অর্জুন – ১১

১১

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ লাগবেই। অতএব আমরা এখন সেই অসাধারণ দার্শনিক মুহূর্তে উপনীত যখন অর্জুন ভগবদ্‌গীতার উপদেশ শুনছেন কৃষ্ণের কাছ থেকে। আমরা আগেই বলেছি—গীতার উপদেশের আধার হিসেবে অর্জুন পূর্বাহ্নেই ছিলেন উপযুক্ত। এখন যুদ্ধমুখীন স্পধার পরিস্থিতিতে তাঁকে বুঝি আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল—দেখো অর্জুন। তোমার অসাধারণ অস্ত্রনৈপুণ্য সত্ত্বেও তুমি যা করতে যাচ্ছো—তার কতা তুমি নও, কারণ একমাত্র অহঙ্কার-মূঢ় মানুষেরাই নিজেকে কত ভাবে—তাহংকার-বিমূঢ়াত্মা কত্তাহমিতি মনতে। স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল—ভীষ্ণ, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণের মতো মহারথ যোদ্ধারা কাল পরিপক্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই মারা গেছেন বা যাবেন—অর্জুন তুমি সেই মৃত্যুর নিমিত্ত মাত্র, কতা নও। এই যে বিরাট যুদ্ধভূমিতে দাঁড়ানো সবচেয়ে নিপূণ ব্যক্তিটিকে একেবারে দাশনিকভাবে, নৈর্ব্যক্তিক ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করা হল, এইখানেই মহাভারতের শেষ পর্যায়ে যুদ্ধোত্তর শান্তরসের সঙ্গে একমাত্র অর্জুনেরই যেন নায়কত্ব তর্কযোগ্য হয়ে ওঠে। অর্জুন যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন, যেহেতু ক্ষত্রিয়ের ধর্মে দুর্যোধনের মতো অন্যায়ী। ব্যক্তিকে শাসন করা প্রয়োজন, তাই। অর্জুন যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন, যেহেতু এই কর্মে তাঁর অধিকার আছে, কিন্তু এই কর্মের ফলে তাঁর আসক্তি নেই। অর্জুন যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন, যেহেতু যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তে ভীষ্ম-দ্রোণের মতো পিতামহ বা আচার্যের, দুর্যোধন-দুঃশাসনের মতো জ্ঞাতিভাইদের শরীরে অস্ত্রাঘাত করতে হবে—এই চিন্তায় তিনি আপন কর্তব্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণের কাছে নিষ্কাম কর্ম, জ্ঞান এবং পরিশেষে পরম ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণের বাণী শুনে তিনি এখন আত্মস্থ, ধীর, আপন কর্তব্য সম্বন্ধে সংশয়হীন এবং যুদ্ধ করার জন্যই যে যুদ্ধ করতে হবে—এই রকম একষ্টা নৈর্ব্যক্তিক ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত। ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই আমরা অর্জুনের মধ্যে মহাভারতের নায়ক সন্ধানের সার্থকতা খুঁজে পাই।

পাঠকের ধৈর্য নিঃশেষ হবার আগেই আরও একটা ব্যাপারে তাঁদের অবহিত হতে বুলি। দেখুন, একেবারে ভীষ্মপর্ব থেকে আরম্ভ করে সৌপ্তিক পর্ব পর্যন্ত কৌরবদের সঙ্গে পাণ্ডবদের যে বিরাট যুদ্ধ চলেছে—তাতে অর্জুন কেমন যুদ্ধ করেছেন, কত বিচিত্র বাণ ছুঁড়েছেন, কত বীরত্ব দেখিয়েছেন—এই আলোচনা আমি আপাতত নিরর্থক মনে করি। আচার্য দ্রোণের কাছে পাখির মাথা কাটার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর থেকে সারাজীবন ধরে তিনি যে অস্ত্রশিক্ষা করেছেন, তাতে এই রকম একটা বিরাট যুদ্ধ তাঁর কছে কাম্য ছিল। হয়তো এই দিকে লক্ষ্য রেখেই মহামতি কৃষ্ণ তাঁর যুদ্ধ-পূর্ব বিচলন দেখে অবাক হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন—ক্ষত্রিয়বীরগণ এই রকম একটা যুদ্ধের সম্মুখীন হলে নিজেদের ধন্য মনে করে—সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্‌। অর্জুন তাঁর সমস্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধটি আজ পেয়েছেন। অথচ তাঁর কী বিড়ম্বনা, যাঁদের সঙ্গে তাঁর এই যুদ্ধ হবে, তাঁরা সবাই তাঁর আত্মীয়স্বজন।

ঠিক এই মুহূর্তে গীতার কথা তাঁকে প্রকৃতিস্থ করেছে—এই যুদ্ধ তাঁর কাছে ধর্মের স্বরূপে ধরা দিয়েছে। আরও আশ্চর্যের কথাটা দেখুন, যে ভীষ্ম, যে দ্রোণকে অস্ত্রাঘাত করার আশঙ্কায় অর্জুন বিচলিত হয়েছিলেন, সেই ভীষ্মের মৃত্যুর শেষ কারণ কিন্তু তিনি নন। দ্রোণাচার্যের মৃত্যুও তাঁর হাতে হয়নি। এমনকী যে কর্ণের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্জুন অন্তরে অন্তরে চিরকাল তুষাগ্নি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন, সে কর্ণের মৃত্যু যতখানি ভাগ্যের হাতে হয়েছে, অর্জুনের হাতে ততটা নয়। এর কারণ কী? মহাভারতের কবি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধরকে এ কী বিড়ম্বনায় ফেলেছেন? আধুনিক অল্পস্বত্ব চিন্তাবিদ্ৰা বিশালবুদ্ধি ব্যাসের ভাব-ব্যঞ্জনা কিছুই না বুঝে বলে ফেলেন—অর্জুন! সে তো বাসুদেব কৃষ্ণের ছায়ামাত্র। ও কি নিজে কিছু করেছে? কৃষ্ণ বুদ্ধি দিয়েছেন, আর অর্জুন তোতার মতো তা অনুসরণ করেছে। শুধুমাত্র অল্পস্বত্বতার কারণেই এমন মন্তব্য আমাদের শুনতে হয়, তাই শুধু নয়। অতিবুদ্ধি গবেষক—যাঁরা সাহেব-সুবো আর উর্বর প্রতিভার বিভিন্ন বক্তব্য সমযোজনা করে নিজস্ব বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারেন—তাঁদের মুখেও একই বক্তব্য শুনি আরেকভাবে। এই কুফল তখনই সম্ভব, যদি আমরা বিশালবুদ্ধি ব্যাসের ভাবব্যঞ্জনা ব্যাসের অনুকূলে না বুঝি। ভগবদ্‌গীতাকে তাঁরা মহাভারতের অন্তর্গত হৃদয় ভাবেন না এবং গবেষণা-বলাৎকারে যাঁরা এই একান্ত মহাভারতীয় অংশকে স্বয়ম্ভু মনে করেন তাঁরা অর্জুনকেও বুঝবেন না, কৃষ্ণকেও বুঝবেন না। আমি বলেছি—ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণের মতো মহারথ যোদ্ধাদের যুদ্ধে একান্তভাবে জয় করার যশ অর্জুন আত্মসাৎ করতে পারলেন না। এর কারণ কী? আমি বলব—এরও কারণ সেই ভগবদ্‌গীতাই। কৃষ্ণ বলেছিলেন—যে কাজটা করছি—তা বড় কাজই হোক অথবা ছোট—সে কাজটা আমি করেছি—এমন অভিমান যাঁর নেই, যাঁর বুদ্ধি কর্মের ফলে লিপ্ত হয় না, সে এই সমস্ত লোককে হত্যা করলেও, হত্যার পাপ তাঁর লাগে না—

