ভীম – ৮

বারো বছর বনবাসের পর এক বছরের অজ্ঞাতবাসে অসামান্য রূপবতী দ্রৌপদীকে কী করে লুকিয়ে রাখা যাবে—তা নিয়ে ভীমের বড় ভাবনা ছিল। ভীমের ভয়—‘পুণ্যকীর্তি রাজপুত্রী’ সাধারণের মতো সেজে সাধারণের মধ্যে থাকলেও তাঁর মনস্বিতা, তাঁর অলোকসামান্য ভাব-ব্যঞ্জনা তাঁর স্বরূপ প্রকাশ করে দেবে—বিশ্রুতা কথমজ্ঞাতা কৃষ্ণা পার্থ চরিষ্যতি। ভীম একথা বলেছিলেন সেই দ্বৈতবনে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ঝগড়ার সময়। অবশ্য নিজের সম্বন্ধেও তাঁর বিশ্বাস এবং ভাবনা কম ছিল না এবং সে ভাবনা তিনি প্রকাশ করেছিলেন দ্রৌপদীর সম্বন্ধে কথা বলার অব্যবহিত পরেই। ভীম বলেছিলেন—প্রজারা সব আমাকে ছোট বয়স থেকে জানে। পাহাড়কে যেমন চেপেচুপে লুকিয়ে রাখা যায় না, তেমনই আমার পক্ষেও নিজেকে লুকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব—নাজ্ঞাতচর্যাং পশ্যামি মেরোরিব নিগূহনম্।

তবে এসব হল ঝগড়ার সময়ের কথা। বাস্তবে যখন অজ্ঞাতবাসের সময় এল, তখন ভীম এটাকে বেশ মজা হিসেবেই নিলেন। যুধিষ্ঠির যখন অজ্ঞাত-বাসের সময় রাজার সান্নিধ্যে পাশা খেলে নিজেকে লুকোতে চাইলেন, তখন ভীম বললেন—আমি সাজব রান্নার ঠাকুর। আমার নাম হবে বল্লব। অন্ন-ব্যঞ্জন নানা রকম রাঁধব। জ্বালানির কাঠ কুড়িয়ে আনব নিজের কাঁধে। রাজা দেখে খুশি হবেন। আর আমি যদি একবার রাজার রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াই তবে সেখানে আর যত ঠাকুর-চাকর আছে, সবাই আমাকে রাজা বলে মেনে নেবে—রাজ্ঞস্তস্য পরিপ্ৰেষ্যা শংসন্তে মাং যথা নৃপম্। আসলে ভীম নিজে প্রচণ্ড খেতে ভালবাসেন আর ভালবাসেন বলেই রান্নাও জানতেন ভালই। তা ছাড়া বারো বছর বনবাসে শশ-মৃগ-বরাহ পুড়িয়ে খেয়ে তাঁর অরুচি ধরে গেছে। অতএব রাজার রান্নাঘরের আধিকারিক হয়ে ভীম বোধহয় নিজের দুঃখও ঘোচাতে চান, সঙ্গে রাজাকেও খাওয়াতে চান ভাল-মন্দ নানান কিসিমের রান্না। বারো বছরের বনবাসী পেটের স্বপ্ন তাই চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়র নিরঙ্কুশ অধিকার পাওয়া—ভক্ষ্যান্ন-রসপানানাং ভবিষ্যামি তথেশ্বরঃ।

তবে কিনা, ওই বিশালকায় যুদ্ধপ্রিয় মানুষটি শুধু রান্নাঘরে দিন কাটাবেন, তা হতেই পারে না। ভীম নিজেও সেটা মনে মনে জানেন। তাই রন্ধনশালার আধিকারিক হবার ইচ্ছে প্রকাশ করেই ভীম বলেছেন—এমন যদি হয়, রাজবাড়িতে কোনও হাতি ঘোড়া ষাঁড় খেপে উঠেছে, তবে সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আমি সাহায্য করব। যদি বিরাটরাজার মল্লযোদ্ধারা যুদ্ধের প্রদর্শনীতে আত্মশক্তি প্রদর্শন করে, তবে আমিও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের শুধু প্রাণে মারতে বাকি রাখব। রাজাকে দেখাব আমার খেল, তাতে তাঁর আনন্দ বাড়বে, আমার ওপর তিনি খুশি হবেন—রতিং তস্য বিবর্ধয়ন্। ভীমের কথা শুনে বোঝা যায়—অন্যদের মতো তিনি নিশ্চেষ্ট বসে থাকতে পারবেন না। রান্নার ফাঁকে-ফুরসতে একটু-আধটু যুদ্ধের ব্যায়াম না করে তিনি বসে থাকতে পারবেন না।

পাঁচ পাণ্ডবভাই আত্মগুপ্তির নানা পরিকল্পনা নিয়ে একে একে বিরাটনগরে ঢুকলেন। যুধিষ্ঠির কঙ্ক নামে আগেই বিরাটের রাজসভায় দ্যূতকরের জায়গা পেয়ে গেছেন। এবার ভীমের পালা। ভীম ঠিক রান্নার ঠাকুরের মতো সাজলেন। খালি গা। একহাতে একটা উনুন-খোঁচানো শিক—সে শিকের এক পাশটা দিয়ে জ্বলন্ত অঙ্গারও ভোলা যায়। ভীমের অন্য হাতে বড়সড় একটা হাতা। অবশ্য এর সঙ্গে একটা কুটনা-কোটা বঁটিও আছে। রান্নার সরঞ্জাম হাতে নিয়ে ভীম রাজবাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলেন—এমন ভাবে, যাতে তিনি রাজার চোখে পড়েন।

আজকে যদি ভারতীয় সামরিক বাহিনীর এক বিশালদেহী গৌরবরণ পদস্থ সুপুরুষ হাতে হাতা-খুন্তি নিয়ে পথ চলেন, তাহলে তিনি যেমন সবার চোখে পড়বেন, সেই রকম ভীমও বিরাটরাজার নজরে পড়লেন। অবশ্য ভীমও দর্শনার্থী হয়েই রাজদ্বারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভীমের চেহারা দেখে বিরাটরাজার খুব পছন্দ। দর্শনার্থীদের মধ্যে সবার আগে তাঁর ডাক পড়ল। ভীম বিরাটের উদ্দেশে বললেন—মহারাজ! আমি সূপকার। রাঁধতে জানি ভাল। নাম বল্লব। আমাকে যদি রান্নার কাজ দেন, তবে আপনার মন-পসন্দ নানা রকম রেঁধে খাওয়াব—ভজস্ব মাং ব্যঞ্জনকারমুত্তমম্। বিরাট বললেন—ধুর! তোমাকে দেখে মোটেই রান্নার লোক বলে মনে হচ্ছে না। যা তোমার চেহারা, যেমন শক্তিমান তোমার গঠন, তাতে রান্নার লোক বলে তোমায় বিশ্বাসই হয় না, তুমি বিনয় দেখাচ্ছ—ন সূদতাং মানদ শ্রদ্ধধামি তে।

