অর্জুন – ১০

১০

পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিরাটের রাজধানীতে পাণ্ডব-সহায় রাজারা সবাই প্রায় সমবেত হলেন—দ্রুপদ, কৃষ্ণ, বলরাম এবং আরও কিছু কর্তাব্যক্তি। এই সব সভায় আমরা অর্জুনকে প্রায় কথা বলতে দেখিনি। তাঁর গাণ্ডীব এবং দিব্য-অস্ত্রের চেতনায় অন্য যোদ্ধাব্যক্তিরা অনেকেই বারংবার বলে গেছেন যে, অর্জুনের সামনে আসলে আর রক্ষে নেই। কিন্তু অর্জুনকে আমরা কিছু বলতে দেখছি না। এমনকী কুরুসভায় দ্রুপদের যে দৃত প্রথম গিয়ে পাণ্ডবদের জন্য রাজ্য যাচনা করছে, সেই দূতও ধৃতরাষ্ট্র এবং কুরুবৃদ্ধদের অর্জুনের ভয় দেখাচ্ছে। বলছে—তোমাদের একদিকে ওই এগারো অক্ষৌহিণী সেনা আর একদিকে অর্জুন—সত্যি বলছি, তোমরা পার পাবে না! আর শুধু পাণ্ডবদের দূতই বা কেন, কারণ ধরে নিতে পারি—সে অজুনের গুণ বাড়িয়ে বলছে, কিন্তু দুর্যোধনের পক্ষেও যাঁরা শান্তিকামী আছেন, তাঁরাও অর্জুনের ভয় দেখিয়ে দুর্যোধনকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছেন। স্বয়ং ভীষ্মের মতো অত বড় ইচ্ছামৃত্যু যোদ্ধা পয়স্তি সেই সময় কুরুসভাকে উদ্দেশ করে বলেছেন—অর্জুনের মতো অস্ত্রবিৎ মহারথ যোদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধ করবে কে? স্বয়ং ইন্দ্রও যদি বজ্র হাতে নেমে আসেন ভুঁয়ে, তবে তাঁর পক্ষেও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা সম্ভব হবে কি না জানি না, অন্য ধনুর্ধরদের কথা আর কী বলব—কিমুতান্যে ধনুর্ভৃতঃ?

কুরুসভায় অর্জুনের সম্বন্ধে ভীষ্মের ধন্যধ্বনিতে কর্ণের গা যেন জ্বলে গেল। তিনি একেবারে রে রে করে ভীষ্মের কথার প্রতিবাদ করলেন, অনেক অপকথাও বললেন সঙ্গে। ভীষ্ম আর থাকতে পারলেন না। বললেন—এত বড় বড় বাত দিয়ে তো লাভ নেই—কিছু রাধেয় বাচা তে—তুমি তোমার কর্মটা স্মরণ করো। বিরাটরাজার গো-হরণের সময় অর্জুন একা আমাদের দু’জনকে কাত করে দিয়েছিল। অতএব এখন পাণ্ডবদের এই রাজ্য ফিরিয়ে না দিয়ে যদি তোমার কথা শুনি, তা হলে অর্জুনের বাণে যুদ্ধক্ষেত্রে শুয়ে শুয়ে ধুলো খেতে হবে, বুঝলে— ধ্রুবং যুধি হস্তেন ভক্ষয়িষ্যামঃ পাংশুকান্। ভীষ্মের কথা শুনে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রও খানিকটা থতমত খেয়ে শেষ পর্যন্ত সঞ্জয়কে দূত করে পাঠালেন পাণ্ডবদের কাছে। ধৃতরাষ্ট্রের বাতায় শান্তির বাণী ছিল, পাণ্ডবদের জন্য সোৎসুক কুশল প্রশ্ন ছিল, কিন্তু হৃতরাজ্যের প্রতিদান নিয়ে কোনও বরাভয় ছিল না। সরলমতি যুধিষ্ঠির পর্যন্ত সে সব কথায় ভুললেন না। কিন্তু ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার, কুরুসভার দৃত সঞ্জয়ের সঙ্গে যা কথাবার্তা হল—তা সবই প্রায় যুধিষ্ঠির উবাচ। অর্থাৎ যুদ্ধ, শান্তি বা নীতি-নিয়ম নিয়ে যা কথাবাতা হল, তা সবই প্রধানত সঞ্জয়ের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের। হ্যাঁ, কুরুসভায় দ্রৌপদীর অপমান, পাশা-খেলা ইত্যাদির প্রতিক্রিয়া হিসেবে অর্জুন কিংবা ভীমের মনোভাব যুধিষ্ঠির জানাতে ভোলেননি, কিন্তু অর্জুন সেখানে বড়দাদাকে অতিক্রম করে কোনও কথাই বলেননি! অথচ সঞ্জয় যখন কুরুসভায় ফিরে পাণ্ডবদের বিশেষত যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য নিবেদন করার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন, তখন—কী আশ্চর্য, ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে প্রথম প্রশ্ন করছে—বলে সঞ্জয়। কুরুসভায় রাজাদের কাছে বলার জন্য সেই অর্জুন কী বার্তা পাঠিয়েছেন?

