অর্জুন – ৮

আমরা যে মহাকাব্যিক পরিমণ্ডলের কথা বলেছিলাম, সেই নিরিখে আবার জানাই যে, দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় অর্জুনের কোনও সাময়িক প্রতিক্রিয়া নাই ঘটুক, কিন্তু নীরব অর্জুনের দিক থেকে এই লাঞ্ছনার ফল ছিল এতটাই ব্যাপ্ত যে, বনবাসের থেকেও এ-ঘটনা যেমন তাঁর কাছে গুরুতর ছিল, তেমনই কৌরবরাও কেবলই ভেবেছেন —আজ থেকে চোদ্দো বছর পর না জানি অর্জুন কী করে! একবার বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে সাবধান করে দিচ্ছেন, আরেকবার নারদ অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় জানাচ্ছেন—আজ থেকে চোদ্দো বছর পর কৌরবদের সর্বনাশ হবে। এই সাবধান-বাণী আর সাধারণ অভিসম্পাতের শেষে দুর্যোধনকে সমস্ত রাজনৈতিক সমস্যাটা বুঝিয়ে দিলেন মহামতি দ্রোণাচার্য। তাঁর মতে একদিকে যেমন দ্রৌপদীকে রাজসভায় টেনে নিয়ে আসাটাই ছিল কৌরবদের অন্যায়ের চরম বিন্দু, তেমনই অন্যদিকে এর ফল হিসেবে চোদ্দো বছর পর অর্জুনের প্রতিশোধ নেওয়াটাই ছিল শেষ কথা। তিনি ভয় পাচ্ছেন—আগমিষ্যতি বীভৎসুঃ—অর্জুন আসবেন। এই যে সব-কথার মধ্যে একবার করে শোনা যাচ্ছে—অর্জুন আসবেন—আগমিষ্যতি বীভৎসুঃ—একবার দ্রোণাচার্যের মুখে, একবার ধৃতরাষ্ট্রের মুখে-এর থেকে বোঝা যায়—সভাস্থলে পাঞ্চালী কৃষ্ণার অপমানে তিনি যতই নীরব থাকুন, তাঁর অন্তঃক্রিয়া ছিল এতই গভীর, এতই তীব্র যে প্রত্যেকে তাঁকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছেন—যেষাং যোদ্ধা সব্যসাচী কৃতাস্ত্রো, ধনুর্যেষাং গাণ্ডীবং লোকসারম্।

পাণ্ডবরা যখন বনবাসে দিন কাটাতে আরম্ভ করেছেন, সেই সময়ে কৃষ্ণ একদিন এসে উপস্থিত হলেন পাণ্ডবদের ডেরায়। তাঁর সঙ্গে দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্নও ছিলেন। কৃষ্ণ পাশা-খেলার সময় উপস্থিত ছিলেন না এবং তিনি থাকলে হয়তো পাশা-খেলা হতও না। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে কৌরবরা যে অন্যায় অত্যাচার দ্রৌপদীর ওপর করেছে তার জন্য তিনি প্রাথমিকভাবে এতই রেগে গেলেন যে, মনে হল—এই এক্ষুনি যেন তিনি কৌরবরাজ্যে গিয়ে ভয়ানক যুদ্ধ করে সবাইকে মেরে ফেলবেন। অর্জুন তাঁকে অনেক স্তোকবাক্য দিয়ে শান্ত করলেন বটে, কিন্তু দ্রৌপদী তাঁকে ছাড়লেন না। কৃষ্ণ যে দ্রৌপদীর সখা। দ্রৌপদী তাঁকে যা মুখে আসল তাই বললেন, বিশেষ করে কুরুসভায় তাঁর লাঞ্ছনার কথা। বিশেষ করে সেই বিপদে তাঁর স্বামীরা যে তাঁকে একেবারেই রক্ষা করেননি—সেই কথা খুব জোর দিয়েই প্রকাশ করলেন। বারংবার তাঁর ভাষায় ধিক্কার শব্দ উচ্চারিত হল ভীমের শক্তিমত্তা লক্ষ করে, বারংবার অপশব্দ উচ্চারিত হল অর্জুনের ধনুষ্মত্তা লক্ষ করে। শেষে দ্রৌপদী কৌরবদের পূর্ব আচরণগুলি, অর্থাৎ সেই ভীমকে বিষ খাওয়ানো, জতুগৃহে পাঠানো—ইত্যাদি শত্রুতার কথাও আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। দ্রৌপদীর কথা শুনে কৃষ্ণ রোদনপরা দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন—আজকে যেমন তুমি কেঁদে ভাসাচ্ছো, তেমনই কৌরবদের বউরাও একদিন কেঁদে ভাসাবে। অর্জুনের বাণে যেদিন কৌরবেরা রক্তগঙ্গায় শুয়ে থাকবে, সেদিন তাদের বউরাও তোমরাই মতো করে কাঁদবে—তুমি বিশ্বাস করো পাঞ্চালী।

অর্জুণের বাণে? কৃষ্ণের কথা শুনে দ্রৌপদী একবার তেরছা করে তাঁর মধ্যম-স্বামী অর্জুনের মুখের দিকে তাকালেন—সাচীকৃত-মবৈক্ষৎ সা পাঞ্চালী মধ্যমং পতিম্‌! ভাবটা এই—সেই প্রচণ্ড অপমানের সময় যাঁকে রা কাড়তে দেখিনি, সেই অর্জুনের ওপর এতটা ভরসা করা কি যুক্তিযুক্ত হবে? প্রাণের বন্ধু কৃষ্ণের সামনে, শ্যালক-সম্বন্ধী ধৃষ্টদ্যুম্নের সামনে কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর এই অবিশ্বাসের চাউনি অর্জুনকে মুহূর্তের জন্য উদ্বেলিত করে তুলল। তা ছাড়া এত রাগের মধ্যেও দ্রৌপদীর দিক থেকে অর্জুনের প্রতি একটু বিশেষ দুর্বলতা প্রকাশ করা হয়ে গেছে। পাঁচ স্বামীর সামনেই সেই বিশেষ দুর্বলতা ফুটে উঠেছে তাঁর কথায়। পাণ্ডবদের ওপর কৌরবদের ধারাবাহিক অত্যাচারের প্রসঙ্গে যখন জতুগৃহের কথা উঠল, তখন দ্রৌপদী বলে ফেলেছেন—জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে পাণ্ডবরা ছন্নছাড়ার মতো ঘুরতে ঘুরতে পাঞ্চালে পৌঁছেছিলেন। আর সেখানেই তো সব্যসাচী অর্জুন আমাকে জিতে নিল নিজের ক্ষমতায়। দ্রৌপদী সোৎসুকে আরও বলে ফেলেছেন—ঠিক তুমি যেমন কৃষ্ণ। বিদেহরাজার সভায় সমবেত রাজপুত্রদের সবাইকে হারিয়ে দিয়ে তুমি যেমন রুক্মিণীকে জিতে এনেছিলে, ঠিক তেমন করেই-অন্যে যা পারত না—সেই রকমভাবে সবাইকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে পার্থ অর্জুন আমাকে জিতে নিয়ে এসেছিল—এবং সুযুদ্ধে পার্থেন জিতাহং মধুসূদন।

পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে দাঁড়িয়ে, পঞ্চস্বামীর ঘরণীর মুখে একতম পার্থের প্রতি বীরভোগ্যা রমণীর এই সগৌরব পক্ষপাত সমস্ত ধিক্কারের মধ্যেও, সমস্ত অবিশ্বাসের চাউনির মধ্যেও অর্জুনকে নিশ্চয়ই মুহূর্তের জন্য উদ্বেলিত করে তুলল। কৃষ্ণের কথা সমর্থন করে অর্জুন অত্যন্ত সংক্ষেপে যা বললেন—তার মধ্যে অবশ্য একতম পতির স্বতন্ত্রতা মেশানো ছিল। অর্জুন বললেন—অমন করে কেঁদো না তুমি—মা রোদীঃ শুভতাম্ৰাক্ষি। এই সম্বোধন—শুভতাম্ৰাক্ষি—এর মধ্যে কেঁদে কেঁদে দ্রৌপদীর চোখ লাল হয়ে যাবার ব্যঞ্জনা নেই তো? যদি তা থাকে, তবে অর্জুনের সম্বোধনেও সরসতা আছে। অর্জুন বললেন—অমন করে কেঁদো না। ঠিক আছে, এই কৃষ্ণ যেমনটি বলেছেন ঠিক তেমনটিই ঘটবে, তার অন্যথা হবে না—নান্যথা বরবৰ্ণিনি।

এই স্থির প্রতিজ্ঞাবাক্যের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। পাণ্ডবরা দ্বৈতবনে প্রবেশ করেছেন। কষ্টেসৃষ্টে বনের ফল কুড়িয়ে, শিকার ধরে আর পর্ণশয্যায় মাটিতে শুয়ে পাণ্ডবদের দিন কাটতে লাগল। এরই মধ্যে একদিন সন্ধ্যাবেলা কথায় কথায় আবার সেই কুরুসভায় পাশা-খেলার কথা উঠল। বিদগ্ধা পাঞ্চালী মহামতি যুধিষ্ঠিরকে খুব এক প্রস্থ গালাগালি দিলেন। বনের মধ্যে ভীম-অর্জুন—এই সব মহাবীর স্বামীদের চরম দুর্গতি দেখে দ্রৌপদী আর স্থির থাকতে পারলেন না। যুধিষ্ঠিরের প্রতি কোপবর্ষণ চলল কয়েক অধ্যায় জুড়ে। সময় বুঝে ভীমও গলা মেলালেন দ্রৌপদীর সঙ্গে। তাঁদের মত হল—দুর্যোধন যখন কপটতা করেছে, অতএব তার শর্তে সত্যবদ্ধ হয়ে বনবাস করার কোনও মানে হয় না। বরঞ্চ এখনই গিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে রাজ্য দখল করে নেওয়া উচিত। যুধিষ্ঠির অনেক বকা-ঝকা আর গালাগালি শুনলেন বটে, কিন্তু শেষে অনেক চিন্তাভাবনা করে যে বিচক্ষণ সিদ্ধান্তটি দিলেন, সেটা কেউ অমান্য করতে পারলেন না। যুধিষ্ঠির বললেন—যুদ্ধ মানে তো শুধু দুর্যোধন-দুঃশাসনের সঙ্গে যুদ্ধ নয়! কৌরব পক্ষে লড়বেন মহা-মহা সব বীর—ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ—এঁরা কেউ কিছু কম যোদ্ধা নন। এঁদের সবার সঙ্গে লড়তে হবে। অথচ আমাদের সহায় বলতে কী আছে? যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে ভীম, যিনি এতক্ষণ যুদ্ধ-যুদ্ধ করে গলা ফাটাচ্ছিলেন, তিনিও কেমন যেন চুপসে গেলেন। দ্রৌপদীর মুখও থেমে গেল নিমেষে।