যস্য নাহংকৃতো ভাবো বুদ্ধি র্যস্য ন লিপ্যতে।

হত্বাপি স ইমাঁল্লোকান্ন হন্তি ন নিবধ্যতে ॥

বস্তুত ভীষ্মকে যদি শিখন্ডীর মাধ্যম ছাড়াই অর্জুন রণভূমিতে শায়িত করতে পারতেন, ধৃষ্টদ্যুম্নের কথা ছেড়েই দিলাম, যদি ‘অশ্বত্থামা হত’ এর মতো মিথ্যাভাষণ না করেও যদি দ্রোণাচার্যকে অর্জুন মারতে পারতেন, অথবা কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে যাওয়ার মতো দুর্ভাগ্য যদি অর্জুনের সহায় না হত—তাহলে এই সমস্ত বীরযোদ্ধাদের রণভূমিতে লুষ্ঠিত করার অহঙ্কার এবং গৌরব অর্জুনের হৃদয়ের সত্যপথ রুদ্ধ করত এবং অবশ্যই কর্মফলে তাঁর লিপ্তি ঘটাত। অতএব সে সুযোগই অর্জুনের হল না। মহাভারতের কবি অর্জুনকে এমনভাবেই গীতার সঙ্গে মিশিয়ে তাঁর চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করলেন

যে, সে লোকটার বলবার মতো কোনও সুযোগই রইল না যে-ভীষ্মের মতো যোদ্ধাকে, দ্রোণের মতো অস্ত্রগুরুকে, কর্ণের মতো অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধাকে আমি, শুধু আমিই মেরেছি। ওদিকে আরও একবার গীতার শেষ পৃষ্ঠায় লক্ষ করুন—ভগবান রূপে চিহ্নিত কৃষ্ণ নামক ব্যক্তিটি সমস্ত দার্শনিকতার শেষ প্রস্তাবে বলছেন—তামার সমস্ত ধর্মাধর্ম অতিক্রম করে তুমি আমার শরণাগত হও, অর্জুন। আর সেই ধর্মতিক্রমে তোমার যদি কোনও পাপ হয়, তবে তার দায় আমার। দেখুন, এই যে চরম শরণাগতি—এর পথও স্বয়ং কৃষ্ণই করে দিয়েছেন। কৌরবপক্ষের একেকজন সেনাপতি মারা গেছেন এবং তার আগে কৃষ্ণ তাতে স্বেচ্ছায় বুদ্ধি জুগিয়েছেন; তাতে অন্যায় যা হয়েছে—তার দায় বহন করেছেন তিনি নিজে। অর্জুন বাসুদেব কৃষ্ণের শরণাগত, অতএব তাঁকে অহঙ্কার থেকে মুক্ত করার ভার যেমন তাঁর, অন্যায় থেকে মুক্ত করার ভারও তেমনি তাঁরই।

গীতার উপদেশের নিরিখে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে গীতার চরম ধর্ম শোনার পর তিনি বাসুদেবের শরণাগত হয়েছেন। আমি আগে যেমন বলেছি যে, গীতার ধর্ম শ্রবণ করার সবচেয়ে উপযুক্ত আধার ছিলেন অর্জুন, তেমনই এই গীতার চরম উপদেশ যে শরণাগতি, সে শরণাগতিও তাঁর পূর্বাহ্নেই ছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার ঠিক আগে যুধিষ্ঠির কৌরবপক্ষের বিশাল সৈন্য সমাবেশ এবং সেনাপতি ভীষ্মের সুচিন্তিত ব্যূহ-রচনা দেখে ভীষণ ভয় পেলেন—বিষাদম্ অগমদ্‌ রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ। তিনি অর্জুনকে ডেকে বললেন—হ্যাঁ গো ভাই, পিতামহ ভীষ্ম যাঁদের যোদ্ধা, আর যে অভেদ্য সেনাব্যুহ তিনি রচনা করেছেন—আমরা যুদ্ধ করব কী করে? অর্জুন বললেন—অতিপ্রাজ্ঞ, অতিবীর ব্যক্তিকেও তাঁর থেকে অল্পতর জ্ঞানী বা অল্পতর বীর যেভাবে জয় করেন—তার একটা সূত্র আছে। স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা এই কথাটা একসময় বলেছিলেন। বলেছিলেন—জয়লিঙ্গু ব্যক্তি শক্তি আর ক্ষমতার জোরে নিজের জয় যতখানি প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তার চেয়ে অনেক বেশি পারে নিজের সততা, অনৃশংসতা, ধর্ম এবং অবশ্যই উদ্যমের জোরে। কাজেই কোনটা ধর্ম এবং কোনটা অধর্ম—এটা জেনে, আমরা শুধু লোভের জন্যই এই যুদ্ধ আরম্ভ করছি কি না—এটা বুঝে এবং সর্বোপরি আমরা সাহঙ্কারে যুদ্ধ করছি কিনা—এটা উপলব্ধি করেই আমি বলতে পারি—যেখানে ধর্ম সেখানেই জয়। তা ছাড়া সমস্ত কল্যাণ-গুণ এবং ধর্মের আধার হলেন কৃষ্ণ—তিনি রয়েছেন আমাদের পক্ষে। সবচেয়ে বড় কথা—তিনিই যেখানে আপনার জয় চান, সেখানে কি জয় না হয়ে পারে—যস্য তে জয়মাশাস্তে বিশ্বভুক্‌ ত্রিদিবেশ্বরঃ।

লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই—অর্জুন সেই সত্যের পথ, সেই স্থিতবুদ্ধি, সেই কাম-লোভ-হীন কর্তব্য কর্ম বিষয়ে, সেই নিরহঙ্কার প্রয়াসের কথা বলছেন—যা পরে আরও বিস্তারিতভাবে দার্শনিকের যুক্তিতে কৃষ্ণের কাছে তাঁকে শুনতে হবে। আর যে চরম শরণাগতির কথা গীতার শেষে অর্জুনকে সম্পূর্ণ ভারমুক্ত করবে, সেই প্রপন্নতা অর্জুনের মধ্যে পূর্বাহ্নেই চিহ্নিত। এই শরণাগতি, এই প্রপন্নতা তাঁকে বৃহত্তর শক্তির কাছে দাসে পরিণত করেনি, অথবা তাঁকে বাসুদেব-কৃষ্ণের ছায়া হিসাবে উপস্থিত করেনি। বস্তুত অতি বৃহৎ মহাসত্ত্ব ব্যক্তির পক্ষে এই প্রপন্নতা অর্জুনের চরিত্রে নতুনতর দার্শনিক মাত্রা যুক্ত করে। যে ছোট, যে দুর্বল—শরণাগতি তার স্বাভাবিক ধর্ম। কিন্তু যিনি সমর্থ এবং একাধিকবার যার সামর্থ্য বিভিন্ন যুদ্ধে প্রমাণিত, প্রতিষ্ঠিত, তিনি যদি তাঁর সমস্ত সামর্থ্য, নৈপূণ্য, এবং শক্তি সত্ত্বেও অন্তিম এক চরম মুহূর্তে চরমতম শক্তির কাছে নিজেকে লঘু করতে পারেন—সেখানে তাঁর সামর্থ্যগৌরবের সঙ্গে বিনয়ের মাহাত্ম্য যুক্ত হয়। তাঁর নিপুণতা, তাঁর অস্ত্রশক্তি, তাঁর সামর্থ্য, এগুলি কবির ভাষায়—