সঞ্জয় বললেন বটে, তবে অর্জুনের যা মনোভাব ছিল, তা অর্জুনের জবানীতে বললেন। সেই ওজস্বিনী ভাষার মধ্যে অর্জুনের নিজস্ব অহঙ্কার যতটুকু ছিল, তা সবটাই যেন ভাইদের বীর্যবত্তার জন্য। যুদ্ধ লাগলে ভীম কী করবেন, যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব, অভিমন্যু কতটা ক্ষতি করবেন। কৌরবদের—সেই স্তুতিতেই অর্জুনের ভাষা প্রধানত খর হয়ে উঠেছিল। ফলত নিজের কথা যখন এল তখন গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে অহঙ্কারও কিছু মিশে গেল তাঁর ভাষণে। এই প্রথম আমরা অর্জুনকে জোরালো ভঙ্গিতে বলতে শুনলাম যে, যখন যুদ্ধকালে আমার গাণ্ডীবের টঙ্কার শোনা যাবে তখন মন্দবুদ্ধি কৌরবরা অনুতাপ করবে—কেন যুদ্ধ করতে এলাম। যখন মেঘের ভিতর থেকে বিদ্যুৎ-ফুলিঙ্গের মতো, গাছ থেকে পাকা ফলের মতো আমার বাণগুলি পড়বে দুর্যোধনের সৈন্য-সামন্ত আর তার নিজের ঘাড়ে—তখন তারা অনুতাপ করবে।

অর্জুনের ভাষণ দীর্ঘতর ছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে তাঁর কথায় আত্মগরিমার আভাস পাওয়া গেল, সেই মুহূর্তেই তিনি বন্ধু কৃষ্ণের অলৌকিক ক্ষমতার দিকে কথা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। অসংখ্য যুদ্ধে তাঁর পারদর্শিতার খবর দিয়ে অর্জুন বলেছেন—সবার ওপরে বৃদ্ধ পিতামহ, আচার্য দ্রোণ, কৃপ এবং মহামতি বিদুর আছেন—তাঁরা যা বলবেন, তাই হবে। তাতে কুরুকুলের আয়ু বাড়ক—এতে সর্বে যদ বদস্ত্যেতদস্তু/আয়ুষ্মন্তঃ কুরবঃ সন্তু সর্বে। বস্তুত কুরুবৃদ্ধরা প্রত্যেকেই প্রধানত অর্জুনের ভয়ে যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছেন, কিন্তু তাঁদের চেষ্টা ফলবতী হয়নি। দুর্যোধন গোঁয়ার ছেলের মতো বাবা-মা ঠাকুরদাদা কারও কথাই শোনেননি। উল্টো দিক দিয়ে আপনারা অর্জুনকে দেখুন। এই কিছুক্ষণ আগে যাঁকে আমরা কথঞ্চিৎ আত্মগৌরব প্রকাশ করতে দেখেছি, এই যিনি দুর্যোধনের ভবিষ্যৎ অনুতাপ নিয়ে কথঞ্চিৎ তৃপ্ত হয়ে পড়েছিলেন, সেই অর্জুন নিজেকে আত্মজনের স্বার্থে, বিশ্বজনের স্বার্থে কতটা পরিবর্তিত করছেন।

