অর্জুন – ১

অর্জুনের কথা মনে হলেই আমার পুব-বাংলা থেকে আসা সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে। ছেলে জলপানি পেয়েছিল বলে তাকে তার মা-বাবা কলকাতায় পড়তে পাঠিয়েছিল। মনে আশা—এই ছেলে বড় হয়ে, বড় চাকরি করে সংসারের সাত-আটটা প্রাণীর অন্ন ব্যঞ্জনের ব্যবস্থা করবে, বাড়ি করবে, স্থায়ী আবাস দেবে, আর বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেবে উদ্বৃত্ত কিছু পয়সা যা ইচ্ছে করো। হ্যাঁ, বড় হওয়া, বড় চাকরি, পাকা বাসা—সব তার হয়েছে। কিন্তু সে এককালীন সব পারেনি, তারই মধ্যে কালচক্রে কারও প্রস্থান, সংসার-চক্রে কারও আগমন, এটা, ওটা, সেটা—শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কেউই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হলেন না—না পিতাঠাকুর, না স্নেহময়ী জননী, না গৃহিণী, না ভাই-বোন। কোথায় যেন খোঁচ রয়েই গেল। অথচ মনের গহনে সবাই পরিষ্কার জানে—এই মানুষটি না থাকলে কবে কে কোথায় ভেসে যেত।

মহাপ্রস্থানের পথে যেদিন কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের অক্লান্ত নায়ক অর্জুন মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, তখন ভীম যুধিষ্ঠিরকে বললেন—দ্রৌপদী, সহদেব, নকুল—সবার কথা না হয় বুঝলাম, কিন্তু এই ইন্দ্রের মতো ভাই আমার অর্জুন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল—এর কারণটা কী? কই, কোনও অন্যায় তো তাকে কোনওদিন করতে দেখিনি, তা হলে হলটা কী? যুধিষ্ঠির অম্লানবদনে উত্তর দিলেন—অর্জুন মরল দুটি কারণে। এক—কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে যখন প্রশ্ন উঠেছিল—কে কতদিনে শত্রুদের বিনাশ করতে পারবে, তখন অর্জুন মেজাজে বলেছিল—আমি একদিনে সমস্ত শত্রু বিনাশ করতে পারি। কিন্তু এ-প্রতিজ্ঞা সে রাখতে পারেনি। অতএব এই মিথ্যা প্রতিজ্ঞার দায় তার এক নম্বর অপরাধ। তার দ্বিতীয় অপরাধ—সে নিজেকে এত বড় ধনুর্ধারী মনে করত যে, অন্য কোনও ধনুর্বেদী পুরুষকে সে গণ্যই করত না। উচ্চাভিলাষী কোনও মানুষের এমনটি করা উচিত নয়, অতএব নিতান্ত আপন এই বীরত্বমুগ্ধতা—তার দ্বিতীয় অপরাধ।

হায়! উচ্চাভিলাষীতার সংজ্ঞা সম্বন্ধে এমন একটা ব্যাখ্যা যাঁর কাছে শুনতে হল—তাঁর জীবনে উচ্চাভিলাষ বলে কিছু ছিল না। নিরন্তর অভ্যাস এবং অধ্যয়নে যে ধনুর্বিদ্যার চরম পুরস্কারটি অর্জুন মনে মনে পেয়েছিলেন তার সম্বন্ধে কটুক্তি শুনতে হল এমন একজনের কাছে, যাঁকে পরীক্ষার সময় গুরুদেব কান মুলে বার করে দিয়েছিলেন—তম্‌ উবাচ অপসর্পেতি। গালাগালি দিয়ে বলেছিলেন—তোমার দ্বারা আর যাই হোক, এই ধনুক-বাণের লক্ষ্যভেদ সম্ভব নয়—নৈতচ্ছকং ত্বয়া বেদ্ধৃং লক্ষ্যমিতেব কুৎসয়ন্‌। হায়! যুধিষ্ঠির এমন সময়ই কথাগুলি বললেন—যখন অর্জুন বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে কী হত তা কিন্তু বলা যায় না। অথবা যুধিষ্ঠিরকে দোষ দিয়ে লাভ কী? যে যার নিজের মতো দেখে। নীতিশাস্ত্র বলে—বিদ্যালাভ বা টাকা-পয়সা উপায় করা যার কাছে প্রধান সে যেন নিজেকে অজর-অমর ভেবে নেয়। কেননা বিদ্যা কিংবা অর্থের জন্য প্রধান প্রয়োজন তানলস উদ্যোগ। আর যার কাছে ধর্মাচরণই প্রধান, তার ভাবা উচিত—আমার সময় আর নেই, জীবনটা পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দু; ধর্ম-আচরণ কালকের জন্য ফেলে রাখলে আর হয় কি না হয়, অতএব এখনই সবচেয়ে ভাল সময়। আমাদের মতে—বিদ্যা এবং অর্থের ব্যাপারে অর্জুন আর ধর্মের ব্যাপারে যুধিষ্ঠির আমাদের নীতিশাস্ত্রীয় উদাহরণ।