এখন সে যে আমার বীণা, হতেছে তার বাঁধা

বাজবে যখন তোমার হবে তোমার সুরে সাধা—

সব দিতে হবে।

এই প্রপন্নতার কী ফল হয়েছে জানেন? কোনও অন্যায় অর্জুনের গায়ে লাগেনি। অনেকে বলেন এবং দুর্যোধনের মতো লোক তখনও বলেছেন—সব কৃষ্ণের ছুতো। কৃষ্ণের ছল আর কপটতার জন্যই পাণ্ডবরা যুদ্ধ জিতেছেন, নইলে তাঁদের সাধ্য ছিল না—ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, দুর্যোধনের মতো শক্তিকে পর্যুদস্ত করা। কৃষ্ণ কারও মুখ বন্ধ করেননি। এই কলঙ্ক, এই অপমান তিনি বহন করেছেন এবং একবার নয় বারবার সবার সামনে হেঁকে অর্জুনকে বলেছেন—তুমি ঋজুযুদ্ধের দ্বারা এই ভীষ্ম, এই দ্রোণ, এই কর্ণের মতো যোদ্ধাকে রণভূমিতে শায়িত করতে পারতে না, অর্জুন। আমি যুদ্ধ আমার শততা, আমার মায়া প্রয়োগ না করতাম—তা হলে আজ কোথায় তোমাদের জয়, কোথায় তমাদের রাজ্য, কোথায় কী? দেখুন, কী নিপুণ ভঙ্গিতে কৃষ্ণ অর্জুনের সমস্ত দায়, সমস্ত কলঙ্ক নিজের ঘাড়ে নিয়েছে। এ হল সেই চরম প্রতিজ্ঞার ফল—আমি তোমাকে তোমার সমস্ত পাপ থেকে মিক্ত করব—অতঃ ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ। না জানি অর্জুনের মনের তখন কী অবস্থা। বোধ করি, এই শেষের দিনটির জন্যই যুদ্ধারম্ভের প্রথম পর্বে দ্বারকায় গিয়ে কৃষ্ণের পায়ের কাছে বসেছিলেন অর্জুন—আমার জগতের সব তোমারেই দেব, দিয়ে তোমারে দেব—বাসনা।

আমি বোধহয় একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি ভারতযুদ্ধের পূর্বমুহূর্তে ভগবদ্‌গীতার দার্শনিক পরিবেশই আমাকে মুখর করে তুলেছিল। গীতা শোনার পর অর্জুন যুদ্ধ করতে গেছেন সম্পূর্ণ ভারমুক্ত হয়ে। বড় খেলোয়াড়ের যদি খেলা জেতানোর ‘টেনশন’ না থাকে তবেই সে তার স্বাভাবিক খেলা খেলে। পরীক্ষার্থীর মনে যদি ‘ফাস্ট হওয়ার ‘টেনশন’ না থাকে তবেই সে ভাল পরীক্ষা দেয়। অর্জুন সেই যুক্তিতে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। আমি আগেই বলেছি—অর্জুনের মতো অসামান্য একজন যোদ্ধা কত যুদ্ধ করলেন, কত নৈপুণ্য দেখালেন, কত সৈন্যশাতন করলেন—সে আলোচনায় আমি যাব না। কেন না সে যুদ্ধ এতই বিশাল, সে নৈপুণ্য এতই লোকাতীত, যার বর্ণনা আমার দীন ভাষায় করা সম্ভবপর নয়। বস্তুত ভীষ্ম এবং অর্জুনের যুদ্ধ, ভীস্ম এবং অর্জুনের মতোই হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের দশম দিনে ভীষ্ম যখন নিজেই নিজের মৃত্যুর উপায় বলে দিলেন, তখন যুদ্ধের কর্তৃত্ব অর্জুনের হাত থেকে শিখণ্ডীর হাতে চলে গেল। এরপর যত বাণই অর্জুন ছুঁড়ন, যত বীরত্বই তিনি দেখান, তাঁকে আর ভীষ্মবধের কারণ বলা গেল না। ভীষ্মের অলোকসামান্য প্রতিভা এবং অর্জুনের মতো শ্রেষ্ঠতম বীরের মধ্যে অন্তর ঘটিয়ে রাখল একজন ক্লাব—শিখণ্ডী।

পিতামহ হিসেবে ভীষ্ম বুঝেছিলেন—তাঁর মৃত্যুতে অর্জুনের গৌরব আহত হল, আহত হল নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বারেব অভিমান। তাই মৃত্যুশয্যায় শুয়েও বুড়ো ঠাকুরদাদা কত না উপায় বার করলেন—অর্জুনকে শ্রেষ্ঠতার সম্মান দেওয়ার জন্য। একবার বললেন-এই শরশয্যায় শুয়ে আমার মাথাটা ঝুলে যাচ্ছে—আমাকে উপযুক্ত বালিশ দাও। কৌরব, পাণ্ডবরা সবাই তখন তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন। ভীষ্মের কথা শুনেই কৌরবরা কত না সুন্দর মহামূল্য বালিশ নিয়ে এলেন, কী বলব! কিন্তু ভীষ্ম বললেন—এই কি রণভূমিতে শায়িত ক্ষত্রিয়বীরের উপাধান? ভীষ্ম এবার অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বললেন এই বারশয়নের উপযুক্ত একটি বালিশ হয়তো তুমিই দিতে পারো বৎস! চোখের জল মুছে, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম বুঝে বুদ্ধিমান অর্জুন অসাধারণ নিপুণতায় তিনখানি বাণ সংযুক্ত করে পিতামহ ভীষ্মের লম্বিত মস্তক শরীরের সমানপাতী করে রাখলেন। সানন্দে ভীষ্ম তাঁকে অভিবাদন জানালেন—এই না হলে সমস্ত যোদ্ধাদের মধ্যে কেমন করে শ্রেষ্ঠ হলে তুমি!

সেদিনের রাত কাটল। সকালবেলায় কৌরব, পাণ্ডব আর অন্যান্য রাজারা সবাই আবার ভিড় করে এলেন ভীষ্মের কাছে! শরপাতনের যন্ত্রণায় তিনি তখন হাঁপাচ্ছেন, কোনওরকমে বললেন—জল, জল দাও। রাজার সব মিষ্টমধুর খাবার আর জলের পাত্র নিয়ে এসে ভীষ্মকে জল খাওয়াতে চাইলেন। ভীষ্ম তাঁদের একটু লজ্জা দিয়েই বললেন—আমি কি মানুষের মতো সাধারণ অবস্থায় শুয়ে আছি। যাও সব, অর্জুনকে ডেকে দাও। পিতামহের প্রশংসা-গৌরবে আরও বিনীত অর্জুন এসে দাঁড়ালেন ভীষ্মের কাছে। ভীষ্ম বললেন—তোমার বাণের জ্বালায় আমার সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে—একটু জল দিয়ে এই জ্বালা জুড়োবার ব্যবস্থা করো। অর্জুন রথে উঠলেন, সমন্ত্রক-বাণে পৃথিবী ফুড়ে জলের অবিরাম ধারা এনে জুড়িয়ে দিলেন ভীষ্মের শরীর আর তৃষ্ণা। অর্জুনের কাণ্ড দেখে অন্তরের লজ্জায় কৌরবরা শীত-লাগা গরুর মতো কেঁপে উঠলেন—সম্প্ৰবেপন্ত কুরবা গাবঃ শীতাৰ্দিতা ইব। ভীষ্ম বললেন—আমি কিন্তু একটুও আশ্চর্য হচ্ছি না, অর্জুন। কারণ, ধনুর্ধরদের মধ্যে তুমিই সেই একতম বীর, যে এই অসম্ভব কাজ করতে পারে। তুমি যে শ্রেষ্ঠতম, তুমি যে একাই সমস্ত ক্ষত্রিয়কে উৎখাত করতে পারো—এ-কথা আমি বারংবার দুর্যোধনকে বলেছি। তাঁর মাথায় এই সত্য কথাটি ঢুকল না। ভীষ্ম বারবার অর্জুনের কথা তুলে দুর্যোধনকে আবারও শেষবারের মতো যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হতে বললেন, কিন্তু এই কথাগুলির মধ্যে দুর্যোধনের প্রতি তাঁর শুভেচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরঙ্গ প্রশংসার সান্ত্বনা ছিল অর্জুনের জন্য—যিনি ঈশ্বরেচ্ছায় ভীষ্মের দণ্ডদাতা হলেও, মৃত্যুর কতা নন।

