিরঃ। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর অন্য পুত্রদের জন্ম-কথাও শুনলেন। কিন্তু সেদিন তিনি হস্তিনাপুরের সিংহাসন থেকে নেমে এসে প্রথম পরিচিত পাণ্ডু-পুত্রদের সালিঙ্গনে কুশল প্রশ্ন করেননি। পিতৃহারা ষোলো বছরের জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবকে তিনি একবারও বলেননি— তুমি কুলজ্যেষ্ঠ— হস্তিনাপুরে তোমার অধিকার কেউ সন্দেহ করে না। না, ধৃতরাষ্ট্র এ-কথা বলেননি। শতশৃঙ্গবাসী ঋষিরা কিন্তু ইঙ্গিত করে বলেছিলেন— ধর্মাত্মা পাণ্ডু বনে থেকেও পাঁচটি পুত্রের মাধ্যমে পিতৃপিতামহের বংশ-পরম্পরা রক্ষা করেছেন— এষ পৈতামহো বংশঃ পাণ্ডুণা পুনরুদ্ধৃতঃ।

যুধিষ্ঠির কি এই ইঙ্গিত বোঝেননি? ঠিকই বুঝেছেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র বোঝেননি। বুঝেও বোঝেননি। কেননা, বুঝলে এই মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজপদে অঙ্গীকার করতে হয়। এই সরল অনুধাবন-প্রক্রিয়ার মধ্যে না গিয়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র রাজোচিত গাম্ভীর্যে পাণ্ডু এবং মাদ্রীর দাহকার্য তথা শ্রাদ্ধের কথা ঘোষণা করেছেন। ছোটভাই মারা যাওয়ায় তিনি শোকগ্রস্ত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সে শোক নিশ্চয়ই কুন্তী কিংবা পাণ্ডবদের চেয়ে বেশি ছিল না।

লক্ষণীয় বিষয় হল, পাণ্ডুর দাহ এবং শ্রাদ্ধ-তর্পণ সম্পন্ন হয়ে গেলে পাঁচ ভাই পাণ্ডবদের আমরা যখন হস্তিনায় প্রবেশ করতে দেখছি, তখন ধৃতরাষ্ট্র বা তাঁর পুত্রদের কাউকে প্রত্যুদ্‌গমন করে পাণ্ডবদের ঘরে নিয়ে আসতে দেখছি না। লক্ষণীয়, গঙ্গা-তীরে অশৌচ-ক্রিয়া এবং শ্রাদ্ধের শেষে হস্তিনানগরীর পৌরজন এবং জনপদবাসীরাই পাণ্ডবদের নিয়ে হস্তিনায় প্রবেশ করেছেন— পাণ্ডবান্‌ ভরতৰ্ষভান/ আদায় বিবিশুঃ সর্বে পুরং জানপদাস্তদা। শতশৃঙ্গের পর্বতগৃহ থেকে পিতৃগৃহে আসা পাণ্ডব-ভাইরা পুরঃপ্রবেশের পথে কৌরব ভাইদের কাছ থেকে এমন কোনও উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেন না, যাতে নতুন পিতৃগৃহ তাঁদের কাছে সহজ হয়ে ওঠে। ধৃতরাষ্ট্রও এ ব্যাপারে খুব বেশি উৎসাহ দেখাননি।

রাজধানীতে রাজবাড়ির কাছাকাছি একটা থাকবার জায়গা নিশ্চয়ই পাণ্ডবরা পেয়েছিলেন; এমনকী শরীর ধারণের উপযুক্ত খাবারও তাঁরা পেয়ে যাচ্ছিলেন— সংব্যবৰ্ধন্ত ভোগাংশ্চ ভুঞ্জানা পিতৃবেশ্মনি। কিন্তু সে শুধু খাবারই। পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির সেই মর্যাদা মোটেই লাভ করছিলেন না, যা দুর্যোধন লাভ করেছিলেন পিতার কাছে। পার্থক্য একটা ছিল এবং সেটা ভালভাবেই ছিল। ভীমকে বিষ খাইয়ে মারবার জন্য দুর্যোধন যে পরিকল্পনা করেছিলেন, তা কার্যকর করার জন্য রাজ্য ব্যবহার করেছিলেন দুর্যোধন। গঙ্গাতীরে প্রমাণকোটিতে জায়গা ঠিক করা, সেখানে অস্থায়ী গৃহনির্মাণ করা, প্রচুর খাবার-দাবারের ব্যবস্থা রাখা এবং সমস্ত ব্যাপারে রাষ্ট্রের সহযোগিতা পেতে দুর্যোধনের কোনও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে তাঁর ভাইদের নিয়ে থাকতে হত ভৃত্যের মতো। এমনকী অস্থায়ী কার্যনির্বাহক রাজা ধৃতরাষ্ট্র অথবা তাঁর পুত্র অন্যায় করলেও, তা জোরে বলবার সাহস ছিল না পাণ্ডবদের।

