ভীম – ৭

যুধিষ্ঠির-শকুনির দ্যূতক্রীড়া দ্রৌপদীর কাছে যত অভিশাপের মতোই নেমে আসুক, কিন্তু দ্রৌপদীর কাছে এই দ্যূতক্রীড়ার আবিষ্কার হলেন ভীম। তাঁর এই মধ্যম-স্বামীটিকে তিনি রাগী বলে জানতেন—সেটা বড় কথা নয় ; কিন্তু যে স্বামীদের, বিশেষত যুধিষ্ঠির এবং অর্জুনকে তিনি যত ন্যায়পরায়ণ বলে জানতেন, ওই দ্যূতসভার পরিসরে চরম অপমান এবং লজ্জার মুহূর্তে তাঁরা তাঁদের যথার্থতা অথবা ন্যায়পরায়ণতার মাহাত্মে দ্রৌপদীর কাছে ধরা দেননি।

অথচ কী আশ্চর্য, বিদগ্ধা রমণীর অভিমান-মঞ্চ থেকে যে স্বামীটিকে তাঁর শুধুই রুক্ষ, ক্রোধী এবং সরল বলে মনে হত, দ্রৌপদী সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন যে, সেই ভীমের অসহিষ্ণুতা শুধু যুদ্ধ অথবা শত্রুশাতনে নয়, প্রেমেও তাঁর একই রকম অসহিষ্ণুতা আছে। দ্রৌপদী বুঝলেন—ভীম তাঁর কাছে বিকিয়েই আছেন। নইলে দেখুন, নীতির দোহাই, আইনের দোহাই এবং সর্বোপরি সত্যের দোহাই নিয়ে যে ধর্মরাজ স্বামী অথবা নীতিপরায়ণ অর্জুন দ্রৌপদীর অপমানে চুপটি করে বসে থাকলেন, সেখানে অসঙ্গত জেনেও, যথেষ্ট নীতিসিদ্ধ নয় জেনেও ভীম তো বসে থাকতে পারলেন না। অন্তত দ্রৌপদীর ওই চরম লজ্জার মুহূর্তে ভীমের ওই আইন-বহির্ভূত অনীতির শব্দরাশি একদিকে যেমন দুর্যোধন-কর্ণ-দুঃশাসনদের পরোক্ষে ভয় দেখিয়েছে, তেমনই অন্যদিকে আরও পরোক্ষভাবে এক বিদগ্ধা রমণীর চোখ খুলে দিয়েছে—ভীম তাঁকে অতিশয় ভালবাসেন।

এই অসহিষ্ণু ভীমের ভালবাসা, যা বার বার অন্য পাণ্ডবদের ছাপিয়ে প্রকাশিত হয়ে পড়ছিল, সেই ভালবাসার উত্তরে দ্রৌপদীও তাঁকে ভালবাসা দিয়েছেন কিনা, সে প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না, কারণ তা প্রমাণিত হওয়ার জন্য আমাদের সময় দিতে হবে আরও। তবে দ্রৌপদী যে ভীমকে তাঁর চিরভক্তের মতো আবিষ্কার করলেন—এটা নিশ্চয়ই দ্যূতসভার চরম অভিজ্ঞতার মধ্যেও তাঁকে আনন্দ দিয়েছে। যদিও পঞ্চস্বামীর মধ্যে একতম ভীমের প্রতি ব্যবহারেও তিনি এতটাই বিদগ্ধা যে, তিনি ভীমকে আলাদা করে তাঁর আবিষ্কারের রহস্যটা মোটেই বুঝতে দেননি। নইলে দেখুন, বনবাসের প্রথম লগ্নেই যখন কৃষ্ণ তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে এলেন, তখন ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে নিজের অপমানের কথা বলবার সময় দ্রৌপদী অর্জুনকে যেমন ধিক্কার দিয়েছেন, তেমনই ধিক্কার দিয়েছেন ভীমকে—ধিগ্বলং ভীমসেনস্য ধিক্ পার্থস্য গাণ্ডীবম্। অথচ সেই অপমানের সময় অর্জুন তাঁর জন্য কিছুই করেননি, অথচ ভীম করেছেন। প্রতিবাদ করেছেন তীব্রস্বরে, ভয় দেখিয়েছেন এবং যুধিষ্ঠিরের একটি আদেশ-বাক্যের জন্য আকুলি-বিকুলি করেছেন। তাতে কাজও হয়েছে অনেক। কিন্তু দ্রৌপদী ভীমের সেই আর্তির মূল্য দেননি। তাঁকে সমান জায়গায় মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর অন্তরের নায়ক অর্জুনের সঙ্গে। তার মানে—অর্জুন যা করেননি, ভীম তা করেছেন—এটা স্বীকার করে নিতে যেন দ্রৌপদীর ইচ্ছে করে না। অথচ এই মহানুভব বীর শুধু দ্রৌপদীর ওপর ভালবাসায় কৌরবদের শত মুখরতা সহ্য করেও তাঁর প্রিয়তমার কাছে কোনও মূল্য পেলেন না।

থাক সে কথা। বনবাসের রুক্ষ-শুষ্ক দিনগুলি দ্রৌপদীর কাছে মোটেই সুখপ্রদ ছিল না। বিশেষত বিনা কারণে দুর্যোধন-শকুনির চক্রান্ত তাঁকে প্রতিনিয়ত পীড়িত করছিল। দ্রৌপদী আর থাকতে পারলেন না। সেদিন তিনি সন্ধ্যাবেলায় অন্যান্য পাণ্ডবস্বামীদের সঙ্গে বসে ছিলেন। যুধিষ্ঠিরও সামনেই বসে। দ্রৌপদী আস্তে আস্তে কথাটা তুললেন। প্রথমে ভালভাবে, তারপর অল্প রেগে, তারপর বেশি রেগে। প্রথম দিকে তাঁর বক্তব্য রচিত হয়েছিল স্বামীদের জন্য ভাবনায়। অর্থাৎ এই যে ভীম-অর্জুনের মতো বীরেরা, যাঁরা অন্য রাজাদের কাছে যমের মতো, তাঁরা সব এখানে এসে বনের ফল কুড়োচ্ছেন, লজ্জা নিবারণের জন্য গাছের বাকল জোগাড় করছেন—এও কি সহ্য করা যায়? নাকি যে যুধিষ্ঠির আগে রাজা হয়ে হেমপীঠে পা রেখে অন্য রাজাদের প্রণাম গ্রহণ করতেন, তাঁকে এই উদ্‌ভ্রান্ত বনবাসীর বেশ মানায়?

এসব কথা থেকে রাজনীতির কথা এল এবং রাজনীতির কথায় দ্রৌপদী বেশ প্রমাণ করে দিলেন যে, যুধিষ্ঠিরের উৎসাহ, উদ্যম, চেষ্টা বলে কোনও জিনিস নেই। নিজের সত্য-নিষ্ঠার বাড়াবাড়িতে তিনি যে স্ত্রী এবং বশম্বদ ভাইদের যথেষ্ট কষ্ট দিচ্ছেন—সে কথা বলতেও দ্রৌপদীর দ্বিধা হল না। যুধিষ্ঠিরও কিছু কম যান না। নরমে-গরমে তিনি দ্রৌপদীকে এক হাত নিলেন এবং বলে দিলেন—দরকার থাকে তো অন্য ভাইরা দ্রৌপদীকে নিয়ে রাজ্য অধিকার করার চেষ্টা করুক, আমাকে তোমরা একা থাকতে দাও। কথা কাটাকাটির চরম মুহূর্তে তখনকার দিনের ভীষণ গালাগালি ‘নাস্তিকে’র সংজ্ঞাতেও দ্রৌপদীকে চিহ্নিত করলেন যুধিষ্ঠির। কিন্তু দ্রৌপদী ত কিছু কম যান না। তিনি ‘পণ্ডিতা মনস্বিনী’। অতএব যখন একে একে রাজনীতি শাস্ত্রের সারকথাগুলি তিনি বলতে আরম্ভ করলেন, তখন যুধিষ্ঠির একটু থমকেই গেলেন।