দ্রোণাচার্যের সঙ্গে পাঁচদিন যুদ্ধ চলেছিল পাণ্ডবদের। এই পর্বে দ্রোণাচার্যের মৃত্যু যত বড় ঘটনা, তার চেয়েও বড় ঘটনা বোধ করি অভিমনুর মৃত্যু, অর্জুনের প্রিয়তম পুত্রের মৃত্যু। যেদিন অভিমন্যু মারা যান, সেদিন পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির তাঁর মুখের দিকে চেয়ে এই দারুণ সংবাদ দিতে পারেননি। প্রতিদিনের যুদ্ধ শেষ করে অর্জুন যখন ফিরে আসতেন, তখন তিনি রথ থেকে নামতে-না-নামতেই দ্রৌপদীর ছেলেদের সঙ্গে করে অভিমন্যু হাসি-মুখে অর্জুনকে একেবারে শিবিরের ভিতর পর্যন্ত নিয়ে যেতেন। এই ছিল অভিমন্যুর অভ্যাস। এ হেন ছেলেকে না দেখে এবং যেহেতু অর্জুন পূর্বেই দ্রোণাচার্যের চক্রব্যুহের কথা শুনেছেন—তিনি ভীষণ শঙ্কিত হলেন। ক্রমে ক্রমে সবই প্রকাশ পেল এবং অভিমন্যুর মৃত্যুতে অর্জুন যে আঘাত পেলেন—তার বর্ণনা ব্যাসের লেখনীতেই মানায়, আমার উদ্ধৃতি-পদ্ধতিতে সে শোকের একাংশও বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এই আকুল অবস্থার মধ্যে অবশ্যই যিনি তাঁর পাশে দাঁড়ালেন—তিনি কৃষ্ণ। ভগবদ্গীতার অমৃত কথার মতোই আরও কটি কথা কৃষ্ণের মুখ দিয়ে উৎসারিত হল এবং অবশ্যই দার্শনিকতার যুক্তিতেই মৃত্যুর মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা প্রশমিত করা ছাড়া কৃষ্ণের আর কিছু করার ছিল না। তবু পুত্রশোক শোক-তপ্ত পিতামাতার অন্তরে এমনই এক শূন্যতা সৃষ্টি করে—যে শূন্যতা প্রগাঢ় দার্শনিকতার দ্বারাও বিলুপ্ত করা যায় না। স্বভাবতই অর্জুন সেই ভয়ঙ্কর জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞা নিলেন, কেন না জয়দ্রথই সেই ব্যক্তি, যিনি অভিমনুর সাহায্যে এগিয়ে আসা অন্য পাণ্ডবদের চক্রব্যুহে ঢুকতে দেননি।

অর্জুন প্রতিজ্ঞা করলেন—পরের দিন সূর্যাস্তের আগেই তিনি জয়দ্রথকে মারবেন, নইলে নিজে আত্মহত্যা করবেন। জয়দ্রথ দুর্যোধনদের জামাই হওয়া সত্ত্বেও আচার্য দ্রোণ এবং সবার হাতে পায়ে ধরে বাঁচবার চেষ্টা করলেন। আচার্য দ্রোণও তাঁর অস্ত্র শিক্ষার সমস্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ব্যুহ-রচনার সার শকটব্যুহ তৈরি করলেন এবং জয়দ্রথকে প্রায় ধামাচাপা দেবার মতো করে লুকিয়ে রাখলেন। আচার্য স্বয়ং রক্ষা করছিলেন সেই ব্যুহের দ্বার। স্বাভাবিকভাবে আচার্য দ্রোণের সঙ্গেই অর্জুনের যুদ্ধ আরম্ভ হল। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি পেরে উঠছিলেন না বটে, কিন্তু তিনি ছাড়ছিলেনও না। অর্জুনের হাতে সময় ছিল না—অনেক যুদ্ধ করে, অনেক পথ পেরিয়ে শকটব্যুহের সেই জায়গায় পৌঁছতে হবে—যেখানে জয়দ্রথ আছেন। অর্জুন কিন্তু আচার্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বেশ মত্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে কৃষ্ণ বললেন তাড়াতাড়ি, বন্ধু। তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যার আগে আমাদের জয়দ্রথকে মারতে হবে। তখন কৃষ্ণের বুদ্ধিতে অর্জুন আচার্যকে প্রদক্ষিণ করে বললেন—আপনি আমার গুরু, পিতা। আপনার কাছে হারলেই বা লজ্জা কী? এইভাবে আচার্যকে তিনি এড়িয়ে এলেন বটে, কিন্তু শকটব্যুহের আরও সব অসাধারণ রক্ষী দুঃশাসন, দুর্যোধন, অশ্বথামা, কৃতবর্মা, কর্ণ—এঁরা তো আর কেউ ছেড়ে দেবার লোক নন। অতএব যুদ্ধ হতে থাকল ভয়ঙ্কর, সময়ও যেতে থাকল বিস্তর।

সবচেয়ে মুশকিলে পড়লেন কৃষ্ণ। অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছেন—জয়দ্রথকে সন্ধ্যার আগে মারবেন, নইলে নিজে মরবেন। ক্রোধোদ্দীপ্ত অবস্থায় প্রতিজ্ঞার পিছনে কারণ থাকলেও অহংবোধও থাকে। মহাভারতের সমস্ত পর্বে কৃষ্ণ চেয়েছেন—অর্জুন যুদ্ধ করুন, কিন্তু শান্ত নিরহঙ্কার ভঙ্গিতে করুন। অথচ এইখানে পুত্রশোকের মতো গভীর দুঃখ অর্জুনকে বিচলিত করে দিয়েছে, তাঁর মনে সামান্যতম হলেও সেই অনীপ্সিত কর্তৃত্বের বোধ এনে দিয়েছে, যা কৃষ্ণ মনে মনে চান না। এক্ষেত্রে আবারও তাঁকে সেই মায়া সৃষ্টি করতে হল। দিবসের শেষ সূর্য তখনও আলো ছড়িয়ে চলেছে, এরই মধ্যে কৃষ্ণের বুদ্ধিযোগে ঘনিয়ে এল আকালিক অন্ধকার। জয়দ্রথ সানন্দে ভাবলেন তিনি বেঁচে গেছেন এবং অর্জুনকেও আত্মহত্যা করতে হবে। তিনি তাঁর লুকোনো জায়গা থেকে মুখটি বার করে সূর্যের সঞ্চার দেখছিলেন, অন্যান্য সৈনিকেরাও তাই। কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন-জয়দ্রথ মুখ বার করেছে—সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল দেখে তুমি যেন সংকোচ কোরো না, ও আমারই বুদ্ধি। তুমি মারো জয়দ্রথকে। কিন্তু ‘মারো’ বললেই কি আর মারা যায়। দুর্যোধন, কৃপ, কর্ণ—সবাই তো লড়ছেন। এই অবস্থায় অর্জুনের অস্ত্রচালনা ছিল ঈর্ষণীয়। কী অসাধারণ দক্ষতায় এই মহারথ যোদ্ধাদের কাবু করে তিনি জয়দ্রথকে মারলেন-তা বলে বোঝানো যাবে না। তবু এই সামান্য একটা ‘তবু’ রয়ে গেল। অন্য সবার ক্ষেত্রে অর্জুন অসামান্য অস্ত্রকৌশল দেখানোর সুযোগ পেলেন বটে, জয়দ্রথকে তিনি অসাধারণ নিপুণতায় হত্যা করলেন বটে, তবু তাঁর প্রতিজ্ঞা-রক্ষার ব্যাপারে কর্তৃত্ব রয়ে গেল কৃষ্ণেরই হাতে। তিনি যে বলেছিলেন—তুমি নিরহঙ্কার হয়ে যুদ্ধ করবে, যুদ্ধের ফলে অনাসক্ত হয়ে যুদ্ধ করবে। তাই যে মুহূর্তে—তা সে পুত্রশোকের মতো গভীর দুঃখ থেকেই তোক অথবা অন্য কোনও কিছু—অর্জুনের মধ্যে অহঙ্কার দেখা গেছে, আসক্তি দেখা গেছে, তখনই কৃষ্ণ ঘটনার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন নিজের হাতে। তিনি যে বন্ধুকে কথা দিয়েছিলেন তুমি—আমার শরণ নাও, সমস্ত পাপের দায় আমার।