ঠিক এই সময় পাণ্ডবদের ঘরে এসে পৌঁছলেন মহামুনি ব্যাস। তিনি অভয় দিয়ে বললেন, —ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ যত বড় যোদ্ধাই হন না কেন—ভয়ের কিছু নেই। আমি প্রতিস্মৃতি নামে এক দিব্য বিদ্যা দান করছি। এই বিদ্যার বলে অর্জুন তপস্যায় সন্তুষ্ট করুক দেবরাজ ইন্দ্রকে, মহাদেবকে, বরুণকে, যমকে।

সেই অর্জুন। যিনি এতক্ষণ ক্রোধে আরক্ত হয়েছিলেন, সেই ভীমও নন, যিনি ধর্মের তত্ত্ববোধে প্রায় সিদ্ধভূমিতে অবতীর্ণ, সেই যুধিষ্ঠিরও নন, তপস্যার জন্য নির্দিষ্ট হলেন অর্জুন। কারণ, ব্যাস বলেছিলেন—ইনিই পারেন সেই সুরলোকের সম্মুখীন হতে, যাঁর তপস্যার উপযুক্ততা আছে, শক্তিও আছে—শক্তো হ্যেষ সুরান্‌ দুষ্টুং তপসা বিক্রমেণ চ। অর্জুনের মধ্যে আছে সেই দুর্লভ সংমিশ্রণ—তপস্যার ক্ষমতা এবং বীরত্ব। অতএব একদিন যুধিষ্ঠির তাঁকেই পাঠালেন তপস্যা করার জনা—যে তপস্যায় ইন্দ্র, মহাদেব সন্তুষ্ট হবেন; জ্যেষ্ঠভ্রাতার আজ্ঞায় অর্জুন প্রতিস্মৃতি শিখে নিয়ে হিমালয়ের দিকে চললেন। সঙ্গে থাকল শুধু গাণ্ডীব আর অক্ষয় তৃণ। মনে রইল কৌরবকুল বধের প্রতিজ্ঞা, নজর রইল শুধু উঁচুতে দেবতার স্থানের দিকে—বধায় ধার্তারাষ্ট্রানাং নিঃশস্যোর্ধ্বমুদীক্ষ্য চ। পাণ্ডবভাইদের কারও মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরুল না। শুধু বনবাসিনী বীরবধু কৃষ্ণার চোখ জুড়ে জল এল। শৃঙ্গার-সরসা রমণীর মুখ দিয়ে জননীর মতো শুভকামনা ঝরে পড়ল। দ্রৌপদী বললেন—তোমার জন্মের সময় জননী কুন্তীর মনে তোমাকে নিয়ে যে আশা ছিল আর তুমিও জীবনে যা চেয়েছো—তাই যেন তুমি পাও। এরপর থেকে যখন তুমি এখানে আর থাকবে না—তোমার ভাইয়েরা তখন নিশ্চয়ই তোমারই গৌরব-গানে দিন কাটিয়ে দেবে, কেননা আমাদের জীবন, মরণ, রাজশ্বৈর্য—সব তোমারই ওপর নির্ভরশীল। বিদায় বন্ধু, তোমার ভাল হোক, দেবতারা তোমাকে রক্ষা করুন। দ্রৌপদীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ভাইদের আশা-ভরসা পাথেয় করে অর্জুন দ্রুত চলে গেলেন ইন্দ্ৰকীল পর্বতে।

পাহাড়ি পথ অতিক্রান্ত হতে হতে এক জায়গায় ছদ্মবেশী ইন্দ্রের সঙ্গে যখন অর্জুনের দেখা হল। তখন অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। ইন্দ্রের কাছে অর্জুনের বক্তব্য ছিল একটাই—আমি লোভ বা কামনায় পীড়িত নই, স্বর্গের ঐশ্বর্য আমি চাই না। আমার অসহায় ভাইদের আমি বনে ফেলে এসেছি এবং এই বনবাসই আমাদের লজ্জা। আমি এর থেকে মুক্তি চাই। ইন্দ্র বললেন—তুমি তপস্যায় মহাদেবকে তুষ্ট করো, তারপর আমাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র তুমি পাবে। অর্জুন সেই মুহূর্তে সেইখানেই দেবদেব মহাদেবের তপস্যায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। মহাদেবকে তপসায় সন্তুষ্ট করা বড় সহজ কথা নয়। অনেক কষ্টে, অনেক ত্যাগে, অনেক আর্তিতে অর্জুন শেষ পর্যন্ত তাঁর দেখা পেলেন। মহাদেব ব্যাধের বেশে এসে অর্জুনের সঙ্গে ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি করে তাঁর ভক্তি পরীক্ষা করলেন; শেষে স্বমূর্তিতে দান করলেন পাশুপত-অস্ত্র।

কিরাতবেশী মহাদেবের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ-পর্ব নিয়ে ভারবির অমরকাব্য ‘কিরাতাৰ্জুনীয়’ লেখা হয়েছে। আমি তার বিশদ অংশে যাচ্ছি না, কিন্তু মহাভারতে কিরাতবেশী মহাদেব অর্জুনকে পাশুপত-অস্ত্র দেবার পূর্ব মুহূর্তে যে দুটি পরীক্ষা করে দেখেছেন, তা হল-অর্জুনের শৌর্য এবং ধৈর্য। মহাদেবের সঙ্গে যুদ্ধে বারংবার তীক্ষ থেকে তীক্ষ্মতর বাণ নিক্ষেপের মধ্যেও অর্জুনের শৃঙ্খলাবোধ ছিল ক্রমিক। একটি কঠিন বাণে যখন কাজ হচ্ছে না, তখন তার থেকেও কঠিনতর অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। শেষে অক্ষয় তৃণের ভাণ্ডারও যখন শেষ হয়ে গেল তখন ধনুকের বাড়ি, খস্কোর কোপ, অবশেষে হাতাহাতিও বাদ গেল না। দেবদেব মহাদেবের নিষ্পেষণে একসময় অজ্ঞানও হয়ে গেলেন অর্জুন। কিন্তু জ্ঞান ফেরা মাত্রই ভাবলেন—একবার স্থির মনে মহাদেবের পুজো করেই আবার যুদ্ধে নামব। এই যে ধৈর্য এবং অবশাই তাঁর পূর্বদর্শিত শৌর্য—এই দুটি গুণই লোক-বিধ্বংসী মহাস্ত্র ধারণের উপযুক্ততা নির্ণয় করে। পাশুপত-অস্ত্রদানের প্রাঙ্‌মুহূর্তে তাই মহাদেব মন্তব্য করেছেন—অর্জুন! তোমার এই বীরত্ব আর ধৈর্যে আমি খুশি—শৌর্যেনানেন ধৃত্যা চ। আর অস্ত্রদানের পর মহাদেব বলছেন—তুমিই এই অস্ত্র ধারণের উপযুক্ত, নিক্ষেপের উপযুক্ত এবং তুমিই এই অস্ত্র ফিরিয়ে আনারও উপযুক্ত। কখনও যেন এই অস্ত্র হঠকারিতার বশে সাধারণ-জনের ওপর প্রয়োগ কোরো না।

অর্জুনের সম্বন্ধে মহাদেবের এই মূল্যায়ন এবং বিশ্বাস যে কতখানি খাঁটি—সেটা আমাদের পুনরায় স্মরণ করতে হবে মহাভারতের যুদ্ধপর্বের শেষে—যখন পঞ্চপাণ্ডবের পাঁচটি ছেলেই মারা গেছে এবং ক্রোধী অশ্বত্থামার মারণাস্ত্র লক্ষ্য করেছে পাণ্ডবদের একমাত্র আশা-ভরসা অভিমন্যুর সন্তানবীজ পরীক্ষিৎকে। এ-সব দুঃখ এবং ধৈর্যের কথায় আমরা পরে আসব। আপাতত অর্জুনকে আমরা বড় প্রসন্ন দেখেছি। এই প্রসন্নতা যতখানি অস্ত্রলাভের জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি যেন মহাদেবকে দেখার সৌভাগ্যে—আমি মহাদেবকে দেখেছি, তাঁর শরীর ছুঁয়েছি হাত দিয়ে দৃষ্টঃ—স্পষ্টশ্চ পাণিনা! মহাদেবের পর যম, বরুণ, কুবের—অনেক দেবতাই তাঁকে দিলেন অলৌকিক সব অস্ত্র আর স্বর্গ থেকে ইন্দ্র পাঠিয়ে দিলেন তাঁর আপন রথ। সারথি মাতলি তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যেতে এসেছে।

এতদিন পরে অর্জুনের বনবাসের কষ্ট, তপস্যার কষ্ট—সব মুছে দিতেই যেন দেবরাজ ইন্দ্রের এত আয়োজন। ছেলে বলে কথা। অর্জুন স্বর্গে পৌঁছে তখনও প্রথম-বিস্ময়ের ঘোরটুকুও কাটাতে পারেননি—নন্দন কানন, পারিজাত ফুল, অপ্সরা, গান-বাজনা কত কিছু। এরই মধ্যে দেবরাজ তাঁকে ডেকে নিলেন কাছে, বসালেন কোলের কাছে, অধাসন ত্যাগ করে। অর্জুনের কি লজ্জা করছিল? পাণ্ডব অর্জুন বীজী পিতার সঙ্গে অধাসনে বসে কোনও অস্বস্তি বোধ করছিলেন না তো? স্বর্গের আচার ব্যবহার, রকম-সকমও যে একেবারে আলাদা। আমাদের পশ্চিমি কায়দায় হাল-ফ্যাশনের বাড়িতে বাপ-ছেলের একসঙ্গে মদ-খাওয়ার ঘটনাটা যেরকম—এও বুঝি তাই। স্নেহাতুর পিতার প্রথম স্নেহবর্ষণ শেষ হতে না হতেই ধুম নাচ-গান আরম্ভ হয়ে গেল। স্বৰ্গবেশ্যা সুন্দরীরা দলে দলে ইন্দ্রের সামনে অর্থাৎ অর্জুনের সামনে নাচ দেখাতে আরম্ভ করল—শরীর দুলিয়ে, কোমর দুলিয়ে—কম্পমানৈঃ পয়োধরৈঃ। অর্জুনের কি অস্বস্তি হচ্ছিল?