ভীম বললেন—কী যে বলেন কত্তা! আমি যা জানি, তার মধ্যে প্রথম কথাটাই হল রান্না। ইন্দ্রপ্রস্থে সেই যে মহারাজ যুধিষ্ঠির-মশায় ছেলেন, তিনি জানতেন আমার রান্নার স্বাদ। তবে হ্যাঁ, আপনি যা বললেন, আমার মতো শক্তপোক্ত লোক কমই আছে হেথায়। হাতি বলুন, সিংহ বলুন কি বড় বড় কুস্তিগিরই বলুন—আপনার যদি খুশি লাগে, তো—তাদের আমি ঠাণ্ডা করে দিতে পারি এক নিমেষে। বিরাট বললেন—ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি যখন রান্নার কাজ চাইছ, তোমায় সেই কাজই দিলাম আমি। তবে যাই বলো রান্নার কাজ তোমাকে মানায় না—ন চৈব মন্যে তব কর্ম তৎ সমম্। তবে তুমি যখন বলছ, মেনে নিলাম। আমার পাকশালায় যত ঠাকুর আছে, আমি তাদের মধ্যে তোমাকে আমার প্রধান পাচক এবং আধিকারিক নিযুক্ত করলাম—তেষাম্ অধিপো ময়া কৃতঃ।

ভীম রাজবাড়ির প্রধান পাচক নিযুক্ত হলেন। আর খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট নেই। বেশ মেজাজেই আছেন। মাঝে মাঝে রাজার মাইনে করা অথবা বাইরের মল্লযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের অভ্যাস ঠিক রাখেন। রাজবাড়ির বউ-ঝি-পরিচারিকারাও সে সব যুদ্ধ দেখেন। সেখানে সৈরন্ধ্রী দ্রৌপদীও রানি সুদেষ্ণার পাশে দাঁড়িয়ে সেই যুদ্ধ দেখেন। নিজের অজান্তেই মাঝে মাঝে তিনি ভীমের তারিফও করে ফেলেন। সেই দেখে রাজবাড়ির মেয়েরা হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠে। বলে—ওই জওয়ান পাচকটির ওপর সৈরন্ধ্রীর ইয়ে আছে, মানে হাঃ হাঃ, হিঃ হিঃ।

ভীম এসব খবর জানেন না। তিনি সরল মানুষ। তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছে কেউ যেন আমাদের না চিনতে পারে। বাস্। তিনি আর কারও দিকে তাকান না, দ্রৌপদীর দিকেও না। কিন্তু তিনি না তাকাতে চাইলেও ঘটনা-প্রবাহ এমনই এক জিনিস, যা তাঁকে একভাবে বিরাটের রাজবাড়ির এক উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে দিল।

বিরাটরাজার শালা কীচক দ্রৌপদীকে দেখে একেবারে মোহিত হয়ে পড়ল। দ্রৌপদীকে দেখলেই সে একথা-সেকথার টানে আপন আকর্ষণ প্রকাশ করতে থাকে। প্রেমের থেকে তার শারীরিক আকর্ষণই বেশি এবং এই আকর্ষণ প্রকট শব্দরাশিতে দ্রৌপদীর সামনে প্রকাশ করতেও তার দ্বিধা হয় না। দ্রৌপদী নিজে তাকে যথেষ্টই নিরাশ করতে থাকেন এবং মাঝে মাঝে তাকে ভয়ও দেখান যে, তাঁর পঞ্চ গন্ধর্ব-স্বামী কীচকের সর্বনাশ করে ছাড়বে। কামোন্মত্ত কীচক এসব কথায় ভয় পায় না। সৈরন্ধ্রী দ্রৌপদীকে কব্জা করতে সে তার বোন রানি সুদেষ্ণাকে হাত করে। কীচক তাঁকে বলে—যে উপায়ে সৈরন্ধ্রী আমার দিকে আকৃষ্ট হয়—তুমি সেই ব্যবস্থা কর—যেনোপায়েন সৈরন্ধ্রী ভজেন্মাং গজগামিনী।

সুদেষ্ণা ভাইয়ের কথায় ভুলে তাকে বাড়িতে অন্ন-পানের ব্যবস্থা করতে বলেন। ভাইকে বলে দেন—আমি ফিকির করে সৈরন্ধ্রীকে তোমার বাড়িতে মদ আনতে পাঠাব। সেই সুযোগে তুমি যা পার কর। ব্যবস্থা পাকা হল। সুদেষ্ণা ভাইয়ের বাড়ি থেকে সুরা নিয়ে আসতে বললেন সৈরন্ধ্রীকে। সৈরন্ধ্রী কিছুতেই রাজি নন। তিনি কীচকের কুমতবল বুঝে গেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে কীচকের বাড়িতে যেতে বাধ্য হলেন দ্রৌপদী।

যা হবার ছিল তাই হল। দ্রৌপদীকে দেখেই কীচক তাঁর আঁচল চেপে ধরল। দ্রৌপদী ধস্তাধস্তি করে কোনও রকমে কীচককে মাটিতে ঠেলে ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে উপস্থিত হলেন রাজসভায়। সেখানে বিরাট এবং যুধিষ্ঠির দুজনেই বসে আছেন। হয়তো দৈবক্রমে অথবা রাজাকে অন্ন-পান কিছু জোগাবার জন্য ভীমও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দৌড়নো অবস্থাতেই দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে ফেলে কীচক, এবং বিরাটরাজার সামনেই দর্পিতা সৈরন্ধ্রীকে সে লাথি মারে। বিরাট তাকে কিছুই বলতে পারেন না। একে শালা, তায় সেনাপতি, বিরাট নিশ্চেষ্ট বসে থাকেন।

ভীমের রাগ চড়তে থাকে। তিনি দাঁত কিড়মিড় করতে থাকেন এবং মনে মনে তখনই কীচককে মেরে ফেলার জন্য প্রস্তুত হন। ভ্রূকুটী-কুটিল ললাটের মধ্যে হাত ঘষতে ঘষতে ভীম একখানি গাছ দেখতে থাকেন। অর্থাৎ গাছের বাড়িতে কীচককে এখনই শেষ করে দিতে চাইলেন তিনি। যুধিষ্ঠির দেখলেন—মহা বিপদ। অজ্ঞাতবাস চলছে। কোনওক্রমে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেলে আবার পাক্কা বারো বচ্ছর বনে। যুধিষ্ঠির বিরাটকে দেখছেন না, দ্রৌপদীকে দেখছেন না, কীচককে দেখছেন না, শুধু ভীমকে দেখছেন। ভীম বসেছিলেন, একটি গাছ লক্ষ্য করে তিনি এখন ওঠার উপক্রম করছেন তাড়াতাড়ি—ভূয়শ্চ ত্বরিতঃ ক্রুদ্ধঃ সহসোত্থাতুমৈচ্ছত।