ঠিক এই অবস্থায় দ্রৌপদীর সঙ্গে সুর মেলালেন ভীমসেন। এতক্ষণ যা উতোর-চাপান চলছিল, তাতে অর্জুন, নকুল, সহদেব—সবাই চুপ করে বসেছিলেন। কিন্তু সবাই চুপ করে থাকলেও তো ভীম চুপ করে থাকবেন না। দ্রৌপদীকে যে তিনি হৃদয়ের গভীর থেকে ভালবাসেন। দ্রৌপদীর অপমান হলে তাঁর শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ থাকে না। দুঃশাসন-দুর্যোধনের অসভ্যতায় তিনি যেমন রক্তপান বা ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তেমনই জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের পাশা-খেলার হাতটিও তিনি পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আজ আবার যখন যুধিষ্ঠিরের পরুষ তর্কে দ্রৌপদী যৎকিঞ্চিৎ বিপর্যস্ত, তখন আবারও তাঁর রাগ হচ্ছে যুধিষ্ঠিরের ওপর—ক্রুদ্ধো রাজানমব্রবীৎ।

ভীম বললেন—এই বনবাসে এসে আমাদের কোন লাভটা হচ্ছে শুনি? ধর্ম, অর্থ, কাম—কোনটা পাচ্ছি এই বনবাসে? আপনি তো দুর্যোধনের সঙ্গে খুব ধর্ম করলেন, কিন্তু দুর্যোধন কি আমাদের রাজ্যটা ধর্ম দিয়ে জিতেছে? শেয়াল যেরকম সিংহের খাবার নিয়ে যায় চোরি-চোরি, কুত্তা যেমন সবলের খাদ্য চুপিসারে নিয়ে যায়, আপনার বেখেয়ালে আমাদের রাজ্যটা সেইভাবেই আমরা খুইয়েছি দুর্যোধনের কাছে। আপনার শাস্তর্ শুনে আমরা নিজেদের আটকে রেখেছিলাম বলে—আত্মানং ভবতাং শাস্ত্রৈনিয়ম্য ভরতর্ষভ—আমাদের কী হল জানেন—নুলো মানুষের হাত থেকে লোকে যেমন এটা-ওটা নিয়ে যায়, ল্যাংড়া লোকের হাতে গরু থাকলে যেমন সে গরু লোকে টেনে নিয়ে যায়—আপনার শাস্ত্র শুনে আমরাও তেমন ল্যাংড়া আর নুলো হয়ে রইলাম। আমাদের সব গেল—হৃতমৈশ্বর্যম্ অস্মাকং জীবতাং ভবতঃ কৃতে।

দ্রৌপদী যেভাবে জ্যেষ্ঠস্বামীকে দুষলেন, ভীমও একইভাবে দুষলেন তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে। রাজনীতির বাচম্পত্যও ভীম কম জানতেন না। তাঁর মতে শুধু ধর্ম নয়—তুমি ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মেছ, অতএব অর্থ-কাম, প্রজাপালন, আপন স্বার্থ—সেও তোমাকে বুঝতে হবে। যদি না বোঝো তাহলে আর রাজা হয়ো না, মুনি-ঋষিদের মতো বনে বসে মোক্ষ-সাধনা কর। বাঁকা-চোরা নানা কথা বলে ভীম কিন্তু শেষ পর্যন্ত কীভাবে হৃত রাজ্য উদ্ধার করা যায়, সেই পরামর্শ দিলেন। কড়া করে বললেন—আপনি এটা ভাববেন না যে, আপনি দুর্বলের মতো বনবাসের ব্রতচর্যা গ্রহণ করেছেন, সে কাজ কৃষ্ণ কিংবা অর্জুন, নকুল কিংবা সহদেব অথবা আমি কোনও ভাবেও সমর্থন করি। আপনি পুরোদমে যুদ্ধ আরম্ভ করুন। মনে রাখবেন, অর্জুনের গাণ্ডীব দিয়ে যে বাণগুলি বেরয়, সেগুলি সহ্য করার ক্ষমতা কারও নেই। আর আমার কথা বলি—পৃথিবীতে এমন কোনও বীর অথবা কোনও হাতিও জন্মায়নি যে ক্রুদ্ধ ভীমের গদার বেগ সহ্য করতে পারে। আমি বলি—আমাদের ওপর ভরসা রেখে আজই চলুন হস্তিনাপুরে—অদ্যৈব গজসায়ম্।

ভীমের কথায় যুধিষ্ঠির একটু রেগেই গেলেন, যদিও রাগটা প্রকাশ করলেন নিজেকেই আরও হেয় করে। যুধিষ্ঠির বললেন—তখন বললেই পারতে। ক্ষত্রিয়ের নিয়ম মেনে পাশা খেলতে গিয়েছিলাম। কই তখন তো বাপু কিচ্ছুটি বলোনি। আগে কোনও কথা না বলে, এখন আমাকে সত্য থেকে সরে আসতে বলছ, এ কি ভদ্রলোকের কথা? যুধিষ্ঠির ভীমকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন—তুমি যখন আগুন দিয়ে আমার হাত পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলে, তখন কেবল অর্জুন তোমাকে বারণ করেছিল। কিন্তু তুমি যদি সেদিন ব্যাপারটা ঘটিয়ে ফেলতে, অর্থাৎ নিজের বীরত্ব প্রকাশ করে সবাইকে মেরে ধরে ঠাণ্ডা করে দিতে, তাহলে, আজকে কিছুই ঝামেলা হত না—কিং দুষ্কৃতং ভীম তদাভবিষ্যৎ।

ভীমের হঠাৎ ক্রোধ, তাঁর শারীরিক শক্তি, তাঁর বাঁধ-ভাঙা উৎসাহ—এগুলির প্রতি যুধিষ্ঠিরের কটাক্ষ যতই থাকুক, তিনি কিন্তু দ্রৌপদীর কথাটা ফেলতে পারলেন না। দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের প্রত্যেকের স্ত্রী যেহেতু, তাই আগ বাড়িয়ে তাঁর কথাটা যিনিই বলবেন সেই স্বামীর দিক থেকেই পৃথক এক সরসতা প্রকাশ পায়। প্রত্যেকেই সে সরসতা চেপে রেখেছেন, কিন্তু ভীম তা পারেননি। ভীম সজোরে তাঁর প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছেন দ্রৌপদীর পক্ষ নিয়ে। শুধু তাই নয়, সমস্ত লজ্জা কাটিয়ে উঠে দ্রৌপদীর জন্য যুধিষ্ঠিরের কাছে মুরুব্বি করতেও তাঁর বাধেনি। দ্রৌপদীর চরম অপমানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটা যে জরুরি ছিল এবং সেই প্রতিবাদ করে যে ভীম ঠিক কাজই করেছেন—সেটা যুধিষ্ঠির মেনে নিলেন। বললেন—এক সময় বিষ খেয়ে কতক দিন তার জ্বালা সহ্য করলে যেমন লাগে, যাজ্ঞসেনীর সেই কষ্ট-অপমান দেখে তবুও দুর্যোধনদের যে আমি ক্ষমা করেছি, তার জন্য আমার বিষ-জ্বালা আছে এই বুকে—দূয়ে বিষস্যেব রসং হি পীত্বা। তুমি আর কিছু কাল মাত্র অপেক্ষা করো।

ভীম বললেন—অপেক্ষা? এই তেরো বছরের অপেক্ষা মানে মুল্যবান এই আয়ুষ্কালের অপচয়। তারপর আর মরতে কত দিন—আয়ুষো’পচয়ং কৃত্বা মরণায়োপনেষ্যতি। এই মুহূর্তে শত্রুদের মেরে রাজ্যের দখল নিন আপনি। যে রাগে আমি জ্বলছি, সে রাগের উত্তাপ আগুনের থেকেও বেশি। দিন যায়, রাত যায় আমি ঘুমতে পর্যন্ত পারি না—ন নক্তং ন দিবা শয়ে। এর থেকে খারাপ বিপদ আর নেই, যাতে আপনার রাজ্য অন্যে কেড়ে নিয়ে ভোগ করছে। অথচ আপনি বলছেন অপেক্ষা করতে। আপনার এই বুদ্ধি বেদ মুখস্থ করা শ্রোত্রিয় পুরোহিতের মতো বোকা-বোকা। যারা শুধু ‘গুরুদেব এই বলেছেন, মনু-বাবা এই বলেছেন—এই বুদ্ধিতে চলেন, তাঁরা আর যাই বুঝুন, করণীয় কার্যের তত্ত্বটিই বোঝেন না—অনুবাকহতা বুদ্ধি র্নৈষা তত্ত্বাৰ্থদর্শিনী। আমি ভেবে অবাক হই—বামুন-ঠাকুরদের মতো দয়ালু একজন মানুষ আমাদের এই ক্ষত্রিয় বংশে কী করে জন্মাল? ক্ষত্রিয়ের বাড়িতে যারা জন্মায়, তাদের বুদ্ধি হয় ক্রুর নৃশংস। এমনকী মনু মহারাজও তাই বলেছেন। অতএব সব ভেবেচিন্তে যুদ্ধের ব্যাপারেই সংকল্প করুন—তস্মাচ্ছত্রুবধে রাজন্ ক্রিয়তাং নিশ্চয়ত্বয়া।

