কর্ণ – ৯

সত্যিই তো কর্ণ বারবার বলেন—আমি জিতব, তবু বার বার অর্জুনের কাছে হারেন কেন? এর একটা অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ। মনে রাখতে হবে, তখনকার দিনের সামাজিক প্রেক্ষাপটে জাতি ব্যবস্থা কিংবা বর্ণ ব্যবস্থায় বিশ্বাস করাটা ছিল স্বাভাবিক। নীলকণ্ঠ সেই বিশ্বাস অনুসারেই লিখেছেন এবং এ ব্যাপারে তাঁকে মদত জুগিয়েছে অশ্বত্থামার ‘সূত’ বলে কর্ণকে সম্বোধন। নীলকণ্ঠ লিখেছেন-কর্ণকে গালাগালি দেওয়ার সময় অশ্বত্থামা যে তাঁকে ‘সুত’ বলে সম্বোধন করেছেন তার একটা কারণ আছে। অশ্বত্থামা একের পর এক যুদ্ধের নাম করেছেন আর বলেছেন—কোন যুদ্ধটায় তুই অর্জুনের সঙ্গে জিতেছিস রে বেটা। প্রায় এই প্রসঙ্গেই ‘সূত’ সম্বোধন। নীলকণ্ঠ লিখেছেন—কর্ণ যে সূর্যের ঔরসজাত পুত্র সে-কথা অশ্বত্থামা জানতেন। কিন্তু সারথি জাতীয় অধিরথের ঘরের পরিবেশে কর্ণ তাঁর ক্ষত্রিয়ত্ব হারিয়েছেন বলে অশ্বত্থামা মনে করেন। নীলকণ্ঠ লিখেছেন—সমস্ত বর্ণেই মানুষের দুই রকমের জন্ম হয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র—সব বর্ণেই। এক জন্ম পিতামাতার শুক্ৰশোণিত সূত্রে, আর এক জন্মসংস্কারে। ছেলে যে জন্মাল, সে যদি পিতামাতার আপন সংস্কারেই মানুষ হয় তাহলে প্রায় ক্ষেত্রেই সন্তানের প্রকৃতির কোনও পরিবর্তন হয় না। এই ধরনের ছেলেকে বলে ‘একজ’—তত্র য এব যোনিঃ স এব সংস্কর্ত্তা চেৎ স একজো ন প্রকৃতিতশ্চ্যবতে। কিন্তু কর্ণ ‘একজ’ নন, ‘দ্বিজাত’। দেবলোকের ক্ষত্রিয় পুরুষ সুর্যের ঔরসে জন্মালেও কর্ণ মনুষ্যলোকে সমান্তরাল কোনও ক্ষত্রিয় সংস্কারে সংস্কৃত হননি। তিনি মানুষ হয়েছেন সূত অধিরথের বাড়িতে সারথি-জাতের সংস্কারে। ঠিক এই কারণে তাঁর প্রকৃতিতে একটা দো-আঁশলা ব্যাপার ঘটেছে। নীলকণ্ঠের মতে—সূর্যের থেকে জন্মানোর ফলে ঔরসগতভাবে ক্ষত্রিয়ত্বের কারণে কর্ণ যথেষ্ট পরিমাণে শত্রুপাতনে সক্ষম, পর-প্রহারেও কুশল। কিন্তু তাঁর মধ্যে যেহেতু সুতের সংস্কারও সম পরিমাণে বর্তমান, তাই অতি বড় শত্রুর প্রহার তিনি শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে পারেন না এবং এইজন্যই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে তাকে মাঝে মাঝেই পালাতে হয়—কর্ণস্তু দৈবক্ষত্রজোপি অক্ষত্রিয়েণ সুতেন সংস্কৃত ইতি দ্বিজাতত্বাৎ ক্ষত্রিয়ত্বেন প্রহর্ত্তং কুশলো’পি সূতত্বেন পরকীয়প্রহারং সোঢুমশক্ত ইতি যুদ্ধাৎ পলায়তে।

আমরা আজকের দিনে বর্ণব্যবস্থার নিরিখে পুরো ব্যাপারটা ঠিক এইভাবে দেখতে চাই না। তবে যা ঘটেছিল, তার একটা উচিত ব্যাখ্যা দিতে গেলে আমরা নীলকণ্ঠের মতটা একটু অন্যভাবে বলতে পারি। একটা জিনিস সবাই নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, অতি নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরে যদি কেউ কখনও বিত্তবান হয়, তবে প্রায়শই সেই হঠাৎ বড়লোকের বৃথা বাগাড়ম্বর বৃদ্ধি পায়, এবং অন্য যথাযুক্ত হজমশক্তিশালী বিত্তবানকে সে যথার্থ বিত্তবান বলে গ্রাহ্য করে না। একইভাবে অতি মুর্খ পিতামাতার ঘরে যদি দৈববলে অতি পণ্ডিত পুরুষ জন্মায়, তবে সেই পণ্ডিতের অনেক ক্ষেত্রেই বৃথা পাণ্ডিত্য প্রকাশ পায়, এবং যথোপযুক্ত পণ্ডিত মানুষকে সে গাণনার মধ্যেই আনে না। কর্ণের ব্যাপারটাও একই রকম। চিরন্তন সত্য বোঝার জন্য জাতি-বর্ণের প্রসঙ্গ তোলার প্রয়োজন নেই। তবে এও ঠিক যে, সূত অধিরথের বাড়ির পরিবেশে থেকে যে ছেলে দ্রোণাচার্য, পরশুরামের পাঠশালা ঘুরে এসেছে, তার কদর অনেক। এই কদরে কর্ণের আরও বেড়েছে এবং আদর শুধু অধিরথের ঘরে নয়, এই আদর যেহেতু এসেছে প্রসিদ্ধ ভরত বংশের যুবরাজের কাছ থেকে, তাই কর্ণের পক্ষে বাগাড়ম্বর স্বাভাবিক। কিন্তু বনেদী বড়লোকের যেমন টাকা-পয়সা হজম করার শক্তি থাকে, প্রকৃত বিদ্বানের পক্ষে যেমন বিদ্যাবত্তা হজম করা সম্ভব হয়, কর্ণের এই হজমশক্তি ছিল না। অতিক্রুর দুর্যোধনের বন্ধুত্ব তাঁর এই বদহজম আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে পেটুক যেমন তার শেষ ক্ষমতার দিকে লক্ষ না রেখেই যথেষ্ট খেয়ে যায় এবং অতি গুরুপাক দ্রব্য জীর্ণ করতে অক্ষম হয়, তেমনই কর্ণ পরশুরামের শিষ্য হওয়ার বাবদে দুর্যোধনের বহু শত্ৰু-পাতনে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও অর্জুনের মতো গুরুপাক বস্তু তিনি শেষ পর্যন্ত জীর্ণ করতে পারেন না, তাঁকে পালাতে হয়। অর্জুনের মধ্যে যে নায়কোচিত ধীরোদাত্ততা আছে, যে লঘুগুরু জ্ঞান আছে এবং সর্বোপরি অর্জুনের মধ্যে যে সহনশীলতা আছে, কর্ণের তা নেই এবং সেই জন্যই কর্ণকে হারতে হয়। এ হার শক্তির পরীক্ষায় নয়, এ হার হয় প্রকৃতিতে।