যুধিষ্ঠির কাল বিলম্ব না করে ভীমের দিকে আঙুল তুলে বললেন—হ্যাঁগো পাচক-ঠাকুর তুমি এমন করে গাছের দিকে তাকাচ্ছ কেন—আলোকয়সি কিং বৃক্ষং? বুঝতে পারছি রান্নার জন্য তোমার কাঠের দরকার। তো কাঠের জন্য বাইরে যাও, গাছ কেটে নিয়ে এসো বাইরে থেকে—যদি তে দারুভিঃ কৃত্যং বহিবৃক্ষান্নিগৃহ্যতাম্। ভীম যুধিষ্ঠিরের ইঙ্গিত বুঝলেন। তাঁর চৈতন্য হল, খেয়াল হল অজ্ঞাতবাসের কথা, চলেও গেলেন রাজসভা থেকে। সৈরন্ধ্রী দ্রৌপদীকেও যুধিষ্ঠির নরমে-গরমে নানা কথায় বুঝিয়ে রানি সুদেষ্ণার ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।

দ্রৌপদী সুদেষ্ণার ঘরে গেলেন বটে, তবে ক্ষত্রিয়াণীর রাগ কমল না। রানির সঙ্গেও তাঁর কথা কাটাকাটি হল। সুদেষ্ণা বললেন—আমার ভাই কীচক যদি তোমার সঙ্গে অভদ্রতা করে থাকে, তবে নিশ্চয়ই আমি তাকে শাস্তি দেব। দ্রৌপদী বললেন—তোমাকে আর অত চিন্তা করতে হবে না। যে মানুষদের সে রাগিয়ে দিয়েছে, তাতে তার শাস্তির চিন্তা তাঁরাই করবেন। তা ছাড়া আজকে যা ঘটল, তাতে এটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, কীচকের মৃত্যু আসন্ন—মন্যে চাদ্যৈব সুব্যক্তং পরলোকং গমিষ্যতি। দ্রৌপদীর এই দৃঢ় বিশ্বাসের কারণ ভীম, যিনি স্বচক্ষে কীচকের ব্যবহার দেখেছেন।

দ্রৌপদী নিজের ঘরে এলেন। স্নান-টান করে ভাবতে বসলেন। কার কাছে যাবেন, কীই বা করা উচিত—এই চিন্তা তাঁকে পেয়ে বসল। দ্রৌপদী বুঝলেন—যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলে কোনও ফল হবে না। তিনি এতই স্থির এবং এতই বেশি ভাবেন যে, তাঁর কাছে গেলে আশু ফল পাওয়া বোধহয় সম্ভবই নয়। অর্জুনও তেমনই, তিনি যুধিষ্ঠিরের শুধু ভাই নয়, শিষ্যও বটে—ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য। অজ্ঞাতবাসের কথা মাথায় রেখে দ্রৌপদীর এই সমস্যায় তিনি কতটা সাড়া দেবেন—সে সম্বন্ধে সন্দেহ আছে। তার ওপরে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে একটুও আলোচনা না করে অর্জুন শুধু নিজের তাগিদেই দ্রৌপদীর সমস্যা মেটাতে আসবেন—এমন আশা দ্রৌপদী করেন না।

একমাত্র লোক হলেন ভীম। দ্রৌপদী ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন—এই অবস্থায় ভীম ছাড়া অন্য দ্বিতীয় কোনও লোক, তাঁর মনের ইচ্ছে অনুসারে চলবেন না—নান্যঃ কশ্চিদ্ ঋতে ভীমান্মমাদ্য মনসঃ প্রিয়ম্। পূর্বের অভিজ্ঞতায় দ্রৌপদী জানেন—তাঁর ব্যক্তিগত কোনও সমস্যায় ভীম ‘না’ বলেননি। এবার তো কীচকের দুর্ব্যবহার ভীম নিজের চোখেই দেখেছেন। অতএব তাঁকে বোঝাতে দেরি হবে না।

কেউ যাতে তাঁকে না দেখতে পায় সেই ভাবে, রাতের আঁধারে নিজের সুখশয্যা ছেড়ে দ্রৌপদী গুটি-গুটি ভীমের কাছে চললেন। বিরাটের রান্নাঘরে পৌঁছে দ্রৌপদী দেখলেন ভীম ঘুমোচ্ছেন। কত দিন পরে এই শক্তিমান বীর স্বামীর তাঁর সঙ্গে দেখা। মহাভারতের কবি লিখেছেন—তিন বছর বয়সের গরু যেমন পূর্ণ-যৌবনের পীড়ায় কামাতুরা হয়, এতদিন পর সেই মধ্যম-স্বামীটিকে দেখে দ্রৌপদীও তেমনই ভীমের আসঙ্গ-লিপ্সায় আবিষ্ট হলেন। ঘুমন্ত ভীমকে জড়িয়ে ধরলেন উষ্ণ-বক্ষে বাহুর ডোরে। তাঁকে জাগিয়ে তুললেন আলিঙ্গন-চুম্বনের তীব্রতায়—বাহুভ্যাং পরিরভ্যৈনং প্রাবোধয়দনিন্দিতা।

বনের মধ্যে সুপ্ত সিংহকে সিংহী যেমন জাগিয়ে তোলে, সেইভাবে দ্রৌপদী জাগিয়ে তুললেন ভীমকে—মৃগরাজবধূরিব। এরপর আধো ঘুমে আধো জাগরণে থাকা ভীমের সঙ্গে যখন কথা আরম্ভ করলেন দ্রৌপদী, তখনও তিনি তাঁকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে ধরে আছেন—মত্ত হস্তীকে যেমন জড়িয়ে ধরে হস্তিনী, সেইরকম—ভীমসেনমুপাশ্লিষ্যদ হস্তিনীব মহাগজম্।

লক্ষণীয়, ভীমের সঙ্গে দ্রৌপদীর এই আকস্মিক নিশীথ-মিলনের চিত্রে মহাভারতের কবি অন্তত চারটি বন্যপ্রাণীর উপমা দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি বাদে তিনটিই আমি বলেছি। প্রথমে দ্রৌপদী যখন ভীমকে দেখলেন তখন গাভী আর বলীর্বর্দের উপমা। দীর্ঘদিনের পর স্বামীর সঙ্গে নিভৃত মিলনে যেহেতু আবেগের তাড়নাই ছিল প্রধান, অতএব ইন্দ্রিয়-তাড়িত গাভীর উপমা এসেছে কবির মনে। এই তাড়না বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। দ্রৌপদী রাজবধু, অতএব হৃদয়ের সমস্ত আবেগ এক মুহূর্তে সংযত করে তিনি ‘মৃগরাজবধূ’ অর্থাৎ সিংহীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। সুপ্ত ভীম-সিংহকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন রাজোচিত গাম্ভীর্যে। কিন্তু ভীম জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দ্রৌপদী তাঁকে আবারও বিমোহিত করেছেন শারীরিক সৌন্দর্যে, লঘু শৃঙ্গারে—হস্তিনী যেমন শুণ্ডে-শুণ্ডে প্রতি অঙ্গে জড়িয়ে ধরে মত্ত হস্তীকে। হস্তিরাজের তখন কিছুতে ‘না’ বলবার মানসিকতা থাকে না। ভীমের অবস্থাও তেমনই হল।