দুর্যোধন যখন সুপরিকল্পিতভাবে ভীমকে বিষ খাইয়ে গঙ্গায় ফেলে দিলেন, তখন দুর্যোধনের বাইরের ব্যবহার দেখে যুধিষ্ঠির কিছুই বুঝতে পারেননি। মহাভারতের কবি টিপ্পনী কেটে বলেছেন— ভাল লোক দুনিয়াটাকে সব সময় ভালই দেখে— স্বেনানুমানেন পরং সাধুঃ সমনুপশ্যতি। ভীমকে না দেখে তিনি ভেবেছেন— ভীম আগেই বাড়ি চলে গেছেন। একবারও তাঁর সন্দেহ হল না— সবাই আছে, শুধু ভীম নেই কেন? তারপর যখন বাড়িতে ফিরে দেখলেন ভীম নেই, তখন যুধিষ্ঠিরের মন ভয়ে একেবারে আকুল হয়ে উঠল। একবার মাকে জিজ্ঞাসা করেন— ভীম কোথায় গেল; একবার এখানে-সেখানে খুঁজে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন, তারপর অধিকতর উদ্বিগ্ন হয়ে মায়ের কাছে সন্দেহ প্রকাশ করেন— ছাতা-জুতো, উত্তরীয়, উষ্ণীষ— ভীমের কোনও জিনিস আমরা পরিত্যক্ত অবস্থায় কুড়িয়ে পাইনি। আর তাকে তো দেখছিই না। আমার ভাল মনে হচ্ছে না, মা— নহি মে শুধ্যতে ভাবস্তং বীরং প্রতি শোভনে। সে যে কোথাও ঘুমিয়ে পড়ে আছে— এ কথা বিশ্বাস করতে আমি একটুও রাজি নই, আমার মনে হচ্ছে— তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, মা— যতঃ প্ৰসুপ্তং মন্যে’হং ভীমং নেতি হতন্তু সঃ।

প্রথমবার, হস্তিনাপুরে বসবাসের সময়ে এই প্রথমবার যুধিষ্ঠির কারও নাম না করে কৌরবদের অন্তর্ঘাত সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এই সন্দেহ এতটাই সত্য ছিল যে, মহাভারতের কবি তাঁকে এই মুহূর্তে রীতিমত বুদ্ধিমান বলে চিহ্নিত করেছেন— ধর্মরাজেন ধীমতা। ভীমকে দেখতে না পেয়ে বীরজননী কুন্তী বিদুরকে ডেকে এনেছেন নিজের ঘরে। কুন্তীর উৎকণ্ঠা দেখে বিদুরও পাণ্ডবদের নিয়ে পুনরায় ভীমের অন্বেষণে বেরিয়েছেন। ভীমকে পাওয়া যায়নি। কুন্তী তখন বিদুরের কাছে যুধিষ্ঠিরের পূর্ব-সন্দেহ পুনরাবৃত্তি করেছেন। বলেছেন— ক্ষমতালোভী নির্লজ্জ দুর্যোধন ভীমকে হয়তো মেরেই ফেলেছে— নিহন্যাদপি তং বীরং জাতমন্যুঃ সুযোধনঃ।