আচার্য দ্রোণের হন্তা হিসেবে দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন আগে থেকেই চিহ্নিত ছিলেন। তবু দ্রোণাচার্যের সেনাপতিত্বের সময় বহুবার অর্জুন তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন এবং প্রায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জয়ী হয়েছেন অর্জুন। এই প্রিয়তম শিষ্যটির ব্যাপারে আচার্যেরও এমন এক শ্রদ্ধামিশ্রিত প্রশ্রয় ছিল যে, তিনি বোধ হয় জয়ী হতে চাননি। এই সমস্ত যুদ্ধেই অর্জুন তাঁর অস্ত্র-শিক্ষা শিল্পের স্তরে নিয়ে গেছেন। আচার্যও একাধিকবার অর্জুনকে হাতে পেয়েও কিছু করতে পারেননি। যুদ্ধ যত করেছেন, প্রিয়শিষ্যের নিপুণতায় মুদ্ধ হয়েছেন তার থেকে বেশি। এর জন্য দুর্যোধনের কাছে তাঁকে কথাও শুনতে হয়েছে যথেষ্ট। অর্জুনের ব্যাপারে তাঁর মুগ্ধতা, তাঁর স্নেহ এবং সর্বোপরি তাঁর বিশ্বাস এতটাই ছিল যে, দুর্যোধন বারবার সেটাকে পক্ষপাত বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এই জয়দ্ৰথবধের পরেও দুর্যোধন তাঁকে বলেছেন—আপনি আমার পক্ষে যুদ্ধ করলেও আপনি যে পাণ্ডবদেরই ভাল চান—সেটা আমি জানি। অর্জুন আপনার শিষ্য বলেই তাকে আপনি ছেড়ে দেন। আচার্য দ্রোণকে এতই অপমানসূচক কথা বলেছেন দুর্যোধন যে, তিনি শেষ পর্যন্ত কৌরবদের সারা জীবনের অন্যায়গুলি একের পর এক উচ্চারণ করে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন এবং শেষে সিদ্ধান্ত করেছেন—তুমি কে হে দুর্যোধন, অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেব-দানব কারও পার পাবার উপায় নেই। দ্রোণাচার্য বৃদ্ধও হয়ে গিয়েছিলেন, অস্ত্রপাতনের ক্ষিপ্রতাও তাঁর কমে গিয়েছিল, কিন্তু অর্জুনের সঙ্গে তিনি যে কোনওভাবেই এঁটে উঠতে পারলেন না—এটা যতখানি আশ্চর্যের, ততখানি আনন্দের। অর্জুনের দিক থেকেও ব্যাপারটা লক্ষণীয়।

আচার্য দ্রোণকে মারার ব্যাপারে অর্জুন সোজাসুজি দায়ী ছিলেন না এবং এটা তাঁর সৌভাগ্য! কিন্তু যেভাবে দ্রোণকে মারা হল—তাতে অর্জুনের সায় ছিল না মোটেই। আচার্যের সাংঘাতিক ক্ষমতা এবং তাঁর হাতে যে পরিমাণ সৈন্যক্ষয় হচ্ছিল—তার বহর দেখে কৃষ্ণ অর্জুনের কাছেই প্রথম প্রস্তাব করলেন যে, এই বৃদ্ধের কাছে তাঁর প্রিয় পুত্রের মৃত্যুর মিথ্যা খবর দেওয়া দরকার, নইলে দ্রোণাচার্য অস্ত্র-ত্যাগ করবেন না এবং অস্ত্র-ত্যাগ না করলে তাঁকে বধ করা যাবে না। কৃষ্ণের এই প্রস্তাব অর্জুন একটুও অনুমোদন করেননি—এতন্নারোচয়দ্‌ রাজন্‌ কুন্তী পুত্রো ধনঞ্জয়ঃ। কিন্তু সবাই মত করলেন এবং সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরকেও এ-কথা বলতে হল যে, অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ। সংবাদ শুনে আচার্য অস্ত্র-ত্যাগ করলেন এবং ধ্যানযোগে জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ পরমেশ্বরকে হৃদয়ে অবধারণ করলেন। দ্রুপদের ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্ন পিতার অপমানের শোধ নেবার জন্য খঙ্গ নিয়ে লাফিয়ে নামলে রথ থেকে—দ্রোণের গলা কেটে ফেলতে চান তিনি।

অর্জুন দেখছেন—ধৃষ্টদ্যুম্ন এগোচ্ছেন। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে অর্জুন বললেন—না, ধৃষ্টদ্যুম্ন! না, আচার্যকে এইভাবে মেরো না, ওঁকে তুমি জীবন্ত ধরে নিয়ে এসো—জীবন্তমানয়াচার্যং মা বধীঃ দ্রুপদাত্মজ। অর্জুন বারবার চেঁচাতে থাকলে, অর্জুনের চিৎকার শুনে সৈনিকেরাও ‘না-না’ করতে থাকল। ধৃষ্টদ্যুম্ন কারও কথাই শুনলেন না। খঙ্গের এক কোপে দ্রোণাচার্যের মাথা কেটে ছুঁড়ে দিলেন কৌরবদের সামনে। অর্জুনের ভীষণ, ভীষণ খারাপ লাগল। তাঁর বোধ হয় সেদিনটির কথা মনে পড়ছিল—যেদিন দ্রুপদকে জ্যান্ত বেঁধে আনতে বলেছিলেন দ্রোণাচার্য। ধৃষ্টদ্যুম্ন তখন জন্মাননি। কেউ নয়, এই অর্জুনই সেদিনকার যুদ্ধে দ্রুপদের রথ, অশ্ব এবং সারথিকে জখম করে দ্রুপদকে জীবন্ত বেঁধে এনেছিলেন। কিন্তু কই দ্রোণও তো তার বেশি চাননি। চরম অপমানিত হয়েও আচার্য নিজে তাঁর গায়ে হাত তোলেননি, তাঁকে মেরে ফেলতেও বলেননি। প্রতি-অপমানে এইটুকু সম্মান তো তিনি আশা করতেই পারতেন। হয়তো সে দৃশ্যটাই অবচেতন থেকে অর্জুনকে দ্রোণের মতোই বলাচ্ছিল—ওঁকে তুমি জীবন্ত ধরে নিয়ে এসো—জীবন্ত আনায়াচার্যম্। ধৃষ্টদ্যুম্ন কথা শোনেননি। কিন্তু এই আচরণ! সবার সামনে, শিষ্যদের সামনে পঁচাশি বছরের বয়স্ক গুরুর চুল ধরে মাথা কেটে ফেলা—অর্জুন কিছুতেই মানতে পারেননি। রাগে, দুঃখে তিনি এবার সেই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে অতিক্রম করে কথা বললেন, যা তিনি জীবনে করেননি।

অর্জুন বললেন, আপনি রাজ্যলাভের আশায় গুরুর সঙ্গে মিথ্যা আচরণ করলেন। ভদ্র-সজ্জনের ধর্ম আপনি জেনেও এমন অধর্মের কাজ করলেন। জানেন তো রামচন্দ্র অন্যায়ভাবে বালিকে মেরে যে অখ্যাতি চিরকাল বহন করেছেন, দ্রোণবধের জন্য সেই অখ্যাতি আপনিও বহন করবেন চিরকাল। অর্জুনের কথা মিথ্যা হয়নি। এই এক অকীর্তি যুধিষ্ঠিরকে, সত্যবাদী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে আজও কালিমালিপ্ত করে। অর্জুনের কথা শুনে ভীম আর ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে প্রায় উপহাসই করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রশ্রয় পেতেন না, যদি ভীম কনিষ্ঠ ভাইকে উপহাসের ভাষায় কথা না বলতেন। ভীম বলেছিলেন—আহা, আহা এমন সব ধর্মকথা বলছো না ভাই, যেন বনের মধ্যে মুনি উপদেশ দিচ্ছেন—মুনির্যথারণ্যগতো ভাষতে ধর্ম-সংজ্ঞিতম্‌। ক্ষত্রিয়ের সমস্ত গুণ তোমার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তুমি যে কেমন করে এমন বোকার মতো কথা বলছ? তুমি এত ধর্মের কথা বলছ—তা, ওই পাশা-খেলা, দ্রৌপদীর অপমান, বনবাস—এগুলো কোন ধর্মে হয়েছে?