দ্রৌপদীর ওপর সমস্ত অধিকার যেন ভীমেরই—এইভাবেই দ্রৌপদী তাঁকে বললেন—তুমি জেগে ওঠো ভীম। তুমি এমন মরার মতো ঘুমোচ্ছ কেমন করে—কিং শেষে ভীমসেন যথা মৃতঃ? একেবারে মরে না গিয়ে থাকলে কোনও জীবিত স্বামীর বউকে ওই পাপিষ্ঠ এই রকম অপমান করতে পারে? দ্রৌপদী সোজাসুজি কীচকের কথার সূত্রপাত করলেন। ভীম উঠে বসলেন চিন্তার ভঙ্গিতে। কীচকের ঘটনা তিনি দেখেছেন স্বচক্ষে, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের ইঙ্গিতবাহী তর্জনীটিও তাঁর স্মরণে আছে। ফলে যে উত্তেজনা, যে দ্রুততা তাঁর সার্বিক আচরণে চিরকাল লক্ষিত, সেই উত্তেজনা এখন দেখা গেল না। তাই বলে দ্রৌপদীর কোনও ব্যাপারেই তিনি উদাসীন নন। ভীম কথা আরম্ভ করলেন একটু সংযত ভঙ্গিতে, একটু নরম ভাবে, কারণ কীচকের ‘ডিটেইলস’ তিনি জানেন না।

ভীম বললেন—এত তাড়াহুড়ো করে কী জন্য তুমি আমার কাছে এসেছ? তোমার গায়ের রঙ যেন কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। একটু রোগাও হয়ে গেছ দেখছি—ন তে প্রকৃতিমান্ বর্ণঃকৃশা পান্ডুশ্চ লক্ষ্যসে। কী ব্যাপার? সব খুলে বলো তো দেখি ; ভাল হোক, মন্দ হোক, প্রিয়-অপ্রিয় যাই হোক, সব খুলে বলো। এই কথার সঙ্গে সঙ্গে ভীম নিজের কথাটা আখ্যাপন করতে ভুললেন না। আমি অর্জুন এবং দ্রৌপদীকে নিয়ে পূর্বে যখন প্রবন্ধ লিখেছি, তখন বারবার বলেছি—অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর কী পরিমাণ দুর্বলতা ছিল। নিজের প্রয়োজনে ভীমকে দ্রৌপদী বারবার ব্যবহার করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর মন তিনি বাঁধা দিয়ে রেখেছিলেন অর্জুনের কাছে।

ঠিক এই মুহূর্তে লক্ষ করবেন—ভীম কেমন বুঝতেন যে, তিনি ব্যবহৃত হচ্ছেন ; কিন্তু ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও এই বিদগ্ধা রমণীকে ভাল না বেসে থাকতে পারতেন না তিনি। ঠিক সেই কারণেই এই বিপন্ন মুহুর্তে তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে—আদ্যোপান্ত সব ঘটনা খুলে বলো, কৃষ্ণা। তুমি তো জানো—তোমার সমস্ত কাজে আমিই শুধু কেমন করে তোমার বিশ্বাস রেখেছি, কথা রেখেছি—অহমেব হি তে কৃষ্ণে বিশ্বাস্যঃ সর্বকর্মসু। এমন কী যত বিপদ তোমার জীবনে এসেছে, সবগুলি থেকে আমিই তোমাকে উদ্ধার করেছি। এখনও যা বলবার তা বলে ফেলো তাড়াতাড়ি। তারপর শুতে যাও, এই অজ্ঞাতবাসে কেউ যদি তোমায় দেখে ফেলে? যেভাবেই হোক, অজ্ঞাতবাসের কথাটা এখনও ভীমের মাথায় আছে।

তোমার সমস্ত কাজ আমি করে দিই, সমস্ত বিপদে আমিই তোমাকে রক্ষা করি—এই কথাগুলির মধ্যে এমন একটা ভাব ছিল যেন—কাজের বেলায় এই শৰ্মা, আর প্রেমের বেলায় অর্জুন। অর্জুনের ব্যাপারে দ্রৌপদীর সততাটা ভীম বুঝে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি এমনই এক বেচারা পুরুষ, যিনি দ্রৌপদীকে কিছুতেই না ভালবেসে পারেন না। দ্রৌপদী অবশ্য অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। ভীমের কথা, ভাষা এবং ভাব বুঝে তিনি প্রথমেই খানিকটা গালাগালি দিয়ে নিলেন যুধিষ্ঠিরকে। কীচকের ঘটনাটাও অবশ্য সেইসঙ্গে ভীমকে সবিস্তারে বললেন দ্রৌপদী। দ্রৌপদী আপন জীবনের নানা ঘটনার উল্লেখ করে শুধু বোঝাতে চাইলেন যে, যুধিষ্ঠিরের পাশা-খেলার জন্যই জীবনে তাঁর যত দুঃখ। দ্রৌপদী এইবার তাঁর নিজের দুঃখের সঙ্গে ভীমের দুঃখটাও মিলিয়ে নিলেন। বোঝাতে চাইলেন—আমার নিজের জন্য আর কতটুকু, তোমার দুঃখ দেখে দেখে আমি আর সইতে পারি না।

দ্রৌপদী বললেন—আমার দুঃখ একটাই। এই যে তোমার মতো একজন মানুষ হীন রাঁধুনে বামুনের কাজ করে দিন কাটাচ্ছ—এর থেকে বড় কষ্ট আর আমার কাছে কী আছে? রান্নার কাজ শেষ হয়ে গেলে তুমি যখন বিরাটের সেবা কর, লোকে তোমাকে বিরাটরাজার চাকর বলে ভাবে। এ কষ্ট আমি কী করে সইব? বিরাটরাজা যখন খুব খুশি হয়ে তোমাকে হাতির সঙ্গে লড়াই করান, তখন আমাদের অন্তঃপুরের নচ্ছার মেয়েগুলো দাঁত বার করে হাসে আর ওদিকে ভয়ে আমার বুক কাঁপে—হসন্ত্যন্তঃপুরে নার্য্যঃ মম তুদ্বিজতে মনঃ। তুমি যখন বুনো মোষ আর বাঘ-সিংহের সঙ্গে লড়তে থাক, তখন বিরাটরানি সুদেষ্ণা কী মজাই না পান, আর ওদিকে আমার যেন মাথার মধ্যে কেমন করতে থাকে। রানি তখন তাঁর দাসীদের কী বলে জানো? ওই রান্নার ঠাকুর আর এই সৈরন্ধ্রী প্রায় একই সময় এই বাড়িতে কাজে লেগেছে তো,—অস্মিন্ রাজকুলে চোভৌ তুল্যকালনিবাসিনো—তা ছাড়া একসঙ্গে এতকাল এই বাড়িতে আছে, ওকে দেখে দেখে একটু ভালবাসাও জন্মেছে সৈরন্ধ্রীর—তাই ওই রান্নার ঠাকুরটা লড়াই করতে নামলেই সৈরন্ধ্রীর মনে কষ্ট হয়। তা বাপু! ওই রান্নার ঠাকুর বল্লবও বেশ সুন্দর দেখতে, আর আমাদের সৈরন্ধ্রীও বেশ দেখতে—দুজনকে বেশ মানায়—যুক্তরূপৌ চ মে মতৌ।