একপ্রস্থ ঝুমুর নাচের পর গন্ধর্ব চিত্রসেনকে নিয়োগ করা হল অর্জুনের চিত্ত বিনোদনের জন্য। তিনি আবার একপ্রস্থ নাচের ‘অর্ডার’ দিলেন। কিন্তু অর্জুনের মন বসছে না, ভাল লাগছে না। হ্যাঁ, গৃহকতার আতিশয্যে তাঁকে মাঝে মাঝে আগ্রহ প্রকাশ করতে হচ্ছে বইকী, কিন্তু সব বিনোদন ভেদ করে মনে পড়ছে—দ্রৌপদীর কাপড় ধরে টানাটানি করছে দুঃশাসন, অথবা পাশা-খেলার কপট চালে হারিয়ে দিচ্ছে শকুনি। মনে পড়ছে—ভাইদের কথা, বনবাসী ভাইদের কথা, পুত্রবিরহিণী কুন্তীর কথা। অর্জুনের কিছু ভাল লাগছে না—ন শর্ম লেভে পরবীরহস্তা ভ্রাতৃণ স্মরণ মাতরঞ্চৈব কুন্তীম্‌।

এরই মধ্যে বড়মানুষ বাবা হিসেবে ইন্দ্রের মনে হল—নাচ দেখতে দেখতে অর্জুন একবার উর্বশী অপ্সরার দিকে কেমন যেন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। ছেলের বুঝি মনে ধরেছে এই নৃত্যপরা সুন্দরীকে। সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গের রাজা হুকুম দিলেন চিত্রসেনকে—ঊর্বশীকে বলো, সে যেন অর্জুনকে একটু ঘনিষ্ঠভাবে সঙ্গ দেয়—সোপতিতু ফাল্গুনম্‌। চিত্রসেন উর্বশীর কাছে গিয়ে অর্জুনের অসংখ্য গুণ গাইলেন অনেক করে। উর্বশী ভুললেন। স্বর্গসুখ ভোগ করে করে তাঁরও বুঝি বা অরুচি ধরে গেছে। মতের মানুষ অর্জুন তাঁর কাছে হয়তো নতুন রসে ধরা দিল। বিশেষত মর্ত্য মানুষের ভালবাসা যে কত গভীর হতে পারে—সে অভিজ্ঞতা তাঁর বহু আগেই হয়ে গেছে, যদিও ভালবাসার গভীরতা সম্বন্ধে তাঁর কোনও বোধ নেই। কুরুবংশের মূল-পুরুষ পুরূরবার প্রেমে বাঁধা পড়েছিলেন স্বর্গসুন্দরী উর্বশী। স্বর্গের নৃত্যকালে ছন্দপাতন অপরাধের আঘাত তাঁর কাছে প্রেমের পরশে রূপান্তরিত হয়েছিল পুরূরবার সঙ্গমাধুর্যে। তবু মতে তাঁর পক্ষে থাকা সম্ভব হয়নি। স্বর্গের অভ্যাসে তাঁকে পুনরায় ভেসে আসতে হয়েছিল স্বর্গের গড্ডলিকায়। কিন্তু উর্বশীর প্রেমে বাঁধা বিরহাতুর পুরূরবার বাঁধনহারা ক্রন্দনধ্বনি এখনও মর্তে বন-বনান্তর থেকে তাঁর কানে ভেসে আসে পুরাণ-মুনিদের ছন্দে, বিক্রমোর্বশীয়ের গ্রন্থনায়। স্বর্গসুন্দরী বুঝি কৌতুক অনুভব করেন—মর্ত্য মানুষেরা অভীপ্সিতা রমণীকে পাবার জন্য কেমন আতুরভাবে কাঁদে। স্বর্গে তো এমনটি নেই।

সেই পুরূরবার বংশেরই আরেক পুরুষ এই অর্জুন—যাঁর গুণপনার কথা এতক্ষণ ধরে চিত্রসেনের কাছে শুনছিলেন উর্বশী। স্বর্গসুন্দরীদের বয়স বাড়ে না, যৌবন স্থির হয়ে আছে যৌবনেই। পার্থ অর্জুনের কথা শুনে উর্বশীর হৃদয় মথিত হল—ফাল্গুনে জাতমন্মথা। বললেন—যাব—আমি ঠিক সময়মতো যাব অর্জুনের কাছে। উর্বশীর সঙ্গে কথা বলে গন্ধর্ব চিত্রসেন যখন চলে গেছেন, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অর্জুনের নামের গুণে স্বর্গসুন্দরীর মনে নতুন কোনও রসের আবেশ হল বুঝি! সেই ভর সন্ধ্যায় তিনি শরীর মেজে স্নান করলেন—স্বর্গের গড্ডল ধুয়ে গেল যেন। তারপর খুব সেজে, গয়না পরে, খোঁপায় মালা দুলিয়ে উর্বশী অর্জুনের কাছে চললেন—পার্থ-প্রার্থনলালসা। তখন আকাশে চাঁদ উঠেছে, রজনী গাঢ় হচ্ছে—উর্বশীর জ্যোৎস্নাভিসার শুরু হল।

সবাই জানেন—স্বর্গসুন্দরীদের স্বভাব বড় চপল, তাদের মনে প্রেম-ভালবাসা বলে কিছুই নেই, উর্বশীরও তা ছিল না। পুরূরবার সঙ্গে উর্বশীর মিলনেও তাই দেখেছি। পুরুষ পুরূরবা যখন গভীর প্রেমে উন্মত্তপ্রায়, উর্বশীর তখন হুঁশও নেই। এখন অর্জুনের কাছে যাবার সময়েও মনে মনেই তিনি অর্জুনের সঙ্গে রতিরতা। অর্জুনকে রূপে ভোলাবার জন্যই তিনি সেজেছেন, ভালবেসে নয়। তাঁর সাজের মধ্যে তাই যেন উদ্দাম প্রদর্শনী, মনটাকেও সেইভাবে তৈরি করার জন্য সামান্য একটু মদও খেয়ে নিয়েছেন তিনি। তাতে সূক্ষ্মবস্ত্রে, সুসূক্ষ্ম উত্তরীয়ে স্বর্গসুন্দরীর রূপ আরও ‘প্রেক্ষণীয়তরা’। তাঁর পরিধেয় বস্ত্র এবং উত্তরীয়ের সূক্ষ্মতা ছিল এতটাই যে হালকা মেঘের তলায় চাঁদের জ্যোৎস্নার মতো তাঁর শরীর-সংস্থানগুলি ছিল স্পষ্টাস্পষ্ট রহস্যে ঘেরা—তনুরভ্রাবৃতা ব্যোমি চন্দ্রলেখেব গচ্ছতী। বেশবাসে, অঙ্গরাগে মানসিক শৃঙ্গারের উপাত্তে এসে উর্বশী অর্জুনের ঘরের দরজায় এসে পোঁছলেন।

দরজা খুলেই এমন মোহিনী মূর্তি দেখে অর্জুন চকিতে বুঝলেন—তিনি উর্বশী। লজ্জায় তাঁর মাথা নুয়ে গেল, চক্ষু মুদে গেল। মুখে বললেন—স্বর্গসুন্দরীদের প্রধান তুমি। তোমাকে নমস্কার। আজ্ঞা করুন দেবী। আমি তোমার ভৃত্য। উর্বশী তো অবাক। বলে কী লোকটা? যার জন্য এত হাব-ভাব, ছলা কলা, গন্ধর্ব চিত্রসেনের দূতিয়ালি—তার মুখে এ কী কথা! উর্বশী অজ্ঞান হয়ে যাবেন না তো? তিনি সমূলে চিত্রসেনের বক্তব্য, ইন্দ্রের ইচ্ছা সব প্রকাশ করে নিজের কথা বললেন—সব সুন্দরীরা যখন একসঙ্গে হয়ে আমরা নাচ দেখাচ্ছিলাম দেবরাজ আর তোমার সামনে, তখন অমন অনিমিখে কেন চেয়ে ছিলে আমার দিকে, শুধু আমারই দিকে? সেটা লক্ষ করেই তো দেবরাজ চিত্রসেনকে দিয়ে আজকের অভিসার ঘটিয়েছেন। তবে ভেবো না—আমি শুধু ওঁদের কথাতেই এখানে তোমার কাছে এসেছি। তোমার কথা শুনে, তোমায় দেখে আমি অভিভূত, আমারও ইচ্ছে করে আমি তোমাকে পাই—চিরাভিলষিত বীর মমাপ্যেষ মনোরথঃ।