ভীম আরও অনেক বকলেন অর্জুনকে। ফলে ধৃষ্টদ্যুম্নও আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ পেলেন। তবুও আচার্য দ্রোণের এমন মৃত্যুতে অর্জুনের ধিক্কার গেল না। তিনি ‘ছি-ছি’ করতেই থাকলেন। যুধিষ্ঠিরের মানসিকতা সম্বন্ধেও তাঁর গ্লানি কমল না। বস্তুত দ্রোণের সামনে মিথ্যা-উচ্চারণের ব্যাপারে যুধিষ্ঠির কিংবা ভীমের, এমনকী তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারে ধৃষ্টদ্যুম্নেরও যে খুব দোষ ছিল, তা নয়। কারণ প্রস্তাব এসেছিল কৃষ্ণের কাছ থেকে, যুধিষ্ঠিরকে প্রায় জোর করেই অশ্বত্থামার মিথ্যা মৃত্যুর কথা বলতে বাধ্য করা হয়েছিল আর ধৃষ্টদ্যুম্ন জন্ম থেকেই দ্রোণের মৃত্যুর জন্য চিহ্নিত, দ্রোণও সে-কথা জানতেন। কিন্তু প্রাণপ্রিয় আচার্যের মৃত্যুতে অর্জুনের অন্তরে সেই সদাজাগ্রত শিষ্যটি এমনভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে, দাদা যুধিষ্ঠিরকেও তিনি লঙঘন করেছিলেন।

যুধিষ্ঠিরকে তিনি আরও একবার ভীষণভাবে লঙঘন করেছিলেন। বস্তুত বিস্তীর্ণ রণক্ষেত্রের মধ্যে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ছিলেন এতই বেমানান যে, মাঝে মাঝেই তিনি কেমন হতচকিত হয়ে যেতেন। কর্ণের সেনাপতিত্ব যখন চলছে, তখন যে তিনি সবচেয়ে বেশি লড়াই করবেন তাতে সন্দেহ কী। ঠিক এমনই এক দিনে যুধিষ্ঠির-মহারাজ কর্ণের বাণে খুব মার খেলেন। কর্ণ কিছুতেই আর তাঁকে ছাড়েন না, মেরেই যাচ্ছেন, মেরেই যাচ্ছেন। যুধিষ্ঠির একেবারে ল্যাজেগোবরে হয়ে গেলেন। স্বয়ং অর্জুন অশ্বত্থামার সঙ্গে প্রবল যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, ভীমও ব্যস্ত ছিলেন কৌরব সৈন্য-ধ্বংসে। সময় বুঝে কর্ণ যুধিষ্ঠিরকে একেবারে বাণে বাণে উত্যক্ত করে তুললেন এবং যতক্ষণ কর্ণ অন্যত্র না সরলেন, ততক্ষণে তাঁকে ওই বাণের আঘাত সহ্য করতে হল। কর্ণ চলে যেতেই যুধিষ্ঠির একেবারে শিবিরে চলে গেলেন।

এদিকে যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখতে না পেয়ে অর্জুন ছুটতে ছুটতে এলেন ভীমের কাছে এবং সেখানেই তিনি খবর পেলেন যুধিষ্ঠির প্রায় পালিয়েই চলে গেছেন শিবিরে। অর্জুন আবারও ছুটতে ছুটতে শিবিরে এলেন এবং যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি অর্জুনকে ভীষণ কটু কথা বলতে আরম্ভ করলেন। প্রথমে তো দুই-ছেলের বয়স্কা মা যেমন এক ছেলের সামনে অন্যতরের প্রশংসা করে নিজের ‘পোজিশন’ বাড়াতে চান, তেমনই যুধিষ্ঠিরও অর্জুনকে বললেন—ওই এক ভীমের ভরসাতেই আমি যা বেঁচে আছি, নইলে, এতদিনে যা হত..ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর যুধিষ্ঠির কর্ণের অভূতপূর্ব শক্তির প্রশংসা করলেন এবং বললেন তুমি কি আজও সে ব্যক্তিটিকে মারতে পেরেছ-যা তুমি এতকাল বলে এসেছ? অর্জুন প্রথমে নিজের দোষ-ক্ষালন করার চেষ্টা করলেন। তিনি কতটা ব্যস্ত ছিলেন, কত সাংঘাতিক যুদ্ধ হয়েছে অশ্বত্থামার সঙ্গে—সব বলে বোঝাতে চাইলেন অর্জুন। কিন্তু যুধিষ্ঠির সেদিন এতই মার খেয়েছেন কর্ণের হাতে যে, তিনি অর্জুনকে গালাগালি করতে আরম্ভ করলেন। গালাগালি এতটাই করলেন, যা যুধিষ্ঠিরকে মানায় না। তিনি এতই রেগে গেলেন যে, অর্জুন কর্ণের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন—এমন কথাও বলতে ছাড়লেন না। একেবারে শেষে বললেন—ওইরকম বিরাট একটা খঙ্গ কোমরে দুলিয়ে, গাণ্ডীবের মতো একটা ধনুক হাতে নিয়ে, কৃষ্ণের মতো একটা লোককে সারথি বানিয়ে বাবু—যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

আসলে যে দাদাকে অর্জুন দেবতার মতো শ্রদ্ধা করেন, যাঁর জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে যুদ্ধ ছেড়ে শিবিরে এসেছেন তিনি—সেই দাদার মুখে অনেকক্ষণ অকথা এবং অপযশ শুনে অর্জুন মনে মনে একেবারে ক্ষেপেই ছিলেন, শেষে তাঁর সাধের গাণ্ডীব-ধনুকের অপমান শুনে তিনি এমনই বেগে গেলেন যে, তিনি যুধিষ্ঠিরকে মারতেই গেলেন। অর্জুনের প্রতিজ্ঞা ছিল—যে ব্যক্তি তাঁর গাণ্ডীবকে অপমান করবে, তাঁকে তিনি মেরেই ফেলবেন। অর্জুন তাই খড়্গ হাতে নিলেন। আসলে আমার মনে হয় গাণ্ডীবের থেকেও বড় কথা—যুধিষ্ঠির ভাইকে এত অপমান করেছেন এবং তাও এমন এক ভাইকে, যে যুধিষ্ঠিরের কাছে সদা-বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছে, যে তাঁর আপাত অন্যায়গুলিও সব সময় সমর্থন করেছে—সেই দাদা যুধিষ্ঠির যখন তাঁর যোগ্যতায়, তাঁর ইচ্ছায়, শুভকামনায় অবিশ্বাস করলেন—সেটা অর্জুন সইতে পারলেন না। তিনি গাণ্ডীবের অপমানকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে মারতে উদ্যত হলেন। মহামতি কৃষ্ণের হস্তক্ষেপে ব্যাপারটা মিটে যায় বটে, তবে এই ঘটনা নিয়ে পণ্ডিতমহলে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। প্রয়াত বিমলকৃষ্ণ মতিলাল এ বিষয়ে অসাধারণ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন তাঁর ‘নীতি যুক্তি এবং ধর্ম নামক গ্রন্থে। কাজেই এ বিষয়ে আমার আর কথা। বলা মানায় না। আমরা কর্ণবধের প্রসঙ্গে আসি।