দ্রৌপদী বলে চললেন—শুধু এইটুকু হলেও হত। এত কথার পরে বলে কিনা—মেয়েদের মনের কথা কে জানে বাবা—স্ত্রীণাং চিত্তঞ্চ দুর্জ্ঞেয়ম—কার মন কোথায় মজে? এমন ধারা কথা শুনলে কার না রাগ হয়, বলো? কিন্তু আমি যেই রেগে যাব, অমনই ওরা আরও বলবে—ওই রান্নার ঠাকুরটার ওপর সৈরন্ধ্রীর একটু ইয়ে আছে—সমশঙ্কত মাং ত্বয়ি। তুমিই বলো, তোমার মতো একটা মানুষকেও যদি এই নরকে পড়ে থাকতে হয় যে নরক তৈরি করেছেন রাজা যুধিষ্ঠির, তবে আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কী? দ্রৌপদী অর্জুনের জন্যও ভীমের কাছে দুঃখ করলেন বিস্তর; নকুল-সহদেবও এই সময় তার বিলাপের পরিসর থেকে বাদ গেলেন না। এটা হয়তো ভীমের সামনেই ভীমকে ভোলানোর মতো কোনও স্বামী-সাম্যবাদ।

সব কথার পরে আবার তাঁর নিজের কথা এল। কত হীন কাজ তাঁকে করতে হয়, কেমন করে কত কষ্টে রাজপত্নী সুদেষ্ণার ঝিগিরি করতে হয়—সব বলে দ্রৌপদী ভীমের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগলেন। বার বার দুঃখের নিঃশ্বাস ছেড়ে, বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে দ্রৌপদী ভীমের হৃদয় যেন একেবারে ঘেঁটে তুললেন—হৃদয়ং ভীমসেনস্য ঘট্টয়ন্তীদমব্রবীৎ। দ্রৌপদী শেষ কথা বললেন এমনভাবে যাতে ভীমের পুরুষকারে আঘাত লাগে। বললেন—আমি হয়তো অনেক অপরাধ করেছি বিধাতার পায়ে, যার জন্য এখনও আমার মতো অভাগার মরণ নেই কপালে—অভাগ্যা যত্র জীবামি কর্তব্যে সতি পাণ্ডব।

দ্রৌপদীর মুখে এমন কষ্টের কথা শুনে ভীম আস্তে আস্তে দ্রৌপদীর হাত দুটি নিয়ে স্পর্শ করালেন নিজের গালে। চেঁচিয়ে উঠলেন নিজের ওপর ধিক্কারে—বৃথাই আমার বাহুবল, বৃথাই অর্জুনের গাণ্ডীব-টঙ্কার। নইলে তোমার যে হাত দুটি ছিল কোমল, রক্ত লাল, সেই হাতে আজ কাজ করে করে কড়া পড়েছে। ভীম হঠাৎ ক্রোধে উন্মত্ত হলেও এই মুহূর্তে ধৈর্য হারালেন না। যে যুধিষ্ঠিরকে দ্রৌপদী খুব করে গালাগালি দিয়েছেন, সেই যুধিষ্ঠিরের প্রসঙ্গ টেনে ভীম বললেন—যুধিষ্ঠির অজ্ঞাতবাসের অবসান প্রতীক্ষা করছেন দ্রৌপদী। নইলে সেইদিনই আমি লাথি মেরে কীচকের মাথাটা গুঁড়িয়ে দিতাম।

ভীম যতই রাগ করুন, সভার মধ্যে যুধিষ্ঠিরের সেই কটাক্ষপাত তিনি ভোলেননি। সরল মানুষ, অজ্ঞাতবাসের শেষ পর্যায়ে এসে তিনি সুস্থির যুধিষ্ঠিরের কথার মূল্য দিচ্ছেন বেশি। যে করেই হোক, এটা তাঁর মাথায় ঢুকেছে যে, কীচকের দৌরাত্ম্য সাময়িক। এই ঘটনাকে প্রাধান্য দিয়ে পাণ্ডবরা যদি লোকচক্ষে প্রকট হয়ে পড়েন, তবে যুধিষ্ঠির পুনরায় বারো বছরের বনবাসে যাবেন। তিনি কিছুতেই সত্যভ্রষ্ট হবেন না। দ্রৌপদীকে ভীম বোঝালেন—দ্যাখো, যাদের জন্য আজকে রাজ্যচ্যুত হয়ে দিশাহারার মতো ঘুরছি, সেই দুর্যোধন, দুঃশাসন শকুনি অথবা কর্ণের গলা যতক্ষণ না কাটতে পারছি, ততক্ষণ আমার মনের কাঁটা যাবে না। তুমি একটু ধৈর্য ধরো, অত রাগ কোরো না।