বস্তুত বাংলা ভাষায় যে ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ বলে কথাটা আছে, ভীমের নীতিটা প্রায় তাই। রাজনীতির নৈতিক জ্ঞান তাঁর যথেষ্টই আছে, কিন্তু যে ‘পোলিটিক্যাল ট্রেনিং’ থাকলে যুধিষ্ঠির, অর্জুন, অথবা কৃষ্ণ হওয়া যায়, সেই ‘ট্রেনিং’ তাঁর ছিল না। আমরাও তাই সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। কারণ, আমরা দ্রৌপদীর কথা বলছিলাম। ভীমের ভাষণে যুধিষ্ঠিরের নীতি বদলায়নি, সেটা বলাই বাহুল্য, কিন্তু দ্রৌপদীর দিক থেকে এর মূল্য আছে অনেক। দ্যূতসভায় যে মুখর স্বামীকে তিনি একান্ত পক্ষপাতী বলে আবিষ্কার করেছিলেন, যাঁকে তিনি রমণীয় বিগদ্ধতায় অর্জুনের সঙ্গে সমানভাবে ধিক্কার দিয়েছিলেন, সেই স্বামীটি যে অন্যদের থেকে আলাদা, সেটা ভীমের ভাষণে দৃঢ় হল। অর্জুন, নকুল, সহদেব কেউ নয়, যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ আক্ষরিকভাবে সমর্থন করেছেন একমাত্র ভীম। রমণীর বিচক্ষণতায় দ্রৌপদী বুঝলেন—ভীম অন্য স্বামীদের চেয়ে তাঁকে বেশি ভালবাসেন। ভাগের বউয়ের গঙ্গা পাওয়ার প্রবাদ নেই বটে, তবে ভীমের মধ্যে তিনি বিশ্বস্ত চিরভক্তটিকে খুঁজে পেলেন।

দ্রৌপদী যে অর্জুনকে অর্থাৎ স্বয়ম্বরসভার সেই মৎস্যচক্ষুভেদী নায়কটিকে মনে মনে বেশি পছন্দ করতেন অথবা তাঁর জন্য যে তাঁর প্রেমিকার অপেক্ষা ছিল, সে-কথা আমি আমার ‘অর্জুন’ প্রবন্ধে যথাসম্ভব ব্যক্ত করেছি। কিন্তু ভীম কীভাবে দ্রৌপদীকে দেখেন অথবা দ্রৌপদী ভীমকে কী চোখে দেখেন, সেটাও আমাদের একটু বুঝে নিতে হবে। ভীম-যুধিষ্ঠিরের তর্কাতর্কির অবসান ঘটল ব্যাসদেবের আগমনে। তিনি কৌরবদের যোগ্য প্রতিপক্ষতার জন্য দেবতাদের তুষ্ট করে দিব্য-অস্ত্র জোগাড় করার ওপর জোর দিলেন। অবশ্যই দেবতা এবং মহাদেবকে তপস্যায় তুষ্ট করে পাশুপত অস্ত্র বা অন্যান্য দিব্য-অস্ত্র জোগাড় করার ভার পড়ল অর্জুনের ওপর। যুধিষ্ঠিরের কাছে ব্যাসের বলা ‘প্রতিস্মৃতি’ বিদ্যা নিয়ে অর্জুন চলে গেলেন তপস্যায়।

দ্রৌপদী অনেক কাঁদলেন অর্জুনের জন্য। অনেক শুভেচ্ছা প্রকাশ করলেন অর্জুনের সফলতা কামনা করে। অর্জুন চলে গেলেন দ্রৌপদীর হৃদয় শূন্য করে। অর্জুনের জন্য দ্রৌপদী নিজেই এই শূন্যতা ব্যক্ত করেছেন তাঁর জ্যেষ্ঠ স্বামীর কাছে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভীমও। দ্রৌপদী বলেছিলেন—এই সমস্ত পৃথিবী আজ আমার কাছে শূন্য হয়ে গেছে—শূন্যামিব প্রপশ্যামি তত্র তত্র মহীমিমাম্। আমি শুধু ভাবি—এসব কথা শুনে যুধিষ্ঠির কি নকুল-সহদেবের যাই প্রতিক্রিয়া হোক, কী ভেবেছিলেন তাঁর সেই চিরভক্ত—ভীমসেন?

অর্জুন তপস্যা করে অস্ত্র নিয়ে ইন্দ্রসভা থেকে ফিরে আসতে পারছেন না, অতএব বনবাসের বসন্ত-বাহার দ্রৌপদীর কাছে তিক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু কী বলবো সেই প্রেমের সম্বন্ধে—যেখানে অর্জুনকে ছাড়া দ্রৌপদীর যেহেতু ভাল লাগছে না, অতএব সেটা ভীমেরও ভাল লাগছে না। নিজের ভাল লাগা নয়, তার ভাল লাগছে না বলে ভীমেরও ভাল লাগছে না। বৈষ্ণব পদাবলীতে ভবিষ্যতে এই প্রেম নিয়ে গান লেখা হয়েছে জানি : ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর কবি এই প্রেমের উত্তরাধিকারে—তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুঃখ পাই গো—লিখবেন, তাও জানি। কিন্তু ভীম মনে-প্রাণে অত ‘রোম্যান্টিক’ ছিলেন না। অথচ যেই না দ্রৌপদী বললেন, অর্জুনকে ছাড়া ভাল লাগছে না, অমনই ভীমও বললেন—অর্জুনকে ছাড়া, সত্যিই তো, যেন সব অন্ধকার হয়ে গেছে—পশ্যামি চ দিশঃ সর্বা স্তিমিরেণাবৃতা ইব।

অর্জুনকে ভীম কম ভালবাসতেন না—জানি। শুধু ভীম কেন, কেউই তাঁকে কম ভালবাসতেন না। অতএব ভীম সেই সুরে কথা বলতেই নকুল-সহদেবও সুর মেলালেন ভীমের সঙ্গে। কিন্তু সে ছিল শিশুদের কান্না মেলানোর সামিল। আমি তার খুব বেশি মূল্য দিই না। মূল্য দিই ভীমের সেই গদ্যজাতীয় কবিতাটিকে, যাতে দ্রৌপদীর দুঃখ-সূত্রপাতেই সরল কথা সুর হয়ে ওঠে—সুন্দরী আমার! তুমি যা বললে, তাতে মন আরও ভরে উঠল আমার। তোমার কথা, সে যেন অমৃতের আস্বাদ দিল আমার হৃদয়ের গভীরে—তন্মে প্রীণাতি হৃদয়ম্ অমৃতপ্রাশনোপমম্। দ্রৌপদী যা বলেছিলেন, তা কিন্তু অর্জুন সম্বন্ধেই বলেছিলেন, কিন্তু শুধুমাত্র দ্রৌপদী বলছিলেন বলেই তা অমৃতের স্বাদ বয়ে আনে ভীমের হৃদয়ে। অর্জুনের ভাগ্য নিয়ে ঈর্ষা নয়, অসূয়া নয়, কোনও পরশ্রীকাতরতাও নয়, শুধুমাত্র দ্রৌপদীর জন্য ভীমের এই আবেগ-আর্তি, তাঁর ক্রূর-নৃশংস গদ্যমূর্তিকে আমার কাছে পদ্যময় করে তোলে। হয়তো এই সরলতাই কবিতা বা প্রেমের শ্রেষ্ঠ ভাষা।