কর্ণই বোধ হয় একমাত্র ব্যক্তি, যাঁকে অর্জুন তাঁর সমকালীন সময়ে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করতেন। কুরুসভায় দ্রৌপদীর সঙ্গে কর্ণ যে অসভ্য আচরণ করেছিলেন, তার নিরিখে অর্জুন। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—আমি কর্ণকে মারব। আমার মনে হয়—দ্রৌপদীর অপমানে যে ক্ষোভ অর্জুনের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, তার অনেকটাই মিশে গিয়েছিল সেই চরম ক্ষোভের সঙ্গে, যেদিন কিশোর অর্জুনকে আত্মীয়বন্ধুর সামনে কর্ণের প্রতিস্পর্ধিতায় থমকে দাঁড়াতে হয়েছিল। উন্মুক্ত রঙ্গস্থলে অর্জুন যখন তাঁর অস্ত্রবিদ্যার সার শিল্পগুলি দেখাচ্ছিলেন, তখনই কর্ণের আগমন এবং প্রতিস্পধিতা তাঁকে চরম লজ্জার মধ্যে ফেলে দেয়। এই অপমান তিনি জীবনে ভোলেননি এবং এর জন্য নিজেকে তিনি এমনভাবেই শিক্ষিত করেছিলেন, যাতে কোনওভাবেই কর্ণ তাঁকে প্রতিহত করতে না পারেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে বেশ কয়েকবার তিনি কর্ণকে পর্যুদস্ত করেছেন, কিন্তু এই যুদ্ধ ছিল শেষ জায়গা, যেখানে তিনি তাঁর চরম অস্ত্র-শিক্ষার শেষ শিল্পটি দেখাতে পারতেন।

কিন্তু মহাভারতের কবি এতই নিষ্করুণ যে তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে অর্জুনের অসাধারণ অস্ত্রনৈপুণ্যই শে কথা ছিল না। তিনি একদিকে কর্ণচরিত্রের গঠন করেছেন ভাগ্যের বঞ্চনা দিয়ে এবং অর্জুনকে তিনি শুধুই অস্ত্রশিক্ষার নিপুণতায় বড় করে দেখাতে চান না। রসসৃষ্টির চরম সম্ভাবনায় যে শিশুটিকে তিনি মায়ের কোল থেকে নামিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, সে দিন থেকে দুর্ভাগ্য আর বঞ্চনাই তাঁর জীবন নিয়ন্ত্রিত করেছে। অস্ত্রবিদ্যায় একান্ত কুশলী হওয়া সত্ত্বেও মহাভারতের কবি তাঁর হাতে সৌভাগ্যের শেষ-অস্ত্র তুলে দেননি। সমস্ত জীবন ধরে দুর্যোধনের সান্নিধ্যে তাঁকে ঐহিক সুখ। দিয়েছে, কিন্তু বীর ক্ষত্রিয়ের এন্তি সহচর ভাগ্যটি দেননি। অন্যদিকে অপরজনকে ঐহিক সুখের বঞ্চনা দিয়েছেন, বনবাসে আর কঠিন সাধনায় তাঁর জীবন কেটেছে, কিন্তু এই জাগতিক পরিমাপের থেকেও তাঁর ব্যক্তি-পরিমাণ বৃদ্ধি করার জন্য মহাভারতের কবি তাঁকে দিয়েছেন দার্শনিক নিরহঙ্কার। সেই নিরহঙ্কার সুস্থিত করার জন্য একদিকে কৃষ্ণের মতো সুমতিকে অর্জুনের চালক তথা সারথি করে রাখা হয়েছে, অন্যদিকে কর্ণকে দেওয়া হয়েছে দুর্ভাগ্য—যাতে একজন ঋজু-জয়ের আনন্দ অনাবিলভাবে ভোগ করে অহঙ্কত না হন, আর অন্যজনও যেন জীবনের শেষ যুদ্ধে পুরোপুরি হেরে না যান, যেন তিনি বলতে পারেন—আমিই অর্জুনকে মারতাম, কিন্তু কী করব, দুর্ভাগ্য আমার রথের চাকা মাটিতে বসে গেল।

যুধিষ্ঠির আর অর্জুনের একটা খটাখটি হয়ে যাবার পরেই কিন্তু কর্ণবধের জন্য অর্জুনের গতি ত্বরান্বিত হয়। কর্ণ জীবনে পাণ্ডবদের প্রতি যা যা অন্যায় করেছেন—সেগুলি একের পর এক বলে বলে কৃষ্ণও অর্জুনের তেজ আরও উদ্দীপ্ত করেছেন। এক সময় অর্জুন সাহঙ্কারে বলেও ফেলেছেন—তুমি আমার সহায় আছ, আমি কার পরোয়া করি। কিন্তু আস্তে আস্তে কথায় কথায় ক্ষত্রিয়ের দপাবেশে আরও বলেছেন—আমার সমান ধনুর্ধর আর কে আছে এই জগতে, বীরত্বেই বা কে আছে আমার সমান—ধনুর্বেদে মৎসমো নাস্তি লোকে/পরাক্রমে বা মম কো’স্তি তুল্যঃ। কৃষ্ণ আপাতত অর্জুনের এই সব কথায় প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। এমনকী যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণের রথের চাকা যখন মাটিতে বসে গেছে এবং কর্ণ যখন বারবার ক্ষত্রিয়ের ধর্ম স্মরণ করিয়ে দিয়ে অর্জুনকে বাণ মারা থেকে নিবৃত্ত করতে চাইছিলেন, তখন কৃষ্ণই তাঁর পূর্বের দুষ্কর্মগুলি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন—সেই সব মুহূর্তে তোমার ধর্ম কোথায় গিয়েছিল, কর্ণ? অর্জুনকে বলেছেন—মারো অর্জুন! এই উপযুক্ত সময়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সতেরো দিনের মাথায় কর্ণ অর্জুনের হাতে মারা পড়লেন কিন্তু ভূমি তার রথচক্র গ্রাস করেছিল—এই অবস্থায় অর্জুন যে তাঁকে মারলেন—এই অপ্রতিদ্বন্দ্বিতার ভূমিকাটি অর্জুনের রয়েই গেল। অর্থাৎ মহাভারতের কবি তাঁকে সেই সমান প্রতিস্পর্ধিতার গৌরব দিলেন না, যাতে তাঁর শত্রুদ্বেষ, ইচ্ছা-অভিলাষ, প্রয়োজনীয় সন্তুষ্টির মাত্রা অতিক্রম না করে, রণলব্ধ বিজয় তাঁকে যেন আত্মশ্লাঘার দিকে প্রেরিত না করে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণবধের সঙ্গে সঙ্গেই কৌরবদের সমস্ত জয়াশা ফুরিয়ে যায়। অপিচ কর্ণের মতো মহাবীর অর্জুনের হাতে মৃত্যুবরণ করার পর অর্জুন আরও কাকে কাকে মেরেছিলেন, যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞে তিনি কতটা কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন—এই সব কথা প্রায় অবান্তর হয়ে দাঁড়ায়। প্রবন্ধ-লাঘবের খাতিরে আমি সেই সব অনুপুঙ্খ আলোচনার মধ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু একটি কথা না বললেই নয়। দ্রৌপদীর সমস্ত সন্তানগুলিকে হত্যা করার পর অশ্বত্থামা যখন পাণ্ডবদের রোষাগ্নিতে পড়লেন—তখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য তিনি জগদ-ধ্বংসী ব্রহ্মশির অস্ত্র ত্যাগ করেছিলেন। অর্জুনও সেই অস্ত্র প্রতিহত করার জন্য নিজের ব্রহ্মশির অস্ত্র ত্যাগ করলেন। এবার নারদ এবং ব্যাস—দুই পুরাণ মুনি এসে দাঁড়ালেন সেই দুই ভয়ঙ্কর অস্ত্রের মাঝখানে। মনুষ্যলোকের হিতবুদ্ধিতে তাঁরা দুই মহাবীরকেই বললেন—অস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অস্ত্র প্রত্যাহার করে নিলেন। কিন্তু অশ্বত্থামা অস্ত্র হানাটাই জানেন, কিন্তু প্রত্যাহারের কৌশল জানেন না। তাঁর অস্ত্র শেষ পর্যন্ত কুরুপাণ্ডবের একমাত্র সন্তানবীজ অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরার গর্ভস্থ পুত্রকে ধ্বংস করতে উদ্যত হল। কৃষ্ণের ক্ষমতায় পরক্ষিত রক্ষা পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু অশ্বত্থামা যখন কিছুতেই তাঁর অস্ত্র প্রত্যাহার করতে পারছেন না—তখন মহামুনি ব্যাস তাঁকে একটি অসাধারণ কথা বলেছিলেন।