অর্জুন আবারও লজ্জা পেলেন। উর্বশীর আত্মনিবেদন শুনে কানে আঙুল দিলেন লজ্জায়। বললেন—আমি এখনই যা শুনলাম, তা ভুল-শোনা হয়ে থাক—দুশ্রুতং মে’স্তু। তুমি আমার কাছে জননী কুন্তীর মতো, ইন্দ্রাণী শচীর মতো। তোমাকে যে নৃত্যসভায় অমন করে অনিমেষে দেখেছিলাম তার কারণ শুনবে উর্বশী? তুমি যে বিশাল এই পৌরব বংশের জননী—যে বংশের অধস্তন শেষ পুরুষ হিসেবে আমি তোমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি, আর ভাবছি—আমার বংশের অন্যতম মূল পুরূরবা একদিন তোমারই গর্ভে আমার এই বংশের ধারা রক্ষা করেছিলেন—গুরার্গুরুতরা মে ত্বং মম বংশবিবর্দ্ধনী। উর্বশী অর্জুনের ন্যায়নীতির তত্ত্বে জলাঞ্জলি দিয়ে বললেন—থাক ওসব কথা। স্বর্গরাজ্যে সবাই সমান, আমরা সবারই ভোগ্যা। এখানে এসে তুমি আমাকে গুরুর আসনে বসিয়ে দিতে পারো না। পুরূরবার বংশ, যে বংশ নিয়ে তুমি এত গৌরব করছে—সেই বংশের অনেক অধস্তন পুরুষই পুণ্যবলে স্বর্গরাজ্যে এসে আমাদের রমণসুখ উপভোগ করেন। তা ছাড়া এই মুহূর্তে তোমার সঙ্গ পাওয়ার জন্য শৃঙ্গারী হয়ে উঠেছে আমার মন। তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারো না।

সব কথা শুনেও অর্জুন আবারও একই কথা বললেন, এবং পুনরায় কুন্তী আর শচীর সম্বোধনে ডাকলেন উর্বশীকে। স্বর্গসুন্দরী অপ্সরার সম্মানে খুব লাগল। ত্রিভুবন-কামা রমণীকে অর্জুন প্রত্যাখ্যান করছেন, শৃঙ্গারযোগ্যা ষোড়শী সুকুমারীকে মা মা করছেন, তাও কিনা যে রমণী স্বর্গেও সবার কাছে সুলভ নন, কিন্তু অর্জুনের কাছে তিনি নিজে স্বয়ং এসেছেন শৃঙ্গার-চিকা হয়ে—কাজেই এই মুহূর্তে বংশ নিয়ে অর্জুনের গৌরবস্মৃতি তাঁর কাছে নেহাতই অপমানজনক বলে মনে হল। বয়স না-বাড়া স্বর্গের ষোড়শীর মনে মর্ত্য-মানুষের ন্যায়বিচার একেবারেই গণ্য হল না। ঋগ্‌বেদ থেকে আরম্ভ করে বিক্ৰমোবশীয় পর্যন্ত পুরুবংশের অগ্রজন্মা পুরূরবার বিরহাতুর কান্নার অর্থও সেদিন উর্বশী বুঝতে পারেননি আর আজ সেই বংশেরই অধস্তন অর্জুনের সূক্ষ্ম নীতিবোধও তাঁকে পীড়া দিল। প্রতিহত কামনা ক্রোধের সঞ্চার করল তাঁর মনে। তাঁর মনে হল বুঝি—পূর্বে পুরূরবা তাঁর সঙ্গ পাবার জন্য যে কান্নাটা কেঁদেছিলেন, আজ স্বয়ং যেচে-আসা তাঁকেই প্রত্যাখ্যান করে অর্জুন তার শোধ তুললেন। তিনি অভিশাপ দিলেন—তোমার বাবার কথায় আমি নিজে যেচে তোমার কাছে এসেছিলাম। তবু আমার সঙ্গে যখন এই ব্যবহার করলে তখন মেয়েদের মধ্যে থেকেও হীনমান নপুংসক হয়ে থাকবে তুমি।

উর্বশী ফিরে গেলেন রাগে ফুলে, লজ্জায় সংকুচিত হয়ে। অভিশাপ শুনে অর্জুনও এলেন বন্ধু চিত্রসেনের কাছে। সবিস্তারে জানালেন রাত্রির সব ঘটনা। দেবরাজ ইন্দ্রকেও জানানো হল উর্বশীর অভিশাপের কথা। দেবরাজ নিজ পুত্রের মধ্যে এই ঋষির সংযম দেখে খুব খুশি হলেন। অভয় দিয়ে বললেন—চিন্তার কারণ নেই কোনও। বনবাসের পর অজ্ঞাতবাসে যেতেই হবে তোমাদের। তখন এই নপুংসকের ভুমিকাই তোমার কাজে লাগবে। আমরা জানি—এই নপুংসকের ভূমিকা অর্জুনের কাজে লেগেছিল—যখন এক বৎসর কাল তিনি বিরাটরাজার ঘরে বৃহন্নলার বেশে বিরাট-কন্যা উত্তরার নৃত্যগুরু সেজেছিলেন।

এক্ষুনি আমরা উর্বশী-প্রত্যাখ্যানের মধ্যে অর্জুনের যে সংযম দেখলাম, যে সংযম দেখে দেবরাজ অভিভূত হয়েছেন—এই সংযম খুব সাধারণ নয়। হ্যাঁ, ইতিপূর্বে উলূপী, চিত্রাঙ্গদা অথবা সুভদ্রার ক্ষেত্রেও আমরা অর্জুনের চিত্তবিক্ষেপ এবং কিছুটা ইন্দ্রিয়ের শিথিলতাও দেখেছি। দ্রৌপদীর সঙ্গ না পাওয়ার ফলে তাঁর মনে একটা অভিমান কাজ করে থাকতে পারে এবং সেইজন্যই এক ধরনের ইন্দ্রিয়-প্রবণতা তখন ঘটে থাকতে পারে—এই ছিল আমাদের অনুমান। কিন্তু বনবাস থেকে ফেরার পরে তিনি দ্রৌপদীর সঙ্গ-সাহচর্য নিশ্চয়ই লাভ করে থাকবেন, উপরন্তু বৃষ্ণিসুন্দরী সুভদ্রা দ্রৌপদীর প্রায় সমান্তরাল জায়গায় দাঁড়িয়ে অর্জুনের জীবনে বিরাট স্থিরতা এনে দিয়েছেন। বনবাসে আসা ইস্তক অর্জুনের মনের মধ্যে কেবলই তোলপাড় করছে কুরুসভার অপমান—যার প্রতিশোধের প্রস্তুতিতে মহাদেবের তপস্যা, যদিও মহাদেবের. তপস্যার ফলে অস্ত্রলাভের থেকেও তাঁর মনে জুড়ে বসল অলৌকিক এক প্রসন্নতা। ইন্দ্রলোকে এসে হাজারো সুখভোগের মধ্যেও তাঁর এই মানসিক-প্রসন্নতা তাঁকে অনেক ব্যাপারেই নিস্তরঙ্গ করে রেখেছে। এ ছাড়া স্বর্গের সুখরাশির মধ্যে বাস করেও বনবাস ক্লিষ্ট ভাইদের জন্য তাঁর অন্তরে অন্তরে এক ধরনের কষ্ট জমা হচ্ছিল—আমি এটাকে পাপবোধ বলব না—তবু এই বোধ তাঁর উপভোগবৃত্তি কণ্টকিত করেছিল। কাজেই উর্বশীকে প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে তাঁর বংশমাতৃকার বোধ যতখানি কাজ করেছে, ঠিক ততখানি কাজ করেছে তাঁর চিত্তের ক্রমিক-স্থিরতা, প্রসন্নতা এবং ভাইদের জন্য বিষণ্ণতা!

যাই হোক ইন্দ্রের কথায় অর্জুন তাঁর সম্ভাবিত ক্লীবত্ব সম্বন্ধে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু দেবরাজ তাঁর পুত্রটিকে ছাড়লেন না। আরও কিছুদিন অর্জুনকে স্বর্গে আটকে রাখবার জন্য লোমশ মুনিকে দিয়ে উৎকণ্ঠিত যুধিষ্ঠিরকে কাম্যক বনে খবর পাঠালেন—এই তিনি এলেন বলে। মহাদেবের সঙ্গে বাহুযুদ্ধ এবং শেষে পাশুপত-অস্ত্র পাওয়ার খবর যেমন লোমশ মুনির মাধ্যমে যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে পৌঁছল, তেমনই কথায় কথায় অন্য মুনিদের মুখে হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছেও এই খবর গেল। ধৃতরাষ্ট্র অর্জুনের ব্যাপারে এমনিতেই আতঙ্কিত ছিলেন, এখন তার পাশুপত-অস্ত্র লাভের ঘটনা তাঁকে এতটাই শঙ্কিত করে তুলল যে, তিনি বুঝলেন —অর্জুন এখন একেবারেই অপ্রতিরোধ্য। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে ওঠা কুরুকুলের বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্মের পক্ষেও সম্ভব হবে না; সম্ভব হবে না আচার্য বৃদ্ধ-দ্রোণাচার্যের পক্ষেও, আর কর্ণের পক্ষে তো নয়ই কারণ, ধৃতরাষ্ট্রের মতে অর্জুন কতখানি বীর—সে সম্বন্ধে কর্ণ ততখানি অবহিত নয় এবং তার বোধহয় কিছু দয়াও আছে অর্জুনের ব্যাপারে—ঘৃণী কর্ণ প্রমাদী চ আচার্যঃ স্থবিরো গুরু। ধৃতরাষ্ট্রের প্রথম কথাটা ঠিক হলেও হতে পারে, কিন্তু তিনি যে তাঁকে দয়ালু ভাবছেন—এটা ভুল এবং এ ভুল তৈরি হয়েছে—কর্ণের বারংবার আস্ফালনে, অর্থাৎ কর্ণ যে এক ফুঙ্কারে অর্জুনকে উড়িয়ে দিতে পারেন, কিন্তু সেটা যে তিনি করছেন না—এটা যেন তাঁর দয়া। কিন্তু এরই মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র এটা পরিষ্কার বুঝেছেন যে, সমস্ত বিপত্তিটাই ঘটল দুর্যোধন এবং কর্ণের জন্য। বিশেষত পাণ্ডবঘরণী দ্রৌপদীকে সভার মধ্যে টেনে এনে যে গর্হিত অন্যায় দুর্যোধন-কর্ণনা করেছেন তার ফলেই ক্রোধযুক্ত হয়ে পাণ্ডবরা আরও শক্তিশালী করে তুলছে নিজেদের। ধৃতরাষ্ট্র ভয় পাচ্ছেন—সাধারণভাবেই অর্জুনের বাণ তাঁর ছেলেদের অন্তকাল ঘটিয়ে দিতে পারে, সেখানে দ্রৌপদীর অপমানে সে এখন রাগে জ্বলছে—কিং পুন র্মনুনেরিতাঃ! সব ব্যাপারটা ধৃতরাষ্ট্র আরও একবার দুর্যোধনকে বোঝালেন, কিন্তু কোনও লাভই তাতে হল না। নিরুপায় ধৃতরাষ্ট্র তখন শুধু ভাবনালোকে দেখতে পেলেন—সূর্যের কিরণের মতো অর্জুনের বাণ-ধারা এসে পড়ছে তাঁর ছেলেদের ওপর, আর সেই বাণধারাই নিঃশেষে শেষ করে দিচ্ছে তাঁর ছেলেদের। হায়! বিধাতা কী এক সর্বহর, কালন্তক যমের মতো করে সৃষ্টি করেছেন অর্জুনকে, যাকে কোনওভাবেই যুদ্ধে লঙ্ঘন করা যায় না।