অথচ উলটো দিকে দ্রৌপদীকে দেখুন। অর্জুন আসবেন জেনে সবাই মিলে তখন গন্ধমাদন পর্বতে এসে উপস্থিত হয়েছেন। পাহাড়ের রাস্তা, দ্রৌপদী হাঁটতে পারেন না। চলতে চলতে সংজ্ঞা হারান। ভীমই তাঁকে নিয়ে এসেছেন পুত্ৰ ঘটোৎকচের কাঁধে চড়িয়ে। ভীম তাঁকে বলেছিলেন—বাছা! তোমার মা শ্রান্ত, ক্লান্ত, তুমি তাঁকে কাঁধে নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলো—হৈড়িম্বেয়ং পরিশ্রান্তা তব মাতাপরাজিত। আমার ধারণা—এই কাঁধে চড়ানোর কষ্টটুকু ভীম নিজেই স্বীকার করতেন। এ অভ্যাস তাঁর আগেই দেখেছি। কিন্তু দ্রৌপদীর চতুঃস্বামীর মধ্যে দ্রৌপদীর গাঢ়-প্রত্যঙ্গস্পর্শ ভীমের দেহে-মনে যদি কোনও চিৎকার করার মতো আনন্দ দিয়ে ফেলে, তবে ভীম, অন্তত ভীম সে আনন্দ চেপে রাখতে পারবেন না বলেই বোধহয় প্রিয় পুত্রকে তিনি অনুরোধ করেছেন—কাঁধে বয়ে নিয়ে চলো তোমার মাকে। দ্যাখো এমনভাবে পথ চলো যাতে কোনও কষ্ট না হয় তাঁর-গচ্ছনীচিকয়া গত্যা যথা চৈনাং ন পীড়য়েঃ।

দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে সবাই গন্ধমাদনে এলেন। বড় মনোরম পর্বত এই গন্ধমাদন। যেমন তার প্রকৃতির শোভা, তেমনই স্বর্গীয় সব অনুভূতি। এমন জায়গায় এসে, যে যুধিষ্ঠিরের প্রতি এত শুষ্ক ছিলেন দ্রৌপদী, তাঁকে পর্যন্ত হাওয়ায় উড়ে আসা সুর-সৌগন্ধিক পদ্ম একগাছি উপহার দিয়ে বসলেন। আর ভীমকে বললেন-আমাকে যদি তুমি একটুও ভালবাস ভীম, তাহলে আরও, আরও অনেক এমন পদ্ম আমাকে এনে দাও—যদি তে’হং প্রিয়া পার্থ বহুণীমান্যুপাহর।

হায়! ভীম জানেন—কত দুর্গম সেই পদ্মবনের পথ। হয়তো মানুষের প্রেমের যে পদ্মবন আছে, সেখানে পৌঁছনোর পথও ততখানিই কঠিন ভীমের কাছে, যতখানি কঠিন এই পথ। দ্রৌপদী অর্জুনকে ছাড়া পৃথিবী শূন্য দেখেছিলেন—ভীমের কাছে দ্রৌপদীর সেই দুঃখপাত ছিল অমৃতের স্বাদ, কারণ অর্জুনকে ভীমও ভালবাসেন। আজ একটি মাত্র সৌগন্ধিক পদ্ম যুধিষ্ঠিরকে উপহার দিয়ে তাঁর তৃপ্তি হল না। তিনি আরও পদ্ম চান যুধিষ্ঠিরকেই দেবার জন্য, কিন্তু সেই উপহারের পদ্ম এনে দেবেন ভীম, তাও সে দ্রৌপদীকে ভালবাসার জন্য ধন্য হয়ে—তুমি যদি আমায় একটুও ভালবাস ভীম—ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভীম যাবেন, দ্রৌপদীর জন্যই যাবেন। দ্যূতসভার অপমানের মধ্যে যাঁর পক্ষপাত আবিষ্কার করেছিলেন দ্রৌপদী, বনবাসের তর্কে-বিতর্কে যে আবিষ্কার সযৌক্তিক অথবা বিশ্বাসের পর্যায়ে এসেছিল, অর্জুনের ওপর নিজের প্রেম জানিয়েও ভীমের মতো ভক্তের আরও এক অন্যতর প্রেমে যিনি আস্থা রাখতে আরম্ভ করেছিলেন, সেই বিদগ্ধা রমণী তাঁর চিরভক্তকে পরীক্ষা করবেন না?

ভীম চললেন দ্রৌপদীর জন্য সুর সৌগন্ধিক আহরণ করতে। ভীমের কথাই যখন বলছি, তখন কত দূর্গম সে পথ, কত ক্রোশ দূরে, পথে কত শত বাধা—এসব মহাভারতের কবির কারুণ্য নিয়ে আমারও বর্ণনা করা উচিত ছিল। কিন্তু আমি তা করছি না। কারণ পথক্লেশ, বাধা, যক্ষ-রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ—এসব ভীম যেভাবে দমন করতে পারেন, সেভাবে তিনি শুধু নিজের গভীর অন্তরশায়ী প্রেমকেই দমন করতে পারেন না। তিনি দ্রৌপদীর জন্য যাচ্ছেন। পদ্মবনের রক্ষক কুবের পর্যন্ত জেনে গেছেন সেই উদগ্র প্রেম কী রকম? যুদ্ধ-বিগ্রহের অন্তরে তিনি বলেছেন—নিয়ে যাও বাপু, যত চাও পদ্মফুল, আমি যখন বুঝেছি দ্রৌপদীর জন্য তোমাকে এই ফুল নিয়ে যেতে হবে, অতএব তা নিতেই হবে, নাও তুমি যত চাও—গৃহ্নাতু ভীমো জলজানি কামা/কৃষ্ণা-নিমিত্তং বিদিতং মমৈতৎ।

অথচ যুধিষ্ঠির কী ভাবনাতেই না পড়েছিলেন ভীমের জন্য। এদিক দেখেন, সেদিক দেখেন, ভীমকে আর পাওয়া যায় না। শেষে অধৈর্য হয়ে নকুল-সহদেব, দ্রৌপদী—সবাইকেই জিজ্ঞাসা করলেন—কোথায় ভীম, তাকে তো দেখছি না। সলজ্জে দ্রৌপদী বললেন—আমিই তাকে পাঠিয়েছি। সেই যে তখন তোমাকে দিলাম সেই পদ্মফুল—কী সুন্দর গন্ধ, হাওয়ায় উড়ে এসে পড়ল আমার সামনে, আর আমি অমনি দিয়ে দিলাম তোমার হাতে। তো সেই পদ্মফুল আরও অনেকগুলো আমি ভীমকে আনতে বলেছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমার ভাল লাগবে বলেই—প্রিয়ার্থং মম পাণ্ডব—ভীম সেই ফুল আনতে চলে গেছেন আরও উত্তরে, কয়েক ক্রোশ দূরে। যুধিষ্ঠির আর দেরি করলেন না। মাথা-গরম লোক, হঠাৎ হঠাৎ কোথায় কী করে বসে-কৃতবানপি বা বীরঃ সাহসং সাহসপ্রিয়ঃ। সবাই মিলে চললেন, ভীম যেদিকে গেছেন সেই দিকে।

পদ্ম-সরোবরের কাছে গিয়ে যুধিষ্ঠির দেখলেন—যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই। এখানে ওখানে কুবেরের অনুচর যক্ষ-রাক্ষসেরা সব কেউ হাত ভেঙে, কেউ পা ভেঙে এদিক-ওদিক পড়ে আছে আর সেই পদ্ম-পুস্করিণীর পারে ভীম গদা উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন—উদ্যম্য গদাং দোর্ভ্যাং নদীতীরে ব্যবস্থিতম্। কষ্টার্জিত সৌগন্ধিক পদ্ম আবার ফিরে গিয়ে দ্রৌপদীকে আর দেওয়া হল না ভীমের। কারণ দ্রৌপদী নিজেই ভীমের কাছে চলে এসেছেন যুধিষ্ঠিরের চাপে পড়ে। কিন্তু তাঁর পরীক্ষাও হয়ে গেছে। দ্রৌপদী বুঝে গেছেন—ভীমকে তিনি যা বলবেন, ভীম তাই করবেন। তাঁর প্রণয়-মালঞ্চের এক নতুন মালাকর, যে সর্বদা শশব্যস্ততায় তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলবে—নতুন কোন কর্ম দেহ অকর্মণ্য দাসে।