ব্যাস বলেছিলেন—পার্থ অর্জুন যে ব্রহ্মশির অস্ত্র তাগ করেছেন — সে কিন্তু কোনও রাগ থেকে নয়, কিংবা তোমার বধের জন্যও নয়—উৎসৃষ্টবান্ ন রোষেণ ন নাশায় তবাহবে। শুধু তোমার অস্ত্র যাতে প্রতিহত হয়—সেইটাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। বস্তুত আমরা যখন অর্জুনকে অস্ত্র ত্যাগ করতে দেখি, তখন তিনি নিজের, অশ্বত্থামার এবং আপন ভাইদের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সেই কথা উচ্চারণ করেছেন। অতিশয় বিপন্ন অবস্থাতেও লোকহিতের জন্য অর্জুনের এই যে সহানুভূতি, এই যে ধৈর্য, এই যে সংযম—এগুলির কথা আমি পূর্বে বলেছি। কিন্তু আবারও বললাম এই জন্য যে, সবার জন্য যার চিন্তা থাকে, তাঁর কাছ থেকে সংসারের অতি কাছের মানুষগুলির প্রত্যাশাপূরণ হয় না। অর্জুনের জীবনে প্রতিটি কাজের মধ্যে যে ‘ব্যালান্স’ বা সৌম্যবোধ ছিল, তাতে সংসার-জীবনের সবাইকে তিনি খুশি করতে পারেননি। পুত্রশোকের যে তাড়নায় দ্রৌপদী অশ্বত্থামার জীবন চেয়েছিলেন ভীমের কাছে, অথবা ভীমও যে ক্রোধের তাড়নায় অশ্বত্থামার দিকে ধেয়ে গিয়েছিলেন, এমনকী অশ্বত্থামাও যে ক্রোধে পাণ্ডব-বধের জন্য ব্রহ্মশির ত্যাগ করেছিলেন, সেই তাড়নায় অর্জুন অস্ত্রমোক্ষণ করেননি। ক্ষুব্ধ পরিস্থিতি মাত্রেই তিনি বিচলিত হন না বলে দ্রৌপদীও তাঁকে অশ্বত্থামা-বধের অনুরোধ করেননি। পূর্বে দেখেছি বিরাটনগরে কীচক-বধের জন্যও তিনি ভীমকেই অনুরোধ করেছেন, অর্জুনকে নয়। তিনি জানতেন পূর্বাপর চিন্তাপরায়ণ অর্জুনকে বললে ক্রোধের সদ্যফল নাও মিলতে পারে। ফলত অর্জুনকে তিনি যতই ভালবাসুন, তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পারেননি দ্রৌপদী।

আবার যুধিষ্ঠিরকে দেখুন—কর্ণপর্বে কর্ণের কাছে নাকানিচোবানি খেয়ে তিনি অর্জুনকেই দুষেছেন। যুদ্ধেও স্থির থাকেন বলে যাঁর নামই যুধিষ্ঠির, তিনি সকলের সামনে কর্ণের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে কী অপ্রীতিকর ভাষায়ই না অর্জুনকে দোষী করেছেন। যুদ্ধে স্থির হয়েও যুদ্ধের ফল তিনি কত তাড়াতাড়িই না চেয়েছেন অর্জুনের কাছে! জানি—যুদ্ধ জিনিসটাই যুধিষ্ঠির পছন্দ করেন না এবং সেই কারণেই হয়তো যুদ্ধ যাতে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়—তাই তাঁর ঈপ্সিত ছিল। কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণের মতো বীর যোদ্ধাকে কি তিনি চিনতেন না? তা ছাড়া যুদ্ধোদ্যমেরও একটা পর্যায় আছে। কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ লাগল, আর তাকে মেরে দিলাম—এ তো হয় না। মহাকাব্যের নিরিখে প্রতিনায়কের কৃতিত্বও তাতে খাটো হয়। তার ওপরে অসাধারণ দিব্য-অস্ত্রগুলির প্রয়োগ অর্জুনের মোটেই পছন্দ নয়। সেখানে যদি অর্জুনকে বলা যায়—কই! কর্ণকে মারবে বলে এত বড় বড় কথা তো বলেছিল, কোথায় গেল তোমার সেই প্রতিজ্ঞা। কোথায় তোমার নিপুণতা? তুমি বরং তোমার গাণ্ডীবখানা কৃষ্ণের কাঁধে ঝুলিয়ে দাও, আর তুমি হও তাঁর সারথি—এমন কথায় কার না রাগ হয়?

তাই বলেছিলাম—অর্জুনের কাছে চাওয়া হয়েছে বড় বেশি। দ্রৌপদী তার কাছে একপত্নীব্রত পুরুষের প্রেম চেয়েছেন, যুধিষ্ঠির তাঁর কাছে সদা নম্রতা এবং সমরশীঘ্রতা চেয়েছেন, ভীম তাঁর কাছে। চেয়েছেন প্রতি পদে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, জননী কুন্তী অর্জুনের কাছে চেয়েছেন সন্তান ধারণের সার্থকতা, আর সর্বোপরি কৃষ্ণ তাঁর কাছে চান প্রত্যেক কর্মে সকর্মক, অথচ নির্লিপ্ত ভূমিকা। তাঁর কাছে জায়া, জননী, ভাই এবং সখার মতো পরস্পরবিরোধী চরিত্রের এই যে প্রত্যাশা—সেই প্রত্যাশাপূরণ কোনও একটি ব্যক্তি-পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তিনি অর্জুন হলেও, নয়। তা ছাড়া সমতা বা সমদৃষ্টি এমনই এক দার্শনিক পদার্থ, যা সংসারের বাইরের মানুষের বোধ যতটা তৃপ্ত করে, ঘরের মানুষের মন ততটা নয়। ফলত যুধিষ্ঠির, ভীম, কৃষ্ণা, কুন্তী—সবাইকে তৃপ্ত করতে গিয়ে, তিনি কাউকেই পুরোপুরি তৃপ্ত করতে পারেননি; অথচ সবাই ভেবেছে—আসলে তাঁর শক্তি, নিপুণতা এবং সহৃদয়তার নিরিখে সবাই ভেবেছে—তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি প্রত্যেককে তৃপ্ত করতে পারতেন। এও এক বিড়ম্বনা। সবাঙ্গীনভাবে যাঁর মহাভারতের নায়ক হবার কথা, এই বিড়ম্বনাই হয়তো সমালোচকের মনে তাঁর নায়কত্ব প্রতিষেধ করেছে। হয়তো এই বিড়ম্বনাই তাঁকে আস্তে আস্তে ঠেলে দিয়েছে গীতোক্ত নিস্তরঙ্গ দার্শনিকতার দিকে। হয়তো এই বিড়ম্বনাই মহামতি কৃষ্ণের ওপরে তাঁর নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। যাতে জায়া, জননী, ভাই—সবাই যখন মুখ ঘুরিয়ে নেবে তখন একজন, অন্তত একজন তাঁর রথের রশি ধরে সংসারের যুদ্ধক্ষেত্র পার করে দেবে, আর বলবে—তুমি শুধু যুদ্ধের জন্যই যুদ্ধ করে যাও অর্জুন, কী হবে, কী ঘটবে—তা নিয়ে তুমি ভাবনা কোরো না। এমন নির্বিকার বৈরাগী ফলাকাঙ্ক্ষাহীন যুদ্ধবীরের মধ্যেও যদি মহাভারতের অন্তঃশায়ী শান্তরসের নায়ক খুঁজে না পাওয়া যায়, তা হলেও বলব—অর্জুন! তুমি এখনও বঞ্চিত, কেননা জায়া, জননী, ভাইদের মতো তুমি আমাদেরও তৃপ্ত করতে পারোনি। অথবা এই বঞ্চনা তোমাকেই শুধু মানায়, অর্জুন! শুধু তোমাকেই।