আপনারা লক্ষ করেছেন কিনা জানি না, কিন্তু আমার বারবার মনে হয়—কী নির্লিপ্ত এবং নিস্তরঙ্গভাবে অর্জুন নিজেকে তৈরি করছেন। ধৃতরাষ্ট্রের কথা শুনে উল্টো দিক দিয়ে বোঝা যায় যে, তাঁর এই সমস্ত চেষ্টাই দ্রৌপদীকে অপমানের ফলে আরও দৃঢ়তর হয়েছে, কিন্তু কোনওভাবেই এই প্রয়াসকে আপাতদৃষ্টিতে ‘দ্রৌপদীর জন্যই’—এইভাবে চিহ্নিত করা যায় না। তার ওপরে চরম অস্ত্রটি লাভের জন্য তাঁর যে ওই লোকাতীত বৃত্তিগুলিকে শুধু ‘একটি মাত্র নারীর জন্য’—বলে চিহ্নিত করতে আমাদের সংকোচ আছে। হ্যাঁ, এ-কথা অবশ্যই ঠিক যে, সমস্ত মহাকাব্যগুলিতেই বৃহৎ যুদ্ধের কারণ হিসাবে সাধারণভাবে কখনও হেলেন, কখনও সীতা, কখনও বা দ্রৌপদীকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ কথাটা ইলিয়াডের ব্যাপারে কতটা ঠিক, আমার পক্ষে তা বলা মুশকিল, কিন্তু রামায়ণ, মহাভারতের ক্ষেত্রে যে কথাটা বড়ই অতিসরলীকরণের পর্যায়ে পড়বে—তা আমি জোর দিয়েই বলতে পারি। মহাভারতের বিশাল এবং পর্যাপ্ত পরিমণ্ডলের নিরিখে আমরা বলতে চাই—দ্রৌপদীর অপমান অর্জুনকে যতটা প্ররোচিত করেছিল, তার থেকে অনেক বেশি প্ররোচিত করেছিল রাজ্যাভিলাষী অহঙ্কারী দুর্যোধনের অহঙ্কার, অন্যায় এবং অধর্ম—দ্রৌপদীর অপমান যেগুলির একটি অঙ্গমাত্র। তপস্যার মাধ্যমে অর্জুনের অস্ত্রলাভ সেই অধর্ম এবং অন্যায় নিরাকরণের জন্যই। তাই তাৰ্জুনের চেষ্টা, ত্যাগ, তপস্যা—এগুলি যতখানি দ্রৌপদীর জন্য, তার থেকে অনেক বেশি ধর্মের জন্য।

ধর্মের মতো বিশাল এক তত্ত্বই যেহেতু মহাভারতের বিশাল পরিমণ্ডলের সঙ্গে নিতান্ত খাপ খেয়ে যায়, আমরাও তাই লোকান্তক অস্ত্রের জন্য অর্জুনের তপস্যার কথাটা বুঝতে পারি। নইলে মহামতি কর্ণের সঙ্গেও অর্জুনের কোনও পার্থক্য থাকে না। কর্ণ অস্ত্র চান শুধু অর্জুনকে মারবার জন্য—ব্যক্তিগত হিংসায়। এর পেছনে তপস্যার মতো নিষ্কাম বিশুদ্ধ শক্তিও কাজ করে না। কিন্তু অর্জুন অস্ত্র চান ধর্মের কারণে, প্রতিপক্ষের অধর্ম শাতন করার জন্য। প্রতিপক্ষ সেখানে আপন। অধর্মের কারণেই ধবংস লাভ করবে—অর্জুন হবেন সেই ধ্বংসের নিমিত্ত মাত্র। অর্জুনকে আমরা পূর্বেও দেখেছি। তিনি শুধু ত্যাগে, তিতিক্ষায় এবং পরিশ্রমে নিজেকে আরও বিরাট এক লক্ষ্যের জন্য প্রস্তুত করছেন। স্বর্গে গিয়ে কোনও লঘু উপায়ে তিনি অস্ত্রলাভ করার চেষ্টা করেননি। দেবরাজকে তিনি বলেছেন—আমি তোমাকে আচার্য হিসেবে বরণ করছি, তুমি আমাকে নূতনতর দিব্য-অস্ত্রের প্রযুক্তি শিখিয়ে দাও। দেবরাজ বলেছেন—তা হয় না। আমি এই সব অস্ত্র কৌশল শেখালে সেই বলে বলা হয়ে তুমি ক্রুর কাজ করতে থাকবে—ক্রূরকর্মাস্ত্রবিত্তাত ভবিষ্যতি পরন্তপ। অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছেন—না, আমি এই অস্ত্র মানুষের ওপর প্রয়োগ করব না। দেবরাজ খুশি হয়ে বলেছেন তাহলে যাও আমার অস্ত্রাগারে, অগ্নি, বায়ু, বরুণ—এঁদের কাছে শেখো সব ভাল করে—শিক্ষ মে ভবনং গত্বা সর্বাণ্যস্রাণি ভারত। অর্জুনকে পাঁচ বৎসর ধরে এই দিব্য-অস্ত্রের প্রয়োগ শিখতে হয়েছে, যদিও মানুষের ওপর তার প্রয়োগই নেই। তবু শিখেছেন নিজেকে দুর্ধর্ষ করার জন্য, অপ্রতিরোধ্য করার জন্য। কারণ দিব্য-অস্ত্রগুলি নিজের হেফাজতে থাকলে প্রয়োগ না করলেও তার অস্তিত্বেই মানুষ ভয় পায়। শুধু এইটুকুর জন্যই এত সাধনা। সাধনার মতো এত বড় একটা বিশাল তাত্ত্বিক ব্যাপার আছে বলেই অর্জুনের ত্যাগ, তপস্যা এবং অস্ত্রলাভকে আমরা শুধুমাত্র একটি নারীর জনাও বলতে পারছি না, যদিও বলতে পারলে আধুনিক অর্থে সেটি খুবই পুরুষোচিত এবং বীরজনোচিত হত, অপিচ সাময়িক ভাবনায় নারীর মর্যাদাসূচকও হত হয়তো।

ওদিকে অর্জুনকে দেবরাজ স্বর্গে আটকে রাখলেন বটে, কিন্তু তাঁর অবর্তমানে বনবাসী ভাইয়েরা ভীষণ মনমরা হয়ে পড়লেন। বিশেষত পাঞ্চালী-কৃষ্ণা তাঁর প্রিয়তম স্বামীকে স্মরণ করে এমন কিছু মনের কথা বলে ফেললেন, যাতে যুধিষ্ঠিরের মতো সরল মানুষও বুঝলেন যে, অর্জুনের ওপর এই বীররমণীর বিশেষ কিছু পক্ষপাত আছে এবং এই পক্ষপাতের স্মৃতি স্পষ্টতই যুধিষ্ঠিরের মনে দ্রৌপদীর মৃত্যু পর্যন্ত অম্লান ছিল। দ্রৌপদী বলেছিলেন—এই বনবাসে কি অর্জুন ছাড়া ভাল লাগে! অর্জুনের তুলনা শুধু অর্জুনের সঙ্গেই হতে পারে, আমার দু-হাতওয়ালা অৰ্জুন শুধু তুলিত হতে পারেন হাজার হাতওয়ালা কার্তবীর্য অর্জুনের সঙ্গে। সেই অর্জুন। তুমি ছাড়া এই বন আমার কাছে শুন্য। এমন মধুর ফুল-ফল, লতা-তরু, এমন সুন্দর এই পৃথিবী—তোমাকে ছাড়া কি ভাল লাগেন তথা রমণীয়ং বৈ তমৃতে সব্যসাচিনম্‌। এরপর দ্রৌপদী তাঁর চার স্বামীর সামনে অর্জুনের ঘন কালো গায়ের রঙ আর কালো চোখের প্রশংসায় মুখর হলেন আর বারবার বলতে লাগলেন—তাঁকে ছাড়া এখানে আমার কিছুই ভাল লাগছে না,—তমৃতে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠং বনং ন প্রতিভাতি মে। এই বিলাপের পরে আর কী হতে পারে? চার ভাই অতঃপর অর্জুনের জন্য আপন আপন শোক প্রকাশ করলেন। কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর অনুকরণে। কিন্তু পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের মনে একটা খোঁচ রয়ে গেল, যা তিনি প্রকাশ করেছেন দ্রৌপদীর মৃত্যুর পর ভীমের কাছে।