আমরা জানি— ভীম মারা যাননি। দুর্যোধন তাঁকে মারার চেষ্টা করেছিলেন মাত্র। সমস্ত পাণ্ডব-ভাইদের মধ্যে ভীমের ব্যাপারেই দুর্যোধনের চরম আশঙ্কা ছিল এবং তাঁকে মেরে দুর্যোধন তাঁর পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে চেয়েছেন। দুর্যোধনের এই বুদ্ধিটুকু যুধিষ্ঠির পূর্বাহ্নেই ধরে ফেলেছেন— সেটা আমরা দেখেছি আগেই, কিন্তু এই বুদ্ধির জন্যই যে কবি তাঁকে ‘ধীমান্’ বলে চিহ্নিত করেছেন, তা মোটেই নয়। বরঞ্চ বাসুকির পাতালপুরী থেকে ফিরে আসার পর যুধিষ্ঠির যেভাবে ঘটনার যবনিকাপাত করেছেন— তার মধ্যেই যুধিষ্ঠিরের প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা লুকিয়ে আছে।

ভীম বেঁচে ফিরে এলেন হস্তিনাপুরে। ভাইদের সামনে, মায়ের সামনে দুর্যোধনের সমস্ত অপকর্ম এবং কৌশলগুলি সবিস্তারে শোনাতে লাগলেন ভীম। ভীমের যা চরিত্র তাতে খুব চুপিচুপি সব কথা বলে ভবিষ্যতের শিক্ষা নেবার লোক তিনি নন। ভীমের কথার মধ্যেই যুধিষ্ঠির তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন— একদম চুপ! এ সব কথা কারও সামনে আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ কোরো না— তুষ্ণীং ভব ন তে জল্প্যমিদং বাক্যং কথঞ্চন।

এই একটা ধমকের মতো কথা বলেই যুধিষ্ঠির যেন পিতৃহারা ভাইদের সমস্ত ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তিনি জানেন— জননী কুন্তী অধৈর্য হয়ে বিদুরের কাছে দুর্যোধনের পরিকল্পনা নিয়ে নানা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। শুধু ভরসা এই— মহামতি বিদুর পাণ্ডবদের পক্ষপাতী। কিন্তু তাঁদের সন্দেহের কথা দুর্যোধনের কানে গেলে সে যে আরও গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে— সে কথা বলাই বাহুল্য। বিদুর এতকাল ধরে কুরুসভার প্রবর-মন্ত্রী। কুন্তীর কথা শুনে বিদুর তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া চেপে রেখেও বলেছিলেন— এরকম করে জোরে জোরে বলবেন না, বউদিদি— মৈবং বদস্ব কল্যাণি! এ সব কথা শুনিয়ে এখন যদি দুর্যোধনকে বকাবকি করি, তাহলে উলটে সে আরও অনিষ্ট করবে আপনার— প্রত্যাদিষ্টো হি দুষ্টাত্মা শেষে’পি প্রহরেত্তব।

পরিষ্কার বোঝা যায়, এই মুহূর্তে যুধিষ্ঠির যে প্রায় ধমকে উঠলেন ভীমকে, তার একমাত্র কারণ, বিদুরের দূরদর্শী-বুদ্ধিটুকু যুধিষ্ঠির সঙ্গে সঙ্গে আত্মসাৎ করেছেন। বিদুর যে-কথা কুন্তীকে বলেছিলেন ভীমকে ফিরে পাওয়ার আগে, ঠিক সেই কথাটিই যুধিষ্ঠির ভীমকে বলেছেন ভীম ফিরে আসার পরে। যুধিষ্ঠির জানেন, তিনি এখন শুধু পিতৃহারাই নন, রাজ্যহারাও বটে। কুন্তীর হাত ধরে ঋষিদের সামনে নিয়ে পাঁচ ভাই যেদিন রাজবাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন, সেদিনও তাঁরা রাজপুত্রের প্রাপ্য সম্মান পাননি। আর আজও তাঁরা কুরুদের বাড়িতে রয়েছেন অনুগৃহীতের মত। অন্যের অধিগৃহীত ভূমিতে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থেকে যদি পুনরায় পিতৃরাজ্য অধিকার করতে হয়, তবে ধৈর্যশীল হতেই হবে— পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির এটা জানেন। খুব ভাল করে জানেন। আর জানেন বলেই মহামতি বিদুরের ধীর-গভীর নীতিশাস্ত্রের জ্ঞান তিনি গ্রহণ করবার চেষ্টা করেছেন প্রথম থেকেই।