কোনওদিক দিয়েই কোনও কিছু ফল হল না দেখে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের দূত হয়ে কুরুসভায় যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। যাবার আগে আসন্ন যুদ্ধের ইতিকর্তব্য সম্বন্ধে তিনি প্রত্যেক পাণ্ডবকে তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত জিজ্ঞাসা করেছেন। আর কী মহানুভবতা এই পাণ্ডবদের। যুদ্ধে লোকক্ষয় এবং স্বজনবিনাশ যাতে না ঘটে, সেজন্য শুধু যুধিষ্ঠির নয়, ভীমের মতো ওইরকম আপাতক্ৰোধী মানুষও সেখানে শান্তির কথাই বললেন। কৃষ্ণ পর্যন্ত এতে আশ্চর্য হয়ে গেছেন। কিন্তু ওই যে আগে বলেছি, যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন—এই দুজনের মধ্যেই এমন এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব ছিল যাকে ইচ্ছে করলেই অবহেলা করা যায় না। ভীম জানতেন—যুধিষ্ঠির যা বলেছেন, অর্জুনও তাই বলবেন। বিশেষত যুধিষ্ঠির যেটা বলবেন তাঁর গভীর দার্শনিক বুদ্ধির প্রমাণে, অর্জুন সেটাই বলবেন তাঁর নিপুণ অস্ত্রশিক্ষার গৌরব বিনীত করে। অস্ত্রের শাসনে মানুষের কতটা ক্ষতি হতে পারে সেটা তিনি অত্যন্ত মানবিকভাবে চিন্তা করতে পারেন বলেই আপন অধিগত অস্ত্রবিদ্যা—যা নাকি তাঁকে উদ্ধতও করতে পারত, তাই তাঁকে উদাত্ত এবং প্রশান্ত করে তুলেছে। ফলে কৃষ্ণ যখন অর্জুনের মত জিজ্ঞাসা করলেন, তখন তিনি বললেন—আমার যা বলার ছিল, যুধিষ্ঠিরই তা বলে দিয়েছেন—উক্তং যুধিষ্ঠিরেণৈব যাবদ্‌ বাচ্যং জনার্দন।

অর্জুন যুধিষ্ঠিরের মতে মত মিলিয়ে দিলেন দেখে কেউ যদি আবারও ভাবেন অর্জুন যুধিষ্ঠিরের ছায়া মাত্র—তা হলে কিন্তু আবারও মস্ত ভুল হবে। মনে রাখা দরকার, যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে কুরুসভায় পাঠাতেই চাননি। প্রথমত তিনি জানতেন, এই শান্তির প্রস্তাব ব্যর্থ হবে। দ্বিতীয়ত সমাগত রাজবৃন্দ এবং কুরুসভার মধ্যে কৃষ্ণের মতো মানুষের প্রস্তাব বিফল হবে—এটা যুধিষ্ঠিরের ভাল লাগেনি। কিন্তু কৃষ্ণ রাজনীতিটা যুধিষ্ঠিরের থেকে ভাল বুঝতেন এবং সেই কারণেই শান্তির প্রস্তাব ব্যর্থ করার রাজনৈতিক দায় যাতে কৌরবদের ওপর পড়ে—সেইজন্যেই কুরুসভায় যেতে চেয়েছেন। অন্যদিকে অর্জুনকে লক্ষ করুন। তিনি যুধিষ্ঠিরের শান্তি কামনায় সম্মতি জানিয়েছেন, কিন্তু অহেতুক দার্শনিকতার মধ্যে যাননি, কারণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দার্শনিকতার পরিণতি নয়, রাজনীতিরই পরিণতি। অতএব যুধিষ্ঠিরের বাক্য সমর্থন করেই অর্জুন কৃষ্ণের দিকে ঝুঁকেছেন।