অথচ অর্জুনকে দেখুন। হ্যাঁ, আধুনিক ভাবনায় এটা হয়তো খুবই বীরোচিত হত, যদি এরপর স্বর্গ থেকে ফিরে অর্জুন সবার সামনে বিশেষ পক্ষপাত দেখাতেন কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর ওপর, অথবা একান্তে ব্যক্ত করতেন পৃথক কোনও মধুর বিরহ-বেদনা। কিন্তু তা হয়নি, অনেক দিন পরে যখন দেবরাজ ইন্দ্রের রথে চড়ে অর্জুন উকণ্ঠিত ভাইদের কাছে এসে পৌঁছলেন, সেদিন সবার মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল বটে, কিন্তু কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে আলাদা করে কোনও গভীর অব্যক্ত কথা বলতে পারেননি অর্জুন। তাঁর এতদিনের হৃদয়-যন্ত্রণা উপশম করার জন্য তাঁকে শুধু মুহূর্তের জন্য সান্ত্বনা দিতে পেরেছেন—সমেত্য কৃষ্ণাং পরিসান্ত্য চৈনাম্‌। তার বেশি কিছু করা ধীরোদাত্ত এই মহাবীরের পক্ষে সম্ভব হয়নি; করলে, দ্রৌপদীর মতোই তা অন্যভাইদের, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের চোখে পড়ত। মনে লাগত আরও বেশি। তবু এরই ধ্যে সাধারণ প্রবাসী-স্বামীর মতো অর্জুন দ্রৌপদীকে স্বর্গ থেকে আনা সূর্যের আলো ঠিকরানো একটা গয়না উপহার দিলেন, কিন্তু বেশ জানি এই উপহার দ্রৌপদী। মতো বিদগ্ধা রমণীকে ভোলানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। অথচ এই ‘রুটিনের’ বেশি আর কোনও বিশেষ আদর অর্জুনের পক্ষেও দেখানো সম্ভব হয়নি। দেখালে, ভাইদের এবং যুধিষ্ঠিরের চোখে তা অন্য কোনও গভীর অর্থ নিয়ে ধরা দিত, যা অর্জুন কখনও চাননি।

এ বাবদে মহাভারতের কবির ব্যঞ্জনাটা কী অদ্ভুত! গয়না অর্জুন কাকে দিলেন? না, ‘সুতসোমমাত্রে’—সুতসোমের মাকে। সুতসোম দ্রৌপদীর গর্ভে ভীমের ছেলে। দ্রৌপদী কোনও সাতকালের বুড়ি নন, কিন্তু সুতসোমের মা দ্রৌপদীকে গয়না দিলেন মানে—ব্যাস দেখাচ্ছেন অর্জুন পৃথক কোনও একান্ত অধিকারবোধে দ্রৌপদীকে উপহার দিতে পারছেন না। কারণ দ্রৌপদী শুধু অর্জুনের ঔরসজাত শ্রুতকীর্তির মা নন, তিনি ভীমের ছেলে সুতসোমেরও মা। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়—অর্জুনের ব্যাপারে মহাভারতের কবির সেই সমব্যথা ছিল, যাতে তিনি বুঝেছিলেন—বিরহবিধুরা প্রিয়া পত্নীকে উপহার দিয়ে অর্জুনের মনে যতখানি আবেগ আসার কথা ছিল, সে আবেগ অনেকটাই তিনি দমিত করেছিলেন এই ভেবে যে, দ্রৌপদী যতখানি তাঁর স্ত্রী, ভীমেরও ঠিক ততখানি। কাজেই উপহার দিলেন সুতসোমের মাকে, শ্রুতকীর্তির মাকে নয়। অর্জুনের মনের অন্তঃস্থ এই অভিমান দ্রৌপদী নিশ্চয়ই বোঝেননি। তবু যে স্বামীর জন্য এত ভালবাসা, এত চাওয়া তিনি চিরটাকাল বহন করে এসেছেন, সেই সরসতায় কি তিনি অর্জুনের দেওয়া বহুমূল্য অলংকারখানি পেলেন, কিংবা তিনিও তো শুধু শ্রুতকীর্তির মায়ের গৌরবে অর্জুনের উপহার নিতে পারেননি, কারণ তিনি যে সুতসোমেরও মা, ভীমেরও প্রিয়তমা রমণীটি। তবু এরই মধ্যে তার মনে আকুল বসন্তের হাওয়া লাগে, সমস্ত অভিযোগ শেষ হয়ে যায়—যখন প্রিয় বন্ধু কৃষ্ণ এসে বলেন—এতদিন তোমার ঘর যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। কৃষ্ণা! অর্জুন ফিরে এসেছে আর তোমার ঘর নয় শুধু, তুমিও যেন ভরে উঠেছে—দিষ্ট্যা সমগ্রাসি ধনঞ্জয়েন সমাগতেত্যেবমুবাচ কৃষ্ণঃ। এ সব কথায় দ্রৌপদীর বুক ভরে উঠেছিল নিশ্চয়ই—সে না বুঝুক, অন্যে তো বোঝে।

আমরা এই হৃদয়চচার জগৎ বাদ দিয়ে আবারও অর্জুনের কথায় ফিরে আসি। মনে রাখা দরকার—অর্জুন সশরীরে স্বর্গ থেকে ঘুরে এসেছেন। পাণ্ডবভাইয়েরা আর দ্রৌপদী সোৎসুকে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলেন। অর্জুন শিশুর মতো—কী দেখেছেন, কী খেয়েছেন, কত ভোগ, কত সুখ—সর্ব অনুপুঙ্খ বর্ণনায় বিবৃত করলেন ভাইদের সামনে। স্বর্গের সুখে যদি ভাইদের মনে ব্যথা লাগে তাই সব বর্ণনার শেষে বললেন—পাঁচ বচ্ছর আমি স্বর্গে দেবতাদের সঙ্গে কাটিয়েছি, কিন্তু আমার মনে ছিল সেই পাশা-খেলার অপমান—স্মরতা দ্যূতজং কলিম্‌। এই একটি কথায় যুধিষ্ঠির থেকে আরম্ভ করে সব ভাই এবং অবশ্যই কৃষ্ণা যে কত খুশি হলেন, তা নিশ্চয়ই বলে বোঝাতে হবে না। তাঁরাও শিশুর মতো অর্জুনের দিব্য অস্ত্রগুলি দেখতে চাইলেন, যা অর্জুন দেখালেন পরের দিন সকালে। অর্জুন বললেন—দেবরাজ আমাকে বলেছেন—ভীম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ—কেউ তোমাকে কিচ্ছুটি করতে পারবে না। আর এই দেখো না—আমার যুদ্ধের অঙ্গ হিসেবে এই ‘দেবদত্ত’ শঙ্খ আমাকে দিয়েছেন দেবরাজ, আর শিক্ষার সার্থকতার জন্য মাথায় নিজে পরিয়ে দিয়েছেন এই চড়া-কিরীট—দিব্যং চেদং কিরীটং মে স্বয়মিন্দ্রো যুমোজ হ।

এইভাবে বনবাসে প্রবাসের কথায় দিন কাটছিল পাণ্ডবদের। এরই মধ্যে দুর্যোধনের মাথায় দুর্বুদ্ধি চাপল। তিনি কর্ণের বাম্পায়িত স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে ভাবলেন—একবার হস্তিনাপুরের রাজ-ঐশ্বর্য বেচারা পাণ্ডবদের দেখিয়ে আসা যাক। বিশেষত সেই উদ্ধতা-রমণী দ্রৌপদীকে একবার দেখিয়ে আসা যাক যে, গরিব পাণ্ডবদের বিয়ে করে সে কত বড় ভুল করেছে। ধৃতরাষ্ট্রের এতে সায় ছিল না, কারণ অর্জুনের অস্ত্রলাভে তিনি খানিকটা ভীত ছিলেন। কিন্তু দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না, তাঁকে এটা ওটা বুঝিয়ে দুর্যোধন-কৰ্ণরা দ্বৈতবনের সেই সরোবরের এক পারে এসে থানা গাড়লেন, যার আরেক পারে আছেন যুধিষ্ঠিরেরা। দুর্যোধন ঐশ্বর্য দেখানোর জন্য ঘরের বউ-ঝিদের যথেষ্ট গয়নাগাটি পরিয়ে বনের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন বটে, তবে তাঁর কু-অভিপ্রায় টের পেয়ে সেখানে আগেভাগেই এসে পৌঁছেছিলেন গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন, যিনি অর্জুনের স্বর্গসখা।

গন্ধর্ব চিত্রসেন যুদ্ধ করে দুর্যোধন এবং তাঁর বউ-ঝিদের বন্দি করে রাখলেন, কর্ণ পালালেন। খবর গেল যুধিষ্ঠিরের কাছে। ভীম তো গালাগালি দিতে আরম্ভ করলেন ঠিক হয়েছে ব্যাটাদের, আমরা যা করতাম, গন্ধর্বরাই তা করে দিয়েছে। কিন্তু অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির বললেন—সে কী কথা ভীম! জ্ঞাতিবিদ্বেষ যতই থাক, তারা আমাদের বংশের লোক বটে, তাতে আবার এখন বিপদে পড়ে শরণ নিয়েছে আমাদের। তোমরা যেভাবে হোক—ভাল কথায় তোক, অল্প বল প্রয়োগ করে তোক অথবা যুদ্ধ করেই হোক—তাদের মুক্ত করে নিয়ে এসো। যুধিষ্ঠির কথা বলছিলেন ভীমের সঙ্গে, কিন্তু তাঁর আদেশের জবাব এল গুরুর অধ্যাত্মজীবনের শিষ্যের মতো অর্জুনের কাছ থেকে—প্রতিজজ্ঞে গুরোর্বাক্যম্। বিদ্বেষের লেশমাত্র নেই, যুধিষ্ঠির বলেছেন—অতএব করতে হবে। ভাবটা এই-দুর্যোধন কে, তা জানি না, সে কী করেছে, জানি না, কিন্তু যুধিষ্ঠির কুলধর্মের কথা বলেছেন—সব মূল্যে সেই ধর্ম রক্ষা করতে হবে। অর্জুন চললেন, সঙ্গে ভাইয়েরাও। গন্ধবদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হল। শেষে বন্ধু চিত্রসেনকে অর্জুন বললেন—বন্ধু। ছেড়ে দাও দুর্যোধনকে, হাজার হোক সে আমাদের ভাই; তুমি যদি আমার প্রিয় সাধন করতে চাও, তা হলে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছে অনুসারে দুর্যোধনকে ছেড়ে দাও। নানা কথার পর দুর্যোধনের মুক্তি হল, কিন্তু নিন্দুকেরা বলে—এ কীরকম অর্জুন, তিনি কি যুধিষ্ঠিরের ছায়া? নইলে ভীমের কথাও বুঝি—অন্তত তাঁর বিকার আছে; কিন্তু এই অর্জুনটা কী? তাঁর কি ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই?

