ভীম – ১২

১২

দুর্যোধনের মৃত্যুর অব্যবহিত আগে এবং পরে ভীম বহুতর তীক্ষ্ণ ভাষায় তাঁর আক্রোশ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ঠিক এক্ষুনি যে কথাটা ভীমের মুখে আমরা শুনলাম, তার মধ্যে দু’টি কথা আমি খুব জরুরি বলে মনে করি। এক, পাণ্ডবদের হাতে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা নিহত হয়েছেন; দেখো। দুই, যাজ্ঞসেনীর তপস্যায় পাণ্ডবদের হাতে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা নিহত হয়েছেন, দেখো।

মনে রাখা দরকার, ভীম যে দুর্যোধনের মাথাটা পা দিয়ে ঘষে দিয়েছিলেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তা অনুমোদন করেননি। তাঁর মায়ার শরীর, তিনি অসীম দয়ালুতায় ভীমকে বলেছিলেন—এত অপমান কোরো না ভীম, হাজার হলেও তিনি রাজা, আমাদের জ্ঞাতি, জনসমাজে তাঁর একটা সম্মান আছে—ইত্যাদি ইত্যাদি। ভীম থেমেছিলেন ঠিকই, কিন্তু আমাদের মনে হয়—সদা ক্রোধী, ক্ষমাহীন ভীমের দিক থেকে এই ব্যবহার কতটাই বা অন্যায় ছিল! একজন ব্যক্তি হিসেবে যদি বিবেচনা করেন, তবে দেখবেন—দুর্যোধনের অবিচার, অন্যায়, অত্যাচার, ভীম কতটা সহ্য করেছেন, আর যুধিষ্ঠিরই বা কতটুকু? যে বয়সে ভীমকে বিষ খাইয়েছিলেন দুর্যোধন, যেভাবে বারণাবতের ভার ভীমকে বইতে হয়েছিল, যেভাবে যুধিষ্ঠির ভাইদের পণ রেখে পাশা খেলেছিলেন, যেভাবে দ্রৌপদীকে রাজসভায় অপমানিত হতে হয়েছিল, এবং যেভাবে একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে অঙ্গভঙ্গি করে কৌরবরা ভেঙিয়েছিলেন, তাতে একজন সম্মানী লোকের পক্ষে দাদাকে অতিক্রম করাটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু তবু তিনি অতিক্রম করেননি। নিজের সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস এবং অহংবোধ থাকা সত্ত্বেও কারও কাছে যদি তিনি বিনত থেকে থাকেন, তো সে ব্যক্তি যুধিষ্ঠির। কিন্তু এও তো ঠিক যে, বছরের পর বছর যুধিষ্ঠিরের ব্যক্তিত্বে নিজেকে দমন করা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত ক্রোধগুলি তার জমেই ছিল। দুর্যোধনকে নিজে হাতে মেরে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত আক্রোশটুকুই শুধু মিটিয়ে নিয়েছেন তাঁর মাথায় বাম চরণ তুলে দিয়ে।

কিন্তু পরের মুহূর্তেই ভীম জানেন যে, এই বিশাল যুদ্ধ তিনি একা জেতেননি। প্রত্যেক পাণ্ডবভাইয়ের এখানে অবদান আছে এবং ‘টোটালিটি’ দিয়েই সেই যুদ্ধের বিচার করা যায়। উপরন্তু দ্রৌপদী শুধু তাঁর একার স্ত্রী নন, প্রত্যেক পাণ্ডবের সেখানে সমান অধিকার। দৈবাৎ দুর্যোধনের সঙ্গে এই শেষ যুদ্ধ তাঁরই মাধ্যমে শেষ হল, কিন্তু তিনি নিজে তার ক্রেডিট নিতে চান না। সম্পূর্ণ জয় তাই তিনি উৎসর্গ করেছেন পাণ্ডবদের নামে এবং সেই জয়ের কারণ হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন এক ক্ষত্রিয়াণীর সাধনাকে, অলৌকিক ভাষায় যার নাম দ্রৌপদীর তপস্যা। দ্রৌপদীর সাধনার মূর্তিময় সাধন হলেন ভীম। কৌরবদের নিগ্রহে ভীম যে ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, সে তাঁর ব্যক্তিগত ক্রোধের জন্য যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁর ভাইদের জন্য এবং তার থেকেও বেশি দ্রৌপদীর জন্য। ভীমের বক্তব্যে বার বার দেখা যাবে যে, তিনি তাঁর নিজের কারণে যতটা ক্ষুব্ধ, তার চেয়ে শত-গুণ বেশি ক্ষুব্ধ হন দাদা যুধিষ্ঠিরের অপমানে এবং ততোধিক, তাঁর প্রিয়া দ্রৌপদীর অপমানে।

ভীমের চরিত্র-আলোচনার শেষ পর্বে এসে আবারও আমাদের দ্রৌপদীর কথাই স্মরণ করতে হবে। দ্রৌপদী, দ্রৌপদী এবং দ্ৰৌপদী। সেই সভাপর্বের প্রথম থেকে আমরা ভীমের মধ্যে দ্রৌপদীর চির ভক্তটিকে দেখতে পেয়েছি। আজ এই যুদ্ধ-পর্বের শেষে এসে ভীমকে আরও একবার দ্রৌপদীর ইচ্ছা-পূরক এক পুরুষ হিসেবে দেখতে পাব।

অশ্বত্থামা পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধের জন্য দুর্যোধনের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সে প্রতিজ্ঞা আরও একবার তিনি ঝালিয়ে নিলেন মৃত্যুপথযাত্রী ভগ্ন-ঊরু দুর্যোধনের সামনে। পাণ্ডবদের শিবিরে যখন জয়ের উল্লাস চলছে, ঠিক তখনই রাতের অন্ধকারে তিনজন মহারথী স্বার্থ সাধনের তাড়নায় ব্রেরিয়ে পড়লেন পাণ্ডব-শিবিরের উদ্দেশ্যে। রাত আরও ঘনিয়ে এল। সুখসুপ্ত হলেন পাঞ্চালের রাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী এবং দ্ৰৌপদীর পুত্রেরা। অশ্বত্থামা বিনা দ্বিধায় পাণ্ডব-শিবিরে প্রবেশ করে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র এবং সমস্ত পাঞ্চালদের মেরে রেখে এলেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে দুর্যোধন বড় সুখী হলেন এই সংবাদ পেয়ে। বংশে বাতি দিতে পাণ্ডবদের কেউ রইল না—এই যা তাঁর শান্তি।