অজ্ঞাতবাসের শেষ পর্যায় থেকে যুদ্ধের উদ্যোগ-কাল পর্যন্ত ভীমকে আশ্চর্যভাবে মাথা ঠাণ্ডা করে চলতে দেখছি। এমন কী যে যুধিষ্ঠিরের ব্যাপারে তিনি সর্বক্ষণ দ্রৌপদীর সহমত পোষণ করেন, সেই যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে তিনি দ্রৌপদীকে বলছেন—এত রাগ কোরো না, প্রিয়া আমার। তুমি যুধিষ্ঠিরকে যেভাবে গালাগালি দিলে, এই গালাগালি যদি তাঁর কানে যায় তবে তিনি আত্মহত্যা করবেন, দ্রৌপদী।—শৃণুয়াদ্ যদি কল্যাণি নূনং জহ্যাৎ স জীবিতম্। দ্রৌপদীও বুঝলেন। বললেন—আমি যে কষ্ট পেয়েছি তাতে আমার মাথার ঠিক ছিল না ভীম—তাই অমন করে বলেছি। কিন্তু এটাও তো ভাবতে হবে যে, কীচক আমাকে নির্লজ্জভাবে কামনা করছে। সভার মধ্যে বিরাটের সামনে, যুধিষ্ঠিরের সামনে, এমন কী তোমার সামনেও সে আমাকে লাথি মারল। আবার তার সঙ্গে দেখা হলে, আমার দিক থেকে বাধা এলে, আবারও সে আমাকে মারবে—দর্শনে দর্শনে হন্যাৎ। কাজেই ভীম এর একটা বিহিত না করলেই নয়। দ্রৌপদী ভীমকে আবার চেতিয়ে তুললেন। বললেন—ভীম! জটাসুরের হাত থেকে তুমিই আমাকে বাঁচিয়েছ। ভাইদের সঙ্গে নিয়ে জয়দ্রথের হাত থেকেও তুমিই আমাকে বাঁচিয়েছ। আজ এই বিপদে কীচকেরও একটা ব্যবস্থা করো। যেমনি পাথরের ওপর বাড়ি মেরে কলসী ভাঙে, তেমনি কীচকের মাথাটাও তুমি ভেঙে গুঁড়িয়ে দাও। কীচক বেঁচে থাকতে কাল যদি সূর্য ওঠে, তবে জেনো আমি বিষ খেয়ে মরব। ভীম বুঝলেন—দ্রৌপদী শারীরিক এবং মানসিক দুই দিক দিয়েই বিপর্যস্ত। স্বাভাবিক অবস্থায় দ্রৌপদী কখনও এই ব্যবহার করেন না। ক্রন্দনরতা দ্রৌপদী ভীমের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন—ভীমস্যোরঃ সমাশ্রিতা। সান্ত্বনায়, সোহাগে ভরিয়ে দিয়ে ভীম আবারও জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। বললেন—ঠিক আছে। যেমনটি তুমি বলছ, তেমনটিই হবে। আজকের সন্ধ্যাবেলার মধ্যেই কীচককে আমি শেষ করে দেব। কথা দিলাম। তুমি কীচককে নিভৃত মিলনের লোভ দেখিয়ে নিয়ে এসো বিরাটরাজার নৃত্যগৃহে। দিনের বেলায় সেখানে নাচ গান হয় বটে কিন্তু রাতের বেলায় কেউ সেখানে থাকে না। সেখানে একটা বিছানাও পাতা আছে। আমি ওই বিছানাতে শুয়েই কীচককে তার মৃত পূর্বপুরুষদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।

যে রাত্রে দ্রৌপদী ভীমের সঙ্গে কথা বলে এলেন, তার পরদিন সকালেই কীচক এল দ্রৌপদীর সঙ্গে দেখা করতে। নিজের সম্বন্ধে নানা রকম দম্ভোক্তি করে সে আবারও দ্রৌপদীর কাছে তার কুপ্রস্তাব ব্যক্ত করল। যেন ভয় পেয়েছেন, যেন একটু গলে গেছেন—এই রকম একটা ভাব করে দ্রৌপদী কীচককে নিভৃত-মিলনের প্রস্তাব দিলেন বিরাটরাজার নৃত্যগৃহে। কীচক সানন্দে রাজি হল এবং সেই সন্ধ্যায় অপরূপ সাজে সেজে নাগরক-বৃত্তির সমস্ত সরসতা নিয়ে দ্রৌপদীর কাছে উপস্থিত হওয়ার তোড়জোড় আরম্ভ করল।

কীচকের সঙ্গে কথা সেরেই দ্রৌপদী আরও একবার ভীমের কাছে ছুটে গেছেন রান্নাঘরে। বলেছেন—সব ঠিক হয়ে গেছে। এবার শুধু কীচককে মেরে তুমি আবারও আমার চোখের জল মুছিয়ে দেবে—অশ্রুদুঃখাভিভূতায়া মম মার্জস্ব ভারত। দ্রৌপদী বাক্-বৈদগ্ধ্যে ভীম আর গতরাত্রের ভীম রইলেন না। দ্রৌপদী আত্মত্রাণের জন্য আর কোনও ভাইয়ের কাছেই যে যাচ্ছেন না, শুধু একান্তভাবে তাঁর ওপরেই নির্ভর করছেন—এই দুরূহ সৌভাগ্য তাঁকে এতটাই উচ্ছ্বসিত করে তুলল যে, ভীম তাঁর পূর্বরাত্রের সংযত প্রশান্তিটুকু ভুলেই গেলেন। তার ওপরে একটা দ্বন্দ্বযুদ্ধের সুযোগ পেয়ে—এবং সে যুদ্ধও শুধু দ্রৌপদীর জন্যই যেহেতু—ভীম একেবারে প্রগল্ভ হয়ে উঠলেন দ্রৌপদীর কাছে।

ভীম বললেন—হাতি দেখেছ দ্রৌপদী? হাতি যেমন পা দিয়ে বেল ফাটায়, ঠিক তেমন করেই আমি কীচকের মাথা ফাটাব। আমি হিড়িম্বকে মেরে যেমন হাতের সুখ করেছিলাম, সেই সুখই তুমি আজ আবার আমাকে এনে দিলে—সা মে প্রীতিঃ সমাখ্যাতা কীচকস্য সমাগমে। আজকে আমি তাকে শেষ করে ছাড়ব। যদি এ কাজ গুপ্তভাবে সম্পন্ন হয়, তো ভাল কথা। যদি না হয় তো প্রকাশ্যেই কীচককে মারব। তারপর দরকার হলে বিরাটরাজার সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। তারপর ফিরে যাব দেশে। সেখানে দুর্যোধনকে মেরে আমাদের রাজ্য কেড়ে নেব। থাকুন এখানে যুধিষ্ঠির, তিনি বসে বসে মৎস্যরাজ বিরাটের সেবা করুন—কামং মৎস্যমুপাস্তাং হি কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ।

কল্পনার যুদ্ধে ভীম অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছেন। দ্রৌপদীকে খুশি করার জন্য ভীম এখন যুধিষ্ঠিরকে ছাড়তেও রাজি। দ্রৌপদী দেখলেন—পাগলা ঘোড়া খেপেছে। যিনি আগের দিন যুধিষ্ঠির দুঃখ পাবেন বলে দ্রৌপদীকে পর্যন্ত শান্ত হতে বলেছেন, তিনি আজকে উলটো কথা বলছেন। দ্রৌপদী বুঝলেন—গতিক মোটেই সুবিধের নয়। ভীম যদি হুঙ্কারে-টঙ্কারে এমন কিছু করে বসেন, যাতে লোক-জানাজানি হয়ে তাদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যায়, তবে যুধিষ্ঠির, অর্জুন, কেউ তাঁকে ক্ষমা করবেন না। তখন পুরো ব্যাপারটা হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়াবে। দ্রৌপদী তাই ভীমের কাছে অনুনয় করে বললেন—না বাপু! তুমি গুপ্তভাবে লোকচক্ষুর আড়ালেই কাজটা সারো। আমার জন্য অজ্ঞাতবাসের শপথ নষ্ট কোরো না—নিগূঢ় স্ত্বং তথা বীর কীচকং বিনিপাতয়। ভীম স্বীকার করলেন—ঠিক আছে তাই হবে। যেমন তুমি বলবে, তাই করব—যথা ত্বং ভীরু ভাষসে।