আপনারা বলবেন—তোমার নীতিশাস্ত্রীয় উপমার প্রয়োজনটা কী ছিল এখানে? আমি বলব—প্রয়োজন অল্পই। তা হল—একজন আরেকজনের মনের কথা বোঝে না। যে মানুষ ছোটবেলা থেকে ক্ষত্রিয়োচিত অস্ত্রবিদ্যায় অবহেলা করে জটাধারীর মোক্ষবিদ্যায় মন দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে ধনুর্ধারীর অন্তরবেদনা বোঝা কতটা সম্ভব! বেদনা এতটাই যে, অর্জুন তো শুধু ‘অ্যাপ্রিসিয়েশন’ চেয়েছিলেন, নইলে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা এতই নিষ্কাম যে, তাঁর পক্ষে বড়ভাইকে টপকে রাজা হওয়াও সম্ভব ছিল না অথবা সে ইচ্ছেও ছিল না। অথচ দেখুন—তাঁর কাছে চাওয়া হয়েছে কতটা? অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের দক্ষিণা দিতে হবে—শেষ ভরসা অর্জুন। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে লক্ষ্যভেদ করতে হবে—এগিয়ে আসবেন অর্জুন। বিরাটরাজার রাজ্য আক্রান্ত—অর্জুনকে দৌড়তে হবে। ভীষ্ম-কর্ণের মতো মহা মহা যোদ্ধা নিপাত করতে হবে—অর্জুন সামনে যাও। এ তো গেল বড় বড় জায়গা, সম্পূর্ণ মহাভারতের এই বিরাট এবং গভীর অরণ্যে যদি কোনও বামুনের একটা গরুও হারায় তো সেটা খুঁজে বার করতে হবে অর্জুনকেই।

এতটা যাঁর কাছে চাওয়া হয় এবং এতটাতেই যিনি সফল—তিনি কিন্তু মহাভারতের নায়ক নন। পুনশ্চ, এত বড় সফল মানুষ যদি যুদ্ধোন্মাদনার চরম মুহূর্তে অথবা কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ-বিস্ফোরণের প্রান্তিক মুহূর্তে একবার বুক বাজিয়ে বলেন—এই কুরুসৈন্য নিকেশ করতে আমার একদিনের বেশি সময় লাগবে না—তাহলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে! দ্বিতীয়ত, তাঁর সমসাময়িক ধনুর্ধারীদের যে অর্জুন একটুও গণ্য করতেন না—এটা তো অহঙ্কার নয়, বারংবার বিজয়ের অনুভূতিতে পরিপূর্ণ একটি আত্মবিশ্বাসমাত্র। আর যদি প্রতিপক্ষের প্রতি অবজ্ঞায়, বারবার তাদের যুদ্ধে হারিয়ে এমন একটা ধারণা তাঁর মনের মধ্যে বাসা বাঁধে যে, আমিই শ্রেষ্ঠ, আমার সঙ্গে কে লড়বে—তাহলে বলব সেটা তো ঘটনা। অর্জুনের সময়ে অর্জুনের মতো কে ছিলেন? এ অহঙ্কারও কিন্তু আমাদের মতো পোকা-বাছা লোকের নজরে পড়েনি, পড়েছে যুধিষ্ঠিরের চোখে। কেন বলুন তো? ধরিত্রীর মতো সর্বংসহ যাঁর হৃদয়, শত্রুরও পর্যন্ত দোষ যিনি দেখতে পান না, স্বয়ং শত্রুপক্ষ পর্যন্ত যাঁকে ‘অজাতশত্রু’ উপাধি দিয়েছে—সেই যুধিষ্ঠির কিন্তু অর্জুনের এই মৃত্যুকালেও তাঁর একটিমাত্র অপমানবাক্য ভুলতে পারেননি। অথচ সেদিনটা ছিল অর্জুনের কাছে অন্তহীন চাওয়ার এক অতি প্রকট প্রকাশ। ফল যা হয়—সংসারের অফুরান চাহিদার জোগান দিতে দিতে সেই পুব বাংলার ছেলেটি যেমন একদিন সামান্য কারণেই রাগে ফেটে পড়ল, অর্জুনও ঠিক তাই করলেন। কিন্তু অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে একটুখানি না পেলে সে দোষটুকুই যেমন সংসার মনে রেখে দেয়, যুধিষ্ঠিরও তাই অর্জুনের অনিচ্ছাকৃত অপমানটুকুই মনে রেখে দিলেন শেষের দিনটি পর্যন্ত, তার অন্য হাজার পাওয়াগুলি মনে রাখলেন না।

না, ঘটনাটি আমি এখনই উল্লেখ করতে চাই না। কারণ, এই প্রবন্ধের প্রস্তাবনা যেভাবে হল, তাতে ভয় আছে—শেষে শুধু চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বেই অর্জুনের জীবন সূচিত না হয়। সমস্ত মহাভারত জুড়ে অর্জুন যেমন সর্বব্যাপী যেমন সর্বতোগামী কার্যসাধক, তাতে তাঁর সুখ-দুঃখ, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, পাওয়া-না-পাওয়া এবং সর্বোপরি তাঁর মানসিক দ্বন্দ্বগুলি যদি একটু আধটু তুলে না ধরতে পারি, তাহলে অর্জুন সম্বন্ধে কিছু লেখাটাই আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে। তবু এরই মধ্যে তাঁর কাছে পাণ্ডব-সংসারের প্রত্যাশার হিসেবটিও আমরা রাখব, কারণ সেই সুরেই আমাদের কথারাম্ভ হয়েছে।

এ কথাটা প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, মহাভারতে অর্জুনই হচ্ছেন একমাত্র সুষম চরিত্র, যাঁর মধ্যে কোনও কিছুরই বাড়াবাড়ি নেই, আবার কোনও কিছুরই কমতি নেই। জানি না—মহামতি ব্যাস তাঁকে এই কারণেই পাঁচ পাণ্ডবভাইদের মাঝখানে রেখেছেন কিনা! অর্থাৎ এদিকে যুধিষ্ঠির-ভীমের মতে বিরাট চরিত্র, আবার ওদিকে নকুল-সহদেবের মতো নমনীয় চরিত্র—এই দুয়ের মাঝখানে ঠিক মানদণ্ডের কাঁটাটির মতো দাঁড়িয়ে আছেন অর্জুন। যা কিছুই তাঁকে করতে হয়েছে সুস্থ, স্বাভাবিকভাবে করতে হয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত—সমস্ত কিছুই তাঁর জীবনে একান্ত সুষমতায় চিহ্নিত। কোনও কিছুর মধ্যে বাড়াবাড়ি নেই, আবার খামতিও নেই।

অর্জুন যখন জন্মালেন, তখন বিশাল বা অসামান্য কিছু ঘটেনি। অর্থাৎ জন্মলগ্নেই অলৌকিক কোনও ক্রিয়াকলাপ তাঁকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেনি, যেমন করেছিল তাঁরই অগ্রজ ভীমকে। জন্মের অব্যবহিত পরেই ভীম মায়ের হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিলেন একটি পাথরের ওপর। তাতে শিশু ভীমের হাড়-গোড় ভাঙা দূরে থাক, সেই পাথরটাই নাকি ভেঙে গিয়েছিল। জন্ম-সময়েই এমন কোনও চমৎকারিতা দেখানো অর্জুনের দ্বারা সম্ভব হয়নি। তবে একটা জিনিস তাঁর ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। তাঁর জন্মের আগে পিতা পাণ্ডু উপযুক্ত পুত্রের জন্য তপস্যা করেছিলেন, যা তিনি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের জন্যও করেননি, বায়ুপুত্র ভীমের জন্যও করেননি। প্রাচীনদের মতে জনক-জননীর হৃদয়-বিকার মাত্রই যে পুত্রের জন্ম হয়, সেই কামজ পুত্রের মধ্যেও কোনও বিকার থাকবে বলে তাঁরা আশঙ্কা করতেন। সুস্থ, স্বাভাবিক, বলবান পুত্রের জন্য তাই জনক-জননীর তপস্যা বা সাধনা বিহিত ছিল। অর্জুন কিন্তু পিতা পাণ্ডুর সাধনার ধন। বস্তুত যুধিষ্ঠির এবং ভীমের জন্ম পর্যন্ত পাণ্ডুর পুত্রলাভের চমকটাই ঘোচেনি। তাঁর নিজের সন্তান উৎপাদন করার শক্তি ছিল না। কাজেই কুন্তীর কাছে যখন তিনি শুনলেন যে, কুন্তী পুত্রলাভের ব্যাপারে দুর্বাসার বরলাভ করেছেন, অপিচ নির্দিষ্ট দেবতাকে আহ্বান করে তখনই গর্ভধারণ করতে পারেন, পাণ্ডু তখনই কুন্তীকে বললেন—আজকেই তুমি সেই বরপুত্র লাভের চেষ্টা করো—অদৈব ত্বং বরারোহে প্রতস্ব যথাবিধি। তোমার মন্ত্রবলে আজই আহ্বান কর ধর্মকে, কারণ ধর্মই তো আমাদের জীবনে সব।