দ্রৌপদীর ঈপ্সিত প্রিয়তম স্বামীটি স্বর্গ থেকে ফিরে এলেন গন্ধমাদনের সানুদেশে। কাঁধে দিব্য অস্ত্রভার, ধনুর্বিদ্যার শ্রেষ্ঠত্বে কিঞ্চিৎ লজ্জিতও বা। যুধিষ্ঠির, ভীম, পাঞ্চালী-কৃষ্ণা—সবাই আনন্দে আত্মহারা হলেন অর্জুনের আগমনে। অর্জুন ফিরে আসার পর যুধিষ্ঠিরের বনবাসের আবাসে প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল—দুর্যোধনের ঘোষ-যাত্রা। কৌরবদের অধিকারে কত গরু আছে, তা গুনে নেবার অছিলা করে দুর্যোধন নিজের বৈভব দেখাতে এলেন বনে। থানা গাড়লেন ঠিক পাণ্ডব-কুটীরের কাছেই। কিন্তু দুর্যোধনের পরিহাসে বাদ সাধলেন গন্ধর্ব চিত্রসেন। জায়গাটি নাকি গন্ধর্বদের এলাকার মধ্যে।

দুর্যোধনের সঙ্গে গন্ধর্ব চিত্রসেনের ঝগড়াঝাটি মারামারি আরম্ভ হল। দুর্যোধন এবং তাঁর বাহিনী চিত্রসেনের হাতে বন্দি হলেন। কৌরবদের বাড়ির বউ-ঝিদের সোনায় মুড়ে দুর্যোধন পাণ্ডবদের দমক দেখাতে এসেছিলেন বনে, তাঁদের ধরে নিয়ে গেল গন্ধর্বরা। কুরুসভার বৃদ্ধ মন্ত্রীরা সাধারণ সৈনিকরা বনবাসী যুধিষ্ঠিরের কাছে দুর্যোধনের বিপত্তির কথা জানাল। যুধিষ্ঠির সব কথা ভাল করে শুনবার আগেই ভীম সোচ্ছ্বাসে বলে উঠলেন—আরে ইয়াঃ। কত যত্ন করে হাতি-ঘোড়া সাজিয়ে আমাদের যা করতে হত, গন্ধর্বরাই তো তা করে দিয়েছে-অস্মাভি র্যদনুষ্ঠেয়ং গন্ধর্বৈস্তদনুষ্ঠিতম্।

যে মন্ত্রীরা এতদিন দুর্যোধনের পাশে ছিলেন, যাঁরা দুর্যোধনের মুক্তি ভিক্ষা চাইতে এসেছিলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে, ভীম তাঁদের ছাড়লেন না। আচ্ছা করে শুনিয়ে বললেন—ঠিক হয়েছে। ব্যাটা ভেবেছে একরকম, হয়েছে আরেকরকম। আরে এই হয়। কপট পাশা খেলায় যার হাত ছিল, এও সেই ধৃতরাষ্ট্রের দুর্মন্ত্রণা। বোঝা যাচ্ছে, এমন লোক এখানেও আছে, যারা আমাদের ভাল চায়, নইলে, আমরা এখানে মেজাজে বসে রইলাম, আর কাজ হাসিল করে দিল অন্য লোক—যেনাস্মাকং হৃতো ভার আসীনানাং সুখাবহঃ। আরে তোরা হস্তিনাপুরে আরামে বসে ভেবেছিলি—আমরাই শুধু বনবাসে শীত বর্ষা আর গরমে কষ্ট পাব, আর তোরা বসে বসে দেখবি-দ্রষ্টুমিচ্ছতি দুর্মতিঃ। এখন যা করেছিলি তার ফল বোঝ।

যুধিষ্ঠির ভীমকে থামালেন। ভীমকে বোঝালেন কুলের মর্যাদা—দুর্যোধন যাই করুক, তবু সে আমাদের জেঠতুতো ভাই। অন্য শত্রুর হাত থেকে তাকে না বাঁচালে, আমাদের মর্যাদা থাকে না। যুধিষ্ঠিরের যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হলেন ভীম। শেষে অর্জুনের সঙ্গে একত্রে গিয়ে দুর্যোধন এবং তাঁর স্ত্রীদের মুক্ত করলেন। দুর্যোধনকে মুক্ত করার ব্যাপারে অর্জুনের ভূমিকাই বড় ছিল, ভীম ছিলেন সাহায্যকারীমাত্র। অর্জুনের মর্যাদায় তিনি অর্জুনের পাশে আছেন মাত্র, নইলে দুর্যোধনকে বাঁচানো তাঁর মনঃপূত ছিল না।

অর্জুন ফিরে আসার পর বনবাসের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনা—ধৃতরাষ্ট্রের জামাই জয়দ্রথের আগমন এবং দ্ৰৌপদীকে হরণের চেষ্টা। পাণ্ডবভাইরা সবাই তখন ক্ষুধার অন্ন জোগাতে শিকারে বেরিয়ে পড়েছেন। বাড়িতে দ্রৌপদী একেবারে একা। বনবাসের পর্ণকুটীরে থাকা সত্ত্বেও এই বিদগ্ধা রমণীর রূপে আলোকিত হয়ে ছিল বনতল। সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে জয়দ্রথ বনের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দ্রৌপদীকে দেখে মোহিত হলেন। তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন জয়দ্রথ।

জয়দ্রথের ভাব-ভঙ্গি, কথা-বার্তা শুনে দ্রৌপদীর হৃদয়, কেঁপে উঠল। প্রথমে গালাগালি, তারপর স্বামীদের ক্ষমতার কথা বলে ভয় দেখানো, এবং পরিশেষে আবারও গালাগালি দিয়ে দ্রৌপদী বাক্য শেষ করলেও জয়দ্রথ সিংহের ঘরে এসে সিংহী চুরি করার মতো দ্রৌপদীকে জোর করে রথে চড়িয়ে নিলেন। দ্রৌপদী বেশি বাধা দিলেন না, ধস্তাধস্তি অথবা শারীরিক কুস্তাকুস্তির চেয়ে তিনি জয়দ্রথের রথে ওঠা অনেক বেশি সম্মানজনক মনে করলেন। কারণ, তিনি জানতেন যে, পাঁচ স্বামী পাঁচ দিকে শিকারে গেছেন—একজন না একজনকে ঠিক পাওয়া যাবে বনভূমির কোনও এক পথে। আর তখন জয়দ্রথের নিস্তার নেই।

পাণ্ডবরা খবর পেয়ে গেলেন দ্রৌপদীর এক পরিচারিকার কাছে এবং আরও সবিস্তারে ধৌম্য পুরোহিতের কাছে। ভীম এবং অর্জুন ছুটলেন জয়দ্রথকে ধরার জন্য। সঙ্গে নকুল-সহদেব এবং যুধিষ্ঠির। জয়দ্রথ সেনাবাহিনী নিয়ে এসেছেন বনে। কাজেই বেরতে তাঁর সময় লাগছে। জয়দ্রথ সেনা-বাহিনীর মাথার ওপর দিয়ে পঞ্চপাণ্ডবের রথের ধ্বজা দেখতে পেলেন। যেন কিছুই হয়নি, এমন একটা ভঙ্গিতে জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে বললেন—পাঁচখানি রথ চোখে পড়ছে কৃষ্ণা। মনে হচ্ছে, তোমার স্বামীরা এল বুঝি—মন্যে চ কৃষ্ণে পতয়স্তবৈতে। তুমি একটু চিনিয়ে দেবে—কে কেমন, কী তাদের পরিচয়।