এই যে দেখুন বনবাস—অজ্ঞাতবাসের পর পাণ্ডবেরা দ্রুপদের পুরোহিত মারফত—যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই—বলে নিজেদের রাজ্যাংশ প্রার্থনা করে পাঠালেন, সেখানে কী হল? না হয় পুরোহিতের ভাষায় পাণ্ডবের শক্তি-প্রশংসা কিছু ছিল, না হয় তাঁর ভাষায় মিশেছিল পাণ্ডবদের তেরো বছরের গ্লানি—তার জবাব তো ভীষ্মই দিচ্ছিলেন। ভীষ্ম তো ভণিতা করে বলেই দিলেন—ব্রাহ্মণ! পাণ্ডবেরা সন্ধি চায় বটে, তবে আপনার ভাষাটা বেশ কড়া, তবে হ্যাঁ সেটা হয়তো আপনি ব্রাহ্মণ বলেই—অতিতীক্ষ্ণং তু তে বাক্যং ব্রাহ্মণ্যাদিতি মে মতিঃ। কিন্তু ভীষ্ম বলতে পারলেন কই? ভগিতা করে কথারম্ভের আগেই তো—‘ধ্যাত্তারিকার’ বলে রাগ দেখিয়ে ফেললেন কর্ণ—ভীষ্মে ব্রুবতি তদ্‌বাক্যং ধৃষ্টম্ আক্ষিপ মন্যুমান্। দুর্যোধনের ‘ডিসিশন’ কর্ণই তৈরি করে দিচ্ছেন। ভীষ্মের যুক্তিগ্রাহ্য কথা শুনে পাছে দুর্যোধন নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নেন, তাই পূর্বাহ্নেই তাঁর ইন্ধন জোগাচ্ছেন কর্ণ, পূর্বাহ্নেই তাঁকে সচেতন করছেন কর্ণ। বৃদ্ধেরা কেউ নন, রাজা ধৃতরাষ্ট্র নন এমনকী যুবরাজ দুর্যোধনও নন, কুরুদের হয়ে একবার মাত্র দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে, ভীষ্মকে ‘ধুত্তোর’ বলে, কথা শোনালেন কর্ণ। তেরো বছর বনবাসের পর পাণ্ডবেরা যে প্রস্তাব পাঠালেন, তার উত্তর দিচ্ছেন কর্ণ। কুরুসভায় তাঁর এতই প্রতাপ।

কর্ণ বললেন বার বার এক কথা বলে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে চাই না—কিং তেন ভাষিতেন পুনঃপুনঃ। কর্ণের ধারণা, দুর্যোধনের মতোই কর্ণের ধারণা যে, অজ্ঞাতবাসের আগেই অর্জুনকে দেখা গেছে সেই বিরাট যুদ্ধের আসরে। আসলে ওই যুদ্ধে অর্জুনের কাছে হেরে যাওয়ায় কর্ণের সমস্ত অহমিকা যেহেতু মলিন হয়ে গিয়েছিল, তাই কর্ণ কিন্তু ক্ষত্রোচিত ক্ষমতার বদলে আবার কপটতার দিকে মন দিচ্ছিলেন। কর্ণ বললেন—সবাই জানে যে, শকুনির পাশার দানে কী শর্ত ছিল, অজ্ঞাতবাসের সময় তাদের দেখা গেলে আবার তাদের বনে যেতে হবে—এইটেই কথা। এই সত্য প্রতিজ্ঞার বাইরে এসে পাণ্ডবেরা যদি বিরাটরাজা আর দ্রুপদরাজার ওপর নির্ভর করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে আমাদের, তাহলে মনে রেখ, সেই ভয়ে ভীত নয় দুর্যোধন। ভয় দেখালে দুর্যোধন একের চার ভাগ কেন, এক পা জমিও ছাড়বেন না—দুর্যোধনে ভয়োদ্বিয়ো ন দদ্যাৎ পাদমন্ততঃ। হ্যাঁ যদি ন্যায়ের কথা বলো তা হলে অতি বড় শত্রুকেও আমাদের দুর্যোধন সমস্ত পৃথিবী দিয়ে দিতে পারেন এবং সেটা পাণ্ডবদেরও দেবেন, যদি তারা প্রতিজ্ঞাটি ঠিক ঠিক মতো পালন করে। হ্যাঁ, আবার বারো বছরের বনবাস শেষ হোক, তারপর তারা নির্ভয়ে আমাদের দুর্যোধনের কোলে এসে বসুক। কিন্তু তা না করে যদি অন্যায়ভাবে বোকার মত দাবি চালায় পাণ্ডবেরা, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে আমার কথা যেন স্মরণে থাকে—স্মরিষ্যন্তি বচো মম।

আবার সেই দম্ভ। দর্পী কর্ণের কথাগুলি শুনলেন? সাধে কি আর গান্ধারী মাতা সবার শেষে বলেছিলেন যে ভারত যুদ্ধের অনুক্ত কর্তা ছিলেন কর্ণ। কর্ণ যেভাবে যুক্তি সাজিয়ে, ইন্ধন জুগিয়ে দুর্যোধনকে অশুভ পথে প্ররোচিত করলেন, তাতে সাময়িকভাবে যে কোনও ঠাণ্ডা মানুষও প্ররোচিত বোধ করবেন, সেখানে দুর্যোধন শত জটিলতায় দীর্ণ। এর ওপরে আছে সেই দম্ভ, যার ওপর দুর্যোধন বার বার ভরসা করে আশাহত হন, আবারও ভরসা করেন, কেননা কর্ণ ছাড়া আর কোনও শক্তিশালী বারই তাঁরই মতো করে তাঁরই ছন্দে, তাঁর কথা ভাবেন না। কিন্তু কথার মাঝখানে স্তব্ধ হওয়া ভীষ্ম কর্ণকে ছাড়বেন কেন ; কর্ণের স্পর্ধা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে আর ভীষ্মেরা ছাড়তে পারছিলেন না—আগেই সে-কথা বলেছি। কর্ণের মুখরতায়, দাম্ভিকতায় আহত ভীষ্ম বেশ রেগেই বললেন—ওরে রাধার বেটা! মেলা বকবক কোরো না, তোমার নিজের কাজকর্ম একটু স্মরণ কর তাহলেই হবে। তুমি একা নও, আমরা ছ’জন মহারথ যোদ্ধা ছিলাম বিরাটরাজ্যে গোধন হরণের সময়। আমাদের ছ’জনকেই অর্জুন একা হারিয়ে দিয়েছিল। তুমি যে তার সঙ্গে যুদ্ধ করেও বার বার বেঁচে গেছ, তার থেকেই বুঝি কী কর্ম তুমি করেছ-বহুশো জীয়মানস্য কর্ম দৃষ্টং তদৈব তৎ—অর্থাৎ পালিয়ে বেঁচেছ। তোমার কথা শুনে যদি এখন এই ব্রাহ্মণের মুখে পাণ্ডবদের সন্ধির প্রস্তাব মেনে না নিই, তা হলে যুদ্ধক্ষেত্রে শুয়ে শুয়ে আবার আমাদের মাটি খেতে হবে। যেমনটি আগের যুদ্ধে মুচ্ছিত হয়ে খেয়েছিলাম—ধ্রুবং যুধি হতাস্তেন ভক্ষয়িষ্যাম পাংশুকান্।

ভীষ্মের রাগ দেখে মহামতি ধৃতরাষ্ট্র একটু ভয়ই পেলেন, একটু তিরস্কারও করলেন কর্ণকে। পরে সঞ্জয়ের কাছে মন খুলেই বললেন যে, “আমাদের পক্ষে এই দুর্যোধন আর কর্ণ ছাড়া আর কেউই নেই, যারা পাণ্ডবদের এত বিদ্বেষ করে। নিরপেক্ষতার মুহূর্তে ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের বিশেষণ দিয়েছেন পাপমতি, মন্দবুদ্ধি আর কর্ণের বিশেষণ দিয়েছেন ক্ষুদ্রচেতা—-অন্যত্র পাপাদ্ বিষমান্কমন্দবুদ্ধে-র্দুর্যোধনাৎ ক্ষুদ্রতরাচ্চ কর্ণাৎ। সত্যি দুর্যোধনের অসমদর্শিতার সঙ্গে সঙ্গে কী এক পরশ্রীকাতরতা কর্ণকে পেয়ে বসেছিল যে, অতবড় উদার দাতা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর অতি বিশ্বস্তজনের চিত্তভূমিতেও ক্ষুদ্রচেতার পদবী লাভ করেছেন তিনি। কিন্তু এহ বাহ্য, ধৃতরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া বড়ই সাময়িক। সাময়িকভাবে তিনি ভীমার্জুনের শক্তি চিন্তা করে ভয় পেয়েছেন, অতএব আপাতত দুর্যোধন তাঁর কাছে মন্দবুদ্ধি, কর্ণ তার চেয়েও ক্ষুদ্রতর। লোকে যা বলে, এখন ধৃতরাষ্ট্রও তাই বললেন। কিন্তু কর্ণের বিপদটা তো অন্য জায়গায়। ধৃতরাষ্ট্র কী বলছেন, না বলছেন তাতে কিছু আসে যায় না, স্বয়ং দুর্যোধন তাঁকে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ—এইসব মহারথীনের সমান মনে করেন—ভীষ্ম দ্রোণকৃপাণাং চ তুল্যঃ কর্ণো মতো মম। শুধু তাই নয়, কখনও বা স্বয়ং পরশুরামের সমান মনে করেন কর্ণকে। অবশ্য এ ধারণা দুর্যোধনের হয়েছে কর্ণের মারফতই, কারণ কর্ণই তাঁকে এসে বলেছেন—পরশুরাম নাকি তাঁকে জানিয়েছেন—আমার মতনই কিংবা আমার সমানই ক্ষমতা তোমার—অনুজ্ঞাতস্তু রামেণ মৎসমো’সীতি ভারত।

আমরা জানি যে, দুর্যোধনেব কাছে কর্ণ পরশুরামের কথাটা হয়তো একটু বাড়িয়ে বলেছেন এবং কিছু কথা যে তিনি চেপেও গিয়েছিলেন তাও আমরা জানি। এখন যুদ্ধ এগিয়ে আসছে, এখন সবারই সঠিক মূল্যায়ন হওয়া দরকার। ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন যে, তাঁর গুষ্টিতে দুর্যোধন আর কর্ণ ছাড়া তেমন পাণ্ডব-বিদ্বেষী আর কেউ নেই। বস্তুত এঁরাই যুদ্ধ চান। আর চাইবেনই বা না কেন, না চেয়ে উপায়ই নেই, যুদ্ধের কারণ তো এঁরাই। এখন এই যুদ্ধোদ্যোগের মুহূর্তে যখনই দূতেরা একবার পাণ্ডবদের কাছে যাচ্ছে, আরেকবার ধৃতরাষ্ট্রের কাছে আসছে, তখনই কিন্তু পাণ্ডব পক্ষ থেকে বার বার সেই দূতসভায় পাঞ্চালী-কৃষ্ণার অপমানের কথা উঠেছে। বার বার কর্ণের কথা উঠেছে, যিনি পঞ্চপতির সামনেই পঞ্চস্বামিগর্বিত দ্রৌপদীকে ‘বেশ্যা’ বলেছিলেন। পাণ্ডবদের প্রতিনিধি হয়ে স্বয়ং বাসুদেব ধৃতরাষ্ট্রের শান্তি-দৃত সঞ্জয়কে জানিয়েছেন—মনে রেখ সঞ্জয়! সেই সূতপুত্র কর্ণ দ্রৌপদীর শ্বশুরস্থানীয়দের সামনে তাঁকে কী বলেছিল। বলেছিল—তোমার এখন আর কোনও গতিই নেই দ্রৌপদী, তুমি এখন ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের ভোগ্যা দাসী। বলেছিল—দ্রৌপদী! এখন তুমি বরং তোমার পঞ্চস্বামী বাদ দিয়ে নতুন কোনও স্বামী বেছে নাও কৌরবদের মধ্যে থেকে। কৃষ্ণ বললেন—সঞ্জয়! এসব কথা অর্জুনের মনের মধ্যে ছুঁচের মত বিঁধে রয়েছে, কর্ণের কথার ছুঁচ—কর্ণাৎ শরে বাঙ্ময়-স্তিম্মতেজাঃ প্রতিষ্ঠিতো হৃদয়ে ফাল্গুনস্য।

সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে ফিরে এসে সব বলেছেন ধৃতরাষ্ট্রকে। তাঁকে বোঝানোও কম হয়নি। স্বয়ং বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে সহস্র নীতিকথা শুনিয়ে শেষ মন্তব্য করেছেন মহারাজ। আপনি দুর্যোধন, শকুনি অথবা কর্ণের ওপরে কুরুদের সমস্ত ঐশ্বর্য ন্যস্ত করে কী করে ভাবছেন আপনি মঙ্গল লাভ করবেন—কর্ণে চৈশ্বর্যমাধায় কথং ত্বং ভূতিমিচ্ছসি। কিন্তু একটু আগেই যে বলেছি দুর্যোধন-কর্ণের ব্যাপারে ধৃতরাষ্ট্রের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিতান্তই সাময়িক, নইলে স্বয়ং কুরু কুলপতি ভীষ্মকেও তিনি কীরকম অবজ্ঞাই না করলেন। সঞ্জয়ের কথার সূত্র ধরে ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রকে কৃষ্ণ এবং অর্জুনের ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন করছিলেন। একই সঙ্গে ভীষ্ম সতর্ক করছিলেন দুর্যোধনকেও। ভীষ্ম বলেছিলেন—বার বার বলছি দুর্যোধন, কৃষ্ণ আর অর্জুনকে যুদ্ধে যদি এক রথে আসতে দেখ, তা হলে কৌরবদের সমূহ বিপদ। এটা মনে রেখ, সমগ্র কৌরবকুল তোমারই সিদ্ধান্তের প্রতীক্ষা করে কিন্তু তুমি নিজে চালিত হও তিন জনের বুদ্ধিতে। তাদের মধ্যে একজন হল ওই পরশুরামের অভিশপ্ত শিষ্য, বেজাতে জন্মানো সূতপুত্ৰ কৰ্ণ—রামেণ চৈব শপ্তস্য কর্ণস্য ভরতর্ষভ। দুর্জাতেঃ সূতপুত্রস্য…। দ্বিতীয় শকুনি, তৃতীয় দুঃশাসন। দুর্যোধনের বুদ্ধিদাতাদের লিস্টিতে প্রথম নাম কর্ণের। কুরুবৃদ্ধেরা যে তাঁর ওপর সন্তুষ্ট নন, তা তাঁদের আরোপিত বিশেষণগুলি থেকেই বোঝা যায়। কর্ণ ‘দুজাতি’, কর্ণ ‘সূতপুত্র’—এইসব বিশেষণ কর্ণের গা-সওয়া, কিন্তু যাঁর ক্ষমতা এবং অস্ত্রবলের ওপর দুর্যোধন সমধিক ভরসা করেন, সেই অস্ত্রবিদ্যাও যে গুরু পরশুরামের অভিশাপে কার্যকালে কাজে লাগবে না সেই কথাটা দুর্যোধনকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ফলে কর্ণের রাগ আরও বেড়ে গেল। তিনি অবশ্য সুচতুরভাবে ওই শাপ-টাপের প্রসঙ্গে গেলেন না। উল্টে শক্তিমান পুরুষের জাতি নিয়ে যে কোনও আলোচনা ভদ্র সমাজে বিগর্হিত, সেই দিকটা দিয়ে চেপে ধরলেন ভীষ্মকে।

কর্ণ বললেন—যা বলেছেন, বলেছেন। কিন্তু আপনি আর দ্বিতীয়বার এসব বাজে কথা বলবেন না, পিতামহ! আমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন করি এবং সেই ধর্ম থেকে আমি একচুলও নড়ি না। তা ছাড়া, আর কী খারাপটা আপনি দেখেছেন আমার মধ্যে, যাতে করে আমাকে এমন করে গালাগালি দিতে পারেন আপনি—কিঞ্চান্যন্ ময়ি দুর্বৃত্তং যেন মাং পরিগর্হসে। কই, আমার মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা তো কোনও অন্যায় আচরণ দেখতে পায় না। আর আমিও কোনওদিন তাদের বিরুদ্ধে কাজ করিনি। অর্থাৎ তুমি তা করছ। এই কথাটা ভীষ্মের দিকেই অঙ্গুলি সংকেত করে বলা। কর্ণ বলতে চান—ভীষ্ম কৌরবদের যথেষ্ট দোষ দেখতে পান, যা কর্ণ পান না। ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরাও ভীষ্মকে খুব একটা আপনার বলে মনে করেন না, অথচ তিনি ঠাকুরদাদাগিরি করে নাতিদের দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বাঙাল প্রবাদ জানলে কর্ণ এখুনিই বলতেন—মায় মানে না ঝি, আপনাআপনি সোহাগী। প্রায় এতটা বলার পর কর্ণ উদ্ধত হয়ে বললেন—যা বলেছি, বেশ করেছি। হ্যাঁ, আমি পাণ্ডবদের একা শেষ করে ছাড়ব। কর্ণ স্পষ্টতই বলতে চাইলেন—আপনি কে? মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের যা প্রিয়, আমি তাই করেছি, তাই করি, আর কাজ করি দুর্যোধনের, রাজ্যের ভার যাঁর ওপরে, আপনি কে—রাজ্ঞো হি ধৃতরাষ্ট্রস্য সর্বং কার্যং প্রিয়ং ময়া। তথা দুর্যোধনস্যাপি স হি রাজ্যে সমাহিতঃ।