সব ঠিকঠাক হয়ে রইল। সন্ধ্যাবেলায় নৃত্যপরা বালিকারা সব বিদায় নিয়েছে বিরাটের নৃত্যগৃহ থেকে। ভীম নিশ্চুপে শুয়ে রইলেন নৃত্যশালার সুসজ্জিত শয্যায়। সেজে-গুজে মাথায় মালা জড়িয়ে, গন্ধভরা চিনাংশুকের উত্তরীয় উড়িয়ে কীচক শয্যা-শায়িত ভীমকে স্পর্শ করল। কীচক ভীমরূপী মৃত্যুকে সম্বোধন করে বলল—সুন্দরী! বাড়ির সব মেয়েরাই আমার বসন-ভূষণ আর রূপের প্রশংসা করে। ভীম বললেন—তা যা বলেছ ; এমন স্পর্শসুখ আমি জীবনে অনুভব করিনি। ভীম এবার কীচকের চুলের মুঠি ধরে দ্বন্দ্বযুদ্ধ আরম্ভ করলেন। কীচকের শক্তি কম নয়, কিন্তু ভীমের শক্তি যেহেতু তার থেকে বেশি, অতএব লড়াই হল অনেকক্ষণ এবং যুদ্ধের পরিণতি ঘটল ভীমের অনুকূলে। যুদ্ধের অন্তকালে কীচক একটি গোলাকার মাংসপিণ্ডে পরিণত হল। তাকে দেখে মনে হল যেন একটা জলের কচ্ছপ ডাঙায় উঠেছে—কুর্মং স্থলে ইবোদ্ধৃতম্। ভীম দ্রৌপদীকে কীচকের অবস্থাটা দেখিয়ে রান্নাঘরে ফিরে গেলেন।

দ্রৌপদী প্রহরীদের খবর দিলেন সেই রাত্রেই। তারা মশাল জ্বালিয়ে কীচকের মৃত শরীর পরীক্ষা করল। মৃত কীচকের একশো ভাই উপকীচকেরা এসে লায়েক দাদার পরিণতি দেখে প্রথমে অনেক কাঁদল। তারপর এই অপঘাত-মৃত্যুর জন্য তারা দ্রৌপদীকেই দায়ী করে তাঁকে বেঁধে নিয়ে চলল শ্মশানে। তারা ঠিক করল—মৃত কীচকের সঙ্গে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে দ্রৌপদীকে। দ্রৌপদী চেঁচামেচি শুরু করলেন, স্বামীদের ছদ্মনাম ধরে ডাকতে আরম্ভ করলেন শ্মশানযাত্রার পথে। সেই আর্ত চিৎকার বিরাটের রান্নাঘরে পৌঁছল।

ভীম রান্নার ঠাকুরের সাজগোজ পালটে, খাটো ধুতি ফেলে দিয়ে একটা বারো হাতি কাপড় পরে—ততঃ স ব্যায়তং কৃত্বা বেশং বিপরিবর্ত্য চ—অপরিচিত রাস্তায় রাজধানীর প্রাচীর টপকে শ্মশানে পৌঁছলেন। সেখানে একটা শুকনো গাছ উপড়ে নিয়ে একটার পর একটা বাড়ি মেরে একশো-পাঁচ ভাই উপকীচকের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলেন। ফিরবার সময় দ্রৌপদীকে শুধু বললেন—যারা বিনা অপরাধে তোমার সঙ্গে এই রকম অসভ্যতা করে তাদের আমি এইভাবেই মারি,—এবং তে ভীরু বধ্যন্তে যে ত্বাং হিংসন্ত্যনাগসম্। ভীম বুঝিয়ে দিলেন ভবিষ্যতে দুর্যোধন-দুঃশাসনের ব্যাপারেও তিনি কথা রাখবেন। ভীম সঙ্গে সঙ্গে অন্য রাস্তায় পাকশালায় ফিরে গেলেন।

ভীম যে কাণ্ড করলেন, তাতে সৈরন্ধ্রীর গন্ধর্ব-স্বামী সম্বন্ধে একটা সার্বত্রিক ভয় ছড়িয়ে গেল বিরাটের রাজধানীতে। দ্রৌপদীর দিক থেকে ভীমের প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত রইল না। শ্মশান থেকে ফিরে চলার পথে জনসাধারণের ভীতত্রস্ত ভাব দেখতে দেখতে এক সময় তিনি রাজধানীতে ঢুকলেন। ঘরে ফেরার আগে তিনি ভীমের কাছে একবার না গিয়ে পারলেন না। কীচকের ঘটনা আরম্ভ হওয়ার সময় থেকে পঞ্চস্বামীর একতম ভীমকে তিনি যে ভাবে ভালবেসেছেন, যত তাঁর ওপর নির্ভর করেছেন—সেগুলি যে মিথ্যা নয়, সেটা বোঝাবার জন্যই যেন দ্রৌপদী আবারও গেলেন বিরাটের পাকশালায়। ভীমকে বললেন—আমাকে যে এমনি বিপদে বাঁচিয়েছে, আমার সেই গন্ধর্ব-রাজাকে নমস্কার—গন্ধর্বরাজায় নমো যেনাস্মি পরিমোক্ষিতা।

ভীম সব বোঝেন। দ্রৌপদীর এই উচ্ছ্বাস বাক্য—সে যত মধুরই লাগুক তাঁর কানে, যতই তা তাঁর আত্মতুষ্টির কারণ ঘটাক—তবুও ভীম জানেন—দ্রৌপদীর এই উচ্ছ্বাস-বাক্য যতখানি তাঁর কাজের পুরস্কার, যতখানি কৃতজ্ঞতা, প্রেম ততখানি নয়। ভীম জানেন—পঞ্চপাণ্ডবের একতম স্বামী হিসেবে যে ভালবাসা তাঁর প্রাপ্য ছিল, এ সে ভালবাসা নয়—‘মনে কি করেছ, বঁধু/ ও হাসি এতই মধু/ প্রেম না দিলেও চলে শুধু হাসি দিলে॥ তবু থাক, কৃতজ্ঞতা হলেও তা এত শুষ্ক নয় যা ভীমের অভিমান তুঙ্গে তুলে দিতে পারে। ভীম নিজে তাঁকে ভালবেসেই পরম তৃপ্ত, কিন্তু এইসব ‘শিভ্যালরি’র মুহূর্তে যখন প্রিয়তমা রমণী এসে বলে—নমস্কার গন্ধর্বরাজাকে, তখন কোথায় কোন অভিমানে যেন খোঁচা লাগে। ভীম বলে ওঠেন—না, না, সেসব কিছু নয়, আমি যা করেছি, তাতে তোমার বশম্বদ অন্য পাণ্ডব-পুরুষেরা এখন নিশ্চিন্ত বোধ করবেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে তাঁদের কিছু করণীয় ছিল বলে, তাঁরা যদি মনে মনে লজ্জিত হয়ে থাকেন, তবে আমি তাঁদের সেই লজ্জা নিবারণ করলাম মাত্র। তাঁরা এখন দায়মুক্ত বোধ করবেন, এর বেশি আর কী—তস্যাস্তে বচনং শ্রুত্বা অণৃনা বিচরন্ত্যুত।