অশ্বত্থামার চক্রান্তে সমস্ত পাণ্ডব-শিবির বিহ্বল হয়ে পড়ল। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর মনের কথা ভেবে শঙ্কিত হলেন। নকুলকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন বিরাটরাজার নগরী থেকে দ্রৌপদীকে নিয়ে আসতে। প্রিয় পুত্রদের মৃত্যু সংবাদ শুনে দ্রৌপদী আর স্থির থাকতে পারলেন না। বিশেষত যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে প্রায় মাটিতে পড়ে যাবার মতো হলেন। অশ্বত্থামার ব্যবহারে ভীম ক্রোধে আরক্ত হয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন। দ্রৌপদীকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে তিনি এক লাফে গিয়ে দ্রৌপদীকে ধরে ফেললেন—বাহুভ্যাং পরিজগ্রাহ সমুৎপত্য বৃকোদরঃ। দ্রৌপদী ঢলে পড়লেন ভীমের কোলে। ভীম তাঁকে অনেক সান্ত্বনা দিলেন, অনেক বোঝালেন। কিন্তু দ্রৌপদীর মতো এক ক্ষত্রিয়াণীর পুত্রশোক ধর্মপ্রবচনে শান্তি লাভ করে না। উপযুক্ত প্রতিহিংসার মধ্যেই এই শোকের তবু কিছু শান্তি।

দ্রৌপদী প্রকৃতিস্থা হয়েই যুধিষ্ঠিরকে বললেন—তুমি যদি সবিক্রমে অশ্বত্থামার জীবন না হরণ করো অথবা যদি কোনওক্রমে এই পাপিষ্ঠ বেঁচে থাকে, তবে আমি এই তোমার সামনে উপোস করে মরব। যুধিষ্ঠির সামান্য এটা-ওটা বোঝানোর চেষ্টা করলেন- হ্যাঁ অশ্বত্থামা পালিয়ে গেছে, বড্ড দূর সেই পথ, দুর্গম বনের মধ্যে কোথায় তাঁকে খুঁজব—ইত্যাদি, ইত্যাদি। দ্রৌপদী বললেন—ওসব বুঝি না। শুনেছি অশ্বত্থামার মাথায় তার জন্মের সময় থেকেই একটি সহজাত মণি আছে, তুমি ওই পাপিষ্ঠকে মেরে ওই মণি এনে দেবে আমাকে এবং সেই মণি আমি তোমার মাথায় দেখব, তবেই আমি বাঁচব, নইলে নয়—জীবেয়মিতি মে মতিঃ।

দ্রৌপদী দেখলেন—ধর্মপুত্রকে বেশি বলে লাভ নেই। তিনি নানান সুযুক্তি দেবেন আর চিন্তা করবেন, তার থেকে বরং তাঁর সাধনার সাধন ভীমকে ধরা ভাল। দ্রৌপদী যা বলবেন, তাই তিনি করবেন। অতএব দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে ছেড়ে ভীমকে বললেন—তুমিই শুধু আমাকে বাঁচাতে পারো, ভীম—ত্রাতুমর্হসি মাং ভীম। তুমিই ওই পাপিষ্ঠকে মেরে দেখাও, ঠিক যেমন ইন্দ্র মেরেছিলেন শম্বুরাসুরকে। শুধু এইটুকু বলেই দ্রৌপদী থামলেন না। বিপন্না রমণীর সমস্ত রমণীয়তার সঙ্গে বিদগ্ধতার মিশ্রণ ঘটিয়ে দ্রৌপদী ভীমের ওপর আবারও সেই আস্থা, সেই বিশ্বাস জ্ঞাপন করলেন, যে আস্থা এবং বিশ্বাস তাঁর অন্য পাণ্ডবস্বামীরা লাভ করেননি। দ্রৌপদী বললেন—কি সাধারণ, অবস্থায়, কি বিপদে, তুমি যেমন তোমার সমস্ত বিক্রম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারো—এমনটি দ্বিতীয় কেউ নেই—ন হি তে বিক্ৰমে তুল্যঃ পুমান্ অস্তীহ কশ্চন। করণাবতের জতুগৃহে যখন আগুন দেওয়া হয়েছিল, তখন তুমিই পাণ্ডবদের আশ্রয় ছিলে, হিড়িম্ব রাক্ষসকে বধ করার সময়েও সেই তুমি। আবার ওই বিরাটনগরে বদমাশ কীচক যখন আমার পিছনে লেগেছিল, তখন তুমিই সেই বিপদে থেকে আমায় রক্ষা করেছিলে, ঠিক যেমন ইন্দ্র তাঁর প্রিয়া পত্নী শচীদেবীকে সব সময় রক্ষা করেন—পৌলোমীং মঘবানিব। আজ সময় এসেছে, আবার তুমি অশ্বত্থামাকে মেরে নিজে সুখী হও—বিনিহত্য সুখী ভব। ‘তুমি সুখী হও’ মানে, আমি যেহেতু সুখী হব অতএব তুমি সুখী হবেই—দ্রৌপদী এটা ধরেই নিয়েছেন।

ভীমের বুকটা নিশ্চয়ই ফুলে উঠল। কৃষ্ণা-পাঞ্চালী যে শুধু যুধিষ্ঠিরকে তাঁর কথা জানিয়েই ছেড়ে দেননি, ভীমকে যে তিনি আলাদা করে এই নির্দিষ্ট কাজের জন্য চরম বিশ্বাসভাজন মনে করেছেন—এটা ভীমকে নিশ্চয় পুলকিত করেছে। যুধিষ্ঠির নয়, অর্জুন নয়, ভীমকে তিনি নিজের কাজের জন্য, নিজের ইচ্ছাপূরণের জন্য অদ্বিতীয় বলে মনে করেছেন। তা ছাড়া ‘শচীকে যেমন রক্ষা করেন ইন্দ্র’ এই কথাটি বলে ভীমের মর্যাদা এক মুহূর্তে শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন দ্রৌপদী। শচীর (যেমন ইন্দ্র, দ্রৌপদীর তেমনই ভীম—বিপৎ-ত্রাণের ব্যাপারে এই একতম অধিকার, এই একান্ত আস্থা ভীমকে বুঝিয়েছে যে, দ্রৌপদী যেন তাঁকেই একমাত্র ভরসা করার মতো স্বামী বলে মনে করেন। নিজেকে ভীম নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে দেবরাজ ইন্দ্রের সাজাত্যে অনুভব করেছেন। শচীকল্প দ্রৌপদী যেন তাঁর একার—ভীমের বুক ফুলে উঠল।

ভীম মহারাজ যুধিষ্ঠিরের আদেশের অপেক্ষা করলেন না। নকুলকে সারথি নিয়ে সোজা রথ হাঁকিয়ে দিলেন অশ্বত্থামার সম্ভাব্য গতিপথ লক্ষ্য করে। ভীম দ্বিতীয়বার কিছু ভাবলেন না, কিন্তু ভাববার মতো কিছু ছিল। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা যথেষ্ট অস্ত্রনিপুণ বটে, তবে তাঁর সংযম বস্তুটা বড় কম ছিল। মনের সংযম তাঁর যেমন কম, তেমনই অস্ত্র প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তাঁর সংযম ছিল না, বিশেষত মারণাস্ত্রের প্রয়োগে। সেকালের গুরুরা শিষ্যকে মারণাস্ত্রের প্রয়োগ শেখালে শতাধিকবার তার যথাযুক্ত প্রয়োগ সম্বন্ধে অবহিত করতেন। দ্রোণাচার্য অর্জুনকে ‘ব্রহ্মশির’ নামে এক ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র দিয়েছিলেন কিন্তু গুরুর এই অহৈতুকী কৃপা পুত্র হিসেবে অশ্বত্থামার সহ্য হয়নি। তিনিও পিতার কাছে এই অস্ত্রের জন্য বায়না ধরেছিলেন। স্নেহ প্রবল হওয়ায় দ্রোণাচার্য অশ্বত্থামাকে ওই মারণাস্ত্র দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু খুশি মনে দেননি—নাতিহৃষ্টমনা ইব। দ্রোণাচার্য তাঁর পুত্রের বুদ্ধি চাঞ্চল্যের খবর রাখতেন যথেষ্ট—বিদিতং চাপলং হ্যাসীদত্মজস্য মহাত্মনঃ—এবং সেইজন্যই তাঁকে এই অস্ত্রের প্রয়োগ সম্বন্ধে যথেষ্ট সাবধানও করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের স্বভাব বড় পালটায় না।

কিছু না ভেবে ভীমকে ছুটে যেতে দেখেই কৃষ্ণ ভয় পেলেন এবং অর্জুনকে নিয়ে ছুটলেন ভীমের পিছন-পিছন। কারণ অশ্বত্থামা যদি কোনওক্রমে সেই দিব্যাস্ত্র ব্রহ্মশির প্রয়োগ করেন তা হলে এক মুহূর্তে ভীম নিশ্চিহ্ন হবেন। ভীম রথ নিয়ে ছুটতে ছুটতে একসময় গঙ্গাতীরে দেখলেন—অশ্বত্থামা কৌপীন-টৌপীন পরে ব্যাসদেবের সামনে বসা ঋষিদের সঙ্গে বসে আছেন। ভীম তাঁকে দেখেই ‘দাঁড়া ব্যাটা, দাঁড়া’—এমনটি বলতেই অশ্বত্থামা ব্রহ্মশির তুলে নিলেন হাতে, কারণ অশ্বত্থামা কৃষ্ণ এবং অর্জুনকেও ভীমের পিছনে আসতে দেখেছেন।

এর পরের ঘটনা সবার জানা। অর্জুনও তাঁর ব্রহ্মশির ত্যাগ করলেন এবং মহর্ষি বেদব্যাস এবং নারদ এসে দাঁড়ালেন উভয়ের মাঝখানে। ঋষিদের অনুরোধে অর্জুন তাঁর অস্ত্র ফিরিয়ে নিলেন বটে কিন্তু অশ্বত্থামা তা পারলেন না। বেদব্যাস অশ্বত্থামাকে মাথার মণিটি দিয়ে দিতে বললেন তাঁর প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে। অশ্বত্থামা মণি দিতে বাধ্য হলেন এবং সেটি নিয়ে পাণ্ডবরা খুব তাড়াতাড়ি ফিরলেন দ্রৌপদীর কাছে। ভীম মণিটি হাতে নিয়ে দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললেন—এই নাও তোমার মণি—অয়ং ভদ্রে তব মণিঃ—তোমার পুত্রহস্তা পরাজিত। দ্রৌপদীর একটা কথায় ভীমের একটু অভিমান ছিল। আজকে দ্রৌপদীর কাছে তাঁর সমস্ত প্রতিজ্ঞা পূরণ করে ভীম সেই পুরনো কথাটা তুললেন। ভীম বললেন—কৃষ্ণ যখন সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে হস্তিনায় যাচ্ছিলেন, তখন তুমি দুঃখ করে বলেছিলে—‘আমার স্বামী নেই, আমার ছেলে নেই, এমনকী তুমিও নেই কৃষ্ণ’। আজকে দেখো—দুর্যোধনকে মেরে আমি আমার কথা রেখেছি। দুঃশাসন যখন মাটিতে পড়ে ছটফট করছিল, সেই অবস্থায় আমি তার রক্ত পান করেছি, আমি কথা রেখেছি।

এক নিঃশ্বাসে স্বামিত্বের এতগুলি প্রমাণ দিয়েও ভীমের মনে হল—দ্রৌপদী যে বলেছিলেন। অশ্বত্থামাকে মেরে তার মণি ছিনিয়ে আনবে তুমি। কিন্তু ব্যাসের মধ্যস্থতায় তাকে মারা তো হয়নি। দ্রৌপদী যদি আবারও রেগে যান? ভীম তাই—অশ্বত্থামা কতটা বিধ্বস্ত হয়েছেন, ক্ষত্রিয়ের ধর্মে কতটা লাঞ্ছিত হয়েছেন—সেগুলি বলে পরোক্ষে অশ্বত্থামার যে মৃত্যুই হয়েছে—সেটাই বোঝাতে চাইলেন। ভীম বললেন—অশ্বত্থামার কীর্তি একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি, দ্রৌপদী—যশো’স্য পাতিতং দেবি শরীরং ত্ববশেষিতম্‌—ওকে শুধু বাকি রেখেছি প্রাণে মারতে। নইলে, মণি তো কেড়েই নিয়েছি, উপরন্তু ওকে বাধ্য করেছি সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্র আমাদের সামনে মাটিতে নামিয়ে রেখে আত্ম-সমর্পণ করতে।

দ্রৌপদী ভীমের এই অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। বললেন—ঠিক আছে, ঠিক আছে, গুরুপুত্র গুরুই বটে। এই কাজটি করে দিয়ে তুমি অন্তত আমাকে আমার পুত্রদের কাছে ঋণমুক্ত হবার সুযোগ দিয়েছ। অশ্বত্থামার সঙ্গে যা ঘটেছিল, তাতে ভীমের থেকে অর্জুনের ‘ক্রেডিট’ই বেশি। কিন্তু এও ঠিক ভীম যদি দ্রৌপদীর কথা শোনামাত্র বেরিয়ে না পড়তেন, তাহলে যুধিষ্ঠিরের ঔদাসীন্যে অর্জুনও উদাসীন হয়ে পড়তেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে যে ঝড় বয়ে গেল পাণ্ডব-শিবিরে এবং পুত্রশোকে দ্রৌপদীর যে অবস্থা হয়েছিল, তা থেকে ভীমই তাঁকে উদ্ধার করেছেন এবং পরিশেষে তিনি যেন দ্রৌপদীর কাছে সেই স্বামিত্বের অধিকার দাবি করেছেন, যাতে দ্রৌপদী আর পাণ্ডববন্ধু কৃষ্ণকে ঠেটি ফুলিয়ে সাভিমানে না বলতে পারেন—আমার স্বামীরা নেই, এমনকী তুমিও নেই কৃষ্ণ! নইলে এমন পোড়া কপাল হয় আমার! কুঞ্চিত ভুরুতে কৃষ্ণের কাছে এই কথা বলার সময় দ্রৌপদীকে নিশ্চয় এতটাই সুন্দর দেখিয়েছিল যে, ভীম কি একটু ঈর্ষান্বিত বোধ করেছিলেন? আজ সবগুলি প্রতিজ্ঞা-পূরণের পর দ্রৌপদীর কাছে ভীম তাই সানুযোগে বলতে চেয়েছেন কী দ্রৌপদী! সত্যিই কি তোমার স্বামী নেই বলে মনে হচ্ছে?

আমরা আবারও দ্রৌপদীর অঞ্চলছায়া থেকে ভীমকে সরিয়ে আনব। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়ে যেতে মহাত্মা যুধিষ্ঠির হস্তিনায় চললেন ধৃতরাষ্ট্রকে সান্ত্বনা দেবার জন্য। পারস্পরিক সান্ত্বনার পর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন—ভীম কোথায়? তাকে তো দেখছি না? সরলমতি ভীম এগিয়েই যাচ্ছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে, কিন্তু কৃষ্ণ সেই সময় এক ঝটকায় তাঁকে সরিয়ে দিয়ে একটি লৌহ-ভীম এগিয়ে দিলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। দুর্যোধন এক সময়ে এই লোহার ভীমটি বানিয়ে তার ওপরে গদার বাড়ি মারার অভ্যাস করতেন। কৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভীমের ক্ষতি করার জন্যই ধৃতরাষ্ট্র তাঁর পুত্রহস্তা ভীমকে খুঁজছেন। ধৃতরাষ্ট্রের গায়ে অসাধারণ শক্তি ছিল এবং সেই শক্তিতে লৌহ ভীমও তিনি চূর্ণ করে ফেললেন। এই ঘটনার পর ধৃতরাষ্ট্রের মনে অবশ্য অনুশোচনাও হল। ভীমকে মেরে ফেলেছেন ভেবে তিনি কাঁদতেও আরম্ভ করলেন। কিন্তু এই ব্যবহার লোক-দেখানোও হতে পারে। কৃষ্ণ অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রকে সান্ত্বনা দিয়ে লৌহ-ভীমের কথা প্রকাশ করলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রও খানিকটা শান্ত হলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের এই ব্যবহারের একটা প্রভাব অবশ্যই ভীমের ওপর পড়েছিল এবং নানাভাবে এই বিরূপ ব্যবহারের প্রতিশোধ নিতে ভীম ছাড়েননি। আমি আসছি সে-কথায়।

ধৃতরাষ্ট্রের পর পাণ্ডবরা জননী গান্ধারীর মুখোমুখি হলেন। তাঁর শতপুত্রের হন্তা বলে এখানে ভীমের কিছু জবাবদিহিও করার ছিল। ভীমকে আমরা এই জননীর সম্মুখে অন্য এক রূপে দেখি। পুত্রশোকাতুরা এক জননীর হৃদয় তিনি এতটাই বুঝেছিলেন যে, দুর্যোধন-দুঃশাসনের মৃত্যু ভীমের মুখে অন্যতর একটা মাত্রা লাভ করে গান্ধারীর সামনে। গান্ধারী বলেছিলেন—দুর্যোধন ভীমের চাইতে গদাযুদ্ধে বেশি নিপুণ কিন্তু ভীম তাঁকে নাভির নীচে গদা মেরে যে অন্যায় করেছে, তাতে আমার বড় রাগ হচ্ছে—তন্মে কোপমবর্ধয়ৎ।

মুখ কাঁচুমাচু করে ভীম যখন গান্ধারীর সামনে এসে বললেন—অধর্মই হোক আর ধর্মই হোক, আমি দুর্যোধনের ঊরুতে আঘাত করেছি, সেটা ভয়ে এবং আত্মরক্ষার জন্য—আত্মানাং ত্রাতুকামেন ত্ৰাসাত্তত্র ময়া কৃতঃ। নইলে, ওপরে যেভাবে লাফিয়ে উঠে গদা বাগিয়ে ধরেছিলেন দুর্যোধন, তাতে ঊরুতে আঘাত না করলে ভীমের মৃত্যু ছিল অবধারিত। ভীম তাঁর কৃতকর্মের একটু অন্যরকম ব্যাখ্যা করেই গান্ধারীর হৃদয় জয় করেছেন। যে পুত্রের বীর্যবত্তা এবং নিপুণতা সম্বন্ধে মায়ের গর্ব ছিল গান্ধারীর মনে, সেই বীর্য এবং নিপুণতাকেই তার হত্যাকারী ভয় পেয়েছে এবং সেই ভয়ে সে অন্যায়ের আশ্রয় নিয়েছে—এই কথাটা পুত্রশোকাতুরা জননীকে যে খানিকটা সান্ত্বনা দেবে এটা ভীম বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন বলেই অথবা হয়তো বা গান্ধারীর মতো অমন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বলেই ভীম অকপটে স্বীকার করেছেন—এটা ঠিকই; তোমার ছেলেকে আমি ন্যায়-যুদ্ধে মারতে পারিনি। কিন্তু এমন কে আছে এই পৃথিবীতে, যে তাঁকে ন্যায় যুদ্ধে মারতে পারত? সেই জন্য আমিও অন্যায়ই করেছি—ন শক্যঃ কেনচিদ্ধন্তুমতো বিষমমাচরম্।

গান্ধারীর সামনে এই অকপট স্বীকারোক্তি ভীমের মাহাত্ম্য এখানে শতগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। অন্যদিকে লক্ষণীয় এই স্বীকারোক্তির সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুর্যোধনের সারা জীবনের অন্যায়, অত্যাচার এবং প্রবঞ্চনার ঘটনাগুলিও গান্ধারীর সামনে পুনরুক্তি করতে ছাড়েননি। ভীম তার প্রত্যেকটি অন্যায়ের উল্লেখ করেছেন আর বলেছেন—সেই জন্য আমি এই অন্যায় করতে বাধ্য হয়েছি—ততো বিষমমাচরম্। গান্ধারী যেহেতু নিজ পুত্রের গভীর অন্যায়গুলি সব জানেন, কাজেই ভীমের কথাগুলি তাঁর কাছে অগ্রাহ্য হয়ে যায়নি। ভীম তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন—তোমার ছেলে আমাদের সঙ্গে কত অভব্যতা করেছে, তা তো তুমি সবই জানো মা—ভবত্যা বিদিতং সর্বমুক্তবান্ যত সুতস্তব।

গান্ধারীও এই প্রত্যুত্তরের যোগ্য ব্যক্তি। ভীম অন্যায় স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝেছেন যে, ভয় এবং আত্মরক্ষার তাগিদেই ভীম এই অন্যায় করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেছেন—ঠিক আছে, এটা না হয় বুঝলাম। তা ছাড়া তুমি তো আমার ছেলের প্রশংসাই করছ—যৎ প্রশংসসি মে সুতম্। কিন্তু দুঃশাসনের ব্যাপারে তুমি কী বলবে? দুঃশাসনের বুক চিরে তুমি রক্ত খেলে রণক্ষেত্রে? এমন অনার্য ব্যবহার কেউ কোনওদিন করেছে? গান্ধারীর মন বুঝে ভীম যুক্তি দিলেন কী বলছ তুমি মা? অন্যের রক্ত তো কেউ খায়ই না, তাতে আবার নিজের রক্ত। আমার রক্তের সঙ্গে আমার ভাইয়ের রক্তের তফাত আছে কোনও—যথৈবাত্মা তথা ভ্রাতা বিশেষো নাস্তি কশ্চন? তা ছাড়া আমি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছি মাত্র। দুঃশাসনের রক্ত পান করা দূরের কথা, সে রক্ত আমার দাঁত বা ঠোঁটের নীচে যায়নি—রুধিরং ন ব্যতিক্রামদ্‌ দম্ভোষ্ঠা অম্ব মা শুচঃ। তা ছাড়া তোমার ছেলেরা চিরকাল আমাদের অপকার করার চেষ্টা করেছে, যদিও আমরা আগে কোনওদিন তাঁদের অপকার করিনি। এই অবস্থায় তুমি যখন তাঁদের বারণ করতে পারনি তখন শুধু তুমি আমার দোষটাই দেখছ—এটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে নান মার্মহসি কল্যাণি দোষেণ পরিশঙ্কিতুম্।

ভীমের এই যুক্তিটাও গান্ধারী স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু গান্ধারীর শেষ কথাটা ছিল অকাট্য এবং ভীমের সেখানে উত্তর দেওয়ার কিছু ছিল না। গান্ধারী অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে দেখিয়ে, করুণার প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন—ভীম! তুমি এই বৃদ্ধের একশোটা ছেলের মধ্যে অন্তত একজনকেও তো বাঁচিয়ে রাখতে পারতে। আমাদের রাজ্য চলে গেল, তাতে কিছু নয়, কিন্তু অন্তত একটা ছেলে বেঁচে থাকলেও তো সে আমাদের এই দুই বুড়োবুড়ির হাতের নড়ি হত-নাশেষয়ঃ কথং যষ্টিমেকাং বৃদ্ধ-যুগস্য বৈ। ভীম এ-কথার কোনও জবাব দিতে পারেননি। কারণ, এ–কথার কোনও উত্তর হয় না। গান্ধারী যে বৃদ্ধের প্রতি ভীমকে করুণা করতে বলেছিলেন, সেই বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি পছন্দ করতেন না মোটেই। তবুও একশোটার মধ্যে অন্তত একটি নিরীহ পুত্রকে তিনি প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন, যদিও তা তিনি পারেননি, এবং হয়তো সেটা ধৃতরাষ্ট্রের জন্যই।

সেই ছোটবেলা থেকে পাণ্ডবদের ওপর, বিশেষত ভীমের ওপর দুর্যোধন-শকুনিদের যে অত্যাচার হয়েছে, সেই অত্যাচারের সম্বন্ধে ভীমের ধারণা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। ভীম মনে করতেন—স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্র ইচ্ছে করলে কৌরবপুত্রদের অন্যায়গুলি বারণ করতে পারতেন। সেই বারণ তো তিনি করেনইনি, উপরন্তু দুর্যোধন-দুঃশাসনদের চক্রান্তের পিছনে স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ পক্ষপাত ছিল। পাণ্ডবদের নিজস্ব ঘরোয়া আলোচনায়, সভাগৃহের নানা তর্ক-যুক্তিতে ভীম বার বার ধৃতরাষ্ট্রের কুচক্রী ভাব প্রকাশ করেছেন। কথা-প্রসঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রকে—বুড়ো এই করেছে, সেই করেছে—বলতেও ভীমের কোনও দ্বিধা ছিল না। কাজেই গান্ধারীর ‘বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র’ ভীমের কাছে ‘কুচক্রী বুড়ো’ ছাড়া আর কিছুই নয় আর সেই বুড়োর একটি সন্তানও অবশিষ্ট রাখা মানে,—ভীমের কাছে চক্রান্তের শেষটুকু জিইয়ে রাখা। ভীম তা চাননি এবং সেই কারণেই গান্ধারীর শেষ বক্তব্যে তিনি সাড়া দেননি।

যুদ্ধ-বীরদের শ্রাদ্ধ-শান্তি সব মিটে গেলে পাণ্ডবদের কাছে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ালেন স্বয়ং পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির। শত শত মহাবীরদের মৃত্যু বরণ করতে দেখে যুধিষ্ঠিরের মন ভোগ-বিমুখ হয়ে উঠল। তিনি সিংহাসনে বসতেই চাইলেন না। এ অবস্থায় যিনি প্রথম মুখ খুললেন, তিনি ভীম। সমস্ত শত্ৰু-পাতন করার পর যুধিষ্ঠিরের এই রাজ্য-বিমুখতা তাঁর কাছে অতিনাটকীয়তা ছাড়া কিছু মনে হল না। তিনি সেই কথাগুলি আবারও যুধিষ্ঠিরকে বলতে আরম্ভ করলেন, যা একবার তিনি বলেছিলেন বনবাসে।

ভীম বললেন—তোমার বুদ্ধিটা একেবারে বোকার মতো; বেদ মুখস্থ করা বামুনদের মতো আমার বুদ্ধিটা একেবারে ভোঁতা হয়ে গেছে। রাজা হওয়ার ব্যাপারে তোমার যে এত অনীহা, এটা আসলে তোমার অলস স্বভাবের জন্য, অন্য কিছু নয়—আলস্যে কৃতচিত্তস্য রাজধম্মানসূয়তঃ। তা বাপু! তোমার এই জড় বুদ্ধির কথাটা আগে জানালেই পারতে, তা হলে আর আমরা কষ্ট করে যুদ্ধও করতাম না, এত সব লোকও মারা যেত না। সারা জীবন যেমন ভিক্ষে করে কেটেছে, তেমনই ভিক্ষে করেই এই জীবন কাটিয়ে দিতাম—ভৈক্ষমেবাচরিষ্যাম।

ভীম আবারও কৌরবদের অন্যায়ের প্রসঙ্গ তুলেছেন। তারা যে অন্যায়ভাবে পাণ্ডবদের রাজ্য কেড়ে নিয়েছিলেন, সে প্রসঙ্গও জানাতে ভোলেননি। হৃত রাজ্য নিজেদের বাহুবলে সম্পূর্ণ অধিকার করার পর আজকে যুধিষ্ঠিরের এই বৈরাগ্য-ভাব ভীমের কাছে পুরো ‘ন্যাকামি’র মত লাগছে। ভীম বললেন—তোমার ভাবটা কী রকম জানো? কুয়ো খুঁড়ে যারা জল পায় না, তারা যেমন গায়ে খানিকটা কাদা মেখে শেষে তৃপ্তি পায়, তুমিও সেই রকমই করছ। গাছে উঠে মধু না পেয়ে যারা গাছ থেকে পড়ে মরে, তোমার অবস্থাও সেই রকম। কামুক পুরুষ স্ত্রীলোক হাতে পেয়েও যদি ভোগ করতে না পারে, তাদের যেমন অবস্থা হয়, তোমার অবস্থাও সেইরকম।

ভীম খুব গালাগালি দিলেন যুধিষ্ঠিরকে। মনের সাধ মিটিয়ে গালাগালি দিলেন। এমনকী এটা বলতেও ছাড়লেন না যে,—আমরাই বোকা, শুধু শুধু আমরা তোমাকে দাদা বলে একটা বোকা বুদ্ধি লোকের পেছনে পেছন ছুটেছি—বয়মেবাত্ৰ গর্হ্যা হি যদ্‌ বয়ং মন্দচেতসম্। আমাদের শক্তি ছিল, বিদ্যা ছিল, বুদ্ধির গভীরতাও ছিল, কিন্তু তবু অক্ষম লোকের মতো এক নপুংসকের আদেশ পালন করে চলেছি—ক্লীবস্য বাক্যে তিষ্ঠামো যথৈবাশক্তয়স্তথা।

ভীম যুধিষ্ঠিরের পিঠোপিঠি ভাই বলেই বোধহয় এতটা বলতে পারেন। শত্রুতার গভীর পারাবার পার হয়ে এসে আজ নিজের লোকই অন্য সুরে কথা কইছে, ভীমের এই সব দ্বিমুখতা সহ্য হবার নয়। অতএব গালাগালি যা দিলেন, চরমভাবেই দিলেন। শুধু ভীম নয়, যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসন গ্রহণ করার জন্য অর্জুন, যমজ দু-ভাই এবং দ্ৰৌপদী—প্রত্যেকেই যথেষ্ট অনুরোধ করলেন। অবশ্য কাজ হল শুধু অর্জুন আর কৃষ্ণের জোরালো বক্তব্যে। যুধিষ্ঠির রাজা হলেন শেষ পর্যন্ত।

মানুষ যখন কষ্ট করে, ঈপ্সিত বস্তু পাবার জন্য জীবনভর সংগ্রাম করে, তখন তার মন একরকম থাকে। কিন্তু দীর্ঘ, অতিদীর্ঘ সংগ্রামের পর যদি বিজয় লাভ করা যায়, তবে একটা নির্বিঘ্ন-ভাব মনের মধ্যে আসে, যুধিষ্ঠিরেরও তাই এসেছিল। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মানসিক গঠন এবং ভীমের মানসিক গঠন এক নয়।