এই অপমান ভীষ্মের সহ্য হবার নয়। এতদিন ধরে যিনি এই বিশাল কুরুকুলের সমস্ত তন্তুগুলি রক্ষা করে এসেছেন, তিনি ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধনের প্রিয় বোঝেন না, বোঝে এই কুরুদের আশ্রয়পুষ্ট কর্ণ। অথবা আশ্রয়পুষ্টের এই স্বভাব, সে শ্রেয় বোঝে না, প্রেয় বোঝে, পরিণামে হিতকারিতা বোঝে না, বিষয়ের আপাতরম্যতা বোঝে। কিন্তু ভীষ্ম যদি এখন সেই সব তর্ক তোলেন, তা হলে স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের তা মোটেই বুদ্ধিগোচর হবে না—হবে না যে, তা বিদুরের বিরাট বক্তৃতা শেষেই বোঝা গেছে। ভীষ্ম তাই সে ধার দিয়ে গেলেনই না, তিনি বাস্তবতার কথা তুললেন। তিনি কর্ণের সেই আত্মম্ভরিতার কথাটা উদ্ধার করে নিলেন, তাঁর সমস্ত বাক্যগুলি থেকে। ভীষ্ম জানেন, যুদ্ধ যখন লাগবে, তখন সেই বাস্তবতার নিরিখেই কর্ণের কথার উত্তর দেওয়াটা ভাল। ভীষ্ম বললেন—প্রায় প্রতিদিনই একবার এই কর্ণ হামবড়াই করে বলবে—আমি একাই পাণ্ডবদের শেষ করে দেব—হস্তাহং পাণ্ডবানিতি। আরে পাণ্ডবদের তুলনায় এই কর্ণটা একের যোলো ভাগও নয়—নায়ং কলাপি সম্পূর্ণ পাণ্ডবানাং মহাত্মনাম্।

বিরাটরাজ্যের যুদ্ধের আসরে, দ্রোণাচার্যের কথার উত্তরে কর্ণ যখন একই কথা বলেছিলেন—পাণ্ডবদের আমিই মারব—তখন এই ভীষ্ম কোনওমতে কর্ণের কথার যৌক্তিকতা স্থাপন করে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বন্ধ করেছিলেন ; দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য অশ্বত্থামার মতো বীরকে কোনওমতে তিনি কৌরবপক্ষে পুনরায় স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু আজ যখন সেই লোক, সেই একই কথা তাঁরই মুখের ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে তাঁকেই ‘নিমকহারাম’ বলতে চাইছে, তখন ভীষ্মও লাগামছাড়া কথাবার্তা আরম্ভ করে দিলেন। ভীষ্ম বললেন—ধৃতরাষ্ট্র! আজ তোমার ছেলেদের কপালে যে দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে আসছে, তার সবটাই জানবে এই বদমাশ সারথির বেটার কাজ—তদস্য কর্ম জানীহি সূতপুত্রস্য দুর্মতেঃ। প্রধানত, এইটার ওপর নির্ভর করেই তোমার দুর্বুদ্ধি ছেলে দুর্যোধন, তার বীর জ্ঞাতিভাইদের অপমান করেছিল। আর এই কর্ণ পাণ্ডবদের মারবে বলছে—তা বেশ—এই কর্ণের একটা সেইরকম সাংঘাতিক কর্মের কথা বলো, যা পাণ্ডবদের কেউ না কেউ করেনি। এই যে বিরাটনগরে এত বড় যুদ্ধটা হয়ে গেল, সেখানে কর্ণটা লড়তে গেছিল অর্জুনের সঙ্গে। কী হল? কর্ণের নিজের ভাইটাও যখন মরে গেল, তখন এই কর্ণ কী করেছিল—কিমনেন তদা কৃতম্। সেই যুদ্ধে অর্জুন যখন সমস্ত কুরু-প্রধানদের যুদ্ধে মুচ্ছিত করে পরনের কাপড়টা পর্যন্ত খুলে নিয়ে চলে গেল, তখন এই কর্ণটা কোথায়, কোন দূরদেশে লুকিয়েছিল—প্রমথ্য চাচ্ছিনদ্ বাসঃ কিময়ং প্রোষিতস্তদা? যখন গন্ধর্ব চিত্রসেন তোমার ছেলে দুর্যোধনকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, তখন কোথায় ছিল এই সূতের বেটা, যেটা আজকে এখানে দাঁড়িয়ে ষাঁড়ের মত গোঁ গোঁ করে চেঁচাচ্ছে—ক্ক তদা সূতপুত্রো’ভূদ য ইদানীং বৃষায়তে। আরে সেদিন, সেই অর্জুন, সেই ভীম, সেই নকুল-সহদেব—এরাই গিয়ে গন্ধর্বদের হটিয়ে দিয়ে তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে এনেছিল। এই কর্ণের মিথ্যা বাগাড়ম্বর অনেক শুনেছি, ওসব ফালতু কথার কোনও মূল্য নেই—এতান্যস্য মৃষোক্তানি বহুনি ভরতর্ষভ।

ভীষ্মের কথাগুলি অক্ষরে অক্ষরে সমর্থন করলেন দ্রোণাচার্য, কারণ তিনিই কর্ণের কটু অপমানের পূর্বভোগী। দ্রোণাচার্য ধৃতরাষ্ট্রকে সাবধান করে দিলেন এবং বললেন—খবরদার এইসব ধান্দাবাজদের কথা শুনে আপনি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন না—ন কামম্ অর্থলিপ্সুনাং বচনং কর্তুমর্হসি। কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ বললে কী হবে, আমরা আগেই বলেছি ধৃতরাষ্ট্রের কর্ণ বিষয়ক বিরূপ প্রতিক্রিয়া অতি সাময়িক। হিতের কথা তাঁর আর ভাল লাগে না, বরঞ্চ কর্ণের আপাতবশংবদতার কথাই তাঁর ভাল লাগে, কেউ তাঁর প্রিয় সাধন করছে এইটাই তাঁর ভাল লাগে, অন্ধ রাজার গোপন অন্ধ ইচ্ছেগুলি কেউ নির্বিচারে পালন করছে—এইটাই তাঁর ভাল লাগে। ফল হল এই যে, ভীষ্ম-দ্রোণ যা বললেন, সেদিকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে, যেন কিছু শুনতেই পাননি এমন একটা ভাব করে তাঁর বিস্ফারিত অন্ধ চক্ষু দুটি দিয়ে ইঙ্গিত করলেন সঞ্জয়কে—অনাদৃত্য তু তদ্‌বাক্যবাক্যমর্থবদ্ দ্রোণভীষ্ময়োঃ। যেন এই ভীষ্ম-দ্রোণের প্রলাপ বাক্যের কোনও মূল্যই নেই, বরং কর্ণ যা বলেছেন ঠিক বলেছেন, এমনি একটা ভাব করে ধৃতরাষ্ট্র সাবহেলায় জিজ্ঞাসা করলেন—হ্যাঁ সঞ্জয়, কী হল তারপর, পাণ্ডবেরা কী বললেন?

মহাভারতের কবি আর কিছুতেই কর্ণকে সমব্যথা দেখাতে পারছেন না। কবির ধারণা, ধৃতরাষ্ট্র যখন ভীষ্ম, দ্রোণের মত মানুষের সার কথা শুনলেন না, ভদ্রতা করে তাঁদের কথার জবাবও দিলেন না, উল্টে কর্ণের প্রতিই যখন ধৃতরাষ্ট্রের গৃঢ় সমর্থন রয়ে গেল, তখন কুরুকুলের সাধারণ জনেরা নিজের জীবনের আশা বিসর্জন দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের সমস্ত কথা শুনলেন, পাণ্ডবদের প্রতিজ্ঞা নিষ্ঠা শুনে তাঁর যে একটু ভয় ভয়ও করছিল না, তা নয়, কিন্তু তাঁকে আপন মতে প্রতিষ্ঠিত করতে দুর্যোধনই ছিলেন যথেষ্ট। ভীষ্ম যেহেতু কর্ণের বীরত্ব নিয়ে কটু সমালোচনা করেছেন, তাই দুর্যোধন সবার সামনেই পুনরায় তাঁকে কাল্পনিক পাণ্ডবহন্তার আসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তুলনা দিয়ে বললেন, কর্ণ আপন শক্তিমত্তায় ওই ভীষ্ম, দ্রোণ কি কৃপের থেকে কোনও অংশে কম নয়, বরঞ্চ ভীষ্মের গুরু পরশুরামও নাকি তাঁকে সমযোদ্ধার আসন দিয়েছেন—অনুজ্ঞাতশ্চ রামেণ মৎসমো’সীতি ভারত। হ্যাঁ, ইন্দ্রদেবের প্রবঞ্চনায় এবং কর্ণের দানশূরতায় কবচ-কুণ্ডলটি খোয়া গেছে বটে, কিন্তু মজুত আছে কর্ণের কাছে সেই ইন্দ্রের দেওয়া এক বীরঘাতিনী শক্তি—যে শক্তি থেকে অর্জুনের কিছুতেই নিস্তার নেই—কম্মাদ জীবেদ্ ধনঞ্জয়ঃ। দুর্যোধন কর্ণের শক্তি দেখিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন—আপনি একটুও চিন্তা করবেন না মহারাজ, পাকা ফলের মতো জয় আমাদের হাতের মুঠোয়—ফলং পাণেী ইবাহিতম্।

আমরা আগেই বলেছি মহাভারতের কবি আস্তে আস্তে তাঁর সমস্ত সমব্যথিতা উঠিয়ে নিচ্ছেন কর্ণের ওপর থেকে। যে শক্তি, যে রণনিপুণতা নিয়ে জন্মেছিলেন কর্ণ, সেই শক্তি শুধু অন্যায় বুদ্ধির মোসাহেবি করে এখন একেবারে একা হয়ে গেছে। সহনশীলতা এবং পাত্রপাত্র বোধ—দুটিই কর্ণের মধ্যে না থাকাতে তিনি শেষ পর্যন্ত কৌরবকুলের ধ্বংসসাধকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান বলে চিহ্নিত হয়েছেন। এমনকী স্থিতিশীল প্রকৃতিস্থ অবস্থায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত মনে করেন—দুর্যোধন আমার গোপাল ছেলে, সুবোধ বালক, আসল কাজটা করছে ওই কর্ণ। দুর্যোধনকে তিনি স্পষ্টই জানিয়েছেন—দেখ বাপু তুমি তো নিজে ইচ্ছে করে কিছু কর না, ওই কর্ণ তোমাকে দিয়ে করিয়ে নেয়—ন ত্বং করাষি কামেন কর্ণঃ কারয়িতা তব। দুর্যোধনের গোষ্ঠীতে কর্ণের এই প্রযোজক কর্তার ভূমিকা, এটা খানিকটা সত্যও বটে। কর্ণ নিজে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা—এইসব বড় মাপের মানুষদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্র যখন সবার চাপে পড়ে দুর্যোধনের কাছে সন্ধির প্রস্তাব করলেন, তখন দুর্যোধন পরিষ্কার সেই একাকিত্বের দায়িত্ব নিয়েছেন। অর্থাৎ যুদ্ধ যদি লাগে এবং ভীষ্ম দ্রোণ, কৃপ, কেউ যদি যুদ্ধ নাও করেন, তবু তিনি যুদ্ধ করবেন, শুধু তাঁর সঙ্গী হবেন কর্ণ। তিনি বলেছেন—আমি কারও ওপর কোনও ভরসা রাখছি না, শুধু আমি আর কর্ণ—অহঞ্চ তাত কর্ণশ্চ—এ দুজনে মিলেই আমরা যুদ্ধ করব। যুদ্ধটা যদি যজ্ঞের মতো চেহারা নেয়, তাহলে সেই রণযজ্ঞের পশুবলি হবেন যুধিষ্ঠির, আর সেই যজ্ঞের পুরোহিত হবেন কর্ণ আর দুর্যোধন—অহঞ্চতাত কর্ণশ্চ রণবজ্ঞং বিতত্য বৈ। যুধিষ্ঠিরং পশুং কৃত্বা দীক্ষিতৌ পুরুষর্ষভৌ।

রণযজ্ঞে পাণ্ডব-প্রতিনিধি যুধিষ্ঠিরকে বলি দেওয়ার জন্য দুর্যোধন কারও ওপর নির্ভর করেননি, প্রধানত কর্ণের ওপর ছাড়া। এই নির্ভরতার জন্য কর্ণের মত নিতে হয়নি দুর্যোধনকে, কর্ণের ওপর দুর্যোধনের দখলদারি এতটাই। কর্ণও অবশ্য তাঁর কথার মর্যাদা দিয়েছেন কিন্তু সেই সঙ্গে একটা বড় ঘটনাও ঘটে গেল। কুরুসভার বৃদ্ধেরা যে আস্তে আস্তে কর্ণের থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে পড়ছিলেন তারই এক চূড়ান্ত রূপ দেখা গেল এই সময়। দুর্যোধনের নির্ভরতায় আপ্লুত হয়ে কর্ণ খেয়ালই করলেন না যে, ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের কাছে পাণ্ডবদের সম্বন্ধে নানা কথা জানতে ব্যস্ত আছেন—বৈচিত্রবীর্যম্ তম্ অচিন্তয়িত্বা। এমনিতেই কর্ণ কথা বলতে উঠলেই কুরুসভায় দুর্যোধনের অনুগতদের মধ্যে ‘এনকোর’ ‘এনকোর’ ধ্বনি ওঠে। ঠিক তেমনিভাবেই—প্রহর্ষয়ন্ সংসদি কৌরবাণাম্-কর্ণ নিজের মনে দারুণ আস্থা নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন। কর্ণ বললেন—দুর্যোধন! পাণ্ডবদের ব্যাপারটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও, ওদের সঙ্গে আমি বুঝে নেব—পার্থান্ হনিষ্যামি মমৈষ ভারঃ।

কুরুসভায় এখন পাণ্ডব-কৌরবের ক্ষমতা-অক্ষমতা যাচাই চলছে দিন রাত। কে কাকে মারতে পারবে। কার শক্তি কত—এ সব তুলনা, প্রতিতুলনা চলছে। সেই অবস্থায় কর্ণ তাঁর স্বাভাবিক নিয়মে আবারও বলে ফেললেন—পাণ্ডবদের দণ্ড দেওয়ার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। হ্যাঁ, আমি গুরু পরশুরামের কাছে মিথ্যা কথা বলে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছিলাম বটে, গুরুও আমাকে অভিশাপ দিয়েছেন যে, আমার অন্তকালে সেইসব মারণাস্ত্র আমার স্মৃতিগোচর হবে না। কিন্তু তবু বলছি, সে সব অস্ত্রের শেষমেশ এখনও যা আমার মাথায় আছে, তাতেই ওই পাণ্ডবদের বারোটা বেজে যাবে—তস্মাৎ সমর্থো’স্মি মমৈষ ভারঃ। কর্ণ গুরুর কথাটা তুললেন এই জন্যে যে, বার বার পরশুরামের অভিশাপের কথাটা বলে তাঁকে একটু খাটো করে দেখার একটা প্রবৃত্তি ভীষ্ম-দ্রোণের মধ্যে দেখা যাচ্ছিল। অতএব ভীষ্ম-দ্রোণের মুখ ভোঁতা করে দিয়ে বললেন—আরে! পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য—আপনারা এত কষ্ট করবেন কেন? আপনারা বুড়ো মানুষ, আপনারা মেজাজে বসে থাকুন ওই দুর্যোধনের পাশটিতে। পাণ্ডবদের ব্যাপারে আপনাদের কারও কোনও চিন্তা নেই, ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন—পার্থান্ হনিষ্যামি মমৈষ ভারঃ।

আর কত! আর কত সহ্য করতে পারেন ভীষ্ম! ভীষ্ম বললেন—তোমার সময় হয়ে এসেছে বাছা। যথেষ্ট বড় বড় কথা শুনেছি—কিং কত্থসে কালপরীতবুদ্ধে—আর নয়। ওই যে ইন্দ্রের দেওয়া ওই শক্তিটার ওপর অত ভরসা করছ তুমি, ভাবছ একবার ব্যবহার করেই অর্জুনকে সাবাড় করবে তুমি। আরে, যুদ্ধক্ষেত্রে যখন বাসুদেব কৃষ্ণের চক্র চলবে, তখন ইন্দ্রের শক্তি গুঁড়িয়ে যাবে—চক্ৰাহতাং দ্রক্ষ্যসি কেশবেন। ওই যে সাপের মুখওয়ালা বাণটা, যেটাকে তুমি প্রতিদিন মালা-টালা দিয়ে পুজো কর, তোমার সঙ্গে ওটারও আর চিহ্ন থাকবে না অর্জুনের বাণে। এটা মনে রেখ অর্জুনকে রক্ষা করছেন স্বয়ং বাসুদেব, তোমাদের মতো বিরাট যোদ্ধাকে ওপারে পাঠাতে যাঁর সময় লাগবে না একটুও—যঃ ত্বাদৃশানাঞ্চ বলীয়সাঞ্চ হন্তা রিপূণাং তুমুলে প্রগাঢ়ে।

কর্ণের রাগ হল সাংঘাতিক, অথচ প্রথমে স্বীকারও করে নিলেন কৃষ্ণের বলবত্তার কথাটা। বললেন—হ্যাঁ, স্বীকার করলাম কৃষ্ণ খুব বড় মানুষ কিন্তু তাই বলে আমিও যা বলেছি তাও এমন কিছু বাজে কথা নয়। শুনে রাখুন পিতামহ! এই আমি অস্ত্র ফেলে দিলাম, আপনি বেঁচে থাকতে এই সভাতেও আমি আসব না, এবং যে যুদ্ধে আপনি আছেন, সে যুদ্ধেও নয়। কিন্তু আমি কী করতে পারি আর পারি না, তা সবাই দেখবে আপনি গতায়ু হলে—ত্বয়ি প্রশান্তে তু মম প্রভাবং দ্রক্ষ্যন্তি সর্বে ভুবি ভূমিপালাঃ। এই বলে কর্ণ কুরুসভা ত্যাগ করে রাগে ফুঁসতে ফুসতে নিজের বাড়ি চলে গেলেন। দুর্যোধন ভীষ্মকে খানিকটা বকাবকি করলেন এবং পরিষ্কার তাঁকে জানালেন—পিতামহ! আপনি কিংবা দ্রোণের ওপর নির্ভর করে আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না, পঞ্চপাণ্ডবদের ঠাণ্ডা করতে আমি, কর্ণ আর দুঃশাসনই যথেষ্ট—অহং বৈকৰ্ত্তনঃ কর্ণো ভ্রাতা দুঃশাসনশ্চ মে। এ কথাগুলি সবই কর্ণের কথা। কর্ণ চলে গেলে, কর্ণের কথা বলেই ভীষ্মকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন স্বয়ং দুর্যোধন। দুর্যোধন কর্ণের পুরনো কথাটাও ফিরিয়ে দিলেন। বললেন—অস্ত্রে, ক্ষমতায়, সৈন্যবলে আমরাও পাণ্ডবদের থেকে কম যাই না, তবু খালি আপনি পাণ্ডবদের জয় দেখতে পান সব জায়গায়, কেন? আমরা কি এতই ফেলনা—পিতামহ বিজানীষে পার্থেষু বিজয়ং কথম্। বললাম তো পাণ্ডবদের ঠাণ্ডা করতে, আমি, কর্ণ আর দুঃশাসনই যথেষ্ট, আপনাদেরও কাউকে প্রয়োজন নেই—পাণ্ডবান্ সমরে পঞ্চ হনিষ্যামি শিতৈঃ শরৈঃ।