দ্রৌপদী বললেন—পরিচয়? মরবার ফন্দি করেছ এতক্ষণ, এখন পরিচয় দিয়ে কী হবে—কিং তে জ্ঞাতৈ মূঢ়, অনায়ুষ্যং কর্ম কৃত্বাতিঘোরম্। তবে কিনা মুমূর্ষ লোকের শেষ ইচ্ছেতে বাধা দেব না। বলাটা আমার ধর্ম, তাই বলছি—আখ্যাতব্যং ত্বেব সর্বং মুমুর্ষো/ময়া তুভ্যং পৃষ্টয়া ধর্ম এষঃ। দ্রৌপদী পরিচয় দিতে আরম্ভ করলেন। যুধিষ্ঠির মহারাজের পরিচয় দেওয়া শেষ হল। এবার ভীমের কথা। দ্রৌপদী বললেন—ওই যে দেখছ—শালখুঁটির মতো চেহারা, ইয়া লম্বা দুটো হাত, রাগে ঠোঁট কামড়াচ্ছে বারবার, ভুরু দুটো কুঁচকে রয়েছে—ওই হচ্ছে আমার স্বামী বৃকোদর ভীম। ওর কাজকর্ম কোনওটাই মানুষের মতো নয়। মানুষ যা করতে পারে না, সেটা ও করতে পারে বলেই ওর ‘ভীম’ নামটি সার্থক। দ্রৌপদী এবার জয়দ্রথকে একটু অবহিত করে বললেন—মনে রেখো, ওর কাছে দোষ করে কারও আর বাঁচার আশা থাকে না। কেউ ওর সঙ্গে শত্রুতা করলে, ও সেটা জীবনে ভোলে না এবং শত্রুকে না মেরে ফেলা পর্যন্ত ওর মনে কোনও শান্তিও থাকে না—বৈরস্যান্তং সংবিধায়োপযাতি/পশ্চাচ্ছান্তিং ন চ গচ্ছত্যতীব—এমনকী মেরে ফেলার পরেও যে খুব শান্তি পায়, তা নয়, শত্রুর ছেলে, তার নাতি পর্যন্ত ওর মারণ-সীমার মধ্যে থাকে।

ভীমের সম্বন্ধে এমন মূল্যায়ন বোধহয় আর কেউ করেননি। করলেও হয়তো তা এত সঠিক হবে না। যাই হোক, যুদ্ধ বাধল। জয়দ্রথের আদেশমূলক নানা চিৎকার—অ্যাই! আটকে দাও, মারো এবার, তেড়ে এগিয়ে যাও—এরই মধ্যে ভীম হাতে তুলে নিয়েছেন তাঁর সোনা দিয়ে মিনে করা লোহার গদাখানি। জয়দ্রথের প্রধান বন্ধু কোটিকাস্য। তিনিই প্রথম দ্রৌপদীকে দেখে এসে দ্রৌপদীর রূপের বর্ণনা করেন জয়দ্রথের কাছে। সেই কোটিকাস্য ভীমের ওপর নানা অস্ত্র নিক্ষেপ করে বেশ কিছু সৈন্য নিয়ে পথ আটকালেন তাঁর।

ভীম অবশ্য চোখের সামনে ভিড়-ভাট্টা বেশি পছন্দ করেন না। নিমেষে গোটা কয়েক হাতি এবং চোদ্দো জন পদাতিক সৈন্য গদার বাড়িতে উড়িয়ে দিয়ে তিনি পৌঁছলেন কোটিকাস্যের কাছে। কোটিকাস্যের সারথিটিকে তিনি পিটিয়ে না মেরে একটি ধারালো ক্ষুরের সাহায্যে কুচ করে নামিয়ে দিলেন মাথাটা। ব্যাপারটা এত ‘স্মুদ্’ ছিল যে, কোটিকাস্য বুঝতেও পারলেন না কী হল—ন বুবোধ হতং সূতং স রাজা বাহুশালিনা। হঠাৎ করে রথ থেমে যাওয়ায় ভীম কোটিকাস্যের চুলের মুঠি ধরে এমন একখানা থাপ্পড় কষালেন যে, সেটাই তাকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে গেল। তারপর একটা সামান্য অস্ত্রের ছোঁয়ায় কোটিকাস্য দ্রৌপদীর রূপ বর্ণনার পরম ফল লাভ করলেন ভীমের কাছে।

বেগতিক দেখে জয়দ্রথ রথ থেকে নেমে দ্রৌপদীকে ছেড়ে দিলেন এবং ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় মারলেন পালানোর জন্য, কারণ এ অবস্থায় পালালেই একমাত্র বাঁচোয়া। দ্রৌপদীকে রথে চড়িয়ে নিলেন যুধিষ্ঠির। ওদিকে জয়দ্রথ পালালেন। ভীম কিন্তু কোনও দিকে না তাকিয়ে একের পর এক জয়দ্রথের সৈন্য শেষ করে যাচ্ছেন। মনে পড়ে তো—পাণ্ডবদের সেই প্রথম যুদ্ধের কথা। গুরুদক্ষিণার কারণে দ্রুপদের সঙ্গে যুদ্ধ। ভীম সেখানেও শুধু সৈন্য-শাতন করে যাচ্ছিলেন। সেই ‘অপরিশীলিত’ ক্ষাত্রশক্তির তাণ্ডব, যার প্রয়োজন অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিকভাবে প্রাসঙ্গিক। এখানেও ঠিক তাই চলছিল। ভীম মেরেই যাচ্ছেন, মেরেই যাচ্ছেন। এবং একসময় দেখা গেল—অর্জুন তাঁকে ডেকে বলছেন—যার অসভ্যতার জন্য আমরা কষ্ট পেলাম দাদা, সেই তো পালাল। তুমি শুধু শুধু এই নির্দোষ সৈন্যগুলিকে মেরে যাচ্ছ, তুমি তাকে খোঁজো—তমেবান্বিষ্ব ভদ্রং তে কিং তে যোধৈ র্নিপাতিতৈঃ।

সেই এক মোচড়। ‘ক্রুড’ ক্ষাত্রশক্তিকে ঠিক ঠিক খাতে বইয়ে দেওয়া। অর্জুনের চতুর্দিগ্দর্শী পরিশীলিত দণ্ডচালনার কাজই এই—প্রয়োজনে দণ্ডকে নির্মমভাবে ব্যবহার করা, প্রয়োজনে তাকে নিয়ন্ত্রণ করাও। অর্জুনের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে যে বিশাল শক্তি অকারণে ক্ষীণ হচ্ছিল, সেই শক্তির লক্ষ্য স্থির হয়ে গেল এক দিকে—জয়দ্রথকে ধরতে হবে। তবু এই বিপন্ন ত্বরিত মুহূর্তে—যে মুহূর্তে ভীমের অন্য কোনও কিছু খেয়াল থাকে না, যেমন মূল জয়দ্রথের পালানোটাই তাঁর চোখে পড়েনি—সেই মুহূর্তেও কিন্তু আরও গভীরতর এক অনুভূতি কাজ করছে ভীমের মধ্যে। আমি সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাই না।

অর্জুনের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ভীমের নজর পড়েছে দ্রৌপদীর দিকে। না, জয়দ্রথ তাঁকে নিয়ে পালাতে পারেনি। তিনি সুরক্ষিত রয়েছেন যুধিষ্ঠিরের রথে। ভীম আস্তে-ব্যস্তে যুধিষ্ঠিরের সামনে গিয়ে বললেন—যারা যুদ্ধ করতে এসেছিল, তারা মরেছে। অবশিষ্ট যারা আছে, তারা পালাতে ব্যস্ত। আপনি দ্রৌপদীকে নিয়ে নকুল-সহদেবের সঙ্গে আশ্রমে ফিরে যান। সেখানে গিয়ে চকিত-বিপর্যস্ত দ্রৌপদীকে আপনি সান্ত্বনা দিন—প্রাপ্যাশ্রমপদং রাজন্ দ্রৌপদীং পরিসাত্ত্বয়।

যেন এ কাজটা তাঁরই করার কথা ছিল। শুধু জয়দ্রথকে ধরে আনার ব্যস্ততায় এই কাজটুকু তাঁর করা হল না। বস্তুত আমরা দ্রৌপদীর প্রতি ভীমের এবং ভীমের প্রতি দ্রৌপদীর পারস্পরিক সরসতা পরিমাপ করতে বসেছি। শৃঙ্গার-রস এখানে গৌণ হলেও বীর-রসের প্রাঙ্গণেও সে যেহেতু উঁকি দিয়ে গেছে, তাই সেটা না বললে ভীমের মতো যুদ্ধবীরের এই লঘুতা সপ্রমাণ তো হয়ই না, সদর্থক তো নয়ই। বরঞ্চ এই সাংঘাতিক মুহূর্তে ভীমের এই লঘুতাই প্রমাণ করে—দ্রৌপদীর জন্য তিনি কতটা আচ্ছন্নবোধ করেন মনে মনে। জয়দ্রথের অভব্যতায় দ্রৌপদীর মতো ক্ষত্রিয় রমণীর হৃদয় কতটা আতপ্ত হয়ে উঠতে পারে—সেটা ভীম যথেষ্টই জানেন। আর জানেন বলেই দ্রৌপদীকে আশ্রমে নিয়ে গিয়ে যে সান্ত্বনাটা তিনি যুধিষ্ঠিরকে দিতে বললেন, সেটাই তিনি বুঝিয়ে দিলেন ব্যঞ্জনায়। দ্রৌপদীকে এই সান্ত্বনা যুধিষ্ঠির দিতে পারবেন না বলেই ভীম নিজেই সেটা দ্রৌপদীকে শুনিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন—আপনি দ্রৌপদীকে নিয়ে ফিরে যান। বেঁচে থাকলে ওই মাথামোটা জয়দ্রথ আমার হাত থেকে মুক্তি পাবে না—ন হি মে মোক্ষতে জীবন্ মূঢ়ঃ সৈন্ধবকো নৃপঃ। ও যদি পাতালেও গিয়ে লুকিয়ে থাকে, যদি দেবরাজ ইন্দ্রও তার রথের সারথি হয়ে রথ চালিয়ে নিয়ে আসেন জয়দ্রথকে, তবু সে বাঁচবে না।

ভীম কথাটা বলেছিলেন দ্রৌপদীকে শুনিয়ে যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে। এবারে ভীমের কথা শুনে দুজনেরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া আমার লক্ষ করব। ভীমের মারণ-পণ বক্তব্য শুনে যুধিষ্ঠির বলে উঠলেন—না বাপু! আর যাই করো প্রাণে মেরে ফেলো না দুরাত্মা জয়দ্রথকে। ভেবে দেখো—ভগিনী দুঃশলা বিধবা হবে। আর ভেবো জননী গান্ধারীর কথা।

যুধিষ্ঠিরের কথা শেষ হতে না হতেই দ্রৌপদী ফেটে পড়লেন। তাঁর বক্তব্য তিনি ভীমকেই শোনালেন—ভীমম্ উবাচ ব্যাকুলেন্দ্রিয়া—কারণ, তিনি জানেন—তিনি যা চাইবেন, ভীম তাই করবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে ভীমের সঙ্গে যেহেতু অর্জুনও আছেন—যে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের ভাই শুধু নয়, শিষ্যও বটে, অতএব অর্জুনকেও জড়িয়ে নিতে হল ভীমের সঙ্গে। দ্রৌপদী বললেন—আমার প্রিয় কাজ যদি করতে চাও, তাহলে একেবারে শেষ করে দেবে পুরুষাধম জয়দ্রথকে—কর্তব্যং চেৎ প্রিয়ং মহ্যং বধ্যঃ স পুরুষাধমঃ। যে একজনের বউকে তুলে নিয়ে যায়, যে নাকি রাজার ধন চুরি করে, সে যদি বিপাকে পড়ে তার জীবন ভিক্ষেও চায়, তবুও তার মুক্তি হওয়া অনুচিত।

দ্রৌপদীর কথা শুনে ভীম চললেন, অর্জুনও চললেন জয়দ্রথকে ধরতে। এক ক্রোশ যেতে না যেতেই জয়দ্রথকে পাওয়া গেল। তাঁর ঘোড়া জখম হয়েছে, তিনি পায়ে হেঁটে পালাচ্ছেন। অর্জুন বললেন—তিষ্ঠ জয়দ্রথ! ফিরে এসো এখানে, পালিয়ে যাবার চেষ্টা কোরো না। তুমি এই বীরত্ব নিয়ে কী করে একজন স্ত্রীলোককে কামনা কর?

ভীম দেখলেন—ভদ্রাভদ্র শব্দের অপমান-ব্যঞ্জনায় জয়দ্রথ মোটেই ফিরবে না। তিনি তখন—অ্যাই দাঁড়া বলছি, যাচ্ছিস কোথায় কথার উত্তর না দিয়ে—এই ভঙ্গিতে সোজা তাড়া করলেন জয়দ্রথকে—তিষ্ঠ তিষ্ঠেতি তং ভীমঃ সহসাভ্যদ্রবৎ বলী। অর্জুনের কোনও অপেক্ষা না করে ভীম তাড়া করলেন জয়দ্রথকে আর ভীম তাড়া করলেন মানেই সেখানে কী ঘটবে কেউ বলতে পারে না। কারণ ভীমের শত্রুতা পরপক্ষকে মৃত্যুর শাস্তি না দিয়ে শেষ হয় না। অতএব ভীম ছোটা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই পরিশীলিত দণ্ডধরের মুখ থেকে শেষ সাবধান-বাণী উচ্চারিত হল—দাদা! একেবারে মেরে ফেলো না কিন্তু—মা বধীরিতি।

ভীম ছুটে গিয়ে জয়দ্রথের চুলের মুঠি ধরলেন। এবার তাকে মাটিতে ফেলে একেবারে পিষে দিলেন হাতের চাপে। মারামারির সময় ভীম শত্রুকে একটু-আধটু ছেড়ে দেন। কেন না ছেড়ে দিলে পুনরায় মারার গতিটা দ্বিগুণতর হয়। জয়দ্রথ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আবার যেই উঠতে যাবেন—পুনঃ সঞ্জীবমানস্য তস্যোৎপতিতুমিচ্ছতঃ—অমনই তাঁর মাথার ওপর ভীমের লাথি পড়তে লাগল। তারপর জয়দ্রথকে মাটিতে ফেলে তার পেটে হাঁটুর গোত্তা চালালেন খানিকক্ষণ, মুখের ওপর পড়ল ঘুসির পর ঘুসি—তস্য জানু দদৌ ভীমো জঘ্নে চৈনমরত্মিনা।

এই ধরনের ‘অ্যাকশন সিন’ আপনারা হিন্দি সিনেমায় অনেক দেখেছেন। তবে ভীমের এই মারগুলো কিন্তু একেবারে নীতিশাস্ত্র-ছাঁকা মার। নীতিশাস্ত্র বলে—ক্ষত্রিয় যদি অন্যায় করে, তবে তাকে চার কিসিমে মারতে হবে। আবার ওই ক্ষত্রিয়ই যদি পরের বউ তুলে নিয়ে যাবার মতো অন্যায় করে, তবে মারের কিসিম হবে পাঁচ রকম। ভীম ঠিক সেই ভাবেই মারের ব্যাকরণ মেনে প্রত্যেকটি মার দিয়েছেন জয়দ্রথকে—

বামপাণি-কচোৎপীড়া ভূমৌ নিষ্পেষণং বলাৎ।

মূর্ধ্নি পাদ-প্রহরণং জানুনোদরর্মদনম্।

মালুরাকারয়া মুষ্ট্যা কপোলে দৃঢ়তাড়নম্॥

অর্থাৎ বাঁ হাতে চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানো, মাটিতে ফেলে ঘষা, মাথায় লাথি, পেটে হাঁটুর গোত্তা এবং মুখে ঘুসি—পরের বউ-তোলা ক্ষত্রিয়াধমের এই হল ‘স্পেশাল’ মার। ভীম তাই করেছেন। জয়দ্রথ মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তবু ভীমের মার থামছে না। অর্জুন বললেন—দাদা! যুধিষ্ঠিরের কথা মনে আছে তো? এবার থামো। ভগিনী দুঃশলার কথাটা মাথায় রাখো একটু।

অর্জুন জানেন—জয়দ্রথ যা করেছেন, তাতে ভীমের হাতে এই বেদম মার তাঁর প্রাপ্য। কিন্তু চরম দণ্ড দিতে গেলেও দণ্ডনীতির নিয়মে দোষী ব্যক্তির পাত্রত্ব বিচার করতে হয়। সুনিয়ন্ত্রিত রাজশক্তি যুধিষ্ঠির-অর্জুনের মতো নেতার মাধ্যমেই প্রকটিত হয় বলেই দোষীর পাত্ৰাপাত্র-জ্ঞান তাঁদের স্মরণে থাকে। অর্জুন তাই ঠিক সময়ে ভীমকে বলেছেন—দাদা! মহারাজ যুধিষ্ঠির যেমনটি বলেছিলেন—ভগিনী দুঃশলার কথা মনে রেখো। এবার ছেড়ে দাও—দুঃশলায়াঃ কৃতে রাজা যত্তদাহেতি কৌরব।

অর্জুন ‘দাদা যুধিষ্ঠিরে’র কথা বললেন না, ‘রাজা যুধিষ্ঠিরে’র কথা বললেন। উত্তেজনার এই চরম মুহূর্তে বাধা-বন্ধহীন, লাগামছাড়া, মোটা দাগের ক্ষাত্রশক্তিকে সুচিন্তিত রাজশক্তির দ্বারা আবারও নিয়ন্ত্রিত করা হল। এবং তা করলেন অর্জুন। ভীম মোটেই খুশি হলেন না। খুশি হলেন না, কারণ রাজার আদেশে নয়, অর্জুনের তর্কযুক্তিতেও নয়, তিনি জয়দ্রথকে ধরতে এসেছেন শুধু দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য। দ্রৌপদী বলে দিয়েছেন—যদি আমার প্রিয় চাও, তবে একেবারে শেষ করে দেবে ওটাকে—বধ্যঃ স পুরুষাধমঃ।

দ্রৌপদী যা বলেছিলেন, ভীম ঠিক তাই করছিলেন। অতএব সেই চরম উত্তেজনার মুহূর্তে অর্জুন তাঁকে বাধা দেওয়ায় ভীমের অসম্ভব রাগ হয়ে গেল। তিনি বললেন—আমার হাত থেকে আজ এই বদমাশের রেহাই নেই। ও কৃষ্ণা দ্রৌপদীর সঙ্গে অসভ্যতা করেছে, আমার হাত থেকে ও ছাড়া পাবে না—নায়ং পাপসমাচারো মত্তো জীবিতুমর্হতি। ভীম এ-কথা বললেও যুধিষ্ঠির অথবা অর্জুনের ধীর-গম্ভীর নির্দেশটুকু তিনি উড়িয়ে দিতে পারলেন না। একদিকে চরম ক্রোধ, অন্যদিকে ‘নামিল আদেশ’। একেবারে নিরুপায় হয়ে তিনি নিজের চুল ছেঁড়ার মতো করে বলে উঠলেন—কী যে করি? আমাকে কি তোমরা কিছুই করতে দেবে না। ওদিকে ওই এক রাজা, সব সময় তিনি দয়া দেখাচ্ছেন—যদ্রাজা সততং ঘৃণী—আরেক দিকে আছে তোমার মতো কতগুলো বোকা-বুদ্ধ, যারা সব সময় আমাকে আটকে রাখছ—ত্বঞ্চ বালিশয়া বুদ্ধ্যা সদৈবাস্মান্ প্রবাধসে।

তবু ভীম অর্জুনের কথাটা একেবারে উলটে দিতে পারলেন না। রাগের চোটে তিনি জয়দ্রথের টেরি-কাটা মাথার পাঁচটি জায়গায় অর্ধচন্দ্র বাণের ক্ষুর দিয়ে চেঁছে দিলেন। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে এটা মাথা ন্যাড়া করে ঘোল ঢালার চেয়েও অনেক বেশি অপমান। মাথার চুল চেঁছে দিয়ে ভীম এবার খানিকটা গালাগালি দিয়ে জয়দ্রথকে বললেন—তোর বাঁচার উপায় আছে একটাই। তুই সবার মধ্যে নিজের পরিচয় দিবি—পাণ্ডবদের দাস বলে। যদি তাই করিস, তবেই শুধু প্রাণে বাঁচবি, নইলে নয়।

জয়দ্রথ রাজি হলেন। তখন ভীম তাঁকে রথে চাপিয়ে নিয়ে চললেন যুধিষ্ঠিরের কাছে, কারণ সেখানে দ্রৌপদীও আছেন। জয়দ্রথের অবস্থা দেখে যুধিষ্ঠির আর কী করেন। ভীমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন—এবার ছেড়ে দাও ভাই। ভীম বললেন—উহু আপনার কথায় একে ছাড়ব না, আপনি দ্রৌপদীকে জিজ্ঞাসা করুন—দ্রৌপদ্যাঃ কথ্যতামিতি। তাঁকে বলুন—এ ব্যাটা এখন আমাদের দাস হয়ে গেছে। যুধিষ্ঠিরের ব্যক্তিত্ব মান-মর্যাদার ঢং একটু আলাদা। তিনি দ্রৌপদীকে কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। শুধু আরও মধুর করে ভীমকে বললেন—আমাদের যদি কোনও মূল্য থাকে তোমার কাছে, তবে জয়দ্রথকে এবার ছেড়ে দাও—মুঞ্চেমম্ অধমাচারং প্রমাণা যদি তে বয়ম্।

যুধিষ্ঠিরের এই ভাষা থেকে প্রমাণ হয়ে যায়—ভীম শুধু দ্রৌপদীর কথারই মূল্য দিচ্ছিলেন। বিদগ্ধা দ্রৌপদী দেখলেন—ব্যাপারটা এখন অন্য দিকে গড়াচ্ছে। একরোখা ভীম দ্রৌপদীর কথার মূল্য দিতে গিয়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রায় অপমানই করে ফেলেছেন। এই অবস্থায় যদি দ্রৌপদীও গোঁ ধরে বসে থাকেন, তাহলে যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন রীতিমতো আহত বোধ করবেন। ভীমের ভালবাসার উগ্রতাও তাতে বড় বেশি প্রকট হয়ে উঠবে। এককভাবে ভালবাসার এই প্রকট প্রকাশ তাঁকে অস্বস্তিতেও ফেলে দেবে। বিশেষত যুধিষ্ঠির যেভাবে বলেছেন, তারপরেও যদি ভীম তাঁর কথা না শোনেন, তবে তার দায় আসবে দ্রৌপদীর ওপরেই।

অতএব যুধিষ্ঠির যেই বললেন—আমাদের কথার যদি কোনও মূল্য থাকে—প্রমাণা যদি তে বয়ম্—সঙ্গে সঙ্গেই দ্রৌপদী আর ভীমকে কথা বলতে দেননি। তিনি তাঁর পূর্বের আদেশ প্রত্যাহার করে ভীমকেই বলেছেন—ছেড়ে দাও ভীম। লোকটা তো আমাদের দাসত্ব স্বীকারই করেছে। আর, তা ছাড়া ওর মাথার পাঁচ জায়গায় ন্যাড়া করে দিয়ে ক্ষত্রিয়ের অপ্রাপ্য চরম অপমানও ওকে করা হয়েছে।

দ্রৌপদী কথাটা বললেন ভীমকে, কিন্তু সেটা বললেন, যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে—দ্রৌপদী চাব্রবীদ্ ভীমম্ অভিপ্রেক্ষ্য যুধিষ্ঠিরম্। ভাবটা এই—যুধিষ্ঠির! তুমি যে আমাকে না পুছেই নিজেদের মূল্যে জয়দ্রথকে ছেড়ে দিতে বললে তাতে মোটেই কাজ হবে না, যদি না আমি ভীমকে অনুরোধ করি। অর্থাৎ আমি বলছি ছেড়ে দিতে, তাই ভীম তাঁকে মুক্তি দিচ্ছে, তোমার কথায় কিছু হচ্ছে না।

বস্তুত দ্রৌপদী জয়ী হলেন। বড় দাদার ওপর যথেষ্ট ভক্তিশ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও আরও গভীরতর এক প্রেমে ভীম যে বলেছিলেন—তুমি বললে হবে না, দ্রৌপদীকে জিজ্ঞাসা কর—দ্রৌপদ্যাঃ কথ্যতামিতি—এই অতিক্রমটুকু দ্রৌপদীকে আবারও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিল যে, অন্তত পঞ্চস্বামীর একতম এক বীর তাঁর অঙ্গুলী-সংকেতে চলবেন। দ্রৌপদীর ওপর ভীমের সপ্রেম পক্ষপাত এই ঘটনা থেকে এতটাই প্রকট হয়ে পড়ে যে, এখন আর সেটা মহাভারতের কবির শব্দব্যুহ ভেদ করে পদে পদে দেখিয়ে দিতে হবে না।