আমাদের ধারণা—এইভাবে কুন্তীর পুত্রলাভের ব্যাপারে তখনও পাণ্ডুর মনে শঙ্কা ছিল। অথবা রাজা হিসাবে তখনও যে তাঁর কোনও উত্তরাধিকারী নেই—এই ভাবনাও পাণ্ডুকে পীড়িত করছিল। ফলে কুত্তার কাছে পুত্রলাভের উপায় শোনামাত্র তিনি আর দেরি করতে চাননি। বৎসরান্তে কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে লাভ করলেন এবং চমৎকৃত পাণ্ডু বলোদ্ধত পুত্রের জন্য দ্বিতীয়বার বায়ুকে আহ্বান করতে বলালেন। ভীম জন্মালেন। এইবার বুঝি পাণ্ড আশ্বস্ত হলেন। বংশরক্ষার চিন্তা নেই, সিংহাসনের অধিকার নিয়ে চিন্তা নেই, এমনকী সিংহাসন রক্ষার ব্যাপারেও চিন্তা যেন অনেকটা কমল। দুর্বাসার আশীবাদের প্রাথমিক চমক ভাঙার পর এই প্রথম পাণ্ডুর মনে হল—মানুষের শ্রেষ্ঠতা আসে দেব এবং পুরুস্কার একসঙ্গে যুক্ত হলে। আমার সেইরকম একটি শ্রেষ্ঠ পুত্র চাই এবং এ পুত্র চাইতে হবে দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে। মনে মনে অমিত শক্তিধর এক পুত্রের কামনায় তিনি কুন্তীকে তপস্যায় মন দিতে বললেন। তিনি নিজেও বসে গেলেন উগ্র তপস্যায়। আরাধনা করতে লাগলেন দেবরাজ ইন্দ্রের। উপযুক্ত পুত্রলাভের সাধনার পর অর্জুনের জন্ম। ইচ্ছা হয়ে যে এতকাল জনক-জননীর। হৃদয়ের মধ্যে ছিল, সে এবার অর্জুনের রূপ নিয়ে জন্মাল। দেবতারা আশীবাদ করলেন—শিবের মতো শক্তি হবে এই ছেলের, যুদ্ধে ইন্দ্রের মতো অজেয় হবে, কুরুরাজার ঘরের লক্ষ্মীশ্রী ফিরিয়ে আনবে এই অর্জুন—কুরুলক্ষ্মীং বহিষ্যতি।

কিন্তু অর্জুনের এত কিছু গুণের পরিচয় তখন পাওয়া যায়নি। জন্মলগ্নেই ভীমের মতো তিনি পাথর গুঁড়ো করে দেননি, অন্যদিকে পাঁচ রাজপুত্রের মধ্যে তিনিই হলেন সবচেয়ে কালো। এইজন্যই কি তাঁকে অদ্ভুতদর্শন বলে বর্ণনা করেছেন কবি। যাই হোক, পিতার মৃত্যুর পর পাঁচ ভাইয়ের ঠিক মাঝখানটিতে যে ছেলেটি মুখ শুকনো করে ঋষিদের হাত ধরে এসে ধৃতরাষ্ট্রের সভায় দাঁড়িয়েছিল, সে দিনও তাঁর কোনও বিশেষত্ব ছিল না। ঋষিরা পরিচয়ের সময় যুধিষ্ঠিরের কথা বলেছিলেন—ইনি ধর্মের ঔরসে জাত ভীমের কথা বলেছিলেন—ইনি বায়ুর ঔরসে জাত। কিন্তু পাঁচ ভাই পাণ্ডবের মধ্যে অন্যরকম কালো ছেলেটিকে দেখিয়ে তাঁরা বলেছিলেন—এ হল অর্জুন, কুন্তীর গর্ভে দেবরাজ ইন্দ্রের তেজে এর জন্ম। সমস্ত বড় মানুষের কীর্তি-যশ এই ছেলে স্নান করে দেবে—যস্য কীর্তি র্মহেস্বসান সর্বন্‌ অভিভবিষ্যতি।

ঋষিরা বলেছিলেন, কারণ, এই পুত্রলাভের জন্য তাঁরা পিতা পাণ্ডুর সাধনাটুকু জানতেন। জানতেন, যেহেতু বীরপুত্র লাভের জন্য পাও তাঁদের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন—মন্ত্ৰয়িত্ব মহর্ষিভিঃ। কিন্তু তাতে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কী? ঋষিরা বললেন, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র শুনলেন—এই, পর্যন্ত। বিশেষত ঋষিরা পাণ্ডুর প্রত্যেকটি ছেলে সম্বন্ধেই ভাল কথা বলেছেন। তার মধ্যে থেকে অর্জুনকে বিশেষ করে আমল দেবার মতো কিছু হয়নি ধৃতরাষ্ট্রের। তাঁকে নিয়ে তাঁর কোনও চিন্তা ও ছিল না। বরঞ্চ মধ্যম-পাণ্ডব ভীমসেন, যাঁর বাল্যক্রীড়ার শক্তিতে এবং বাহুল্যে কৌরবেরা প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, তাঁকে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের চিন্তা ছিল বেশি। অর্জুনকে তখন কে চেনে? এরই মধ্যে ভীমকে বিষ খাওয়ানো নিয়ে কত হই হই হয়ে গেল, তবু অর্জুনকে কেউ রা কাড়তে দেখল না। অর্জুনের প্রথম কথাটি কবে শোনা গেল জানেন? কুরুবৃদ্ধ পিতামহ সমস্ত কুরু-রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার জন্য সঁপে দিলেন যুদ্ধবিদ দ্রোণাচার্যের কাছে। দ্রোণাচার্য তাঁদের সবাইকে শিষ্যত্বে স্বীকার করে নিয়ে বললেন—বাছারা! আমার একটা গুরুতর কাজ আছে, যা আপাতত আমার মনেই রইল। কিন্তু তোমরা যখন সবাই অস্ত্রবিদ্যায় নিপুণ হয়ে যাবে, সেদিন তোমরা আমাকে সেই কাজটি করে দেবে। কুরু-কুমারেরা আচার্যের কথা শুনে সবাই মাথা নিচু করে চুপটি করে রইল। একমাত্র অর্জুন, যে কখনও কোনও কথা বলে না, সেই অর্জুন গুরুর কথা শুনে বললেন—আপনি যা আদেশ করবেন, আমি তাই করে দেব, গুরুদেব! একশো পাঁচজন বালকের মধ্যে সেই মুহূর্তে একজন হয়ে গেলেন অর্জুন। অস্ত্রশিক্ষার আগেই নিজের ওপর এই আস্থাটুকু গুরুরা চান, আর সেই আস্থাতেই অর্জুন বলেছিলেন—আমি করে দেব। শতাধিক পঞ্চ মৌনমূক বালকের মধ্যে মাত্র একজনের মুখে নিজের আশাপূর্তির সম্ভাবনা দেখে আচার্য দ্রোণ সেদিন আনন্দে অর্জুনের মস্তক আঘ্রাণ করলেন, অর্জুনকে জড়িয়ে ধরে তিনি আনন্দে কেঁদে ফেললেন—প্রীতিপূর্বং পরিস্বজ্য প্ররুরোদ মুদা তদা।