এ হল কর্ণের সঙ্গে দুর্যোধনের পারস্পরিক সেই পিঠ-চুলকানি, যাতে করে, কুরুবৃদ্ধেরা সবাই একে একে প্রত্যেকেই আপন কক্ষে গিয়ে পৌঁছেছেন ; আর কেউই দুর্যোধনের সঙ্গে মানসিকভাবে কাছাকাছি নেই। ভীষ্ম, দ্রোণ যতদূর সরেছেন দুর্যোধনের কাছ থেকে, দুর্যোধন তত কাছাকাছি হয়েছেন কর্ণের। দূত সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে ‘রিপোর্ট’ দিয়েছেন যে, তিনি অর্জুন আর কৃষ্ণকে এক আসনে বসে থাকতে দেখে বড়ই ভয় পেয়েছেন—একাসনগতৌ দৃষ্টা ভয়ং মাং মহাবিশৎ। সেইকালের দিনে দেবপ্রতিম এই দুই প্রবাদ পুরুষের ঘনিষ্ঠতা সঞ্জয়ের মনে যে প্রমাদের সঞ্চার করেছে, অনুরূপ ভয় পাণ্ডব পক্ষেরও হতে পারত—কর্ণ-দুর্যোধনের ঐকান্তিক ঘনিষ্ঠতায়, কারণ তাঁদেরও আমরা একাসনেই বসতে দেখেছি। কৃষ্ণ যখন শান্তির দূত হয়ে এলেন কৌরবদের সভায়, তখন কর্ণ-দুর্যোধনও একাসনেই বসে ছিলেন-কর্ণ-দুর্যোধনাবুভৌ… একাসনে মহাত্মানৌ। কিন্তু তবুও যে তাঁরা কোনও ভয়ের সৃষ্টি করতে পারেননি, তার কারণ হিসেবে না হলেও মহাভারতের কবি তাঁদের একটা বিশেষণ দিয়ে আমাদের সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন। কবি লিখেছেন—কৃষ্ণের আসনের অত্যন্ত কাছাকাছি কর্ণ আর দুর্যোধন একাসনে বসেছিলেন, কিন্তু শান্তি-সন্ধির কথা শোনার মতো তাঁদের প্রকৃতি ছিল না, তাঁরা দুজনেই রাগে গুম হয়ে বসেছিলেন—একাসনে মহাত্মানৌ নিষীদতুরমর্ষণৌ। মনের মধ্যে ক্রোধের মতো এত বড় একটা রিপু নিয়ে, পাত্রপাত্র-বিবেকহীন স্বার্থপরায়ণ এক অহমিকা নিয়ে কখনও মহান ব্যক্তিত্বের দাবি করা যায় না। তাঁদের একাত্মক অহমিকা যেখানে কৌরবদের নিজের ঘরের মধ্যেই ভাঙন ধরে গিয়েছিল সেখানে পাণ্ডবের শিবিরে কৃষ্ণার্জুনের একাত্মতায় তাঁদের শত্রু পক্ষের যে শুধু ভয় উৎপাদিত হচ্ছিল তাই নয়, কৌরব পক্ষের অনেক মান্য পুরুষই তাঁদের হৃদয়-ভরা সম্মান নিবেদন করতে আরম্ভ করেছিলেন পাণ্ডব পক্ষের ওই দুই মহান পুরুষের উদ্দেশ্যে। ভীষ্ম-দ্রোণের মতো পুরুষেরও তাঁদের প্রতি এই সম্মান-বোধ ভয়ে তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছে নীতি-যুক্তির বৈধতায়, যে বৈধতা কর্ণ-দুর্যোধনের হৃদয়ে ছিল না। সমস্ত মতে নিরপেক্ষ গান্ধারীর যুক্তিতেও কর্ণ পরিচিত হয়েছেন অত্যন্ত ক্রোধী বলে—সূতপুত্রো দৃঢ়ক্রোধঃ। কর্ণ-দুর্যোধনের যৌথ আস্ফালন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, কৌরব পক্ষের স্থিতধী পুরুষেরা শেষ পর্যন্ত পাণ্ডব পক্ষেই যোগ দিয়ে বসেন কি না, এমন আশঙ্কার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। কৃষ্ণের দৃতকর্ম যখন প্রায় ব্যর্থ হল, সেই সময় গান্ধারী তো পরিষ্কার দুর্যোধনকে বলেছিলেন—তোমার বন্ধু ওই সূতপুত্ৰ কৰ্ণ, কিংবা দুঃশাসন জীবনেও পাণ্ডবদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। স্বয়ং কৃষ্ণও দুর্যোধনকে শাসিয়ে গেছেন তাঁর, দুঃশাসনের এবং কর্ণের অভদ্র ভাষা এবং ব্যবহারের জন্য, বিশেষত যে ভাষা কর্ণ ব্যবহার করেছিলেন পাশা খেলার আসরে কুলবধু দ্রৌপদীর প্রতি। কৃষ্ণ স্পষ্টতই বলেছেন, সে ভাষা ছোটলোকের ভাষা—নৃশংসানাম্ অনার্যানাং পুরুষাণাঞ্চ ভাষণম্।

কিন্তু গান্ধারীর নিরপেক্ষ বাক্য, কৃষ্ণের শাসানি এবং ভীষ্ম-দ্রোণের মতো পুরুষদের বিরুদ্ধতাও দুর্যোধন-কর্ণকে টলাতে পারেনি। তাঁরা এক সময় শান্তির দূতকে বেঁধে রাখার কল্পনাও করেছিলেন—দুর্যোধনস্য কর্ণস্য…ইদমাসীদ্ বিচেষ্টিতম্। কৃষ্ণ বুঝেছিলেন, সব বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন যে, দুর্যোধনের যত মেজাজ, তা বোধহয় সবটাই কর্ণের জন্য। একটা সময় এল যখন পুরুষোত্তম কৃষ্ণ কুরুসভার সমস্ত মানুষগুলিকে আপন ব্যক্তিত্বে বিমূঢ় করে দিয়ে কর্ণকে তুলে নিলেন আপন রথে—আরোপ্য চ রথে কর্ণং প্রায়াৎ সাত্যকিনা সহ। কুরুসভার ছেলে বুড়ো সবাই জল্পনা কল্পনা করতে লাগল—কী হল, কৃষ্ণ কর্ণকে হঠাৎ তুলে নিয়ে গেলেন কেন ব্যাপারটা কী?