দেখুন, সাধারণ দৃষ্টিতে ব্যক্তিত্বের অর্থ যাই হোক, ব্যক্তিত্ব মানে কখনই অহঙ্কার নয়, বলদর্পিতাও নয়। ব্যক্তিত্ব মানে নিজেকে ধারণ করা—তার জন্য চেঁচামেচিও করতে হয় না, বাহু-আস্ফোটও করতে হয় না, দাঁত-মুখও খিচোতে হয় না। শুধু দেখবেন—যাঁর ব্যক্তিত্ব আছে, তাঁকে অতিক্রম করা যায় না, তিনি শুধু যুক্তিতে কথা বলেন এবং নিজেকে স্থির রাখেন। এই ব্যক্তিত্ব এবং ধারণক্ষমতা যুধিষ্ঠিরের যেমন ছিল, অর্জুনেরও ঠিক তেমনই ছিল। যার জন্য একের সঙ্গে অপরের শক্তি এবং অস্ত্রশিক্ষার বিরাট পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও যুধিষ্ঠির এবং অর্জুনের মতের মিল এত বেশি। সাময়িক যে ঘটনাটা ঘটল, তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেও নিজেকে এবং অন্যকে বিচার করাটাই ব্যক্তিত্বের লক্ষণ। ভীম সাময়িক ঘটনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে পূর্বাপর চিন্তা করতে পারেন না; যুধিষ্ঠির তা পারেন, অর্জুনও তা পাবেন। যে কোনও কারণেই হোক এই মুহূর্তে অর্জুনের মাথায় এটা ঢুকে গেছে যে, যুধিষ্ঠির ঠিক কথা বলেছেন—জাতি-বিদ্বেষের থেকে অন্য প্রতিপক্ষের সামনে নিজের বংশ এবং কুলবধূদের মর্যাদা আরও বেশি। অতএব দুর্যোধনের প্রতি ব্যক্তিগত শত-বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে রক্ষা করা উচিত, বিশেষত রক্ষা করা সবলেরই ধর্ম, দুর্বলের নয়।

ঠিক একই রকমের ব্যক্তিত্ব আবারও আপনারা দেখতে পাবেন—দুর্যোধনের ভগ্নীপতি জয়দ্রথ যখন বিজন বনে দ্রৌপদীকে দেখে মুগ্ধ হলেন এবং তাঁকে রথে তুলে নিয়ে চললেন। দ্রৌপদী হাত-পা ছুঁড়তে থাকলেন, কাঁদতে থাকলেন এবং স্বামীদের ভয়ও দেখালেন জয়দ্রথকে। কোনও কাজই অবশ্য হল না। জয়দ্রথ তাকে ছাড়লেন না বটে, কিন্তু খবর পেয়ে পাণ্ডবরা সবাই ছুটলেন জয়দ্রথের পেছনে। দূর থেকে পাঁচভাই পাণ্ডবকে দেখে জয়দ্রথ রথস্থা দ্রৌপদীকে তাঁদের পরিচয় এবং গুণাগুণ জিজ্ঞাসা করলেন। ঠিক এই রকম একটা বিপন্ন মুহূর্তেও দ্রৌপদী তাঁর পঞ্চস্বামী সম্বন্ধে যে মূল্যায়ন করেছিলেন এতই নিখুত যে দ্রৌপদীর তারিফ না করে পারা যায় না। আমি যুধিষ্ঠিরের অথবা নকুল-সহদেবের প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। কিন্তু দুই মহাবীর ভীম এবং অর্জুনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটা কী—তা হাগপং দুই নায়কেরই প্রেম-বশীভূতা দ্রৌপদীর দৃষ্টিতে একবার দেখতে পারি।

দ্রৌপদী বলেছিলেন—এই যে দেখছো—শালখুঁটির মতো চেহারা, কপাল ভ্রূকুটি-কুটিল, আর রাগে ঠোঁট কামড়াচ্ছেন—ওই হল আমার স্বামী বৃকোদর। ওঁর গায়ের জোর সাংঘাতিক এবং কাজকর্মও ঠিক মানুষের মতো নয়। ওঁকে সবাই তাই ভীম বলে ডাকে। এইবার চরিত্রের মূল কথাটি বললেন দ্রৌপদী—ওঁর কাছে অন্যায় করে পার পাবার উপায় নেই, অপরাধীকে উনি শেয় করে ছাড়বেন। আর শত্রুতা যদি কেউ একবার করে—তা উনি জীবনে ভুলবেন না—নাস্যাপরাদ্ধাঃ শেষমাপ্লবন্তি/নায়ং বৈরং বিস্মরতে কদাচিৎ। এবার দ্রৌপদী অর্জুনের কথায় আসছেন, যদিও অন্য প্রসঙ্গে আমি এই কথাটা আগে বলেছি। দ্রৌপদী বললেন—ওই যে দেখছো অদ্বিতীয় ধনুর্ধর—তিনি ধনঞ্জয়—অর্জুন। ওঁর যেমন ধৈর্য, তেমনি জিতেন্দ্রিয় অর্থাৎ তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি বিষয় পেলেই উত্তেজিত হয় না, সেগুলিকে তিনি নিজের ইচ্ছা মতো চালনা করতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা, ইনি যুধিষ্ঠিরের শুধু ভাই নয়, শিষ্যও বটে। ফলত যুধিষ্ঠিরের যে অসাধারণ গুণগুলি সেগুলিও নিশ্চয়ই অর্জুনের আয়ত্তে। এবার চরিত্রের সেই মূল কথা—দ্রৌপদী বলছেন—কামনার বশে বা ভয় পেয়ে অথবা হঠাৎ ক্রোধে তিনি কখনও ধর্ম ত্যাগ করবেন না। আবার ইচ্ছে হয়েছে বলেই, কিংবা ভয় পেয়েছেন বলেই অথবা রাগ হয়েছে বলেই তিনি নৃশংসতা করবেন তাও নয়—যা বৈ কামান্নভয়ান্ন কোপাৎ, ত্যজেদ্ধর্মং ন নৃশংস্যঞ্চ কুর্য্যাৎ।

বলতে পারেন—এ তো কথার কথা, গুণ গাইতে গেলে অমন কথা মানুষ বলে, তায় আবার বউ বলছে। আমরা বলি—এই মুহূর্তে যে ঘটনাটি ঘটবে, তাতেই দুই ভাইয়ের মৌলিক চরিত্র পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি বেশি কথায় যাচ্ছি না। ছুটে আসা পাঁচ ভাইয়ের অস্ত্র যুদ্ধে কাতর হয়ে জয়দ্রথ সৈন্য-সামন্ত সব হারালেন। জয়দ্রথ শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদীকে নিজের রথ থেকে নামিয়ে দিয়ে প্রাণ নিয়ে পালানোর বুদ্ধি করলেন। জয়দ্রথ পালিয়ে গেছেন অথচ ভীম তাঁর নিরীহ সৈনিকদের পিটিয়েই চলেছেন। অর্জুন বললেন—এ কী করছেন দাদা! যার অন্যায় অসভ্যতার জন্য আমরা বিপাকে পড়েছি, তাকে খুঁজে বার করুন! এই সাধারণ সৈনিকগুলোকে মেরে কী হবে? অর্জুনের কথার যৌক্তিকতা লঙ্ঘন করা ভীমের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সত্যিই তো জয়দ্রথকে খুঁজে বার করা দরকার। জয়দ্রথ পালানোর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সৈনিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করার আর কোনও অর্থ থাকে না। কিন্তু জয়দ্রথের ওপর যে রাগ হয়েছিল, ভীম সেটা মেটাচ্ছিলেন তাঁর সৈনিকদের মেরে। অর্জুনের কথা শুনে তিনি প্রকৃতিস্থ হলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে বললেন—নকুল-সহদেব এবং দ্রৌপদীকে নিয়ে আপনি বনের আশ্রমে অপেক্ষা করুন, আমার হাত থেকে জয়দ্রথের আজ রক্ষা নেই। ভীমের কথার মধ্যেই এমন এক রুদ্র ইঙ্গিত ছিল, যা যুধিষ্ঠিরকে সচকিত করে তুলল।