মহাভারতের একেবারে শেষ দিকে বিদুর যখন মারা গেলেন, ঠিক তার আগে আগে যুধিষ্ঠির বিদুরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন বনে। সেখানে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী— সকলেই বানপ্রস্থ অবলম্বন করে বসবাস করছিলেন, বিদুরও ছিলেন তাঁদের কাছাকাছি। যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কাছেই বিদুরের প্রথম সংবাদ পেলেন। ধৃতরাষ্ট্র বলেছিলেন— বিদুর সাংঘাতিক তপস্যা করছেন। আহার করেন না, বিশ্রাম করেন না, ভীষণ রোগা হয়ে গেছেন— বায়ুভক্ষো নিরাহারঃ কৃশো ধমনিসন্ততঃ। এই শূন্য কাননের মধ্যে ব্রাহ্মণরা কখনও তাঁকে দেখতে পান, কখনও পান না।

এই সব কথা বলতে বলতেই যুধিষ্ঠির বিদুরকে চকিতে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠির তাঁর পিছন পিছন ছুটলেন। বার বার ডাকতে থাকলেন কাকা! আমি যুধিষ্ঠির, আমি হস্তিনার রাজা। বিদুর কিছুতেই কান দিলেন না। বন থেকে বনান্তরে তিনি পাগলের মতো ছুটে চলেছেন, আর মহারাজ যুধিষ্ঠির ছুটছেন তাঁর পিছন পিছন। মহাভারতের কবি মন্তব্য করলেন— এক মহাবুদ্ধি ব্যক্তি আরেক মহাবুদ্ধি মানুষের অনুগমন করলেন— অভিজজ্ঞে মহাবুদ্ধিং মহাবুদ্ধির্যুধিষ্ঠিরঃ।

এই যে একটি মাত্র পংক্তির মধ্যে যুধিষ্ঠির এবং বিদুরের বুদ্ধির সামান্য ঘটল— এই সমানতাই সব নয়। একটু পরেই ধাবমান বিদুর এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়ালেন এবং যুধিষ্ঠির দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। বিদুর যুধিষ্ঠিরের দিকে অনিমেষ স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন আর মনে হল যেন বিদুরের চোখ যুধিষ্ঠিরের চোখে, তাঁর প্রাণ যুধিষ্ঠিরের প্রাণে, তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলি যেন যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে প্রবেশ করল। কবি আবারও মন্তব্য করলেন— বিদুর যোগবলে যুধিষ্ঠিরের অঙ্গে প্রবেশ করলেন— স যোগবলমাস্থায় বিবেশ নৃপতেস্তনুম্‌।

কথাগুলির মধ্যে অলৌকিকতার অংশটুকু ছেটে দিলেও বলা যায়— নীতি এবং ধর্মের যে সারাংশটুকু দিয়ে মহাকবি বিদুরের চরিত্র এঁকেছেন, ঠিক সেই সারাংশ যুধিষ্ঠিরের অন্তরে থাকায় যুধিষ্ঠিরের ‘দেহেন্দ্রিয়মনোবুদ্ধি’ সবই বিদুরের মতো। জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে যুধিষ্ঠির বিদুরের নীতি দিয়ে আরম্ভ করেছিলেন এবং জীবনের শেষপর্বে বিদুরকে তিনি সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করেছিলেন। বিদুরই ছিলেন যুধিষ্ঠিরের আদর্শ। যুধিষ্ঠিরের মতো মানুষ ইন্দ্রিয়, মন এবং প্রাণ দিয়ে আদর্শকেই শুধু আত্মসাৎ করেন।