অর্জুন বললেন—তোমার কথাটা আমার বেশ ভাল লেগেছে, কৃষ্ণ! তুমি নিশ্চয় এটা বুঝেছ যে, এখন আমাদের খারাপ অবস্থার নিরিখে এবং ধৃতরাষ্ট্রের লোভের নিরিখে কিছুতেই সন্ধি হওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া তুমি বলেছ—যুদ্ধ যে তুমি চাও না, তা মোটেই নয়। তা যদি হয়, তবে যুদ্ধই হোক। কৃষ্ণের কাছে নিজের অন্তর্গত মনের কথাটা জানিয়েই আবার যুধিষ্ঠিরের মনোগত ইচ্ছায় স্থিত হয়েছেন অর্জুন—অর্থাৎ যুদ্ধ নয় শান্তিই চাই। যে অদ্ভুত প্রাজ্ঞতায় এখানে তিনি যুধিষ্ঠিরের ওপরে কথা বলে পুনরায় যুধিষ্ঠিরের দিকে ঝুঁকলেন—তা বলে বোঝানো যাবে না। একইভাবে কৃষ্ণকে এবং অন্য ভাইদের স্মরণ করিয়ে দিলেন আরও দুটি পুরাতন কথা। এক, রাজসভায় আহূত হয়ে যুধিষ্ঠির পাশা খেলে কোনও অন্যায় করেননি, বরঞ্চ কপট পাশা খেলে কৌরবরাই তাঁদের বনবাসের কষ্ট দিয়েছে। দুই, যুধিষ্ঠিরকে সমর্থন করার পরেও অর্জুন এবার অত্যন্ত সচেতনভাবে দ্রৌপদীর প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। বলেছেন—তুমি তো জানো কৃষ্ণ! কীভাবে দ্রৌপদী সভার মধ্যে অপমানিত হয়েছেন এবং পাণ্ডবদের মনের ভিতর যে সেই অপমান এখনও ক্রিয়া করছে—এও তুমি নিশ্চয়ই জানেনা। অর্জুনের যুক্তিটাই অন্যরকম। যুধিষ্ঠিরের পাশা-খেলা এবং দ্রৌপদীর অপমান দুটোকে তিনি আলাদা ইসু ভাবেন। অর্থাৎ দ্রৌপদীর অপমানের জন্য তিনি কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে পারেন, কিন্তু সেই অপমান যে যুধিষ্ঠিরের জন্যই হয়েছে—এটা তিনি মনে করেন না। যুধিষ্ঠিরকে কপট-পাশায় দুর্যোধনেরা হারিয়েছে এবং তাদেরই অন্যায়-পরম্পরায় দ্রৌপদীর অপমান অন্য একটি অপমানমাত্র। এর জন্য কৌরবেরাই দায়ী, যুধিষ্ঠির নয়।

এই যে একদিকে শুদ্ধবুদ্ধি যুধিষ্ঠিরকে সবার কাছ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা এবং অন্যদিকে ধর্মপত্নী দ্রৌপদীর অপমানের জন্য তাঁর যুদ্ধ ঘোষণা—এই দুটোই অর্জুনকে যতখানি ‘ব্যালান্সড্‌’ মানুষটি করে তুলেছে, ঠিক ততখানিই যুধিষ্ঠিরের মতো ব্যক্তিত্ব থেকে তাঁকে পৃথক করে ফেলেছে। কৃষ্ণ শান্তির বাণী নিয়ে কুরুসভায় যাবার আগে একবার কুন্তীর কাছে গেলেন। এই অবসরে মহারানি কুন্তী যাঁর কথা বারবার স্মরণ করেছেন তিনি অর্জুন। বারবার কুন্তী আক্ষেপ করেছেন যে, এত অপমানিত হওয়া সত্বেও, সে এসব সইছে কী করে? উপহাস করে বলেছেন—আহা যেদিন অর্জুন আমার কোলে এল, দেবতারা আকাশবাণী করে বলেছিলেন—এই ছেলে তোমার বিশ্বজয় করবে। হায় কিসের কী? গম্ভীর হয়ে কুন্তী বলেছেন—আমার কথা বলে তুমি তাকে বোলো, কৃষ্ণ—যে বিপন্ন সময়ের জন্য ক্ষত্রিয় জননীরা বীরপুত্র গর্ভে ধারণ করে, সেই সময় এখন এসে গেছে—যদর্থং ক্ষত্রিয়া সুতে তস্য কালো’য়মাগতঃ। জননীর হাহাকারে, দ্রৌপদীর অপমানে বীরগভা কুন্তী আহত আপ্লুত হয়ে কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না—এত অস্ত্রশক্তি, এত নিপুণতা নিয়েও অর্জুন কেন চুপ করে আছে? কিন্তু এর উত্তর যে তিনি জননী হিসেবে প্রথম কুশল প্রশ্নেই কৃষ্ণকে বলে নিয়েছেন—সে কথা তাঁর খেয়াল নেই। কুন্তী বলেছিলেন—আমার অর্জুন কেমন আছে কৃষ্ণ। আমার অর্জুন—সূর্যের মতো যার তেজ, শম-দম ইত্যাদি সাধন যার ঋষির মতো, ক্ষমাতে যে সর্বংসহা বসুন্ধরার মতো, আর ইন্দ্রের মতো যার বিক্রম—সেই ধনঞ্জয় অর্জুন কেমন আছে, কৃষ্ণ?

এই বিশ্বসংসারে জননীই যেহেতু তাঁর পুত্রকে সব থেকে বেশি চেনেন, তাই অর্জুনের সম্বন্ধে কুন্তীর এই মূল্যায়ন আমরা খুব বেশি মূল্যবান মনে করি। যে মানুষের মধ্যে পরস্পর-বিরোধী রোগ আছে, তার চিকিৎসা করা যেমন কঠিন, তেমনই সূর্যের মতো যাঁর তেজ অথচ পৃথিবীর মতো যাঁর ধারণশক্তি, তাঁকে কারণ উপস্থিত হলেই উদ্দীপ্ত করা কঠিন। এই ধাতের মানুষেরা অপেক্ষা করে থাকেন। যখন পৃথিবী তার ধারণসীমা অতিক্রম করে, যখন অন্যায় অন্ধকার রাত্রির মতো ঘন হয়ে ওঠে, তখনই উপযুক্ত সময়ে সূর্যের মতো আত্মপ্রকাশ করেন অর্জুন। দুর্যোধনের অহঙ্কারে এবং নিবুর্ধিতায় কৌরবদের কাল পরিণত হয়ে এসেছিল এবং এই উপযুক্ত সময়ে অর্জুনকেও আমরা কথা বলতে দেখেছি, তাঁকে উদ্যোগী হতেও দেখছি। যুধিষ্ঠির-অর্জুনের আশঙ্কা অনুযায়ী কৃষ্ণের শান্তিকামনা সার্থক হল না এবং আবারও বীর জননী কুন্তী যুদ্ধক্ষেত্রে আপন কনিষ্ঠ পুত্রকে আহ্বান জানালেন, কারণ তাঁর মতে সমস্ত পাণ্ডবরা অর্জুনের ওপরেই প্রধানত ভরসা করে—যস্য বাহুবলং সর্বে পাণ্ডবাঃ পর্যপাসতে।

কৃষ্ণের দৌত্য বিফল হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গেই পাণ্ডবরা যুদ্ধের প্রস্তুতি আরম্ভ করলেন। পাণ্ডবদের সেনাপতি নির্বাচিত হলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং এই নির্বাচন অর্জুনের ভোটেই। কৃষ্ণ নির্বাচন সমর্থন করেছেন। সেনাপতি নির্বাচন করার সময় সবাইকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। সহদেব মৎস্যরাজ বিরাটের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। নকুল সেনাপতি হিসেবে চেয়েছিলেন দ্রুপদকে। এমনকী ভীম শিখণ্ডীকে চেয়েছিলেন সেনাপতি করতে। কিন্তু অর্জুনের নির্বাচনই যে সবচেয়ে বুদ্ধিসম্মত ছিল, তা বোঝা যায় কৃষ্ণের সমর্থনে। প্রথমত ধৃষ্টদ্যুম্ন নির্বাচিত হলে, দ্রুপদ এবং শিখণ্ডীর কিছুই বলার থাকে না, কারণ তাঁরা এক ঘরেরই মানুষ। দ্বিতীয়ত ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি অর্জুনের সমর্থনের পিছনে আরও একটা গুঢ় কারণ ছিল বলে আমরা মনে করি, তবে তা ঠিক কি না, মহাভারত-রসিকেরা তা বিচার করে দেখবেন। কুরুসভায় দ্রৌপদীর অপমান পঞ্চপাণ্ডবদের মনে কাঁটার মতো বিঁধে ছিল। কিন্তু উদ্যোগ-পর্বে কৃষ্ণ শান্তির দূত হয়ে যাবার সময় সবাই যখন শান্তির কথা বলতে শুরু করলেন, বিশেষত ভীম এবং অর্জুন—যাঁরা দ্রৌপদীর অপমানে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন, তাঁরাও যখন শান্তির দিকেই ঝুঁকতে লাগলেন তখন আরও একবার অভিমানে ফেটে পড়লেন দ্রৌপদী। তিনি বললেন—যুদ্ধ যাতে লাগে সেই ব্যবস্থাই তোমার করতে হবে কৃষ্ণ। পঞ্চপাণ্ডবের ঘরণী হয়ে রাজসভায় এ অপমান আমি সহ্য করেছি, তার প্রতিবিধান যদি এঁরা না করেন, তাহলে ধিক ভীমসেনের শক্তিতে। ধিক অর্জুনের ধনুষ্মত্তায়। আমি আবারও বলছি—যদি ভীম অথবা অর্জুনের মতো মহাবীর সেই অপমানের কথা মাথায় রেখেও এখন হঠাৎই সন্ধিকামুক হয়ে ওঠেন, তবে জেনো—আমার বুড়ো বাবা, আমার ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং আমার ছেলেরা আমার জন্য যুদ্ধ করবে—পিতা মে যোৎসতে বৃদ্ধঃ সহ পুত্রৈ মহারথৈঃ।

আমার ধারণা—যুদ্ধকালে পান্ডবদের সেনাপতি নির্বাচনের সময় দ্রৌপদীর এই অভিমানের কথাটা অর্জুনের মনে হি! চিরকালই তিনি কথা বলেন কম, কিন্তু কথা তাঁর মনে থাকে বড় বেশি। তাই সহ যখন উপিস্থত হল, তিনি প্রথমেই সেনাপতিত্বের জন্য ধৃষ্টদ্যুম্নের নাম উল্লেখ করলেন। কৃষ্ণের সমপথে এই নির্বাচনের পিছনে রাজনৈতিক এবং পারিবারিক মাত্রা বিনা কথায় যুক্ত হয়ে গেল। কুরুক্ষেত্রে ধর্মক্ষেত্রে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। দুর্যোধনের শিবিরে বিরাট জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেল—কে কতদিনে পাণ্ডবদের উৎখাত করতে পারেন। ভীষ্ম বলেছেন—আমি একমাসে সব শেষ করতে পারি, দ্রোণ বলেছেন—আমিও তাই। কৃপাচার্য সময় নিয়েছেন দু’মাস, অশ্বত্থামা দশদিন আর কর্ণ পাঁচদিন। সব শুনে যুধিষ্ঠির তো একটু ভয়ই পেয়ে গেলেন। তিনি বললেন—হ্যাঁ গো অর্জুন, সবাই যে দশদিন, পাঁচদিন সব বলছে, তা তুমি কত সময়ে এই বিরাট কুরুসৈন্য ধ্বংস করতে পার? অর্জুন উত্তর দিলেন। সবাই জানেন এবং আমিও পূর্বে এ-কথা উল্লেখ করেছি যে, শুধুমাত্র এই উত্তরের ওপর নির্ভর করে যুধিষ্ঠির অর্জুনের মৃত্যুকালীন বিচার করেছিলেন। যুধিষ্ঠিরের মতে অর্জুনের কথার মধ্যে অহঙ্কার ছিল। তিনি নিজেকে এতবড় ধনুর্ধর ভাবতেন যে, ভীষ্ম-দ্রোণ-কৰ্ণ যা পারেন না, তাই তিনি একদিনে করে দেবেন বলেছিলেন। বস্তুত মহাভারতের যে জায়গাটায় এই প্রশ্নাত্তর-পর্ব ঘটেছে, সেখানে আমরা অর্জুনকে একটুও অহঙ্কারী দেখিনি, বরঞ্চ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনয় আমাদের মুগ্ধ করেছে। অর্জুন প্রত্যুত্তরে যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন—যাঁদের কথা আপনি বললেন, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ—এঁরা প্রত্যেকেই অসাধারণ ধনুর্ধর। যা তাঁরা বলেছেন, তাঁরা তা করতেও পারেন—এ ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু তার জন্য আপনার কোনও দুশ্চিন্তার কারণ নেই। মহামতি বাসুদেব সহায় থাকলে—এক নিমেষে আমি সমস্ত ভূত-চরাচর ধ্বংস করতে পারি। তার কারণ আমার কাছে শিবের দেওয়া সেই পাশুপত-অস্ত্র আছে—যা ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অশ্বত্থামা—কারও কাছেই নেই। দেবদেব পশুপতি যুগান্তসময়ে তাঁর সংহার-লীলার জন্য যে অস্ত্র প্রয়োগ করেন—তা তিনি আমাকে দিয়েছেন।

এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু অর্জুন জানিয়েছেন—তবু কিন্তু আমি এই অস্ত্রের সাহায্য নেব না, কারণ এই দিব্য-অস্ত্র সাধারণ যুদ্ধে প্রয়োগযোগ্য নয়। আমি যুদ্ধ করব, সবাই যেমন যুদ্ধ করে তেমনই, একেবারে বিশিষ্ট অস্ত্রের বিরুদ্ধে বিশিষ্ট অস্ত্র—ঋজুযুদ্ধ। এই যুদ্ধের ক্ষেত্রে অর্জুন কোনও সময়সীমা উল্লেখ করেননি, বরঞ্চ সবিনয়ে ধ্রুপদ, বিরাট, ধৃষ্টদ্যুম্ন—ইত্যাদি স্বপক্ষীয় ধনুর্ধরদের কথা গৌরব সহকারে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন—এঁরা থাকতে আপনার চিন্তা কী মহারাজ? এই বাক্যগুলির মধ্যে কোথাও কোনও অহঙ্কারের স্পর্শমাত্র আছে বলে আমাদের মনে হয় না। আর ভীষ্ম-দ্রোণ ইত্যাদি মহাধনুর্ধরদের কথার প্রতিক্রিয়ায় অর্জুন যে নিমেষে শত্রুশাতনের সম্ভাবনার কথা বলেছেন—তার মধ্যে তাঁর নিজের অহঙ্কার যতখানি ছিল, তার চেয়ে মহাদেবের দেওয়া পাশুপত-অস্ত্রের গৌরব ছিল একশোগুণ বেশি। তবু কিন্তু তিনি এই অস্ত্রের গৌরব আত্মসাৎ করতে চাননি। বরঞ্চ বলেছেন—আমি ঋজুযুদ্ধ করব অর্থাৎ আমি যা পারি—দিব্য-অস্ত্রের গেীরবে তার বেশি কিছু করব না বা করে দেখাতে চাই না।

এই কথার পরেও যুধিষ্ঠির, মনে রাখবেন—ধর্মবিৎ, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির যে তুচ্ছ ব্যপদেশে মৃত্যুর দায় দিয়েছেন অর্জুনকে—তা যুক্তিযুক্ত মনে করি না। মনে করি না—তার কারণ আরও গভীর হতে পারে এবং অনেক সময় গভীর এবং কোনও সঙ্গত কারণ লুকোনোর জন্যে মহাজনেরাও তুচ্ছ কারণ তাশ্রয় করেন। আমাদের ধারণা—যে দোষে দ্ৰেীপদীকে দায়ি করেছে যুধিষ্ঠির—অর্থাৎ পাঁচ পাণ্ডবকে বিয়ে কয়েও দ্রৌপদী অর্জুনকে বেশি ভালবাসতেন—উল্টো দিক দিয়ে একইরকম আশঙ্কা অর্জুনের ব্যাপারেও লালন করেননি তো যুধিষ্ঠিত? অন্তত মনে মনে? অর্জুন যে দ্রূপদসভায় সমস্ত বীরমণ্ডলীর মাথা হেট করে দিয়ে দ্রৌপদীকে লাভ করেছিলেন—এ-কথা কি যুধিষ্ঠির ভুলতে পেরেছিলেন?। অরজুন ছাড়া অন্য কোনও পান্ডবই যে সেই অসম্ভব মৎস্য-লক্ষ্য ভেদ করতে পারতেন না—এ-কথা কি যুধিষ্ঠির সব সময় মনে রাখেননি? যদি মনে নাও রাখতেন স্বয়ং দ্রৌপদীই কি কথাপ্রসঙ্গে যুধিষ্ঠিরকে তাঁর প্রকৃত অধিকার কথা মনে করিয়ে দেননি? এই তো সেদিন যখন বনবাসের কুটিরে কৃষ্ণ এসে পৌঁছলেন পাণ্ডবদের কাছে, তখন তো দ্রৌপদী নিজের অভিমান প্রকাশ করার সময় নিজের এবং পাণ্ডবদের কষ্টসংকুল জীবনকথা বলতে বলতে পরিষ্কার বলেই ফেললেন—তারপর তো সেই দ্রুপদের রাজসভায় এসে সবার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাকে জয় করে নিলেন সব্যসাচী অর্জুন! আর কত গর্বভরে এ-কথা বললেন দ্রৌপদী—ঠিক তোমার মতো কৃষ্ণ। তুমি যেমনটি বিদর্ভ নগর থেকে রুক্মিণীকে জয় করে নিয়ে এসেছিলে, তেমন করেই আমাকে জয় করেছিলেন অর্জুন। এই সামান্য কটা কথার মধ্যে আরও একটা সামান্য তথ্যও দ্রৌপদী নির্দেশ করতে ভোলেননি। অহৎ সেদিন যে যুদ্ধ অর্জুন জিতেছিলেন তা অন্য কেউ পারত না—তার মানে কি অন্য পাণ্ডবরাও পারতেন না——স্বয়ংবরে মহৎ কর্ম কৃত্বা ন সুকরং পরৈঃ।

এই সব কথায় দ্রৌপদীর স্পষ্ট পক্ষপাত বিপ্রতীপভাবে যুধিষ্ঠিরের মনে অন্য কোনও প্রতিক্রিয়া তৈরি করত না তো? তিনি ভাবেননি তো যে, অর্জুনের প্রতি ট্রোপদীর যে ভাব, অর্জুনেরও দ্রৌপদীর প্রতি সেই ভাবই আছে মনে মনে। মুশকিল হচ্ছে—কথায়, কাজে, বিরহে, আনন্দে দ্রৌপদী যে পক্ষপাত অর্জুনের প্রতি দেখিয়েছেন, অর্জুন দ্রৌপদীর প্রতি সেই পক্ষপাত তো দূরের কথা —এমন ভাবও কোনওদিন প্রকাশ করেননি, যাতে বোঝা যায় যে অর্জুন নিজেকে এই বিদগ্ধা রমণীর অধিকারী বলে ভাবেন। এর জন্য বনবাস এবং দূরে থাকাও হয়তো তিনি বেশি পছন্দ করেছেন। কিন্তু আমার ধারণা যুধিষ্ঠির কোনওদিনই এই শঙ্কা থেকে মুক্ত হননি যে অর্জুনের অন্তর্গত কোনও স্বাধিকারবোধ আছে দ্রৌপদীকে নিয়ে। ফলত তুচ্ছ এক অছিলায় অর্জুনকে তিনি দায়ী করেছেন অহঙ্কারী বলে, যে অহঙ্কার তাঁর কথায়, কাজে এমনকী অহষ্কারের সুলভ মুহর্তগুলিতেও প্রকাশ পায়নি।