ঔপন্যাসিক যেমন তাঁর উপন্যাসে নায়কের চরিত্র আগে থেকেই আন্দাজ করে নিয়ে নায়কের স্বভাব অনুযায়ী ঘটনার বিস্তার করেন, অর্জুনের ভাগ্য-নিয়ন্তা হিসেবে মহাভারতের কবিও তাই, করেছেন। অর্জুন যদি ইতিহাসের সত্য-চরিত্রও হন, অথবা কবির কল্পনা—তা হলেও এমন হতে পারে না যে, এই আচার্য দ্রোণের সামনে কথা বলার আগে অর্জুন কোনওদিন কথা বলেননি। দাদা, ভাই, মায়ের সঙ্গে কারণে অকারণে নিশ্চয়ই তিনি কথা বলেছেন, কিন্তু মহাভারতের কবি সে সব কথা অকিঞ্চিৎকর বলে মনে করেছেন। ভীমকে বিষ খাওয়ানোর প্রসঙ্গে ভীমের শক্তি, সাহস এবং খামখেয়ালিপনার সঙ্গে দুর্যোধনের কথা, যুধিষ্ঠিরের কথা এসেছে, কিন্তু অর্জুন সেখানে একটি কথাও বলছেন না। মহাভারতের কবি যেখানে প্রথম অর্জুনকে দিয়ে কথা বলালেন, তখন অন্য সবাই মৌনমূক, নিরুত্তর। অর্জুন সেখানে একা উত্তর দিচ্ছেন, একশো পাঁচজনের মধ্যে একা উত্তর দিচ্ছেন। সে উত্তরও কী রকম? অন্য সবাইকে অপ্রতিভ করে মহাবীরের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে, নিজের গুরু পর্যন্ত যা পারেননি, সেই কাজ করার আশ্বাসে উত্তর দিচ্ছেন। এই যে মর্যাদা, এই যে heroic isolation, এই যে স্বাতন্ত্র—এটা মহাভারতের কবি অন্য কোনওভাবে দেখাতে চাননি, দেখাতে চেয়েছেন অস্ত্র-শিক্ষার আসরে শৃঙ্খলাবদ্ধ একটি বালকের দৃঢ় প্রত্যাশ্বাস এবং প্রতিজ্ঞার মধ্য দিয়ে—আপনি যা চান, তাই আমি করব—অর্জুনস্তু ততঃ সর্বং প্রতিজজ্ঞে পরন্তপ। মহাভারতের কবি যাঁকে প্রথম কথা বলিয়েছেন প্রতিজ্ঞার ছলে সে তখনও অস্ত্রবিদায় কৌতূহলী বালকমাত্র। কিন্তু গুরুর সামনে তাঁর প্রথম কথা এবং প্রতিজ্ঞার মধ্যে শুধুমাত্র গুরুভক্তিই ছিল না, ছিল—পিতার মৃত্যুর পর ঋষিদের হাত ধরে এসে কুরুসভায় পরিচয়-প্রমাণ করা ভিখারী বালকের হাহাকার, ছিল নিজের মাথার ওপর পদে পদে কৌরব-ভাইদের আপন উচ্চতা ঘোষণার যন্ত্রণা, ছিল—নিজের বড়দাদা যুধিষ্ঠির এবং জননী কুন্তীর সসংকোচ ব্যবহার—যে ব্যবহারে ভীমকে বিষ খাওয়ানো হলেও কুন্তী সে-কথা রাজ্যের পরিচালক ধৃতরাষ্ট্রকে বলতে পারেননি, যে ব্যবহারে যুধিষ্ঠির ভীমের কোনও দোষ না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন—চুপ করো ভীম, কাউকে এসব কথা বোলো না, এরা যে এ-সব কাজ করেছে, কাউকে যেন বোলো না—তুষ্ণী ভব ন তে জল্প্যম্‌ ইদং কার্যং কথঞ্চন।

মহাভারতের কবি এই সব কঠিন সময়ে অর্জুনকে দাঁতে দাঁত চাপিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছেন, তাঁর দুই হাতের মুষ্টি অপমানে দৃঢ়তর করেছেন, কিন্তু যেদিন দ্রোণাচার্য অস্ত্র-শিক্ষা করাতে এলেন, সেদিন থেকে দৃঢ়তর দন্তপংক্তি থেকে বেরিয়ে এল একটি বাক্য—আপনি যা বলবেন, আমি সব করব। আর সেই দৃঢ়তর দুই বাহু-মুষ্টিতে আবদ্ধ হল একটি তীর এবং ধনুক। ভাবটা এই-আপনি যা বলেন, সব করব ঠিকই, কিন্তু তার বদলে সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্রবিদ্যা আমার চাই। আমি একা যেহেতু আপনার প্রত্যাশাপূরণ করব বলেছি, অতএব ওই শ্রেষ্ঠ অস্ত্রশিক্ষাও আমারই চাই, আমার, শুধু আমার একার। বাস, দ্রোণাচার্য রাজপুত্রদের সবার হাতে শিক্ষার উপযুক্ত অস্ত্র দিলেন, কিন্তু সবার মধ্যেও নিজের আকাঙ্ক্ষিত কাজটির মতো তাঁর মনে আঁকা থাকল সেই কৃষ্ণবর্ণ দৃঢ়মুষ্টি বালকটি—যে বলেছিল—আপনি যা চান, আমি সব করব।