কতগুলি প্রলাপজ্ঞ পণ্ডিত যুধিষ্ঠিরকে বিদুরের অবৈধ সন্তানরূপে চিহ্নিত করেছেন। বলা বাহুল্য— এঁরা অবৈধতার মধ্যেই একমাত্র রস খুঁজে পান। অতএব কোনও মহাভারতীয় প্রমাণ ছাড়াই এঁরা নাটক লিখতে ভালবাসেন। এঁদের খেয়াল থাকে না— অবৈধতার কোনও বিষয় মহাভারতের কবি লুকোননি। অতএব যুধিষ্ঠিরের ক্ষেত্রে নতুন কোনও অবৈধতার আবিষ্কার করতে গেলে রস জারিয়ে ওঠে এবং তাতে সমানধর্মা সহৃদয়ের রসাভাস পুষ্ট হয়। তাঁর দিক থেকে লাভ এইটুকুই।

জীবনের প্রথম বড় একটি সিদ্ধান্ত দেবার সময় যুধিষ্ঠির যে বিদুরের অনুগামী হলেন, তার একটি রাজনৈতিক কারণও আছে। ধৃতরাষ্ট্রের সভায় যাঁরা মন্ত্রী ছিলেন, বিদুর তাঁদের অন্যতম। উপায় না থাকলেও একমাত্র তিনি এবং অংশত পিতামহ ভীষ্ম হস্তিনাপুরের সিংহাসনে পাণ্ডবদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার স্বীকার করতেন। এর মধ্যে পিতামহ তত স্পষ্ট করে সে কথা বলতেন না, বিদুর সেটা বলতেন। বিদুর অনীতি অন্যায় মেনে নেন না। ধৃতরাষ্ট্রের মতো বড়ভাই বললেও মেনে নেন না। বিরুদ্ধ-জায়গায় দাঁড়িয়ে রাজকুলের এক প্রধান মন্ত্রণাদাতার স্পষ্ট-পক্ষপাত যদি লাভ করা যায়, তবে সেটা যুধিষ্ঠিরেরই লাভ। যুধিষ্ঠির তাই আরও বেশি করে বিদুরের অনুগামী হতে চাইলেন। নীতি, যুক্তি এবং ধর্মবোধের সাধর্ম্য থাকায় বিদুরও সব সময় যুধিষ্ঠিরকে যথোপযুক্ত বুদ্ধি দিয়ে যেতে থাকলেন— ধর্মাত্মা বিদুরস্তেষাং প্রদদৌ মতিমান্‌ মতিম্।

ভীমকে চুপ করতে বলা মানে শত্রুপক্ষকে নিজেদের পরিকল্পনা বুঝতে না দেওয়া। অর্থাৎ তোমাদের কুপরিকল্পনা আমরা বুঝে গিয়েছি, কিন্তু দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে শোরগোল করে লোক জমিয়ে দুর্যোধনের রাজনৈতিক ফয়দা বেশি হতে দেব না। কেন না তাতে দুর্যোধন সোজাসুজি ঘটনা অস্বীকার করবেন এবং নিজের রাজনৈতিক প্রভাব এবং টাকাপয়সা খরচা করে হস্তিনাপুরের রাজনীতি নিজের অনুকূলে নিয়ে আসবেন। যুধিষ্ঠির ভীমকে থামিয়ে দিয়ে ভাইদের বললেন— আজ থেকে তোমরা সযত্নে একে অন্যকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে— ইতঃ প্রভৃতি কৌন্তেয়া রক্ষতান্যোন্যমাদৃতাঃ। যুধিষ্ঠির ভাইদের সদা সর্বদা সচেতন হয়ে থাকতে বললেন, কিন্তু ভীমের প্রতি দুর্যোধন যে অন্যায় করেছিলেন, সেই অন্যায়ের জন্যই পাণ্ডবদের ওপর বিদুরের পক্ষপাত রয়ে গেল। যুধিষ্ঠির কৌরবদের এই প্রথম অন্যায় একেবারে প্রচার করতে না দেওয়ার ফলে বিদুরের মতো মহাবুদ্ধি-মন্ত্রী প্রথম থেকেই পাণ্ডবদের পক্ষপাতী হয়ে গেলেন এবং সাধ্যমত তিনি পাণ্ডবদের বুদ্ধি জোগাতে লাগলেন কৌরবদের মন্ত্রিসভায় থেকেও।