এমন অবস্থায় কার না রাগ হয়? রাগ যুধিষ্ঠিরেরও হয়েছে, ভীমেরও হয়েছে, অর্জুনেরও হয়েছে। চরম অপমানে ক্ষুব্ধ হয়েছেন দ্রৌপদী নিজেও। কিন্তু এই সঙ্কটকালেও ব্যক্তিগত সমস্ত হানির মধ্যেও বিরাট এবং গভীর পুরুষ কিন্তু তাঁর সমস্ত পরিমণ্ডলের কথা মনে রাখেন। ভীমের ভাব দেখেই যুধিষ্ঠির বললেন—যত বদমাইশ হোক, একেবারে প্রাণে মেরে ফেলো না তাকে। বেচারা দুঃশলা-ভগিনীর কথা মনে রেখো। তার খুড়তুতো ভাইদের হাতে দুঃশলার স্বামী মারা যাবে, বিধবা হবে, ধর্মময়ী গান্ধারীর মনের কী দশা হবে—একটু মনে রেখো ভাই—দুঃশলামভিসংস্মৃত্য গান্ধারীঞ্চ যশস্বিনীম্। বেচারাকে প্রাণে মেরো না।

কথাগুলি এমন এক ব্যাপ্ত-গভীর-হৃদয় থেকে উৎসারিত হচ্ছে যা সমসাময়িক ঘটনার নিরিখে ভীষণভাবে প্রতিবাদ করা যেতে পারে, কিন্তু কথাগুলি অতিক্রম করা কঠিন। হ্যাঁ, প্রতিবাদ অবশ্য হল। দ্রৌপদী তাঁর জ্যেষ্ঠ-স্বামীর স্থিরতা এক মুহূর্তে উড়িয়ে দিয়ে সেই ক্ষণেই বললেন না, ভীম। না, যুধিষ্ঠিরের কথা শুনো না। ভীম-অর্জুন দু’জনেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু দ্রৌপদী ভীমকেই শুধু বললেন—তুমি যদি আমার ভাললাগার মতো কিছু করতে চাও, তা হলে সেই পাপা কুলাঙ্গার জয়দ্রথকে তুমি কিছুতেই ছাড়বে না, একেবারে মেরে ফেলবে কৰ্ত্তব্যং চেং প্রিয় মহং বধ্যঃ স পুরুষাধমঃ।

ভীম-অর্জুন—এই দুই পৃথক ব্যক্তিত্ব আরও দুই পৃথক ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে চরম দুই আদেশ শুনে জয়দ্রথকে ধরতে রওনা হলেন। অর্জুনের অস্ত্রনৈপুণ্য এমনই যে এক ক্রোশ দূর থেকে বাণ ছুঁড়ে জয়দ্রথের রথের ঘোড়া দুটিকে আগে মেরে ফেললেন। জয়দ্রথ তখন দৌড়চ্ছেন। অর্জুন বললেন—ফিরে এসো জয়দ্ৰথ, এই ক্ষমতা নিয়ে তুমি বীররমণীর জন্য লুদ্ধ হও? এসব ভদ্র ভাষা ভাম বোঝেন না। ঝড়ের গতিতে দৌড়ে গিয়ে তিনি জয়দ্রথকে ধরে ফেললেন। অর্জুন শুধু বললেন—প্রাণে মেরো না। ভাম জয়দ্রথকে চুল ধরে মাটিতে ফেলে কিল, চড়, লাথি, ঘুষিতে এমন অবস্থা করলেন তাঁর যে, জয়দ্রথ অজ্ঞান হয়ে গেলেন। অর্জুন দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করলেন—ভগিনী দুঃশলার কথা মনে রেখো, আর কিছু নয়।

সেই একই সুর, সেই একই স্থিরতা। যুধিষ্ঠিরের ভাই এবং শিষ্যের মুখ থেকে যে কথাটা বেরুল—এরও প্রতিবাদ করা যায়, কিন্তু অতিক্রম করা যায় না। শুধু ছোটভাই বলে ভীম বাড়তি যে সুবিধাটুকু পেলেন তাতে প্রতিবাদের ভাষায় এইটুকু সংযোজন হল—শুধু আমি হলে, দ্রৌপদীর সঙ্গে ও যা ব্যবহার করেছে, তাতে এ ব্যাটা আমার হাত থেকে বাঁচত না। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের যে দয়ার শরীর-ভীম ব্যঙ্গ করে বললেন—আর তুমি হলে আরেক মাথামোটা, সবসময় আমার কাজে বাধা দিচ্ছ-ত্বঞ্চ বালিশয়া বুদ্ধ্যা সদৈবাস্মান প্রবাধসে। ভীম গালাগালি দিলেন বটে, কিন্তু অর্জুনকে অতিক্রম করতে পারলেন না। দ্রৌপদী, যিনি অত করে ভীমকে বলেছিলেন, সেই তিনিও অতিক্রম করতে পারেননি। ভীম জয়দ্রথকে মাথা মুড়িয়ে চরম অপমানের চুনকালি দিয়ে যুধিষ্ঠিরের সামনে উপস্থিত করেছিলেন। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন—যথেষ্ট হয়েছে, ছেড়ে দাও ভাই। ভীম বললেন—আপনি বললে কী হবে—দ্রৌপদীকে বলুন-দ্রৌপদ্যাঃ কথ্যতামিতি। আমরা জানি সেই মুহূর্তেও যদি দ্রৌপদী বলতেন—তাহলে ভীম তাঁকে মেরেই ফেলতেন। কিন্তু দ্রৌপদীর কী হল? তিনি একবার জ্যেষ্ঠ-স্বামীর দিকে তাকলেন—অভিপ্রেক্ষ্য যুধিষ্ঠির। কিন্তু দ্রৌপদীর দিকে যুধিষ্ঠির আর তাকাননি, যদি এই মুহূর্তে তিনি তাঁকে লঙঘন করেন। কিন্তু না, অতিক্রম করা সম্ভব হল না। দ্রৌপদী নিজের গরিমা লঘু করে এমন ভাব দেখালেন, যেন এই যথেষ্ট হয়েছে—ও, তুমি ওর মাথা মুড়িয়ে দিয়েছ, তাহলে তো ও আমাদের গোলাম এখন, দাও চাকরটাকে ছেড়েই দাও।

দুটি বিপরীতমুখী লোকের কাছ থেকে দুটি বিপরীতমুখী লোক দুটি আদেশ শুনেছিল। কিন্তু গভীর, ধীর এবং ব্যাপ্ত এক হৃদয় যা শুধু মহাভারতের ব্যাপ্ত পরিমণ্ডলের সঙ্গেই মিলে যায়, সেই হৃদয় থেকে যখন আদেশ নেমে আসে, তখন অতি কঠিন ভীমের মতো মানুষও ছোটভাই অর্জুনের একটা বাক্য অতিক্রম করতে পারেন না। শুধু একটা কথা—মা বধীরিতি—প্রাণে মেরো না। ভীম গালাগালি দিয়েও আদেশের মতো অর্জুনের এই শব্দ কটি অতিক্রম করতে পারেননি। দ্রৌপদীও পারলেন না—তাঁর সমস্ত অপমান গায়ে মেখেও যুধিষ্ঠিরের সেই পরিব্যাপ্ত সর্বতোভদ্র অভিলাষ তিনি অতিক্রম করতে পারলেন না। এই ব্যক্তিত্বের জাত এতই আলাদা, এতই একক যে সাধারণ বুদ্ধিতে এ যেন সওয়াও যায় না, অবহেলাও করা যায় না। এই ব্যক্তিত্বের সর্বগামিতা এতই বেশি যে প্রতিবাদের পরের মুহূর্তেই তা সযৌক্তিক হয়ে পড়ে। অর্জুনও তখন যুধিষ্ঠিরের ছায়া হয়ে থাকেন না। তিনি যুধিষ্ঠিরের সর্বতোভদ্র ধর্মের প্রয়োক্তার মতো দেখা দেন। যুধিষ্ঠির যা মুখে বলেছেন অথচ শক্তিতে সামর্থে করতে পারছেন না, অর্জুন সেটাই আপন শক্তি এবং সামর্থ্যের গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করেন। যুধিষ্ঠির যে সিদ্ধির কথা উচ্চারণ করেন, অর্জুন তার সাধনোপায়।

কিন্তু তাই বলে অর্জুন যুধিষ্ঠির নন। যুধিষ্ঠিরের ধৈৰ্য্য, সহ্য এবং ত্যাগও যেন মাত্রাছাড়া, অলৌকিক পর্যায়ের। অর্জুন তা সম্পূর্ণ অধিগত করতে পারেন না। তাঁর বিকার আছে, প্রতিটি বিপন্ন মুহূর্তে তাঁর প্রতিক্রিয়া আছে, কিন্তু সে বিকার সে প্রতিক্রিয়া তিনি চাপতে পারেন। তাঁর বিকার, বা প্রতিক্রিয়া ঘটনার মুহূর্তে প্রকাশ না পেলেও, পরে তা প্রকাশ পায়, এবং তা তিনি মনেও রাখেন। ধর্মরূপী যক্ষ যখন তাঁর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জল খেতে নিষেধ করেছিলেন, অর্জুন তা শোনেননি। তার সবচেয়ে বড় কারণ এই নয় যে তিনি গোঁয়ার, তার কারণ তিনি তাঁর অতি প্রিয় দুই ভাই নকুল আর সহদেবকে সেই মুহূর্তে মৃত পড়ে থাকতে দেখেছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ধনুবাণ হাতে নিয়েছেন এবং অবজ্ঞা করার জন্যই যেন অবজ্ঞা করে জলে হাত দিয়েছেন। ফল যা হওয়ার হয়েছে, কিন্তু সেই মুহূর্তেই তিনি অতিমানুষ-চরিত্র-সম্পন্ন যুধিষ্ঠিরের থেকে আলাদা হয়ে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে গেছেন। বিপ্রতীপভাবে এই সব জায়গায় যুধিষ্ঠিরের ধৈর্য-স্থৈর্য বুদ্ধদেব বসু মহাশয় তাঁর অসামান্য ভাষা শৈলীতে প্রকাশ করেছেন। আমি এক্ষেত্রে কলম ধরবার উপযুক্ত বোধ করি না নিজেকে। তবে অর্জুনের একান্ত মানুষোচিত বিকারগুলি আমি সময়মতো আরও কিছু দেখাব, যা আমার মতে শুধু মানুষোচিত নয় ভারতের নায়কোচিতও বটে।