দ্রৌপদী একসময় বলেছিলেন—ভীম কখনও অপরাধ ক্ষমা করেন না। অপরাধী যদি নিহত হয়, তবে তার পুত্র-পৌত্র পর্যন্ত তাঁর ক্রোধের অনুভূতি জাগ্রত থাকে। যুধিষ্ঠির সিংহাসনে আরোহণ করার পর ভীম যথেষ্ট সুখেই ছিলেন। রাজার ঘরের খাবার-দাবার আর অনুপম ভোগ-বিলাস যখন ভীমকে বড় তৃপ্তি দিয়ে ফেলেছে, ভীম তখনও কিন্তু কৌরব পক্ষের সেই জীবিত বৃদ্ধটির ওপর তাঁর রাগ ভোলেননি। দুর্যোধনের পুত্র-পৌত্র সবই গতায়ু হওয়ার ফলে ভীমের সীমাহীন অক্ষমা এখানে ঊর্ধ্বগামী হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের ওপর গিয়ে পড়েছে। যুধিষ্ঠির অথবা অর্জুন-নকুলেরা হত পুত্র এবং হৃত রাজ্য ধৃতরাষ্ট্রকে পরম ক্ষমায়, আদরে এবং শ্রদ্ধায় নিজেদের অভিভাবকের মতোই সম্মান করতেন। এমনকী কুন্তী এবং দ্রৌপদী, যাঁরা নানাভাবে চরম লাঞ্ছনা লাভ করেছেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে, তাঁরাও কিন্তু একান্তভাবে বধূর কর্তব্য পালন করে গেছেন ধৃতরাষ্ট্রের সেবায়। কিন্তু ভীম এখানে বিরল ব্যতিক্রম। অথচ কী আশ্চর্য, গান্ধারীর ব্যাপারে ভীমের কিন্তু কোনও অভিযোগই ছিল না এবং আমরা দেখেছি—নিজেকে হীন করেও তাঁকে তিনি কীভাবে খুশি করার চেষ্টা করেছেন।

অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাঁর পুত্রদের রাজ্যশাসনকালে যত সুখে ছিলেন, তার চেয়ে বেশি সুখে ছিলেন যুধিষ্ঠিরের সময়। ভীম সর্বক্ষেত্রে দাদার কথা মেনে চলতেন বটে, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের ব্যাপারে মনে মনে তিনি সব সময় ক্ষুব্ধ থাকতেন এবং নিতান্ত অনিচ্ছায় যুধিষ্ঠিরের কথাও মানতেন—অম্ববর্তত সংক্রুদ্ধো হৃদয়েন পরাজুখঃ। উলটো দিক দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রও এই ক্রোধের ব্যতিক্রম নন। দুর্যোধনের কথা মনে হলেই ভীমকে তাঁর নিজের চরম শত্রু বলে মনে হত। ফলত পরস্পরে একটা মানসিক শত্রুতা দুজনেই নিয়ত বহন করতেন সমস্ত ভোগবিলাসের মধ্যেও।

ভীম ধৃতরাষ্ট্রের পূর্বের অন্যায়গুলি ভুলতে পারেন না। তার ওপরে সবার সামনে লৌহ-ভীম চূর্ণ করে ধৃতরাষ্ট্র যে আক্রোশ দেখিয়েছেন ভীমের ওপর, সেখানে ভীমের মতো ব্যক্তি যে ধৃতরাষ্ট্রের চরণ চুম্বন করে তাঁকে মস্তকে স্থান দেবেন—এ আশা ভীমের কাছে না করাই ভাল। ভীম মহামতি যুধিষ্ঠিরের আড়ালে সব সময় তাই করতেন, যা ধৃতরাষ্ট্র পছন্দ করেন না—অপ্রকাশন্যপ্রিয়াণি চকারাস্য বৃকোদরঃ। তা ছাড়া তখন যেহেতু রাজযন্ত্র পাণ্ডবদের হাতেই, অতএব নিজের দলের লোক দিয়েও তিনি ধৃতরাষ্ট্রের কাজ এবং আদেশের ব্যাঘাত করতেন। এর ফলে বুড়ো ধৃতরাষ্ট্র কখনও হয়তো বেড়াবার লাঠি খুঁজে পেতেন না, হয়তো কখনও তাম্বুল-বীটিকায় দুর্গন্ধ পেতেন, আবার হয়তো সুস্বাদু ফলের রস ভেবে নিম্ব-রসের মিশ্রণ সেবন করতেন। মোট কথা ভীম তাঁকে যুধিষ্ঠিরের আড়ালে সুস্থ থাকতে দিতেন না।

শুধু এটুকু হলেও হত। মহামতি ধৃতরাষ্ট্র হয়তো গান্ধারীকে নিয়ে রাজপ্রাসাদের অলিন্দে বসে পূর্বের সুখস্মৃতি চর্বণ করছেন। সেই সময় কোনও প্রাসাদ-স্তম্ভের আড়ালে বেশ দূরত্ব রেখেই সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে দাঁড়াবেন ভীম। ওই দূর থেকে তাঁর উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা যাবে এবং ধৃতরাষ্ট্রকে শুনিয়ে শুনিয়েই তিনি হাতের গুলিতে ফাঁপা শব্দ করবেন আর বলবেন—দেখেছিস তো এই মুগুরের মতো হাত দুটো, এই হাত দিয়েই আমি অন্ধ রাজার ছেলেগুলোকে যমের বাড়ি পাঠিয়েছি—অন্ধস্য নৃপতেঃ পুত্র ময়া পরিঘবাহুনা। আরে আমার এই চন্দন-মাখা হাত দুটোকে পুজো কর তোরা, এই হাতেই আমি সাবাড় করেছি দুর্যোধনকে আর তার পুরাণের বন্ধুদের।

ভীম এমনভাবেই কথাগুলি বলতেন, যাতে ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী তাঁর কথা ভালভাবে শুনতে পান—সংশ্রবে ধৃতরাষ্ট্রস্য গান্ধার্যাশ্চাপ্যমৰ্ষণঃ। ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে খুবই আঘাত পেতেন এসব কথায়, কিন্তু যুধিষ্ঠির এবং তাঁর অন্যান্য ভাইরা এতটাই ধৃতরাষ্ট্রের কথা মেনে চলতেন যে, যুধিষ্ঠিরের কাছে ভীমের সম্বন্ধে অভিযোগ করাটা যুক্তিযুক্ত মনে করেননি। অন্যদিকে যুধিষ্ঠিরের পক্ষে ঘুণাক্ষরেও এটা বোঝা সম্ভব হয়নি যে ভীম এই সব কাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর আড়ালে। পনেরো বছর এই ভাবে গেছে, কিন্তু ক্রমাগত ভীমের কথাগুলি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রহারা হৃদয়ে এতই বেশি করে বাজছিল যে, তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। ভীমের বাক্যবাণে পীড়িত হয়েই তিনি বানপ্রস্থ অবলম্বন করবেন বলে ঠিক করলেন—রাজা নির্বেদমাপেদে ভীম-বাক্‌বাণপীড়িতঃ। যুধিষ্ঠির অবশ্য আপন ধর্মবুদ্ধির কারণে এই বানপ্রস্থ-ধর্মে খুব বেশি আপত্তি করেননি, এবং একবারের তরেও তিনি ধারণা করেননি যে, ধৃতরাষ্ট্রের এই নির্বেদের কারণ স্বয়ং ভীম।

বানপ্রস্থে যাবার আগে ধৃতরাষ্ট্র তাঁর পূর্বজ ভীষ্ম, বাহ্লীক এবং অন্যান্য মৃত আত্মীয়-স্বজনদের শ্রাদ্ধ-শান্তি করে কার্তিক পূর্ণিমার দিন কিছু দান-ধ্যান করতে চেয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির অত্যন্ত খুশি হয়ে—যত টাকা দরকার, আপনি দয়া করে গ্রহণ করুন রাজকোষ থেকে—এই ধরনের উদারতা দেখিয়ে পুত্রহারা ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি মর্যাদার চূড়ান্ত করেছেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের বানপ্রস্থে যাবার সংকল্পও ভীমের ক্রোধ বিন্দুমাত্র লঘু করেনি। ধৃতরাষ্ট্রকে শ্রাদ্ধ করতে দিতেও তিনি রাজি ছিলেন না, দানধ্যান তো দূরের কথা। তিনি বলেছিলেন—ভীষ্ম, দ্রোণ—এঁদের শ্রাদ্ধ কার্য আমরাই করতে পারব—বয়ং ভীষ্মস্য দাস্যামঃ—কুন্তী কর্ণের শ্রাদ্ধ করতে পারবেন। ওঁর দরকার কী? উনি যেন কারও শ্রাদ্ধ না করেন—শ্রাদ্ধানি পুরুষব্যাঘ্র মা প্রাদাৎ কৌরবো নৃপঃ।

আসলে ভীম আগাগোড়াই নিজের ভাইবন্ধু-মা-বউ নিয়ে বড় সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর উদারতা যা ছিল, তাও এই পাণ্ডবসংসারের গণ্ডিকে ঘিরে। এমনকী যেদিন থেকে কর্ণকে তিনি নিজের ঘরের লোক বলে জানতে পেরেছেন, সেদিন থেকে, তাঁর ওপরেও তাঁর রাগ চলে গেছে। নিজের ভাই, নিজের স্ত্রী এবং অবশ্যই মায়ের জন্য এমন কোনও কষ্ট নেই যা তিনি করতে পারেন না। কিন্তু কোনওভাবেই তাঁর শত্রুপক্ষের একটি লোকও কখনও আনন্দে থাকুক—এ তিনি মোটেই চাইতেন না—মা নো নন্দন্তু শত্রবঃ! সেই যেদিন যুধিষ্ঠিরের কাছে দুর্যোধনের প্রথম চক্রান্ত, বিষ খাওয়ানোর কথা ভীম প্রকাশ করেছিলেন, সেদিনও যুধিষ্ঠির তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন—চুপ করো ভীম, এ সব কথা যেন কেউ শুনতে না পায়। আবার আজ যখন ধৃতরাষ্ট্রের শ্রাদ্ধ-শান্তির কথা শুনে তিনি পূর্বানুভূত বনবাসকষ্ট আর কৌরবদের তঞ্চকতার কথা তুললেন তখনও আবারও সেই যুধিষ্ঠিরের কাছে তাঁকে ধমক শুনতে হল—চুপ করো ভীম আর নয়—জোষমাস্কেতি র্ভৎসয়ন্।

বস্তুত ভীম তাঁর মনের মধ্যে বৈরিতা চেপে রেখে মহান হতে পারেন না, মহান হতে চানও না। ধৃতরাষ্ট্র তাঁর শেষ বয়সে পাণ্ডবদের অনুগ্রহে বেঁচে আছেন—পূর্ব শত্রুর এই পর-নির্ভরতাই যেখানে যুধিষ্ঠির বা অর্জুনকে শত্রুতা ভুলিয়ে দিয়েছে, ভীম কিন্তু শুধু এতেই সন্তুষ্ট নন। শত্রুর প্রতি কৃপা করার মহত্ত্ব থেকে, তারা কষ্ট পাচ্ছে—এই ক্ষুদ্র সুখেই ভীমের আনন্দ। আমরা ভীমের ব্যবহার সব সময় যে অনুমোদন করতে পারি, তা নয়, কিন্তু মা, ভাই এবং প্রিয়া পত্নীর জন্য তাঁর মতো কষ্টও কেউ করেননি। শত্রুতার বন্ধুর পথে হাঁটতে হাঁটতে যাঁরা এই বলবান ভাইটির কাঁধে উঠে পড়তেন মাঝে মাঝেই, শত্রুরা যাঁর অঙ্গ-ভঙ্গি নকল করে রসিকতা করে, বনবাসের শীত, গরম আর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যিনি ভাইদের আর স্ত্রীকে পাহারা দিতেন, তিনি আর যাই চান, মহৎ হতে চান না। বরঞ্চ পরিবারের প্রত্যেকটি লোক সুখী হয়েছে, খুশি হয়েছে—এই ক্ষুদ্র সরল আনন্দটুকুই তাঁকে আনন্দিত করে। যুধিষ্ঠির অথবা অর্জুনের বিশাল ত্যাগ এবং বিশাল মহত্ত্বের পরিবর্তে ভীম যা চাইতে পারেন, তা হল—গোগ্রাস-যোগ্য ভাল কিছু খাবার, পদ্মপাতার পাত্রে কড়া ধাতের কৈরাতক মদ্য, দ্রৌপদীর সামান্য কটাক্ষ, একখানি লৌহময়ী গদা, আর শত্রুর মাথায় লাথি মারার একটা সুযোগ। বাস্! ভীম এইটুকুই, এইরকম কোনও পঞ্চভূতেই ভীমের দেহ-মনের গঠন এবং তুষ্টি।