কথাগুলির মধ্যে যে অভিমানই থাকুক, অন্তত ভীমের এই অভিমানটুকু যে মিথ্যে নয়, তার প্রমাণ—দ্রৌপদী ভীমের সঙ্গে দেখা করেই বিনা কারণে অর্জুনের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন এবং একটু মান-অভিমানের পালাও চালিয়ে গেছেন। ভীম যে বলেছিলেন—‘তোমার বশম্বদ অন্য পাণ্ডব-পুরুষেরা’—এই ইঙ্গিত হয়তো অর্জুনের দিকেই, যদিও উলটো ব্যঞ্জনায় অর্জুন দ্রৌপদীর বশম্বদ না হলেও, দ্রৌপদী যে তাঁরই বশম্বদ—সেটাই হয়তো ভীমের ইশারা।

আমরা ভীম এবং দ্রৌপদীর পরস্পর-সম্পর্কে পরে আবার আসব। আপাতত জানানো দরকার—কীচকের মতো বীর যোদ্ধার মৃত্যু এত অস্বাভাবিকভাবে হয়েছে বলে, একটা সন্দেহ কুরুরাজ্য পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। কুরুবৃদ্ধেরা কীচক-বধে কোনও একক বাহুবলের প্রমাণ দেখে ভীমের অবস্থান সম্পর্কে খানিকটা নিশ্চিন্তই হয়ে গিয়েছিলেন। মহাভারতে এ-কথা এত স্পষ্ট করে বলা না থাকলেও আদি নাট্যকার ভাস এই অনুমানটুকু কাজে লাগিয়েই তাঁর বিখ্যাত ‘পঞ্চরাত্র’ নাটক রচনা করেন। কীচকের মৃত্যুর পর ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা দুর্যোধনের সঙ্গে জোট বাঁধেন বিরাটরাজ্য আক্রমণ করার জন্য। বিরাটের গোশালা লুণ্ঠন করাটা দুর্যোধনের একটা চাল হলেও, তাঁর মনেও যে পাণ্ডবদের অবস্থান সম্পর্কে একটা সংশয় এবং অনুমান ছিল, এটা বোঝা দুরূহ নয়।

ঠিক হল, আক্রমণ হবে দুটো সেক্টরে। সুশর্মা আগে গিয়ে বিরাটের রাজ্য আক্রমণ করবেন এবং বিরাট যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে গেলেই কৌরবরা বিরাটের গোশালা আক্রমণ করবেন। কিন্তু যুদ্ধ এমন এক জিনিস, ভাবা যায় এক রকম, হয় আর এক রকম। সুশর্মা যে অসফল হবেন—এ তাঁর স্বপ্নেরও বাইরে ছিল। বিরাট যুদ্ধযাত্রায় বেরুলে তিনি নব-নিযুক্ত কর্মচারী ছদ্মবেশী যুধিষ্ঠির, ভীম এবং নকুল-সহদেবকেও সঙ্গে নিয়ে নেন। প্রথম দিকে এঁরা বিরাটরাজার পিছন-পিছনই যুদ্ধ করছিলেন। কিন্তু যে মুহূর্তে সুশর্মা বিরাটের অশ্ব, রথ, সারথি সব শেষ করে দিয়ে তাঁকে নিজের রথে তুলে নিলেন, সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠির ভীমকে নির্দেশ দিলেন বিরাটকে মুক্ত করার জন্য—এত কাল সুখ-বাসের প্রতিদান।

যুদ্ধ করার সুযোগ পেয়ে ভীম ভারী খুশি। বললেন—দাদা! সামনে যে সরল-সোজা গাছটা আছে, এটাই আমার গদার কাজ করবে। যুধিষ্ঠির বললেন—করো কী, করো কী? গাছ দিয়ে গদার কাজ সারলে লোকে তোমাকে সন্দেহ করবে, কারণ এমন অসাধারণ ক্ষমতা যে ভীম ছাড়া অন্য কারও নেই। লোকে তোমাকেই ভীম বলে বুঝে নেবে—জনাঃ সমববুধ্যেরন ভীমো’য়মিতি ভারত। তুমি ভাই গতানুগতিক ধনুর্বাণ, ঢাল-তলোয়ার নিয়েই যুদ্ধ করো। যেমন অন্য মানুষে করে, সেইভাবেই বিরাটকে ছাড়িয়ে আনো। ভীম গেলেন এবং একে তাকে মেরে-ধরে শেষ পর্যন্ত সুশর্মাকে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় বেঁধে নিয়ে এলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। ভীম মেরেই ফেলতেন সুশর্মাকে, কিন্তু সেই এক কথা—দয়ালু যুধিষ্ঠির তাঁকে ছেড়ে দিলেন। সুশর্মা বিরাটের দাসত্ব স্বীকার করে পালিয়ে বাঁচলেন।

এর পর বিরাটরাজ্যে আর একটি সাংঘাতিক যুদ্ধ হল। অর্জুনবেশী বৃহন্নলার সঙ্গে কৌরবদের যুদ্ধ। সে যুদ্ধে ভীমের কোনও অংশ নেই বটে, কিন্তু যুদ্ধ-জয়ের শেষে পাণ্ডবরা যখন আত্মপরিচয় দিয়ে রাজসভায় দাঁড়ালেন, তখন বিরাটরাজাকে আমরা ভীমের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে দেখছি—সুশর্মার হাত থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে আনার জন্য। বিরাটগৃহে অজ্ঞাতবাসের শেষেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধোদ্যোগ শুরু হয়ে গেল। বিরাটের বাড়িতে পাণ্ডব, যাদব, পাঞ্চাল, মৎস্যদের ‘মিটিং’ বসল। দ্রুপদের দৃত সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের সভায় গেলেন। ধৃতরাষ্ট্রের দৃত হয়ে পাণ্ডবদের কাছে এলেন সঞ্জয়। দেশ-বিদেশের রাজাদের কাছে দু-পক্ষ থেকেই চিঠি গেল পাণ্ডব-কৌরবের একতর পক্ষ অবলম্বনের অনুরোধ জানিয়ে। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল।